'যাহ! এবার?'অমলবন্ধু দুশ্চিন্তায় পড়লেন। মনে মনে বলেন, 'ইস আবার ভুল! হৈমন্তীদের বাড়ি থেকে বেরোবার আগে বাসভাড়াটা নেওয়া হয়নি তো!'এই ভয়টাই হচ্ছিল। অমলবাবু তবুও এপকেট-ওপকেট দেখেন, ব্যাগ হাতড়ান। যদি বাস ভাড়াটুকু….নাহ , কোন পকেটেই নেই… ইস, হৈমন্তীর বাবা অনেকবার বলেছিলেন, 'মাস্টারমশাই, এটা রাখুন যাবার সময় আবার তাড়াহুড়োয় যদি ভুলে যান…।'
তখন ইতস্তত না করলেই ভাল হত। যদিও পকেট বিলকুল ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় বেশ জন্য লজ্জিত বোধ করছিলেন। মুখ না তুলেই মাথা দুলিয়ে উত্তরে দিয়েছিলেন, 'ঠিক আছে, ঠিক আছে। যাবার সময় না হয়...'
--নেবেন কিন্তু মনে করে। ভুললেই মুশকিল।
--আচ্ছা, আচ্ছা। মনে থাকবে।
--বাবা, আপনি যা লাজুক, মনে নেবেন কিন্তু।
--হুঁ। এটুকু বলতেই কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল অমলবাবুর আর সেই ভুলটাই হল, নেওয়া হয়নি।
খুব সহজ একটা ব্যাপার ঘটেছে। অমলবাবুর পকেটে টাকা নেই। পকেটমারি হয়েছে এমন নয়। ফুরিয়ে গেছে তাও না। বরং কারণটা শুনলে অনেকেই হাসবে। অমলবাবু ভুলে গেছেন।
এমন ভুল আগেও হয়েছে, তখন ঝোলা হাতড়ে, বইয়ের ফাঁকে, কোথাও না কোথাও ঠিক পেয়ে গেছেন। আজ সেসব গুপ্ত জায়গাও বিশ্বঘাতকতা করেছে, একটাকাও নেই। কিন্তু এতটা পথ হেঁটে যাওয়াই তো মুশকিল। কাল পা মচকেছে, গোড়ালির ব্যথায় বেশ কাবু। না হলে কপাল ঠুকে হাঁটাই লাগাতেন।
আজ এই টাকার ব্যাপারে তিন তিনবার ফ্যাসাদে পড়লেন। অমলবাবুর ভাবগতিক বেশ ছন্নছাড়া। পোশাকআশাকে নজর নেই। আলমারি খুলে একটা যেকোন জামাকাপড় হাতের কাছে থাকলেই হল। ওই জামাপ্যান্টেই ইস্কুল। হয়ত আগের দিনই গিন্নি ইস্ত্রি করা জামাপ্যান্ট বের করে দিয়েছিল, মনেই নেই।
মানিব্যাগের বালাই নেই, টাকাপয়সাও হয় বুক-পকেটে, কিম্বা ঝোলায় বা বইয়ের ফাঁকে। গোলমাল এই জামাকাপড়েই হয়েছে। কালকের জামার পকেট টাকা রেখেছিলেন।
একবার ভাবলেন ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরবেন। পরক্ষণেই ভয় হল।
ট্যাক্সি চেপে ফ্ল্যাটে গিয়ে যদি দেখেন, গিন্নি জামাটামা ধুয়ে দিয়েছেন… আর টাকা পয়সা সব... তখন? গিন্নির যা ধোয়াধুয়ির বাতিক...
গড়বড় অনেকদিনই হয়েছে। আজকেরটা বেশ বাড়াবাড়ি, গড়িয়াহাট থেকে নাগেরবাজার, অনেকটা পথ। ব্যথা না থাকলে হয়ত চেষ্টা করা যেত, তবে আজ ২২১ ছাড়া গতি নেই। বাসটা নাগেরবাজার অবধি যায়। এঃ! বেজায় মুশকিল হল দেখছি।
একবার ভাবলেন, কনডাক্টরদের তো মুখ চেনা। বলে একবার দেখবেন? ‘ভাই, ….আজ টাকাটা না ... আনতে ভুলে গেছি, কাল নেবেন? এ পথেই রোজ যাতায়াত করি...গুলমোহরে নামি।’ না থাক বাবা, ফস করে যদি বলে,
--গ্যাস দেবেন না তো, পয়সা নেই ….নেবে যান।
তখন? লোকেরা তাকিয়ে দেখবে... ছাত্রছাত্রীও থাকতে পারে.. সঙ্গে মা-বাবা। পরদিন ইস্কুলে গিয়েই বলবে...জানিস...এবিসি কী করছে কাল ..! কেউ ওই নামে না চিনলেও নিকনেমটা বললে ফট করে বলবে ... গুলমোহর হাইয়ের? ওনাকে তো আমরা অ্যালফাবেট বলি, খুব চিনি, কী হয়েছে রে?…
অমলবাবু অবশ্য অ্যালফাবেট শুনলে রাগ করেন না। স্টুডেন্টরা অমন নিকনেম আকছার দেয়।
ওনারাও দিয়েছেন। সংস্কৃত পড়াতেন কার্তিকস্যার। নিকনেম ছিল, 'ঝঞ্ঝনাৎছৈল'...যা রেগে যেতেন, স্যারের ফর্সা মুখ, লাল টকটকে...
অমলবাবুর এ ভয়টাও হচ্ছে, কনডাক্টর যদি সবার সামনে বলে,
--মানুষদের মুখ দেখলেই চিনি, যান..যান.. এক্ষুনি নেবে যান। ঘন্টি বাজিয়ে বাস থামাবে.. ইঞ্জিন গোঁ গোঁ করবে। প্যাসেঞ্জাররাও হয়ত একসঙ্গে তেড়ে আসবে--
--পকেটে পয়সা নেই, চালাকি হচ্ছে? গায়ে তো কালারপ্লাস, সেটাও কী পয়সা না দিয়ে?
সত্যি বলতে কী, জামাটা গিন্নির কেনা, নেহাৎ কাল অচিন্ত্য কালারপ্লাস বলে ফাজলামিটা করল তাই নামটা জেনেছে।
ছি ছি। ও সব বলা যাবে না… আচ্ছা, কনডাক্টররা কি সত্যিই মুখ দেখে মানুষ
চিনতে পারে? তাহলে নিশ্চয়ই মনের কথাও জানে। অমলবন্ধু যে ঘুষের ভয়ে পালিয়ে এসেছে পাঁচ পাঁচটা সরকারি চাকরি থেকে, সেটাও নিশ্চয়ই ধরতে পারবে। ডিপার্টমেন্টের নাম শুনলে লোকেরা আজও অমলবন্ধুকে গাধা বলে। সে যাক গে, বহু লোকের ভুলভাল ধারণা আছে। অনেকেই বলেছে, 'কী বলছেন মশাই.. ওখানে চাকরি করতেন! উপরিতে লালে লাল...’
অমলবাবু মনে মনে বলেন, 'ভুল। আপনাদের ধারণা বিলকুল ভুল।'
অমলবন্ধুকে ওরা টিটকারি দেয়। বলে,
--বোকার হদ্দ, সোনার ডিম দেওয়া হাঁস ছেড়ে বেটা… আহাম্মক।'
অমলবাবু আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন, গুমটির দিকে...হঠাৎ চোখ পড়ল লোকটার দিকে…
আরে জয়ন্ত না? হ্যাঁ, হ্যাঁ জয়ন্তই তো! তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে, কাঁধে ঠোকা দেয়।
--কি রে জন্তু , তুই!
জন্তু নামের লোকটা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ঘাড় ফেরায়।
--কে?
--কে বলছিস মানে! ব্যাটা আমাকে চিনতে পারছিস না?
--না! কে আপনি?
থতমত খেয়ে যায় অমলবাবু। 'আরে আমি। অমল। অমল বন্ধু চ্যাটার্জি।'
--মনে করতে পারছি না।
--সে কিরে। তুই পল্লশ্রীতে পড়তিস না?
--না।
--না! তোদের বাড়িতে তুলসীমঞ্চ ছিল না?
--নাহ।
--মানে! রোজ দুপুরে স্নানের পর তোর ঠাকুমা তুলসীমঞ্চে জল দিতেন। গঙ্গামন্ত্র পড়তেন--
--ঠাকুমাকে আমি চোখেই দেখিনি।
--বাহ! তোর ফাজলামির স্বভাবটা এখনও যায়নি?
--ফাজলামি! মানে?
অমলের জেদ চেপে যায়। শংকরকে চিনতে ভুল হবে! ইস্কুলে শংকর মাত্র একবার 'বি' সেকশন ছিল, এইটে। নইলে বরাবর 'এ'...ভালো ক্যারিকেচার করত; লেখাপড়ায় তেমন আহামরি ছিলনা। তবে খুব রসিক। একবার টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়ল। তখন নাইন, ধীরেনস্যারের গার্ড ...
স্যার একেবারে নিপাট ভালো মানুষ। পিটি করাতেন। ফাইভে অঙ্ক নিতেন।
জয়ন্ত বলল, 'স্যার, আপনিও তো অঙ্ক করার সময় ছাত্রবন্ধু দেখে অঙ্ক করাতেন, ফাইভে... আমরা তো কিছু মনে করতাম না। হেডস্যারকেও বলিনি কখনও.. আজ আমাকে ধরে ফেললেন! এই একটা মাত্র প্রশ্ন, তাও চোতা করতে পারিনি...সবে বের করেছি। মা কালীর দিব্যি--'
জয়ন্তের কথায় সারা হলে হাসির রোল। স্যার কী ভেবে খাতা ফেরত দিলেন তক্ষুনি। তবে চোতা কি ফেরত দিয়েছিল? মনে পড়ছে না ...
--কিরে জয়ন্ত সব ভুলে গেলি?
--কোনটা বলছেন?
--কোনটা মানে? যা বলছি, তাতেই তো না করছিস।
--আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
--ভুল হচ্ছে!এসব কী বলছিস? তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলিস না?
--আমি আপনার বেস্টফ্রেন্ড, ইম্পসিবল!
এসব কী বলছে জয়ন্ত? অমলের এত ভুল হচ্ছে? পিলপিল করছে লোকজন। জায়গাটা ভিড়ে ভিড়াক্কার, গায়ের উপর পড়ছে। জয়ন্ত খানিকটা সরে গেল।
অমলও পেছনে পেছন এল। ইতস্তত করে, তবুও মরিয়া হয়ে বলল,
--দ্যাখ রাস্তায় সিন-ক্রিয়েট করিস না।
--আমি সিন-ক্রিয়েট করছি?আপনিই তখন থেকেই জয়ন্ত, জন্তু আরও হাবিজাবি বলছেন। কে জয়ন্ত?কে জন্তু?
অমলের নিজের মেমারির প্রতি আস্থা টলমল করে। গুলমোহর হাইয়ের অমল বন্ধু চ্যাটার্জি। স্টুডেন্টরা বলে এবিসি ডিকশনারী।
স্পেলকুইজ জিতেছিলেন ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট। তারপর স্টেট, ফার্স্ট-প্রাইজ। আবৃত্তিরও প্রাইজ ছিল বাঁধা । এখনও ঝরঝর করে বলে দেবেন। সঞ্চয়িতার যেকোন কবিতা। মনে ভেসে আসে আফ্রিকার লাইন 'উদ্ভ্রান্ত সেই… আদিম যুগে ...স্রষ্টা যখন…'
সামনের লোকটা জয়ন্ত মহাজন নয়? ওদের বাড়ি ছিল বিরাটিতে, মাধ্যমিকের পর যাদবপুর হাইস্কুলে ভর্তি হয়। বাবা যতীন মহাজন। তেজারতি আর বন্ধকীর ব্যবসা। একবার সোনা বন্ধক রাখা নিয়ে কী গোলমাল। সেই গোলমালের দিন ওদের ছাদে খেলছিল। নিচ থেকে চিৎকার, হইচই…
--জয়ন্ত, কিছু হয়েছে রে?
--দূর বাদ দে, ও সব বাবার কাস্টমার, রোজ ক্যাচাল।
--কেন?
--কেন আবার। বাবা কারচুপি করে।
--মানে?
--ধেৎ মাথামোটা। সোনা কষ্টিপাথরে ঘসে--
--কেন?
--কেন আবার? যাচাই করে আসল কী পান মেশানো।
--পান মানে?
--ভেজাল।
--লাভ কী?
--আরে বুদ্ধু। এটাতে সোনার গুঁড়ো ঝরিয়ে নেয়। কুঁচফল চিনিস?
--না তো।
--সোনা ওজন করতে লাগে। ছোট্ট লাল ফল, মাথার দিকে কালো টিপ। একটা রক্তকুঁচ বীজের ওজন, একরতি সোনা।
--এতে কী হয়?
--বন্ধকী সোনা ছাড়াতে এলে ফেরতের সময় ফলগুলো বাবা পাল্টে দেয়। ওজন কমে যায়, ফলগুলো তো সব দেখতে একই রকম। আনাড়ি হলে ধরতেই পারবি না।
জয়ন্ত কুঁচফল দেখিয়েছিল, আশ্চর্য সুন্দর...
সেদিন থানা পুলিশ হয়েছিল, এক মহিলার হার বন্ধক নিয়ে। মহিলা বন্ধক রেখেছিলেন সব মিলিয়ে ত্রিশভরি। ফেরতের সময় দেখা গেল ঊনত্রিশভরি। মহিলার কাছে কাঁচা রসিদ ছিল। ওজনে মিলছিল না।
মহিলা বেজায় চিৎকার করছিলেন, 'বাকি সোনা?'
--মানে?
--ত্রিশ লেখা আছে।
--না, ঊনত্রিশই ছিল।
--এই যে আমার কাছে লেখা। আঙটি, হার, দুল সব মিলিয়ে জমা-ওজন ত্রিশভরি।
--আমার কাছে তো ঊনত্রিশ লেখা।
--এক ভরি গেল কোথায়?
--গেল মানে?ওজন তো আপনি নিজে করেছেন। রসিদও আপনাকে দিয়ে লিখিয়েছি। এই দেখুন আপনার নিজের হাতে ওজন লেখা—ঊনত্রিশ।
--এটা আমার হাতের লেখা নয়। হাতের লেখা জাল, আপনি সোনা চুরি করছেন।
--এঃ ভারি তো ত্রিশভরি...আমাদের পাঁচপুরুষের কারবার। সোনা চুরি করে পাঁচপুরুষের ব্যবসা চলেনা।
--চলছে তো জালিয়াতি করেই।
যতীন মহাজন পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, 'আপনি জোচ্চোর। পয়সা কী সস্তা!’
সেকী গোলমাল... পুলিশ এল। সবাইকে থানায় নিয়ে যায়। এসব পরিষ্কার মনে আছে। ..ও জয়ন্ত মহাজন নয়?
--দ্যাখ, ইয়ে মানে ...দেখুন, আমার ভুল হচ্ছে কিনা আপনিই ভালো বলতে পারবেন?
--এ কথার অর্থ কী?লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে। আপনি অনেকক্ষণ ধরে হিজিবিজি বকে যাচ্ছেন। ‘আসল ধান্দাটা কী শুনি?'
অমলবন্ধুর কান ঝাঁ ঝাঁ করে। এমনভাবে লোকটা চেঁচামেচি করছে যে একটু একটু করে ভিড় বাড়ছিল।
--বলুন তো আপনার আসল উদ্দেশ্যটা কী? ইনিয়েবিনিয়ে নানান কায়দায়, আমার আস্থা অর্জন করতে চাইছেন। আমি বারবার না বলছি। আপনি কিন্তু একবারও পরিষ্কার বলেননি, কী চাইছেন?
বলাবাহুল্য অমলের বিড়ম্বনা ক্রমশ বাড়ছে। ছোটখাটো জটলার কলেবর বাড়তে সময় লাগবে না। খেয়াল করল আশেপাশের কৌতূহলী দৃষ্টি।
লোকটা ধমকের সুরে বলে, 'বলুন তো ঠিক করে। আপনার কী চাই?'
--না তেমন কিছু না।
--তেমন কিছু নয়, তাহলে এতক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করছিলেন কেন? বলুন।
--ইসে...ইয়ে মানে... আমার পকেট ফাঁকা। বাড়ি যাওয়ার ভাড়াটুকুও নেই। তাই ভেবেছিলাম আপনি যদি জয়ন্ত হন। দশটা টাকা ধার নেব।
--সরি।
--না না ঠিক আছে, অনেকদিন আগের কথা, আমারই হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছিল।
বিহ্বল অমলবন্ধু। জনস্রোতে মুখ লুকোতে পারলে বাঁচত। স্মৃতির তঞ্চকতায় পরিত্যক্ত চায়ের ভাঁড়ের মত গুঁড়িয়ে যাচ্ছেন… লজ্জায় দিশেহারা অমলবন্ধুর হতাশার প্রচণ্ড উত্তাপ অপ্রস্তুত করে দেয়। গলার কাছে কী একটা জমাট বেঁধে কঠিন--আটকে দিচ্ছে ফুসফুসের বাতাস। গুলমোহর হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক অমলবন্ধু চ্যাটার্জির নিজেকে বড় অসহায় লাগে। খেয়াল হল না সন্ধে গড়িয়ে গেছে। মুখের ভেতরটা তেতো, গলা শুকিয়ে কাঠ।
বিধ্বস্ত অমলবন্ধুর মনে পড়ে গতবছর ইস্কুলের বিজ্ঞান প্রদর্শনীর কথা। একছাত্র ওই প্রদর্শনীতে নিজের তৈরি করা মোবাইলের একটা অ্যাপ দেখাচ্ছিল, যা দিয়ে জানা যায় একই চেহারার মানুষ যদি পৃথিবীতে আরও কোথাও থাকে, তবে তাকে নিমেষেই খুঁজে বের করা যাবে।
দেখিয়েও দেয় শাহরুখ খান, শচীন তেন্ডুলকরের ডামিকে ...তারা নাকি ভারতেই আছে.. প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধীর ডামিও নিমেষে ভেসে উঠেছিল ওর মোবাইলে… হয়ত আজ জয়ন্ত বলে যে ভুলটা হল ...সেটা হয়ত এমনই একজন ...জয়ন্তের ডামি...নাহ...কাজটা খুবই অন্যায় হয়েছে….ইস্
অমলবন্ধুর মনেপড়ে, ইস্কুল, জয়ন্ত আর অমল ছিল হরিহর-আত্মা। বন্ধুরা খ্যাপাতো 'অজ' বলে। অমলের 'অ' আর জয়ন্তর 'জ'। বন্ধুরা ডাকত ছাগল।
মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষদিন। একে অন্যের জামায় ছবি আঁকল, নাম লিখল, সই করল। জয়ন্তর সেদিন কী কান্না, অমলবন্ধুরও চোখে জল। ইস্কুল ছাড়ার পরেও অনেকদিন যোগাযোগ ছিল।
সত্যি অমলেরই ভুল, উনি জয়ন্ত নন। ওর চেহারার জয়ন্তের ছায়া আছে। জয়ন্ত হলে বুকে ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়ত, এত ইমোশনাল হওয়াটা ঠিক হয়নি।
যা থাকে কপালে, বাস এসে গেছে। অমল বাসে ওঠে। শরীরে ঠান্ডা স্রোত বইছে। কনডাক্টরকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারেনি, সবাইয়ের সামনে ভাড়া চাইলে হাজার গলায় টিটকিরির কন্ঠ যদি চিৎকার করে, 'আসল ধান্ধাটা কী শুনি?'
কন্ডাক্টর দু'তিনবার কাছে এসে ঘুরেও গেছে। অমল ঘামছে। এই বাসে চেনা পরিচিত যদি কেউ থাকে, থাকতেই পারে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবে; টিকিট চাইলে বলবে, 'গুমটিতে নামব, করছি।'
কিন্তু তারপর গুমটিতে গিয়ে?
কন্ডাক্টরের হাত ধরে বলব, 'ভাই আমার কাছে একটুও টাকা নেই। বিশ্বাস করো, আমি রোজ এই বাসেই যাই। 'গুলমোহর হাই' স্কুলে পড়াই। কাল আপনাকে ডবল ভাড়া দেব। মিথ্যে বলছি না।'
যদি বলে, 'আগে বলেন নি কেন? বেশ ট্রিকস করে তো আসতে শিখেছেন?'
--না ভাই কোন ট্রিকস করছি না...আমি ভুল জামা পরে এসেছি। আজ এক ছাত্রীকে পড়াতে গেছিলাম। ওখানেও গড়বড় করেছি। ওদের বাড়ির নিচে কেকের দোকান আছে...
--এসব শুনে আমি কী করব?
--না মানে ওই দোকানে ...কেক খেয়ে দাম দিতে গিয়ে দেখি….পয়সা নেই। খুব লজ্জায় পড়ে ওনাকে বললাম, 'দাদা, এই বাড়িতে পড়াতে আসি তিনতলায়…'
--হ্যাঁ হ্যাঁ জানি, আপনি হৈমন্তীর মাস্টারমশাই। এরজন্য এত চিন্তা করছেন কেন! পরেরদিন দেবেন। ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়।
--ও আপনি কেকের দোকানেও জক দিয়ে খেয়েছেন। বাহ ভালো ট্যাকটিকস। দেখে তো এত ছ্যাঁচড়া মনে হয় না। শাল্লা যত্তো সব আলফাল লোক...মামার বাড়ির আবদার…
বাস ফাঁকা হয়ে যাবে আর কিছুক্ষণ পর। খ্যাচাৎ খ্যাচাৎ করতে করতে কনডাক্টর এগিয়ে এসে... ঘুরে গেল সামনে দিয়ে, কনডাক্টর কী ভুলে গেছে টিকিটের কথা!
নাহ। নিজে থেকেই বলে দেওয়া ভালো। এখন গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। নিজের মধ্যে জোর এনে কোনক্রমে বলল, 'ভাই আমার কাছে...ইয়ে কোন পয়সা নেই ...কাল আপনাকে দুটো টিকিটের দাম দিয়ে দেব। আমি গুলমোহর হাইস্কুলে পড়াই। বিশ্বাস করুন, কাল ঠিক দিয়ে দেব। এই রুটের বাসেই যাতায়াত করি। তোমাদের বাসের নম্বর তো …'
কন্ডাক্টর ঘোলাটে চোখে চেয়ে থাকে, 'ছেড়ে দিন, ভাড়া লাগবে না।'
--না না। আমি ঠিক দিয়ে দেব।
--লাগবে না। মালিক বারণ করেছে, আপনার থেকে ভাড়া নিতে।
--মালিক মানে? কে মালিক?
--ওই যে কেবিনে।
--মালিকের নাম কি?
--জয়ন্ত মহাজন।
জয়ন্ত! জয়ন্ত মহাজন। অমলবন্ধু সিট ছেড়ে ওঠে। চলন্ত বাসে এলোমেলো পা পড়ছে, টলতে টলতে কেবিন অবধি যায়। মুখ বাড়িয়ে ডাকল।'জয়ন্ত?'
--আরে অমল!
অমলবন্ধু উত্তেজিত, 'তুই রাস্তায় আমায় না চেনার ভান করলি কেন?'
মুখ দিয়ে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ে জয়ন্ত। 'দ্যাখ, ফট করে তো টাকা দেওয়া যায় না যাকে তাকে, ঘষে দেখছিলাম।
--ঘষে কী দেখছিলিস?
--এতবছর পর...তুই আসলে অমলই তো, না 'পান' মেশানো।
রাগে ফেটে পড়ে অমল। 'কী দেখলি?'
--দেখলাম, পান আছে, তবে কম। ভাড়া ন'টাকা, চাইলি দশটাকা। ফোকোটে কী এক টাকা দেওয়া যায়?