• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা: দই দম্বল, প্রেসিডেন্সিতে পাঁচ দশক ফিরে দেখা, বিদ্যাসাগর চরিতামৃত, বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || ‘স্মৃতির ….জানলা খুলে চেয়ে থাকি…’ ||

    দই দম্বল--সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়; ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’, কলকাতা ৯; প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০১৯; ISBN 978 9387 158993

    “লিখন আমার না-দেখা সেই বোন
    যাকে ভেবে শেষ বয়সেও মা হতো আনমন।
    শহর আমার মায়ের শাড়ির গন্ধ
    এখনও সেই হলুদ-লাগা, আটপৌরে…
    চোখ করলেই বন্ধ।”

    এই উৎসর্গপত্রীতে চোখ পড়ার আগেই তা আটকে গিয়েছিল বইটির অসামান্য পৃষ্ঠপ্রচ্ছদে। যেন সত্যজিতীয় সিনেমার ফ্রেম—ঐ দেখুন না!

    তাই, লিখন নিয়ে লিখবো, না শহর নিয়ে না ফ্রেমে ফ্রেমে বাঁধা জীবনের জলছবিগুলি নিয়ে—ধন্ধে পড়েছি এই গ্র.স. লিখতে বসে। এই পেত্থম, বলতে পারেন, এক গ্র.স. লিকতে বসে দিশেহারা হয়ে পড়চি!


    *

    শত প্রতি শত শহুরে (পড়ুন, কলকেতে) ষাটোর্দ্ধ এই কৃতবিদ্য ডাক্তারবাবুর রোমে রোমে জড়িয়ে আছে শহর কলকাতা—তাঁর নিজেরই ভাষায়ঃ “অপার বাঙ্গলা আর কলকাতার কথা নতমস্তকে আঁজলা ভরে নিয়েছি এই অনন্ত মাধুকরীতে…”, যিনি আবার নিজেকে না-লেখক বলে জাহির করতে বড্ড পছন্দ করেন। হেঁ হেঁ!

    কী নিয়ে লেখা এই কেতাবখানি? শহর কলিকাতা নিয়ে, না বাঙলা ও বাঙালি নিয়ে না…মানুষ নিয়ে!!

    মানুষ-দেখা এক কঠিন কাজ, আরও কঠিন তাঁদের নিয়ে লেখা—উপরন্তু, এমন আকর্ষণীয়ভাবে পাতার পর পাতা—দুই খণ্ড জুড়ে। পরবাস-এর এই কলামে এমন বইয়ের কথা আমরা আগেও পড়েছি বটে—

    ৫৩ সংখ্যায় ‘আমার আত্মজন’, বা ৫৬-সংখ্যায় ‘বাজার সরকার’, বা ৬৮-সংখ্যায় বাসুদা-র ‘তোমার পরশ আসে’; কিন্তু মানুষ-দেখা তো আর অমন চট্‌ করে ফুরিয়ে যায় না গো । তাই বর্তমান লেখক সিদ্ধার্থের লিখনও পড়ি মহা উৎসাহে, মোহিত হই এবং ভাবি, না-পড়লে বড্ড অপূর্ণতা থেকে যেত !

    কারণ, অতি-বিখ্যাত হয়েও এক্কেবারে না-লিখত যে ওঁর গপ্পের কুশীলবগণ! নৈলে, শ্রেষ্ঠ রচনাটির (‘সরল’) নায়ক আর কে হতে পারতেন গণিতের কিংবদন্তী শিক্ষক কেশবচন্দ্র নাগ মশায় ছাড়া? তাঁর মিত্র-স্কুলের সুহৃদ-তথা-সহকর্মী কবিশেখর কালিদাস রায় নিজ নিবাসের নাম ‘সন্ধ্যার কুলায়’ রেখেছেন দেখে কেশববাবু নিজবাটীর নাম ‘সরল’ রাখলেন। ছাত্র-লেখকের প্রায়-স্বগতোক্তি, ‘ভাগ্যিস সিঁড়িভাঙা রাখেননি স্যর’! পিঠ চাপড়ে দিয়ে হাসির উতরোলে ভেসে গিয়েছিলেন গম্ভীর কেশবচন্দ্র!

    ‘সেন্স অব হিউমার’ বিষয়টি আজকাল বাঙালির লিখন থেকে হারিয়ে গেছে প্রায়—যে ধারা এককালে মুজতবা আলী সাহেব বা ভিয়েন-সম্রাট শিব্রাম বা কামাক্ষী চাটুজ্যে করে রাখতেন আলোকিত। সিদ্ধার্থের এই সেন্স প্রায় জারোমীয়! আমরা Jerome Klapka Jerome এর কথা বলছি। নৈলে, ‘আলুওয়ালার সঙ্গে মনের কথা না বললে আলু যে ভালো সিদ্ধ হইব না’ (পৃ ২০৭), বা, হাতের রেখায় আছে এক বিবাহ আরেক ম্যারেজ (পৃ ৮৩), বা বসন্ত কেবিনে পড়ুয়া প্রেমিকের ‘মেনু’ শব্দ ভুলে তাকে ‘সিলেবাস’—এমন এমন সূক্ষ্ম ঠাট্টার কী দাম হয়?

    এবং লেখকের প্রকাশভঙ্গিমা! কত কত নূতন বাক্যবন্ধ যে শিখলাম, বা পড়ে জল এলো চোখে! যেমন, ‘ম্যাট্রিকে ফার্ষ্ট’ (সমতুল্য, Bradmanesque) ; বা, ‘মাঝরাতের একমাত্র ট্রেন ভোর হতে চাওয়া সকালের দিকে চলে গেল আমাদের দুয়ো দিতে দিতে’ (পৃ ৮২) ; বা, ‘আলোকপর্ণা শহরের গেরামভারি সব কেতাবঘর’ (মুখবন্ধে)।


    *

    অতি-প্রতিভাধর কিন্তু বঞ্চিত বা অস্বীকৃত মানুষজনের প্রতি স্বাভাবিক এক টান দেখা গেছে লেখকের এই প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড মিলিয়ে ৪৪+৪২= ৮৬টি রম্যরচনার মধ্যে —তা সে ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা’-র প্রকৃত সুরকার ধীরেন মাস্টার হোন্‌ বা শান্তিনিকেতনের বিস্মৃতা নৃত্যশিল্পী মমতা রায় ভট্টাচার্য বা সলিল চৌধুরীর প্রথমা পত্নী জ্যোতি! এবং অনন্য প্রতিভাধর তথ্যচিত্রকার বারীন সাহা। এঁদের গল্প সিদ্ধার্থ না শোনালে শুনতে পেতাম কোথায়?

    তবে এক্কেরে অ-বিখ্যাত মানুষজনের কতা কি আর নেই গ? সতুকাকা বা শ্যামাপিসি-রা তবে কে কে? এমন এমন অবিখ্যাত নোকজনের কতা গেয়ে অনায়াসে পাঠকের অন্তঃস্থলে পৌঁছে যেতে পারেন যিনি তিনি তো আর যে সে লেখক নন। পড়ে মনে হয় এই এই চরিত্রগুলি যেন আমার কতদিনের চেনা, কত আপনার!

    আর আর সব স্মৃতিকথাধর্মী লেখাগুলি বাদই রাখলেম না-হয় , কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডের ঐ ‘An Augist Gathering’ কল্পকাহানিটি পড়লে ওঁর লেখনীর ধার-ও-মান নিয়ে ডাউট থাকে না কোনো—এক্কেরে বোল্ড আউট। এ’-কলমচি বাক্যিহারা। বাকি বিচার করবেন পাঠক—এ’লেখা পড়ে।


    *

    পৃষ্ঠপ্রচ্ছদের সৌকর্য ব্যতিরেক সারা বই জুড়ে ছবির মান বেশ নিকৃষ্ট। মুদ্রণপ্রমাদ বহু, যতি-চিহ্ন ব্যবহারের কোনো মাঈ-বাপ নাই। গ্রন্থের সম্পাদক বা নূতন প্রকাশনালয়টি এমন দায়সারা কাজ করে বড্ড অবিচার করেছেন অসাধারণ এই বইটির প্রতি।

    ভবিষ্যত কোনো সংস্করণে এই এই খামতির অপনোদন দেখতে চাই।


    || গ্রন্থ-সমালোচনা নয়, সশ্রদ্ধ তর্পণ ||

    প্রেসিডেন্সিতে পাঁচ দশক—ফিরে দেখা অমলকুমার মুখোপাধ্যায়; মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা-৭৩; জানুয়ারি ২০২১; ISBN: নেই

    ১৯৪০এর দশকের কথা।

    বাবার হাত ধরে বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ক্লাস ফাইভের এক বালক প্রথম দেখতে এসেছে শহর কলকেতা! না, গণিতশিক্ষক তার পিতৃদেব তাকে চিড়িয়াখানা বা যাদুঘর বা মনুমেন্ট দেখাতে নিয়ে যাননি। প্রথমেই কলেজ স্ট্রিটে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রকাণ্ড সিঁড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রণাম করো বাবা অমল, প্রণাম করো এখানে। এর চাইতে বড় তীর্থক্ষেত্র ভারতবর্ষে আর নাই। এ’হল প্রেসিডেন্সি কলেজ। ভারতের শ্রেষ্ঠ কলেজ। তোমাকে বড় হয়ে এই কলেজে পড়তে হবে ও পড়াতে হবে।’

    “বাবার সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পেরে আমি আপ্লুত ও গর্বিত!” গল্পের শেষে টিউটোরিয়াল ক্লাসে এই মন্তব্য করতেন স্যর। সজল চোখে।


    *

    প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডঃ অমলকুমার মুখোপাধ্যায় কতবড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, তাঁর লেখা বইগুলি তিন প্রজন্ম ধরে ছাত্রছাত্রীর দল আজও পড়ে চলেছে, অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কত জবরদস্ত প্রশাসক ছিলেন—এ’সব বলবার এক্তিয়ার এই অধম কলমচির নাই। উপরন্তু ওঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র হিসেবে এবং এ’বইয়ের উৎসর্গপত্রীতে স্থান পেয়ে গিয়ে এই লেখনী চলে যেতে পারে অ-নৈর্ব্যক্তিক পথে—আছে সেই শঙ্কাও। তদ্‌সত্ত্বেও পরবাস-সম্পাদক মহাশয়ের নিকট আবেদন—অনন্য এই জীবনীগ্রন্থটির সঙ্গে আম-পাঠকের যোগসূত্রের এক পথ করে দিন। আধুনিক ভারতবর্ষের শিক্ষা-ইতিহাসের কোনো পাঠক-গবেষকের কাছে মাইল-ফলক হয়ে থাকবে এই বই—প্রচার পাক এই গ্রন্থ, পরিচিত হোন্‌ পরবাসের ঋদ্ধ পাঠককুল এই গ্রন্থটির সঙ্গে।


    *

    দশ বছর আগে ৫০-তম সংখ্যায় স্যারের ভ্রাতৃপ্রতীম সহকর্মী অধ্যা. বিশ্বনাথ দাস মহাশয়ের ‘প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিবৃত্ত’-গ্রন্থটির সমালোচনা প্রসঙ্গে লিখেছিলাম, ‘গিবনকে পেতে তো বিশ্বকে বারোশ’ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর বর্তমান পথিকৃৎ-উদ্যোগটি এলো এক মান্য রাশিবিজ্ঞানীর হাত ধরে—এইটেই লক্ষণীয়।’ এটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি বর্তমান আলোচিত গ্রন্থটি যেটি স্বয়ং ‘গিবন’ দ্বারাই লিখিত, কারণ প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস লেখার জন্য অধ্যা. অমলকুমার মুখোপাধ্যায়ের চাইতে যোগ্যতর মানুষ আর পাওয়া যাবে না, কলেজের সঙ্গে যাঁর যোগ প্রায়-অর্ধশতাব্দীর! পোর্টিকোর পাশের বৃদ্ধ দেবদারু গাছটা কেটে ফেললে যিনি প্রায় আত্মীয়বিয়োগের সুরে কেঁদে ওঠেন!


    *

    নদীর স্রোতের মতো চলন এই গ্রন্থের! গল্পচ্ছলে বলে চলা কত-না পাওয়া-না-পাওয়ার গল্প—কত সাফল্য-ব্যর্থতা। এক স্টোইক সমাজবিজ্ঞানীর নন-ভ্যালু এডেড ভঙ্গিতে লেখা। যদিও মুখবন্ধে উনি লিখেছেন যে গতবছরের কোভিড-কোয়ারেন্টাইনের বদ্ধতা কাটাতেই তাঁর হাতে কলম তুলে নেওয়া ও এই গ্রন্থের জন্ম, কিন্তু আমরা পরবাসের প্রাচীন পাঠককুল জানি যে বছর তিনেক আগে ৭০ সংখ্যায় উনি পরবাস কে যে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সেটাই ছিল এই আত্মজীবনীগ্রন্থটির শুরুয়াৎ—যার অনেক গল্প এই জীবনীগ্রন্থে এসে বিস্তৃততর রূপ পেয়েছে যেন—তা সে সহপাঠিনী নবনীতা দেবের সঙ্গে প্রেম-ও-চুম্বনের কবিতার চালাচালি হোক্‌ বা তুখোড় নকশাল নেতা কাকা-র সঙ্গে টক্কর! উল্লেখ্য, অসীম চট্টোপাধ্যায়ও কিন্তু বীরভূমেরই ভূমিপুত্র।


    *

    ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন অমলবাবুর আবাল্য বন্ধু, যে বন্ধুত্ব টিঁকে ছিল প্রণবের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। এ’ আত্মজীবনীতে বারে বারে উঠে এসেছে বন্ধু প্রণবের কথা—কখনও কখনও বা এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতেও। বেশ সুখপাঠ্য।


    *

    অনেক অনেক ঘটনাবলী উঠে এসেছে এই জীবনীগ্রন্থে—স্যরের বিভাগীয় প্রধান হওয়া থেকে অধ্যক্ষ হওয়া এবং ডিরোজিওর জন্মদিন পালন থেকে লেডিজ হস্টেলের উদ্ঘাটন। যে গল্পটা নেই সেটা দিয়েই এই লেখা শেষ করবো।

    বাঁকুড়াবাসী এক গ্রাম্য ছাত্র তার বিবাহে সসংকোচ নিমন্ত্রণ করেছে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপালকে—মনে দোলাচল—স্যর আসবেন তো, স্যর আসবেন তো? স্যর যখন সত্যিই এলেন তাঁকে বসানোর তাঁকে আপ্যায়নের পথ খুঁজে পায় না সেই বরবেশী নিরীহ ছাত্র। নিজের পিতৃদেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল—আমার মাস্টার মশাই! পক্ককেশ অশীতিপর বৃদ্ধকে সটান পদস্পর্শ করে প্রণাম করলেন অধ্যক্ষ অমলকুমার মুখোপাধ্যায়। ছাত্রটি অবাক বিস্মিত! জাতে যে সে শুঁড়ি, শিডিউল কাস্ট। স্যর তো জানেনও সে পরিচয়! আজও বৃদ্ধ বয়সে এই গল্প করতে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে সেই ছাত্রের আঁখি—যে আজ এক মস্ত বড় ব্যাঙ্কের হর্তাকর্তা ।

    শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতাতেই হয় না—এটা শেখাতে পেরেছিলেন বলেই অমলবাবু আজও পিতৃপ্রতীম ভক্তি পান ছাত্রদের কাছে। তাই তিনি এক কিংবদন্তি।



    || রোহিণী নন্দনের গাওয়া নন্দন-কাননের মহাকাব্য ||

    বিদ্যাসাগর চরিতামৃত—অবিনাশ চন্দ্র হালদার; প্রকাশকঃ রোহিণী নন্দন, কলকাতা ১২; সেপ্টেম্বর ২০২০; ISBN 978-93-88866-37-8

    বঙ্গসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রতনহার ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’-এর রচনাকার বৈদ্যকুলশ্রেষ্ঠ গোস্বামী কৃষ্ণদাস কবিরাজ ষাটোর্দ্ধ বয়সে প্রথম লেখনী ধরে এই

    অমৃতভাণ্ডের সৃষ্টি করেছিলেন। জানি না, বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এত বেশি বয়সে প্রথম সাহিত্যচর্চা শুরু করে এমন ক্লাসিক লেখবার দ্বিতীয় আর কোনো উদাহরণ আর আছে কিনা, বাংলা ভাষায় তো নেই-ই।

    আর বর্তমানে আলোচ্য মহাগ্রন্থখানি এক অনামী সরকারী-চাকুরের বিশ বছরের বিদ্যাসাগর-চর্চার ফসল! মানুষ হিসাবে, এবং জাতির জীবনে তাঁদের অবদানের নিরিখে চৈতন্যদেব ও ঈশ্বরচন্দ্র অবশ্যই তুলনীয়। তাই আজকে এই ‘বিদ্যাসাগর চরিতামৃত’ গ্রন্থ সম্বন্ধে দু-কথা বলতে গিয়ে কৃষ্ণদাসজীর ঐ মহাগ্রন্থের কথা মনে পড়ে গেল।

    আলোচ্য গ্রন্থের ‘ভূমিকা’ লিখতে আহূত হয়ে পবিত্র সরকার মহাশয় বড়ই কুণ্ঠিত বোধ করেছেন—এই সহস্রাধিক পৃষ্ঠার বহু-পরিশ্রম-মণ্ডিত বইটির মুখবন্ধ লেখবার অধিকার তাঁর আছে কিনা, সেটা ভেবে। উনিই যদি এতো দ্বিধাগ্রস্ত হন তবে নিতান্ত আনপড় এই কলমচি কোন্‌ অধিকারে এই গ্র.স. লিখতে কলম ধরে?

    আবারও বলি, এই কলামে পরবাস-সম্পাদক মহাশয় তো কেবল ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’-কেই স্থান দেন না, ‘গ্রন্থ-পরিচয়’-ও থাকে। সেই ভরোসায় দু’কথা লিখতে সাহস করি।


    *

    বাংলা ভাষায় চৈতন্যচর্চার পাশাপাশি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্য তথা রবীন্দ্রচর্চা-সাহিত্যেরও কমতি নেই

    কোনো। তেমনই ঈশ্বরচন্দ্র-চর্চা। অশোক সেন মহাশয় থেকে স্বপন বসু, ফ্রাঙ্ক ভট্টাচার্য, ইন্দ্রমিত্র প্রমুখ অনেকেই উল্লেখযোগ্য যোগ রেখেছেন এই চর্চায়। অতি সম্প্রতি ঢাকা বাংলা একাডেমি-র স্বরোচিষ সরকার মশাইয়ের একটা বই বেরিয়েছে দেখলাম, ‘বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরচর্চা’। পড়বার ইচ্ছা রাখি।

    সত্তর দশকে কলকেতা-শহরকেন্দ্রিক কিছু অতিবামমনস্ক ছোঁড়া বিদ্যাসাগরের মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদ করে বিপ্লব করত, মনে পড়ে? আবার, আজকের সবচেয়ে বড় বাম-পার্টির কর্ণধার বিমান বসু মহাশয়, দেখি, বিদ্যাসাগরের নামে নালেঝোলে হন। উপরন্তু আজকের অতি-আধুনিক অতি-বামপন্থী কেহ কেহ বিদ্যাসাগর মশায়ের অবদানকে তুচ্ছ-তচ্ছিল্য করে মোটকা কেতাব লেখেন, তা-ও দেখেছি। বিদ্যাসাগর বাঙালি মুসলমানের জন্যে কী করেছেন? কেনই বা তাঁরা তাঁকে এক মহামানব মানবে—এমন এমন বিতর্কও চোখে পড়েছে বহুৎ!

    গান্ধী থেকে নেহরু, বসু থেকে সাভারকর—কোন্‌ বড় মাপের মানুষের বিরুদ্ধ-সমালোচনা হয়নি, বলুন তো? একা গান্ধীজীর বিরুদ্ধে যত যত বিরুদ্ধ-মন্তব্যের কেতাব আছে—গুণে শেষ করা যাবে না তা। বিদ্যাসাগর মহাশয় তো তা-ও রাজনীতির আঙ্গিনা মাড়াননি, না ধর্মের। তবু আজকেও বিতর্ক তাড়া করে ফেরে পর্বতের মাপের এই মানুষটির পিছনে পিছনে।

    বর্তমান গ্রন্থকার অবশ্যি বিতর্কিত বিষয়টিষয় এড়িয়েই গিয়েছেন, যেটাকে অনেকে বইটির এক মাইনাস পয়েন্ট হিসেবে দেখতে পারেন—যে এ’বই ভক্তিমাধুর্যে একটু বেশিই ডুবে আছে।


    *

    হুগলি জেলার অজ পাড়াগাঁয়ের নয় বছরের এক দরিদ্র বালক বাপের হাত ধরে চল্লিশ ক্রোশ পথ হেঁটে হেঁটে কলকেতা শহরে এসে পৌঁছেছিল কেবলমাত্র বিদ্যাশিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে। সালটা ১৮২৯। রেলপথের নাম তখনও ভারতে শোনেনি কেউ। বড়বাজারের এক ব্যবসায়ীর গৃহে আশ্রিত থেকে প্রবল পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে সংস্কৃত বিদ্যাশিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিলাভ। সংস্কৃতভাষাশিক্ষা করলেও তিনি প্রাচীন হিন্দুত্বের নিগড়ে বাঁধা পড়ে থাকেননি কখনও—তাই না ১৮৫৭-র বিদ্রোহীরা কলকাতায় ঢুকে পড়তে পারলে প্রথমেই এই বিদ্যাসাগর লোকটিকে কোতল করতে চেয়েছিল! রামকৃষ্ণ-বিদ্যাসাগর ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারে পূর্বোক্তের ভক্তিরসে আপ্লুত হননি এই কর্মবীর—যাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের সাশ্রু নিবেদন, ‘ভগবান চার কোটি বাঙালি গড়তে গড়তে কী করে যে একজন ঈশ্বরচন্দ্র গড়ে ফেলেছিলেন!’


    *

    পরম বিনয়ের সহিত বর্তমান গ্রন্থকার নিজেকে ‘সংকলক ও সম্পাদক’ হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন, লেখক হিসেবে নয়; যদিও এই মহাগ্রন্থটিতে যে অনেকানেক লেখকের প্রবন্ধাবলীর সন্নিবেশ ঘটেছে তা কিন্তু মোটেও নয়। পুরো লিখনটাই অবিনাশবাবুর নিজস্ব। প্রভূত রেফারেন্স তো আছেই থাকবেই আসবেই এমন এক গ্রন্থের রচনায়। গ্রন্থটিকে বিদ্যাসাগরের উপরে এক ‘এনসাইক্লোপিডিক’ কাজ বলা চলে, যেটা বইটি কিনে ঘরে রাখার প্রধান কারণ। কেবলমাত্র পরিশিষ্ট ও further reading list-টিই যতটা সম্পৃক্ত ও পূর্ণ—বিদ্যাসাগরের উপরে পড়তে-জানতে আর কোনো লাইব্রেরি হাঁটকাতে হবে না। প্রণতি জানাই ‘অনামী’ লেখকের এমন প্রয়াসের সামনে।


    *

    কলকেতা শহরের জ্ঞানীগুণীজন ও তথাকথিত শিক্ষিতদের ব্যবহারে (এবং, নিজের অনেক পরিবার-সদস্যের দুর্ব্যবহারেও) উত্যক্ত হয়ে জীবনের শেষ প্রায় দুইটি দশক বিহারের (এখন ঝাড়খণ্ডে) কার্মাটাঁড়ে সহজসরল সাঁওতালদের মধ্যে অতিবাহিত করে পরম সুখলাভ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ‘নন্দন কানন’ নাম দিয়েছিলেন তিনি সেই আশ্রমের যেখানে স্ত্রীশিক্ষার স্কুল থেকে বয়স্কশিক্ষা তথা নিজের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্লিনিক চালাতেন এই মহাপুরুষ। সেটা মনে পড়ে গেল এই প্রকাশকের নামটি দেখেঃ ‘রোহিণী নন্দন’! ব্যবসায়িক সাফল্যের নিরিখে মস্ত এক প্রশ্নচিহ্ন ধরে নিয়েও বিপুলাকার এই পুস্তকের এমন সযত্ন

    প্রকাশনার সামনে আনত প্রণিপাত করি। এমন প্রকাশক না থাকলে এমন বই হাতে পেতাম না। এ’বই তাই যতটা অবিনাশের, ততটাই রোহিণী-নন্দনের!




    || …করে শুধু মিছে কোলাহল… ||

    বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান--দেবোত্তম চক্রবর্তী; প্রকাশকঃ ‘কলাবতী মুদ্রা’, কলকাতা-৮; ISBN: নেই

    না, গুরুপাক হবে না।

    একই সংখ্যায় একই ব্যক্তির উপরে দুইটি ইয়া ইয়া গ্রন্থের সমালোচনা পড়তে, কারণ আলোচ্য মানুষটি আর কেউ নন, স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র দেবশর্ম্মণঃ! আর উপরের ঐ ‘চরিতামৃত’ গ্রন্থে যদি তাঁর পূজাটা একটু বেশি করে ফেলা হয়ে গিয়ে থাকে তো তা পুষিয়ে নিতে বর্তমানটিতে পড়ে নিতে পারবেন বিদ্যেসাগর মশায় আসলে কত শঠ দাম্ভিক ধান্ধাবাজ একটা লোক ছিলেন, কেবল ইংরেজদের চাকরামি ও দালালি করবার জন্যেই ওঁর এতো বোলবোলাও (হ্যাঁ, ঠিক এই এই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন লেখক)। তাঁর মুখোশ খসিয়ে দিতে আবির্ভূত হয়েছেন এই যুব-লেখক শ্রীমান দেবোত্তম চক্রবর্তী, পেশায় ইঙ্গ-শিক্ষক, …‘অগণন অন্ত্যজ হিন্দু, দরিদ্র মুসলমান এবং আর্ত ও অসহায় নারী’-র মুক্তিদূত হয়ে যিনি অবতীর্ণ হয়েছেন (প্রথম ব্লার্ব দ্র.).

    কেতাব লিকে লিকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রণম্য মানুষদের গায়ে কাদা ছিটিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়ানোর পরম্পরা নূতন কিছু নয়। কয়েকটি তেমন ঘৃণ্য নাম তো এখনই মনে আসছে। কিন্তু সেই গোত্রেই দেবোত্তমকে ফেলে দেওয়া যেত যদি না তাঁর এই গ্রন্থ বহু-গবেষিত হতো, যদি না এতে প্রকৃত পরিশ্রমের ছাপ থাকত। কিন্তু এত পরিশ্রম করে কী হাসিল করলেন লেখক? দুগগাপুজোর বিচিত্রানুষ্ঠানের আসরে বিশ্বশ্রী মনতোষ আইচের দাঁতে করে লোহার পাত বাঁকানোর খেলা দেখে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মশাই বলেছিলেন যে এমন একটা ‘আটার ওয়েস্টেজ অব হিউম্যান এফর্ট এণ্ড স্কিল আগে কখনও দেখিনি।’ (দ্র. কুমারপ্রসাদ)।

    দেবোত্তমবাবুর এই কেতাব পড়তে পড়তে সেই কথাটা মনে এল।


    *

    তিনটি পর্বে বিভক্ত এই গ্রন্থঃ ‘শিক্ষাসংস্কারক’ এবং ‘সমাজসংস্কারক’ এবং ‘সাহিত্যসংস্কারক’ বিদ্যাসাগর। এবং এই তিনটি ক্ষেত্রেই আসলে তিনি যে কতটা অন্তঃসারশূন্য ছিলেন, উপনিবেশের দালাল ছিলেন—বহু পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন লেখক। আর কী সব একেকটা অধ্যায়ের শীর্ষনামঃ

    # সংস্কৃত কলেজে শিক্ষাসংস্কার—বিলিতি তলোয়ারের খাপে দিশি খাঁড়া ভরবার কসরত; বা,

    # বিধবাবিবাহ আইন—বিদেশি প্রভুর দেশি সহচর; বা,

    # বিদ্যাবণিক বিদ্যাসাগর—নীতিবোধের পরাকাষ্ঠা

    এমন এমন ঠেস দেওয়া অ-নৈর্ব্যক্তিক হেডিং না থাকলে গবেষক হিসেবে বেটার মার্কস দেওয়া যেত তাঁকে।

    পড়ে দেখি একটা অধ্যায়ঃ

    ঐ ‘তলোয়ারের খাপ আর খাঁড়া’ অধ্যায়ে বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন সংস্কার প্রয়াস—যেমন, (১) সংস্কৃত কলেজে ইংরিজিরও পাঠ শুরু করানো বা (২) বেতন পদ্ধতি চালু করা বা (৩) রবিবারে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করা—এর প্রত্যেকটির মধ্যেই লেখক বিদ্যাসাগরের দালাল-মানসিকতা খুঁজে পেয়েছেন। আরও এক ধাপ এগিয়ে প্রথম বাঙলা ব্যাকরণ গ্রন্থের প্রণেতা হ্যালহেড সাহেবের গ্রন্থটির প্রশংসা করায় সরাসরি তাঁকে ‘ভৃত্য’ বলেছেন ঈশ্বরকে। মস্ত বৈপ্লবিক কাজ করেছেন বটে! প্রশ্ন রাখি, কী করা উচিত ছিল এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের? ‘বাঁশের কেল্লা’ গড়ে যুদ্ধ ঘোষণা করা? সেটাই দেশভক্তির একমাত্র পরাকাষ্ঠা? সমাজে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা রয়েছে। সেটা ভুলেই মাও-সাহেব ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ ডেকে চীনদেশের সাড়ে সব্বোনাশ করে দিয়েছিলেন। সেটা ভুলে যাব? ওঃ, সরি, তিনি তো আবার আপনাদেরও চেয়ারম্যান ছিলেন!

    তারপর সস্তা জনপ্রিয়তা আদায়ের আরও আরও প্রয়াস তো আছেই। নারীশিক্ষা প্রসঙ্গে কেন কেবল গার্গী-মৈত্রেয়ী-খনা-লীলাবতীর কথা এনেছেন (পৃ ১৪২), কেন রাজিয়া সুলতানা বা নূরজাহান (!) এর মতো মহীয়সী মুসলিমের নাম করেন নি—তাই নিয়ে ক্ষোভ দেবোত্তমের। তাহলে তো মাতা গুর্জরী বা মাতা সাহেব কৌর এর মতো শিখ মহীয়সীদেরও নামোল্লেখ করা উচিত ছিল। করলেন না তো স্যর? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে এসি রুমে বসে অনেক অনেক সমালোচনা লেখা যায় বাপু হে, সেই সময়ে সেই পরিপ্রেক্ষিতটা কী ছিল সেটা জানতে হবে, মানতে হবে। ‘মহাস্থবির জাতক’, ‘Discovery of India’—পড়েছেন তো বটে। সেই প্রেক্ষিতটা সঠিক না হলে সবই ঐ ‘Plato’s REPUBLIC from Marxist perspective’ হয়ে যাবে হেঁ হেঁ।


    *

    গ্রন্থটির শীর্ষনাম রেখেছেন, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান’. এক্কেবারে মিথ্যে কথা। এখানে বিদ্যাসাগরের ‘বিনির্মাণ’-টাই করেছেন লেখক মহা উৎসাহে, কোনো ‘পুনর্নির্মাণ’ নাই। ভাঁওতা। কারণ সেটা ওঁর অঘোষিত এজেন্ডা-র মধ্যে পড়ে না।

    এজেন্ডা শুধু তো গৈরিকবর্ণের হয় না, লাল-অতিলাল এজেন্ডার ইতিহাস আরও অনেক পুরনো।

    অনেকদিন পরে একটি বইয়ের গ্রন্থ-সমালোচনা লিখতে এতটা বিরক্ত হলাম। আর যা-ই হৌক, ‘ভাবের ঘরে চুরি’-কে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments