• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গল্প
    Share
  • শেষ অশেষের ধনে : দিবাকর ভট্টাচার্য


    শ্যামাঙ্গী।

    স্বেচ্ছাচারী।

    এবং রহস্যময়ী।

    সবা‌ইকে উপেক্ষা করাই তার সহজাত প্রবৃত্তি।

    সবার অলক্ষ্যে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কারো সামনে এসে দাঁড়ানোই তার স্বভাব।

    অতি গহন, অতীব দুর্বোধ্য পথেই তার সর্বদা যাতায়াত‌।

    কিন্তু সেই গতিবিধি একজনের নয়নপথে ধরা দিল সহজেই। তিনি অবশ্যই এক ভিন্নপুরুষ। তিনি এক তরুণ কবি।

    এই কবি যখন তাকে প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিলেন তখন তার জীবনে কুড়িটি মাত্র আষাঢ় পার হয়েছে। আরেকটি আষাঢ়ের মেঘাশ্রয়ের অনেক আগেই এক আকস্মিক অশনিসংকেতের রাত্রে তিনি দেখেছিলেন তাকে। তাঁর একান্ত প্রিয়জনের কাছে আসতে। এবং সেই প্রিয়জনকে নিয়ে চলে যেতে। অবধারিত পথে।

    সেই কালরাত্রিতে ওই নবীনকবি সুস্পষ্টভাবেই দেখেছিলেন ওই অঘোরবর্ণাকে। নিশ্চিতভাবেই জেনেছিলেন সেই সহসাগতা নারীর স্বরূপ। এরপর থেকেই ওই নারীকে নিভৃতে অনুসরণ করতে লাগলেন ওই কবি। সে এক দীর্ঘ নির্জন পথযাত্রা। কবি দেখলেন সেই নারী অলৌকিকার মতো যথেচ্ছ বিচরণ করছে, কিন্তু কী ভয়ঙ্কর বাস্তব তার প্রতিটি উপস্থিতিই। যেন এক অতল বিস্ময়ের ঘোরে এই যাত্রাপথ তাঁর জীবনপথের সঙ্গে বিজড়িত হয়ে গেল সহজেই।

    * * *

    সে ছিল এক শ্রাবণী পূর্ণিমার সায়াহ্ন। কবি দেখলেন সেই নারী চলেছে এক জনপদের ভিতর দিয়ে। সবার অলক্ষ্যে। এরপর সে প্রবেশ করল নগরীর উপকন্ঠে এক নিস্তব্ধ মন্দিরে। সেখানে এক প্রাচীন বিগ্রহের সামনে পূজার উপাচার নিয়ে নিরালায় বিভোর হয়ে রয়েছে এক কিশোরী। কবি বিস্মিত হয়ে দেখলেন সেই অলক্ষিতা নারী যেন এক অলৌকিক ক্ষমতায় ওই বিগ্রহের সামনে রাখা প্রদীপের শিখায় প্রবেশ করল। আর তখনই ওই অগ্নিশিখা যেন হঠাৎ আরও দীপ্তি পেয়ে প্রসারিত হোলো চতুর্দিকে। পরমুহূর্তেই ওই অগ্নিশিখা স্পর্শ করল পূজায় মগ্ন ওই কিশোরীর শাড়ির আঁচল। এবং সে কিছু বোঝার আগেই তাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে নিল এক লেলিহান তাণ্ডব। কবি স্তম্ভিত হলেন। এবং উপলব্ধি করলেন এই সংহারের নেপথ্যটিকে।

    *

    এর কিছুকাল বাদেই কবি আবার দেখতে পেলেন ওই গহনগতি নারীকে। নিজস্ব নির্লিপ্তভঙ্গিতে সে হেঁটে চলেছে গভীর রাতে, নগরের এক রাজপথে। তাকে অনুসরণ করে কবি এসে উপস্থিত হলেন এক আলোকোজ্জ্বল অট্টালিকার সামনে। এইবার সেই অলৌকিকা অদৃশ্যা যেন নির্ধারিতভাবেই প্রবেশ করল ওই বাড়ির একটি বিপুল বর্ণালোকিত কক্ষে। সেখানে আনন্দে উচ্ছল কিছু নারীপুরুষের মাঝে বসে আছে এক দীপ্ত সুদর্শন যুবক। তার পাশে এক রম্যা যুবতী। অবশ্যই এ কোনো উদ্‌যাপনের মধুকাল। সেইসব প্রোজ্জ্বল সমারোহকে ভ্রূক্ষেপ না করে ওই আঁধারনিহিতা নারী সবার অগোচরে যেন নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ওই সুখমগ্ন যুবকটির সামনে। তারপর এক ঘোরদৃষ্টিতে তাকাল ওই যুবকের প্রফুল্ল চোখদুটির দিকে। যুবকটি যেন সহ্য করতে পারল না সেই দৃকপাত। যেন এক তীব্র যন্ত্রণায় থরথর করে কেঁপে উঠলো তার সমস্ত দেহ। সবাই ত্রস্ত হয়ে ঘিরে ধরলো সহসা চেতনারহিত স্থিরদৃষ্টি ওই যুবাকে। ওই ঘোরবর্ণা নারীর অশিবদৃষ্টি কিন্তু বিদ্ধ হয়েই র‌ইল ওই যুবকের কাতর চোখদুটিতে। যুবকটি নিস্তেজ হয়ে স্থির হয়ে গেল কবির চোখের সামনেই। কবি নীরবে প্রত্যক্ষ করলেন এই যমভূমির লীলা।

    *
    এর আরও কিছুকাল বাদেই এক প্রত্যূষের অমল আলোয় কবি আবার দেখতে পেলেন সেই আকস্মিকাকে। নগরীর উপকন্ঠ ছাড়িয়ে সে চলেছে আপনমনে। যেন এক নিশ্চিত পথে। কবি এবার তাকে অনুসরণ করে এসে পড়লেন এক পর্ণকুটিরের সামনে। সেখানে শুয়ে আছেন এক শীর্ণ বৃদ্ধ। অতি ক্লিন্ন মুখ তাঁর। চোখদুটি দূরের আকাশের দিকে নিবদ্ধ। কবি দেখলেন ওই আশ্চর্য নারীটি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ওই বৃদ্ধের দিকে। তারপর যেন এক পরম মমতায় হাত রাখলো তাঁর কপালে। বৃদ্ধটি যেন তার মুখের দিকে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেলেন তৎক্ষণাৎ। রহস্যময়ী নারীটি এইবার নির্বিকার ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো সেই জীর্ণ কুটিরটির থেকে। সমস্ত ব্যাপারটা আগের মতোই সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন কবি। আর এরপরেই এলো সেই বিপুল মুহূর্ত।

    *

    "আমি অনুমান করেছিলাম কেউ যেন আমার পিছু নিয়েছে—এখন দেখছি আমার অনুমান নির্ভুল—কিন্তু কী তোমার পরিচয়?" —এক আশ্চর্য শীতলকন্ঠে বলল সেই নারী—যখন সে হঠাৎ কবির মুখোমুখি হোলো ওই কুটির থেকে বেরিয়ে আসার সময়।

    কবি সামান্য অপ্রস্তুত হয়েও উত্তর দিলেন—"আমি কবি। কিন্তু তুমি কে রহস্যময়ী?"

    "আমি এক অবধারিতা। কিন্তু তুমি আমায় এভাবে অনুসরণ করছ কেন?" —এক‌ই রকম শীতলকন্ঠে প্রশ্ন করলো সেই নারী।

    "তোমার স্বরূপ জানার জন্য।" — শান্তকন্ঠে উত্তর দিলেন কবি।

    "কী জানলে?"

    "হ্যাঁ। তুমি অলৌকিকা। আঁধারনিহিতা। নিষ্ঠুরা।"

    "সম্পূর্ণ ভুল জেনেছ। আমি অতি কঠিনভাবে দেখা দিই বাস্তবে। দিনের আলোর মতো প্রকট হ‌ই যথাসময়ে। আমার কাজের ক্ষেত্রে নির্বিকার থাকাই আমার স্বভাব। আমার নাম মৃত্যু।"

    কবি শান্ত কন্ঠে বললেন—"তাহলে আমার অনুমানও নির্ভুল প্রমাণ হোলো।"

    "আমার পরিচয় জেনেও আমায় এইভাবে অনুসরণ করছ? আমায় আভাস মাত্র পেলেই সবাই ভয়ে পালিয়ে যায় আর তুমি কোন দুঃসাহসে আমায় জানার জন্য এইভাবে আমার পিছনে চলেছ? তুমি কি আমার ক্ষমতা এখনো বুঝতে পারো নি? —কথাগুলো যেন শীতল শলাকার মতো ভেসে এলো মৃত্যু নাম্নী নারীটির দিক থেকে।

    বলতে না বলতেই সহসা একটি ভয়ঙ্কর বিষধর সর্পে বদলে গেল সেই নারীর রূপটি। কবি সেই সাপটির দিকে তাকিয়ে বললেন—"আমার তোমার থেকে কোনো ভয় নেই। কারণ উপযুক্ত মুহূর্ত না এলে তুমি আমার শেষগতি করতে পারবে না। যদিও যন্ত্রণা দিতে পারো অবশ্যই। কিন্তু এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা তোমার নেই।"

    কবির এইকথা শেষ হওয়ার পরেই ওই ভয়ানক সর্পটি আবার সেই নারীর রূপে রূপান্তরিত হোলো। এবং বললো—"তাই বুঝি নির্ভয়ে আমায় অনুসরণ করছো? আমায় খুব কাছ থেকে দেখতে চাইছো?"

    "নাহ্‌। জীবনের সঙ্গে তোমার সম্পর্কের রহস্যটা জানতেই তোমার পিছু নিয়েছি।" —খুব শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন কবি।

    "জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক?" —কথাটা বলতে গিয়ে এক অনির্বচনীয় হাসিতে মুখটা ভরে গেল সেই তামসী রূপান্বিতার। "এর জন্য তোমাকে আমার পিছু পিছু আসতে হবে না। আমিই তোমার কাছাকাছি থাকব। দেখতে পাবে।" — কথাটি কবির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন তিনি। কবি সেই দৃষ্টির সামনে যেন বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গেলেন সেই মুহূর্তে। তিনি হয়তো কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলেন সেই দুরুহা নারীকে কিন্তু তার আগেই সে অন্তর্হিত হয়েছে স্বভাবতই।

    *

    এর পর শুরু হোলো এক গহন যাত্রা। নাহ্‌। মৃত্যুর পিছু পিছু আর যেতে হয়নি কবিকে। কারণ মৃত্যুই তার চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বারবার। একেক সময়ে একেক রকম রূপে। সে এক দীর্ঘ পরিক্রমা। এই যাত্রাপথে কবির জীবন থেকে একে একে বিদায় নিয়েছেন তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও অন্যান্য আরো অনেক একান্ত আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব। এদের প্রত্যেকের চলে যাওয়াকে কবি খুব কাছ থেকেই দেখেছেন। আর প্রতিটি মৃত্যুই যেন অনন্যরূপে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে। কখনো তাঁর তাকে মনে হয়েছে শ্যামসমান কখনো মনে হয়েছে পরাণবধূ। কখনো তার এই আকস্মিকতাকে মনে হয়েছে ঈশ্বরের অভিশাপ, কখনো বা মনে হয়েছে সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এইভাবে বারবার দোলাচলে থেকে পার হয়ে গেল বহুবছর। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কবি কিন্তু নিজেকে ক্রমশ বিজড়িত করে ফেলেছেন ওই মৃত্যুর সঙ্গে।

    এরপর একদিন কবির স্বাস্থ্য হঠাৎই অনুজ্জ্বল হয়ে গেল। তিনি আশ্রয় নিলেন রোগশয্যায়। আর তখন ওই ক্লিন্নমনে বারবার সেই তমস্বিনীর ছবির ভেসে আসতে লাগল।

    আর ওই নির্ভারিণী অবধারিতাও যেন এইবার সেই অমোঘের নির্দেশ পেলেন। যে নির্দেশকে সহজেই পালন করে এসেছেন তিনি এতকাল। কিন্তু এইবার এই নির্দেশ যেন তার কাছে বিষমভার বলে মনে হোলো। অথচ যাত্রা তাকে করতেই হবে। পৌঁছতে হবে নির্ধারিত ব্যক্তিটির কাছে। যথাসময়ে।

    অত‌এব এই অন্তরীণা অক্ষমা নারী যথামুহূর্তে প্রবেশ করল কবির কক্ষে। ‌কবি তাকে দেখেই যেন শিহরিত হলেন। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। তারপর‌ই স্মিত হেসে বললেন—"সারাজীবন ধরে দেখলাম শুধু ছলনায় ঢেকে রাখলে নিজেকে—এবার এই শেষমুহূর্তে অনাবৃতা পরমা হয়ে আসবে না? নয়তো আমাদের মিলন হবে কীভাবে?" মৃত্যু তার মুখটি নীচু করে তাকালো সেই মুমূর্ষু মানুষটির দিকে। তার দূরাশ্রয়ী নয়নপথের দিকে। মৃত্যু ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কবির দুই গালে হাত রাখল। প্রেমাস্পদার মতো। আর কবি স্থির হয়ে গেলেন সেই দূরাগতা নারীর অবর্ণা মুখশ্রীটির দিকে তাকিয়ে।

    এইবার সেই অনন্যা নারীর চোখ দুটি থেকে গড়িয়ে পড়ল দুই বিন্দু অশ্রুজল। এই প্রথম এবং শেষবারের মতো। সেই মুহূর্তে মৃত্যু উপলব্ধি করল এই কবিই একমাত্র মানুষ যে তাকে অন্তর থেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। জগতে কেউ কখনো আর তাকে নিয়ে বলার সাহস রাখবে না—"বসন খোল"। এই মানুষটিকে বিধির নিয়মে দুহাতে তুলে নিয়ে সে রিক্ত হয়ে গেল শেষ অশেষের ধনে।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ : রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments