১৯০০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্ম হয় মধু বসুর। বাবা ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসু। মা কমলা বসু ছিলেন বিখ্যাত ‘ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক’ রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যা। ৬৩ নং ধর্মতলা স্ট্রীটের বাড়িটি ছিল সেসময় কলকাতার অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, কেশবচন্দ্র সেনের পরিবার, ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে তাঁদের আন্তরিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মধু বসু লিখছেন—“কেশবচন্দ্র সেনের বড়ো মেয়ে সুনীতিদেবী মার সহপাঠিনী ছিলেন। এই কারণে তাঁর ছোটো বোনেরা সবাই আমার মাকে তাঁদের বড়োদিদির মতোই দেখতেন। এই সম্বন্ধে মা নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন: “আপার সার্কুলার রোডে একটি অনাথ আশ্রম ছিলো (যেটি এখন ‘লিলি-কটেজ’)। যেখানে মিস পিগট নামে একজন মিশনারী মহিলা ও তাঁহার অন্যান্য ইংরাজ শিক্ষয়িত্রীরা ওপরে থাকিতেন। নীচের তলায় অনাথ বালিকারা থাকিত। বিলাত হইতে তখন যাঁহারা ফিরিয়া আসিতেন, তাঁহাদের স্ত্রী ও ছোট ছেলেমেয়েদের থাকিবার নিমিত্ত মিস পিগট ফ্যামিলি কোয়ার্টার্স খুলিয়াছিলেন। মা, আমি এবং আমার তিন বোন, বিমলা, অমলা ও সরলা সেই ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকিতাম। মা ওখানে থাকিয়া মিশনারী মেমদের কাছে ইংরাজি ও সেলাই ইত্যাদি শিখিতে আরম্ভ করিলেন। মিসেস বি. এল. গুপ্ত ও তাঁর লটি নামে এক কন্যা ও সতীশ নামে এক পুত্র আর একটি ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকিতেন। সেই সময়ে সুনীতিদেবী ও তাঁহার এক ভগিনী আমাদের ওখানে পড়িতে আসিতেন। তখন তাঁহার সহিত আমার প্রথম আলাপ হয়। ওঁরা তখন কলুটোলায় থাকিতেন। এগারটার সময়ে আচার্য কেশবচন্দ্র সেন তাঁহাদের স্কুলে রাখিয়া যাইতেন এবং বিকেল চারটের সময়ে লইতে আসিতেন। আমরা সারাদিন এক শিক্ষকের কাছে পড়িতাম। অল্পদিনের মধ্যেই কুচবিহার মহারাজার সহিত সুনীতির বিবাহের প্রস্তাব আসিল। বিবাহের সব যোগাড় হইলে তাঁহারা কুচবিহারে চলিয়া গেলেন। ...
সুনীতি দেবী মাকে নিজের বোনের মতো দেখতেন বলে তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত (রাঁচিতে ১৯৩২ সনের শেষের দিকে ইনি দেহত্যাগ করেন) মার সঙ্গে সেই সম্বন্ধই বজায় রেখেছিলেন।” (পৃ: ১৮-১৯)
মধু বসু ছোটো থেকেই ছিলেন খেলাপাগল। ফুটবল খেলার নেশা এমন পেয়ে বসেছিল তাঁকে, রাঁচি থেকে হাজারিবাগ প্রায় ৭০ মাইল পথ পেরিয়ে খেলতে যেতেন তিনি। বাঁকুড়ায় পড়ার সময় ফুটবল, হকি, ক্রিকেট—‘সব বিভাগের ক্যাপ্টেন’ হলেও খেলাধুলোয় মন ভরছিল না। কলকাতায় যাবার অজুহাত হিসেবে বাঁকুড়ায় সায়েন্স নিয়ে পড়ার পরিকাঠামোগত অসুবিধার কথা জানালেন তিনি অভিভাবককে। প্রমথনাথ বুঝতে পারলেন ছেলের ইচ্ছে। তিনি ‘অনিচ্ছার সঙ্গে মত দিলেন।’ ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা দেবার পর মেট্রোপলিটান কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হলেন মধু বসু। সেসময় মেট্রোপলিটান ফুটবল টিমের গোষ্ঠ পাল, নগেন কালি প্রমুখ খেলোয়াড়ের উল্লেখ করেছেন লেখক। ১৯১১ সালের মোহনবাগানেরর শিল্ড বিজয়ী টিমের সদস্য রাজেন সেন ছিলেন ‘আমাদের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন।’ খেলার সূত্রেই আসে কোচবিহারের কথা—“কলকাতার ফুটবল মরশুম শেষ হলে আমরা খেলতে যেতাম বাইরে—মুর্শিদাবাদ, তাজহাট, ঢাকা, কুচবিহার প্রভৃতি জায়গায়। একবার কুচবিহারে খেলতে গেছি। কুচবিহার টিমে বেশির ভাগই মোহনবাগানের ভূতপূর্ব খেলোয়াড়েরা ছিল, যেমন শিবদাস ভাদুড়ি, বিজয় ভাদুড়ি, সুকুল, কানু, অভিলাষ প্রভৃতি। আমরা সব একসঙ্গে চলেছি এক কামরায় নরক গুলজার করে। কামরার মধ্যেই সুরার স্রোত বয়ে যাচ্ছে—তখন আমার বয়েস কতই বা—আঠারো বছর হবে। এইসব নামকরা স্পোর্টসম্যানের এই দৃষ্টান্ত চোখের সামনে দেখে আমার তরুণ মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছিল যে, ভালো স্পোর্টসম্যান হতে গেলে এই রকম না করলে চলে না। এইটাই রীতি বা ফ্যাশান। তার ওপর কুচবিহার মহারাজার অতিথি হয়েছিলাম আমরা—সেখানে তো খাদ্য ও পানীয়ের ছড়াছড়ি। সুতরাং আমিও এর প্রভাব থেকে বাদ পড়লাম না।” (পৃ: ৪১) মধু বসু ‘আমার জীবন’ আত্মকথা লেখার শুরুতেই অসম্ভব সুন্দরভাবে বলছেন—“... লিখতে গিয়ে ভাবছি আমার জীবন তো শুধু আমার একলার জীবন নয়, আমার জীবনের সঙ্গে যে আরও অসংখ্য মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে, তাদের সকলের কথা কি আমি অকপটে আর অসংকোচে বলতে পারব? সে অধিকার কি আমার আছে?” (পৃ: ১৫) অকপট সত্যি কথা বলতে গিয়ে কাউকে অজ্ঞাতে আঘাত করার প্রশ্নটিও তাঁর মনের মধ্যে ছিল। এই সুখপাঠ্য রচনা থেকে মধু বসুর বিচিত্রগামী প্রতিভা সম্বন্ধে যেমন আমরা অবগত হই, তেমনই মনে হতে থাকে তিনিই এই সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার প্রকৃত অধিকারী। নিজের কথা বলতে গিয়ে অসংখ্য মানুষদের কথা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, যা আমাদের অমূল্য সম্পদ।
মধু বসুর সিনেমায় পদার্পণ ঘটেছিল আকস্মিকভাবেই। সে সময় সিনেমায় কাজ করাকে ভালো চোখে দেখা হত না। অভিনয়ের ব্যাপারে কমলা দেবীর উৎসাহ ছিল আগে থেকেই। প্রমথনাথ বসু জানতেন ছেলের জেদের কথা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি ক্ষুণ্ণ ছিলেন। কিন্তু আপত্তি করলেন না সুকুমারের ইচ্ছেতে। জানিয়ে রাখা ভালো, মধু-র প্রকৃত নাম ছিল সুকুমার। মি. অস্টেনের পরিচালনায় তিনি ‘লাইট অফ এশিয়া’ ছবিতে কাজ করলেন। ফিল্মের কাজের আগ্রহে পাড়ি জমালেন বিদেশে। ‘লাইট অফ এশিয়া’ ছবি চলাকালীন বিরতিতে বক্তৃতা দিতে হত। সেখানে তিনি ভারত সম্বন্ধে কৌতূহলী করে তুলতে চাইতেন বিদেশের মানুষকে। বিখ্যাত পরিচালক মি. হিচ্ককের ইউনিটে হাতেকলমে ফটোগ্রাফির অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলেন দেশে। রাঁচিতে এসে গিরিশচন্দ্রের ‘প্রহ্লাদ-চরিত্র’ অবলম্বনে ‘প্রহ্লাদ’ নাটক অভিনয়ের প্রস্তুতি নিলেন এবং সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থও করলেন বাড়ির বারান্দায় স্টেজ বানিয়ে। কলকাতার গ্লোব থিয়েটারে ‘প্রহ্লাদ’ মঞ্চস্থ হয় ১৯২৭ সালের ৭ জানুয়ারি। মধু বসু জানাচ্ছেন—‘নাট্যজগতে এই আমার প্রথম পদক্ষেপ’। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের নাতি ক্যাপ্টেন কুণাল সেনের সঙ্গে দেখা হয় মধু বসুর। তিনিই তাঁকে প্রস্তাব দেন একটি ফিল্ম তুলতে। তাঁর কথায় জানা যায় গবর্ণর লর্ড লিটন যাচ্ছেন কোচবিহারে শিকার করতে। তিনি মহারানি ইন্দিরা দেবীকে বললে হয়ত তিনি রাজি হয়ে যাবেন। মধু বসু জানাচ্ছেন—“এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ইন্দিরা মহারানি ছিলেন বরোদার গাইকোয়ারের কন্যা। কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুরের দ্বিতীয় পুত্র জিতেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল এঁর। মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ মারা গেলে ইন্দিরা মহারানি কুচবিহার রাজ্যের ‘রিজেন্ট’ রূপে সমস্ত কার্য পরিচালনা করেছিলেন—কারণ বর্তমান মহারাজা তখন ছিল নাবালক।
কুণালদা এবং মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন মামাতো-পিসতুতো ভাই—কাজেই কুচবিহার রাজপরিবারের সঙ্গে কুণালদার যথেষ্ট হৃদ্যতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল।” (পৃ: ১০৪) আমুদে দিলখোলা কুণাল সেনের প্রশংসা করেছেন লেখক। মূলত তাঁর সৌজন্যেই মধু বসু স্বাধীনভাবে প্রথম ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করবার সুযোগ পেলেন। কুণাল সেনের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন মহারানি ইন্দিরা দেবী। এর পরের কথাগুলো কথকের মুখেই শোনা যাক —
কুচবিহার থেকে ১০/১২ মাইল দূরে একটি গভীর জঙ্গলে আমাদের ক্যাম্প পড়ল। রাজা-রাজড়ার ব্যাপার—সে কী এলাহি কাণ্ড। রোজ সকালে হাতিতে চড়ে বেরুতাম। এই জঙ্গলের বিশেষত্ব ছিল, বড়ো বড়ো ঘাসে প্রায় মানুষ কেন হাতি পর্যন্ত ঢাকা পড়ে যেত। হাতির ওপর হাওদাতে আমি ক্যামেরা ঠিক করে তৈরি থাকতাম। লর্ড লিটন ও মহারানি ইন্দিরাদেবীর হাতির ঠিক পেছনেই আমাদের হাতিটা যেত। আমার সঙ্গে ছিল সাবেদ আলি—কুচবিহার মহারাজার অস্ত্রাগারাধ্যক্ষ। সাবেদ আলির বয়েস হয়েছিল—সে তখন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পেনশন পাচ্ছিল। এত বয়েস হওয়া সত্ত্বেও তার হাতের লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ। ডান-হাত, বাঁ-হাত—দু-হাতেই সমান লক্ষ্য।হাতিতে যেতে যেতে সাবেদ আলি আমায় জিজ্ঞেস করল : আপনি বন্দুক চালাতে জানেন স্যার?
আমি বললাম: না, কখনও তো ছুড়িনি।
সে বললে: আচ্ছা, আপনাকে আমি শিখিয়ে দেব। তারপর বলেছিল: এ-আর কী শিকার করা স্যার! শিকার করতে যেতেন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। তাঁর সঙ্গে যেতেন গোবরডাঙ্গার জমিদার জ্ঞানদা মুখুজ্যে ও কে. চৌধুরী (ব্যারিস্টার) এরা সব। এখনকার মতো তাঁরা এত হাতি-ঘোড়া লোক-লস্কর নিয়ে যেতেন না—মাঝে মাঝে পায়ে হেঁটেই যেতেন।
--বলো কী সাবেদ আলি—পায়ে হেঁটে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
--হ্যাঁ স্যার, পায়ে হেঁটে। তাঁরা ছিলেন আসল শিকারি। কী হাতের টিপ ছিল। আর আজ-কাল শিকার মানে তো খালি স্ফূর্তি।
এই ধরনের নানা গল্প করত সাবেদ আলি।
একদিন ‘লাঞ্চ’ খাওয়ার পর যথারীতি বেরুনো হয়েছে ব্যাঘ্র মশায়ের সন্ধানে।
এমন সময়ে অনেক লোকের হল্লা আর ক্যানেস্তারা বাজানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম।
সাবেদ আলিকে জিজ্ঞেস করলাম: এ কীসের শব্দ?
সাবেদ আলি বলল: বাঘ দেখা গেছে—তাই বিটাররা বাজনা বাজিয়ে ওকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে--ওই যে দেখছেন, সামনের জায়গায় ঘাসগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ওই ফাঁকা জায়গাটায় লাটসাহেবের সামনে বাঘটাকে আনবে। আপনি ক্যামেরা রেডি করে রাখুন স্যার।
এমন সময়ে হঠাৎ বিটারদের গণ্ডি ভেদ করে বাঘটা লাফ দিয়ে পড়ল ঠিক আমাদের সামনের সেই খোলা জায়গাটায়। বাঘটাকে অত সামনে দেখে লিটন সাহেব ঘাবড়ে গেছেন। বাঘটা তাক করছে গভর্নরের হাতির মাথা লক্ষ্য করে লাফ দেবে কি না! এই সময়ে শুনতে পেলাম মহারানি ইন্দিরা বলছেন:
Your Excellency, shoot, shoot—
আমি তো ক্যামেরা চালাতে শুরু করে ছিলাম—হঠাৎ সাবেদ আলি আমার হাতে বন্দুকটা গুঁজে দিয়ে বললে: ক্যামেরা ছেড়ে দিয়ে এবার বন্দুকটা চালান স্যার।
আমি বললাম: সে কী? আমি বন্দুক চালাব কী? আমি তো সবে তোমার কাছে শিখছি।
--হ্যাঁ-হ্যাঁ আপনাকেই চালাতে হবে—আর দেরি করবেন না। দেখছেন না লাটসাহেব কীরকম নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। এই যে ফুটোটা দেখছেন—এর ভেতর দিয়ে দেখে টিপ করুন, তারপরে ট্রিগারটা টিপে দিন। নিন, আর দেরি করবেন না—
আমি মরিয়া হয়ে টিপলাম ট্রিগার, সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা সাংঘাতিক গর্জন করে একটা প্রচণ্ড লাফ দিয়ে পাশের একটা জলার ধারে গিয়ে পড়ল ছিটকে। আমার বলতে যতটা সময়ে লাগল তার শতাংশের একাংশ মাত্র সময়ে লেগেছিল সমস্ত ঘটনাটা ঘটতে—অর্থাৎ কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র।
আনাড়ির মার হলে কী হবে—গুলিটা লেগেছিল বাঘটার মাথার ব্রহ্মতালুতে। সেই আমার প্রথম শিকারে যাওয়া—আর প্রথমটাতেই এরকম সাফল্য।
বন্দুকের আওয়াজ শুনে মহারানি ইন্দিরা দেবী পাশ ফিরে দেখতেই আমার হাতে বন্দুকটা দেখতে পেলেন। তিনি হাত দিয়ে ইশারা করে আমায় তাঁর কাছে ডেকে পাঠালেন। আমি আমার হাতি থেকে নেমে একটি ছোটো হাতিতে চড়ে তাঁর কাছে গেলাম।
মহারানি বললেন: তুমি তো বেশ ভালো বন্দুক ছোড়ো!
আমি তাঁদের কাছে মার্জনা চেয়ে বললাম: আপনাদের অনুমতি না-নিয়ে বন্দুক ছুড়েছি বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু না ছুড়েও উপায় ছিল না—আর এক সেকেন্ড দেরি করলেই বাঘটা আপনাদের হাতির ওপরে লাফ দিত। আমায় মাফ করবেন।
মহারানি বললেন: না, না, তুমি ঠিকই করেছ। আর একটু দেরি করলে হয়তো বিপদ ঘটতে পারত। যাইহোক the skin is yours.
ততক্ষণে ব্যাঘ্র মহাশয়ের তর্জনগর্জন সব শেষ।
লর্ড লিটন ও মহারানি ফিরে গেলেন সেদিনকার মতো। আমি তখন গিয়ে মৃত ব্যাঘ্রের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে উত্তরকালের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ একখানা ছবি তুলে ফেললাম।” (পৃ: ১০৫-১০৬)
ইন্দিরা দেবীর সহায়তায় বাঘ শিকারের ডকুমেন্টারি, মধু বসুর কেরিয়ারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল বলাই যায়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে, রবীন্দ্রনাথের ‘দালিয়া’-র নাট্যরূপ ১৬ এপ্রিল ১৯৩০ সালে নিউ এম্পায়ারে মঞ্চস্থ হয়েছিল মধু বসুর প্রযোজনা ও পরিচালনায়। ‘দালিয়া’র ভূমিকালিপিতে জুলেখার চরিত্রে পাই ইন্দিরা রায়ের নাম। কোচবিহারের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট ইন্দিরা নারায়ণের বিয়ে হয়েছিল ১৯২৮ সালে, ক্যাপ্টেন পূর্ণানন্দ রায়ের সঙ্গে; যিনি ছিলেন মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ ও মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণের এ.ডি.সি.। ১৯২৬ সালের মে মাস থেকে ইন্দিরা নারায়ণ, মহারানি ইন্দিরা দেবীর সঙ্গী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজকুমারী ইলা দেবী ও গায়ত্রী দেবীর অভিভাবিকা হিসেবে তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে ইন্দিরা রায়কে একাধিক চিঠি লিখেছেন। ২০ ভাদ্র শুক্রবার, ১৩৪২ সনে সিংহসদন, শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত গীতোৎসব--শরৎ পর্বে সম্মেলক সংগীতে অংশ নিয়েছিলেন ইন্দিরা রায়। মধু বসুর পরিচালিত নাটকে তাঁর অভিনয়ের কথা সেভাবে আলোচিত হয়নি।
মধু বসু বিয়ে করেছিলেন সাধনা সেনকে। তিনি সম্পর্কে কেশবচন্দ্র সেনের নাতনি। ‘কুচবিহারের ইন্দিরা মহারানির সঙ্গে সাধনাদের পরিবারের নিবিড় সম্বন্ধ’-এর কথা পাই মধু বসুর ‘আমার জীবন’-এ। দার্জিলিঙে তিনি কোচবিহার স্টেটের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। মধু বসু ও সাধনা বসু উঠেছিলেন ইউনিক ভিলায়। আবার রাঁচির কথায় এসেছে মহারানি সুনীতি দেবীর প্রসঙ্গ---
এইসময়ে রাঁচির বি.এন.আর. হোটেলে এসে উঠেছিলেন কুচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী— ইন্দিরা মহারানির শাশুড়ি। আমার মার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা সেই বাল্যকাল থেকে, যখন ওঁরা দু’জনেই মিস্ পিগটের স্কুলে পড়তেন। এ কথা আগেই বলেছি। কুচবিহার ছোটো স্টেট হলে হবে কী? ওর ছিল বিরাট প্রতিপত্তি। ভাইসরয়, গভর্নর ছাড়া ইংল্যন্ডের রাজ-পরিবারের যখনই কেউ ভারতবর্ষে এসেছেন, তিনিই কুচবিহার রাজপরিবারের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন ওখানে শিকার করতে গিয়ে। এর ওপর সুনীতি দেবীই হচ্ছেন প্রথম ভারতীয় রানি যিনি বিলেতে গিয়ে রাজপুরুষদের সঙ্গে কায়দাদুরস্ত ভাবে চলাফেরা করেছেন এবং স্বচ্ছন্দে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলেছেন। বিরাট প্রাচুর্য ও জাঁকজমকের মধ্যে তাঁর জীবনের বহুদিন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখন আর তাঁর সেই আগেকার সুখের দিন ছিল না। স্বামী মারা গেছে; চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মাত্র এক ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে ছিল—তাও তারা দুজনেই তখন বিলেতে। রাঁচিতে ছিলেন শুধু তাঁর এক ভাই— নির্মলচন্দ্র সেন এবং তাঁর পরিবার। তাঁরা অন্য হোটেলে থাকতেন। তাই সম্ভবত নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যে তিনি গাড়ি পাঠাতেন মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। মার সঙ্গে আমি ও সাধনা প্রায়ই যেতাম। আমাকে দেখে তাঁর নিজের বড়োছেলে রাজীবের (রাজ রাজেন্দ্রনারায়ণ) কথা মনে পড়ে যেত—এই কথা তিনি মাকে কয়েকবার বলেছিলেন; আর সেইজন্যেই হয়তো আমি কোনোদিন না গেলেই আমার সম্বন্ধে খোঁজ করতেন। যদিও তিনি সাধনার আপন বড়োপিসিমা, তবু মার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিজের বোনের মতো এবং আমার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অপত্য স্নেহ। তাঁর আগেকার উৎসবমুখর দিনগুলির কথা স্মরণ করে আমার মনটি বেদনায় ভরে যেত, আর ভাবতাম জীবনে ওঠাপড়ার কী বিচিত্র গতি! (পৃ: ১৫৪)
১৯৩৩ সালের শুরুর দিকে লেখক সুস্থ হয়ে চলে আসেন কলকাতায়—“জামশেদপুর ছাড়ার সময়ে খবর পেলাম মহারানি সুনীতি দেবী রাঁচির বি.এন.আর. হোটেলে মারা গিয়েছেন। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ল।” (পৃ: ১৫৪) আমরা এই লেখায় মধু বসুর আত্মজীবনী থেকে দীর্ঘ অংশ উদ্ধৃত করেছি। প্রত্যক্ষ উক্তিতে অনুভব যেভাবে সঞ্চারিত হয়, পরোক্ষভাবে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর তাই লেখকের স্বরকে অবলম্বন করে আমরা তুলে আনতে চেয়েছি কোচবিহারের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে প্রায় অনালোচিত কিছু উপাদানকে। এই লেখার সাফল্য ও সীমাবদ্ধতার প্রশ্নটিও বোধহয় এখানেই নিহিত রয়েছে।
মধু বসুর ‘আমার জীবন’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বৈশাখ ১৩৬৭ বঙ্গাব্দে। আমরা এই লেখার ক্ষেত্রে দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, ‘আমার জীবন’-এর প্রতিভাস প্রথম সংস্করণকেই (জানুয়ারি, ২০১২) অনুসরণ করেছি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : এণাক্ষী মজুমদার