• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • আমার কদমগাছ : শ্রীতমা মাইতি


    মাদের একটা কদমগাছ ছিল। আমি সে গাছটিকে বড় ভালবাসতাম। আমাদের বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট মাঠ রয়েছে। তাকে চারকোনা করে ঘিরে গিয়েছে এক সরু মোরামের রাস্তা। সেই রাস্তা যেখানে মাঠটাকে ঘিরে কোনা করে বেঁকেছে, ঠিক সেই কোণটিতে দাঁড়িয়ে থাকত আমার কদমগাছ। কদমগাছটিতে সেভাবে ফুলটুল বিশেষ ফুটত না। তবে আমার গাছটা বেশ ঝাঁকড়া ছিল। তার পাতাগুলো কিছুটা মাটি-মাটি রঙের সঙ্গে সবুজ মেশালে যেমন হয়, তেমন দেখতে ছিল।

    আমি তখন খুব ছোট্ট ছিলাম, মানে এই চার-পাঁচ বছরের আর কী! আমি সারাক্ষণ বাড়ির বাইরে একা-একাই খেলতাম। ঘুরতে ঘুরতে মনে মনে কত কথাই না ভাবতাম। আমায় তো তখন খুব ভয় দেখানো ছিল--কিছুতেই একা একা বাইরে বেরোনো হবে না। তখন যদিও রাস্তাতে শুধু সাইকেল আর মাত্র কিছু মোটরবাইক চলত, কিন্তু তাও--বলা তো যায় না! আমারও বেজায় ভয় ছিল। তো আমি একদিন ভাবলাম একা রাস্তায় বেরোব। খুব খানিক ভয়ে ভয়ে, উত্তেজনায়, এক পা এক পা করে সাবধানে চলতে থাকলাম। কদমগাছের কাছে পৌঁছে মনে হল, বাপরে আমি না জানি কী বিশ্বজয় করে ফেলেছি! খুব আনন্দ হল! তারপর ফিরে এলাম। ফিরে আসার সময় একটা সাইকেল আমায় পাশ কাটিয়ে গেল, আমিও সরে দাঁড়ালাম। সে আমার কী আনন্দ তখন, যেন কতবড় এক অ্যাডভেঞ্চার করেছি! পরে আমি এক সময় মাকে বললাম, জানো আমি আজ একা একা কদমগাছ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, মা ভীষণ অবাক হবে, আমায় বকাবকি করবে। কিন্তু মা দেখলাম, খুব একটা অবাক হল না। আমায় বলল--ও, তাই বুঝি? ভালই তো। আমি তো দেখলাম, তুমি খুব সাবধানে হেঁটে গেলে আর ফিরে এলে। এভাবেই সবসময় হাঁটবে। কেমন?

    তারপর আমি যখন আরেকটু বড় হলাম, আমি আর দিদিভাই রোজ বিকেলে হাঁটতে বেরোতাম। আমরা ওই কদমগাছটি পেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিলে আর কোন বাড়িঘর ছিল না। শুধুই মাঠ আর দূরে বন। জমিগুলোরও কত বাহার, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম। কখনও একদম ছোট, হাল্কা সবুজ চারাগাছ মাথা দোলায়। তারপর গাছেরা বড় হয়, সবুজ রং পর পর গাঢ় হয়, দখিন হাওয়ায় ধানের ক্ষেতে স্রোত বইতে থাকে। আমরা ওইসব দেখতাম, গল্প করতাম। আর দেখতাম আমাদের কদমগাছকে--বিভিন্ন ঋতুতে সে বিভিন্ন রকম হয়ে সাজত। বর্ষায় সে সবুজে সবুজ, শীতের শেষে তার পাতা শুকিয়ে গিয়ে ঝরে যেত, আবার বসন্তে গজাত নতুন সবুজ পাতা, তার রং পরপর গাঢ় হত …।

    পাড়ায় অনেকে ছাগল পোষে। তাদের মিষ্টি মিষ্টি ছাগলছানারা আমাদের কদমগাছে খেলত খুব। ছাগলছানা কিংবা একটু বড় বড় ছাগলদেরও খুব ইচ্ছে কদমগাছে চড়ার। আগেই তো বলেছি, কদমগাছটা একটু বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে থাকত। তাই তার কাছাকাছি বাঁকগুলোতে পা রেখে ছাগলগুলো খুব গাছে ওঠার চেষ্টা করত। ভারী মজা লাগত তাই দেখে আমাদের। কখনও কখনও ছোট ছাগলছানারা একটু বেশিই ওপরে উঠে যেত--তারপর আর বেচারিরা নামতে পারত না। ভয় পেয়ে ‘মা-মা’ বলে চিৎকার করত। আমাদের একটু খারাপও লাগত আবার কাণ্ড দেখে হাসিও পেত। তাই ছড়া কেটে বলতাম ---

    “বলছি ওরে ছাগলছানা
    (গাছে) চড়িস নে রে চড়িস নে …”
    এইভাবে আমিও বড় হতে থাকলাম। আমার কদমগাছ যদিও আগের মতোই ছিল, তাও তার বয়স হচ্ছিল, গুঁড়িটা মোটা হচ্ছিল। আমি তখন একটু বড় হয়েছি তো, তাই সারাক্ষণই এটা-ওটা নিয়ে আমার মনখারাপ লেগে থাকে। একদিন বোধহয় রাতে আমরা সবাই বসে টিভিতে সিনেমা দেখছিলাম। আমি তখন অতিরিক্ত বকবক করছিলাম বলে মা আমায় একটু বকেছিল। আমি কিছুই বললাম না কিন্তু আমার ভারী মনখারাপ হল। পরদিন সকালে আবার আকাশ খুব মেঘলা হয়ে আছে, বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব! তাতে তো আমার মনখারাপ আরো বেড়ে গেল। আমি তখন বাড়ির সামনে উঠোনে বসে ড্রয়িংখাতাতে পেনসিল দিয়ে খুব যত্ন করে কদমগাছটাকে আঁকলাম। তার প্রতিটা বাঁক, শাখা-প্রশাখা প্রথমে এঁকে নিয়ে এক-একটা পাতা আঁকলাম। খুব মন দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পেনসিলের শেড দিলাম, যাতে আরও সত্যি সত্যি লাগে। প্রায় এক-দেড়ঘণ্টা লেগেছিল আমার পুরো ছবিটা শেষ করতে। কদমগাছ এঁকে আমার মনখারাপও ভালো হয়ে গেছিল। উপরন্তু বাইরে একা একা বসে আছি বলে মা আদর করে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল।

    সবাই আমার কদমগাছের ছবি দেখে বলল--বাঃ! এতো পুরো সত্যিই আমাদের কদমগাছ! ছবিটা সেসময় আমার খুব প্রিয় হয়ে গেছিল। মাঝেমাঝেই খাতা খুলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

    আরও বড় হলাম। আমার কদমগাছকে আমি মনের মধ্যে আগের মতই ভালোবাসতাম। কিন্তু পড়ার চাপে, না জানি আর কত কী-র চাপ-–তাই আর আগের মত আমার কদমগাছের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম না। তবে যখন বেড়াতে যেতাম, একবার তাকাতাম ওর দিকে ভালো করে। বোধহয় আমার মনের ভাবটা কিছুটা এরকম হয়েছিল যে, আমি তো ওকে ভালোই বাসি। তাই আর দেখার দরকার কী?

    মা একদিন বলল--কদমগাছটা তো তোর জেঠুদের ভাগে পড়েছে। তারা ওটা কেটে দেবে। মুহূর্তে আমার মনটা ফাঁকা হয়ে গেল। আমি একবার বলতে চাইলাম--ওটা কি না কাটলেই নয়? মা বলে চলল--বোধহয় ওদের নতুন রান্নাঘরের দরজা জানালা বানাবে। প্রথমে মনে হল, খুব খানিক চেঁচামিচি করি, আপত্তি জানাই … কিন্তু আমি জানি, আর আমি কোনভাবেই আমার কদমগাছকে বাঁচাতে পারব না। তাকে কেটে দেওয়া হবেই। খুব কষ্ট হল। তার মাঝেই নিজেকে বোঝালাম--আমার কদমগাছের সঙ্গ হয়তো এতদূর পর্যন্তই ছিল। কিন্তু আমি ওকে মনে রাখব। তাও কিছুতেই আমার মনের কষ্ট দূর হচ্ছিল না। তখন ভাবলাম—এক কাজ করা যাক! দিন কয়েকের মধ্যেই একদিন রং-তুলি নিয়ে বারান্দায় বসে জলরঙে আমার কদমগাছের একটা ছবি আঁকব (আমি এখন ভালো জলরং করতে শিখেছি)। আর ওকে দেখতে দেখতে যদি মনে আসে (আশা করি নিশ্চয়ই আসবে) তবে ওকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখব।

    একদিন যায়, দুদিন যায়, আমি আর সেভাবে সময় পাই না। কখনও পড়া-পরীক্ষা থাকে, কখনও অন্য কোন উদ্ভট ব্যাপারে মাথা গরম হয়ে থাকে। কখনও সময় পেলে মনে হয়, না, একাজ তাজা মনে করা উচিত। এভাবে দিন চলে যায়। একদিন নিজেকে বকেই বললাম--ধুত্তোর! ওসব টালবাহানা রেখে চল দেখি জিনিসপত্র নিয়ে বারান্দায় …।

    রং-তুলি, প্যালেট, জল আর খাতা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, মাঠে জেঠু দাঁড়িয়ে আছে। আরও তিন-চারজন লোক দড়ি, করাত এসব নিয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে কাজ করছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারপর বুঝলাম কী হচ্ছে!! আমি ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে চলে এলাম। অনুভব করলাম--আমি কদমগাছকে একদিন ভালোবেসেছিলাম। তারপর সে ভালবাসা ভুলে গেছি।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ শ্রীতমা মাইতি
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments