এই প্রশ্ন অনেকদিন অব্দি আমার মনে জাগতো। যখন ক্লাস সেভেন-টেভেনে উঠি, কে যেন বলেছিলেন, ও দুটো মানুষের চোখ নয়, নির্জনতাবিলাসী এক প্যাঁচার, যে-বাড়ি অনেকদিন কোনো মানুষের বসবাস থাকে না, সেই বাড়ি প্যাঁচা আর বাদুড়দের দখলে যায়। হ্যাঁ, ভূতেরও আগে। পরে বুঝেছি ওসব বাজে কথা। নিজের মুখে নিজের সুখ্যাতি করতে নেই, কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়; আমি ভীষণ ডাকাবুকো। খারাপ লোকে অবশ্য আমার নাম দিয়েছে, গেছো মেয়ে, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না।
আজকাল সব্বাই কতো ভালো ছেলে-মেয়ে হয়ে গেছে, দুপুরবেলা ভবঘুরে হয়ে কুলি কুলি ঘুরে বেড়ায় না, আম-জাম পেড়ে খাওয়া তো দূর অস্ত, গাছে ওঠার কথাই ভাবতে পারে না। আমি এমন গুটিয়ে থাকা মেয়ে নই, হতে চাইও না।
আমাকে নিয়ে বাড়িতে বাবার কাছে মাঝে-মাঝে ছোটোখাটো অভিযোগে মা খুব খুশি হতেন। মা চান আমি আমার মেয়েবেলাটা মনে রাখার মতো করে কাটাই। কিন্তু আমি যাদের আম-জাম পেড়ে খাই তাঁরা অন্ধ সেজে থাকেন, এবং তাঁরা আমারই সমর্থক। অভিযোগ-টভিযোগের তাঁরা ধার ধারেন না। আমার স্মার্ট ফোনের কোনোদিন দরকার হয়নি, আমার একটা গোপন অভিসন্ধিও আছে, সেটা শুধু মাকেই বলেছি আর কারুকে না। এতক্ষণে নিশ্চয় বোঝাই গেছে আমি পড়াশুনোয় একেবারে অষ্টরম্ভা। এই শব্দটার সঠিক মানেও আমি জানি না, শুধু মাঝে মাঝে এখানে সেখানে শুনি। আন্দাজে মনে হয়, ওর মানে গোবরগণেশের চেয়ে ভালো হতে পারে না। তবে আমি তো মেয়ে, তাই অষ্টরম্ভাই সই, তাতে মেয়ে-মেয়ে ভাব আছে। যাইহোক, ছাত্রী হিসেবে আমি খারাপ হলেও আমার বই পড়ার দারুণ নেশা। পাঠ্যবই নয়, পাঠ্যবই কথাটাতেই আমার আপত্তি, গল্প-উপন্যাস কি তবে অপাঠ্য? ‘টংলিং’ বইটা যখন পড়েছি তখন আমি বাচ্চা মেয়ে। কেন জানি আমার আজও মনে হয়, যতোই কমে যাক পড়া, কিন্তু গল্প-কবিতা তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে না পৃথিবী থেকে, কোথাও না কোথাও লেখা হবেই। সবাই একরকমের মানুষ হয়ে গেলে লেখকরা চরিত্র গড়বেন কী দিয়ে? আমার মতন মেয়েরা অদৃশ্য কলমচির চোখে পড়েই, আমরাই চরিত্র হয়ে উঠি। নিজেকে এরকম ভাবে ভাবলে সাংঘাতিক এক রোমাঞ্চ হয়।
যাইহোক, এই গল্প তবু আমার না, মা-র। মা-র হারিয়ে যাওয়ার।
গ্রামের মধ্যেই মা একবার পথ হারিয়ে ফেলে কিছুতেই নিজের ঘর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এটা শুনতে একটা অতি সাধারণ ব্যাপারের মতন, কিছুটা যেন হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতনও বটে, কিন্তু মা-র সেদিনের যন্ত্রণা আমি একেবারে শেকড় থেকে ভাবতে পারি।
শহরে অনেক অলিগলি থাকে, সেখানে অচেনা মানুষ সহজেই পথভ্রষ্ট হয়; কিন্তু আমাদের গ্রামটিও কম নয়। সব গ্রামেরই মোট আয়তনকে বলে ষোলোআনা। যেমন যত কম সংখ্যাই হোক তার পরিমাণ হলো শতকরা একশো। আমাদের গ্রামের দুটি অংশ। পুব দিকটা কিছু কম, তার নাম সাত-আনা, পশ্চিমদিকের বড়ো ক্ষেত্রটির নাম ন-আনা। আমরা থাকি ন-আনায়। এখানেই বাসস্ট্যান্ড। সব বাসস্ট্যান্ডই এমন একটি জায়গায় হয় যেখানে নানা অংশের মানুষের বাস ধরবার সুবিধা থাকবে। বাসস্ট্যান্ড থেকে তাই অনেকগুলো রাস্তা নিজের নিজের গ্রামে পৌঁছতে যেন মরিয়া হয়েই আছে।
মা-র ঘটনাটির সময় আমার বয়েস পাঁচ-ছ বছর হবে, তখন থেকেই আমি বেশ ভবঘুরে। গ্রামের কোনো জায়গাই আমার অগম্য নয়।
নীল চোখের ব্যাপারটা তখনো বুঝিনি, নীল চোখের সঙ্গে দূর থেকে পরিচয় হয়েছে একেবারে গভীর দুপুরবেলা। তার কাছে যেতে সাহস করিনি। তাকে তখনো ওই প্যাঁচাই মনে হয়েছে। মা-র কাছে তার কত গল্প করি এসে। অসীমকাকুকে মা চেনেন, ওরা হলদিয়ায় থাকেন, গ্রামে আসেন কম, দু-বছর তিন বছরে একবার। কিন্তু তাঁদের বাড়ি চিনতেন না মা। মা-র পৃথিবীটা কুঁচকে কতো ছোটো হয়ে ছিল সেইসময় পরে বলছি সেকথা ।
অসীমকাকুর বাড়ি না চিনলেও মা নীল চোখের ব্যাপারও বুঝতেন। কিন্তু আমার কল্পনাকে খাটো হতে দিতে চাননি বলে ওই চোখের রহস্য অনেক দিন টিঁকে ছিল।
সেই অচেনা চোখই হারিয়ে যাওয়ার দিনে হয়েছিল মা-র পথ চেনার চিহ্ন।
অন্য গ্রামের মতন আমাদের এখানেও অনেক বনবাদাড়, দিগন্ত অব্দি ধূ ধূ মাঠ, যাকে বলে ডাঙা। ভাসুরদের নাম এখানে বড্ঠাকুর, তাদের সামনে পড়ে গেলেই মাথায় আধ হাত ঘোমটা। আর শ্বশুরদের তো কথাই নেই, তাঁরা দোর্দণ্ডপ্রতাপ, স্ত্রীলোকের বাড়বাড়ন্ত দু-চক্ষে দেখতে পারেন না।
বিয়ে হয়ে মা এসেছিলেন এমনই এক যৌথ পরিবারে। তার বেশ কিছু বছর পর আমার জন্ম। তখন সবকিছু ধীর গতিতে বদলাচ্ছে। ভাসুর-ঠাকুরদের সামনে এসে যাওয়াকে তখন আর কোনো বউই বাঘদেখার মতন ভাবেন না, ঘোমটাও মুখ ঢাকা নেই, পিছোতে পিছোতে চলে এসেছে খোঁপার কাছে। কিন্তু অনেকদিন, অনেক কাল বলা যায়, মা ছিলেন দাসীর মতনই পরাধীন। বেশি কথা বলা, হাসিঠাট্টা, কিছুরই প্রচলন ছিল না। শুধু কাজ। দুপুর একটার আগে ভাত, শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই আড়াইটের সময় চা, রাত আটটায় আবার ভাত। বাবার মনে অস্বস্তি থাকলেও যৌথ সংসারে কথা বলতে ভয় পেতেন। দাদু আর তাঁর ভাইদের উপস্থিতির কাছে বাবার উচ্চতা নিচু হয়ে যেত প্রতিদিন।
অনেকদিন পর্যন্ত আমি দেখেছি মা খুব কম কথা বলা এক মানুষ। আবার আমি বড়ো হতে তিনি যখন হাসার সাহস পেলেন, দেখি, হাসতে চাইছেন, কিন্তু হঠাৎ করে ফিকে হয়ে যাচ্ছে হাসি। মাছ ভাজতে ভাজতে দু-এক কলি গান গেয়েই অজানা ভয়ে থেমে যান। আমার তখন এক ভয়ঙ্কর কথা মনে আসে। অনেকটা সময় ধরে একটা মানুষকে অর্ধেক মানুষ করে রাখায় মা-র বিশ্বাসই জন্মে গেছে, তিনি কলের পুতুল, তাঁকে অনেকের কথা মানতে হবে, শুনতে হবে, আর তাঁকে শুধু সয়ে যেতে হবে, সইতেই তো তিনি এসেছেন।
গ্রামের মধ্যেই মা-র হারিয়ে যাওয়ার কথাটি যতোবার যে শোনে, হেসে ওঠে। আমি একটু একটু করে তাঁর সেদিনের অসহায়তা বুঝতে শিখেছি, আমার কান্না পায়। আমার একেকদিন প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে অদৃশ্য কারুর ওপর। আমি মা-কে একদিন বলি, ‘কতকাল হয়ে গেল এসেছ, চলো না গ্রামটাকে তো দেখলে না ভাল করে। চলো না মা-মেয়েতে ঘুরি।’
মা অবাক হয়ে যায়, ‘এই ভর দুপুরবেলা? লোকে কী বলবে!’
‘লোকে কিচ্ছু বলে না আজকাল। বলতে বয়েই গেছে। বললেও শুনছে কে!’
মা দুমড়ে-মুচড়ে যান। আমিও জেদ ছাড়ি না।
‘আমার কথা না শুনলে আজ রাতে আমি কিচ্ছু খাবো না, দেখো।’
এমনিতেই আমার খিদে কম। দুপুরে প্রায়-দিনই ভাত খাই না। ওয়াক আসে জোর করে খাওয়ালে।
মা আমার ভীষণ শান্ত। প্রতিবাদ করতে জানেন না কিছুরই। আমি ভাবি, জানেন না নয়, ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বের হলাম দু-জনে। আমার বড়োই ভাল লাগছে। জীবনে প্রথম মা গ্রামকে দেখছে ভাল করে।
এই গাঁয়ে মা এসেছেন আমার জন্মেরও কত আগে, তবু সব কিছু তাঁর চেয়ে আমিই ভালো চিনি।
দু-পাশাড়ি দালানকোঠা, মাঝে চওড়া রাস্তা। আজকাল গ্রমের ভেতরেও সব রাস্তাই ঢালাই করা পাকা সড়ক।
আমি একটা পুরনো ঘর দেখিয়ে মা-কে বলি, ‘কাদের জানো?’
মা রোদের ওপর চোখ মেলার চেষ্টা করে বাড়িটাকে দেখেন। জলের ওপর শোল মাছের মুখ তোলার মতো ছোটো ছোটো স্মৃতি মা-কে কষ্ট দেয়, আনন্দ দেয়।
ঝুলনকাকুদের বাড়ি। এটা নামোকুলি। অর্থাৎ নামোপাড়া। ঝুলনকাকু সম্পর্কে মা-র দেওর হতেন। মাঝে মাঝে আমাদের ঘরে আসতেন। ওঁর কথাতেই মা যা একটু হাসতেন। সবাই হো-হো করে হাসলে মহিলাদের আলতো করে হাসার সম্মতি ছিল। তবু সেটুকুই ছিল মা-র প্রাণ খুলে বাঁচা। ঝুলনকাকু অনেকদিন না এলে মা-র কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগত।
বিকেল পাঁচটায় শেষ বাস এখানে। আজও সেই বাস চলে। বেলা ফুরিয়ে আসতে আসতে তাড়াহুড়ো করে একদিন সেই বাসে করে কোথায় যে চলে গেলেন ঝুলনকাকু, দশ বছর হয়ে গেল তবু ফিরলেন না।
আমি আর মা দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই, কেউ কোত্থাও নেই। ঝুলনকাকুর ছিল পায়রা পোষার শখ। যে বাড়িতে একবার পায়রা পোষ মানে সেখানেই থেকে যায় অনন্তকাল ধরে। ঝুলনকাকু চলে যাওয়ার পরে তাঁর পায়রাদের কত ছেলেপুলে নাতিনাতনি হয়েছে, তারাও বুড়ো হয়ে গেল। মাঝখানে একবার এই বাড়িতে আগুন লাগে, তখন পায়রার দল ভয় পেয়ে উড়ে পালায়। ঘুঘুর ডাক খানিকটা খোলামেলা, পায়রা গুমরায় বেশ চাপা স্বরে, কিন্তু দুপুর ঘুমিয়ে থাকার সময় এই ডাকই হয়ে যায় কোনো কোনো বাড়ির হৃদস্পন্দন। ঝুলনকাকুর পায়ারগুলি পলাতক হওয়ার পরে বাড়িটা অনেকদিন বোবা হয়ে রইল। তারপর পায়রাগুলি ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগল আবার। ঝুলনকাকুর মা, তাঁর স্ত্রী, দুই শিশু আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠল। হয়ত এবার ঝুলনকাকুরও অজ্ঞাতবাস থেকে ফেরার সময় হলো।
আমি মা-কে রোদ্দুরের মধ্যেই ঘোরাতে লাগলাম।
মা-র পুরনো কথা মনে পড়ছে। কিছু কিছু জায়গা তাঁর খুব চেনা। আমাদের ঘর থেকে বেশি দূরও নয়। একটাই তো গ্রাম, কত দূরই বা হতে পারে! কিন্তু কুড়ি-বাইশ বছর মা কোথাও বেরোননি। কুড়ি-বাইশ? চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। মা-র আগের বহুবার দেখা জায়গাও বেশ নতুন লাগছে, যেন সাত সমুদ্দুর পারে কোথাও বেড়াতে এসেছেন।
দেখতে দেখতে আমরা এসে পড়লাম বেহুলা পুকুরপাড়ের ওপর পিচঢালা সড়কে। এটা গ্রামের মূল রাস্তা। রাস্তাটা গেছে বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
একটা কথা আমার মাথায় খেলে গেল হঠাৎ।
মা-কে সোজা বাসস্ট্যান্ডেই নিয়ে এলাম। এটা মা-র জীবনে একটা অভিনব ঘটনা। এতকাল তাঁর বিয়ে হয়েছে এই গ্রামে, কখনো এমন টইটই করে ঘুরে বেড়াননি, মেয়েমানুষ হয়ে দুপুরবেলা বাসস্ট্যান্ডে আসার কথা তিনি আজও কল্পনাতেও ভাবতে পারেন না। আমার ভালো লাগছে এই ভেবে যে, আমার কল্যাণেই মা এতদিন বাদে সত্যি সত্যি রোদ্দুরের স্পর্শ পাচ্ছে। মা-র হয়ে আমিই শিহরিত হচ্ছি। মা-র মুখ লাল হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা রোদ্দুরের জন্যে, লজ্জায় কারণে নয়।
মা অবাক হয়ে বললেন, ‘কতো দূর নিয়ে এলি রে? ফিরতে সন্দ্যে হয়ে যাবে তো!’
আমি হেসে বললাম, ‘দুর খেপি, ছেলেরা তো সবসময় এখানে আসছে আড্ডা মারতে। বাস ধরা তো আছেই। মেয়েরাও আসে। স্বপ্না কাকিমারা তো হামেশাই। এখানে নতুন একটা মেয়েদের স্টোর হয়েছে। বড় দোকান। এখন ভরদুপুর বলে খোলা নেই। একদিন তোকেও কাকিমাদের সঙ্গে নিয়ে আসবো রে খুকি। কি, আসবি তো?’
আমি ন্যাকা হয়ে উঠলে মা-কে তুই-তোকারি করি, মা সেটা খুব উপভোগ করেন।
মা-কে বলে দিতে হলো না, এক সময় তিনি নিজেই বুঝে গেলেন, এটাই বাসস্ট্যান্ড, এখান থেকেই পথ হারিয়ে ওই দূরে রুক্মিণী গ্রামের রাস্তা ধরেছিলেন ভুল করে। বিকেল ধীরে ধীরে নিভে আসছিল, আমাদের গ্রাম আর রুক্মিণীর মাঝখানের হাওয়ায় থমকে ছিল হৃষ্টপুষ্ট এক ধোঁয়ার রেখা।
অন্য অন্য জায়গায় মা শুধু তাঁর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার নির্যাসটুকু বলেই থেমে যেতেন। আমাকে বলতেন আগাগোড়া। হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে জড়ানো তাঁর মনের কথা, তাঁর উদ্বেগ, ভয়। কিন্তু আমার মনে হয়, এই হারিয়ে যাওয়া নিয়েই আরো কত কিছু মা-র বলার আছে, বলতে পারেন না। সব অনুভূতি কি বলে বোঝানো যায়?
আমি তাঁর মেয়ে, তখনও খানিকটা ছোটো, কোনোদিন যদি আর ঘরের রাস্তা খুঁজে বের করতে না পারেন মা, আমার কী হবে এই ভেবে তাঁর একরকমের আর্তি ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু কোথাও কি আশ্চর্য রকমের হালকাও লাগছিল তাঁর? মনেপ্রাণে অনুভব করছিলেন, স্বাধীনতার স্বাদ? এতে কিছুটা নিষ্ঠুরতা স্বার্থপরতার কথা প্রকাশিত হয়ে পড়ে ভেবে মা কি আমার কাছেও তাঁর এই অনুভবের পুঁটলিটি গোপন করে রেখেছেন!
পনেরো-সতেরো বছর আগে মা যখন এখান থেকে হারিয়ে যান, তখন এই জায়গা ছিল বড় বড় ইউক্যালিপটাসে ভরা। সকাল আটটার শক্তিবাস চলে গেলে বিকেল অব্দি খাঁ খাঁ করত চারিদিক। মা শুনেছেন, কার্তিকের এক ভোরবেলা ধূর্জটি ভটচাজের দোকানের ইউক্যালিপটাস গাছটির মাথায় এসে বসেছিল দুটি ময়ূর। কার্তিক আর ময়ূর! ধূর্জটি ভটচাজ এই যোগাযোগে বড় আশ্চর্য হয়েছিলেন।
নিচু হয়ে ঝুলে থাকা চপ-তেলেভাজার দোকান, ভেতরে একঘর অন্ধকার, দিনের বেলাও জ্বেলে রাখতে হতো হ্যারিকেন। ধূর্জটি ভটচাজের সেই দোকান আজও আছে।
মা-কে দেখেই ভটচাজ-দাদু হইহই করে এগিয়ে এলেন।
‘বউমা তুমি? হঠাৎ?’
মা লাজুক হাসলেন।
তিনি সম্পর্কে মা-র একরকমের শ্বশুর হবেন। তবে অন্য শ্বশুর-ভাসুরদের মতন তিনি প্রতাপশালী কোনোকালেই ছিলেন না, বেশ শান্ত নিরীহ ধরনের মানুষ। এই বাসস্ট্যান্ড যখন প্রায় জনমানবহীন ছিল সেই তখন থেকেই তাঁর এখানে দোকান। সারাদিন ধরে কাদের সঙ্গে যে বেচাকেনা হতো তিনিই জানেন।
তাঁর দোকানে গভীর রাতে সেই নির্জনতার কালে একদিন এক অদ্ভুত মানুষ আসে। মানুষ না দত্যি দানো তিনি অবশ্য ঠাহর করতে পারেননি। বন্ধ দোকানে কড়া নেড়ে আগন্তুক কিছু খাবার চেয়েছিল। তেলেভাজার দোকান বন্ধ হয়ে গেলেও খাদ্য কিছু না কিছু থাকেই। দরজা খুলে ধূর্জটি ভটচাজ অন্ধকারে কারুকে দেখতে না পেয়ে বললেন, ‘ওহে কে বটো তুমি? রা দাও।’
একটা মস্ত ইউক্যালিপ্টাসের গুঁড়ির আড়াল থেকে উত্তর এলো, ‘হোই--’
ধূর্জটি ভটচাজের ভয়-ভয় করছিল। লোকটা কে না কে হবে! চোর-ডাকু হওয়াও অসম্ভব কী! তিনি দরজার কাছে খাবার রেখে আন্দাজে লোকটিকে সে-কথা জানিয়ে দিয়েই দরজায় খিল দিলেন।
কিন্তু শুয়েও ঘুম এল না। একটা কথা মনে পড়ে যেতে তড়াক করে আবার উঠে বসলেন বিছানায়। লোকটা তাকে ‘হোই’ বলে যে প্রত্যুত্তর দিয়েছে সেই শব্দের উৎস ইউক্যালিপটাসের গুঁড়ির বেশ কিছুটা ওপরে। অত উঁচুতে মানুষের মুখ? তার মানে মানুষটি সাধারণ লোকের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি লম্বা।
ধূর্জটি ভটচাজের গোটা গা ঘামে ভিজে গেল।
সকালবেলা দেখা গেল, সেই গাছের নিচে একজোড়া চপ্পল, তাও এমনি লোকের পায়ের মাপের তিন গুণ অন্তত।
এই গল্প মা-র মুখে কত দুপুর আর কত ঝড়জলের রাত্তিরে যে শুনতে শুনতে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠেছে তার ঠিক নেই।
ধূর্জটি দাদু মা-কে আর আমাকে দোকানের কাছে গাছের ছায়ায় বসিয়ে খেতে দিলেন, বালুসাই আর গাঠিয়া। মাটির কলসি থেকে এনে দিলেন ঠান্ডা জল। আজকের দুপুরটি তাঁর কাছে সেদিনের সেই ঘটনার মতনই অন্যরকম।
মা-কে বললেন, ‘চায়ের জল বসাই দাঁড়াও মা।’
মা বললেন, ‘দুপুর আরেকটু গড়াক। ঘরে গিয়ে খাবো এখন।’
ধূর্জটিদাদু বললেন, ‘কেন মা, তোমার শ্বশুর তো বরাবর আড়াইটে না বাজতেই চা খেতেন।’
একসময় গরমে সেদ্ধ হয়েও মা-কে ভর দুপুরবেলাতেই দাদুর জন্য চা করে দিতেই হতো। ভটচাজ দাদুর সব মনে আছে।
এনার এখন বলে কিছু নেই, অতীত নিয়েই বেঁচে আছেন। তাও এমন কিছু বলার মতন নয়। পুরনো দিনের গ্রামে কত আর রোমাঞ্চ থাকবে! কিন্তু একেকটি অতি সামান্য ব্যাপার বলতে গিয়েই তিনি উচ্ছ্বসিত উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এই করে অনেকটা বেলা কেটে গেল।
ওঠার সময় তিনি মা-কে চুপিচুপি বললেন, ‘লোকে ভাবে ওষুধ খাই বলেই আমি ঠিক থাকি। ভুল। আমাকে দেখে তোমার কি খ্যাপা-পাগলা বলে কোনোদিন মনে হয়েছে বউমা? সত্যি করে বলো মা।’
মা-র হাত দুটো ধরে তাঁর চোখ জলে ভেসে গেল।
বললেন, ‘কারুকে বোলো না মা আমার, ওষুধ-টষুধ আমি জীবনে খাইনি। লোক দেখানো কিনি বটে, আবার চুপিচুপি ফেলেও দিই। তবু এখনো তো বলছি, সেদিন সেই ঢ্যাঙা লোক এসেছিল। তার চপ্পল এখনো আমার কয়লা-ঘরে টাঙানো।’
হঠাৎ থেমে গিয়ে তারপর বললেন, ‘কতদিন পরে তোমায় দেখলাম, মা আমার। আর তো যাওয়া হয় না তোমাদের ঘর। তুমিও কি আর আসবে এমনি করে! হয়ত দেখাই হবে না। শুনবে কোনোদিন আমি লোকটা নেই। তারপর ভুলেই যাবে। তবু আমি বলি মা, আমার মাথার ব্যামো নেই। কোনোদিন ছিল না।’
দাদুর মাথাটা ঝুঁকে এল মা-র কোলে। মা হাত বুলোতে লাগলেন।
আমি তো আগেই বলেছি আমার একটা অভিসন্ধি রয়েছে আজ।
রুক্মিণী গ্রামের রাস্তা ধরে আমরা সোজা না গিয়ে একটা মাঠের ওপর নেমে আমাদের গ্রামের দিকেই বেঁকে গেলাম। এই রাস্তাতেই মা পথ-ভোলা হয়েছিলেন।
একটু পরেই শীর্ণ এক জলধারা। কাছেই একটা ভাঙাচোরা কালভার্ট। আমরা বলি জোড়। তারপর বাঘ-মানমি গ্রামের ঘন গাছপালা।
কালভার্টটির পরেই শ্মশান। বড় বড় পাথর-চাটান। পাথুরে জমি। বিকেল নুয়ে এলেও খোয়া আর নুড়ি পাথর তাপ ধরে রেখেছে।
একটা ভাঙা খাট পড়ে আছে। তার বাবুই দড়ি আর খুলে পড়ে রয়েছে একদিকে। তিনটে পায়ায় দাঁড়িয়ে খাটটি। আরেকটা পায়া, যাকে আমরা বলি খুরা, অদৃশ্য।
পাথর চাটানের ওপর বসে মা অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন সেদিন।
মা সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলেন কেন?
মা গিয়েছিলেন বাপের বাড়ি। আমি যাইনি। বাবার শরীর খারাপ হয়েছিল। মাকে যেতে হয়েছিল কিছু টাকা-পয়সা সাহায্য আনতে মা-র দাদা আর ভাইয়ের কাছে। সকালে গিয়ে দুপুরের বাসে ফেরা। খেয়ে আসারও পরিস্থিতি নেই। আমার দুই মামা ভেবেছেন, বাস তো মা-র শ্বশুরবাড়ির ওপর দিয়েই রোজ যায়, বাস বদলানো-টদলানোর ঝামেলা নেই। শ্বশুরবাড়ির গ্রামে এত আমার বছর পরে তাদের বোনের পথ ভুল হয়ে যাবে তাঁরা ভাবতেও পারেননি।
অনেকক্ষণ কাঁদলে মন হালকা হয়ে যায়। নানারকম বুদ্ধি তখন প্রখর হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সেদিন মা-র মনে হলো সব জলধারাই একসময় লোকালয়ের ভেতর দিয়ে যায়। জল দেখে দেখে গেলে তিনিও এক সময় কোনো না কোনো গাঁয়ে গিয়ে পড়বেন। জোড়ের এই শীর্ণ জলের পাশে পাশেই তিনি প্রায় আধঘন্টা হাঁটলেন আর পেয়ে গেলেন আমাদেরই গ্রাম।
আমাদের খুব কাছেই একটা খ্যাঁকখ্যাঁক শব্দ হলো। পিছন ফিরে দেখি, রোঁয়া ওঠা কঙ্কালসার শেয়াল। দেখেই বোঝা যায় অনেক দিন ভালো করে খেতে পায়নি।
মা তাকে বললেন, ‘আমাদের ঘরে গেলে এঁটোকাঁটা পেতি। কেউ মারতো না তোকে।’
ধীরে ধীরে কালো হতে লাগলো জল। বেলা ডুবছে। একটা বক এখনো জলের ধারে।
আমি বললাম, ‘মা, তোমার সেদিনের আধঘন্টার রাস্তাটা আমি যদি ক্যালেন্ডারের মতন গুটিয়ে যদি এইটুকু করে তোমায় দেখাই?’
মা অবাক হয়ে বললেন, ‘কী করে?’
এই শ্মশান আমাদের গ্রামেরই। এখান থেকে শর্টকার্ট একটা রাস্তা আছে।
গ্রামের মহিলাদের মধ্যে মা-ই বোধহয় এইভাবে দু-দুবার শ্মশান ঘাটে এলেন। সেদিন মা-র ভয় করছিল। একা বসে তাঁর মনে পড়ছিল ধূর্জটিদাদুর সেই বিরাট লম্বা সেই মানুষটির কথা। সেদিন সে বেশি করে সত্যি হয়ে উঠেছিল শীতের সন্ধ্যায়।
শর্টকার্ট ধরে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সেদিন আধঘন্টা খরচ করে মা-কে পৌঁছতে হয়েছিল যে হলুদ বাড়ির সামনে।
তার জানলার নীল চোখের কথা মা তার আগেই আমার কাছে বহুবার শুনেছিলেন। তিনি তো জানেন সে আসলে কে। এবং আমাদেরই গ্রামের। আমাদের ঘর থেকে ওদের ঘর বেশি দূরেও না। সুতরাং নীল চোখ দেখেই সেদিন তিনি বড়ো করে শ্বাস নিয়েছিলেন অনেকক্ষণ পরে। ওর কাছে গিয়ে, ও মা-কে না চিনলেও মা বলেছিলেন, ‘একদিন আসবি আমাদের ঘর?’
আজ আমরা বাড়িটাকে দেখতে পেয়েও কাছে গেলাম না। তার আগেই খেপি কালির ভাঙা মন্দির। ভেতর বারান্দাটা হিম ঠান্ডা। আমরা হাঁপিয়ে গেছি। মা-কে বললাম, ‘বসবে একটু?’
এইভাবে গ্রামের বউ হয়ে মা কোনোদিন এই মন্দিরে বসেননি। আগে এসেছেন মাঝেমাঝেই। যাদের ভোজ খাওয়ানো অনুষ্ঠান করার সামর্থ নেই এমন কতো পরিবারের মেয়ের বিয়ে হয়েছে এই মন্দির থেকে। মা-রা সব মহিলা মিলে দল বেঁধে তখন বিয়ে দেখতেন আসতেন দূরে দাঁড়িয়ে।
বসে থাকতে থাকতে শুয়ে পড়লেন মা। ভেতরে প্রদীপ জ্বলছে। এখন বৈশাখ মাস। দুপুর তিনটে না বাজতেই রোজ লক্ষ্মীকান্ত পুরুত ভিজে ছোলা আর নকুলদানা নিয়ে পুজো দিতে আসে। এর নাম ধারা। আমি ধারা নিতে কোনোদিন ভুলি না। মা-র হাতে গিয়েও চাট্টি দিই। ওমা, আজ যে সত্যিই ভুলে গেলাম। নকুলদানায় পিঁপড়ে লেগে গেছে।
মা-র বোধহয় একটু তন্দ্রাও এসে গেল। ঘোরের মধ্যেই আমাকে বললেন, ‘আমার মতন অদ্রিজাকেও একদিন গ্রাম দেখিয়ে দিতে পারবি? বড়ো ভালো হয় রে তবে। ছোটোবেলায় ও মানসিকভাবে দুর্বল ছিল। হাত-পাগুলোও ছিল অবশ। এখন ও সব বোঝে। বেরোতেও চায়। না বেরোলে ও যে আরো শয্যশায়ী হয়ে যাবে! পারবি ওকে গ্রাম ঘোরাতে তুই আর আমি দু-জনে?’
আমি অদ্রিজাপিসিকে ভালো করে দেখিনি। শুধু ওর নীল চোখ দেখেছি। নীল তো যন্ত্রণারও রং।
ওর দাদা, অসীমকাকু ওকে এখানে রেখে অনেক দূরে পরিবার নিয়ে থাকে। আসে খুব কম। মা যাই ভাবুক আমি তো জেনে গেছি, ওই নীল চোখে আর রূপকথা নেই। চলতে পারে না অদ্রিজাপিসি। নিজে নিজে খেতেও তার ভীষণ কষ্ট হয়। অর্ধেক খাবার পড়েই যায়। একজন দেখার লোক আছে। সে দুদিন অন্তর আসে। জল আর খাবার রেখে দিয়ে যায়।
মা-র ঘুমঘোরের কথাটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যেন আমিও শুয়ে পড়েছি মার কাছে। মা-র বুকের কাছে মাথা ঠেকে গেছে।
আমার হঠাৎ কেন জানি মনে হলো, একটা লম্বা দুপুর মা-র বুকে। পায়রা গুমরোচ্ছে সেখানে।