সকালেই রাস্তায় বেশ ভিড়। অফিসযাত্রীদের তাড়া। গাড়িটা গোঁত্তা খেতে খেতে সিগন্যালে পৌঁছেই আটকে গেল। সিগন্যাল সবুজ হয়ে যাবার পরে যানজট কাটিয়ে বের হতে হতেই আবার লালবাতি জ্বলে উঠল। আরো মিনিট কয়েক আটকে গেলাম। এমনিতেই আজ দেরি হয়েছে তার ওপর এই যানজট। আর আজই অফিসে শুরুতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লায়েন্ট মিটিং আছে। আমি আছি কোম্পানির সেলস-এর মাথার দিকে।ঠিক সময়ে আজ পৌছনো না গেলে মুশকিল। স্টিয়ারিং-এ বসে অস্থির হয়ে কোন লাভ নেই জানি, তাও মাথাটা জ্যাম হয়ে যাচ্ছিল। এসি-টা বাড়িয়ে দেবার পরেই বাঁ দিকের গালটা চিন চিন করে উঠল। রিয়ার ভিউ মিররে নিজের মুখ দেখে চমকে উঠলাম। বাঁ গালে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে লাল দগদগে কয়েকটা আঙ্গুলের দাগ। সেকি? আবার? এটা কি সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠল নাকি? মাঝে মাঝেই আমাকে কষ্ট দেবে আর মনে করিয়ে দেবে দিন দুয়েক আগের রাতের সেই অলৌকিক শাস্তির কথা। হিমায়িত গাড়ির ভেতরেই ঘামতে লাগলাম আমি।
সেদিন রাতে চোদ্দোতম প্রদীপটা বাড়ির বাইরের গেটে লাগিয়ে যেই পেছন ফিরেছি, দেখলাম ভুস করে ধোঁয়া ধোঁয়া অবয়ব নিয়ে একটা শুকনো চেহারার লোক কোথা থেকে উদয় হয়েছে। একটু শিরশিরে অনুভূতি হল শরীর বেয়ে। এ কী করে এখানে এল? কোথাও কেউ তো ছিল না। বাইরের গেটও বন্ধ। রাস্তা আর সামনের পার্কের দীপাবলীর আলোগুলো যেন একটু নিষ্প্রভ লাগছে এখন।কয়েক মাস আগেই চাকরিতে বদলি হয়ে এই ছোট্ট অথচ ব্যস্ত শহরে এসেছি।একটা সুন্দর কলোনিতে অফিস থেকেই থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা হাতজোড় করে বলে উঠল, 'কর্তা আর বাইরে থাকবেন না। এবার ভেতরে যান। তেনাদের আসার সময় হয়ে গেছে।' লোকটা কাদের কথা বলছে জিজ্ঞেস করার আগেই সে আবার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলতে লাগল, 'আজ ভূত চতুর্দশী, আপনাদের পূর্বপুরুষরা আসবেন আশীর্বাদ দেবার জন্য। ওনারা আশপাশেই আছেন। দয়া করে বাইরে থাকবেন না। ক্ষতি হতে পারে।’ এই বলে লোকটা কোথায় উধাও হয়ে গেল।
এই শহরে আজকাল রাতের দিকে হিম পড়া শুরু হয়েছে। ঠান্ডা লেগে গলাটা যেন একটু ব্যথা ব্যথা করছে। তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে এলাম।ঘরে ঢুকতেই মনে হল আলোর ভোল্টেজ বেশ কম। আলোতে কেমন একটা ছায়া ছায়া ব্যাপার। ডাইনিং টেবিলের পাশ থেকে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আসছে। বউ কোথায় গেল কে জানে? আরে ও তো বেডরুমে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখছি। খাওয়াদাওয়ার পর সামনের বারান্দায় প্রদীপ জ্বালাতে গেছি মিনিট পনেরো হল। এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল? ডুপ্লেক্স কোয়ার্টার। আমি আর আমার বউ থাকি। মেয়ে থাকে বিদেশে; মাস্টার্স করে ওখানেই রিসার্চের কাজ করছে। মেয়েকে মেসেজ করে জানালাম আজকে আমদের হ্যালোইন বা ‘ভূত চতুর্দশী।’ একটা ভূতের ছবি দেওয়া পোস্ট মেয়ের সাথে শেয়ার করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই দেখি সিড়িঙ্গে মার্কা লোকটা আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলল ‘কর্তা বেশি ওপর-নিচ করবেন না। নিচে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন। এখুনি এসে পড়বেন ওনারা। ন্যাভিগেশন গণ্ডগোল হবার জন্য একটু দেরি হয়ে গেছে।’
‘ন্যাভিগেশন? কেন? ওনাদের আবার ন্যাভিগেশনের দরকার কী?’ বেশ অবাক হলাম।
‘কী যে বলেন? এই তো আজ অমাবস্যা থাকাতে ভুল করে অন্য পাড়ায় একটা বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন। ভার্চুয়াল কাস্টম চেকিং-এ ধরা পড়াতে আবার রি-রুট করে এখানে আসছেন। ভূতচতুর্দশীতে ওটাই তো অসুবিধা হয়। ভূতেরা অচেনা জায়গায় পৌঁছে যায়। তাতেই ঘটে বিভ্রাট। আপনি আর দেরি করবেন না। নিচের ঘরে অপেক্ষা করুন। ওনারা এসে পড়লেন বলে। আর এসে যদি আপনাকে না দেখেন, কুরুক্ষেত্র বাধাবেন।’
একরকম ধমক দিয়েই লোকটা আমাকে নিচে পাঠিয়ে দিলো। আমি কোনও রকমে ওপরের প্রদীপগুলোর সলতে উস্কে দিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে চলে এলাম। লোকটা আবার যথারীতি ভ্যানিশ। ও কি ওনাদের দূত না পাইলট কার? কে জানে?
নিচে ড্রইং স্পেসে এসে সোফায় বসে বসে ভাবছি যে এবার ঘুমিয়ে পড়লেই হয়। লোকটাকে অত পাত্তা দেবার কী আছে? কারা না কারা আসবে? আর আদৌ আসবে কিনা তারও ঠিক নেই?
‘কি রে এই তোর রাত জেগে পড়া হচ্ছে?’ একটা কড়া গলায় ধমক খেয়েই ঝিমুনি ভেঙ্গে গেল। অনেক কষ্টে চোখ খুলে কাউকেই আশেপাশে দেখলাম না। কিন্তু ধমক খেয়েই সোফাতে পড়ার বইটা কোথায় রেখেছি খুঁজতে লাগলাম ঘুমচোখে। আরে, কী করছি কী আমি? এখানে বই আসবে কোথা থেকে। আমি তো বসার ঘরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু কীসের অপেক্ষা? কিছুটা সময় কাটল। উঠবো উঠবো করছি, আবার সেই আওয়াজ। ‘তোকে নিয়ে তো পারা গেল না। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আর কী করিস তুই? পড়াশুনো তো লাটে তুলেছিস। সকালে উঠতে পারিস না। রাতে জেগে পড়তে পারিস না। এবারে তো ফেল করবি। বের করে দেব বাড়ি থেকে।’
বহু দিন পরে চেনা বয়ানে বকুনি খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে চিনতে পারলাম রাগি গলাটা। বাবা এসেছেন ঘরের মধ্যে। কিশোরবেলায় এগুলো তো রোজকার বকুনি ছিল। কিন্তু কোথায় গলার মালিক? একটা আওয়াজ পেয়ে ঘুরেই দেখি চিমসে লোকটা কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘কী ব্যাপার বলুন তো বাবার গলা পেলাম মনে হচ্ছে?’ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
‘হ্যাঁ, আপনার বাবা এসেছেন। আপনাকে ঘুমোতে দেখে বেশ রেগে গেছেন। যা রাগি লোক! তবে দূর থেকে রিমোট ভিসুয়ালে দেখছেন তাই রক্ষে। এখনো পর্যন্ত শুধু কণ্ঠটা প্রজেক্ট করা গেছে। ওনাদের হাওয়ার শরীর আসতে একটু সময় লাগছে।’
‘কি যে বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। রিমোট ভিসুয়ালটা আবার কী?’
‘ওই, দূর থেকে উনি আপনাকে দেখছেন আর কি? গলাটা প্রক্ষেপ করতে পেরেছেন শুধু। ঘোর অমাবস্যা বলে শরীর এখনো পৌঁছয়নি। তবে এসে পড়লেন বলে।’
‘আপনি ঠিক কে বলুন তো?’
‘আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমি ট্যুর অপারেটর। আজকে বাইরে বিশেষ আলো নেই, অমাবস্যা, চারদিকে প্রদীপ জ্বলছে। হাওয়াও চলছে এলোমেলো। একটু আগেই ওনারা একটা ডাইভারসনে হাওয়ায় অন্য রাস্তায় ভেসে গিয়েছিলেন। যাতায়াত অনেক মুস্কিল। তাই তো আজ শুরু থেকেই গালাগাল খাচ্ছি। এত খরচাপাতি করে ট্যুর বুক করেছেন ওনারা।’
‘বুক করেছেন? কীসের ট্যুর?’
‘আরে এটা ওনাদের জগৎ থেকে আপনাদের জগতে আসার ট্যুর।’
‘কিন্তু আমি তো শুনেছি ওনারা যেখানে খুশি যেতে পারেন।’
‘তা পারেন বটে, তবে সেটা নিজেদের অরবিটে বা স্তরে। ওপারের জগতে অনেকগুলো স্তর আছে। প্রথমে নিচের স্তর তারপর মেয়াদ পূর্ণ হলে আরও ওপরের স্তর। যত ওপরে যাওয়া যাবে তত শান্তি। অরবিট বা স্তর বদল করতে গেলেই ট্যুর অপারেটর লাগে। এখানকার ভিসার মত ওখানেও অনেক পারমিশনের দরকার হয়। সেগুলো আমরা করিয়ে দিই। হ্যাপা অনেক।’
ওনারা আসার আগে আর একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দিন তো? একটু আগে ন্যাভিগেশনের কথা বলছিলেন। আপনাদের ন্যাভিগেশনটা হয় কী করে?
‘একটা অস্পষ্ট প্যাক প্যাক আওয়াজ শুনেছিলেন এখানে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছিলাম। ওই ডাইনিং টেবিলের নিচে থেকে আসছিল মনে হচ্ছিল। কে আওয়াজ করছিল?
আরে যার আওয়াজ পেয়েছেন সে একটা অদৃশ্য পরিযায়ী পাখি। ও-ই আমাদের পথ দেখায়। আপনি জানেন যে পরিযায়ী পাখির ন্যাভিগেশন গ্রহ-তারকাদের সাথে লিঙ্কড। ওরা এব্যাপারে বেস্ট। আমাদের মহাশূন্যের ভ্রমণ ওরাই গাইড করে। আপনার ঘরে যেটা বসে আছে, সেটা একটা সিন্ধুসারস। বেঁচে যখন ছিল, প্রতি বছর সাইবেরিয়া থেকে ভারতে যাতায়াত করত। ও এখন আমাদের ট্রাভেল কোম্পানিতে কাজ করে। এখন বাতাসে সিগনাল পাঠিয়ে আপনাদের বাবা-মাকে গাইড করে নিয়ে আসছে।’
ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল। তবে তখনও জানতাম না যে কী ভীষণ ঘটনা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষণ পর এই ম্যাড়ম্যাড়ে আলোর মধ্যেই ড্রইংরুমে আরও একটা হাল্কা আলোর বিম এসে পড়ল। আলো কোথা থেকে আসছে তা খুব স্পষ্ট হল না। হয়তো ছাদ থেকে নামল। বিম থেকে ক্রমশ ব্যাপারটা একটা আলোর গোলক হয়ে গেল। একটা পেল্লায় বেলুনের মত আলোর বল কেউ যেন ছাদ থেকে ফেলেছে। বলটা নামতে নামতে মেঝেতে এসে থিতু হয়েছে। আলোর রং বেগুনি থেকে নীল হয়ে যেতেই গোলকের ভেতরে ফুটে উঠল দুটো অবয়ব। এরপর আলোর বলটা নিঃশব্দে ফেটে যেতেই দেখলাম বাবা-মা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের মধ্যে।
‘এই যে ওনারা এসে গেছেন, আমি এবার চললাম। সময় শেষ হলে আবার আসব ওনাদের নিয়ে যেতে। আরও একজনের আসার কথা আছে। তাকেও তো দেখছি না। তিনিই বা কোথায় গেলেন দেখি।’ আর কোন আওয়াজ না পেয়ে বুঝলাম পেছনের লোকটা উধাও হয়ে গেছে।
‘কোথায় গেল চিমসেটা? সন্ধে থেকে রাত অবধি চরকির মত কম ঘুরিয়েছে? এ বাড়ি নয়, ও বাড়ি। এ পাড়া নয়, ও পাড়া! ফিরে গিয়ে দেখাচ্ছি ওটাকে। কী করে ব্যবসা করে দেখব। যত সব অপোগণ্ড।’ দেখলাম বাবার রাগ বেশ চড়েছে।
বাবার রাগ থামাতে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আরে এসেই তো পড়েছ। বোসো না তোমরা।’
‘আমাদের এখন আর বসার দরকার হয় না।’ দেখলাম মাটির থেকে কিছুটা ওপরে ঝুলে রয়েছে ওনাদের পা। এটাই বোধ হয় নিরবলম্ব অবস্থা। এত সূক্ষ্ম ওনাদের শরীর যে পরিষ্কার করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু আবছা অবয়ব ভেসে আছে।
‘কী রে বটু কত রোগা হয়ে গেছিস? খাওয়াদাওয়া করিস না ঠিকমত? আরে চুলগুলো তো প্রায় সবই পড়ে গেছে। কী সুন্দর চুল ছিল তোর।’ গায়ে, মাথায় হাওয়ার মত কিছু লাগছে। বুঝলাম মা আদর করছে।
‘আরে তুই তো কিছুই চটপটে হস নি। যেরকম দেখেছিলাম তার থেকেও খারাপ এখন।’ আমাকে মায়ের আদর খেতে দেখে বাবা আবার ধমকে উঠল।
‘বাবা, এখন তো বয়স হয়েছে। এটা তো চটপটে হবার সময় নয়। আর ক-বছর পরে রিটায়ার করব।’
‘আরে রিটায়ার করছে বলে মানুষ চটপটে থাকবে না? তুই তো সব সময়েই ভ্যাঁদা।’
বাবার কথাতে মন খারাপ করে লাভ নেই। আমাদের যৌথ পরিবারে দাদু, ঠাকুমা, জ্যাঠা অনেক আগেই গত হয়ে যাওয়াতে বাবাই ছিলেন কর্তাব্যক্তি। আমদের সাথে জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাই-বোনদের সকলেরই অভিভাবক বাবা।
‘কই আরেক জন তো পৌঁছল না এখনও। চিমসেটা কোথায় যে গেল?’
বাবার কথায় বুঝলাম ওনারা আর একজনের আসার অপেক্ষায় আছেন। ঠিক এই সময় পেছন থেকে আওয়াজ এল--‘এই তো উনি এসে গেছেন। এবার আপনারা তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিলেই আমরা সবাই ফিরে যাব।’
‘তুমি তো কোন কম্মের নও হে ছোকরা। যেমন তুমি তেমন তোমার গাইড। নিজের কাজই ঠিকমত জানো না, শুধু পেমেন্টের বেলায় আছ। দেখি ঠিক সার্ভিস না দিলে কে তোমায় বাকি পেমেন্ট করে।’
‘ওই তো আর একটা গাইড এসে গেছে। এরও ন্যাভিগেশনে সমস্যা ছিল স্যার।’
দেখলাম, আর একটা সিন্ধুসারস এসেছে। এটা আরও ধূসর। বোধ হয় আগে আসা সারসের বউ। দেখলাম ওরা পথ ভুল করায় লজ্জা পেয়ে ডাইনিং টেবিলের নিচে দুজনে দুজনের পাখায় মুখ লুকিয়ে জড়াজড়ি করে বসে আছে। একটা অস্পষ্ট প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ আসছে ওখান থেকে। সেই সময়েই আরও একটা আলোর বল নামল ছাদ থেকে। ঠিক আগের বারের মতোই আলোর বল ফেটে যেতেই একটা অস্পষ্ট অবয়ব ঘরের মধ্যে ঝুলতে থাকল।
ব্যাপারটা একটু স্পষ্ট হতেই লোকটাকে চিনতে পারলাম। আরে এ তো গামলাদা। মানে আমার জেঠতুতো দাদা লর্ডদা। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেখতে, দারুণ ব্রাইট। পড়াশুনোতে দুর্দান্ত। খেলাধুলোয় তো কথাই নেই। গোল-কিপিং করত। আমাদের তল্লাটের সেরা গোল-কিপার। পুরো পেটটাকে গামলার মতো বেঁকিয়ে গোলপোস্টের নিচে ও বল ধরত। এর জন্যই ওকে ওর বন্ধুরা ওকে গামলা বলে ডাকত। আমরাও বলতাম, তবে আড়ালে। ওকে গোল দেওয়া ছিল ভীষণ কঠিন। পাড়ার অনেক ম্যাচ ও টাইব্রেকারে পেনাল্টি আটকে জিতিয়ে দিয়েছে। পরে ইস্টবেঙ্গলে খেলার ডাক পেয়েছিল। কিন্তু ততদিনে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়ে যাওয়াতে পড়াশুনোকেই বেছে নিয়েছিল কেরিয়ার হিসেবে। তবে দোষের মধ্যে আমাকে ছোট করে ও মজা পেত। আমার ওপর যত সর্দারি করত। আমি ছিলাম ওর নিয়মিত শিকার। বড় বিচিত্র ছিল গামলাদার কাজগুলো। কোথা থেকে যেন বাড়ির লোক জানতে পারত আমি স্কুলে পড়া পারিনি, বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়েছি বা কানমলা খেয়েছি স্যারেদের কাছে। যেদিন এসব হত, সেদিনই সন্ধ্যেবেলা বাবার ঘরে ডাক পড়ত আমার আর আবার শাস্তি পেতে হত। প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরে জেনেছিলাম গামলাদাই বাবাকে এসব বলে দিত। এছাড়াও যখন তখন লোকজনের সামনে দাদাগিরি ফলাত। কানমলা, চড়-থাপ্পড় ছাড়া, বোকার হদ্দ, বুদ্ধিহীন ইত্যাদি বলে সম্বোধন আমাকে একেবারে সহ্যের শেষ সীমায় এনে ফেলেছিল। কাউকে নালিশ করে কোন কাজ হয়নি। গামলাদা ভালো ছেলে বলেওর সাত খুন মাপ। লম্বা-চওড়া চেহারার জন্যও ওকে সবাই সমীহ করত।
তবে ওরকম ডাকাবুকো একটা লোককে মুখ কাঁচুমাচু করে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলাম। আমাকে দেখে চিনতে পারল কিনা বুঝলাম না।একবারও হাসল না। গামলাদা আমাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে প্রায় বছর ছয়েক হল।
‘এবার বুঝলি কেন আমরা এসেছি?’ বাবার গলা পেলাম।
‘আশীর্বাদ করতেই তো। এই ভদ্রলোক তো তাই বললেন।’ থতমত খেয়ে বললাম।
‘সে তো এসেছি যখন করবই। আশীর্বাদ তো সব সময়েই আছে। কিন্তু লর্ড কেন এসেছে বুঝেছিস?
একটা ঘটনার ভুল বিচার হয়েছিল। সেটা ঠিক করা এখনো বাকি রয়ে গেছে?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কোন ঘটনা?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘এবারে লর্ডের সেই নালিশেরই আলোচনা হবে।’
শুনেই পিঠ দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। মুহূর্তে চল্লিশ বছর আগে ফিরে গেলাম। একটা স্কুল পিকনিকের মোক্ষম ঘটনা। মজারও আবার করুণও। এই রাতের অলৌকিক বিচারসভার কারণ বুঝে অজানা আশঙ্কায় মন দুলতে লাগল। বাইরের ভূতচতুর্দশীর রাত আরো গভীর এখন।
স্কুলের পিকনিক সেবারে দত্তপুকুরের বাগানবাড়িতে। আমাদের স্কুল এ-তল্লাটের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা। সেবারেও পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছেলেরা পিকনিকে যাবে। দূরের রাস্তা। তিনটে বাস ভাড়া করা হয়েছে। আমি অষ্টম আর গামলাদা একাদশ শ্রেণীর থেকে যাচ্ছি। আমি যথারীতি গামলাদার থেকে দূরে দূরেই থাকছি। আজকাল গামলাদা কেন জানি না আমাকে দেখলেই ভীষণ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। কোন কারণ ছাড়াই। আমি সাধারণ ছাত্র। একটু গোবেচারা টাইপের। কারো সাথেপাছে নেই। না আমি পড়াশুনোতে ভাল, না খেলাধুলোয়। আর গামলাদা ব্রাইট ছাত্র। আমার সাথে কোন তুলনাই চলে না। হয়ত আমি কোন কিছুতেই ভালো না বলে গামলাদার এত রাগ। কিন্তু এরও তো একটা শেষ থাকা উচিত। আমি কতদিন সহ্য করব? তাই আমি এবারে আমার অপমানের বদলা নিতে তৈরি। পড়াশুনো বা খেলাধুলো দিয়ে কোনদিনই সম্ভব না। তাই অন্যভাবে প্ল্যান করেছি। কেউ জানে না। আমাকে একাই করতে হবে যা করার।
উঁচু ক্লাসের ছেলেরা পিকনিকের দিন খুব স্বাধীনতা পেত। কয়েকজন স্যার সাথে যেতেন বটে তবে তাঁরাও নিজেরা নিজেরা ব্যস্ত থাকতেন। ছাত্রদের সাথে খেলতেন, মজা করতেন। আর উঁচু ক্লাসের কিছু বখাটে টাইপের ছেলেরা লুকিয়ে লুকিয়ে ড্রিঙ্কও করত এই দিনে। এবারেও জেনেছি দু চারজন ছাত্র ড্রিঙ্ক করবে বলে মদের বোতল নিয়ে যাবে। আমি সবচেয়ে নিরীহ গোবেচারা বলে আমাকে কেউই ধর্তব্যের মধ্যে রাখত না। স্কুল করিডরে এরা আমার পেছনেই সব আলোচনা করছিল আর আমি শুনে ফেলেছিলাম আগের দিন। তখনই প্ল্যানটা করে ফেলেছিলাম। ওরা জলের সাথে মদ মিশিয়ে চারটে ওয়াটার বোতলে করে নিয়ে যাবে বাসেই, যাতে আলাদা বোতল না নিতে হয়। তাছাড়া বাইরে থেকে ওই নিষিদ্ধ পানীয়জল বলেই মনে হবে।
পরের দিন সকাল সকাল বাস যাত্রা ভালভাবেই শুরু হল। স্যারেদের মালপত্র, জলের বোতল সব স্কুলের দারোয়ান নীলমনিদার জিম্মাতেই থাকবে। বাস শহর ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তায় প্রবেশ করল। বাইরের দৃশ্য অতি মনোরম। মাটির বাড়ি, ক্ষেত, খামার ইত্যাদি দৃশ্য সবাইকে আনন্দ দিচ্ছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন বাসগুলো টয়লেট ব্রেক দেবে। মাঝখানে কোন সুন্দর জায়গায় গাড়ি দশ মিনিটের জন্য থামবে।
বোমাটা ফাটল রবিবারের পিকনিকের পরের দিন, সোমবারে। টিফিনের আগের পিরিয়ডে হেডস্যারের ঘরে ডাক পড়ল আমার। ভীষণ ভয়ে ভয়ে স্যারের ঘরে ঢুকেই দেখি বাবা বসে আছেন। আমি ঢুকতেই বাবা হেডস্যারকে বললেন ‘হ্যাঁ মাস্টারমশাই ওকেই জিজ্ঞেস করুন আগে, ও বলতে পারবে।’
হেডস্যার জিজ্ঞেস করলেন— ‘এই ওয়াটার বটলটা চেনো?’
আমি ভালো করে দেখলাম টেবিলের ওপর রাখা বোতলটা, তারপর বোকা বোকা মুখ করে বললাম,‘হ্যাঁ চিনি স্যার।’
‘কার বোতল এটা?’
স্যার, এটা আমার লর্ড-দার ওয়াটার বোতল।
বাবা বললেন ‘হ্যাঁ হিমাংশুর ডাক নামই লর্ড।’
তখনই দেখলাম লর্ডদা স্যারের ঘরে ঢুকছে। আমাকে স্যার বললেন--এখন তুমি যেতে পারো। এই দৃশ্য ছেড়ে একদমই যেতে ইচ্ছে না করলেও বেরিয়ে এলাম প্রায় উড়তে উড়তে। কাজ হয়ে গেছে। আমি জানি গামলাদা নিজের ওয়াটার বোতল এখানে দেখে ভীষণ অবাক হবে।
আসলে সেদিন বাসে বিশেষ কিছুই করতে হয়নি আমাকে। বাস তখন টয়লেট ব্রেকে থেমেছিল। সবাই নেমে গেলেও আমিও নেমেছিলাম, তবে একটু দেরিতে। বাসেই লর্ডদার জলের বোতলটা খালি করে নিয়ে গেলাম যেখানে মদ মেশানো চারটে জলের বোতল ছিল। খুব সন্তর্পণে ওই চারটে বোতলের সবকটা থেকে কিছুটা করে নেশার পানীয় লর্ডদার বোতলে ঢেলে দিয়েছিলাম। আর যেটুকু করে খালি হয়েছিল মদ মেশানো পানীয়ের বোতলগুলো, সেগুলো আমার বোতল থেকে একটু একটু জল দিয়ে ভরে দিয়েছিলাম। হ্যাঁ, আরও একটা কাজ করেছিলাম অবশ্য, লর্ডদার বোতলটা নেশার পানীয় ভরার পর নীলমনিদার কাছে রাখা স্যারেদের বোতলগুলোর মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। যথারীতি পরে স্যারেরা ওই বোতলটার কথা টের পেয়েছিলেন আর হেডস্যারকে জানিয়েছিলেন। আর এটা যে লর্ডদার বোতল সেটা নিশ্চয়ই নীলমনিদাই আন্দাজ করে স্যারকে বলেছিল।এটা অবশ্য আমার অনুমান, কারণ আমি দেখেছিলাম পিকনিকে লর্ডদা নীলমনিদাকে নিজের ওয়াটার বোতলটা কোথাও দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। লর্ডদা স্কুলের ব্রাইট বয়। সে যাতে কুসঙ্গে না পড়ে বা খারাপ না হয়ে যায়, সেটা তো স্যারেদের দেখতেই হবে। কাজেই আর সময় নষ্ট না করে হেডস্যার বাবাকেই প্রথমে ডেকে পাঠিয়ে ব্যাপারটা বলেছিলেন।
যদিও ঘটনাটা স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক, হেডস্যার, বাবা, নীলমণিদা ছাড়া আর বিশেষ কারো জানার কথা নয়। তবু কীভাবে যেন অনেকেই জেনে গিয়েছিল।
তবে আমি যে ব্যাপারটার পেছনে আছি সেটা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি।
তাহলে এই কারণেই এতদিন পরে এখানে এই অদ্ভুত বিচারসভা?
বাবা তো রাগে অগ্নিশর্মা-- ‘তুইই তাহলে বোতলের ঘটনাটা ঘটিয়েছিলি। মিটমিটে শয়তান। আর এই নির্দোষ ছেলেটাকে সেদিন কী মারটাই না মেরেছিলাম। ও বার বার বলেছিল যে পিকনিকে ওর ওয়াটার বোতল হারিয়ে গিয়েছিল আর এ ব্যাপারে ও কিছুই জানে না। আমরা কেউই সে কথা বিশ্বাস করিনি। না আমি, না স্কুলের হেড স্যার।’
মা বলল ‘এটা কেন করেছিলি বটু? আমরা তো জানতে পারলাম যখন লর্ড আমাদের ওপারের জগতে এল। আমরা আরও উচ্চস্তরে যাবার জন্য দরখাস্ত করা সত্ত্বেও নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট পাচ্ছিলাম না। কোন হিসেব বাকি থেকে গেছে বলে। দীর্ঘদিন আমাদের আত্মার উন্নত স্তরে যাওয়া আটকে গিয়েছিল। এই ভুল বিচার ঠিক না করে আমরা আরও প্রশান্তির স্তরে উঠতে পারছিলাম না।
‘কেন এ কাজ করেছিলি? সারা জীবন লর্ডকে আমার কাছে মরমে মরে থাকতে হল। আমরা ওপারে গিয়েও এতদিন একই স্তরে রয়ে গেলাম। কেন কেন?’
স্বীকার করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। ভীষণ ঘেন্না হল নিজের ওপর। প্রায় কান্না মেশানো গলায় বললাম-- ‘আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। লর্ডদা তুমি অন্তত আমাকে ক্ষমা করো। ওটা আমার ছোট বয়েসের ভুল। কিন্তু পরে বহুবার ভেবেছি বাবা-মাকে বা তোমার কাছে স্বীকার করব এই নোংরা কাজের কথা, কিন্তু পেরে উঠিনি। পরে যখন সাহস সঞ্চয় করে উঠেছি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
লর্ডদা বলল--‘আমিও কী জানতে পারতাম। ওপারে গিয়ে পাপ-পুণ্যের আকাউন্ট ঘেঁটে বিশ্লেষণ করার সময় আমাকে জানানো হয়েছিল ঘটনাটা। আমার কোন অসুবিধা ছিল না তাতে। কারণ এটা তো আমার পাপ নয়। বরং কিছু নম্বর আরো জমা হয়েছিল আমার খাতায়। কিন্তু ওনারাই বললেন কাকা-কাকিমার নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট আটকে আছে এই ঘটনার জন্য। কারণ কাকা না-জেনে ভুল লোককে শাস্তি দিয়েছিল। আর যতদিন না সঠিক লোককে শাস্তি না দেওয়া হচ্ছে ততদিন কাকা নো-অবজেকশন পাবে না। কাকা না পেলে কাকিমাই বা যায় কী করে? তাই তো এত কাঠখড় পুড়িয়ে ওদেরকে নিয়ে এখানে আসা।’
‘কিন্তু শাস্তি ছাড়া তো বিচার সম্পূর্ণ হয় না। তুমি শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও, তাছাডা এখন শাস্তি না দিলে পরে ওপারে গিয়ে শাস্তি পেতে হবে। আর সে শাস্তি হবে অতি ভয়ঙ্কর।’ মনে পড়ল, ভীষণ রাগলে বাবা আমাকে তুমি বলত।
আলোগুলো এমন সময় প্রায় নিভে এল। হাসু খোকাখুকির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পেলাম মনে হল। বুকটা কেঁপে উঠল। হঠাৎ ঠাস করে এক বিকট শব্দ। কিছু বোঝার আগেই চোখে সরষে ফুল দেখলাম। আর কিছু মনে নেই।
পরদিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল। তাও বউ-এর ডাকে। আজ কালীপুজোর ছুটি তাই অফিস যাবার তাড়াহুড়ো নেই।
‘কী ব্যাপার গো? ঘুমের রেকর্ড করে ফেললে যে। কতবার ডাকলাম উঠছই না। এর পরেও না উঠলে ডাক্তার ডাকতে হত।’
‘একি এত বেলা হয়ে গেছে? ডাক্তার কেন? শরীর তো ঠিকই আছে। আসলে ঘুমোতে কাল রাতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
তখনই গত রাতের কথা মনে পড়ল। সত্যিই কি বাবা-মা এসেছিলেন? আমি বিছানায় এলাম কীভাবে? বাইরের ঘরে গিয়ে দেখলাম সব কিছুই পাট পাট করে গোছানো। ডাইনিং টেবিলের নিচে হাসুখোকাদের জায়গাটাও খালি। কোন পালক বা পায়ের দাগও নেই। শুধু দেওয়ালে বাবা-মা দুজনের ছবিই অনেক বেশি উজ্জ্বল। তাদের হাসিও যেন আগের থেকে অনেক চওড়া। বাথরুমে দাড়ি কামাতে গিয়ে নিজের মুখ দেখে চমকে উঠলাম। আমার পরিষ্কার গালে দগদগে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ আর সাথে একটা চিনচিনে ব্যথা। কিন্তু আমি তো এতক্ষণ কিছু টের পাইনি। কোন ব্যথাও ছিল না। তবে?
চিন্তিত মনে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বউকে জিজ্ঞেস করলাম--‘দেখো তো, গালে কিছু হয়েছে কিনা? কোন দাগ দেখতে পাচ্ছ? বউ ভালো করে দেখে বলল ‘না তো? কিছুই তো দেখছি না। এমন কি মশার কামড়ের দাগও নেই। তোমার কী হয়েছে বলো তো? আজ বেশ অন্যমনস্ক লাগছে?’
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। যাক বাবা কোন দাগ নেই। বাজারহাট করে পাঁঠার মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। অনেক দিন পর গান শুনলাম অনেকক্ষণ।
কী হল দাদা আগে চলুন। ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? দেখি এক ট্রাফিক পুলিশ লাঠি দিয়ে গাড়ির জানলার কাঁচে ঠক ঠক করে শব্দ করছে। পেছনের গাড়িগুলোর হর্নের শব্দে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। সামনে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় তিরিশ সেকেন্ড আগে সিগনাল সবুজ হয়ে গেছে। অ্যাক্সিলেটরে পা দিয়ে চাপ দিতেই গাড়ি এগিয়ে চলল। সাথে চলল গালে ফুটে ওঠা অদৃশ্য আঙ্গুলের দাগ।