শান্তবাবুর অশান্ত হয়ে যাবার যথেষ্ট কারণ আছে। ওনার বস ঘোষসাহেব গতপরশু ডেকে বলেছেন যে শান্তবাবুর নামে অনেক কমপ্লেইন আছে। অফিসে সারা দিন উনি নাকি চেয়ারে বসে ঢুলছেন, মাঝে মাঝে আবার ঘুমিয়েও পড়ছেন। ভুলভাল ইংরেজি বানান আর ব্যাকরণ সমৃদ্ধ চিঠি ড্রাফট করে সাহেবের টেবিলে রেখে আসছেন। হিসেব-পত্রে সামান্য যোগ-বিয়োগও ভুল করে ফেলছেন। এমনই একটা চিঠির ড্রাফট পেয়ে ঘোষসাহেব বেজায় চটে গিয়ে শান্তবাবুকে ডেকে পাঠালেন।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কোনোদিন এতটুকুও আঁচড় পড়তে দেননি শান্তবাবু। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় ওনাকে নিজের ডেস্কে পাওয়া যায়। দুপুরে মাত্র দশ মিনিটে রুটি, আলুভাজা আর একটা ছানার মিষ্টি সহযোগে টিফিন সারেন। পাঁচটার পরেও কাজ থাকলে উনি রাগ না করেই অফিসে থেকে যান। সদাহাস্যময়, নির্ঝঞ্ঝাট এহেন শান্তবাবুর পরিবর্তনে ঘোষসাহেব একটু অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু অনেক দিনের পুরোনো বিশ্বস্ত কর্মচারী বলে একটু-আধটু ভুলচুক সব মেনে নিচ্ছিলেন। কিন্তু সেদিন চিঠির ড্রাফটা পড়েই চট করে মাথায় খুন চড়ে গেলেও উনি শান্তবাবুর স্বাস্থ্য নিয়েও একটু শঙ্কিত হলেন। এই বয়সে আবার নতুন করে কোনো নেশা-টেসার চক্করে পড়লেন কিনা সেটাও সাহেবের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।
“বসুন শান্তবাবু।"
ঘোষসাহেবের হিমশীতল গলা শান্তবাবুর অস্বস্তি একটু বাড়িয়ে দিল।
“শরীর ভালো তো?"
“ইয়েস স্যার।”
“বাড়ির সব খবর ভালো তো?"
“ইয়েস স্যার।”
“সবাই বলছিল আপনার শরীরটা ঠিক ভালো নেই। অফিসের চেয়ারে বসে প্রায়ই আপনাকে ঢুলতে দেখা যায়।”
“রাত্রে ঘুম হয় না স্যার আজকাল।”
"হোয়াই?"
“গিন্নির নাক ডাকার শব্দে সারারাত জেগে বসে থাকি। পঁয়তাল্লিশ পেরোনোর পরেই ও ধুমসো মোটা হয়ে গেল। ব্যাস রাত্রে স্টিম ইঞ্জিনের মতো নাক ডাকাও শুরু করে দিল।” শান্ত বাবু একটু আক্ষেপের সুরে বললেন।
“ডাক্তার দেখান। ই এন টি স্পেশালিস্ট।”
“গিন্নি আমার ডাক্তারের কাছে কিছুতেই যাবেনা। আসলে ও বিশ্বাসই করে না যে ও নাক ডাকে। আমিও কি আর জানতাম স্যার যে মেয়েরা এমন গাঁক গাঁক করে নাক ডাকে। এমন লক্ষ্মীশ্রী বউ যে আমার এত বিচ্ছিরি নাক ডাকবে সেটা আমি কল্পনাতে আনতে পারিনি। সব বাড়িতে কর্তারা দাপটে নাক ডাকায় আর গিন্নিরা কানে তুলো গুঁজে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে। আমার কেসটা একদম উল্টো হয়ে গেল স্যার।” শান্তবাবুর চোখ ছলছল করে উঠল।
“গিন্নি নাক ডাকাটা বেমালুম অস্বীকার কী করে করছে? জোর করে ডাক্তারের কাছে ধরে নিয়ে যান মশাই।”
“স্যার, মোবাইলে নাক ডাকা রেকর্ড করে শুনিয়েছি। তাও বিশ্বাস করছে না। বলছে সব নাকি ভাঁওতা। এখন ভিডিও তো তুলতে পারি না। লাইট জ্বালতে হবে। তাহলেই ঘুম ভেঙে যাবে আর তাতে নাক ডাকাও বন্ধ হয়ে যাবে।”
“এখন তো বয়েস হয়েছে। অন্য ঘরে গিয়ে শোন। রিটায়ার্মেন্টের পর আবার গিন্নির পাশে শোবেন। অবশ্য শুক্র, শনিবার চাইলে শুতে পারেন।”
শান্তবাবু সাহেবের চটুল রসিকতায় একটু লজ্জা পেলেন।
“দুটি তো মোটে ঘর। একটা ঘরে ছেলে থাকে। আমি রাত্রে কয়েকদিন সোফায় শুয়েছি, কিন্তু আমার আবার হাত পা না ছড়িয়ে শুলে ঘুম আসে না। ড্রইং রুমটা বড্ড ছোট। তার ওপর সোফা, টিভি, স্টিরিও সব গুঁজে গুঁজে রাখা। মেঝেতেও চাদর পেতে শোবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার স্ত্রীর নেওটা পোষ্য কিটক্যাট ওর জায়গা দখল পছন্দ করে না। আমার ঘাড়ের ওপর পেছন তুলে শুয়ে পড়ে। কুকুরের পিছন আমার মুখের সামনে। আপনিই চিন্তা করুন স্যার।”
“তাহলে এই সমস্যার সমাধান কী?” ঘোষসাহেব যেন একটু বিরক্ত।
“আপনিই একটা সমাধানের রাস্তা বাতলান স্যার। আপনি অভিজ্ঞ বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ।”শান্তবাবু কাতরকণ্ঠে অনুনয় বিনয় করলেন।
ঘোষসাহেব অকৃতদার নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। রোজ রাত্রে একটু হালকা দারু, বরফ সহযোগে গলায় টনিকের মতো ঢেলে, বিলায়েত খাঁ সাহেবের সেতার মোবাইলের ইউ টিউবে খুব আস্তে চালিয়ে উনি ওনার বিরাট বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। একঘুমে রাত্রি কাবার। সকালে উঠে উনি চাঙ্গা। আবার দ্বিগুণ উৎসাহে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টার বহুদিনের কাজের লোক মন্টু। একটা বড় লাইব্রেরি কাম অফিস রুম, দুটি শোবার ঘর, ড্রইং কাম ডাইনিং রুম, কিচেন,ব্যালকনি। নিউ অলিপুরে ওনার নিজস্ব রাজত্ব।
বছরের এই সময়টাতে অফিসে ট্যাক্সের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মগুলো হয়। আর সে কাজের আরো বেশ কয়েকজন থাকলেও একমাত্র আস্থাবান লোক শান্তবাবু। সেই শান্তবাবু কিনা অফিসে এসে চেয়ারে বসে রোজ ঢুলছেন। ট্যাক্স অডিটের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ভুলভাল করে ফেলছেন। আবার ওনার সমস্যাটাও ফেলনা নয়। একটা লোকের প্রতি রাত্রে বউয়ের নাক ডাকার শব্দে ঘুম না হলে দিনের বেলা তার প্রভাব তো কাজে পড়বেই।
“ফোনটা আপনার গিন্নিকে লাগান তো। আমি নিজে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার জন্য বলব।” ঘোষসাহেব অর্ডার করলেন।
দুরুদুরু বক্ষে শান্তবাবু বাড়ির নম্বরটা রিং করে গলায় মাখন লাগিয়ে কথোপকথন শুরু করলেন--
“মানু, ঘোষসাহেব মানে স্যার তোমার রোগটার ব্যাপারে একটু তোমার সাথে ইয়ে মানে কথা বলতে চান।”
"রোগ; কী রোগ। জন্মেও আমার কোনো রোগটোগ নেই। আর আমি কারুর সাথে কোনো কথাটথা বলতে পারব না। তোমার কথা থাকলে বলো, নাহলে রাখো।” মানু মানে শান্তবাবুর গিন্নি মিনতির গলায় ঝাঁজ।
“শোনো, শোনো। উনি তোমাকে ডাক্তার দেখাতে বলেছেন। আজ সন্ধ্যায় তাহলে চলো যাই।” শান্তবাবু অনুনয়ের সুরে বলেন।
“হ্যাঁ যাব আজ। কদিন ধরে হাঁটুর পিছনটা কেমন চিন চিনে ব্যথা ব্যথা করছে।”
মানুর কথায় কিছুটা যেন আশ্বস্ত হলেন শান্তবাবু। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। যাকগে এই সুযোগে নাক ডাকার সমস্যাটার কথাটাও ডাক্তারের কাছে শেষে পাড়া যাবে খন। ঘোষসাহেবও কিছুটা খুশি হলেন।
সন্ধ্যেবেলা ডাক্তারবাবুকে মানুর হাঁটু দেখানোর পর কিন্তু কিন্তু করে উনি নাক ডাকার সমস্যার কথাটা পেড়েই ফেললেন। মানু চটে কাঁই।
“চোপ, ডাক্তারের সামনে একদম বাজে কথা বলবে না।”
ছোকরা ডাক্তার দাম্পত্যকলহে মুচকি হাসলেন। সমাধানের পথটাও বাতলে দিলেন প্রাঞ্জলভাবে।
“যখনই দেখবেন চিত হয়ে শুয়ে বৌদি নাক ডাকছেন অমনি ঠেলে পাশ ঘুরিয়ে শুইয়ে দেবেন। নাক ডাকা দেখবেন নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে।”
এত সহজ সমাধান শান্তগিন্নির পছন্দ হল না।
বললেন, ”আমি পাশ ঘুরে বেশিক্ষণ শুতে পারি না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।”
ডাক্তারবাবুটি এক অদ্ভুত সমাধানের পথ বাতলালেন। গিন্নির পিঠের নিচে একটি টেনিসবল রাখতে হবে। যেই উনি চিত হয়ে শুতে যাবেন, বলটি পিঠে ফুটবে। উনি আবার ইচ্ছে না থাকলেও ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে শোবেন। ব্যাস, নাক ডাকা বন্ধ হবে।
শান্তবাবু বেজায় খুশি হলেও গিন্নি ডাক্তারের ওপর রেগে ফিরলেন। কিন্তু রাত অনেকটা হয়ে যাওয়ায় টেনিস বলটা সেদিন কেনা হল না। বাড়ি ফিরে ঝাঁ করে শান্তবাবুর মাথায় একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। স্ত্রীর আদরের কুকুর কিটক্যাট একটা টেনিস বল নিয়ে বিকেলে খেলে বেড়ায়। সেটাকেই উনি চুপি চুপি হাতসাফাই করে নিয়ে শুতে এলেন। হাঁটু ব্যথার জন্য একটু আধটু উঁহু উঁহু করেই গিন্নি নিদ্রা যেতেই ধীরে ধীরে নাক ডাকা শুরু হল। শান্তবাবু জানেন এটা আস্তে আস্তে উচ্চগ্রামে যাবে। উনি মানুকে দুহাত দিয়ে ঠেলে পাশ ফেরালেন। নাক ডাকাও তৎক্ষণাত বন্ধ হল। ঝেড়ে আনা কিটক্যাটের খেলার সাথী লাল টেনিস বলটিকে ঠিক মিনুর পিঠের নীচে বসিয়ে শান্তবাবু পরমানন্দে ঘুমিয়ে পড়লেন।
চারিদিকে অন্ধকারের মধ্যে নাক ডাকার বিকট শব্দে শান্তবাবুর কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল। উনি পাশে হাতড়িয়ে দেখলেন মানু চিত হয়ে শুয়ে নাক ডাকিয়ে যাচ্ছে। বলটা তাহলে কোথায় গেল? গিন্নির বিশাল বপুতে কি চাপা পড়ল? উনি মানুর পিঠের তলায় হাত ঢুকিয়ে পাগলের মতো বলটাকে হাতড়ে খুঁজতে লাগলেন। নাঃ, ওটা ওখানে নেই। পিঠে খোঁচাখুঁচিতে মানু জেগে উঠেছেন। চোখ বন্ধ করেই উনি শান্তবাবুকে আদুরে ধমক দিলেন, ”বুড়োবয়েসে কি ভীমরতি হল?"
"দুত্তরী।”বলে শান্তবাবু উঠে পড়লেন। বাথরুমে যাবার জন্য লাইট জ্বালাতেই দেখেন কিটক্যাট মুখে বলটা নিয়ে পিটপিট করে শান্তবাবুর দিকে 'কিরে কেমন জব্দ' ভাব করে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। মাঝরাতে ও বিছানায় উঠে কখন যে ওর সম্পত্তি নিয়ে এসেছে তা ওনারা বুঝতে পারেননি।
“আপনি বরং দিন পনেরো আমার বাড়িতেই রাত্রে থাকুন। ট্যাক্সের কাজগুলো হয়ে গেলে নাহয় আবার নিজের বাড়িতে ফিরে যাবেন।”ঘোষ সাহেবের প্রস্তাবে না করার ক্ষমতা শান্তবাবুর ছিল না। এছাড়া দায়বদ্ধতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। এই সময়ে কাজটা না উতরে দিলে চলে?
সেদিনই জ্বলন্ত চোখে মানুকে বিদায় জানিয়ে শান্তবাবু তল্পিতল্পা নিয়ে রাত্রে সাহেবের বাড়ি হাজির হলেন। রাত্রে খাওয়াদাওয়া ভালোই হলো। সাহেব কেবল একবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কোনো অসুবিধা হলে মন্টুকে বলবেন। ওই আমার গার্জেন। আপনি আমার পাশের ঘরে নিশ্চিন্তে দরজা খুলে ঘুমোন। মন্টু এই সামনের ড্রইং রুমে ঘুমোবে। ও ওখানেই চিরকাল ঘুমোয়।”
দু-একটা ফাইলে চোখ বুলিয়ে হিসেবপত্তরগুলো একটু দেখতে দেখতেই শান্তবাবুর দুচোখে যত রাজ্যের ঘুম যেন ভেঙে এল। রাত্রের না ঘুমোনোর জ্বালা কেবল ভুক্তভোগী মাত্রই বোঝে। রাতের পর রাত উনি জেগে কাটিয়েছেন। সেটা ম্যানেজ করতে অফিসে ঘুমিয়ে এই বুড়ো বয়সে বদনাম কুড়িয়েছেন। আজ সাহেবের বদান্যতায় ওনার বাড়িতেই নিশ্চিন্তে ঘুমোতে এসেছেন। সুন্দর স্বপ্নে বিভোর হয়ে উনি নিজের যৌবনবেলায় যেন ফিরে গেলেন। মানুর সঙ্গে দেখা করতে উনি ব্যান্ডেল থেকে ট্রেনে চড়ে উত্তরপাড়া স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে গঙ্গার ধরে বুড়োবটতলায় আসতেন। সপ্তাহে প্রায় তিনদিন।
নীলডুরে শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজে মানুকে যে কি ভালো লাগত সেটা মনে করে শান্তবাবুর হৃদয় আজ যেন বহুদিন পরে অশান্ত হয়ে উঠেছে। ট্রেনটা কিছুতেই থামছে না। উত্তরপাড়া আসার বেশ আগেই ট্রেনটা স্পিড যেন বাড়িয়ে দিল। স্টেশনে না থেমেই ছুটে চলল। উনি হায় হায় করে উঠলেন। ট্রেনের স্পিড উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। হাওড়াতেও এই ট্রেন থামবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড স্পীডে শেষ স্টেশন হাওড়াতে ট্রেনটা কাঠের স্টপারে বিকট শব্দে ধাক্কা মারছে এটা চিন্তা করেই স্বপ্নেও শান্তবাবু ঘামতে শুরু করলেন। লোকজন ভয়ে চিৎকার শুরু করেছে। মেয়েরা কান্না জুড়েছে। অনেকেই ট্রেন থেমে লাফানোর চেষ্টা করছে। ঘুমটা ভেঙে গেল। কিন্তু ট্রেনের আওয়াজটাতো বন্ধ হয়নি। নিউ অলিপুরের আশপাশে কোনো ট্রেন লাইন আছে বলে বাপের জন্মে উনি শোনেননি। হটাৎ মালুম হলো ট্রেনটা বাইরে নয়, ফ্লাটের ভিতরেই চলছে। ধড়মড় করে উঠে আধো নাইট ল্যাম্পের আলোয় শান্তবাবু ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন। ড্রইং রুম আর ঘোষ সাহেবের রুম থেকে দুটো মেইল ট্রেনের প্রচণ্ড আওয়াজ ভেসে আসছে। দুটো ট্রেন যেন একে অপরকে পাল্লা দিয়ে হুইসেল দিতে দিতে মত্ত হাতির মতো ছুটে চলেছে। সে তুলনায় মানু তো নেহাত গেদে লোকাল। শান্তবাবু উফ্ফ বলে ঘরে ঢুকে সপাটে দরজাটা বন্ধ করলেন।