মাত্র ২৭ বছর ৮ মাস আর কয়েকদিন বেঁচেছিলেন ডেনমার্কের কবি মাইকেল জেনসেন স্ট্রাঙ। তাঁর জন্ম ডেনমার্কের রোডোভ শহরে বেস্পতিবার ১৯ জুন ১৯৫৮ সাল, আমাদের ১৯৮০ দশাব্দের কবিদের সমবয়েসি। অপূর্ব এক ভাষা-প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি — শব্দের চকমকি ঠুকে জ্বালাতেন কাব্যের বিদ্যুৎ। অন্তর্দৃষ্টি, কল্পনাশক্তি আর স্বপ্নবিভাব তাঁর কবিতার তিনটি স্তম্ভ। গভীর মানসিক বিষাদে (Clinical Depression) ভুগতেন তিনি নিয়মিত; দ্বিমেরু ব্যধির (Bipolar Disorder) কবলে পড়ে পছন্দ করতেন নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা — এড়িয়ে চলতেন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার ফলে অখণ্ড ক্লান্তি আর ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিরক্তি ছিল তার মেজাজে। রবিবার ৯মার্চ ১৯৮৬ তিনি চারতলার ঝুলবারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর ন’বছর পরে প্রকাশিত হল তাঁর কবিতা সমগ্র — কবির নামের সঙ্গে শব্দ কৌতুক (Pun) জুড়ে সংগ্রহের নাম — ‘ছিলা টানটান — কবিতা ১৯৭৮-১৯৮৫’ (ডেন ভাষায় ‘SamledeStrunge- digite 1978-1985’; ইংরেজিতে ‘Totally Strung- Poems 1978-1985’)। সাত বছরে স্বনামে প্রকাশিত এগারোটি কাব্যগ্রন্থ; ‘মার্কাস হিটেঙ্গেল’ এবং ‘সাইমন ল্যাক’- এই দুটি ছদ্মনামে প্রকাশিত কবিতা; এবং অপ্রকাশিত, অগ্রন্থিত আরো অজস্র রচনা নিয়ে মোট ১০০১ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থ। পরবর্তী এক দশকে গ্রন্থটি বারবার উঠে এসেছে বেস্টসেলারের তালিকায়। কোপেনহাগেন শহরের আসিস্টেন্সগোর স্থানে অবস্থিত তাঁর সমাধিস্থলটি তরুণ কবিদের তীর্থস্থান। অনুরাগীদের কাছে তাঁর মৃত্যু ডেনমার্কের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতির (Punk Culture) এর যথাযোগ্য অন্তিম অধ্যায়।
র্যাঁবোর সঙ্গে তুলনাটি একেবারেই হাল্কাভাবে করা নয়। ১৮৫৭ সালে শার্ল বোদলেয়ার এক ‘ক্লেদজ কুসুম’ (“ল্য ফ্লর দ্যু মাল”) কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রানস ও বেলজিয়ামের শিল্পে ও সাহিত্যে প্রতীকবাদী (symbolist) আন্দোলনের সূচনা। কৈশোর থেকেই র্যাঁবো সেই আন্দোলনের পুরোভাগে। স্ট্রাভ নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন চরম প্রতীকবাদী (super-symbolist) কবি হিসেবে। তাঁর সপ্তম কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত “পপসঙ্গীত” (“Pop songs”) এর ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, “I wanted to see how far I could go, how much pressure could be withstood by a super-symbolist vision, using all the classical concepts of heaven and hell and queen and prince, before the embalmed world of beauty in the first section is smashed to pieces in depression and suicide poems in the second half.”
দুজনেরই উত্থান ধূমকেতুর মতন এবং মোমবাতির দুই প্রান্ত জ্বালিয়ে আলোকিত করা নিজেদের; দুজনেরই বিদ্রোহ সুখী, মধ্যবিত্ত চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে; দুজনেই বিশেষভাবে প্রসারিত করেছেন কাব্যভাষার দিগন্তকে; দুজনেই বিসর্জন দিয়েছেন শারীরিক আরাম ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য কে; আত্মবিশ্বাস-এ অহমিকার অন্ত ছিল না দুই কবিরই। স্কুলে পড়ার সময় প্রকাশিত এক চমকপদ প্রবন্ধে স্ট্রাঙ লিখেছিলেন, “Art is an extension of reality, an expansion, an education, an excursion, a panorama; it is a window that is opened by the artist and shows everything from hidden dreams across new horizons to signs in the stars of other possibilities.” শিল্পীর দায়িত্ব এবং কর্তব্য হল বাস্তবতার জাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তায় কলমের আঁচড়ে বা পেইন্টব্রাশের টানে নতুন এক অলৌকিক বাস্তবের নির্মাণ।
১৯৭৭ সালে হাই স্কুলের লেখাপড়া সমাপ্ত করে মাইকেল স্ট্রাঙ যান কোপেনহাগেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে- সেখানে শিক্ষার বিষয় শিল্পতত্ত্বের ইতিহাস বা Art History। তখনই তরুণ কবি হিশেবে তাঁর সুনাম এবং মানসিক জটিলতার সূত্রপাত; বাস্তব জগত এবং কল্পনার জগতের সীমারেখাটি তাঁর অবচেতনে প্রথম থকেই ক্ষীণ — সেখান থেকেই তাঁর কবিতার প্রধান অনুপ্রেরণা। ছ’মাসের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকলো তাঁর চিরকালের মতন — শেষ হল লেখাপড়ার সঙ্গে জড়িত এক ঘেয়েমি, ক্লান্তি আর বিরক্তি। তাঁর নিজের ভাষায়, “What I experienced in those six months was that in no time the students had acquired their teacher’s language and adopted their views.”
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জীবনের গতি” (“The pace of life”) — নাম কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করেছি আমি। তাঁর শব্দ ব্যবহারে অনেক সময়ই আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত; ভাষা অমার্জিত ও অসংবদ্ধ; হঠাৎ হঠাৎই শেষ হয়ে যায় কাটা কাটা কবিতার পংক্তি। কোথাও যেন যেতে হবে তাঁকে, বিনা কারণে দেরি হয়ে যায় — মরিয়া ও বেপরোয়া তিনি এগিয়ে চলেন অনাগত ভবিষ্যতের দিকে—
“জীবন আমাকে বদলানোর আগেইর্যাঁবোর মতই তিনি অকালে পরিণত এবং বিদ্রোহী — তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে দ্রুত, এক নিঃশ্বাসে কবিতা থেকে কবিতায় পা ফেলেছেন তিনি। একবার চব্বিশ ঘন্টা সময়ের মধ্যে রচনা করেছেন এক ডজন উচ্চমানের কবিতা — সেটাই তাঁর ব্যক্তিগত রেকর্ড। জানিয়েছেন, “It was like tapping on a wall until it breaks and everything suddenly crowds into my head.” চলল তাঁর কবিতা রচনা কখনও মানসিক অসুস্থতার তাড়নায়, আবার কখনও নিষিদ্ধ ভেষজ দ্বারা প্রণোদিত। সমাজের প্রান্তদেশবাসীদের সঙ্গে তাঁর আলাপ, মেলামেশা, ওঠা বসা (এবং অবশ্যই শোওয়া!)। সামাজিক স্থিতাবস্থা বা Status Quo এর বিরুদ্ধে তাঁর আমরণ যুদ্ধ- তাকে নিকেশ না করা পর্যন্ত শান্তি নেই।
আমি বদলাবো তাকে”
১৯৮০ সালে প্রকাশিত হল পরপর দুটি কাব্যগ্রন্থ: প্রথমে “ভবিষ্যতের স্মৃতিরা” (“Future Memories”) এবং তার পরে “জার্নের মুনশি” (“Recorder of Gerne”)। আশি জন তরুণ কবি সাহিত্যিক, শিল্পী, চিত্রপরিচালক মিলে একটি দল গড়ে তুললেন তিনি, নিজে নেতৃত্বে দিলেন তার; “এক দানা গম” (“A Grain of Wheat”) নামে একটি নিরীক্ষামূলক সাহিত্যপত্রের প্রকাশ শুরু হল ওই একই বছর — যুগ্মভাবে সম্পাদনা করলেন আরেক তরুণ কবি পল বোরাম এর সঙ্গে। দলটির নাম দিলেন “জয় হোক”! ৮০!” (“ACHIEVE! 80!”) — তার দপ্তরে কোপেনহাগেনের সম্ভ্রান্ত অঞ্চলে একটি গৃহে।
পরের বছর ১৯৮১ সালে বেরুল তাঁর মৌলিকতম এবং চরম সম্ভাবনাময় কাব্যগ্রন্থ “আমরা স্বপ্ন ভাঁজ করে করে উর্দি বানাই” (“We folder tabs out of Dreams”)। এখানে তিনি খানিকটা পথ বদলে আন্দ্রে ব্রেতঁর ভাবশিষ্য। ১৯২৪ সালে ব্রেতঁ রচনা করেন “পরাবস্তুবাদী ইস্তেহার” (“Manifesto of Surrealism”) — সেখান থেকেই পরাবস্তুবাদী বা surrealist সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রপাত। গ্রন্থের ভূমিকায় কবি উদ্ধৃত করলেন তাঁর গুরুর মহাগ্রন্থ থেকে — “Pure psychic automatism with the aim of expressing orally, in writing, or in any other way, the real function of thought, the dictation of thought, beyond the control of reason, beyond any aesthetic or moral consideration”. র্যাঁবোর প্রতীকবাদের মতনই ব্রেতঁর পরাবস্তুবাদকে তিনি অনেকটা নতুন রূপ যোগ করে প্রোথিত ডেনমার্কের রুক্ষ, তুষারাবৃত প্রান্তরে।
আবার সেখান থেকেও সরে এলেন তিনি, পাহাড়ের পথে তীক্ষ্ণ এক বাঁক নিল তাঁর কাব্যরীতি। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হল দুটি কাব্যগ্রন্থ, যাদের নিজেদের অবস্থান কবিতার মানচিত্রের দুই সুদূর মেরুপর্বতে এবং শুধু তাই নয় আগের রচনার চেয়ে সর্বতোভাবে ভিন্ন। প্রথম গ্রন্থটি “রাতের শরীর ছেড়ে” (“out of the night”) — ব্যক্তিগত পর্যেবেক্ষণ, স্বপ্নমালা এবং মানসিক সংকটের বিহ্বলতার কবিতা। দ্বিতীয়টির নাম “আমি কেলোভূত, আমার নগ্ন হৃদয়, অপরিষ্কার কবিতা” (“Nigger I, My naked Heart, Unclean Poems”) — উদ্যত মুঠি, রক্তবর্ণ ক্রোধ, নৈরাজ্যবাদী চিৎকারের কবিতা — আকারে দীর্ঘ এবং শব্দ ব্যবহারে অতি-অভিনব। কবিতাগুলির অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। তিনি লিখলেন, “I have reached a point Where I did not care one bit about any kind of form. I had an enormous supply of rage and appetite for life. Metaphorically of the night, Knocking everything over in the sitting room and then tidying up again”। চরম ক্রোধের দ্বিতীয় পর্ব হল আরো একটি গ্রন্থ “আমি কেলোভূত, আমার নগ্ন হৃদয়-২, কাঁচা মাংসের মতন কবিতা ও নোংরা ভাবনাচিন্তা” — ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত। তিনি হুমকি দিলেন, কবিতা লেখা ছেড়ে দেবেন খুব শীগগীর — তাঁর সব কবিতার নীচে একটি সজীব বোমা রেখে দিয়ে দূরে চলে যাবেন নিরাসক্ত ভাবে।
কবিতা লেখা বন্ধ না হলেও ঘটল তার প্রধান দিগ্বদল “পপসঙ্গীত” কাব্যগ্রন্থের প্রকাশে — এখানে তাঁর কন্ঠস্বর মধুরতর — প্রেমের বা কোমলতার কথা বলতে তাঁর দ্বিধা নেই। তিনি সন্ধান পেয়েছেন নতুন পথের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবেন তা অনিশ্চিত। কবিতাকে ছেড়ে যাবার কথাও ঘুরছে তাঁর মাথায়। ভূমিকায় তিনি লিখলেন, “Suddenly I seemed to see a special aesthetic in this, a glittering symbolic universe, which I could write as a pastiche until it collapsed halfway through the book.” এই গ্রন্থে তাঁর কবিতা সুবোধ্য, নিরীক্ষাময় ভাষা সত্ত্বেও সহজ পাঠ্য এবং অনুবাদ সাপেক্ষ। এক অন্তিম প্রশান্তির দিকে তাঁর অমোঘ যাত্রা। পরের বছর ১৯৮৪ সালে তাঁর রাজহংস-সঙ্গীত (Swan Song) — অন্তিম কাব্য গ্রন্থ “ডানা মেলে উদ্যত” (“Armed with Wings”) — পপসঙ্গীতের প্রশান্তি এখানে আরো গভীর এবং বিস্তৃত, তাঁর ছ’বছরের কবিজীবনের একীভবন। কবিতাকে ছেড়ে যাবার চিন্তাও চলেছে — “It is a complete fusion in the course of a year when I was constantly considering giving up writing; it bring together different styles, loosely composed like a diary.” ভাষাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলার পর তার প্রেমে পড়েছেন তিনি।
এর পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও অল্পস্বল্প লেখা চালিয়ে গেলেন তিনি অস্থির, অশান্ত, বিভ্রান্তি ময় মানসিকতায়। “কল্পনা পিস্তল” (“Image Pistols”) নামে একটি কবিতার বইও বেরুল, কিন্তু ততদিনে যেন খেই হারিয়েছে কবিতার। ১৯৮৫ এর মাঝামাঝি নাগাদ কবিতা রচনা পুরোপুরি বন্ধ। ১৯৮৬ এর শেষ শীতের এক দিনে তিনি প্রেমিকা সেসিলিয়া ব্রাস্ককে বললেন, “জানো, আমি উড়তে পারি”, তারপর চারতলার ফ্ল্যাট থেকে উদ্যত ডানা মেলে ভেসে গেলেন হাওয়ায়। কয়েক সেকেন্ড লাগল মাটির পৃথিবীতে পৌঁছাতে।
বেন্তে এল্স্ওয়ার্থ এর জন্ম ডেনমার্কে, তবে ১৯৬৮ সাল থেকে ইংল্যান্ডে বসবাস। ডেন এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই সমান পারদর্শী। পূর্ব অ্যাঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য অনুবাদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে (M.A. in Literary translation) পঠনকালে তিনি প্রথম মাইকেল স্ট্রাভের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে ডিগ্রি শেষ করার পরও অনুবাদের কাজ চলে। ২০০০সালে ল্যাংকাশায়ারের আর্ক পাবলিকেশানস ৪২টি কবিতার দ্বিভাষিক সংস্করণ প্রকাশ করেন “শীতল দশাব্দের এক কুমারী” (“A virgin from a chilly Decade”) নামে। আমি সেখান থেকে দশটি কবিতা বেছে নিয়ে বাংলা অনুবাদ করেছি।
প্রণালী[Nearer]তুমি যদি সূর্য হও
আমি তোমার সাধের বুধগ্রহ
নিকট এবং ঘূর্ণায়মান
তোমার রশ্মির তাপে মরুভূমিপ্রায়
নিজ উন্মাদনায় ক্লান্ত হতে হতে মৃত্যুর কাছাকাছি।
তুমি যদি স্বর্ণ হও
আমি তাহ’লে পারদ
টুকরো হতে হতে তোমার শরীরে ছুটে বেড়াই
ক্লান্ত হও তুমি, ফাটতে শুরু কর ফট ফট
খশে শান্ত মুখশ্রী, বেরিয়ে আসে দুর্বার ক্রোধ।
[System]
যে শান্তি তুমি আমায় দাওযে শান্তি তুমি আমায় দাও
তা পার্ক করা গাড়ির শান্তি নয়।
শপিং মলের ফাঁকে ফাঁকে
নিদ্রাহীন পামগাছের শান্তিও নয়
সংবাদ বুলেটিন আর জনপ্রিয় সঙ্গীতের বিরতিতে
রেডিওর একঘেয়ে গুঞ্জনের শান্তি নয়।
এমন শান্তি নয়
যার তুলনা হতে পারে
খেলো, শৌখীন, ধূলিধূসর সামগ্রীতে সাজানো
জানালার নীরবতায়
মানুষের মুখের প্রতিফলনের সঙ্গে।
এই শান্তির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই
মাতা ও তাঁর পরিবারের
অথবা গ্রামের পথে ম্লান ভ্রমণে গিয়ে
সঠিক বিশ্বাস ও নির্ভুল পোষাকের তরুণদের নিয়ে
চুপচাপ সময় কাটানোর।
তোমার থেকে সেই শান্তি গ্রহণ করি আমি
যা তুমি আমায় দাও
এবং যে দৃষ্টি নিবদ্ধ তোমার মুখের ওপর।
[The Peace You Give me]
নিজেকে আমিনিজেকে আমি
পরমেশ্বরের অভিপ্রকাশ হিশেবে
নক্ষত্রখচিত আকাশের পুজোয় বসাই।
কিন্তু নক্ষত্রের কাছে প্রার্থনা করি না আমি
স্তবে তাদের গুণকীর্তনও না।
না, মাঝে মাঝে কেবল, চটপট
চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে নিই তাদের
যাতে আকাশ এবং নক্ষত্রের সাম্প্রতিক ছবিটা
সর্বদা আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।
এবং অতীব সুখের সঙ্গে বুঝতে পারি।
কোনদিন ঈশ্বরের হাতে
সমর্পণ করতে পারব না
তাঁর সৃষ্টিকে।
[I am allowing myself]
ডানা মেলে উদ্যতঅন্ধকারে দুশ্চিন্তায় আমি
নিজের ডিমে তা দিয়ে ফোটাই নিজেকে
আর ভ্রূপল্লব ছড়িয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতে
উড়ে যাই সোজা পরজন্মের দিকে।
[Armed with Wings]
দিন পড়ে যায় মেঝেয়দিন পড়ে যায় মেঝেয়
কাচ ভাঙার ঝন ঝন শব্দ
টুকরো টুকরো হয় সম্পূর্ণ চিত্রটি
আর দ্যাখো, ছেঁড়া খোঁড়া নকশাগুলো কিভাবে
ধীরে ধীরে নিজের নিজের জায়গায় গিয়ে বসে।
[Days dropped on the floor]
আলোকিত কক্ষে বসেআলোকিত কক্ষে বসে
আমি বাইরে অন্ধকার রাতের দিকে তাকাই।
আমার অভ্যন্তরেও ছড়ায় রাত
এবং সেই অন্তর্লীন আঁধারে
আমি জানালা দিয়ে দেখি
আরেকটি আলোকিত কক্ষকে।
কেউ নেই সেখানে, আলো একা এবং
তার পরিধি ঘিরে অন্তহীন আঁধার।
যদি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
কোন খোলা জানালার দিকে চাই,
নিজের অন্তর্লীন আঁধারে দেখা বস্তুগুলোই
দেখতে পাবো আবার।
[I sit in a lighted room]
জীবনের গতিআমার চিন্তাসূত্রের সঙ্গে
ঘড়িটাকেও ভাঙি—
বাঁচতে চাই আমি
জীবনের গতিতে
তাড়াতাড়ি পরে নাও
নতুন ছদ্মবেশ—
পালটাতে চাই আমি
জীবনের গতিতে
গড়ে তোলা প্রতিতুলনা
দরকার নেই মুখোশের —
নিজের মত বাঁচতে না পেরে
ক্লান্ত আর শ্রান্ত আমি
রঙ বদলাই আমি
নৈরাজ্যের বহুরূপী—
মুখোশ খুললেই
জীবনধারা পালটে যায়
আমার মনন
গজায় ঘিলুর গভীরে—
মত পরিবর্তনের কথা
ভাবব মৃত্যুর পরে
শেষ পর্যন্ত
এই কথা বুঝেছি—
অপরিবর্তনীয় নয়
আমার সত্তা
নিজেকে কি সবাই
আপন করে জানে?
আমি কেয়ার করি না —
বয়ে গেছে নিজের মতন হতে
বদলাও গতিবেগ
অন্য গতির জীবন কাম্য—
জীবন আমাকে বদলানোর আগেই
আমি বদলাবো তাকে
[The pace of Life]
সূত্রাবলীআমি বিশ্বাস রাখি খণ্ড ছিন্ন মেঘ
আর রাস্তা থেকে ভেসে আসা ব্যাখ্যার অতীত শব্দগুলিতে।
আমি বিশ্বাস করি ধাঁ করে সুপার মার্কেটে
শস্তার মাখন আর কিলো কিলো সার্ফের প্যাকেটের ফাঁকে
দেখা হয়ে যাওয়াতে, স্কুলের পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে।
আমি বিশ্বাস রাখি নৈশবেতারে
আমার কানের কাছে তার ভুলো মনা কন্ঠস্বর
বেশি রাতের স্থানীয় সংবাদের আগে
যে সমস্ত আজে বাজে গানবাজনা
তোমাকে জড়িয়ে থাকে ফেনার মতন।
এক চিলতেও বিশ্বাস নেই তোমার ওপর
কোন পরিমাণ লাম্পট্য বা কার্নাকানির বদনাম
আমার চিন্তাকে দূরে সরাতে পারবে না
সেই ফুটোফাটা রোববারগুলোর থেকে
যখন প্রেমের বুকনি সমেত গান পুরোনো ৭৮ আর পি এম
রেকর্ডের মতন খশখশ আর থেমে থেমে বাজে
তাতে ১৯৩৮ সালের কোন হিট গান
(যেটা ডিস্ক জকি ভুলতে পারে নি এখনো)।
আমি বিশ্বাস রাখি রাস্তায় জমা জলের অনিশ্চিত সঙ্গীতে।
কিন্তু বিশ্বাস করি না সেই সঙ্গীত
থামাতে পারে কাউকে
যে মানুষটা কাছের বিল্ডিঙের উঁচুতলা থেকে
ঝাঁপ দিতে চায় ব্যথাতুর, কুৎসিৎ মরণের আলিঙ্গনে।
তারা বিশ্বাস করে পিচ ঢালা পথের দৃঢ় গভীর চুম্বনে
তাতে আলোকময় জলরাশি খচিত থাক বা না থাক।
[Creed]।
বিদায়পেরিয়ে আসা বছরগুলির মতন, অথবা
রাতের ইনজিনের মতন ক্লান্ত আমরা।
শহরে হাঁটি দল বেঁধে
ভোরের মুখে দুই সারি গৃহের মাঝ বরাবর
হেলায় হারাই....
ধুলো আর প্রজন্মের ছদ্মবেশ।
অন্ধকারে জাগে তারা
আমাদের অনিদ্র হাসির পিছু পিছু।
দু চোখ ভরা নিশীথ নিয়ে
প্রবেশ করি আমরা
নতুন সহস্রাব্দে।
[Departure]
নিকটেপতনের অনেকটাই মিল মানবজীবনের সঙ্গে
গন্তব্যের নিকটে পৌঁছালে গতিবেগ বাড়ে
যা কাছে নয় তা মিলিয়ে যায় বহু গতিবেগের দূরত্বে
এবং স্বর্গ আর পৃথিবীর মাঝামাঝি
তুমি শীগগীর জানবে অলীক শূন্যতাকে
যখন স্বর্গ থেকে লাফিয়ে পড়তে পড়তে পড়তে
তোমার শরীর রকেটের মতন এগোবে মাটির দিকে
আর পৃথিবী ক্রমশঃ হাজির হবে নিকটে.....
সব কবিতাগুলির ডেন ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ — বেন্তে এল্স্ওয়ার্থ।