• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • মিহির সেনগুপ্তর সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম – উজাগর রাত্রির এক পরনকথা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী


    সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম— মিহির সেনগুপ্ত; প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০২০; সুপ্রকাশ, কলকাতা; ISBN: 978-81-946009-1-6

    খ্যাতনামা তপন রায়চৌধুরীকে বাখোয়াজি পত্রাঘাত করে বাংলা সাহিত্যে মিহির সেনগুপ্তর ধূমকেতু-সদৃশ আবির্ভাব। তার আগে পর্যন্ত স্মৃতিগদ্যের যে ধারাটি বাংলা সাহিত্যে বইছিল তার চলন ছিল নবকিশোরীর মতো সলজ্জ মেদুর। স্মৃতিগদ্যের এই চলনরেখা ধরে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস একদা বাঙালি পাঠকের মন জয় করেছিল। কিন্তু মিহিরের গদ্য বাঁধভাঙা জলের মতো তৎসম-চান্দ্রদ্বীপি বাকবন্ধের ঢেউ তুলে তার মেদুর চলনে এক আলাদা গতির সঞ্চার করল। স্মৃতিগদ্যের লাজুক কিশোরী যেন এক প্রবল পৌরুষে আচ্ছন্ন হল। এই নতুন গদ্যে মেদুরতা আছে কিন্তু প্রায়শই তা ঝলসে ওঠে হা হা অট্টহাসিতে। বরিশালি উপভাষার আঁচড় আর ‘শোলোক-শাস্তর’ খানিক সয়ে গেলেই সেই আছোলা গদ্যে প্রেমদংশনের শিহরন টের পাবেন পাঠক। সেই সঙ্গে অনুভব করবেন মানুষ রতনের ঠিকানা-খোঁজা কালকূটীয় আউলবাউল একতারার উদাসীন সুরও। এই সমূহ বৈশিষ্ট্য নিয়ে অপরূপ এক আলেখ্য মিহির সেনগুপ্তের ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ নবরূপে হাতে এল ‘সুপ্রকাশ’ প্রকাশনের সৌজন্যে।

    ‘সব মানুষেরই থাকে এক সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’। সেখানেই তার অন্তরাত্মার সিদ্ধি ও শুদ্ধি। সেই মোকামের দিকে উজানযাত্রার পথে এক একটি চরিত্র, তাকে ঘিরে এক একটি বৃত্ত রচনা করতে করতে এগিয়ে চলেন লেখক। সেই বৃত্তের জালে ধরা পড়ে মরমিয়া গল্প, এমনকি মর্মভেদী উপন্যাসও; কোনো অলীক নির্মাণ নয়, বাস্তব জীবনের অপরূপ আখ্যান। সেখানে আছে ‘চোটপাটের হোটেলওয়ালা’ মোকছেদ, খানসেনা ও অপরাপর ধর্ষকদের জারজ ছেলেপিলের পালক হয়ে। আছেন মোকছেদের জীবনদর্শন যিনি গড়ে দিয়েছেন তার মোর্শেদ সেই ফকির সাহেব আর তাঁর বিবি। তাঁদের মুখের ভাষা ‘তুখোড় চান্দ্রদ্বীপি’, মর্মের ভাষা দোতারার সুরে বিবিধ তত্ত্বের মধুর গান।

    লেখকের বিশেষ আত্মজন, খুনে কাহার সৈয়দ আলি চাচা আছেন। প্রাক্তন লেঠেল ও সড়কিবাজ এই মানুষটি ঠিক কেমন? তার আগে আপনাকে ‘চান্দ্রদ্বীপ জাতীয় স্বভাব’ কী তা জানতে হবে।

    সারা বছর ‘বীরমার্গী’, শুধু ঘাসের ডগায় ‘অশ্রুগলা’ শিশির দেখলে আর শিউলি ফুটলে যাদের দেহমনে ‘কান্তভাব’ ভর করে তারাই প্রকৃত চান্দ্রদ্বীপি। এ বাবদে সৈয়দ আলি চাচা লেখকের আত্মজন। কারণ এই সময় চাচার ‘জন্মশত্তুর জুম্মল মোল্লার ছাগলে’ ‘তার আহ্লাদের বাইগুন মরিচের খ্যাত’ ‘মুড়িয়ে দিয়ে গেলে’ তিনি ‘গাইল খামার’ না দিয়ে বলেন, “খাড়অ হুদাহুদা মরিচগুলান খাইস্‌ না। এক বাডি ফ্যান দিতাছি”।

    আলি চাচা লেখককে তুলে নিয়ে রাজাবাড়িতে যান। রাজাবাড়ির জ্যেষ্ঠ সন্তান নুরুদা। নাসির ওরফে নসু তার ভাই কিন্তু ভাবীর দেওর হিসাবে তার পরিচিতি। এই ‘ভাবীর মুখ বড় পাতলা। চন্দ্রদ্বীপললনা। কোনও ভাষা বা শব্দকে অশ্লীল বোধে ত্যাগ করেন না। সুরসিকা যারা, তারা শ্লীলাশ্লীল বিষয়ে ছুঁৎমার্গী হলে রসবর্ষণে হানি ঘটে’। ভাবীর পিতৃপ্রতিম নিবারণকাকা। ভাবীর সনহে তাঁর স্নেহরসে জারিত প্রাকৃত চান্দ্রদ্বীপিরসালাপে সিক্ত হয়ে ওঠে রাজবাড়ির পাকঘরের হাওয়া। নিবারণ কামারের উল্টো পিঠে আর এক পড়শি মইনুদ্দিন চাচা। হাস্যপরিহাস তার কাছে না-পাক। ভাবী কলহের সুতো বাড়িয়ে দিতেই জমে ওঠে দুজনের কলহ। মইনুদ্দিন বলেন, “ওই কামারইয়ারে চিতায় না উডাইয়া যদি মুই কব্বরে যাই, তো হে কব্বর মোর না-পাক। হালার মালাউন”। নিবারণ বলেন, “হুঃ চিতায় উডাইবে মোরে এই মেলেচ্ছ। মোর য্যান জাত জন্ম নাই। তোর কব্বরে মাডি দিমু আমি”।

    কলহে আল দিতে চাচার বিবি তাঁর নিবারণ দেওরকে নিজের কাছে ডেকে নেন। নিবারণ সেই হুকুম তামিল করলে চাচার মুখে দিব্য হাসি — “য্যামন কুত্তা হ্যার তেমনি মুগইর। যা, এহন যাইয়া মাগিগো ফাইফরমাস খাট। হালা মালাউন...।”

    হিন্দু কাক আর মুসলমান কাকের গল্পের আড়ালে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বলি হয়েও সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যে প্রীতির ফল্গুধারা — তার ছবিটি আপন বৈশিষ্ট্যে পরিহাসসিক্ত করে এঁকে দেন লেখক। তাঁর যাত্রাপথে উঠে আসে রায়বুড়ো এবং রসিকের আখ্যান। এই গ্রন্থে তার বিস্তার যতই সংক্ষিপ্ত হোক, তার মধ্যেই লেখা হয়ে যায় হিন্দু-মুসলমানের আপাত-বেড়ার আড়ালে মানবিক বোধে সমৃদ্ধ এক মর্মস্পর্শী উপন্যাস।

    সেই উপন্যাসে ঢুকছি না, কেবল রসিকের বাবা কুদরতের ‘হাইল্যা চাষার গুড়াগাড়ারে শেহানের লইগ্যা সরল পইধ্যতি’ উল্লেখ করার লোভ সম্বরণ করা গেল না। ছেলেকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে অতি যত্নবান কুদরত যে-পদ্ধতিতে রসিককে বর্ণমালার পাঠ দেয় তা একেবারে তার নিজস্ব এবং বরিশাইল্যাদের কাছেও অভিনব — “আইক্‌সা ‘ক’, কুলাকাণা ‘খ’, বগা ‘গ’, আঘারউয়া ‘ঘ’, মাথায় পাগড়ি ‘ঙ’(উচ্চারণে আঙ্গ)।” এরপর — “বাইগুন্‌ইয়া ‘চ’, গাম্‌ছামুড়ি ‘ছ’, বর্গীয় ‘জ’, উফ্‌রাউফ্‌রি ‘ঝ’, কান্ধে বোঁচকা নিও(ঞ)।” — ইত্যাদি ইত্যাদি।

    এরপর মাঠে নামে রাজাবাড়ির নসু। একে একে হরেক মামলা-ফ্যাসাদের আসামীকে সে ধরে এনে তার দুলাভাই, মানে লেখকের এজলাসে হাজির করতে থাকে। যতই রগুড়ে হোক তার ওকালতি-সওয়াল, যতই চান্দ্রদ্বীপিজ ‘দুর্ভাষা’-য় ব্যক্ত হোক আসামীদের জবাব, ওপর ওপর জরিমানা আদায়ের ফিকির হলেও তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে স্থির ও শুভবুদ্ধিযুক্ত সামাজিক কর্তব্য। এই কর্তব্যের একটি হল পূজা উপলক্ষ্যে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অঞ্চলের সকলকে পাত পেড়ে খাওয়ানো এবং রসিকজনদের জন্য কিঞ্চিৎ ‘মদমাদী’-র ব্যবস্থা করার কিছুটা খরচ উশুল করা। পূজাবাড়ির সমস্ত খরচখরচার ভার এই নসুর।

    দুলাভাইয়ের আদালতে প্রথম আসামী যে পুরুষ, তিনি অঞ্চলের একমাত্র বামুন; যদিও তিনি জন্মসুত্রে বামুন কি না, তা নিয়ে সকলেরই সন্দেহ আছে। নেহাত বামুন ছাড়া পূজা হয় না তাই সেই সন্দেহ প্রয়োজনার্থে অব্যক্ত থাকে। লেখক পূজাবাড়িতে প্রতিমা দর্শন করতে গিয়ে কাঠামোর নীচে দুটি অতিরিক্ত মূর্তি দেখে এক রহস্যের আভাস পেয়েছিলেন। এই রহস্যের উন্মোচন করেন গুণরাজ (প্রতিমা গড়ার কারিগর)। পুরুষ-মূর্তি এই বামুনের যিনি মহিলা বিষয়ে লঘুচরিত্র এবং বার্ধক্যে পৌঁছেও ‘ভজনা’ ত্যাগ করেননি। মহিলা-মূর্তি এক প্রোষিতভর্তৃকা নারীর, যার ‘ঢলঢল অঙ্গের লাবণি অবনী বহিয়া যায়’। বামুন এই নারীর সঙ্গে ‘ফষ্টিনষ্টি’ করার অভিযোগে অভিযুক্ত। গুণরাজের কথায় ‘য্যামন হে মাথারি, ত্যামন এই হালার বাউন। খালি গুজগুজ আর ফুসফুস’। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সওয়ালকর্তা সেই নসুই এই দুই মূর্তি গড়ার পরামর্শদাতা। দুলাভাইয়ের আদালতে নসুর ওকালতিতে বামুনের দুই দফায় মোট এক হাজার বাংলা মুদ্রা জরিমানা হয় এবং আসামী তা সাগ্রহে নসুর তহবিলে জমা করে দেন।

    দ্বিতীয় আসামী ‘জামাই’। তার এই ‘জামাই’ উপাধি কেন কেউ জানে না। সে ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার, ধর্মপ্রাণ, বেশবাসে পাক্কা মুসলিম এবং অতি সৎ চরিত্রের মানুষ। তার একটাই অপরাধ, সাধারণের তুলনায় তার জোতজমি একটু বেশিই আছে, অথচ পরিবারের সদস্য সংখ্যা মাত্র তিন। তাঁকে আসামী করার অন্য একটা গুহ্য অভিপ্রায়ও আছে যেটা প্রকাশ পাবে মামলার শেষ পর্বে। তার বিরুদ্ধে প্রথম এবং প্রকাশ্য অভিযোগ, সে সাচ্চা মুসলমান হয়ে ‘মালাউন’-এর দুর্গাপূজার মণ্ডপের বাড়তি চালার মাথায় চাপানোর জন্য মসজিদের টিন ধার দিয়েছে। পূজার মুখেই শুরু হওয়া ঝড়জলের দুর্যোগে মানুষজনের খাওয়ানোর ব্যবস্থা হবে এই চালার নীচে। মামলার সওয়াল যতোই এগোয় ততই তার বিরুদ্ধে অন্য সব অভিযোগও উঠতে থাকে। দ্বিতীয় অভিযোগ সুরাপান। জামাই অভিযোগ অস্বীকার করলে তার অপরাধের সাক্ষী হিসাবে ‘বুড়া’কে কাঁধে করে আদালতে হাজির করানো হয়। এই বুড়া আসলে এক বৃদ্ধা, যে তার কুটিরে মদ বিক্রি করে। বৃদ্ধার সাক্ষ্যে জানা যায় জামাই তার কাছে জল খেতে চাইলে সে মদের গ্লাস না ধুয়েই সেই গ্লাসে তাকে জল দিয়েছিল। জামাই সেই জল অবশ্যই খেয়েছে। সেই গ্লাসে দু-এক ফোঁটা মদ কি আর ছিল না! সুতরাং প্রমাণিত হল জামাই সুরাপানের মতো বেশরিয়ত কাজ করার অপরাধে অপরাধী। এখানেই শেষ নয়, তার সর্বাধিক গুরুতর অপরাধের অভিযোগটি উত্থাপিত হল সবশেষে। সে নাকি তার একমাত্র কাঁচা বয়সের বিধবা শালির বাড়িতে তাকে দেখাশোনার অজুহাতে ঘনঘন যাতায়াত করে। তার মরহুম শ্বশুরের পুত্র নেই, দুটি মাত্র কন্যা। তাই সে শালির স্বাভাবিক গার্জেন। সেই সুযোগে সে তার সঙ্গে সম্পর্ক পাকিয়ে তার শরীর ও সম্পত্তি দুইই ভোগ করার তালে আছে। নইলে সে শালির নিকার ব্যবস্থা করছে না কেন? এই শেষ অভিযোগে সাংঘাতিক মর্মাহত জামাইকে জরিমানা বাদেও অন্য একটি প্রায়শ্চিত্ত করার রায় দেওয়া হল। গুহ্য ব্যাপার এই যে, মোকছেদ এবং জামাইয়ের শালি পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত। তাদের শাদির ব্যবস্থা করাই ছিল নসুর আসল অভিপ্রায়।

    এইসব মোকদ্দমা-বিষয়ক কাজের মধ্যে সময়ের হালকা স্রোতে ভাসতে ভাসতে লেখকের ‘চোখ দুটি শুধু কাজ করে যাচ্ছে। ছবির পর ছবি দেখছি। স্পর্শেন্দ্রিয়ে নিচ্ছি এক জৈবিক অনুভব। মগজ নয়, হৃদয় শুধু জানান দিচ্ছে তার ব্যথা বা আনন্দের সংবেদন’। আর লেখকের এই সংবেদন চুঁইয়ে পড়ছে তাঁর এই আলেখ্যর পরতে পরতে।

    স্বভূমের যাত্রাপথে এক একটি চরিত্র আসতে থাকে; প্রায় সবই অপবর্গীয় মানুষ, কিন্তু স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এই মহিমার মধ্যে নৈতিকতা খোঁজার চেষ্টা বৃথা। সকলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সহজ স্বাভাবিকতায় জীবনের স্রোতে ভেসে থাকার মধ্যেই নিহিত তাদের মহিমা।

    তেমনই এক চরিত্র, জামাইয়ের সুরাপান-মামলার সাক্ষী বুড়া। সে এক অশীতিপর বৃদ্ধা, রায়দের এক শরিকের পরিত্যক্ত ভিটেয় একটি কুটির বানিয়ে বহুদিন ধরে বসবাস করে আসছে। তার একমাত্র ছেলে বাইরে কাজ করে, প্রোষিতভর্তৃকা রূপসী পুত্রবধুকে নিয়ে সে তার কুটিরে ভাটিখানা চালায়। রায়পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক পরস্পর নির্ভরতার, অপিচ, তা এক অদ্ভুত বৈপরীত্যে ভরপুর।

    আর আছে খলিল। পূজার বলির পাঁঠা সে বিনা পেঁয়াজে, হিং দিয়ে রাঁধে। হিন্দু-মুসলমান সবাই সার বেঁধে বসে চেটেপুটে খায় আর তারিফ করে। তাই যবনপুত্রের নাম হয়েছে খলিল ঠাকুর — ‘খলইয়া ঠাহুর’। রায়বাড়ির ছোটো-হয়ে-আসা পরিবারের মহিলাদের ক্ষমতা নেই এই রাজ্যিসুদ্ধু মানুষকে রেঁধে খাওয়ানোর। তাই খলিল বলে, “মুই ঠাহুর থাহি আর শ্যাখ থাহি, মুইই রান্দুম, যার খাইতে অয় খাবা, না খাইতে অয় সোগা মারাও যাইয়া”।

    সপ্তমীর দিন সকালে পূজার আসরে কার্তিক বৈরাগীর প্রবেশ। পূজামণ্ডপে এসেই ঢুলুঢুলু রক্তাভ চোখে মা দুর্গার কাছে সে এক দীর্ঘ নিবেদন পেশ করে, — “হে মা ভগবতী, তুমি দশভুজা, অসুরনিপাতিনী, শত্রুদলনকারিণী, ভক্তবৎসলা, অগতির গতি, অবলের বল।......কিন্তু মাগো, তোমারে এট্টা কতা জিগাই, যহন মিলিটারিরা আইয়া, হেই মুক্তিযুইদ্ধের সোমায়, মোগো হোগার ফুডায় বন্দুকের নল ঢুকাইয়া চিরইয়া ফারইয়া শ্যাষ করতে আছেলে, তহন তুমি কোতায় আছেলে, চুৎমারানি? এহন যহন বেয়াক কিছু ঠাণ্ডা, তহন আবার গুষ্টি সুদ্দা, রাউয়ার মতো পূজা খাইতে আইছ? হত্য কবু মাগো, দোষ অফরাদ নিও না, তোমার মতন এমন বেলাহাজ মাইয়া মানুষ, আর এট্টাও দেহি নাই”।

    দুপুরের বিশ্রামের পর কার্তিক এসে লেখকের সঙ্গে আলাপ করে। লেখকের শৈশবস্মৃতি খুঁজে পায় যৌবনের কার্তিককে। তখন এক বৈরাগী-দম্পতির সঙ্গে আসত এক রূপবান যুবক, তাঁর বাড়িতে এসে গান শুনিয়ে যেত। “জাতে জালইয়া কৈবত্ত। সম্প্রদায়ে বৈরাগী, বত্তমান পেশা কহনও হালুডি, কহনও মাছমারা, আবার কহনও বাজনদারি......” হড়হড় করে নিজের পরিচয় উজাড় করে দেয় কার্তিক।

