• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • খাই খাই ভূতের গল্প : অনন্যা দাশ


    ঝন্টুর সঙ্গে আমার আলাপটা স্কুল থেকে ফেরার পথেই হল। বাবার দুবাইতে পোস্টিং হয়েছে বছর দুয়েকের জন্যে তাই আমি মার সঙ্গে দাদু-দিদার কাছে এসে রয়েছি। এখানকার একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। এই জায়গাটা খুবই ছোট তবে স্কুলটা মন্দ না। টিচাররা ভালোই পড়ান। বাড়ি থেকে বেশি দূর নয় তাই আমি হেঁটেই স্কুলে যাই। কিছু অসুবিধা হয় না। সেই রকমই একদিন স্কুল থেকে ফিরছি এমন সময় দেখি আমার বয়েসি একটা ছেলে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার এক দিকে। আমি ওকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

    বললাম, “কিরে? হাঁ করে কী দেখছিস? স্কুলে যাস না?”

    ছেলেটা মাথা নেড়ে না বলল।

    আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোর নাম কী?” আসলে আমি ভাবছিলাম বাড়ির কাছাকাছি কোন একটা বন্ধু পেলে মন্দ হয় না। স্কুলের পর একটু খেলাধুলো করা যাবে।

    ছেলেটা এবার একগাল হেসে বলল, “ঝন্টু!”

    “তুই এদিকেই থাকিস?”

    ঝন্টু আঙ্গুল দিয়ে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, “ওইখানে!”

    “ও, তা স্কুলে যাস না কেন?” “কী জানি, মা বারণ করে!”

    “তোর মা তো ভারী অদ্ভুত! যাক্‌, আমার সঙ্গে খেলবি?”

    “হ্যাঁ!”

    “ঠিক আছে তাহলে একটু পরে আমার বাড়িতে চলে আসিস। মানে আমার বাড়ি নয়, আমার দাদুর বাড়ি। সেখানেই থাকছি আমরা এখন। চিনিস তুই?”

    “হুঁ! খুব চিনি।” ঝন্টু মাথা নেড়ে বলল।

    “তাহলে আসবি তো?”

    “হ্যাঁ, একটু পরে, তাই তো?”

    আমি জামাকাপড় ছেড়ে খেয়েদেয়ে একটা বই নিয়ে ছাদে গেছি ওমা দেখি ঝন্টু ছাদে এসে হাজির!

    আমি তো অবাক বললাম, “তুই কখন এলি? আর ছাদে এলি কী করে?”

    “এই তো এলাম। তোর দিদা তোর মাকে বলছিলেন কুশ ছাদে গেছে তাই শুনে এখানে চলে এলাম। এটা কী বই?”

    “দারুণ অ্যাডভেঞ্চার গল্প, তুই পড়বি?”

    ঝন্টুর মুখ অন্ধকার, বলল, “আমি তো পড়তে পারি না!”

    “আচ্ছা আমি না হয় তোকে পড়ে শোনাবো!”

    কিছুক্ষণ পড়েই আমি দেখলাম ঝন্টুর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা, সে বইটা যে পাতায় আমি বলি সেই পাতাটা খুলে ফেলতে পারে!

    আমি তো থ! বললাম, “কী করে করিস?”

    ঝন্টু মুচকি হেসে বলল, “জানি না! হয়ে যায়!”

    এর পর ও যা খেলা শুরু করল তাতে আমার মনে হল সে একেবারেই পাগল! স্পাইডারম্যানের মতন চিলেকোঠার ছাদে উঠে যাচ্ছে, ছাদের কার্নিসে, পাঁচিলের ওপর হাঁটছে! আমার তো ভয় লাগছিল হড়কে পড়েটড়ে গেলে শেষে বিপদ হবে। ওকে বলতে ও বলল, “দুর দুর আমার ওসব হয় না!” বলে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে চলল, ওর কারবার দেখে আমি তো হেসেই মরি। একটু পরে সে আমাকে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে রে, কিছু খাবার আছে?”

    “হ্যাঁ, নিচে অনেক খাবারই আছে!”

    “ঠিক আছে, আমি তাহলে নিচে গিয়ে দেখে আসি!”

    আমি বললাম, “মা বা দিদা কারো কাছে চেয়ে নিস।”

    ঝন্টু ‘ঠিক আছে’ বলে চলে গেল।

    একটু পরেই ফিরে এসে বলল, “বাহ, দারুণ খেলাম। অনেকদিন এই রকম খাইনি!”

    আরো কিছুক্ষণ পরে আমি বললাম, “এবার আমাকে পড়তে বসতে যেতে হবে নাহলে দাদু রাগ করবেন। তুই কাল আবার আসবি তো?”

    ঝন্টু মাথা নেড়ে একগাল হেসে বলল, “হ্যাঁ! এই রকম খাবার পেলে তো রোজই আসব!”


    ###

    ঝন্টু তো চলে গেল কিন্তু সেদিন রাতে যা হলো তা আর বলবার নয়।

    রাতে খাবারের সময় দিদা রান্নাঘরে ঢুকে ভয়ানক জোরে চিৎকার করে উঠলেন। আমি দাদু, মা সবার পিলে চমকে গেল। আমরা দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি দিদা মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছেন।

    মা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল মা?”

    “সর্বনাশ হয়ে গেছে! শীলার মা রুটি তরকারি সব করে দিয়ে গিয়েছিল রাতের খাবারের জন্যে, কে যেন সব খেয়ে নিয়েছে! সব বাসন খালি!”

    মা বললেন, “তুমি ঠিক দেখেছ ও রান্না করে দিয়ে গেছে? দেখো হয়তো না করেই পালিয়েছে!’

    দিদা বললেন, “না, আমি নিজের চোখে দেখেছি! শীলার মা আমাকে দেখিয়ে রেখে গিয়েছিল।”

    আমি কিছু বললাম না কিন্তু আমার মন বলছিল ওটা ঝন্টুর কাজ! কিন্তু কী বুভুক্ষু খিদে রে বাবা! চারজন মানুষের খাবার একাই খেয়ে ফেলল!

    সেদিন রাতে আমাদের ম্যাগি খেয়েই শুতে হল।

    পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথ আবার দেখতে পেলাম ঝন্টুকে। আমাকে দেখতে পেয়েই স্যঁৎ করে আমার কাছে চলে এল! আমি আজ আর ওকে পাত্তা দিতে চাইছিলাম না পাছে আবার আমাদের বাড়ি গিয়ে সব খাবার খেয়ে নেয় কিন্তু এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমার আর কিছু করার রইল না।

    ঝন্টু আমার কাছে এসে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছে আর আমি ওকে এড়ানোর জন্যে হুঁ, হাঁ বলে উত্তর দিচ্ছি, এমন সময় দেখি আমাদের ক্লাসের চারটে ছেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেগুলোকে আমি চিনি, খুব বাজে ছেলে। লাস্ট বেঞ্চে বসে, পড়াশোনায় মন নেই, টিচারদের কাছে বকা খায় কিন্তু ভাবখানা এমন যেন তারাই ক্লাসের সর্বেসর্বা! ক্লাসের একটা ছেলেকে আজ টিফিনের সময় বিরক্ত করছিল ওরা উলটোপালটা নাম ডেকে তখন আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই জন্যেই মনে হয় ওরা আমার পিছনে আসছে!

    ঝন্টুও দেখেছে ওদের। আমি দৌড়তে শুরু করেছি দেখে ও বলল, “দৌড়তে হবে না কুশ! দাঁড়া!”

    আমি বললাম, “ওদের চেহারা দেখেছিস? আমাকে কিলিয়ে কাঁঠাল বানিয়ে দেবে!”

    ঝন্টু আশ্বাস দিয়ে বলল, “কিছু হবে না, ওরা তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না, তুই শুধু দেখে যা!”

    আমি সত্যি আর দৌড়তেও পারছিলাম না তাই দাঁড়িয়ে পড়লাম, যা থাকে কপালে ভেবে!

    রতন, তমাল, আশু আর নীলু আমাকে ঘিরে দাঁড়াল, “খুব কেউকেটা মনে করছিস নিজেকে, তাই না? শহর থেকে এসেছিস বলে মাথা কিনে নিয়েছিস একেবারে! এবার এমন মজা দেখাব যে সব পাকামি ভুলে যাবি!”

    রতন একটা ব্যাট বার করল, ভয়ে আমার পা কাঁপছিল। হঠাৎ পাশ থেকে ঝন্টু বলল, “আরে ভয় পাস না! এই দেখ আমার এটা জিলিপি!”

    ওমা রতন ব্যাট হাতে গোল গোল পাক খেতে লাগল! এতটাই অবাক হয়ে গেল রতন যে ওর মুখটা হাঁ হয়ে গেল। আমিও হাঁ! আমাকে মারার বদলে প্যাংলা ঝন্টু ওকে গোল গোল ঘুরিয়ে চলেছে আর রতন কিছুই করছে না!

    “এটা সন্দেশ!” বলে ঝন্টু তমালকে কান ধরে ওঠবোস করাতে লাগল!

    “এটা ল্যাংচা!” আর আশু মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল আর নীলুকে এমন ল্যাং মারল যে সে হোঁচট খেয়ে উলটে পড়ল। তাই না দেখে ঝন্টুর সে কী হাসি! হাততালি দিয়ে লাফালাফি করতে লাগল। ওরা চারজন চোঁ চাঁ দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেল। আমি তো থ!

    ঝন্টু বলল, “কীরকম মিষ্টির নাম দিয়ে দিয়ে ওদের মজা দেখিয়ে দিলাম দেখলি? এর পর থেকে আর ওরা তোকে কোনদিন বিরক্ত করবে না দেখিস! কিন্তু অত কায়দা করতে গিয়ে যে খুব খিদে পেয়ে গেল! কী করি?”

    “আমার সঙ্গে আয়, তবে বাড়ির সব খাবার খেয়ে ফেলিস না যেন কালকের মতন!”

    ঝন্টু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, “খুব বাজে কাজ হয়ে গেছে ওটা! আসলে অত খাবার দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি!”

    “চল আজ দিদাকে বলছি, তোর জন্যে আলাদা প্লেট সাজিয়ে দেবেন ক্ষণ, চিন্তা নেই!”

    ঝন্টু থমকে দাঁড়ালো, বলল, “দিদাকে বললে লাভ হবে না, নিজেই বোকা হবি।”

    আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “কেন?”

    ঝন্টু মাথা নিচু করে বলল, “আমাকে তো আর কেউ দেখতে পায় না তুই ছাড়া, তোর দিদাও না!”

    “মানে?”

    “মানে আবার কী, বেশ কিছুদিন আগেই তো না খেতে পেয়ে মরে গিয়েছিলাম! তারপর থেকে ওই পোড়ো বাড়িটাতে থাকি। এ তল্লাটে সবাই আমার কথা জানে তাই কেউ খেলে না আমার সঙ্গে। তোকে দেখে ভাবলুম বাইরে থেকে এসেছিস তাই আমার ব্যাপারে কিছু জানিস না তো খেলবি, তাই তোর সামনে বেরিয়ে এলাম!”

    আমি এবার একটু একটু বুঝতে পারছিলাম, ঝন্টুকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই ভূত?”

    “হ্যাঁ, তাই তো বলে আমাদের, কিন্তু আমি কারো ক্ষতি করি না জানিস, তাও সবাই আমাকে বেজায় ভয় পায়!”

    “ও এবার বুঝেছি তুই ওই ছেলেগুলোকে নাকানিচোবানি কী করে খাওয়ালি! ওরা তোকে দেখতেই পাচ্ছিল না! দারুণ তো!”

    ঝন্টু হাসল, “ওরা তো বদ ছেলে, তোকে মারতে আসছিল তাই ওদের একটু টাইট দিলাম! এমনিতে ঠিকই আছি কিন্তু না খেয়ে মরেছিলাম তো তাই আমার খুব খিদে পায় মাঝে মাঝেই অথচ কেউ খেতে দেয় না!”

    “হুঁ, ঠিক আছে চল দিদাকে বলব না কিছু। আমার প্লেট থেকেই যা দেওয়ার দিয়ে দেব। বলব স্কুলে খুব দৌড় করিয়েছে তাই খিদে পেয়েছে বেজায়!”

    “তুই খুব ভালো!”

    বাড়ি ফিরে দেখি দাদুর সঙ্গে একজন বসে রয়েছেন। খুব গভীর আলোচনা হচ্ছে ওদের। আমরা দুজনেই খাওয়াদাওয়া সেরে ফেললাম তাও ওনাদের কথা থামে না। তখন আমি দিদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে দিদা? উনি কে? দাদুর সঙ্গে কী কথা বলছেন?”

    দিদা বললেন, “ও তো ঘোষমশাই। ওই সবুজপল্লীতে মিষ্টির দোকান আছে ওনার। কয়েকটা বদমাইশ ছেলে রোজ এসে বিরক্ত করছে। দোকান থেকে টাকা চায়, না দিলে দোকানে ভাঙ্গচুর করে, মিষ্টি ফেলে নষ্ট করে দেয়! খুব সমস্যায় আছেন ভদ্রলোক তাই তোমার দাদুর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে এসেছেন।”

    “কে করে ওই সব?”

    “ওই যে রজ্জু আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা। তাদের মধ্যে কন্সটেবেল যদুনাথের ছেলেটাও রয়েছে তাই পুলিশকে বলেও কোন লাভ হয়নি! তা বলে রোজ এসে টাকা চাইবে, মামারবাড়ির আবদার যেন!”

    ঝন্টু পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল। এবার ফিসফিস করে আমার কানে ওর ফন্দিটা বলে দিল।

    আমি শুনে বললাম, “বেড়ে ফন্দি তো! তাতে তোর খিদের সমস্যাও মিটে যাবে! আচ্ছা দাদুকে গিয়ে বলি!”

    আমি বাইরের ঘরে গিয়ে বললাম, “দাদু আমি দিদার কাছে সব শুনলাম। আমার কাছে কিন্তু ঘোষদাদুর সমস্যার একটা সমাধান আছে!”

    দাদু শুনে আঁতকে উঠলেন, “অ্যাঁ কুশ বলো কী! কী সমাধান?”

    “সেটা বলা যাবে না তবে তার জন্যে দাম লাগবে!”

    ঘোষদাদু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কত দাম?”

    “কত না কী বলুন! রোজ আপনাদের যা মিষ্টি তৈরি হয় তার সব রকমের একটা করে আমাকে দিতে হবে, সকাল আর বিকেল। যদি রাজি হন তাহলে দেখবেন দু’দিনেই আপনার দোকানের উপদ্রব বন্ধ হয়ে যাবে! তবে আমি কী করেছি সেটা কিন্তু বলা যাবে না! আর মিষ্টি কিন্তু সকাল বিকেল দুবেলাই দিতে হবে!”

    ঘোষদাদু শুনে বললেন, “হ্যাঁ একটা করে সব রকমের মিষ্টি দেওয়াটা তো কোন ব্যাপারই নয়, এমনিতেই ওই ছোকরাগুলো অনেক বেশি মিষ্টি নষ্ট করে আর বিক্রি না হলেও তো মিষ্টি ফেলা যায়! তাই আমি তোমার ওই প্রস্তাবে রাজি।”

    সব ঠিকঠাক হয়ে যেতে ঘোষদাদু চলে যাওয়ার পর দাদু বললেন, “তুমি তো মিষ্টি একেবারেই খেতে চাও না দাদুভাই তুমি অত মিষ্টি নিয়ে কী করবে?”

    “ওগুলো আমার জন্যে নয় দাদু, যে কাজটা করবে তার জন্যে!”

    দাদু চমকে উঠে বললেন, “তুমি কী ওই সব-সময়-খিদে-পাওয়া-বুভুক্ষু ছেলেটার পাল্লায় পড়লে নাকি?”

    ঝন্টু পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওর শুনে কষ্ট হবে দেখে আমি বললাম, “থাক না দাদু, কারো যদি উপকার হয়, আর ঝন্টু কারো ক্ষতি তো করছে না!”


    ###

    তারপর আর কী, বদমাইশ ছেলেদের দল একদিনেই শায়েস্তা! জিলিপি, সন্দেশ, রসগোল্লার প্যাঁচে এমন শাস্তি দিল ওদের ঝন্টু যে ওরা আর ঘোষদাদুর দোকানের ধারে কাছে আসার সাহস করবে বলে মনে হয় না। ঘোষদাদু খুব খুশি, থালাভর্তি মিষ্টি আমার হাতে তুলে দিতে কোন রকম আপত্তি করেন না আর ঝন্টুও খুব খুশি, ওর খিদের সমস্যাটা মিটে গেছে!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments