আমার ছেলে খুব পড়ুয়া ছেলে। নিজের ছেলে বলে বলছি না, ওকে কখনও পড়াতে বসাতে হয় না। ছুটির দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ও পড়ার ঘরে চলে যায়। নিজেই বই-খাতা খুলে নিয়ে পড়তে শুরু করে। আবার পড়া হলে নিজেই আঁকার খাতা টেনে নিয়ে আঁকতে শুরু করে। ওর যখন শরীর খারাপ হয়, সকালে আমরা ওকে ডাকি না স্কুল যাবার জন্য। ওর যখন ঘুম ভাঙে, স্কুল শুরু হয়ে গেছে। উঠেই চিল চিৎকার। আমাকে ডাকলে না কেন, আমাকে স্কুল পাঠালে না কেন — ইত্যাদি। তার যে শরীর খারাপ, গা হালকা গরম, মাঝে মাঝে হাঁচছে ও নাক টানছে — সেজন্য স্কুল পাঠানো হয়নি, সে-কথা বোঝায় কার সাধ্যি!
আমরা ওকে কোন প্রেশার দিই না পড়ার জন্য। একদিন স্কুল কামাই হলে কিছু হবে না। তাছাড়া ও-যে এই বয়সে পড়ছে, আমরা কী করেছি আমাদের সময়? খেলে বেড়িয়েছি, ঘুমিয়েছি। সুতরাং ও এই ব্য়সে যা শিখেছে, তাই অনেক বলেই আমরা মনে করি। এই যেমন এখন আমি কম্প্যুটারে অফিসের কাজ করছি, ও কিন্তু আমার পিছনের খাটে বসে গেছে স্নান সেরে। আমার ডায়েরির একটা পাতা খুলে, পেন আঁকড়ে কীসব লিখছে, টের পাই। ওর খুব শখ, বড় হয়ে ট্রেন চালাবে।
লকডাউনের জন্য এখন স্কুল ছুটি। ওর ফাইনাল পরীক্ষা মিটে গেছে ফ্রেব্রুয়ারিতেই। মার্চে পুরীর টিকিট কাটা ছিল। বাতিল করতে হল। এপ্রিলে ওর রি-এডমিশন ও নিউ ক্লাস চালু হবার কথা ছিল। সব আটকে গেল। এখন মে মাস। কতদিন ও ইস্কুল যায় না — তিনমাস হয়ে গেল — স্কুলের কথা ভেবে মন খারাপ করে। চোখে জল নিয়ে বসে থেকেছে অনেকদিন। মাঝে একদিন ভেবেছিলাম স্কুলটা একবার দেখিয়ে নিয়ে আসি। ও রাজিও ছিল। খুব বেশি দূরে নয় আমাদের বাড়ি থেকে। হেঁটে গেলে দশ-পনেরো মিনিট লাগে। ওর মা যখন ছুটির পর ওকে আনতে যায়, হেঁটেই যায়। আর ও স্কুল যায় প্যাডেল-ভ্যানে চেপে। সেই ভ্যানেই ফেরার কথা। কিন্তু কেজি ক্লাসের বাচ্চা, তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যায় বলে ওর মা আনতে চলে যায়। কাছাকাছির অনেকের মা-ই আনতে যায়। নইলে ভ্যানের ভরসায় থাকলে প্রায় একঘন্টা ওকে স্কুলের রেস্টরুমে বসে থাকতে হবে। কারণ যে ভ্যানে ফিরবে, তাতে ক্লাস থ্রি-র বাচ্চা থাকে। সবাইকে একসঙ্গে ভ্যানে চাপিয়েই ওরা ফেরে।
ওর মা বললে, এই যে ওকে স্কুল দেখাতে নিয়ে যাবে বলছ, তাতে বাচ্চাকে তো বের করতে হবে। সেটা কী ঠিক হবে?
তা বটে! আমি এতটা ভাবিনি। ছেলের মনখারাপ দেখে আগুপিছু না-ভেবেই কথাটা বলে দিয়েছি। ও মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিল। এখন ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হবে।
ওর মা রেগে উঠে বলে, এই কথাটা তুমি কী করে ভুলে গেলে যে ওর স্কুলের পিছনেই যে পাড়াটা আছে, একটি করোনা পজিটিভ বেরিয়েছে; কাগজে-টিভিতে খবরও দিয়েছে — ভুলে গেলে? তারপর ওদিকে ছেলেকে নিয়ে যাবার কথা কীকরে মাথায় আসে তোমার?
একদম সত্যি! মাথাতেই ছিল না। সেই মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয়েছে, এখন মে-র মাঝামাঝি — এর মধ্যে করোনাভাইরাস ছাড়া আর কোথাও কোনও খবর নেই। তাই টিভি দেখা বন্ধ করে দিয়েছি, পাতার সংখ্যা কমে যাওয়া খবরের কাগজ বাড়িতে আসে বটে, খেলার খবর ছাড়া আর কিছু পড়ি না। বুঝতে পারছি করোনাভাইরাস আমাদের মজ্জার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, তার সঙ্গে বাস করাটায় আমরা ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠছি। তাই পাড়ার ঘটনার কথাই ভুলে মেরে দিয়েছি।
ছেলে বললে, বাবা তবে কি আমার স্কুল দেখতে যাওয়া হবে না?
চুপ করে থাকি। ওর মা বলে, এখন ছবি আঁক।
না।
তবে পোগো দ্যাখ।
দেখব না।
তাহলে বাবা জ্যান্ত মাছের ডিম এনেছে, লাল লাল করে ভেজে দিচ্ছি, বসে বসে খা।
হয় আমাকে স্কুল দেখাতে নিয়ে চলো নয়তো বাইরে থেকে কিছু কিনে এনে দাও।
ওর মা ওকে আদর করে বলে, কিছুই যে মিলছে না সোনা। দোকানে বিস্কুট নেই, ম্যাগিও নেই। ঘরে যা চাউ ছিল করে দিচ্ছি তো একটু একটু করে। বাবা রোজ বাজার যাচ্ছে, লাইন দিচ্ছে দোকানে দোকানে — কিন্তু জিনিস না পেলে আমরা কী করব বল!
তাহলে আমাকে অন্য কিছু খাবার এনে দাও।
অন্য কিছু কী রে পাগল?
ওই যে দোকান আছে, ওখান থেকে।
আরে ওটা দোকান নয়, গুমটি।
হ্যাঁ, গুমটি। এনে দাও।
কী আনব, বলবি তো!
যা পাওয়া যায়, আনবে।
আমি বলি, ওখানে কিছু পাওয়া যায় না, বাবু। ও খালি আলু-পিঁয়াজ-রসুন রাখে, আর ডিম রাখে।
সে বলে, না, আরও কিছু রাখে। দোকানের ভেতর ঝুলছে, দেখা যাচ্ছে। তোমরা আমাকে এনে দিচ্ছ না।
মহা মুশকিল! সে কিছুতেই শুনবে না, ওর মাও বললে, যাও না একবার, দেখ না যদি কিছু মেলে — এত বায়না করছে ছেলেটা; তুমি যে কেন ওকে স্কুলের কথাটা বলতে গেলে! কাল দুপুরেই ও আমাকে বলছিল, ইস্কুলের জন্য ওর মন-কেমন করছে। না-বুঝে এমন কাণ্ড করো না! কাল তো অফিসের বাসে টুক করে উঠে তুমি অফিস চলে যাবে, ওকে তারপর সামলাব কী করে? জ্বালার শেষ নেই আমার! বাধ্য হয়ে বেরোতে হয়। গুমটিটা দেখা যায় আমাদের বারান্দা থেকেই। এখান থেকে কোনোদিন কিছু কিনিনি। বাইরের দোকানে যখন যেতেই হবে, তখন এদিক-ওদিক করা কেন — এই ভেবেই ওঁর দোকানে যাইনি কখনও। একটি ফর্সামত ভদ্রলোক সেটি চালান। একটা পা টেনে চলেন। ভদ্রলোককে চিনি। নাম না জানলেও পদবি জানি। তিনি থাকেন এই ‘সাধন কমপ্লেক্স’-এর টেন ব্লকের একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে। পাড়ার পুজোতে যে নাটক হয়, একবার ওঁকে একটা পার্ট করতেও দেখেছি। কিন্তু ওঁর সম্পর্কে আর কিছুইআমি জানি না। যতদূর ধারণা, আগে হয়তো কোথাও চাকরি করতেন। সম্ভবত কোনও দুর্ঘটনায় পা-কোমরে চোট পেয়েছেন। ফলে আর চাকরিতে যেতে পারছেন না। পাড়ার মধ্যে গুমটি খুলে বসেছেন মাস দশ হবে।
গিয়ে দাঁড়ালাম দোকানের সামনে। পাড়ার মধ্যে যে ডিজাইন টালি বসানো ফুটপাত, তার পিছন ঘেঁষে, শিরীষগাছের কিনারে গুমটিটা খাড়া করা আছে। তিনি দোকানের বাইরে একটি গোল টুলে বসে থাকেন। দোকানে কোনও লোকজন নেই। একটু দূরে দুটি শালিক ঘুরছে। তিনি শালিকের চলন দেখছেন। আমাকে দেখে নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, কিছু লাগবে?
কিছু না-বলে গুমটির ভেতরটা দেখতে থাকি। তাকে রাখা আছে বিড়ি-দেশলাই-সিগারেটের প্যাকেট। দড়িতে যা সব ঝুলছে তা হল, এক টাকার মাথায় মাখার সুগন্ধী তেলের, দু’ টাকার সস, গুটকা, মশলার ছোট ছোটরঙবাহারি পাউচ। দূর থেকে তাদের চমৎকার দেখায়। এর মধ্যে ছোট বাচ্চার বাহারি কোন খাবার নেই। কী নেব?
ভদ্রলোক টুল ছেড়ে দিলেন। বললেন, বসুন। বলে নিজে বসলেন গুমটির ভেতর। বাইরে পা ঝুলিয়ে। বললাম, বাচ্চাদের মুখরোচক খাবার কিছু নেই?
ছিল। পাঁচটাকা-দশটাকা দামের সুন্দর কেক-বিস্কুট ছিল। সব শেষ হয়ে গেছে — বয়াম খালি। সাপ্লাই দিতে লোক আসছে না। তিনটাকার পার্লে জি বিস্কুট আছে, দেব?
আমি ভাবি। বেরিয়েছি যখন কিছু হাতে করে নিয়ে যেতেই হবে। মোড়ের দোকানে কিছু যে নেই, তা নয়। কিন্তু সেই একই কেক-কুকিজ ও খেতে চাইছে না। বলছে, অন্যকিছু, অন্যরকম কিছুর কথা। কিন্তু এখানে আর কী আছে? কী নেব?
বসেই পড়লাম। রঙিন ফুটপাত খানিক এঁকেবেঁকে চলে গেছে সোজা। গাছগাছালি ঢাকা। দু-একটি কুকুর সেই ছায়ায় শুয়ে আছে। শালিকদুটি গিয়ে উড়ে বসেছে সামনের ডালে।
ভদ্রলোক বললেন, আলুটালু দেব? দাম কমে গেছে, বাইশটাকা কেজি। চন্দ্রমুখী পঁচিশ। ডিমও আছে — পাঁচ টাকা পিস — আজই দিয়ে গেল — একদম টাটকা।
বললাম, ছেলেটা অন্যরকম খাবার চাইছে...
হুম, বুঝেছি। এখন তো কোথাও কিছু পাবেন না, যতদিন না লকডাউন উঠছে। লজেন্স নেবেন? নিয়ে যান না। আপনার ছেলে আমার দোকানে আসে। ওর দাদুর সঙ্গে যখন পার্কে খেলতে যায়, দু’ চারটি করে লজেন্স নিয়ে যায়। নিজে খায়, বন্ধুদের দেয়; এই যে — বলে তিনি নিজেই বয়াম খুলে লজেন্স বের করে আমার সামনে মেলে ধরলেন। বললেন, এই লজেন্স ওর খুব পছন্দের। ও এটাই কেনে। আগের স্টক ছিল আমার, তাই এখনও আছে। তাছাড়া এখন কে কিনবে, পার্ক-ই তো বন্ধ!
তাকালাম। ঝকঝকে মোড়ক। বললাম, কত করে?
একটাকা পিস।
পাঁচটা দিন।
হবে পাঁচটায়? নাকি আরও পাঁচটি দেব। বিকেলে ছেলের সঙ্গে বারান্দায় বসে আপনারাও খাবেন — দিই?
ভদ্রলোক অতি যত্নে কাগজের ঠোঙায় মুড়ে দিলেন। আমাদের পাড়ার দোকানগুলিতে এখন কাগজের ঠোঙা বিলুপ্ত। সকল দোকানদারই পলিপ্যাকেট ব্যবহার করে। মাল মেপে গার্ডার আটকে ছেড়ে দেয়। ইনি একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি কাগজের ঠোঙা ব্যবহার করেন।
ছেলে মেথডিস্ট-এ পড়ে তো?
হ্যাঁ।
কোন ক্লাসে উঠল যেন?
ক্লাস ওয়ান।
হুম। ও যখন ফেরে, এখানে বসে দেখি। রোজই যায়।
হ্যাঁ।
আমার ছেলেও পড়ে। এবার ক্লাস নাইন হল। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে।
আমাদেরও হচ্ছে। ছেলে নিজেই কম্পিউটার খুলে বসে যায়।
চালাতে পারে? বাহ!
স্কুলটাকে দেখবে বলে বায়না করছে, কিন্তু এই অবস্থায় বের করব কী করে?
ভাল করেছেন বের করেননি। ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখুন। লকডাউন না খোলা অবদি কিছু করার নেই। আপনার বোধহয় অফিস হচ্ছে।
হ্যাঁ। আজ অফ।
লকডাউনে মানুষের অনেক ক্ষতি হচ্ছে বটে কিন্তু লাভ হচ্ছে একজনের। প্রকৃতির। এই যে রাস্তাটার ওদিকেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা, আগে কিন্তু এমনি লাল ফুল ছিল না — অনেকদিনের গাছ তো, জানি। দূষণ নেই — ফুল আগের মতই হচ্ছে। বাতাসও মিষ্টি। চারিদিক দেখতে ভাল লাগে। কাগজে পড়ছি সমুদ্রতীরে মানুষের উপদ্রব নেই দেখে কচ্ছপরা ডিম পেড়ে যাচ্ছে, বোম্বের সমুদ্রে ফ্লেমিংগো সারসের ঝাঁক আসছে। গঙ্গানদী বেয়ে কুমীর পৌঁছে যাচ্ছে ফরাক্কায়, শুশুক ফিরে আসছে আবার। বিহারের কোন এক গ্রাম থেকে হিমালয় দেখা যাচ্ছে, পাঞ্জাব থেকে এভারেস্ট — আকাশ এত পরিষ্কার হয়ে গেছে।
প্রকৃতির এই শুদ্ধতার পিছনে আপনারও অবদান আছে — একটু হলেও।
কীরকম?
প্লাসটিক নয়, আপনি কাগজের ঠোঙা ব্যবহার করেন। পুরসভা তো নিত্য প্রচার করছে, প্লাসটিক ব্যবহার করবেন না, দোকানদাররা শুনছে? বললেই বলবে, খদ্দের এমনটি চায়, আমরা কী করব? সেদিক দিয়ে আপনি আলাদা।
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, আপনি লক্ষ করেছেন? কেউ করে না।
কৃষ্ণচূড়া গাছটা কে বসিয়েছিলেন, জানেন?
না। কে?
এইট ব্লকের সাহাবাবু। তিনি অবশ্যি মারা গেছেন অনেকদিন। কিন্তু গাছটা আজও আছে।
এখানে আপনার অনেকদিন হয়ে গেল, না?
বছর দশ।
আমি এসেছি সাত বছর আগে। শরিকি বাড়ি ছিল, নিজের অংশটা বেচে দিয়ে সেই টাকায় এখানে ফ্ল্যাট কিনে এসেছি। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম ফ্ল্যাটবাড়িতে বাস করতে পারব না। এখন বেশ লাগে — কেজি দুই আলু দিই? আলু তো লাগে, নাকি? আর পাঁচটা পার্লে জি বিস্কুট?
তিরিশটা ফ্ল্যাটবাড়ি নিয়ে আমাদের এই ‘সাধন কমপ্লেক্স’। প্রতিটি বাড়ি চারতলা। প্রতিটি বাড়িতে আছে মোট ষোলটি করে ফ্ল্যাট। তার পিছনেই ছেলের স্কুল। কিন্তু ওদিক দিয়ে আমরা যেতে পারি না। ওদিকে একটা খাল আছে, আর খানিকটা জঙ্গল। তাছাড়া আমাদের কমপ্লেক্স সাতফুট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তাই যাবার প্রশ্নই নেই। স্কুল যেতে হলে আমাদের ঘুরে যেতে হয়। কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে মেন রোডে উঠে সার্ভিস রোড ধরতে হয়।
টুলে বসে দেখি, পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশ। খুব ভাল লাগে। স্থানীয় কারখানা সব বন্ধ। আকাশে আকাশে নীল রং। রংএকেবারে ঝকঝক করছে। থেকে থেকে পাখিরা ডাকছে। কোকিল, টিয়া, ফিঙে — কী নেই? গোটা এই কমপ্লেক্স ভরে গেছে হাজারখানেক কাঠবেড়ালিতে।
দাম মিটিয়ে তাকিয়েই থাকি কমপ্লেক্স শেষের ওই দূর আকাশের দিকে। দূষণমুক্ত আকাশের ফাঁকে যদি চোখে পড়ে স্কুলের চূড়াটা — এক ছুট্টে গিয়ে বারান্দায় মেদুর মুখে বসে থাকা ছেলের হাত ধরে নিয়ে আসব। বলব, ওই দ্যাখ, তোর ইস্কুল। বলেছিলাম না, দেখাব।