• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গল্প
    Share
  • প্রেম মানে না মানা : লুনা রাহনুমা


    পুরোনো দিনের ল্যান্ডফোনের রিং-টোনটা প্রভার খুব পছন্দ। তাই নিজের মোবাইলের রিংটোনে সিলেক্ট করা আছে এই টিউনটি। সকাল এগারোটার দিকে আরাম করে কফির কাপ নিয়ে একটা সিনেমা দেখতে বসেছে এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো বেশ কর্কশ স্বরে ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ওদের আলাপ হলো শুরু…

    প্রভা: হ্যালো, কে বলছেন?

    অয়ন: আমি অয়ন। এটা কি তৌফিক আঙ্কেলের নাম্বার?

    প্রভা: আমাকে কি আপনার আংকেল মনে হচ্ছে? আমার কণ্ঠস্বর কি ছেলেদের মতো?

    অয়ন: জি না। আপনি মনে হচ্ছে মেয়ে হবেন। আপনি কি তৌফিক আঙ্কেলের মেয়ে?

    প্রভা: আপনার তৌফিক আঙ্কেলের কয়টি মেয়ে আছে?

    অয়ন: আমি তো জানি না। আসলে আমি তৌফিক আংকেলকে চিনিই না।

    প্রভা: আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আপনি কি ইচ্ছে করে আমার সাথে কথা বলার জন্য আঙ্কেলের গল্প ফেঁদেছেন?

    অয়ন: দেখুন আমি জানি সুন্দরী মেয়েদের ফোন করে ছেলেরা কথা বলতে চায়। অবশ্য আপনি সুন্দরী কিনা তাতো আমি জানিনা। আপনার কণ্ঠস্বরটি ভীষণ মিষ্টি। অবশ্য কণ্ঠস্বর মিষ্টি হলেই যে আপনি দেখতেও মিষ্টি হবেন তার কোনো গ্যারিন্টি নেই। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় সুন্দর কণ্ঠে সুন্দর করে কথা বলা মেয়েগুলো দেখতে ভীষণই বাজে হয়।

    প্রভা: আচ্ছা। তাহলে তো আমিও বলতে পারি যে আপনি নিশ্চয়ই দেখতে কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোর মতো সুপুরুষ হবেন কারণ আপনার কণ্ঠস্বর সেইরকম বিশ্রী, আর কী ফ্যাসফেসে! এতক্ষণে আমার কান অর্ধেক পচে গেছে বাবা।

    অয়ন: অর্ধেকটা পচে গেলে বাকি অর্ধেক আর ভালো রেখে কী হবে বলুন? চলুন ভালো মতো পরিচয় পর্বটি সেরে নেই। কানের পুরোটাই পচুক ঠিক মতো।

    প্রভা: আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার পরিচয় জেনেই ফোন করেছেন। এবার বরং আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন জনাব। আমিও একটু শুনি আপনি কে, কী করেন, কোথায় থাকেন এইসব।

    অয়ন: আপনি আমার সম্পর্কে একেবারে কিছুই যে জানেন না, তা কিন্তু ভুল। আমি আপনাকে শুরুতেই বলেছি আমার নাম অয়ন, তাই আপনি আমার নাম জানেন। আমার কণ্ঠস্বর শুনে আপনি বুঝেছেন আমি দেখতে ভীষণ বাজে। তাই নামের সাথে আমার দর্শন সম্পর্কেও আপনার ধারণা হয়ে গেছে। আমি কিছুটা হ্যাংলা বলতে পারেন, কারণ আমি আপনার মোবাইল নাম্বার জোগাড় করে একজন আংকেলকে খোঁজার নাম করে আপনাকে জ্বালাতন করছি।

    প্রভা: সে তো বুঝলাম। আরো সামনে আগাতে হবে যে। আমি জানিনা এমন কিছু বলুন এবার কষ্ট করে। আপনার বয়স কত? কোথায় থাকেন? কী করেন? নেশা পেশা এইসব আরকি? বন্ধুত্ব করার আগে মিলিয়ে দেখি আপনার সাথে বন্ধুত্ব করা যায় কি না! কত পার্সেন্ট সম্ভাবনা বন্ধু হবার আর কত পার্সেন্ট শত্রুতার!

    অয়ন: আমি কি বলেছি এখনো, কেন আপনাকে ফোন করেছি? আপনি অত নিশ্চিত হচ্ছে কেন যে ফোন করেছি মানেই আমি আপনার বন্ধু হতে চাই?

    প্রভা: চান না? তাহলে কেন ফোন করেছেন? আপনি বুঝি অনেক মেয়েকেই এভাবে ফোন করে আংকেলকে খোঁজেন? এটা কি আপনার হবি? নাকি ব্যাড হ্যাবিট?

    অয়ন: না, অতটা ভাববেন না মিস প্রভা প্লিজ। আমি আপনার সাথে আজ সামান্য হ্যাংলামো করেছি মানছি, কিন্তু যেচে পড়ে মেয়েদের সাথে আলাপের বদঅভ্যাস আমার নেই। সত্যি বলছি। আপনি ইচ্ছে করলে আশপাশে লোকজনের কাছে খোঁজ নিয়েও জানতে পারেন।

    প্রভা: আচ্ছা, আমার নামটিও আপনার জানা আছে দেখছি। ফোন নাম্বার কোথায় পেলেন বলে ফেলুন ঝটপট। নইলে আর কথা বলতে পারছি না আপনার সাথে বলে দিলাম।

    অয়ন: উঁহু, এক্ষুনি বলছি না। আরেকটু সময় লাগবে। আপনাকে একটু জ্বালাব আগে তারপরে বলব। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তারপর সেই আগুনে হাত পা উষ্ণ করে নেব। তবেই না মজা।

    প্রভা: আমি যদি বলি অপরিচিত কারো সাথে কথা বলি না? আমি যদি এখন ফোনটা রেখে দিই?

    অয়ন: পারবেন না। কারণ আপনি অলরেডি আমাকে মনে মনে বন্ধু বানিয়ে ফেলেছেন। নইলে আপনার মতো অহংকারী মেয়ের আমার মতো অচেনা মানুষের সাথে এতক্ষণ কথা বলার কথা না। আমার মনে হয় আপনি আমার বয়সটা জানতে চাইছেন সবার আগে। ঠিক না?

    প্রভা: (কিছুক্ষণ চুপ) আমি বুঝতে পারছি না আমার আসলে ফোনটি কেটে দেয়া উচিত কিনা। আপনি কি ওভারস্মার্ট? নাকি আজ একটু বেশিই বেশি স্মার্টনেস ফলাচ্ছেন আমার সাথে?

    অয়ন: হা হা হা। নাহ। আমি ঠিক ততটাই স্মার্ট যতটা স্মার্ট হলে আপনার মনের কথাগুলো মুখে বলার আগেই বুঝে নিতে পারি। তারহীন যন্ত্রের অপরপাশে বসেও যে আপনার মনের ভেতরের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো ভাষায় প্রকাশ করার আগেই টের পেয়ে যাচ্ছি কেমন দেখুন। আমাদের মনে হয় বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কাছাকাছি সম্পর্ক হতে যাচ্ছে!

    প্রভা: আপনি কি আমার পরিচিত? আমি কি আপনাকে দেখেছি আগে? আপনি কি দেখেছেন আমাকে?

    অয়ন: এখনই শুনবেন? নাকি আরো কিছুক্ষণ মেঘের লুকোচুরি খেলা চলুক মনের আকাশে। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঢেউয়ে ভেসে আরেকটু না হয় দুলুক দুই হৃদয়ের লাগামহীন ভেলা। কথার পিঠে কথার খেলায় আমরা না হয় ধীরে ধীরে আবিষ্কার করব নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির স্পর্শকাতরতাগুলো ঠিক কোথায় কখন কেমন করে উথলে উঠে, প্রচণ্ড আবেগে থরথর করে কাঁপে, অথবা নিমীলিত হয় পরম প্রশান্তিতে বুঁজে আসা আয়ত নয়নের মতো।

    প্রভা: মেঘের খেলা বেশিক্ষণ চলতে দেয়া ঠিক না অয়ন মশাই। বজ্রপাতসহ শিলাবৃষ্টির আশংকা থাকে তাতে। বলুন তো, আপনি কি কবি? কাঁধে ঝোলা, বাবরি চুল, চোখে মোটা চশমা, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, কথায় কথায় কবিতার অন্ত্যমিল খোঁজা! আপনি কিন্তু খুব সুন্দর করে কথা বলেন। গুছিয়ে বলা কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছে আমার, স্বীকার করতে হয়।

    অয়ন: আগে কবি ছিলাম না। জীবনে এই প্রথম কেউ আমাকে কবি বলে ভুল করছে। অবশ্য শুনেছিলাম, প্রেমে পড়লে সবাই কবি হয়ে যায়। এখন আপনিও আমাকে কবি বলতে পারেন। দেখছেন না, কেমন কবিতার মতো কথা বেরুচ্ছে আমারই মুখ থেকে। খুব অবিশ্বাস্য কিন্তু।

    প্রভা: কবিতা আমার খুব প্রিয়। আচ্ছা, আপনি কি আমাকে প্রেম নিবেদন করলেন এইমাত্র? বললেন যে, প্রেমে পড়লে সবাই কবি হয়ে যায়!

    অয়ন: কই না তো! আমি কি বলেছি, এই যে মেয়ে, তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ। আমি কি তোমার একটি আঙ্গুল একটু ছুঁতে পারি? বলি নাই তো এখনো এমন কথা আমার প্রিয়তমা প্রভাকে।

    প্রভা: আপনি আসলে কে বলুন তো? মনে হচ্ছে আপনি আমার খুব পরিচিত কেউ। কোথায় দেখা হয়েছে আমাদের বলবেন প্লিজ? আর পেঁচাবেন না। খুব অস্থির লাগছে আমার।

    অয়ন: বলছি। আমাদের দেখা হয়েছে। কিন্তু সামনাসামনি না। ছবিতে। আমি আপনাকে দেখেছি। আপনিও দেখেছেন আমাকে। ছবিতে দেখেই আমি আপনাকে খুব --, অবশ্য যদিও জানি না আমাকে আপনার কেমন লেগেছে। এখন জিজ্ঞেস করতেও ভয় করছে।

    প্রভা: আপনি কি আজওয়াদ?

    অয়ন: "অতি উত্তম," আমার আরবি নামের বাংলা অর্থ এটা।

    প্রভা: মাই গড! কিন্তু আপনার তো কানাডাতে থাকার কথা। ফোন করেছেন লোকাল নাম্বার থেকে। আপনি কি এখন লন্ডনে? কবে এসেছেন?

    অয়ন: আজ সকালেই পৌঁছেছি। তানিয়া ভাবিকে জানাইনি কিন্তু আমার আসার কথা। আপনার মোবাইল নাম্বারটি উনার কাছ থেকে নিয়েছি অনেক কষ্ট করে। সে যাক। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলুন দেখি! ওহ, আমার ডাক নাম অয়ন।

    প্রভা: আ আ আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। আম্মু আমাকে আপনার একটি ছবি দিয়েছে কয়েক সপ্তাহ আগে। আপনি তানিয়া আপুর দেবর, কানাডায় থাকেন। আমার কেমন লাগে জানাতে বলেছে। কিন্তু আপনি তো দেখছি খুব সাংঘাতিক মানুষ হে!

    অয়ন: হে হে হে, অতটা খারাপ না। আসলে কি হলো সেদিন জানেন, আপনার ছবিটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হলো ছবির মানুষটি আমার সাথে কথা বলছে। হাসছে। আমার চোখে চোখ রেখে বলছে, কবে তুমি আসবে? আর তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আপনার সাথে দেখা করতে হবে। যা থাকে কপালে। টিকেট কেটে চলে এলাম আপনার শহরে, লন্ডনে।

    প্রভা: এই সময় খুব দরকার ছাড়া কেউ এত পথ ট্রাভেল করে? করোনার পরিস্থিতি আমাদের এখানে ভয়ঙ্কর এখন। আমি আপনার সেইফটি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এটা কোনো কথা হলো?

    অয়ন: আমি ঠিক আছি। আপনার সাথে দেখা করা যাবে? আজকেই?

    প্রভা: ন্যাশনাল লকডাউন চলছে সবখানে। কোথায়? কিভাবে দেখা করব?

    অয়ন: সে তো আমার চেয়ে আপনার ভালো জানবার কথা। আমি কিন্তু অতিথি আপনাদের শহরে। আপনি আমাকে গাইড করবেন এই শহরের উঁচু নিচু সরু গলিতে কোথায় কিভাবে একসাথে পথ হেঁটে চলতে চলতে আমরা আমাদের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারি। এই দায়িত্ব এখন আপনার হাতে ন্যস্ত করা গেল।

    প্রভা: দেখা করার একটা উপায় খুঁজছি। চলুন আমরা কোন সুপারশপে গিয়ে শপিং করতে করতে কথা বলি। এসেন্সিয়াল শপিংয়ের জন্য শপে যাওয়া যায়।

    অয়ন: না, দোকানের ভেতর অত মানুষের মাঝে প্রথম দেখা! চলবে না।

    প্রভা: তাহলে ভিক্টরিয়া পার্কে আসুন। এক্সারসাইজ করার নামে কিছুক্ষণ একসাথে হাঁটলাম আর দেখাটাও হয়ে গেল পার্কের সবুজ ঘাসে। কানাডার যুবরাজের লন্ডন শহরে আগমন উপলক্ষে পার্কের চেনা গাছে আজ হয়তো অচেনা ফুল ফুটেছে। লেকের রাজঁহাসগুলো আজ কর্কশস্বরে না চেঁচিয়ে, রবীন্দ্রনাথের গানের মতো মিহিসুরে গাইবে - আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।

    অয়ন: আপনিও কিন্তু কবি হয়ে যাচ্ছেন! খুব ভালো হলো। আমি চাই আপনি আমার মনের সমান্তরালে নেমে আসুন। বেশি সময় নেবেন না প্লিজ।

    প্রভা: আমি এখনো আপনার প্রেমে পড়িনি। আমি অত ঝটপট কারো প্রেমে পড়ি না মিস্টার চক্ষু!

    অয়ন: হা হা হা। বুঝে শুনেই ভালোবাসুন মিস প্রভা। সারাটি জীবন কাটাবেন যার সাথে তাকে বুকে জড়িয়ে নেবার আগে ইচ্ছেমতন যাচাই বাছাই করে নিন। ভালোবাসা হয়ে যাবার পর তাকে মন থেকে শিকড় সহ উপড়ে ফেলার চেয়ে বরং আগেই ভালো করে বুঝে নেয়া ভালো এই গাছের বীজ নিজের বাগানে প্রস্ফুটিত হবে তো!

    প্রভা: আপনি মনে হয় খুব সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন এবার। আমি আপনাকে হার্ট করার জন্য কথাটা বলিনি। সরি।

    অয়ন: আরে নাহ। সরি বলবেন কেন? আমি সত্যি বললাম। আসুন দেখা করি। বড়োরা আমাকে আপনার ঘাড়ে গুঁজে দেবার আগে আপনি নিজেই বুঝে নিন আমাকে নিজের মতো করে।

    প্রভা: আপনি মনে হচ্ছে খুব রোমান্টিক মানুষ অয়ন সাহেব।

    অয়ন: আপনি। আপনিই আমাকে রোমান্টিক বানিয়েছেন। অথবা আপনার একটি ছবি এর জন্য দায়ী। আচ্ছা, পার্কে কি আপনি মাস্ক পরে থাকবেন?

    প্রভা: হি হি হি, না। পার্কে গেলে মাস্ক পরতে হয় না। কিন্তু পার্কে আঙ্গুল ছোঁয়া যাবে না। হাতে গ্লাভস থাকবে।

    অয়ন: চলবে। আমি রাজি।

    প্রভা: কিন্তু কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? তানিয়া আপু শুনলে খুব মাইন্ড করবেন। মামাতো বোনের বিয়ের ঘটকালিটা উনি করতে চেয়েছিলেন। আমি কি আসার আগে আমার আম্মুকে জানিয়ে আসব?

    অয়ন: আমি আর কিছুই শুনতে পারছি না আপনার কথা। লাইনে খুব ডিস্টার্ব। দেখা হচ্ছে ঠিক দুই ঘন্টা পর।

    প্রভা: হি হি হি। আচ্ছা। দেখা হচ্ছে। বাই।

    অয়ন: বাই।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments