• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৪ | অক্টোবর ২০২১ | গল্প
    Share
  • অস্তরাগ : মলয় সরকার


    —হ্যাঁরে কমলি, তোর মনে আছে, তুই কবে থেকে আমার বাড়িতে আসছিস? কতদিন হল?

    —তা আর মনে নেই দিদি--তা ধরো না, বুল্টুর কত বয়স হল—

    —বুল্টু এই পঁচিশ পেরিয়ে ছাব্বিশে পড়ছে।

    —তাহলে আমারও হল ওই প্রায় পঁচিশ বছর। বুল্টু যখন প্রায় এক বছরেরটি তখন তোমার অসুখ করল। তুমি তো প্রায় শয্যাশায়ী। তখনই তো আমি এলাম। তোমার মনে আছে দিদি? বুল্টু তো আমার কাছে কিছুতেই আসবে না। খুব কাঁদত। আর ওদিকে ডাক্তার তোমার ওঠা-হাঁটা বন্ধ করে দিয়েছে। সে কি কষ্ট। তারপর ধীরে ধীরে ও যখন চিনতে শিখল, তবে একটু স্বস্তি হল।

    —সে আর মনে নেই! সেবার যা কঠিন অসুখে পড়েছিলাম--তুই না এলে হয় বুল্টু থাকত না হয় আমি। সেবার ডাক্তারের কথায় জোর করে কর্তা খোঁজাখুঁজি শুরু করল। তাই তোকে পেয়ে সে যাত্রা বেঁচে গেলাম। যাক, করছিস কি এখন?

    —এই বাসন কটা ধুয়েই আসছি।

    —আয়, একটু বসে চা খাই।

    —যাই--

    কমলি, যার সঙ্গে তার মনিব শান্তাদির কথাবার্তা হচ্ছে, তার আসল নাম কমলা। সে-ও অভ্যস্ত ওই কমলি নামে--আজ পঁচিশ বছর ধরে শুনে আসছে তো। ওর নিজের বয়সও নয় নয় করে প্রায় পঞ্চাশ হল। যখন এ বাড়িতে ঢুকেছিল তখন ওর ছেলেও ছোট তবে বুল্টুর থেকে বছর তিনেকের বড়। তারপর ওই বুল্টুকে মায়ের দায়িত্ব নিয়ে কোলে করে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে রান্নাবান্নার যাবতীয় কাজ করা-- এক কথায় গোটা বাড়িটাই মাথায় করে রেখেছে কমলা। শান্তাদির বরকে, ও ডাকে দাদা বলে। সেই সুবাদে ভাইফোঁটায় ফোঁটা দেওয়া থেকে দাদার জন্মদিনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে খেতে দিয়ে, সাধ্যমত উপহার দেওয়া পর্যন্ত-- একেবারে নিজের বাড়ির লোকের মত হয়ে গেছে। হঠাৎ কেউ বাড়িতে এলে বুঝতেই পারবে না যে কাজের লোক কি বাড়ির লোক। জামাকাপড়ও… শান্তাদি, নিজের একটা শাড়ি কিনলে ওরও একটা কেনেন এবং তাও মোটেই খেলো নয়, বরং বেশ ভালই। শান্তা বলেন, লোকে আমার বাড়ি এসে যখন কমলিকে দেখবে, তখন, ও যদি খারাপ নোংরা কাপড় পরে লোকের সামনে যায়, তখন লোকে তো আমারই বদনাম করবে। আর তাছাড়া সারাদিন আমার ঘরে থাকে, আমার ঘরের একটা সম্মানবোধ নেই? ওটা চলবে না।

    তাই পুজোই হোক কি নতুন বছরই হোক, বাড়ির সবার সঙ্গে কমলারও জামাকাপড় হবে। শুধু ওরই নয় ওর ছেলেরও হবে--এটাই চলে আসছে এতদিন।

    শান্তা এবাড়ির গিন্নী, বুল্টু তাঁর একমাত্র ছেলে। আপাতত সে পড়া শেষ করে সদ্য বিয়ে করেছে কিছুদিন আগে। এখন বউ নিয়ে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিস্কোতে। ছেলে খুবই ভাল--রোজ মা-বাবার খোঁজ নেয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাবা-মায়ের জন্য এটা-সেটা পাঠায় আর মাঝে মাঝে জেদ ধরে, তোমরা ঘুরে যাও এখান থেকে। শান্তা আর বুল্টুর বাবা ঘুরেও এসেছেন কয়েকবার, বিদেশে ছেলের কাছ থেকে।

    কমলা বা কমলি ওনার, কাজের লোক বলি কাজের লোক; বন্ধু বলি বন্ধু; আবার আপদেবিপদে পরামর্শদাতাও বটে।

    কমলা এসে বসে দিদির পাশে। দুজনেরই হাতে চায়ের কাপ।

    —এই সময় মনটা একটু চা চা করে, বুঝলি।

    —তা যা বলেছ দিদি। তোমার সঙ্গে থেকে থেকে আমারও যেন কেমন নেশায় পেয়েছে। এই চা খাওয়ার ছুতো করে একটু না বসলে ইঞ্জিন যেন আর চলতে চায় না।

    —ঠিক বলেছিস রে কমলি। দেখতে দেখতে আমরা যেন কেমন বুড়ো হয়ে গেলাম। মনে হয় এইতো সেদিন, নতুন বউ হয়ে এলাম। এটা করব সেটা করব, এটা কিনছি ওটা সাজাচ্ছি। সব কেমন যেন পুরনো হয়ে গেল, না রে?

    —হ্যাঁ দিদি, তাইতো। এখন হাতেপায়ে বাত ধরেছে। দেখো, যখন তোমার বাড়িতে প্রথম আসি, একা মানুষ তো, বলো, বুল্টুকে সামলেছি, তোমাকে সেবা করেছি, রান্নাঘর পরিষ্কার করে রান্না। তবে তো বেলায় লক্ষ্মীর-মা ঘর ঝাড়ু দিতে আসত। আর এখন, উঠতে-বসতে হাত-পা কটকট করে। বেশি কাজ করলে হাঁপ লাগে—

    —হ্যাঁ, তাইতো বলছি রে, তখন কত কাজ করেছি। ভাবলেই কেমন লাগে। তা, তোর ছেলে-বউয়ের খবর কি?

    —ওদের কথা আর বোলো না তো। বউটা একেবারে ছোটলোকের ঘরের মেয়ে। আমার ছেলেটা এত খারাপ ছিল না, সে তো তোমরাও দেখেছ। বউটা এসেই একেবারে তাকে বশ করে নিল দিদি। এখন বউ ছেলেকে বলে কি না, তোমার মাকে আমি দেখতে পারব না। আর ছেলেও এমন ভেড়া, দিদি, কি বলব তোমাকে। বলতে পারলি না, তোমার মা যে এসে থাকছে মাসের মধ্যে পনেরো দিন, সে বেলা কি হয়! জামাইয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে। ওই বউ এসেই আমার সুখের সংসারে আগুন ধরাল দিদি।

    চোখে জল এসে যায় কমলার।

    সেদিন বিকেলে শান্তা কমলাকে বলেন, আজ সন্ধ্যায় একটু আমার সঙ্গে বাজার যাবি কমলি?

    —কেন যাব না দিদি। কোন দোকানে যাবে, কি কিনবে?

    —কিছু শাড়ি আর দু-একটা জামাকাপড় কিনব। ওই নতুন যে রূপালী বস্ত্রালয় হয়েছে ওখানে।

    —ওখানে যেও না দিদি, ওখানে কিছু নেই। আমার বোন কাল ঘুরে এসেছে। তুমি ঘোষ বস্ত্রালয়েই চল, যেখানে বরাবর কিনি।

    সব কাপড়জামা কেনার পর শান্তা দেখলেন কমলা একটা বাচ্চাদের জামার দিকে তাকিয়ে আছে। উনি বুঝলেন ওর মনের কথা। সেটি কমলার নাতির মাপের। শান্তা জামাটি কিনতে চাইলেন। ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন, এটা পছন্দ?

    কমলা আপত্তি জানাল, কিনতে হবে না।

    অনেক জোর করাতেও ওকে রাজি করানো গেল না।

    বাইরে এসে জানাল, ঠাকুমার দেওয়া জামা ওর মা পরতে দেবে না দিদি।

    চোখে জল এসে গেল কমলার। শান্তা ওকে আর আঘাত দিতে চাইলেন না। কতখানি অতৃপ্ত বাৎসল্যরসে যে কমলা ডুবে আছে তা আর তাঁর কাছে গোপন রইল না।

    কমলা অনেকদিন কাজ করছে শান্তার কাছে, তা ঠিক, কিন্তু এখন আর পারে না। বসলে উঠতে পারে না, উঠলে বসতে পারে না। একটু তাড়াতাড়ি কাজ করার থাকলে ও হাঁপিয়ে যায়। এখন কর্তারও অফিস নেই। বাড়ির তাড়া নেই কোন, সংসারটা চলছে যেন গড়িয়ে গড়িয়ে চাকায় তেল না থাকা গাড়ির মত। কিন্তু তাও যেন চলতে চায় না। এখন এক কাপ চা করতে বললেই কমলি হাঁপিয়ে ওঠে। মোটাও হয়েছে অস্বাভাবিক। ডাক্তার দেখাচ্ছে, ওষুধ খাচ্ছে, তবু কিছুই যেন হচ্ছে না।

    সকালে চা খেতে বসেন দুজনে, শান্তা আর কর্তা। কর্তার সঙ্গে কথা বলার এটাই যা সময়। তখনও কমলা এসে পৌঁছয় না। দিনের এই প্রথম চা-টা শান্তা নিজেই করেন। তা না হলে কর্তার মেজাজ খোলে না। ফোনটা তখনই করেছিল বুল্টু। প্রায়ই এই সময়ে ফোন করে ও। একথা সেকথায় বলছিল, তোমরা এবার আমাদের এখানে এসে থাকো, বয়স হচ্ছে--আর একা থাকা উচিত নয়।

    তাতে শান্তার মত নেই। এখানের পরিচিত পরিবেশ, নিজের বাড়ি, গাছপালা ছেড়ে বেশিদিন কোথাও থাকতে চান না দুজনেই। অনেক কথা চালাচালির পর শেষে বলেছে, একান্তই যদি ওখানে থাকবে, তবে কমলামাসির বদলে অন্য লোক দেখো। কমলামাসিকে দিয়ে আর হবে না। ওরও বয়স হয়েছে, নড়তেচড়তে সময় যায়। একজন কমবয়েসি চটপটে কাজের কাউকে রাখো, যাতে সব কাজ করতে পারে। তাতে বেশি টাকা লাগলে আমি দেব।

    কথাটা দু একবার শান্তার মনের কোণে কখনও আসেনি তা নয় তবে স্থায়ী হয়নি। বিকেলের অস্তসূর্যের পাশে সিঁদুরে মেঘের মত দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেছে। টাকাটা বড় কথা নয় কিন্তু কমলাকে ছাড়ার কথা শান্তা ভাবতেই পারেন না। আবার ওকে দিয়ে যে আর কাজ পাওয়া যাবে না সেটাও যে অসত্য নয়, সেটাও বোঝেন শান্তা। আজকে বুল্টু আবার সেই কথা বলায় মনটা আবার চিন্তায়, দোটানায় পড়ল। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। ওকে রেখে আগামী দিনে কাজ পাওয়া যাবে না সেটাও যেমন সত্যি, আবার এতদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গীর জায়গায় নতুন কাউকে ভাবতেও মন চায় না।

    কমলা ঘরে এসে দেখে শান্তা একটু চিন্তিত মনে রেলিং-এ ভর দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

    —কি এত ভাবছো দিদি?

