বেড়ালটা হারিয়ে গেছে, মিমি কেঁদে কেঁদে সারা, কোথাও নেই কোথাও নেই নায়লা। কাজ থেকে ফিরলেই নায়লা ওর ঝালরের মতো ল্যাজ নাচাতে নাচাতে এক ছুটে দৌড়ে মিমির কোলে চেপে ওঠে, তারপর বেশ খানিক আদর খেয়ে নায়লার আদিখ্যেতা শেষ হয়। আজ তার অন্যথা হলো। নায়লা এল না। অনেক ডাকাডাকি করেও যখন ওর সাড়া পাওয়া গেল না, মিমি বাড়ির সম্ভাব্য প্রতিটি কো্না ঘুপচিতে উঁকি দিল, বাগানে ঢুঁ মারল, মায় সুইমিং পুলও এক চক্কর মেরে এল, না কোথাও নেই তার আদুরি নায়লা। কী মনে হতে ত্রস্ত পদে বেডরুমে এসে মিমি দেখে বেডরুমের জানালার ইনসেক্ট স্ক্রিনটা হাতখানেক এক পাশে সরে আছে, কাল রাতে বেশ গরম ছিল, তাই কাঁচের শার্শি খোলাই ছিল, সকালে তাড়াহুড়োয় মিমি খেয়াল করেনি, তবে কি ওই পথেই নায়লা বেরিয়ে গেছে? কিন্তু নায়লা তো বাড়ি ছেড়ে এতক্ষণ থাকে না, ও কি তাহলে পথ ভুল করেছে? না কি ওই দুধসাদা ফুটফুটে পশমি পার্সিয়ান বেড়ালটাকে বাইরে দেখে কেউ ওকে তুলে নিয়ে গেছে! মিমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শূন্য ঘরটার দিকে, নিজের ওপর রাগে ওর নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছে করছে, ওর বুকটা কষ্টের মোচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। মিমি ছুটে বিল্ডিং-এর বাইরে চলে যায়, দুই তিনজন প্রতিবেশীকে জানায়, কেউ কোনো খবর দিতে পারে না, প্রত্যেকে তাদের গ্যারেজ, শেড, এমনকি গাড়ির ভেতরও আঁতিপাঁতি করে খোঁজে, না উবে গেছে নায়লা. ভারাক্রান্ত মনে ফিরে আসে মিমি ওর ঘরে। অন্ধকার ঘরটা মিমিকে যেন গিলতে আসছে, নায়লা ছাড়া ও কীভাবে থাকবে এই ঘরে? নায়লা ওর শরীরের প্রতিটি রোমকূপের সাথে, ওর প্রতি নিঃশ্বাসের সাথে জড়িয়ে আছে, ওর প্রতিটা হাসির উৎস, কান্নার উপশম নায়লা। মিমি জানে নায়লার কলার নেমপ্লেট ট্যাগে মিমির ফোন নম্বর দেওয়া আছে, কিন্তু নায়লার ওই ফুলঝুরির মতো ঘন লোমের ফাঁকে লুকিয়ে থাকে ওর নেমট্যাগ, না জানলে কেউ তো ওটা খুঁজেই পাবে না, তখন কী হবে? নাহ, এতে কাজ হবে না । কম্পিত হাতে ল্যাপটপটা খুলে বসে মিমি। তারপর লস্টমাই কিটি, ফেসবুকের পবুস্ট, ক্রেগলিস্ট ইত্যাদি সব অনলাইন সাইটে নায়লার ছবি আপলোড করে আর তার সাথে হারানো বেড়ালের একটা বিজ্ঞপ্তি আর মিমির টেলিফোন নম্বর জুড়ে দেয়। এসব করতে করতে রাত ৭টা হয়ে গেল, মিমি এর মধ্যে সারাদিনের পরে থাকা কাপড়জামাও খোলেনি, এক গ্লাস জলও খায়নি। ঘরটা মনখারাপের কালো চাদরের আঁধারে ডুবে আছে, নায়লাই তো ছিল একটা চুলবুলি আলোর ফোয়ারা, সে নেই, তাই এবাড়ির আলোও আজ নিভে গেছে । মিমি চুপটি করে বসে থেকে সেলফোন-টা হাতে করে, আশায় আশায় ওর বুক দুরুদুরু করে, কী হয় কী হয় ভাব ।
হঠাৎ মাথার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ চমকে গেল মিমির, তাড়াতাড়ি করে ও নায়লার ছবি আর হারিয়ে যাওয়া বিজ্ঞপ্তির পোস্টারের বেশ কয়েকটা প্রিন্টআউট নিয়ে নিজের পাড়ার কিছু অঞ্চলে আর কাছেপিঠের কয়েকটা কফি শপের দেওয়ালে সেঁটে দিয়ে আসে। এখন শুধু প্রতীক্ষা। রাত আটটা নাগাদ মিমির সেল ফোন বেজে উঠল, নাহ, মিমি ধরবে না, ওর ট্যাক্স একাউন্টেন্ট কল করছেন, ওর জরুরি এপয়েন্টমেন্টটা নষ্ট হবে, মরুকগে, এখন মিমি এগুলো নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতে পারবে না, নায়লাকে সবচেয়ে আগে খুঁজে পেতে হবে, আর সব কিছু পরে সামলাবে মিমি, কাল, পরশু, তরশু। আজ শুধু নায়লা। রাত ৮-৪০, কোনো একটা অজানা নম্বর থেকে কল আসছে, মিমির বুক ধড়ফড় করছে, একান্তে প্রার্থনা করে যেন কোনো এক্সিডেন্ট না হয়ে থাকে, নায়লা যেন বেঁচে থাকে, নাহ আর একটা অবান্তর টেলিমার্কেটিং-এর ফোন। রাত এগারোটা অবধি ঘরবার করতে করতে মিমির ক্লান্ত শরীর এলিয়ে আসে, মিমি সোফায় বসেই ঘুমিয়ে পড়ে।
ভোর হয়, প্রতিদিনের মতো। মিমি তাকিয়ে থাকে নায়লার খাবার বোল, জলের পাত্র--সব যেমন থাকার তেমনই আছে। মিমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, দুচোখ জ্বালা জ্বালা করে, অফিসে ফোন করে, আজ সে কাজে যেতে পারবে না, তার শরীর অসুস্থ। ঘর বন্ধ করে গাড়িটা নিয়ে মিমি বেরিয়ে আসে, চারপাশটা দিনের আলোয় টহল মারে, যদি নায়লার দেখা পায়। নাহ, নেই তার চুলবুলিটা এ চত্বরে। নোনা জল মিমির চোখ উপচে ওর চিবুক বেয়ে নিম্নগামী। মিমি মোছার চেষ্টাও করে না, গাড়ি চালাতে থাকে। অন্যমনস্কের মতো, দৃষ্টি ঝাপসা, গলার কাছে দলা দলা ব্যথা.শূন্যদৃষ্টিতে স্খলিত পায়ে ঘরে ফেরে মিমি। তারপর চোখে মুখে জল দেয়, কাল থেকে কিছু পেটে নেই. মাথাটা ঘুরছে, একটু কিছু মুখে দিতেই হবে, সামনে একটা গোটা দিন পড়ে আছে। ভাবতে ভাবতে কফি বানাতে ঢুকেছে মিমি রান্নাঘরে, ওর ফোন বেজে উঠল। এক ছুটে মিমি ফোন ধরতে গিয়ে দেখল ফোনের স্ক্রিন-এ কোনো নম্বর নেই, একটু আশ্চর্য হলো মিমি, ওপাশ থেকে ততক্ষণে একটা অজানা পুরুষ কণ্ঠ দ্বিধাভরে বলে ওঠে, "ম্যাম মনে হয় আপনার হারানো বেড়ালটা আমি পেয়েছি, আমি এই কালভার স্ট্রিট-এর কফি শপের বাইরেই আছি।" মিমি আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, পয়সার ব্যাগটা নিয়েই ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে এসে পড়ে ওর ওই পাড়ার কফি কাম স্ন্যাক্স শপে, এসে দেখে একজন হোমলেস মানুষ নায়লাকে কোলে করে সংকুচিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নায়লা দিব্যি আরামেই রয়েছে মনে হলো তার কোলে। মিমির দুই চোখ জলে ভরে ওঠে। নায়লা মিমিকে দেখেই অবশ্য সজাগ হয়ে মৃদুস্বরে ম্যাও ম্যাও করে ওঠে, লোকটি সযত্নে নায়লাকে মিমির কোলে স্থানান্তরিত করে একটা ছোট্ট বাও করে চলে যেতে উদ্যত হয়। মিমি লোকটার হাত ধরে ফেলে, বলে, "আপনাকে আমি কী বলে ধন্যবাদ জানাব, আপনি আমায় জীবন ফিরিয়ে দিলেন যে।" লোকটি সলজ্জ হেসে বলে, "না, না, এ আর এমন কি, আমি এই দোকানে রোজ সকালে আসি। ওরা আগের রাতের বাসি স্যান্ডউইচ ডাম্পস্টারে ফেলার আগেই চলে আসি। আজও তাই এসেছিলাম, এসে দেখি এই বিড়ালটা দোকানের কাছেই কেমন ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, মনে হলো খুব খিদেও পেয়েছে বিড়ালটার, কেমন মিউ মিউ করছিল, আমার দেখেই মনে হলো--এ নিশ্চয়ই আনকোরা হারিয়ে যাওয়া বেড়াল, কোনো বেওয়ারিশ নয়। তারপর দোকানের দেওয়ালে সাঁটানো আপনার ওই হারানো বেড়ালের বিজ্ঞপ্তিও চোখে পড়তে সব মিলিয়ে মনে হয় এই সেই বিড়াল।" মিমি লোকটিকে বলে আপনাকে কোথায় পাব আবার, আপনাকে কিছু দিতে ইচ্ছে করছে আমার, যদিও আপনি আমায় যা ফিরিয়ে দিলেন তা অমূল্য। লোকটি সজোরে মাথা নেড়ে বলে না, না সেসবের কিছুই প্রয়োজন নেই। আর আমার তো থাকার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ওই রিভার পার্কটায় থাকতাম, পুলিশ এসে জানিয়ে গেছে ওখানে আর থাকা যাবে না, অন্য কোথায়ও আস্তানা খুঁজতে হবে আজ। মিমি থমকে যায়, সেই ক্ষয়াটে চেহারার অজস্র তালিমারা কোট পরা সবহারানো মানুষটার দিকে চেয়ে ওর মনে হয়, শেষের সেদিন যিশুর চোখেও কি এমনি দৃষ্টি ছিল, ভালোবাসার, বেদনার, সহমর্মিতার আর ক্ষমার? মিমি জিজ্ঞাসা করে, "আপনি ফোন করলেন কিভাবে?'' অদূরের পাবলিক ফোনবুথটার দিকে আঙুল নির্দেশ করে লোকটা বলে, "দুই দিন আগে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ড্রাইভওয়ে থেকে বরফ সরিয়ে দিয়েছিলাম, তিনি বেশ কিছু পয়সা দিয়েছিলেন, তার থেকেই কিছু বেঁচে ছিল, ওতেই হয়ে গেছে।'' মিমি বলে, "আপনি অন্তত সেই পয়সাটা নিন।'' লোকটা হেসে বলে "না, না এই পয়সাটা এতদিনে একটা অন্তত ভালো কাজে লাগল। আপনি যে আপনার পুষ্যিটাকে কত ভালোবাসেন আমি তো দেখছি, কেউ যেন তার ভালোবাসার মানুষের থেকে কোনোদিন হারিয়ে না যায়।'' লোকটার চোখের দৃষ্টি উদাস। ঠোঁটের কাছে এক চিলতে কষ্টের হাসি। পিছু ফিরে লোকটা আবার হাঁটতে শুরু করে দিল।
মিমি এক ছুটে ওর কাছে চলে এল, ব্যাগে যত টাকা ছিল, মুঠো করে নিয়ে জোর করে লোকটার হাতের মুঠোয় গুঁজে দেয়, বলে, "এই পয়সাগুলো দিয়ে সম্ভব হলে আপনিও আপনার ভালোবাসার মানুষটাকে ফোন করবেন, সময় কি একেবারেই হারিয়ে গেছে খুঁজে পাবার? হয়তো নয়, নিশ্চয়ই নয়।"