“কবিতা আমার ওষ্ঠ কামড়ে আদর করে
ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে যায় ছাদের ঘরে—-”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অমোঘ দুটি লাইন বোধহয় সব কবিতাপ্রেমীর মন ছুঁয়ে যাওয়া দখিনা বাতাস। কৈশোরে আমার কবিতার প্রতি টান দেখে আমার ঘোর কবিতাবিদ্বেষী বাল্যবন্ধু রঞ্জন বলে উঠেছিল, তোর অবস্থা হয়েছে,
“বেগুন গাছের নিচে বসে,
ভাবি সমুদ্রটা চানাচুর”
আমি ওকে বলেছিলাম, চিত্রকল্পটা সুবিধের না হলেও লাইন দুটোয় বেশ ছন্দ আছে, তোর মতন ছন্দ বেরসিক এই লাইন দুটো বলতেই পারে না, তুই এটা ঝেড়েছিস। সেটা অবশ্য ও স্বীকার করল না, তবে অচিরেই ওর কবিতা বিরোধিতায় ছন্দপতন হল, দুম করে প্রেমে পড়ে গেল আর প্রেমপত্র লেখার জন্য আমার কাছেই আসতে হত। বিগত শতাব্দীর আশির দশকের প্রথম ভাগের সেই সময়ে কবিতা কোট না করে প্রেমপত্র লেখা যেত না, লিখলে তা প্রেমপত্রের মর্যাদা পেত না। আমি তখন একটু-আধটু কাব্য চর্চা করার সুবাদে অনেক বন্ধুরই প্রেমপত্র লিখে দিচ্ছি আর বিখ্যাত কবিদের সঙ্গে সঙ্গে নিজের কবিতাও (ওগুলো কিছু হচ্ছিল না, তা বোঝার মতো ক্ষমতা তখন ছিল না) কিছু কিছু গুঁজে দিচ্ছি। তা আমার সেই কবিতা পণ্ডিত বন্ধু রঞ্জনের কাছে পৃথিবীর সমস্ত কবিতাই ছিল আমার কবিতা। কবি নামক একটি বিচিত্র জীবকেই সে চিনত, আর সেটা আমি। তার কিশোরী প্রেমিকার কোনও কবিতা ভালো লাগলে যদি জিজ্ঞাসা করত কার কবিতা? তবে বন্ধুবর অম্লান বদনে আমার নাম করে দিত। পরে একদিন সেই মেয়েটির কথা শুনে বুঝতে পারি সুনীল, শক্তির বহু বিখ্যাত কবিতা রচনার কৃতিত্ব নিজের অজান্তেই আমার ওপর বর্তেছে। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর এই দু’জন মহাকবিই আমার কৈশোরকে সব থেকে প্রভাবিত করেছিলেন। আর তা কবিতার কারণে এবং কবিতা বহির্ভূত তাদের বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা, উভয়ের জন্যই। যদিও পরবর্তী সময়ে আমার মনে হয়েছে স্কুল জীবনে কাশিরাম দাসের ‘মহাভারত’ পড়েই ছন্দের প্রতি আমার প্রথম অনুরাগ জন্মায়, আর সেখানে প্রেমরসের থেকে বীররসের প্রতিই বেশি অনুরক্ত ছিলাম। মনে আছে জরাসন্ধ বধের বর্ণনা,
“এক পদে পদ দিয়া,
অন্য পদে কর, হুঙ্কারিয়া
টান দিল বীর বৃকোদর।”
অথবা, দুর্য্যোধন ভীমের গদাযুদ্ধের বিবরণ,
“দুর্য্যোধন-অঙ্গে, ভীম মহারঙ্গে
করে গদার ঘাতনি।।
মহা গদাঘাত, খেয়ে কুরুনাথ
পড়িল ধরণীতলে।”
যাইহোক ফেরা যাক কৃত্তিবাসীদের কথায়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের গোড়ায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী এবং দীপক মজুমদারের যৌথ প্রয়াসে শুরু হয় কৃত্তিবাস কাব্য পত্রিকার পথ চলা। পরে সুনীলেদের সঙ্গে যোগ দিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এই গোষ্ঠীর লেখকদের তখন কৃত্তিবাসী আখ্যা দেওয়া হত। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় কবিতা লিখতেন না তবু তিনি কৃত্তিবাসী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন, আবার কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম কবিতা হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছিল শঙ্খ ঘোষের দশ-বারো পৃষ্ঠার দীর্ঘ কবিতা, ‘দিনগুলি রাতগুলি’। তবু তিনি কৃত্তিবাসী হিসেবে পরিচিত নন। কৃত্তিবাসীদের সেই তুমুল জীবনযাপন থেকে দূরে থেকেছেন শঙ্খ ঘোষ।
সুনীল এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে কৃত্তিবাসীদের মধ্যমণি ছিলেন। কৃত্তিবাসীদের কবিতার সঙ্গে সঙ্গে, তাঁদের রাত্রি যাপন এবং বোহেমিয়ান জীবনধারা, তাঁদের জীবদ্দশাতেই মিথে পরিণত হয়। তারাপদ রায় অবশ্য কখনও এইসব রাত্রিকালীন অভিযানে সুনীলদের সঙ্গী হতেন না।
কৃত্তিবাসীদের সেইসব দুরন্ত জীবন (রাত্রি) যাপন তখন কৈশোর আর প্রথম যৌবনের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা আমার জীবনকে প্রবল ভাবে প্রভাবিত করেছিল, সঙ্গে আমার অন্যান্য কবিতাপ্রেমী এবং কবিতার সঙ্গে সম্পর্করহিত বন্ধুদেরও। আমরা ভাবতাম ওরকম দামাল জীবন যাপন করতে পারলেই বোধহয় ভালো কবিতাও লেখা যায়। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া কবিতার লাইন,
“মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক”
পড়ে আমরাও বাড়ির চোখ রাঙানি এড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছি মধ্য রাতে কলকাতা শাসন করতে, আর হাড়ে হাড়ে বুঝেছি ব্যাপারটা খুব সুবিধের নয়। কয়েকটি কমবয়সী ছেলেকে মধ্যরাতে পুলিশ, সমাজবিরোধী এবং রাতপরীরা কেউই সুবিধার চোখে দেখে না। রাত শেষে হা ক্লান্ত ঘরে ফিরেছি পকেটে খুচরো পয়সা আর খালি চারমিনারের দোমড়ানো প্যাকেটে শেষ সিগারেটকে সম্বল করে। কলম দিয়ে কবিতা বেরোয়নি।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের,
“এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে: আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে: আয় আয়”
পড়ে, গঙ্গার ধারে মহাশ্মশানে জাগ্রত অবস্থায় দাঁড়িয়েই চাঁদ আর চিতাকাঠকে আয় আয় ডাক পাঠিয়েছি, সে এক খাদের কিনারেই দাঁড়িয়ে থাকা বটে।
‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ কাব্যগ্রন্থের আর একটি কবিতা, ‘কিছুতে মেলেনি’ পড়ে নেশা করে চেষ্টা করেছি যদি আমিও দু’দিনের জায়গায় অন্তত একদিন নিজের বাড়িটি না খুঁজে পাই। তবে তা হয়নি, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছি রাতশেষে। বিভিন্ন অজুহাতে সেসব রাত বাড়ির বাইরে কাটানো। কখনও অমুক অসুস্থ, হাসপাতালে ছিলাম। কখনও তমুক মারা গেছে শ্মশানে গেছিলাম। সত্যি সত্যিই সেইরকম ঘটনা ঘটত, তবে একবারকে আমরা পাঁচবার বলে রাতে বেরিয়ে পড়তাম।
আর এইসব দামাল রাতগুলোয় টের পেতাম,
“পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে দেয়ালে দেয়াল, কার্নিসে কার্নিস, ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে”।
সব থেকে কেলেঙ্কারি কাজ করে বসেছিল আমার বন্ধু শ্যামল। শক্তির, ‘অবনী বাড়ি আছো’ পড়ে পাড়ার স্কুলমাস্টার অবনীবাবুর বাড়ি মাঝরাতে গিয়ে কড়া নেড়ে চিৎকার করে আবৃত্তি শুরু করল,
“দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’”
পাড়ায় হুলুস্থুল কাণ্ড। শ্যামলকে চেপে ধরায় বলল, অবনীবাবু স্কুলমাস্টার হলেও কোনও কালচার নেই, “ইট ওয়াজ আ ট্রিবিউট টু শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আরে বাবা শক্তি ওনার নামে কবিতা লিখে যে ওনাকে অমর করে দিল সেটা উনি বুঝলেনই না! রাতের কড়ানাড়াটাই দেখলেন!” অকাট্য যুক্তি।
সুনীলের লেখায় পড়লাম, ‘খালাসীটোলা’ আর ‘বারদুয়ারি’ নামক দুই বাঙলা মদের ঠেকে তাঁদের অভিযানের কথা, আমরাও সেই দুই ঠেকে হাজির হয়ে গেলাম, তবে বাঙলা মদটা ঠিক সহ্য হল না, রীতিমতন চোখে ধাঁধাঁ দেখেছিলাম। লিখে ফেললাম,
‘খালাসীটোলা না বারদুয়ারি,
আবছা একটা আলোআঁধারি।
‘দেবা’ সুনীল, তো ‘বাবুন’ শাক্ত, (শক্তির অনুরাগী)
আমি আবার সুরায় আসক্ত।’
প্রথম দুটো লাইন তখন বন্ধুদের মুখে মুখে ঘুরত, বাঙলা মদ খেয়ে সত্যি সবাই চোখে আলোআঁধারি দেখেছিলাম।
স্কুল বাস থেকে প্রেমিকা নেমেছে, আমি ওর জন্য লেখা আমার কবিতা বুক পকেটে নিয়ে ফিরে এসেছি। আমার কবিতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে সুনীল মাথার মধ্যে মন্ত্র আওড়েছেন,
“বাসস্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ দেখেছি ছুরির মতন বিঁধে থাকতে, সিন্ধুপারে - দিকচিহ্নহীন--”
আবার চানঘরে শরীরময় তুমুল ঝড়ের সময়, হাত সরিয়ে নিয়েছি। সুনীল বলে উঠেছেন,
“এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?”
মনে মনে চিত্রকল্প এঁকে গেছি, একদিন সুনীলের উচ্চারণে প্রেয়সীকে বলব,
“কোনো ঘরে জায়গা নেই, তুমি আমাকে
বসতে বললে সিঁড়িতে
আঁচল দিয়ে ধুলো মুছতে যাচ্ছিলে, আমি বললাম, থাক!
আমার মুখের ঘাম মোছার ইচ্ছে ছিল ঐ আঁচলে।”
আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মোছার ইচ্ছে ছিল খুব, তারচেয়েও ইচ্ছে ছিল শব্দগুলি উচ্চারণের; সুযোগ হয়নি।
তারপর জীবনে বিচ্ছেদ এসেছে, সুনীল সেখানেও ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়েছেন,
“প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়
আমি মানুষ হিসেবে একটু উঁচু হয়ে উঠি
দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়,
যেন ভোরের আলোয় নদীতে স্নানের মতন স্নিগ্ধ।
সমস্ত মানুষের থেকে আমি অন্য দিকে
আমার আলাদা পথ
আমার হাতে পৃথিবীর প্রথম ব্যর্থ প্রেমিকের উজ্জ্বল পতাকা।”
আবার মন খারাপের বৃষ্টিপাতে শক্তি এসে হাত ধরেছেন,
“বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা
হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছ আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে--অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে।”
এখন রঞ্জন চাকরি সূত্রে দিল্লীতে থাকে, আজকাল আর ওর প্রেমপত্র লেখার দরকার পড়ে না, প্রেমিকা এখন অতিশয় গিন্নী, দুই ছেলের মা, ছেলেরাই চাকরিবাকরি করছে। তাই রঞ্জনের কবিতা নিয়ে টিপ্পনিও ফিরে এসেছে। গত রবিবার ফোন করে বলল, কি রে কবি এখনও বেগুন গাছের নিচে বসে চানাচুর খাচ্ছিস?
ওকে কী করে বোঝাই, সুনীল তো কবেই বলে দিয়েছেন,
“শুধু কবিতার জন্য আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা,
শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।”