    বর্তমানে গাঁজা তার দৈহিক লাবণ্য অনেকটাই ফুঁকে দিয়েছে কিন্তু অন্তরকে দিব্যি রসস্থ করে রেখেছে। ‘রয়ানি, গুণাবিবি, কেত্তন, রূপভান বা জারি সারি’ — এসবই গেয়ে বেড়ায় সে। তবে সানাই হল তার ‘হাউসের বাজনা’। যদিও ঢাক-ঢোল, ক্লারিনেট, মোহনবাঁশি — কোনোটাই তার আয়ত্তের বাইরে নয়। একেবারেই জাত-বৈরাগী সে, যথা ইচ্ছা তথা যায়। গাজার ছিলিম তার পাশপোর্ট, সানাইটি তার ভিসা। “মোর না লাগে টিকিট, না পাশপোর্ট ভিসা। যে যেহানে আটকাউক, এনাগো দৌলতে মুই ছাড়া পামুই। এমনকী পুলিশ দারোগারাও মোরে কিছু কয় না”।

    সপ্তমীর সন্ধ্যায় ক্ষীণ জ্যোৎস্না গায়ে মেখে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করে ছোমেদ বয়াতি। কার্তিক যদি এক ‘বীজমানুষ’ হয়, ছোমেদ তাহলে লেখকের পরনকতার ঠিকানা। তাই তার আগমন-সংবাদ লেখকের মনে শিহরন তোলে। ছোমেদ কার্তিকের অগ্রণী দোসর, একে অপরের পরিপূরক। একই সম্প্রদায়, একই পেশা, একই মানস, কেবল ধর্মেই সামান্য ভিন্নতা। কার্তিক হিন্দু, ছোমেদ মুসলমান। অচিরেই জানা যাবে এই ধর্ম তাদের বহিরঙ্গে, অন্তরঙ্গে তারা অভেদ।

    দুজনেই অশিক্ষিত, শ্লীলাশ্লীলবোধ বোধশূন্য কথা-কারিগর। কার্তিক যদি গদ্যকার হয়, ছোমেদ তাহলে পদ্যকার। কার্তিকের উপাখ্যানের হাড়গোড়ে ছোমেদ যেন রক্তমাংসের প্রলেপ লাগায়। যেসব অপবর্গীয় স্বভাব-শিল্পীর ভেতর দিয়ে নিম্ন বাংলার সাংস্কৃতিক ধারাটি বহমান, তাদেরই আদর্শ প্রতিনিধি এই দুই মানুষ। লেখককে তারা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে তাঁর সিদ্ধিগঞ্জের দিকে।

    আসর বসানোর আগে জারি গানের হালহদিশ ব্যক্ত করে ছোমেদ। মূলত কারবালার করুণ কাহিনির উপর রচিত হলেও ক্রমশ সর্ববিধ বিষয় ঢুকে পড়েছে জারি গানের মধ্যে। ছোমেদের ভাষায় জীবনচর্যার ‘পাঁচপেচি’ গল্প। কখনও বা তার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক উসকানিও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ভোলেভালা গায়করা সেসব খেয়াল না করে কথার সুর-তালের ছন্দ মাথায় রেখে গেয়ে যায়। এ ব্যাপারে তার অল্পবয়সের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছোমেদ অবশ্য সতর্ক। এককালে দাপুটে কিন্তু জারিপ্রেমী রায়কর্তাকে লিখিত জারিগান শোনাতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছিল সে। তিনি রচয়িতার বিষাক্ত উদ্দেশ্য খোলসা করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তাকে।

    আসর-প্রাঙ্গণে দোহার-সমন্বিত হয়ে জারি গান শুরু করে ছোমেদ। প্রথমেই বন্দনা। ‘বিশ্বমহোৎসবের মহাসংগীতে যেন অনন্ত দোহাররা বসে আছে, এ যেন তাদেরই বন্দনা’। লোকশিল্পে স্থিত হওয়ার আগে সে এক দীর্ঘ বন্দনা। প্রকৃতি, তীর্থক্ষেত্র, নবী-রসুল, দেবদেবী থেকে শুরু করে লেখকসহ উপস্থিত পঞ্চজন — কাউকেই বন্দনা থেকে বঞ্চিত করে না ছোমেদ। গানের মাঝখানে চলতে থাকে কথকতা, যার মধ্যে ফুটে ওঠে নিম্নবর্গীয় দরদ্র মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। পয়ারের ছন্দে বিলম্বিত লয়ে চলতে চলতে গান ও কথকতা কোনো এক সময়ে এক কাহিনিকে আশ্রয় করে। মনগড়া কোনো কাহিনি নয়, নিদারুণ বাস্তব থেকে উঠে আসা এক রোম্যান্টিক, মর্মস্পর্শী উপাখ্যান; যে উপাখ্যানে কার্তিক নিজেই এক চরিত্র। সরস্বতী, দৌলত এবং অষ্টকে নিয়ে সেই কাহিনি ঘটনার স্রোতে উথালপাথাল এগিয়ে চলে। কল্পনার দিগন্ত ছাপিয়ে বাস্তবের এই অতুলনীয় আখ্যানের গতি থামিয়ে মাঝে মাঝেই আসকথা-পাশকথায় ঢুকে পড়ে ছোমেদ;নিম্ন বরিশালের প্রাচীন ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বর্তমানে হিন্দু বাঙালির তেরো পার্বণের অভাবজনিত নস্টালজিয়া এবং অবশ্যই এসব নিয়ে ছোমেদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা-দর্শন। সে যখন মানুষের কামভাবের কথা বলে তখন যেন তা বরিশালি উপভাষায় অনূদিত ফ্রয়েডেরই এক তত্ত্ব বলে মনে হয়। ছোমেদের কথকতার চলনে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। তার শ্রোতাদেরও অস্থিরতা নেই, নির্বিকারে কথকতার স্রোতে তারা ভেসে থাকে।

    এইভাবেই সপ্তমীর রাত পেরিয়ে কাহিনি গড়ায় অষ্টমীর রাতে। ছোমেদ-কার্তিকের মতো কাহিনির নায়ক দৌলতও মাছমারা। সাঁইদের ট্রলারে অষ্টসহ অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া তাদের জীবনে এক বাধ্যবাধকতা। আসন্নপ্রসবা সরস্বতী অমঙ্গলের আশঙ্কায় সেই যাত্রা থেকে তার বহুকষ্টে পাওয়া প্রেমিক-স্বামীকে বিরত করতে চায়। এখানে এসে ছোমেদ মাছমারাদের নিয়তি নিয়ে সাতকাহন হয়। সেই সাতকাহনের সঙ্গে আশ্চর্য মিল সিঞ্জের ‘রাইডার্স টু দ্য সি’-র আইরিশ রমণীদের নিয়তি-বিলাপের।

    দুস্তর এক ট্র্যাজেডি পেরিয়ে কাহিনি অবশেষে স্থিত হয় জীবনের চলমানতায়, মানুষ ফেরে মানুষেরই আশ্রয়ে, ভালবাসায়; কার্তিকের স্ত্রীর কোলে আশ্রয় পায় হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সন্তান, কানাই।

    খেয়াল রাখা দরকার, মিহিরের এই স্বভূমি-পরিক্রমার সময়টা ১৯৮৬ সাল। বাংলাদেশ নিয়ে এপার বাংলার আবেগ ততদিনে স্তিমিত। ওপারে শেখ মুজিব নিহত। এরশাদের মিলিটারি জমানা তখনও শেষ হয়নি। মৌলবাদীদের বাড়বাড়ন্ত চলছে। বাংলা ভাষা নিয়ে ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের ভালোবাসার আবেগ শহরের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ। যে-গ্রামে মিহির ঠাঁই নিয়েছেন, বাংলাদেশের বাকি সব প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মতোই সেখানকার সমাজ-সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন এসেছে। অবস্থাপন্ন বর্ণহিন্দুরা বেশির ভাগই দেশত্যাগ করেছেন। নিরুপায় যারা থেকে গেছেন, তাদের অতীতের রক্ষণশীলতা এবং ছুঁৎমার্গ দেশকালের চাপে প্রায় অন্তর্হিত; হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিম্নবর্গীয় মানুষদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক অভিন্নতা তার মধ্যে পুরোপুরি সামিল হয়ে গেছেন তাঁরা। অতীতেও তাদের সাংস্কৃতিক উৎসবে তাঁরা অংশ নিতেন ঠিকই, কিন্তু একটা অদৃশ্য বেড়া ছিল যেটা বর্তমানে ভেঙে পড়েছে। মৌলবাদীদের প্ররোচনা সত্ত্বেও তাই গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়নি।

    মিহিরের ব্যতিক্রমী মানস এই সাংস্কৃতিক অভিন্নতায় একাত্ম ছিলই, সেখানে ফিরে আসতে পেরে তার চিত্তাকর্ষক ছবি দেখতে দেখতে, সেই সংবেদনের স্পর্শ নিতে নিতে ক্রমশ তিনি উজিয়ে যেতে থাকেন তাঁর সিদ্ধির মোকামার দিকে। কার্তিক ও ছোমেদ বয়াতির সঙ্গ না করলে, তাদের অপরূপ আখ্যানে, তাদের কথকতার ছন্দে, তার জারি গানের সুরে অবগাহন না করলে সেই সিদ্ধিগঞ্জের ঠিকানা তাঁর অধরাই থেকে যাবে, যেখানে ‘শাদা ভোরের নীল কুয়াশায় বিগত অনন্ত উজাগর রাত্রির পরণকতা সুর আর রঙে’ তাঁকে ঘিরে রাখে, ‘জীবন আর প্রাকৃত চর্যাপদের ছন্দে’ তাঁকে তাঁর ‘শিকড়ে পৌঁছে’ দেয়।

    এই গ্রন্থ মূলত লেখকের স্মৃতি এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের বিশেষ এক অঞ্চলের দুর্গাপূজা উপলক্ষে নিম্নবর্গীয় সাংস্কৃতিক উৎসবের মেলবন্ধন হলেও তার আত্মকথনে উঠে এসেছে সেই অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ইতিহাসের ধারা। সে ক্ষেত্রে মিহিরের দৃষ্টিভঙ্গি কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমী। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও তাঁর অভিজ্ঞান কিছু স্বতন্ত্র। সেই সময়টিকে বাঙালি-আবেগ বর্জিত এক নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে দেখেছেন তিনি। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোমেদের বয়ান তাঁরই কলম-নিঃসৃত কিনা।

    মিহিরের স্মৃতিগদ্যের চলন যেন ছোমেদ বয়াতির কথকতার চলনকেই অনুসরণ করে গেছে। ফলে তাঁর মধ্যে পুনরুক্তি আছে, অতিশয়োক্তি আছে, কাহিনির গতি থামিয়ে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে চলে যাওয়ার প্রবণতা আছে। মিহিরের গদ্যের এই বিলম্বিত সুর-তালের ছন্দে যেসব পাঠক মন ভাসাতে পারবেন না, তাদের পাঠরম্যতায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

    গ্রন্থের প্রচ্ছদ অনবদ্য। সামান্য কিছু বানান ভুল উপেক্ষা করলে সুপ্রকাশের এই কাজ প্রশংসার দাবি রাখে। সবচেয়ে বড়ো কথা, মিহির সেনগুপ্তর এক অসামান্য, বাংলা সাহিত্যের এই ব্যতিক্রমী সৃষ্টিটিকে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থের রূপ দেওয়ার জন্য বাঙালি পাঠকদের কাছে তাঁরা ধন্যবাদার্হ হয়ে রইলেন।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments