[গৌরচন্দ্রিকাঃ আমরা লাদাখ গিয়েছিলাম ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে। দমদম থেকে উড়ানযাত্রায় শ্রীনগর, মাঝে কেবল দিল্লিতে একটু দম নেওয়া। শ্রীনগরে দুটো রাত কাটিয়ে স্থলপথে কারগিল হয়ে লেহ-লাদাখ। তখনও ছিল সেটা কাশ্মীর রাজ্যের অঙ্গ। ইতিমধ্যে রাজনীতির খেলায় প্রশাসনিক ওলটপালট, কাশ্মীর থেকে লাদাখকে ছিঁড়ে নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। এটা উল্লেখ করতে হয় বলেই করা, নচেৎ আমার এই কাহিনিতে তার অন্য কোনো তাৎপর্য নেই।এই কাহিনিতে শ্রীনগরের দুটো দিন উহ্য রেখে দিলাম। ডাল লেক, রকমারি বাগ, হজরতবাল দর্শনের ভুরি ভুরি কাহিনি ছড়িয়ে আছে পাতায়-পর্দায়। আমি আলাদা কিছু শোনাতে পারব না বলে এই সিদ্ধান্ত। কাশ্মীরের অন্য অঞ্চলগুলো আমাদের ভ্রমণসূচির মধ্যে ছিল না।
আর পাঁচটা ভ্রমণকাহিনির মতো লিখতে না চেয়ে আমি একটু পাগলামি করে ফেলেছি। ডিগবাজি দিয়ে শুরু হয়েছে লেখাটা, মানে শেষ থেকে শুরুর দিকে এগিয়েছে। বাকি যা পাগলামি আছে সেটা আগে থেকে না বলে দেওয়াই ভালো।]
ভারতের পশ্চিম-ঘেঁষা উত্তরতম প্রান্তের কারগিল, সিয়াচেন ও লাদাখ সীমান্তের পার্বত্য এলাকা জয় করে সম্প্রতি ফিরে এল জলঘড়ি পরিবারের এগারো জন প্রাচীন যুবক-যুবতীর একটি টিম। সঙ্গে দ্বাদশ ব্যক্তি হিসাবে ছিল এক নবীন বালক। উপক্রমণিকা হিসাবে টিমের এই বারো জনের ভূমিকা-বর্ণন দিয়ে এই লেখা শুরু করছি। বাকি কর্মকাণ্ড ক্রমশ প্রকাশিত হবে।
প্রথমেই ধরছি দ্বাদশ ব্যক্তিটিকে। বয়সে নবীন হলেও প্রবীণদের মতো হট্টগোলে নয় এই স্থিতধী বালক। মাঠে নামার সুযোগ না পেয়ে ক্যামেরায় প্রকৃতি এবং টিম-সদস্যদের কেরামতি নিঃশব্দে ধরে রাখছিল সে। তার প্রতি আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। কারণ, একটা সময়ে সিগারেট ফুরিয়ে যাওয়ায় আমার দমও ফুরিয়ে আসছিল। এদিকে জায়গাটা হল নুব্রা ভ্যালির দিকসিট। সেটি আবার ধূমপান-মুক্ত শহর, সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ। সেই সংকটকালে অন্যান্য টিম-সদস্যদের সহর্ষ অসহযোগিতায় আমি যখন দগ্ধ হচ্ছি, তখন সে-ই আমার পরিত্রাতা হয়ে সম্পূর্ণ একার উদ্যোগে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল সাত কিলোমিটার দূরের হান্দর মিলিটারি ক্যান্টিনে। সেখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সিগারেট সংগ্রহ করে সে আমার দম রক্ষা করে। এই দ্বাদশ খেলুড়ের নামটি নিয়ে শেষ তক খানিক ধন্দ থেকেই গেল। টিমের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক খেলুড়ে তার কাকির সৌজন্যে তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছিল, যেমন গোগো, গোগলা, ঘোগা ইত্যাদি। আমি তেমন দুর্মুখ নই বলে তার নাম দিয়েছি পল গগ্যাঁ।
টিমের দুই ক্যাপ্টেন—অশোক এবং আশিস। সম্মুখভাগের দায়িত্বে অশোক এবং পশ্চাৎভাগের দায়িত্বে আশিস। কেন্দ্রমণি স্বাগতা ম্যাডাম। শক্তিসাধন পালাক্রমে শ্যাডো করে যাচ্ছে এক একজন সতীর্থকে। সদাচঞ্চল তৃপ্তিতনু ভেসে ভেসে জোয়ান(ই) সাপ্লাই করে যাচ্ছে খেলুড়েদের। শ্যামল সারা মাঠ জুড়ে ছুটতে ছুটতে এনার্জি জুগিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেককে। তারই মধ্যে কিছুটা ম্লান প্রান্তিক তিন খেলুড়ে নূপুর, বীথিকা এবং পুতুল। তাদের মলিনতা ঠিক-বেঠিক ড্রিবলিং-এ পুষিয়ে দিচ্ছে বুবুদি। একাদশতম খেলুড়ে গোঁসাই-এর ভূমিকাই একমাত্র অনুমান-অনির্ভর—কখনও হ্যাটট্রিক তো কখনও সেমসাইড।
শেষ পর্যন্ত যে ফাইনালে উঠে ট্রফি নিয়ে আসতে পারল টিম তার পেছনে আছে স্বাগতা ম্যাডামের ভোকাল টনিক, শ্যামলের ফিজিওগিরি, অশোকের তৎপরতা এবং আশিসের ম্যানেজারি। তবে ম্যানেজার মাঝে মাঝেই নিজের পায়ে বল রেখে ‘বল কোথায় বল কোথায়’ বলে হইচই ফেলে দিচ্ছিল।
উপক্রমণিকা এখানেই সমাপ্ত। এবার এই অভিযানের শেষ থেকে আরম্ভ করে শুরু পর্যন্ত শুনিয়ে দেব।
শুভানুধ্যায়ীদের যাবতীয় সতর্কবাণীকে কলা দেখিয়ে আমরা সেই ৪ তারিখ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ড্যাং ড্যাং করে দিব্যি রংবেরঙের রুক্ষ পাহাড়ের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে চলেছি। ইতিমধ্যে ১৮ হাজারি খারদুংলাতে অবলীলায় প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়েছি। শ্বাসকষ্টজনিত অস্বস্তি তেমন টের পাইনি। অবশ্য টিমের ফিজিও শ্যামল নিয়মিত কর্পূর, গোলমরিচ ইত্যাদি বিবিধ অনুপানে আমাদের চাঙ্গা করে রেখেছিল আর কনিষ্ঠমতি শক্তি তরলায়িত হয়ে এর-তার পিছনে লেগে সবাইকে চাগিয়ে রাখছিল। সেসব কথা এখানে বেশি বললে কথার খেলাপ হবে। কারণ আমার এই লেখা শেষ থেকে শুরুর উলটো স্রোতে বইবে বলে কথা দিয়েছি।
এই সোমারিরিতে পৌঁছেই কিন্তু আমাদের সকলেরই একটা কেমন অস্বস্তি শুরু হয়েছিল। পাঁচটার সময় বেরিয়ে লেকের ধারে ঘণ্টাখানেক ঘুরলাম ঠিকই, কিন্তু সূর্যালোক মেঘের আড়ালে চলে যাওয়ায় লেকের জলের বর্ণচ্ছটা দেখার সৌভাগ্য হল না। ওদিকে আবার প্রায় পনেরো হাজার উচ্চতায় ঝড়ো হাওয়ার চোটে ঠান্ডাটাও জাঁকালো। অগত্যা আমরা এখানকার সবে ধন নীলমণি লেক ভিউ হোটেলটিতে ফিরে শ্যামলের ঘরে জমাটি আড্ডা বসালাম। আড্ডা শেষে খাওয়াদাওয়া সেরে সন্ধে দশটাতেই যে যার ঘরে ঢুকে লেপের তলায়। সন্ধে বললাম, কারণ সমগ্র লাদাখেই অর্কদেব বিদায় নিতে এমন গড়িমসি করেন যে আঁধার হতে আটটা বেজে যায়।
শুয়ে পড়েও যে খুব স্বস্তিতে ছিলাম তেমন নয়। আমার ঘরের বিবরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। আমি শারীরিক অস্বস্তি কাটাতে নাক-মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানছিলাম। আর আমার তিনি বলছিলেন, বুকটা কেমন ধক ধক করছে। আমি তখন আমার ছেড়ে রাখা প্যান্টের পকেট থেকে কর্পূর জড়ানো রুমাল বের করে তাকে শুঁকতে বললাম। পরে জানতে পারি ঘরে ঘরে অল্পবিস্তর একই জিনিস ঘটছিল। এমন সময় হোটেলের সিঁড়িতে এবং করিডোরে বহু মানুষের পদশব্দ এবং ভয়ার্ত গলার আওয়াজ শোনা গেল। ঘরের দরজা খুলে প্রথম বেরিয়ে আসে অশোক। দেখে দশ বারো জন তরুণ ভীতবিহ্বল হয়ে পায়চারি করছে। কেউ কেউ মাথায় হাত চেপে করিডোরের মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়েছে। যেচে গিয়ে লোকদের সাহায্য করা অশোকের আজন্মলালিত রোগ। এখানেও তার ব্যত্যয় হল না। তাদের কাছে গিয়ে বলল,—তোমাদের কি শারীরিক কিছু অসুবিধা হচ্ছে? হলে বলো, আমাদের সঙ্গে একজন চিকিৎসক আছেন।
তারা দিশা হারানো নাবিকের মতো অশোককে আঁকড়ে ধরল। সকলেই এক কর্পোরেট সংস্থার কর্মী। অফিসেরই পৃষ্ঠপোষকতায় তারা মানালি থেকে লেহ-এর পথে মোটর সাইকেল অভিযানে বেরিয়েছে। সো-মারিরিতে ঢুকে সকলেই অল্পবিস্তর অসুস্থ বোধ করতে থাকে। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছিল তার। কোনোরকমে তাকে হোটেলে এনে তার গায়ের পোশাক খুলে বিছানায় শুইয়ে রেখেছে। সে এখন অজ্ঞান। অক্সিজেনের অভাব কিনা তারা বুঝতে পারছে না। তাদের কাছে অক্সিজেন পাউচ সহ ফার্স্ট এইড কিট আছে। কিন্তু সেই আকস্মিক বিপর্যয়ে তাদের মাথা এমনই ঘুলিয়ে গেছে যে পাউচ খুলতেই পারেনি।
অশোক তখন শ্যামলের ঘর থেকে তাকে তুলে নিয়ে আসে। তাকে নিয়ে অসুস্থ ছেলেটির ঘরে যায়। শ্যামল তাকে পরীক্ষা করে দেখে তার পালস নেই। চোখের পাতা টেনে টর্চ দিয়ে দেখে চোখের তারা স্থির। বার বার পরীক্ষা করে সে নিঃসংশয় হয় ২৭ বছরের চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী ছেলেটির দেহে প্রাণ নেই। শ্যামলের মাথা নাড়া দেখে সকলের চোখে অবিশ্বাস, তারা মেনে নিতে পারছে না সেই আকস্মিক মৃত্যু। অবিলম্বে মিলিটারি হাসপাতালে তার দেহ নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েও সহজে রেহাই পায়নি শ্যামল। আধ ঘণ্টা ছাড়া ছাড়া তারা এসে তার ঘরে হানা দিয়েছে। ব্যথা কারুর বুকে, কারুর মাথায়। বন্ধুবিচ্ছেদের বেদনাকে ছাড়িয়ে গেছে তাদের ব্যক্তিগত ত্রাস। শ্যামল তার ভাঁড়ারে থাকা ওষুধপত্র উজাড় করে তাদের বিলিয়ে দিয়ে সম্ভবত আশ্বাসক্রিয়ায় (প্লেসিবো এফেক্ট) তাদের নিরাময়ের চেষ্টা করে গেছে।
Tso শব্দের অর্থ ‘হ্রদ’, Mariri শব্দের অর্থ ‘মৃতদের’। দুয়ে মিলে সোমারিরি অর্থাৎ মৃতদের হ্রদ। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস এই হ্রদে বাস করেন মৃত মানুষের আত্মাগণ। সুদূর অঞ্চলের কোনো এক অপেক্ষমাণ মায়ের কোল খালি করে তাঁর তরুণ পুত্রের আত্মাটিকে এই হ্রদে রেখে যাওয়ার অমোচনীয় বেদনাকে বুকে নিয়ে পরদিন ভোরবেলায় সো-মারিরি ছেড়ে চলে এলাম আমরা।
প্রথম তিন দিন বাদ দিলে অভিযানের বাকি আট দিন আমাদের টিম লাদাখের রাজধানী লেহ-কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ময়দানে খেলে বেড়িয়েছে। মোট তেরো দিনের মধ্যে দু’দিন গেছে আসা-যাওয়ায়। সর্বশেষ ময়দান ছিল সো-মারিরি। সেখানে জয়ী হয়ে ফিরে এলেও সেই খেলা ছিল এক আকস্মিক মৃত্যুর ছায়া-মলিনতায় নিস্প্রভ।
বিষাদের স্মৃতিকে চাপা দিতে এবার পেছনে ফেরা যাক নুব্রা উপত্যকার রোদ-ঝলমলে দিন দুটিতে। লাদাখ পার্বত্যাঞ্চলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাইলের পর মাইল রুক্ষ-রঙিন পাহাড়ের মাঝে মাঝে এক খণ্ড করে সবুজ গালচে পাতা উপত্যকা। পাহাড়ি ঝরনাগুলি হল এই সব গালচের সঞ্জীবনী। বরফ-গলা জলের এই ঝরনাগুলিই সিন্ধু নদকে ভরভরন্ত করে রাখে। নুব্রা নিঃসন্দেহে এই উপত্যকাদের রানি।
খেতে গিয়ে এক খুচরো বিপত্তি। আমাদের টিমে কয়েকজন নিরামিষাশী আছে। তারা আবার বিভিন্ন শ্রেণির। নিরামিষাশীদের পুরোভাগে স্বাগতা ম্যাডাম। তিনি একেবারে নৈকষ্য কুলীন, তাঁর পাতে পেঁয়াজও অচল। তাঁরই অনুগামিনী বুবুদি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পেঁয়াজ-সচল গোঁসাই। তৃতীয় শ্রেণিতে দুই বারীয় নিরামিষ—নূপুর এবং শ্যামল। নূপুর সাতটি বারের মধ্যে পাঁচটিকেই জনগণের কল্যাণার্থে বিবিধ দেবতাকে উৎসর্গ করে দিয়ে দুটি মাত্র বারে আমিষ আহার নিজের বরাদ্দে রেখেছে। তার বিপ্রতীপে শ্যামল দুটি বার তার পেসেন্টদের কল্যাণকামনায় উৎসর্গ করে পাঁচটি বার নিজের আমিষ আহারের জন্যে রেখে দিয়েছে। ফলে মাঠে নেমেও তাদের বারের হিসেব মাথায় রাখতে হয়। তো খেতে গিয়ে স্বাগতা ম্যডাম আবিষ্কার করলেন সর্বঘটে পেঁয়াজ! খিদের মুখে এ হেন বিভ্রাট কারই বা সহ্য হয়? খাপ্পা ম্যাডাম স্বঘরে প্রস্থান করলেন। পেঁয়াজ অপেক্ষা উপোষ মহান। ম্যানেজার আশিস অবশ্য তৎক্ষণাৎ ম্যানেজ করল। হোটেলের রাঁধুনিকে দিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই তিনটে পেঁয়াজহীন পদ তৈরি করিয়ে ম্যাডামের ক্রোধ ও ক্ষুধার যুগপৎ উপশম ঘটাল।
দিকসিট বিহারের দিকে যাত্রা করতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেল। সেখানে পুরো ম্যাচ খেলার দম ছিল না টিমের। টেম্পো ট্র্যাভেলারে ছয় ঘণ্টার জার্নি, পেটে ভাত। অতএব বিশাল বুদ্ধমূর্তি দর্শন আর সুউচ্চ বিহার থেকে সিন্ধু-সঙ্গিনী সায়ক নদী অবলোকন করে প্যাভিলিয়নে ফেরত আসতে হল।
ফিরেই সিগারেট-সংকটে গোঁসাই। সেই আখ্যান আগেই উগরে দেওয়া হয়েছে। সামান্য সংযোজন দরকার, নইলে টিমের দুই ক্যাপ্টেনের প্রতি অবিচার করা হবে। পল গগ্যাঁ মূল পরিত্রাতা হলেও, দুই ক্যাপ্টেন গোঁসাইকে সাহায্য করার লোক-দেখানো চেষ্টা দু-রকমভাবে দিয়েছিল; অশোক পল এবং গোঁসাই-এর পিছু পিছু গিয়ে তাদের ভাড়া-করা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠেছিল। তার গোপন মতলব সম্ভবত ছিল আমরা কত টাকা গাড়িভাড়া দিয়ে কত টাকার সিগারেট কিনলাম তা জেনে নিয়ে টীকাটিপ্পনী ঝাড়া। আর আশিস রাস্তায় দাঁড়িয়ে পথচলতি মানুষের মধ্যে ধূমপায়ী ঠোঁট শনাক্ত করার চেষ্টায় ছিল। শেষ পর্যন্ত সঠিক অনুমানে ধরেছিল একজনকে। তার পকেট থেকে এক গণ্ডা বিড়ি বাজেয়াপ্ত করে সেগুলি রেখে দিয়েছিল গোঁসাই-এর জন্যে। ততক্ষণে অবশ্য তার তেষ্টা মিটে গিয়েছিল।
স্যান্ড ডিউনে আপেল বাগান ছাড়াও অন্য একটি বিস্ময় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। হোটেলের একটি অংশে নির্মাণ-কাজ চলছিল। খবরে প্রকাশ পেল, সেই রাজমিস্ত্রিরা মুর্শিদাবাদী, জঙ্গিপুর কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক আমাদের শক্তিবাবুর খোদ ছাত্র। শক্তিবাবুর পড়ানোর গুণে এ হেন উচ্চতায় (প্রায় বারো হাজার ফুট) তারা উঠতে পেরেছে জেনে আমাদের ছাতি ফুলে গেল।
ভোরবেলায় টিমের ঘুম ভাঙতে দেরি হওয়ার প্রশ্নই নেই। কারণ, পাখি ডাকার আগেই স্বাগতা ম্যাডাম ডেকে ওঠেন। হোটেলশুদ্ধু জেগে ওঠে সেই ডাকে। ১০ আগস্ট নুব্রা ভ্যালি সূর্যের মুখ দেখার আগেই জেগে উঠল। আমাদের টিম রওনা দেবে সিয়াচেন সীমান্তের তৃতীয় বিন্দু (থার্ড পয়েন্ট)-র উদ্দেশে। জায়গার নাম তুরতুক।
বারান্দায় বেরিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে হোটেল-মালকিনকে লক্ষ করছিলাম। বয়স্কা বৌদ্ধ মহিলা। স্বল্পবাক। ভোরবেলাতেই পরম মমতায় বাগানের গাছগুলিকে পরিচর্যা করলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর একটা বাকেট হাতে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন যখন, তখন তাঁর হাতের বাকেট ফেনায়িত দুধে ভরভরন্ত। বলা বাহুল্য, চমরি গাই-এর দুধ। প্রাচীন পল্লী-গার্হস্থ্য আর আধুনিক পর্যটন-শিল্পকে অবলীলায় মিলিয়ে দিয়েছেন মহিলা। তাঁর যোগ্য দোসর তাঁর স্বামী। শুভ্রকেশ, সটান চেহারার মানুষটির প্রসন্ন মুখের হাসি দেখলে এবং আন্তরিক কণ্ঠের পরিশীলিত সম্ভাষণ শুনলে চোখ ও কান জুড়িয়ে যাবে সকলের। হোটেলের পাকশালায় বাজারের সবজি ঢোকে না। হোটেল-সংলগ্ন ক্ষেতে দেদার সবজি ফলছে তাঁর তত্ত্বাবধানে।
সাতটা বাজার একটু পরেই যাত্রা করে সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম তুরতুকে। রাস্তার দৃশ্য একই রকম। কারাকোরাম পর্বতমালার রুক্ষ-রঙিন গা বেয়ে সর্পিল রাস্তায় ওঠানামা, মাঝেমধ্যে এক টুকরো হরিয়াল উপত্যকা আর নিয়ম করে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তরে একটি করে সেনা-ছাউনি। সেগুলি আবার পাহাড়ের রঙে রঙ মিলিয়ে চিত্রিত করা, শত্রুর নজর ফাঁকি দিতেই বোধ হয়। নুব্রা ভ্যালির প্রান্তে একটি বেশ বড়ো আকারের সেনা-বিমানের অবতরণ-ক্ষেত্র পেরিয়ে এসেছি আমরা।
তুরতুক একটি ছোটো গঞ্জ মতো এলাকা। রাস্তার পাশ দিয়ে একটি বেগবতী স্রোতস্বিনী সগর্জনে বয়ে চলেছে। তুরতুকের সেনা-ক্যাম্পে আমাদের পরিচয়পত্র জমা দেওয়ার পর প্রত্যেককে রীতিমতো তল্লাশি করে সীমান্তের দিকে আমাদের এগোনোর নির্দেশ দিলেন তাঁরা। সীমান্তের তৃতীয় বিন্দু আরও প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। সেখানে ট্যুরিস্টদের জন্যে মঞ্চ সাজিয়ে বসে আছেন এক সেনা-প্রহরী-কাম-গাইড। এক একটি দলকে জড়ো করে তিনি পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত স্বীয় এবং শত্রু পক্ষের বাঙ্কারের অবস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছেন তারপর তাদের মঞ্চের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন সেসব প্রত্যক্ষ করার জন্যে। মঞ্চে হলুদ এবং লাল রঙের ছয়খানা বাঁশের সরু নল তাক করা আছে ছয়খানা পাহাড়চূড়ার দিকে। লাল নল তাক করা চূড়াগুলিতে পাকিস্তানি বাঙ্কার, হলুদ নল তাক করা চূড়াগুলিতে ভারতীয় বাঙ্কার। পর্যটকরা একে একে সেই নলে এক-চোখ লাগিয়ে নয়ন সার্থক করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। হিসেব করে যারা বাইনকুলার নিয়ে গেছেন তাঁরা অধিক উল্লসিত। ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈন্যরা যে-যার বাঙ্কারে বসে একে অন্যের দিকে বন্দুক তাক করে বসে আছে চব্বিশ ঘণ্টা, বারো মাস। শীতের প্রাক্কালে যে দল বাঙ্কারে যাবে তাদের বরফ-সমাধি না হলে নেমে আসবে ছ’মাস বাদে। গ্রীষ্মের ক’মাস শীতের সঞ্চয়কল্পে তাদের রসদ নিয়ে সমানে চুড়োয় উঠে চলেছে রাসভ ও খচ্চরবাহিনী। বিবীক্ষণধারী পর্যটকদের চোখে এই সৈনিকরা কেবলই দেশপ্রেমিক, মানুষটানুস নয়। সিয়াচেনের ন্যাড়া পাহাড় আগলানোর জন্যে কেমন অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে এরা—শত্রুর গুলিতে কদাচিৎ, বেশির ভাগই প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝায়। এর আগে কারগিল সীমান্তেও একই দৃশ্য দেখে এসেছি আমরা।
তৃতীয় বিন্দুর সৈনিক-বেড়া ডিঙিয়ে কিলোমিটার খানেক এগিয়ে গেলে একটি হরিয়ালি গ্রাম। তুরতুক নয়, সেই থাঙ নামের গ্রামটিই ভারতের শেষ গ্রাম। টিমের কেউ তো নয়ই, সেনাপ্রহরীটিও টের পায়নি, গোঁসাই কখন মঞ্চ টপকে থাঙ গ্রামটির দিকে এগিয়ে গেছে হাঁটতে হাঁটতে। প্রহরীটি সম্ভবত তখন অন্য একদল ট্যুরিস্টকে বাঙ্কারের মহিমা বোঝাতে ব্যস্ত ছিল। একটি বড়ো পাথরের আড়ালে গোঁসাই-এর অবয়ব ঢাকা পড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত টিম তার উদ্দেশ্যে যথেষ্ট কটুকাটব্য বর্ষণ করেও ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিল না। তাকে লাল কার্ড দেখানোই সাব্যস্ত হয়েছিল। শেষতক পল গগ্যাঁ তার ক্যামেরার শক্তিশালী লেন্সে ধরে রাখা গোঁসাই-এর গতিবিধি দেখানোর পর এবং সে আর অধিক অগ্রসর না হয়ে ফিরে আসায় তাকে হলুদ কার্ড দেখিয়েই ক্ষান্তি দেওয়া হয়। স্মর্তব্য, ভারতীয় বাঙ্কারের দিকে তাক করা বাঁশের নলও হলুদ রঙের। গোঁসাই-এর অখুশি হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।
তুরতুকে ফিরে এসে এক দ্বিতল রেস্তোরাঁয় টিমের যে-যার পছন্দমতো লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া হল। তিনখানা নিরামিষ লাঞ্চ প্যাকেট অবশ্য সানডিউন সকালেই তৈরি করে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিল। স্বাগতা ম্যাডাম, বুবুদি এবং গোঁসাই সেগুলিকে অবিলম্বে সাবাড় করল আর বাকিরা হাঁ করে বসে রইল কখন তাদের খাবার রেডি হবে সেই অপেক্ষায়। সেই অবসরে স্বাগতা-বুবুদি কখন যে বেরিয়ে গিয়ে নির্ঝরিণীর মাথার উপর কাঠের সাঁকোয় উঠে পড়েছে গোঁসাই টের পায়নি। পেল যখন, তখন আর সাঁকোর পথ খুঁজে পায় না। শেষে আন্দাজ করে ঘুরপথে গিয়ে সে পৌঁছে যায় একটি মেয়েদের স্কুলে। আপেলের মতো সুন্দরী এক স্কুলবালিকা গোঁসাই-এর নাবালক-সুলভ চলাফেরা দেখে পরম করুণায় তার হাত ধরে তাকে পৌঁছে দেয় সাঁকোর মুখে। সাঁকোর ওপারে এক বেওয়ারিশ অ্যাপ্রিকট বাগান। তার তলায় যেন লাল জাজিম পাতা। পাকা অ্যাপ্রিকটের জাজিম। দুই সখি সেই জাজিম থেকে বেছে বেছে অ্যাপ্রিকট তুলে শাড়ির আঁচল ভরছিল। গোঁসাইকে দেখেই আদেশ হল সেগুলি ব্যাগে ভরে ঝোরায় নেমে ধুয়ে আনার। গোঁসাই-এর পূর্বপুরুষ-সুলভ চলাফেরা দেখেই ভরসা হয়েছিল তাদের। অগত্যা পাথর বেয়ে ঝোরায় নেমে বরফ-শীতল জলে হাত ডুবিয়ে আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করে তবে গোঁসাই রেহাই পায়।
তুরতুক থেকে নুব্রা ভ্যালি রওনা দিতে প্রায় তিনটে বাজল। সাড়ে ছটায় সেনা বিমানক্ষেত্র পেরিয়ে গিয়েই আমাদের গাড়ি মূল রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়ল বাঁ-দিকের কাঁচা পথে। সরু পথের দুপাশে বাবলা-জাতীয় গাছের ঘন জঙ্গল। প্রথমে বাবলাই ভেবেছিলাম। পরে ভালো করে লক্ষ করতেই দেখা গেল, বাবলার মতোই ছোটো ছোটো পাতা হলেও এরা কাঁটাবিহীন। শ্রীনগর থেকে ৬ আগস্ট ভোরে বেরিয়ে কারগিল হয়ে লাদাখ এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছি—গাছ যা চোখে পড়ছে চেনার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমাদের ড্রাইভার বা স্থানীয় মানুষদের তেমন সাহায্য পাচ্ছি না। এখানে বড় গাছ বলতে উইলো আর এক ধরনের পপলার গাছের প্রাচুর্য। স্থানীয় লোকেরা এই সরলবর্গীয় পপলার গাছটিকে বলেন সবেদা। আগাছা-জাতীয় কিছু গুল্মকে বাদ দিলে বাকি থাকে কেবল আপেল, অ্যাপ্রিকট আর এই বাবলা-জাতীয় গাছ। হতে পারে জুনিপার, নিশ্চিত নই একেবারেই।
টিমের দুর্দশার তখনও অনেক বাকি ছিল। উটগুলি আরোহী নিয়ে ফিরে আসার পর একটা দারুণ দৃশ্যের সাক্ষী হল দল। উট-মায়েরা যখন আরোহীদের নিয়ে দূরে চলে যাচ্ছিল, তখন তাদের বাছাদের ছাউনিতেই রেখে দেওয়া হচ্ছিল। তারা যে মায়েদের চোখে হারায় সেই দৃশ্যই প্রত্যক্ষ করা গেল তারা ফিরে আসতেই। আরোহীরা পিঠ থেকে নামার আগেই তারা ‘ম্যায়া ম্যায়া’ রবে ডাক ছেড়ে ছুটে গেল যে-যার মায়ের কাছে। মা এবং ছা উভয়েই পুনর্মিলনের আকুলতায় আরোহীদের নেমে আসার পথে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বসল। আমরা মগ্ন হয়ে তা-ই দেখছিলাম, হঠাৎ-ই হু-হু করে ছুটে এল মরু-ঝড়। সঙ্গে সঙ্গে সারা দেহে বালির চাবুক। এদিকে অন্ধকারও নেমে আসছে দ্রুত। আমরা এলোমেলো পদক্ষেপে এগোতে লাগলাম গাড়ির দিকে। ততক্ষণে নাকে-মুখে-চোখে এবং পোশাকের ভেতরে বালির রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। দাঁত কিরকির করছে, চোখ করকর, দৃষ্টি অন্ধপ্রায়।
সান ডিউনে পৌঁছে নিজের ঘরের দিকে এগোচ্ছি, দেখি এক সুবেশ, সুদেহী মহিলা, হোটেলেরই অতিথি, নিবিষ্ট মনে অ্যাপ্রিকট কুড়োচ্ছেন। আমাকে দেখেই উষ্ণ হাসিতে মুখ ভরিয়ে অ্যাপ্রিকট-ভরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,—খাবেন?
আমাকে লোভ সংবরণ করতে হল। সেই মুহূর্তে সুস্বাদু ফলটিকে গলাধঃকরণ করতে গেলে এক রাশ বালিও তার সঙ্গে পেটে যাবে। সুন্দরীকে প্রত্যাখ্যান করার বেদনা নিয়েই চটপট স্নানঘরে ঢুকে পড়তে হল।
প্যাঙ্গমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা তাঁবুতে। তাঁবুতে ঢুকেই আমাদের চোখ ট্যারা হয়ে গেল। তার অভ্যন্তরে চার-তারা বন্দোবস্ত। বাথরুম নেহাতই কিঞ্চিৎ নড়বড়ে, তাই একটি তারা খসিয়ে রাখলাম। চটপট লাঞ্চ সেরে নিয়ে ফুল টিম গিয়ে দাঁড়াল লেকের ধারে। জলের দিকে তাকাতেই বুকের পাঁজর ফাটিয়ে কবিতার লাইন বেরিয়ে আসতে চাইল; নেহাত ভেতরে সারবস্তু বিশেষ নেই, তাই কোনোরকমে এক লাইন বেরোল—এই নীল কখনও চাখিনি —
দামাল হাওয়া তছনছ করে দিচ্ছিল আমাদের গায়ের আবরণ। হ্রদের নীলাঞ্চল আকুল তরঙ্গ হয়ে শুভ্রস্বচ্ছতায় আছড়ে পড়ছিল আমাদের পায়ের কাছে। কেন যে কোনও পাখি দেখলাম না হ্রদের জলে, সেটা আমাদের কাছে বিস্ময়চিহ্ন হয়ে থাকল।
বাতাসের দাপটে তাঁবুর ছটফটানি আর জলের গর্জন শুনতে শুনতে সবাই বিছানায় গেল। কেবল সারা রাত ধরে কারা যেন তাঁবুর দড়ি কাটার চেষ্টা করে তৃপ্তি-শক্তির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাল।
উত্তুঙ্গ শিখর বা গহীন সাগর—মহিলারা যেখানেই যাবেন, মন তাদের উড়ু-উড়ু করবে সাজসজ্জার উপকরণে দৃষ্টি না পড়া পর্যন্ত।
আমাদের টিম তেরো দিনের ভ্রমণের মধ্যে সর্বাধিক সময়, তিন দফায় মোট চার রাত কাটিয়েছে লেহ্তে। লেহ লাদাখের রাজধানী। জমজমাট শহর। অনবদ্য দোকান-বাজার। হরেক রকম আধুনিক পণ্যে ভরভরন্ত চকচকে সব বিপণি। একাধিক বিস্তৃত বাজার-চত্বর আছে যেখানে যানবাহন ঢোকা নিষিদ্ধ। তবে সমস্ত ধরনের পণ্যের মূল্য নির্দিষ্ট করা আছে পর্যটকদের দেহের গড়ন এবং ত্বকের রঙ অনুসারে। এমনকি যেসব মহিলা রাস্তায় বসে স্থানীয় সবজি ও ফল বিক্রি করছেন, তাঁরাও জানেন পর্যটকদের পকেট কতটা তরল হতে পারে। শ্রীনগরের রাস্তায় যে আপেল ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়, এখানে তা ২০০ টাকা।
এখানে এলেই আমাদের টিম-সদস্যাদের স্ফূর্তি ঘটছিল, ফুরসত পেলেই তাঁরা ফুড়ুৎ করে বাজারে হাজির। কখনও দল বেঁধে, কখনও একা একা। কৃতিত্বের বিচারে সবাইকে কয়েক যোজন পিছনে ফেলে প্রথম হলেন তৃপ্তিতনু। পর্যটকপুষ্ট মূল্যকে ফুৎকারে উড়িয়ে অবিশ্বাস্য কম দামে তিনি যে-সব সামগ্রী জয় করে আনলেন তা দেখে বাকি সবার তাক লেগে গেল। অবশ্য সেই ক্রয়মূল্যের কোনো সাক্ষী ছিল না। শক্তিসাধন পকেটের হিসাবে কতখানি পোক্ত সন্দেহ আছে। তাই ক্রয়মূল্যে তছরুপ হয়ে থাকলে তা অনির্ণেয় থাকাই ভবিতব্য।
কারগিল থেকে প্রথম দফায় লেহ পৌঁছেছিলাম ৬ তারিখ দুপুরশেষে। কারগিল এবং লেহ-র মধ্যবর্তী বহুশ্রুত সেই চুম্বক-পাহাড়ের আকর্ষণবিন্দুতে নিউট্রাল গিয়ারে রাখা গাড়ির গড়গড়িয়ে চলাও প্রত্যক্ষ করা হয়ে গেছে। কাজেই সেদিনের পক্ষে যথেষ্ট খেলা হয়ে গেছে মনে করে আমরা হোটেলে বিলম্বিত লাঞ্চ সেরে তিনতলার লবিতে আড্ডা বসানোই মনস্থির করলাম। তবে তারই ফাঁকে কোনো কোনো খেলুড়েনি বাজার-দর্শনে বেরিয়েছিলেন কিনা তা হলপ করে বলা কঠিন।
সবশেষে দলের প্রথম ক্যাপ্টেন অশোক তার ব্যক্তিগত ত'বিল থেকে গ্রামীণ ছদ্মবেশধারী এক মহার্ঘ রেস্তোরাঁয় সকলকে বরফ-ক্ষীর পান করিয়ে সাধুবাদ কুড়োল।
মহম্মদ আলি ছিল আমাদের লেহ থেকে নুব্রা ভ্যালি ভায়া প্যাঙ্গম লেক যাত্রার পাইলট। সেই দীর্ঘতম পাহাড়ি পথযাত্রায় এমন পাইলট পাওয়া ভাগ্যের কথা। তার কৃতিত্বের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এক তো তার জগদ্বিখ্যাত নাম! যদিও সে নিজে সেই নামের মহিমা জানে না। জানার দরকারও নেই, সে নিজ-গুণেই মহান। প্রথমত তার অসাধারণ রথচালনা; পাহাড়ি রাস্তা ভি আকারের হোক বা ইউ আকারেরই হোক, পথপৃষ্ঠ মসৃণই হোক বা উঁচুনিচু উপলখচিতই হোক—তার গতির বিশেষ হেরফের নেই। মাথায় ফেট্টি-বাঁধা মঙ্গোলয়েড আকৃতির সুদর্শন পাইলটের হিরোয়িক ড্রাইভের ঠ্যালায় টিমের অনেকেরই প্রাণ কণ্ঠায় এসে ঠেকেছিল। তার এহেন কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে আমরা তাকে স্যাঞ্চো বলে ডাকছিলাম।
এ তো গেল স্যাঞ্চোর টেম্পো-ড্রাইভিং। তার লাইফ-ড্রাইভিং আরও রোমহর্ষক। বয়েস সবে চল্লিশ হয় কি না হয়, এর মধ্যেই সে বিয়ে করেছে তিনখানা। তিনটিই লাভ-ম্যারেজ। তার এই কৃতিত্বও তুশ্চু হয়ে গেল যখন শুনলাম যে সে যখন গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় ঘুরে বেড়ায়, তখন তার সেই তিন লাভ-বার্ড তার কারগিলের বাড়িতে গলা জড়াজড়ি করে তার আগমনের অপেক্ষায় হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে।
৫ আগস্ট দুপুরে আমরা শ্রীনগর থেকে কারগিলে এসে পৌঁছলাম। শ্রীনগর থেকে রওনা হওয়ার কথা ছিল সকাল ছটায়। কিন্তু আগের দিন খবর পাওয়া গেল, ৫ এবং ৬—দুদিনই কাশ্মীর বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। তবে বন্ধে শ্রীনগর ছাড়া অন্য কোথাও টুরিস্টদের ঝঞ্ঝাট হবে না। অতএব ঠিক হল ভোর তিনটেয় আমাদের শ্রীনগর ছাড়তে হবে। বেরোতে বেরোতে অবশ্য সাড়ে চারটে বেজে গেল। বারোটার পর কারগিলের হোটেলটিতে এসে উঠলাম। চমৎকার হোটেল। সেখানে হোটেল-মালিকের পক্ষ থেকে উচ্ছ্বসিত সম্বর্ধনা পাওয়া গেল। আমাদের টিম যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন—সম্ভবত সেরকমই এক বার্তা আমাদের প্রতিটি গন্তব্যের হোটেলে কে বা কারা ছড়িয়ে দিয়েছিল। হলপ করে বলতে পারি আমরা কেউ তার বিন্দুবিসর্গ জানি না। তবে তার সুফল ভোগ করতে আমরা বিশেষ আপত্তি করিনি। এখানেও তাই স্বাগতা ম্যাডাম পুষ্পস্তবক গ্রহণ করলেন, বাকি সবাই ঠান্ডা পানীয় এবং তাজা অ্যাপ্রিকট সহযোগে হোটেলের আপ্যায়ন গ্রহণ করতে দ্বিধা করল না।
সুরি নদীর পাড়ে এই হোটেল। গ্লেসিয়ার থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রবল গর্জনে ফুঁসতে ফুঁসতে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে এর ঘোলা স্রোত। সকলেই জানেন পশুপাখির মতো এই সব নদীনালাও অতি বেআদব, রাষ্ট্রের শাসন মানে না। সুরিও সিন্ধুর মতোই খলখল করতে করতে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে নির্লজ্জের মতো পাকিস্তানের কোলে গিয়ে আছড়ে পড়েছে।
চটপট চানখাওয়া সেরে তিনটি গাড়িতে করে টিম বেরিয়ে পড়ল কারগিল সীমান্ত জয় করতে। পুরোভাগের গাড়ির সারথি কাঁচা বয়সের এক তরুণ। তথাপি সীমান্তের যাবতীয় তথ্য তার মুখস্থ। সম্ভবত তার গাড়িভাড়ার সঙ্গে গাইড-ফিও যোগ করা আছে। একটু এগিয়েই বাজারের মধ্যে তার এক বন্ধু গাড়ি থামিয়ে আমাদের হাতে গাছ থেকে সদ্য পাড়া কয়েকটি পাকা অ্যাপ্রিকট তুলে দিল। এই ফল দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন এখানকার সংস্কৃতির অঙ্গ। সারথিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে তারা ‘বালটি’ ভাষায় কথা বলে। এটি তিব্বতি উপভাষা, এর নিজস্ব লিপি নেই। অনেকেই একটি ভিন্নতর তিব্বতি লিপি ব্যবহার করেন। পাকিস্তানের কিছু অংশের লোক ফারসি লিপিতে বালটি লেখেন। ‘ইগে’ নামে তিব্বতি লিপির একটি রূপভেদ বালটি ভাষার জন্য প্রচলনের চেষ্টা হচ্ছে।
কারগিল সীমান্তের দৃশ্য সিয়াচেনের চেয়ে বিশেষ আলাদা নয়। এখানেও বিভিন্ন পাহাড়চূড়ায় ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বাঙ্কার। সেসব বাঙ্কারে পরস্পরের দিকে তাক করা আছে বন্দুক। আমাদের অবস্থানে যা একটু তফাত; সিয়াচেন সীমান্তের পাহারাদারদের আমরা দেখেছিলাম তুরতুক উপত্যকায় দাঁড়িয়ে, এখানে দেখলাম অন্য এক পাহাড়ের গায়ের রাস্তা থেকে। আমাদের সারথি বলল যে এই পাহাড়টি নাকি আগে পাকিস্তানের এলাকা ছিল, ১৯৬৫-র সংঘর্ষের সময় ভারতীয় বাহিনী এটিকে অধিকার করে নিয়েছে। এর ফলে ভারতীয় সেনা এখানে অনেকখানি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেছে। এই সীমান্তে ভারতের শেষ গ্রাম হুন্ডুরমান-কে আমরা দেখলাম উপর থেকে নীচের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে। কারগিল যুদ্ধের সময় এই পূর্বতন পাকিস্তানি গ্রামটি ভারতের অধিকারে চলে এসেছে। গ্রামের অধিবাসীদের কিছু পাকিস্তানে চলে গেছেন আত্মীয়দের আশ্রয়ে। বাকি যারা আছেন তাদের রুজি-রোজগারের দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়েছে। প্রধানত পাহাড়চূড়ার ভারতীয় বাঙ্কারে রসদ বহন করাই তাদের কাজ।
কারগিলের চিত্র লাদাখের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। ক্ষেতি সামান্য, আর আছে আপেল ও অ্যাপ্রিকটের বাগান। বাকি সব টুরিস্ট ও মিলিটারি-নির্ভর। টুরিস্টদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ব্যবহার অতি চমৎকার।
ফেরার পথে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা টুকটুকে সব বাচ্চাগুলো আমাদের দেখলেই গালভরা হাসি নিয়ে সোৎসাহে হাত নাড়ছিল। সন্ধেবেলায় ফিরে এসে সুরি নদীর পাড়ে হোটেলের লনে বসে দীর্ঘ আড্ডা। পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে এখান থেকে। এক বেলার পরিচয়েই কারগিলকে ছেড়ে চলে আসার অতৃপ্তি ঠিক সেরকমই যখন চলার পথে আমন্ত্রণভরা কোনো আকুল চোখের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।