    —না,কিছু না এমনি--

    —মুখ কিন্তু তোমার তা বলছে নাতো। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। ফোন এসেছিল কারও?

    —হ্যাঁ বুল্টু ফোন করেছিল।

    —কি বলল? চিন্তার ব্যাপার কিছু?

    —না, তেমন কিছু না; ছেলে আমার খুব চিন্তিত, মা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বলে--

    —বুল্টু তোমার সোনার টুকরো ছেলে দিদি, মা-বাবার কথা কত ভাবে-- তা ভালই তো। আমার ছেলের মত নয়। ওরা ভাল থাকুক দিদি--

    —না, ও আজ একটা কথা বলছিল, তাই ভাবছি।

    —কি কথা?

    —ও তো যেতে বলছে।

    শান্তা আসল কথাটা কিছুতেই সোজাসুজি বলতে পারছেন না।

    —যাও না ঘুরে এসো। ভালই তো। অনেকদিন কোথাও বেরোওনি। ছেলে-বউমার সাথে দেখাও হয়ে যাবে, মনটাও ভাল হবে।

    —না না, আমি এখন যাচ্ছি না। বলে দিয়েছি। ছেলে বলছে, তাহলে কাজের একটা ভাল লোক রাখতে যে কমবয়েসি আর চটপটে হবে--

    এক নিঃশ্বাসে কথাটা শেষে বলেই ফেললেন শান্তা, অনেক দোনামনা করে, অনেক চেষ্টা আর মনের সঙ্গে লড়াই করে।

    কথাটা শুনেই হঠাৎ চুপ করে গেল কমলা।

    তারপর অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে ধরা গলায় বলল, তাই রাখো দিদি। আমি আর কাজ করতে পারি না। বুল্টু ঠিকই বলেছে। তুমি--

    বলতে বলতে চোখে জল এসে বাকরূদ্ধ হয়ে গেল কমলার।

    শান্তা পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, আঁচলের খুঁটে চোখ মুছছে কমলা।

    —কি হল, তুই কাঁদছিস কেন?

    —না দিদি, ও কিছু নয়। তুমি দেখো, অন্য কাউকে। আমিও এবার বিশ্রাম নিই।

    মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ফেলল কমলা। অবরুদ্ধ কান্নার বাষ্প যেন বুক ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। আগে থেকে একটা আন্দাজ থাকলেও, এই ঘটনার সামনাসামনি মুখোমুখি হওয়াটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। চুপ করে থাকতে পারলেন না শান্তাও।

    হঠাৎ এসে জড়িয়ে ধরলেন কমলাকে। তাঁর চোখেও অশ্রুর বান ডাকল। দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘরের নিভৃতে এক অশ্রুর বন্যায় ভেসে গেলেন এবং এক অদ্ভুত নাটকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে উঠল।

    কমলা বলে উঠল, জীবনের শেষ দিনগুলো তোমাদের ছেড়ে আর কোথাও যেতে পারব না দিদি। আমার ছেলে বউ ঘর--কিছু থেকেও নেই, তোমাদের বাড়িই আমার সব--। আমি আর কোথাও যেতে পারব না দিদি--

    —তোকে ছেড়ে আমিও থাকতে পারব না রে কমলি--কাকে নিয়ে এতদিন পর থাকব আমি? তোকে ছেড়ে আবার কোনও নতুন মানুষকে আর আপন করতে পারব না রে---

    শান্তাও ভেসে গেলেন আবেগের স্রোতে।

    জীবনের শেষপাদে এসে মনিব-দাসী সম্পর্কের বাইরে এক মানবিক স্বর্গীয় বন্ধুত্বের যে দৃশ্যের অবতারণা হল তার নীরব সাক্ষী থাকল শুধু বাতাস আর ঘরের চার দেওয়াল।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments