আসানসোল শহরের কাছে বিরাট এক লোহা তৈরির কারখানা আছে। এতবড় কারখানা যে তারপাশে ছোটখাটো একটা শহরও গড়ে উঠেছে। তবে শহরের বাইরে আর বিশেষ কিছু নেই — ছোট ছোট গ্রাম, নদী আর দূরে দূরে কটা কয়লাখনি। আমার ছোটবেলা, আমার ইস্কুলের দিন কেটেছে সেই শহরে। ক্লাস ফাইভের পর সিক্সে উঠে বড় স্কুলে যেতে হলো। বড় ইস্কুলে গিয়ে দেখি আমরা যেমন ইস্কুলে নতুন আর আমাদের ক্লাস-টীচার সুধীরবাবু স্যারও তাই। আমাদের ইংরেজি আর ভূগোল পড়াতেন। স্যারকে ঠিক স্যার বলে মনে হতো না, বন্ধু কিংবা বাড়ির বড়দারা যেমন হয় তেমন ছিলেন।
শীতের ছুটি হবার আগে সুধীর স্যার বললেন — “শোন, ভাবছি আমরা বনভোজন করতে যাব। কারা কারা যেতে চাস হাত তোল।”
কুড়ি-বাইশজন ছেলে ছিল ক্লাসে, সবাই হাত তুলল। এক সুস্মিত ছাড়া। সে বলল — “বনভোজন কি করে করতে হয় স্যার?”
“আমরা ওকে বসিয়ে দিয়ে বললাম আরে বনভোজন মানে পিকনিক ….”
সুস্মিত বলল —“ওহ, পিকনিক! পিকনিক মানে জানি। কোনো কাজ নেই, তবু একদল লোক অনেক দূরে গিয়ে কষ্ট করে মাটিতে বসে খাওয়াদাওয়া করে। ওসব কেন করতে যেতে হবে স্যার?”
“তুই যাবি কিনা বল, পিকনিকে খুব মজা হয়।” শার্টের হাতা ধরে আবার ওকে বসিয়ে দিলাম। আমাদের পাল্লায় পড়ে রাজি অবশ্য ওকে হতেই হলো।
সকলেই যেতে চাইলে কী হবে, পরের দিন যখন নাম লেখা হচ্ছিল তখন বেশ কয়েকটা ছেলে প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে ছিল। কারুর টনসিলের ধাত, একটুতেই জ্বর হয় তাই মা যেতে বারণ করেছেন। কারুর পিসতুতো দাদার বিয়ে, কেউ বাড়িশুদ্ধু রাজস্থান বেড়াতে যাচ্ছে আবার কারুর বাবা ভীষণ কড়া, যেতে দেবেন না — এসব না-যেতে-পারা ছেলেদের বাদ দিয়ে বারোজন দাঁড়াল। সঙ্গে সুধীর স্যার আর বিমলদা যাবেন। বিমলদা আমাদের ইস্কুল বাস চালাতেন।
স্যার আর বিমলদা ঠিক করলেন পিকনিকের সকালে মুড়ি আর বেগুনি খাওয়া হবে। দুপুরে ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাংসের ঝোল আর চাটনি।
সেই প্রথম ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে এইভাবে কোথাও যাওয়া। উৎসাহে আমরা সবাই ছটফট করছি। সকাল আটটায় ইস্কুল থেকে বাস ছাড়বে, আর আমরা সাড়ে-সাতটার ভেতরেই পোঁছে গেছি! কেউ নিয়েছে ক্রিকেট খেলার ব্যাট বল, কেউ ব্যাডমিন্টন। মহেশের একটা মাঝারি সাইজের সাইকেল ছিল, বিমলদাকে আগে থেকে বলে রেখেছিল নিয়ে যাবে। বাসের পেটে একটা বড় খুপরি থাকে। চাকার পাশের ডালাটা খুলে ঢোকানো হলো সাইকেলটা।
আমরা সকলে বাসে উঠে পড়লাম আর ঠিক সকাল আটটায় বিমলদা বাস ছেড়ে দিলেন। সুধীরস্যারের ওঠার কথা স্টেশন বাজারের মোড় থেকে। স্যার দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন, বাসে উঠে পড়লেন। আমার কিন্তু দেখলাম স্যারের মুখ আজ ভীষণ গম্ভীর, কারুর সঙ্গে কথাই বলছেন না। কী হলো রে বাবা!
জায়গাটার নাম পাথরঘাটা। দামোদর নদীর ধারে। হালকা জঙ্গলের ফাঁকে কোথাও কোথাও খোলা মেঠো জমি রয়েছে । নদীর পাড়ে, মাঠে, জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় কালো কালো পাথর। এত পাথর আছে বলেই জায়গাটার নাম পাথরঘাটা। নদীর কাছেই একটা সমান ঘাসের জমি পাওয়া গেল, সেখানে শতরঞ্চি পাতা হলো। স্যার বললেন, তোরা সকলে আয়, কথা আছে তোদের সঙ্গে। আমরা সকলে স্যারের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
স্যার বললেন —“একটা অঘটন ঘটে গেছে। রান্নার করার জন্য যে লোকটিকে ঠিক করা হয়েছিল কাল সকাল থেকে তার একশ-চার জ্বর। সে আসতে পারবে না। এমনকি বাজার-হাটও সে করতে পারেনি। পয়সাকড়ি যা দেওয়া হয়েছিল তা অবশ্য ফেরৎ দিয়ে দিয়েছে।
“এখন আমাদের সামনে দুটো রাস্তা রয়েছে। ভোট নিয়ে ঠিক করতে হবে আমরা কী করব। এক হল আমরা ঘন্টাখানেক জায়গাটা একটু দেখেটেখে আবার ফিরে যাই বাসে করে। আর দুনম্বর হলো — আমরা নিজেরাই হাট থেকে জিনিসপত্র কিনে এনে নিজেরাই রান্না করে খাই।
“এক নম্বরে কে কে আছিস হাত তোল ….”
অনেকে পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখল। যদি ভুল করে হাত উঠে যায়! মোটকথা একটা হাতও উঠল না!
“আর দু-নম্বর? সঙ্গে সঙ্গে সব্বাই হাত তুলল। তার মানে ভোটের ফলাফল বারো-শূন্য। আজ আমরা নিজেরাই হাটবাজার করব, নিজেরাই রান্নাবান্না করব!
“আচ্ছা, এবার তোরা দুভাগে ভাগ হয়ে যা। জনা ছয়েক যাবে বিমলদার সঙ্গে হাটে আর বাকিরা আয় আমার সঙ্গে। কাঠ, উনুন আর জলের ব্যবস্থা করতে হবে।
“বিমল, এই অবস্থায় খাবার মেনুটা তো বদলাতে হবে, কীরকম কী করা যায় বলো তো?”
বিমলদা বললেন —“সকালের মুড়ি তো রান্নার লোকের আনার কথা ছিল কিন্তু ছোলা আর বাদাম ভাজা আমি এনেছি। ঠোঙাও আনা হয়েছে। এখন বরং আমরা ওই দিয়ে সকালের খাওয়া সেরে নিই। দুপুরে খিচুড়ি করলে কেমন হয়?”
হই হই করে সকলে সায় দিল।
বাদাম আর ছোলা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমি ছিলাম বিমলদার সঙ্গে হাটে যাবার দলে। অনেকটা হাঁটতে হলো, এরকম মেঠো কাঁচা রাস্তায় তো বাস চলে না। আজ হাটবার। সব কিছুই পাওয়া যায় হাটে। চালডাল থেকে শাকসবজি, মশলাপাতি হাঁড়িকলসি সব। বাসে কিছু পুরোনো থলি আর বস্তা ছিল। সঙ্গে আনা হয়েছিল। তাতে চাল, ডাল, আলু পেঁয়াজ, মটরশুটি, ফুলকপি, টমেটো এইসব নেওয়া হলো। এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, হলুদ তো নেওয়া হল কিন্তু নুন কোথায়? দেখছি না তো কোথাও। জিগেস করতে জানা গেল এখানে সাদা নুন পাওয়া যায় না, কালচিটে পাথুরে নুনই শুধু বিক্রি হয়। তাই নেওয়া হলো। শেষে বিমলদা দেখেশুনে কটা মাটির হাঁড়ি কিনলেন। আর নেওয়া হলো শালপাতা গেঁথে বানানো কুড়ি-বাইশটা খাবার থালা। খিচুড়ি আর টমেটোর চাটনি করতে যা লাগে সবই পাওয়া গেছে, আমরা সকলে ভাগাভাগি করে থলি-বস্তা ঘাড়ে নিয়ে কিংবা মাটির হাঁড়ি মাথায় চাপিয়ে ফিরলাম।
এসে দেখি মাটিতে গর্ত করে ধারেধারে পাথর দিয়ে দুটো উনুন তৈরি হয়ে গেছে।
কাঠ তখনো আসেনি, মহেশ জঙ্গলের দিক থেকে দৌড়ে এসে বলল — “সাইকেলটা নেব ..” আমরা ধমক দিয়ে বললাম —“অ্যাই মহেশ, কাজে ফাঁকি দিবি না। এখন সাইকেল চালাবার সময়?”
আমাদের কথা গ্রাহ্য না করে মহেশ সাইকেলটা বার করল। তারপর কিছুটা চালিয়ে কিছুটা হাঁটিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল।
আরে ওটা কী? দেখি একটা শুকনো ডালপালার জ্যান্ত ঝোপ জঙ্গল থেকে আস্তে আস্তে আসতে বেরিয়ে আসছে!
আসলে ওটা ছিল মহেশের সাইকেল। কাঠকুটো যা পেয়েছে সব কেরিয়ারে, সীটে, সামনের রডে কোনোরকমে বেঁধে বা ঝুলিয়ে সাইকেলটা টেনে টেনে নিয়ে আসছে। আমরা সকলে হাততালি দিয়ে উঠলাম। বিমলদা বললেন, “চমৎকার বুদ্ধি — এ না হলে একসঙ্গে এত ডালপালা আনাই যেত না।”
তা তো হলো। কিন্তু স্যার বললেন —“একটা সমস্যা আছে, নদীর জল অপরিষ্কার, রান্নার আর খাবার জল লাগবে তো। বাসে দুটো চৌকো বড় তেলের তিন আছে, তার একটার আবার তলাটা ফুটো, কী করা যায় বল তো?”
এটা তো আমরা কেউ ভাবিনি। বিনোদ আমাকে ফিসফিস করে বলল —“অনেকে তো বাড়ি থেকে জলের বোতল এনেছে, ওতে হবে না?” আমি বললাম —“দুর বোকা, ওইটুকু জলে কী হবে!”
দেবেশ আর সুস্মিত দুজনে কী যেন বলাবলি করছিল। সামনে এসে বলল — “স্যার, বিজ্ঞান বইতে ছবি আছে একটা কলসিতে বালি, কাঁকর আর নুড়ি পাথর থাক থাক করে রেখে জল পরিষ্কার করা যায়। নদীপাড় থেকে বালি আর পাথর নিয়ে এসে ফুটো তেলের টিনটার ভেতরে যদি বিছিয়ে দিই?”
শুনে তো স্যার ভীষণ খুশি। —“বাঃ, দারুণ বলেছিস — এই তো চাই। যা দু-তিনজন গিয়ে বালি, কাঁকর আর একরকম সাইজের গোলগোল নুড়িপাথর নিয়ে আয়।”
ফুটো টিনের ভেতরে একটা রুমাল পেতে বালি ভরা হল। তারপর কাঁকর, তারপর নুড়ি। সেটাকে বসানো হলো আরেকটা টিনের ওপর। কলসী করে জল ঢালার কিছুক্ষণ পরে পরিষ্কার জল নিচের টিনে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে লাগল। আমরা সকলে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম — “জল আসছে! একদম পরিষ্কার!!” টিন ভর্তি হলে স্যার ওতে একটা ছোট্ট বড়ি ফেলে বললেন — “ক্লোরিন ট্যাবলেট, জীবানুনাশক। এ জল এখন নিশ্চিন্তে খাওয়া যেতে পারে!”
দুটো উনুন জ্বালানো হলো। তার একটা কেমন যেন মনমরা হয়ে প্রায় নিবেই গেল। অন্যটা অবশ্য চট করে ধরে গেল। তাতে বসল খিচুড়ি। হাট থেকে একটা ছুরি কেনা হয়েছিল তা দিয়ে আলু, পেঁয়াজ, সবজি কেটেকুটে হাঁড়িতে দেওয়া হলো। উনুনে তেজ ছিল, কিন্তু খিচুড়ি ফুটতে শুরু হতেই এক সমস্যা। খিচুড়ি নাড়া হবে কী করে? না নাড়লে তলা ধরে যাবে যে! আমাদের ক্লাসে শিবশঙ্কর বলে একটা ছেলে ছিল, ও চশমা পরত, অনেক পাওয়ার। ওকে আমরা পণ্ডিতমশায় বলতাম। পণ্ডিতমশায় একটা উপায় বার করল। ক্রিকেটের ব্যাটটা দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এল — বলল এটা তো প্রায় নতুন, একটু ধুয়ে নিয়ে এটা দিয়ে হবে না? স্যার বললেন — “খাসা বুদ্ধি, বেশ হবে।”
শিবু লেগে পড়ল। বিমলদা বললেন — “খিচুড়িতে চার ছয় মারতে যাস না আবার, আস্তে আস্তে নাড়বি। বড়জোর এক রান নেওয়ার মতো।”
এর মধ্যে আমরা সকলে ভাগ ভাগ করে নদীতে চান করে এলাম। নদীতে একটা লম্বা খুঁটি পুঁতে বিনোদের লাল সোয়েটারটা ঝুলিয়ে দিয়ে ছিলেন বিমলদা। “এটা ‘বিপদসীমা’। ওদিকটায় জল গভীর. কেউ যাবে না।”
উফ্, যা হুটোপুটি করে চান করেছিলাম!
টগবগ করে খিচুড়ি ফুটছে, আমরা শালপাতার থালা ধুয়ে তৈরি হচ্ছি। এমন সময় ফট ফটাস করে একটা শব্দ! কী হলো?
এই রে হাঁড়ি ফেটেছে!
যাক বাবা, ভাগ্য ভাল, খিচুড়ির হাঁড়িটা নয়, অন্য একটা।
বিনোদকে কাজ দেওয়া হয়েছিল টমেটোগুলো ধুয়ে রাখতে। ধোয়ার পর একটা ছোট হাঁড়িতে রেখেছিল। হাঁড়িটা মাটিতে ভালো বসছিল না, তাই যে উনুনটা জ্বলেনি সেটাতে বসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু উনুন আর কাঠের মতো খেয়ালি জিনিস আর হয় না। নিবু নিবু কাঠ যে কখন হাওয়ায় হাওয়ায় ধরে গেছে কেউ বুঝতেই পারে নি। জল না থাকায় হাঁড়িটা ফটাস করে ‘বীরগতি’ পেয়ে গেছে!!
টমেটোগুলো দেখলাম কাঠের আগুনে গিয়ে পড়েছে। চাটনি আমাদের আর ভাগ্যে নেই। কে একজন বলল — “টমেটো পোড়া খাওয়া যায় না?”
দেখাই যাক। প্রথমে একজোড়া কাঠি দিয়ে টমেটোগুলো উদ্ধার হল। বিমলদা ছুরি দেয়ে একটু চিরে চিরে ভেতরে নুন আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে দিলেন। বাসের যন্ত্রপাতির বাক্সে দুটো স্ক্রু-ড্রাইভার পাওয়া গেল। তাতে টমেটো গেঁথে নিয়ে আমরা কাঠের আগুনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝলসে নিলাম, ঠিক যে ভাবে বার-বি-কিউ করা হয়।
এবার খাওয়ার পালা। ইস, কেউ ভাবেনি যে খিচুড়ি নিতে হলে হাতা দরকার! হাতা তো নেই। কী করা যায়?
ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। এমনকী বাতাস বইয়ে, উনুনে আঁচ এনে হাঁড়ি ফাটিয়ে দেওয়াটাও আমাদের মঙ্গলের জন্যই! হাঁড়ির তলার অংশটা গোল হয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, ওটা দিয়ে দেখা গেল হাতার কাজ দিব্যি করে নেওয়া যাবে। ব্যাস্, আমরা সকলে শালপাতা নিয়ে বসে পড়লাম।
যা খাওয়া হয়ে ছিল না, কী বলব তোমাদের, এক কথায় দারুণ। সে বর্ণনা করার মতো ভাষা বা ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই। এক যদি রবীন্দ্রনাথ কাছেপিঠে থাকতেন তাহলে উনি হয়তো আমাদের দেখে “আমসত্ব দুধে ফেলি…” কবিতাটা অন্যভাবে লিখতেন।
মাটির হাঁড়িতে রাঁধি, শালপত্রে খিচুড়ি ঢালি,
টমেটো পুড়াইয়া নিয়া সাথে
হাপুস হুপুস শব্দ, নদীপাড় নিস্তব্ধ
মেঠো পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে!!
এতো সেই ক্লাস সিক্সের কথা। তারপর একটা একটা বছর পেরিয়ে আমাদের ইস্কুলের দিন শেষ হয়ে বোর্ডের পরীক্ষায় বসার সময় হল। সুধীরস্যার এ ইস্কুলে এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই আর আমাদের যখন ইস্কুল ছাড়ার সময় তখন ওনারও বদলির চিঠি এসে গেল!
সুধীরস্যার তিন-তিন বছর আমাদের ক্লাস টীচার ছিলেন। আমরা সকলে খুব ভক্তি করতাম ওনাকে। মনে হয় উনিও আমাদের সবাইকে সমান ভালবাসতেন। উনি চলে যাচ্ছেন তাই আমরা চাঁদা করে ফুলদানি আর কাশ্মীরি শাল কিনেছিলাম স্যারকে দেব বলে। একদিন ক্লাসের শেষে সুধীরস্যারকে নিমন্ত্রণ করলাম। সুধীরস্যারের বিদায় সভা।
প্রথমে আমরা কেউ কেউ ওনাকে নিয়ে কিছু বললাম। তারপর সুধীরস্যার বললেন — “তোদের দেওয়া এ দুটো জিনিস আমি রেখে দেব, সারাজীবন রেখে দেব। তোরা আমার প্রথম ছাত্র, তোদের আমি কোনদিন ভুলতে পারব না রে। তবে কয়েক বছর ধরে একটা কথা তোদের বলব বলব করেও বলা হয়ে ওঠেনি, সেটা ভাবছি বলেই দিই। আর হয়তো তোদের সবাইকে একসঙ্গে পাব না।
“পাথরঘাটায় আমাদের সেই পিকনিক মানে বনভোজনের কথা নিশ্চয় মনে আছে তোদের। সেদিন কোনো জোগাড় ছিল না, রান্না করার লোকও আসেনি — তবু আমি দেখলাম তোদের মতো ছোট ছোট ছেলেরা কীরকম সাহস করে, বুদ্ধি করে, পরিশ্রম করে সব কিছু করে ফেললি। কী যে ভাল লাগছিল আমার! স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম অসুবিধের মুখোমুখি হয়ে তোদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ভাব এসে গেছে, তোরা বুদ্ধি লাগিয়ে কাজ করছিস আর তোদের মনের জোর অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এটাই আমি চেয়েছিলাম রে। আর এটা যাতে হয় তার জন্য আমি আর বিমল ইচ্ছে করেই রান্নার লোককে বারণ করে দিয়েছিলাম। সে থাকলে হয়তো তোরা সেদিন আরও অনেক ভালো ভালো খাবার খেতে পেতিস কিন্তু এরকম বনভোজন তো হতো না রে …”
আমরা সকলে স্যারের কথা শুনে এত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে কিছুক্ষণ আমাদের কথা সরেনি। তারপর সকলে একে একে স্যারকে প্রণাম করলাম আর স্যার আমাদের জড়িয়ে ধরে আর্শীবাদ করলেন। সেই সময়টাতে মনে আছে আমাদের সকলের চোখেই জল এসে গিয়েছিল।
এসব সেই কবেকার, মানে ধরো সেই পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেকার কথা। এখন আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, চাকরিজীবনও শেষ। সেদিন খবর পেলাম সুধীরস্যার আর নেই। বিমলদার খবর জানি না। ক্লাসের ছেলেদের দু-চারজনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, বাকিরা কে কোথায় কে জানে। ইস্কুলে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, ব্যাকরণ যা যা পড়েছিলাম তা তো কবেই ভুলে গেছি কিন্তু বিশ্বাস করো, সেই বনভোজনের প্রতিটি মুহূর্ত ছবির মতো মনে আছে এখনো। কোনো মানুষেরই সব দিন সমান যায় না — ভালো দিন আসে খারাপ দিন আসে। যখনই খুব মুশকিলে পড়েছি, পাশে সাহায্য করার কাউকে পাইনি তখনই সেই বনভোজনের কথা মনে পড়েছে আর নিজের চেষ্টায় এগিয়ে যাবার উৎসাহ পেয়েছি। সেরকম বড়সড় ঘটনা তো কিছু ঘটেনি, তবু এইজন্যই বোধহয় পাথরঘাটার বনভোজন আমাদের মনে পাকাপাকি জায়গা করে রয়ে গিয়েছে। তাই ভাবলাম বনভোজনের গল্পটা তোমাদের শোনাই। তোমাদেরও যদি কোনোদিন কাজে লেগে যায়।
আর হ্যাঁ, এই সঙ্গে আরেকটা কথা না বললেই নয় — বাড়িতে তো কত কী রান্না হয়, তাছাড়া এদেশে ওদেশে ছোট-বড়-মাঝারি কত রেস্তোরাঁয় কত কী খেয়েছি। তবু সেই পাথুরে নুন আর লঙ্কা দেওয়া কাঠের আগুনে পোড়ানো টমেটোর স্বাদ সবকিছু ছাপিয়ে জিভে আজও যেন লেগে রয়েছে।