হাতের ওপর হাত,লাইন দুটো লিখে প্রসন্ন মুখে একটা হাসি খেলে গেল মাইকের। আজ মাইক ব্রিয়ারলির অফ ডে, লিলি অফিস বেরিয়ে যাবার পর মাইক কবিতার খাতা নিয়ে বসেছে, গিন্নী বাড়ি থাকলে মাইকের ভুরি ভুরি কবিতা মাথায় এলেও ঠিক লেখা হয়ে ওঠে না, সাহসে কুলোয় না আর কি। লিলি মাইকের কবিতা খুব ভালো ভাবে নেয় সেটা বলা যায় না।
গভীর হচ্ছে রাত।
ইদানীং কবি এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলি বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে, একজন নতুন পাবলিশার্সকে রাজি করিয়ে ফেলেছে ওর প্রথম কাব্য গ্রন্থ, ‘লিলির সঙ্গে অলিগলি’ প্রকাশ করবার জন্য। খরচা অবশ্য সব মাইককেই দিতে হবে এবং পাবলিশার্স যাতে বইটা ছেপে কিঞ্চিৎ লাভ করতে পারে সেই কথা মাথায় রেখেই টাকা দিতে হবে, তা হোক, প্রথম প্রথম নতুন কবিদের বেলায় ওরকম হয়েই থাকে, মাইক নিশ্চিন্ত একবার বই ছেপে বেরোলে একদম সারা ইংল্যান্ডে হইচই শুরু হয়ে যাবে, ডেইলি মেল, দ্য লন্ডন টাইমসের মতো কাগজগুলো ধন্য ধন্য করবে। প্রচুর বই বিক্রি হবে এবং সমস্ত টাকা উঠে আসবে, তার আগে লিলি এই পকেটের কড়ি গর্চা দিয়ে কবিতার বই ছাপার বিষয়টা না জানলেই হলো। কটা সাহিত্য সভায় সম্বর্ধনা নিতে যেতে হবে তার সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে মাইক যখন ভাবছে,
রাতের পর, ‘ছাত’ না ‘কাত’ কোন অন্ত্যমিলটা দেওয়া যায় ঠিক তখনই রস ভঙ্গ করে মাইকের মোবাইলটা বেজে উঠল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের খোদ বড়োকর্তা টনি অ্যাডামসের ফোন। মাইকের বুঝতে বাকি থাকল না, কিছু গুরুতর ঘটেছে নয়তো অ্যাডামসের ফোন আসার কথা নয়। কবিতার খাতা বন্ধ করে মাইক ফোনটা ধরল, ভেবেছিল কয়েকটা কবিতা দ্রুত শেষ করে প্রকাশককে পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে আসবে, সে গুড়ে বালি।
অধীরদা বললেন, অতনুদা খেলা এবার জমবে মনে হচ্ছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না হলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়ো কর্তা টনি অ্যাডামস স্বয়ং কেন ফোন করবেন মাইককে? দাঁড়ান আগে কফি আর স্ন্যাকসের ব্যবস্থা করি, বলে ইন্টারকমে অর্ডার করতে ঘরে ঢুকলেন। আজ সকালে আমরা দুজনে সস্ত্রীক পুরী এসে পৌঁছেছি। অতিমারীর প্রকোপে লকডাউনে কয়েক মাস একদম হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, অধীরদাই বললেন, চলুন অতনুদা পুরী থেকেই ঘুরে আসি। সকালে বীচে খানিকটা ঘোরাঘুরি করে এসে দুপুরে খেয়েদেয়ে একটা ঘুম মেরে উঠে গিন্নীরা আবার গেছেন সীবিচে ঘুরতে আর আমরা দুজনে হোটেলের বারান্দায় বসেছি ডাবলিন থেকে আসা, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’ এর লেটেস্ট এডিশনে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলির গোয়েন্দাগিরির কাহিনি নিয়ে।
কফিতে চুমুক দিয়ে অধীরদা আবার শুরু করলেন—
অ্যাডামস ফোনে সংক্ষেপে মাইককে বললেন, ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টির প্রেস্টন সিটির হ্যারিস মিউজিয়াম & আর্ট গ্যালারির কিউরেটর গ্রাহাম থর্প মিউজিয়ামের ভেতরে নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেছেন গত পরশু বুধবার আর পরের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ আবিষ্কার করেছেন মিউজিয়ামের আটশো তৈলচিত্রর মধ্যে জর্জ ফ্রেডেরিক ওয়াটসের আঁকা বিখ্যাত পেন্টিং, ‘দ্য ইনোসেন্ট’ উধাও। প্রেস্টন সিটি পুলিশ এই জোড়া রহস্যের সমাধানে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য চেয়েছে। মাইক, তোমাকে প্রেস্টন সিটিতে যেতে হবে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে তোমার জন্য বিস্তারিত ব্রিফিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুমি অবিলম্বে চলে এস। মাইক ব্রিয়ারলি অ্যাডামসকে বলল, ইতোমধ্যে যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়ে গেছে, রবার্টসন (স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে মাইক ব্রিয়ারলির সহকারী) বরং সব কাগজপত্র সহ ভিক্টোরিয়া রেল স্টেশনে চলে আসুক, লন্ডন থেকে প্রেস্টন যাওয়ার সবথেকে দ্রুত যোগাযোগ হচ্ছে রেলপথে, সওয়া একঘন্টা মতো লাগবে। এখন সকাল দশটা বাজে, রবার্টসন যেন এগারোটার মধ্যে স্টেশনে চলে আসে, ট্রেনে যেতে যেতে রবার্টসনের থেকে যা জানার জেনে নেব। অ্যাডামস বললেন, তবে তাই হোক।
আমি অধীরদাকে বললাম, অধীরদা আমি কিন্তু ২০১৯ এ প্রেস্টন সিটি থেকে ঘুরে এসেছি অফিসের কাজে। অধীরদা বললেন, দারুণ তো! আমি জানতাম আপনি লন্ডনে গেছিলেন। আমি বললাম, ঠিকই জানতেন, আর লন্ডন থেকে মাইকরা যেভাবে ট্রেনে প্রেস্টন সিটি যাচ্ছে, আমিও সেভাবে গেছিলাম, তবে হ্যারিস মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি & লাইব্রেরিতে যাওয়া হয়নি, আমি কয়েকঘন্টার জন্য আমার কোম্পানির এক বায়ারকে মীট করতে গেছিলাম। আমার স্বভাব হলো, যে জায়গায় যাই, সে জায়গা সম্বন্ধে একটু পড়াশোনা করে যাই, তাই প্রেস্টন সিটিতে এরকম একটা খুন আর চুরির ঘটনায় আমি খুব অবাক হচ্ছি, কারণ প্রেস্টন সিটিকে শুধু ইংল্যান্ডে নয় সমগ্র ইওরোপেই খুব নিরাপদ জায়গা বলে ধরা হয়, অপরাধের ঘটনা প্রায় শূন্য, রাতেও চুরি ছিনতাই হয় না, প্রেস্টনের জনসংখ্যাও চার লাখের সামান্য বেশি। আমি আন্দাজ করতে পারি বুধবার কাজের দিনে হ্যারিস মিউজিয়ামে খুব একটা জন সমাগম হবার কথা নয়, খুনী বোধহয় সেই সুযোগটাই নিয়েছে, তা খুনটা হয়েছিল কখন?
অধীরদা বললেন, হ্যাঁ সেই কথাতেই আসছি, বলে দ্য ইনভেস্টিগেটরের পৃষ্ঠা ওল্টালেন।
মাইক ট্রেনে উঠে জুত করে বসে রবার্টসনকে বলল, শুরু করো তোমার পাঁচালি। আগে বলো খুনটা কখন হয়েছিল এবং কীভাবে হয়েছিল।
রবার্টসন বলল, কিছুক্ষণ আগেই প্রেস্টন সিটি পুলিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে মেল করে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাঠিয়েছে। বুধবার রাতে খুনটা হওয়ায় পরের দিন সূর্যোদয় অবধি স্বভাবতই পোস্ট মর্টেম শুরু করার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। (পাঠকের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে পোস্টমর্টেম করতে হয়, কেননা টিউব বা এলইডি লাইটের আলোয় ক্ষত চিহ্ন লালের বদলে বেগুনি রঙের মনে হয়।) চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অর্থাৎ আজ শুক্রবার সকালে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট চলে আসে।
রবার্টসন বলল, খুনটা হয় বুধবার রাত্রি ৮.৩০-৯. ৩০ এর মধ্যে। একমাত্র বুধবার দিন হ্যারিস মিউজিয়াম রাত্রি ১০ টা অবধি খোলা থাকে, ওদিকে আবার মিউজিয়ামের একজন কর্মচারী বলছে সে রাত ৯.৩০ নাগাদ মি: থর্পকে জীবিত অবস্থায় দেখেছে। যদিও সে না কি থর্পের মুখ দেখেনি, সুতরাং তার কথায় পুরো ভরসা করা যায় না।
সে, যাইহোক, দশটা বেজে যাওয়ার পরও কিউরেটর অফিস ছেড়ে বেরচ্ছেন না দেখে, সিকিউরিটি ইনচার্জ ইন্টারকমে থর্পকে কল করেন, থর্প রিসিভার না তোলায়, থর্পের মোবাইলে ফোন করেন, রিং হয়ে যায়, থর্প ফোন ধরেন না। তখন দুজন গার্ড থর্পের চেম্বারে এসে তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। মাথার পেছনটা ভারি কিছুর আঘাতে থেঁতলে গেছে, সমস্ত মুখ ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফালা ফালা করা এবং থর্পের দুটো হাত কব্জি থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে, সেদুটোর খোঁজ মেলেনি, খোঁজ মেলেনি কোনও ধারালো অস্ত্রের। ঐ সময় কোনও দর্শণার্থী মিউজিয়ামে ছিলেন না, গার্ডেরা বাইরে থেকে কোনও শব্দ পায়নি, মিউজিয়ামের ভেতরে সিকিউরিটি গার্ডদের আসার কারণ ঘটে না, তারা সিসিটিভির মাধ্যমেই নজর রাখেন, কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজ থেকে কিছু জানা যায়নি, ঐ সময়ের ফুটেজ পাওয়া যায়নি, খুনটা হয় কিউরেটর গ্রাহাম থর্পের অফিসে, সিসিটিভি ব্যবস্থা তখন বিকল।
অধীরদা একটা সিগারেট ধরাতে থামলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু অয়েল পেন্টিংটা উধাও হলো কী’করে? ‘দ্য ইনোসেন্ট’ তো পৃথিবী বিখ্যাত পেন্টিং। অধীরদা বললেন, হ্যাঁ, জর্জ ফ্রেডেরিক ওয়াটস উনবিংশ শতাব্দীর প্রধানতম ইংরেজ পেন্টারদের মধ্যে গণ্য হবেন। তাঁর বিখ্যাত পেন্টিংগুলোর মধ্যেও, ‘হোপ’, ‘ফাউন্ড ড্রাউনড’ আর ‘দ্য ইনোসেন্ট’ অধিক চর্চিত। সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে অধীরদা হেসে বললেন, অতনুদা ভাববেন না যে আমি খুব পেন্টিং বিশেষজ্ঞ। এই তথ্যগুলো সব দ্য ইনভেস্টিগেটরেই লিখেছে, আর পেন্টিংটার মাপ হচ্ছে চার ফুট বাই সাড়ে চার ফুট। মাইক আপনার প্রশ্নটাই রবার্টসনকে করেছিল, পেন্টিংটা উবে গেল কী’করে! রবার্টসন যেটুকু জানাতে পেরেছে, তা হল, পুলিশি তদন্ত শেষ হবার পর, খুনের পরের দিন একটু দেরিতে প্রায় বেলা বারোটা নাগাদ, মিউজিয়াম খোলার অনুমতি দেয় পুলিশ, শুধু থর্পের ঘর তারা সিল করে দেয়। সেইসময় একজন কর্মচারী খেয়াল করেন, দ্য ইনোসেন্ট নির্দিষ্ট দেওয়ালে নেই। এক্ষেত্রেও সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়নি। ছবিটা খুব উঁচুতে টাঙানো ছিল না, আর্ট গ্যালারিতে অনেক ছবি বিভিন্ন উচ্চতায় লাগানো আছে, তার বেশ কিছু ছবি মানুষের আয়ত্তের মধ্যে, শুধু যাতে কেউ এইসব অমূল্য ছবিতে হাত না দেয়, তার জন্য স্টিল বারের সঙ্গে টেপ বেঁধে একটা দূরত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। চলুন অতনুদা, মাইকদের ট্রেন প্রেস্টন সিটি স্টেশনে ঢুকছে, প্রেস্টন সিটি পুলিশের অফিসার মার্ক জোন্স এসেছেন মাইক আর রবার্টসনকে রিসিভ করতে, দেখা যাক জোন্স কী বলছেন।
মাইকদের সাদরে অভ্যর্থনা করে জোন্স বললেন, থর্প হত্যার তদন্তভার প্রেস্টন পুলিশের পক্ষে তিনিই সামলাচ্ছেন, খুনের কিনারা তিনি করে ফেলেছেন, খুনীকে গারদে পোরা খালি সময়ের অপেক্ষা। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট তো দেখেছেন, বলছে ভারি কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুনটা করা হয়েছে, আঘাতটা করা হয়েছে মাথার পেছন দিকে, তারপর ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে কব্জিদুটো কেটে নেওয়া হয়েছে এবং মুখটা ফালা ফালা করে কাটা হয়েছে, মৃতদেহ দেখে চেনাই মুশকিল। মাইক বলল, তাহলে চিনলেন কী’করে? জোন্স বলল মিসেস থর্প লাশ দেখে শনাক্ত করেছেন, থর্পের বুকে একটা আঁচিল ছিল, তাছাড়া পরনের হুডিও থর্পের বটে। অনেকেই সেদিন ঐ হুডি পরিহিত থর্পকে দেখেছে।
পোস্ট মর্টেমে মৃত্যুর সময় বলা হয়েছে ৮.৩০-৯.৩০ মিনিটের মধ্যে। মিউজিয়ামের কর্মচারী রোজ বাটলার জেরায় বলেছে সে ৯.৩০ এর সময় থর্পকে টয়লেটে হাত ধুতে দেখেছে, তাদের মধ্যে কথা হয়নি এবং সে পিছন থেকে থর্পকে দেখেছে, মনে হয় বাটলার সময়টা গুলিয়ে ফেলেছে অথবা অন্য কাউকে দেখেছে। যাকে দেখেছে, সেই খুনী হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অধীরদা ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলে বললেন, এই সময় মাইক একটা মোক্ষম প্রশ্ন করল। আমি বললাম সেটা কি থর্পের মাথার পেছনে আততায়ী কী’করে আঘাত করল জানতে চাওয়া? অধীরদা হেসে বললেন, একদম ঠিক ধরেছেন। থর্পের অফিসে আততায়ী ঢুকলে তার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবার কথা, থর্পের বর্ণনায়, দ্য ইনভেস্টিগেটর লিখেছে বছর পঁয়ত্রিশের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ব্রিটিশ যুবক। এরকম একজন লোককে তার ঘরে ঢুকে মাথার পিছনে আঘাত করা সম্ভব কি? জোন্স উত্তরে জানাল, থর্প বসেছিল টেবিলের উল্টো দিকে দরজার দিকে পিঠ করে, সেই অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়, আততায়ী দরজা দিয়ে ঢুকে থর্পের মাথার পেছনে আঘাত করে। কেউ নিজের ঘরে দীর্ঘ সময় কাজ করবার সময় চেয়ার বদলাতেই পারে, তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। আমি বললাম, হ্যাঁ জোন্সের কথার যুক্তি আছে, আমরাও এরকম করি, তবে আততায়ীর কপাল খুব ভালো বলতে হবে, থর্প নিজের চেয়ারে বসে থাকলে মাথার পিছনে আঘাত করা সম্ভব হত না।
যাইহোক, জোন্স বলল, ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টির পুলিশ অধিকর্তা ডিন ওয়েসেলস একান্তভাবে না চাইলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে এই কেসে দরকার হত না। তবে চুরির ব্যাপারটা তার কাছে এখনও অন্ধকারে। মাইক ব্রিয়ারলি জিজ্ঞাসা করল, তা খুনের মোটিভটা কী? জোন্স বললেন, এটা প্রণয়ঘটিত কেস। মিসেস থর্প লন্ডনের একটা সওদাগরি অফিসে চাকরি করেন, বেশ কিছুদিন ধরে ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে একজন যুবক ট্রেনে প্রেস্টন অবধি তার পিছু পিছু আসছিল, মিসেস থর্প প্রথমদিকে তাকে গুরুত্ব দেননি। ক্রমশ তার সাহস বাড়তে থাকে এবং প্রেস্টন স্টেশন থেকে ফলো করে থর্পদের বাড়ি অবধি আসতে থাকে এবং রীতিমতন প্রেম নিবেদন করতে থাকে। মিসেস থর্প তখন স্বামীকে সব জানান। গত সোমবার মি: থর্প ওঁত পেতে ছিলেন এবং যুবকটিকে হাতেনাতে ধরে দু এক ঘা দেন, তখন যুবকটি থর্পকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় এবং বলে তার গায়ে হাত তোলার শোধ সে থর্পের হাত কেটে দিয়ে নেবে। থর্প দম্পতি সোমবার রাতেই এবিষয়ে পুলিশকে লিখিত অভিযোগ জানান আর বুধবার রাতে এই কাণ্ড। মাইক প্রশ্ন করল, থর্প দম্পতির সঙ্গে ঐ যুবকের বচসার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী আছে? জোন্স বলল, তা নেই। থর্পদের বাড়িটা একটা ডেড এন্ড রাস্তার শেষে, সন্ধ্যার পর এমনি ফাঁকা থাকে, যুবকটি সেই সুযোগটাই নিত, প্রেস্টন এমনিতেও খুব কম জনসংখ্যার শহর। মাইক বলল, কী বুঝলে রবার্টসন? প্রেমে পড়লে মানুষ কী না করে! কব্জি কেটে খুন অবধি। যাইহোক বুঝলে আমাদের বোধহয় চুরির তদন্ত করলেই চলবে, জোন্স সাহেব খুনের কিনারা প্রায় করে ফেলেছেন। তা মি: জোন্স, খুনীকে শনাক্ত করবেন কীভাবে? জোন্স বলল, মিসেস থর্পের বর্ণনা অনুযায়ী পুলিশের শিল্পী, অপরাধীর যে স্কেচ করেছেন, তা দেখে মিসেস থর্প বলেছেন হুবহু সেই লোক।
পুলিশ স্টেশনে চলুন সব দেখাচ্ছি। মাইক বলল, আগে মিউজিয়ামটা ঘুরে যাওয়া যাক, সব অপরাধ তো সেখানেই সংঘঠিত হয়েছে।
কেসটা দারুণ জমে উঠেছে, আমি আর একপ্রস্ত কফির অর্ডার দিয়ে এসে অধীরদা আবার পড়া শুরু করবার আগে ফুট কাটলাম। বললাম, অধীরদা মাইক ব্রিয়ারলিকে যতদূর চিনি, তাতে জল আরও গড়াবে, সবদিক খতিয়ে না দেখে জোন্সের কথা মেনে নেবে না, এখন জল মাপছে। অধীরদা বললেন, হ্যাঁ বিশেষ করে রোজ বাটলার ৯.৩০ নাগাদ থর্পকে দেখেছে বলছে, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী থর্প তখন মৃত। বাটলারের ঘড়ি কি ঠিক ছিল বা আদৌ সে ঘড়ি দেখেছিল কি? হতে পারে ওটা থর্প ছিল না, বাটলার তো মুখ দেখেনি।
চলুন দেখি মিউজিয়ামে মাইক ব্রিয়ারলি, রবার্টসন এবং আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।
জোন্স বলল, চলুন আপনারা দুজনেই পথশ্রান্ত, মিসেস স্মিথের রেস্তোঁরায় কিছু খেয়ে নিয়ে মিউজিয়ামে যাওয়া যাবে, আমারও ওখানে একটা তদন্তের কাজে যাওয়া দরকার, মিসেস স্মিথ গতকাল সকালে অভিযোগ জানিয়েছেন যে তার প্রতিবেশী কামারশালার মালিক রজার উইলিয়ামসকে পাওয়া যাচ্ছে না। রবার্টসন বলল, বেশ খিদে পাচ্ছে, খেয়ে নেওয়াই ভালো বস, মাইক আর আপত্তি করল না। গাড়িতে যেতে যেতে মাইক বলল, তাহলে প্রেস্টন সিটি একেবারে নিরুপদ্রব জায়গা নয়। জোন্স বলল, এই সপ্তাহটাই খারাপ যাচ্ছে, সোমবার থর্প দম্পতি ইভ টিজিং আর খুনের হুমকি পাওয়ার অভিযোগ জানাল, বুধবারে মি: থর্প খুন হয়ে গেলেন এবং বহুমূল্য পেন্টিং উধাও হলো, আবার বুধবার রাত থেকে রজার উইলিয়ামস উধাও হয়ে গেল।
মিসেস স্মিথের বয়স ষাটের আশেপাশে, তিনি বছর পঁয়ত্রিশের উইলিয়ামসকে খুবই স্নেহ করতেন, উইলিয়ামস ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সবই তার রেস্তঁরায় সারতো।
উইলিয়ামসের তিনকুলে কেউ নেই, একজন কর্মচারীকে নিয়ে কামারশালা চালাত আর কামারশালা সংলগ্ন দোকানে সেইসব জিনিস বিক্রি করত। মিসেস স্মিথের কাছে উইলিয়ামসের বাড়ির একটা চাবি সবসময় দেওয়া থাকে, সেদিন রাতে উইলিয়ামস মিসেস স্মিথকে ফোন করে বলে, রাতের খাবার খাবে না। জোন্স জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কটা বাজে? মিসেস স্মিথ বললেন রাত আটটা হবে। উইলিয়ামস একটু বেশি রাত করে খাবার খেত।
পরের দিন উইলিয়ামসের কর্মচারী কাজে এসে দেখে কামারশালা বন্ধ, কামারশালা আর দোকানের দোতলায় উইলিয়ামসের বাসস্থান, সেখানেও উইলিয়ামসের খোঁজ না মেলায় সে মিসেস স্মিথকে জানালে তিনি পুলিশে অভিযোগ করেন। মি: জোন্স বললেন, কেন ধরে নিচ্ছেন সে নিঁখোজ, কোথাও যেতেও তো পারে? মিসেস স্মিথ বললেন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমাকে বলে যেত, কর্মচারীকে আসতেও বারণ করত। রবার্টসন মনে মনে ভাবল, মিসেস স্মিথের বুদ্ধি জোন্সের থেকে বেশি। মিসেস স্মিথ একটা পোস্টকার্ড সাইজের ছবি জোন্সকে দিয়ে বলল, এটা উইলিয়ামসের ছবি, আপনার লাগবে বলে আমি ওর ঘর থেকে নিয়ে এসেছি। রবার্টসন দেখল একজন মধ্য তিরিশের স্বাস্থ্যবান চেহারার যুবক, চোখদুটো খুব বিষণ্ণ, সহজেই চোখে পড়ে। মিসেস স্মিথ বললেন, অফিসার মন মেজাজ খুব খারাপ, আমার দুটো পরিচিত মানুষের একজন খুন হয়ে গেল, একজন উধাও হয়ে গেল, দুজনেই আমার কাস্টমারও ছিল বটে, একটা কিছু করুন।
মাইক ব্রিয়ারলি এতক্ষণ কিছু শুনছিল কি না বোঝার উপায় নেই, এবার সোজা হয়ে বসে বলল, মি: থর্পও আপনার রেঁস্তোরায় আসতেন, তিনি কি উইলিয়ামসের পরিচিত? মিসেস স্মিথ বললেন, পরিচিত কী বলছেন, কয়েক মাস হলো ওদের বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, গত উইক এন্ডে তো দুজনে ব্ল্যাকপুলের সমুদ্র তট থেকে ঘুরেও এসেছে। আসলে মাস ছয়েক হল উইলিয়ামসের বউ ওকে ছেড়ে চলে যায়, ডিভোর্সও হয়ে গেছে। উইলিয়ামসের বাবা মা ভাই বোন কেউ নেই, একদম একা হয়ে গেছিল। থর্প বোধহয় উইলিয়ামসের দোকানে কিছু কেনাকাটা করতে এলে দুজনের আলাপ হয়, ওরা দুজনেই ঘোড়ার রেসে বাজি ধরত, উইলিয়ামস আমাকে বলেছিল, ওর কাছে রেসের বই দেখে থর্প বলে সেও রেস খেলে, সেটাই বন্ধুত্বের কারণ বলে মনে হয়, আর দুজনই সমবয়সী ছিল। মাইক বলল, উইলিয়ামসের প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা যাবে? বলা যায় না, তিনি কোনও সূত্র দিতে পারেন। মিসেস স্মিথ বললেন, সেও তো আমার রেঁস্তোরায় আসত, আর আমার সব কাস্টমারের ফোন নম্বর আমি নিয়ে রাখি, আপনাকে লিখে দিচ্ছি। মাইক ফোন নম্বর লেখা কাগজটা বুক পকেটে রেখে বলল, রবার্টসন হাত চালিয়ে খাও, মি: জোন্স, চট করে একবার পুলিশ মর্গে ডেডবডিটা দেখে নিয়ে মিউজিয়ামে যাব। যদি প্রয়োজন মনে করি তবে পরে উইলিয়ামসের কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলা যাবে। রবার্টসন বলল, এই উইলিয়ামসই খুনটা করে কেটে পড়েনি তো? দুজনের একটা যোগসূত্র তো রয়েছে।মাইক বলল, সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখতে হবে।
রবার্টসন মর্গে বহু ডেডবডি দেখেছে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসার হিসেবে এই কাজ তার কাছে জলভাত, কিন্তু সেও যেন কেঁপে গেল, এমন বীভৎস মৃতদেহ সে কখনও দেখেনি, মিসেস থর্প যে কী’করে এই দৃশ্য সহ্য করলেন ভেবে সে অবাক হলো। মাইক ব্রিয়ারলির অবশ্য কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, সে একমনে লাশটা পরীক্ষা করল, পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে কিসব দেখল, মোবাইলে কয়েকটা ছবি তুলল, তারপর বলল হুম। রবার্টসন জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলে বস? মাইক বলল, বুকে একটা আঁচিল। চলুন মি: জোন্স মিউজিয়ামে যাওয়া যাক। রবার্টসন মনে মনে গালাগাল দিল। শালা বুড়ো ছুঁচো একটা, আঁচিল তো সবাই দেখেছে, নয়তো এই লাশ শনাক্ত হয় নাকি! গাড়িতে যেতে যেতে মাইক জোন্সকে বলল, তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? আততায়ী বদলা নিতে থর্পকে খুন করল এবং তারপর হঠাৎ করে পেন্টিংটা নিয়ে কেটে পড়ল। আপনার এই যুক্তি আদালতে দাঁড়াবে না মি: জোন্স। জোন্স বলল, মোটেই সেই আততায়ী পেন্টিংটা সরায়নি, ওর পেছনে ভেতরের কেউ আছে, সবাই কিউরেটরের লাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় পেন্টিংটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। মাইক বলল, কর্মচারীরা তো তখন সবাই মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে গেছে, বায়োমেট্রিক কার্ড পাঞ্চ না করে কেউ বেরোয়নি, কিউরেটর বেরোয়নি বলেই গার্ডেরা তার খোঁজে ভেতরে গিয়েছিল, অন্য কর্মচারীদের কেউ যদি ভেতরে থাকত তবে সেটা ওদের রিপোর্টে উল্লেখ থাকত। প্রেস্টন পুলিশ ঘটনাস্থলে কতক্ষণে পৌঁছোয়? জোন্স জানাল, পুলিশ স্টেশন তো মিউজিয়ামের প্রায় লাগোয়া, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ চলে আসে, পরে পুলিশ কুকুর নিয়ে আসা হয়, কিন্তু সে মিউজিয়ামের মূল ফটক দিয়ে বাইরে এসে বড়ো রাস্তায় পড়ার পর দিশেহারা হয়ে যায়।
মাইক স্বগতোক্তি করল, কয়েক মিনিট গেট নিশ্চয়ই অরক্ষিত ছিল, কিন্তু ভেতরে কিউরেটর তো মৃত, পেন্টিং নিয়ে যে পালাল, সেও মিউজিয়ামে ছিল, খুনীও সে।
আমি বললাম, অধীরদা, সাধে কী আর মাইক ব্রিয়ারলিকে আড়ালে সবাই বুড়ো ছুঁচো বলে। অধীরদা হেসে বললেন, ভালো গোয়েন্দার কাজই সবেতেই গন্ধ শুঁকে দেখা, যে গন্ধ অন্যদের নাকে অধরা সেটার গন্ধ পেয়ে যাওয়া। জোন্সের গাড়ি মিউজিয়ামে পৌঁছে গেছে, শুরু হলো মিউজিয়ামে জেরা পর্ব।
মাইক ব্রিয়ারলি রবার্টসনকে বলল, সবাইকে জেরা করবার দরকার নেই, প্রেস্টন সিটি পুলিশ যা জেরা করেছে সেই বয়ান দেখাই যথেষ্ট। আমি খালি সিকিউরিটি ইনচার্জের সঙ্গে কথা বলব এবং অবশ্যই মি: বাটলারের কথা শুনব। তার আগে চলো পেন্টিংটা কোথায় ছিল দেখি আর কোন ঘরে হতভাগ্য কিউরেটর খুন হন সেটা একটু খুঁটিয়ে দেখি।
থর্পের ঘরটা বেশ বড়ো, কিউরেটরের পদমর্যাদার সঙ্গে মানানসই। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উল্টোদিকে গদি আঁটা চেয়ারে কিউরেটর সাহেব বসতেন বোঝা যায়। টেবিলের এধারে চারটে চেয়ারও বেশ দামি। টেবিলে একটা কম্পিউটার ছাড়া কিছু নেই। টেবিলের ড্রয়ারগুলো টেনে দেখল মাইক, তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। ক্যালকুলেটর, রাইটিং প্যাড, স্টেপলার এরকম মামুলি জিনিস ছাড়া কিছু নেই। টেবিলের ডানদিকে ফাইল ক্যাবিনেট তালা বন্ধ, ক্যাবিনেট টেবিল ছাড়িয়ে ঘরের মাঝ বরাবর গিয়ে শেষ হয়েছে। ক্যাবিনেটের শেষ প্রান্তে একটি পেতলের বড়ো ফুলদানিতে কয়েকদিনের শুকিয়ে যাওয়া ফুল। উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা পেন্টিং ঝুলছে, সেটাও ফ্রেডেরিক ওয়াটসের আঁকা, জোন্স বলল এটা অরিজিনাল নয় প্রিন্ট কপি, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষর থেকে সে জেনেছে, কিউরেটরের চেয়ারে বসলে ডানদিক থেকে দু’নম্বর চেয়ারে থর্পের মৃতদেহ পাওয়া যায়। মাইক উঠে গিয়ে ফুলদানিটা ভালো করে পরীক্ষা করল, বলল এর আঘাতে একজনের মাথা ভেঙে ফেলা শক্ত নয়, তবে এ খুনী যেরকম আঁট ঘাট বেধে কাজে নেমেছে, তাতে করে এত বড়ো প্রমাণ আমাদের জন্য ফেলে যাবে না, মনে হয় না ফরেনসিক রিপোর্টে এই ফুলদানি কথা বলবে, খুনী অস্ত্র সঙ্গে এনেছিল এবং সঙ্গে নিয়ে গেছে। কিউরেটরের ঘর সংলগ্ন একটি ছোট কিচেন, সেখানে একটি ইলেকট্রিক কেটেল, কফি বানানোর সরঞ্জাম, দুটো বয়ামে কিছু বিস্কুট, একটি হাত ধোয়ার বেসিন।
কিউরেটরের ঘর থেকে বেরিয়ে যে হল, সে হলে দ্য ইনোসেন্ট ছিল না, ছিল তার লাগোয়া হলে, তার মানে কেউ মিউজিয়াম গেট থেকে কিউরেটরের ঘরে যেতে গেলে এই হলে না এলেও চলবে। জোন্স বলল মিউজিয়ামের অনেকগুলো গেট থাকলেও দুটোই খোলা হয় এবং দুটো গেটের কোনওটা থেকে কিউরেটরের ঘরে যেতে গেলে এই হলে আসার দরকার পড়বে না।
রবার্টসন বলল, আততায়ী সেই সুযোগটাই নিয়েছে, সবাই যখন থর্পের মৃতদেহ নিয়ে ব্যস্ত, তখন পেন্টিংটা নিয়ে অরক্ষিত গেট দিয়ে সটকে পড়েছে। মাইক যোগ করল, আততায়ীকে সেইজন্য মিউজিয়ামের এই আর্ট গ্যালারিকে ভালো করে জানতে হবে। সে আগেও এখানে এসেছে এবং প্ল্যান করেছে অথবা জোন্সের কথামতো ভেতরের লোক। মি: জোন্স, ঠিক কতজন গার্ড সেদিন ডিউটিতে ছিল? জোন্স বলল, দুই গেটে দুজন করে এবং সিকিউরিটি ইনচার্জ মি: গফ। আরও দুজন পালা করে সিসিটিভি ফুটেজে নজর রাখে।
সামনের গেটের গার্ডরাই কিউরেটরের খোঁজ করে। মাইক বলল, সেটাই স্বাভাবিক, কারণ ওখান দিয়েই বায়োমেট্রিক পাঞ্চ করে সব কর্মচারীকে বেরোতে হয়।
মিউজিয়ামের অফিস ঘরেই মাইক ব্রিয়ারলি জেরা শুরু করল। প্রথমে ডাকা হল সিকিউরিটি ইনচার্জ মাইক গফকে। মি: গফের বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে, একটু ভারির দিকে চেহারা, নিঁখুত করে দাড়ি গোঁফ কামানো। মাইক ব্রিয়ারলি গফকে জিজ্ঞাসা করলেন সিসিটিভি কাজ করছে না সেটা খেয়াল করলেন না? গফ বললেন, রাত আটটা নাগাদ সিসিটিভি কাজ করা বন্ধ করে দেয়, আমি সঙ্গে সঙ্গে মিউজিয়াম কিউরেটরকে ব্যাপারটা জানাই। মি: থর্প বলেন, আর তো দুঘন্টা বাদে মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে, দর্শকও তেমন বেশি নেই, টেকনিশিয়ান মি: ক্রলিও ছুটিতে, কাল সকালে ক্রলি এসে যা করবার করবে। আমরাও স্বীকার করছি এটাকে বেশি গুরুত্ব দিইনি, ভেবেছিলাম এইটুকু সময় এমনি নজর রাখা যাবে, সেটা হল না বলে দু:খিত। জোন্স বললেন, আমরা এটা ক্রস চেক করেছি, ক্রলি এক সপ্তাহ আগে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন করে রেখেছিল। মাইক মি: গফকে জিজ্ঞাসা করল, কতক্ষণ প্রবেশ দ্বার অরক্ষিত ছিল? গফ বলল, কিউরেটর ছাড়া ততক্ষণে সবাই বেরিয়ে গেছে, কিছু গুরুতর ঘটেছে আমরা ভাবিনি, দুজন গার্ডই একসঙ্গে ভেতরে ঢোকে, আমিই বলেছিলাম সিসিটিভি যখন খানিকক্ষণ বন্ধ ছিল তখন মি: থর্পকে ডেকে দিয়ে যেন একবার মিউজিয়ামে একটা চক্কর দিয়ে নেয়।ওরা মি: থর্পকে খুন হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ওয়াকিটকিতে আমাকে ডাকলে, আমি দিগ্বিদিক ভুলে ভেতরে দৌড়ে যাই, সেই সময় চার পাঁচ মিনিট মিউজিয়ামের মেন গেট অরক্ষিত ছিল। সেই সময় আমার মাথার ঠিক ছিল না। মিউজিয়ামের অন্য গেট বুধবার রাতে নটার সময় বন্ধ হয়ে যায়, সেই গেটের গার্ডরা তখনই চলে যায়। যে দুজন সিসিটিভিতে নজর রাখে, তারা সিসিটিভি বিকল থাকায় ছুটি নিয়ে চলে গেছিল।
এই মিউজিয়াম বাকি দিনগুলো পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়, রবিবার বিকেল চারটেয়। বুধবার রাত দশটা অবধি খোলা থাকলেও অফিস আওয়ার্স বিকেল পাঁচটা অবধি, অর্থাৎ বাইরের কেউ সেইসময় অফিসে কোনও কাজে যেতে পারে না, কর্মচারীরা ভেতরে নিজেদের কাজ সারেন, কিউরেটরের সঙ্গেও বাইরের কেউ দেখা করতে পারে না, বুধবার সারা সপ্তাহের কাজ গুছিয়ে নেবার দিন। এই রুটিন সময়ে সময়ে বদলায়, তখন হয়তো সোমবার বা শুক্রবারও রাত দশটা অবধি খোলা থাকতে পারে, তবে সেটা সপ্তাহে একদিনই হয়। স্বভাবতই সারা সপ্তাহ কারও ডিউটি থাকে না।
মাইক ব্রিয়ারলি মি: গফকে বলল,
আপনি এখন আসতে পারেন। জোন্স জানাল, মি: ক্রলি বলেছেন কাটার দিয়ে সিসিটিভি সিস্টেমের মূল তার কাটা হয়েছিল।
আমি বললাম, অধীরদা ব্যাপারটা লক্ষ্য করুন, খুব সম্ভবত আততায়ী সেদিন ক্রলির অনুপস্থিত থাকার ঘটনা টের পেয়েছিল, নির্দিষ্ট সিসিটিভি বিকল করার কৌশল তার জানা ছিল। অধীরদা বললেন, ভেতরের কেউ এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত না থাকলে এটা হয় না। সে সিসিটিভি বিকল করে বায়োমেট্রিক পাঞ্চ করে যথাসময়ে বেরিয়ে গেছে আর কিউরেটর মি: থর্প জীবন দিয়ে তার মূল্য চুকিয়েছেন, খোয়া গেছে দ্য ইনোসেন্টের মতো মহামূল্য পেন্টিং।
অধীরদা আবার পড়া শুরু করলেন,
এবার ডাকা হলো মি: বাটলারকে। মি: বাটলার জেরার মুখে জানালেন, সেদিন রাত সাড়ে নটা নাগাদ তিনি থর্পকে টয়লেটের বেসিনে হাত ধুতে দেখেছিলেন মনে হচ্ছে, আলাদা করে লক্ষ্য করেননি, একটা অভ্যস্ত আকার দেখে মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই কিউরেটর সাহেব হবেন। পরে জানলাম উনি ততক্ষণে খুন হয়ে গেছেন, বড়ো অমায়িক মানুষ ছিলেন। জোন্স বলে উঠল, মি: বাটলার বোধহয় সময় গোলমাল করে ফেলেছেন। রবার্টসন বলল, এরকমও হতে পারে ওটাই খুনী ছিল, বাথরুমে ঝুঁকি নিয়ে রক্ত ধুতে গেছিল, ওভাবে তো রাস্তায় বেরনো যায় না। বাটলার বলল, এখন মনে পড়ছে যে আমি হ্যালো বলা সত্ত্বেও লোকটা উত্তর দেয়নি। আমি তখন ভেবেছিলাম কিউরেটর সাহেব অন্যমনস্ক আছেন শুনতে পাননি। মাইক জিজ্ঞাসা করল, লোকটার পরনে কী ছিল? বাটলার বলল, প্যান্টের কথা মনে নেই, গায়ে একটা নেভি ব্লু কালারের হুডি ছিল। জোন্স বলল, থর্পও তো তাই পরেছিল, তবে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট একটু এদিক ওদিক হয়েছে। মাইক বলল, দুজন লোক নেভি ব্লু হুডি পরতেও পারে এমনকি সেটা কাকতালীয় নাও হতে পারে।
আপাতত এখানকার পালা সাঙ্গ হলো, ওরে বাবা প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজে, খুনীকে ধরে আবার বাড়িও ফিরতে হবে, কয়েকটা কবিতা খুব জ্বালাচ্ছে বুঝলে রবার্টসন। রবার্টসন মনে মনে বিড়বিড় করল, সেটা পাগলামি দেখে টের পেয়েছি। মুখে বলল, বস বোধহয় খুনী কে ধরে ফেলেছেন? মাইক বলল, সেটা একটা ফোনের ওপর অনেকটা নির্ভর করছে, বুধবার রাত আটটা অবধি সিসিটিভি ফুটেজ হয়তো মি: ক্রলি উদ্ধার করে দেখাতে পারবেন, তবে ওতে কিছু নেই। তুমি মি: জোন্সের সঙ্গে গাড়ির দিকে এগোতে থাকো, আমি ফোনটা সেরে আসছি।
অধীরদা বললেন মনে হচ্ছে ঘটনার ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই। হ্যারিস মিউজিয়াম প্রেস্টন সিটি পুলিশ স্টেশন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত, মাইক ব্রিয়ারলি সেখানে পৌঁছে গিয়ে জোন্সের নেওয়া মিউজিয়াম কর্মচারীদের জবানবন্দী খতিয়ে দেখছে, সিজার লিস্ট মিলিয়ে থর্পের জামাকাপড় পরীক্ষা করছে, হলুদ জামার ওপরে নেভি ব্লু হুডি পরেছিল বলে থর্প একদমই ফ্যাশন সচেতন ছিল না বলে ফোড়ন কাটল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের নির্দেশে পোষাকগুলো মাইকের পরীক্ষার জন্য রাখা হয়েছিল, পরে ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠানো হবে।
মাইক ব্রিয়ারলি জামা আর হুডি পরীক্ষা করে বলল, হুম সেরকমই ভাবছি। মি: জোন্স ক্ষেপে উঠলেন, মশাই একটু ঝেড়ে কাশুন তো। কী এত পরীক্ষা করছেন? ইংল্যান্ডের সমস্ত পুলিশ স্টেশনে আততায়ীর ছবি পৌঁছে গেছে, ও ব্যাটা ধরা পড়বেই।
মাইক ব্রিয়ারলি বলল, মি: জোন্স কাটার দিয়ে সিসিটিভির তার কাটা হলো, যদি ধরে নেওয়া যায় যে ভারি জিনিসটি দিয়ে মাথায় মেরে হত্যা করা হয়েছে, সেটি হাতুড়ি জাতীয় কিছু এবং যে ধারালো অস্ত্রর সাহায্যে কব্জি দুটো কেটে নেওয়া হয়েছে সেগুলি সব কটাই কামারশালায় পাওয়া যায় আর উইলিয়ামস রাত আটটা নাগাদ তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, মিউজিয়ামে পৌঁছতে তার মিনিট দশেক লাগা উচিত? জোন্স বলল, হ্যাঁ হেঁটে এলে তাই লাগবে। আপনি কি উইলিয়ামসকে খুনী ঠাউরেছেন? রবার্টসন বলল, বস আমি আগেই বলেছিলাম। মাইক বলল, উইলিয়ামসকে খুনী ধরে নিলে সে থর্পের কব্জি দুটো কেটে নেবে কেন? এত আক্রোশের কারণ কী? শুধু খুনটা করলেই তো দ্য ইনোসেন্ট সরানোর ফাঁক তৈরি হত। তাকে সিসিটিভি বিকল করতে কে সাহায্য করল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আগে খুঁজতে হবে তো।
আর মি: থর্পকে মিসেস থর্পের ইভ টিজার হুমকি দিয়েছিল বলে থর্পরা খুনের দুদিন আগে অভিযোগ দায়ের করেছিল। আপাতত মি: জোন্স সেই ইভ টিচারের যে ছবি আঁকিয়েছেন তার এক কপি আমাকে দিন আর মিসেস থর্পকে একটা ফোন করে দিন, আমরা ওনার সঙ্গে দেখা করতে যাব।
মিসেস থর্পকে দেখেই বোঝা যায় এখনও আঘাতটা সামলে উঠতে পারেননি, মাইকদের বসতে বলে তখনও ফুলে ফুলে কাঁদছিলেন। মাইক ব্রিয়ারলি বললেন আমি আপনাকে দু একটা কথা জিজ্ঞাসা করেই ছেড়ে দেব, আপনার মনের অবস্থা আমি আন্দাজ করতে পারছি। দেখুন তো এটাই কি সেই লোকের ছবি যে আপনাকে উত্যক্ত করছিল? মিসেস থর্প বললেন, হ্যাঁ এটাই, আমি তো আগেই সেটা শনাক্ত করেছি। ও: হ্যাঁ মি: জোন্স বলেছিলেন বটে, আমার ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা মি: থর্পের কি বুকে আঁচিল ছাড়া আর বিশেষ কোনও চিহ্ন ছিল যা দেখে তাকে শনাক্ত করা যায়? এই দেখুন পিঠে একটা কাটা দাগ রয়েছে বলে মাইক তার মোবাইলে একটা ছবি দেখাল। মিসেস থর্প বললেন, এটার কথা ভুলে গেছিলাম, এটা শুনেছি ওর ছোটবেলায় গাছে উঠতে গিয়ে একটা ডালে খোঁচা খেয়ে হয়েছিল। মাইক বলল, আমার আর কিছু জানার নেই, শুধু একটা কৌতূহল, আপনাদের গ্যারেজের গাড়িটা কে চালায়? আপনি তো লন্ডনে অফিসে যান ট্রেনে, মি: থর্পও মনে হয় অফিস গাড়িতে যেতেন না, মিউজিয়ামের দূরত্ব এখান থেকে খুবই কম। মিসেস থর্প বললেন উইকএন্ডে আমরা দুজনেই চালাতাম। মাইক ব্রিয়ারলি মিসেস থর্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়ল। বাইরে এসে জোন্সকে বলল, আমাদের কাজ শেষ, তবে আসি, দয়া করে প্রেস্টন রেল স্টেশনে আমাদের পৌঁছে দিন।
রবার্টসন মনে মনে গালাগাল দিল, শালা বুড়ো ছুঁচো আবার নাটক শুরু করেছে। জোন্স বলল, মানে কী? তদন্ত শেষ! মাইক বলল, হ্যাঁ। বলে জোন্সের আঁকানো ছবিটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। জোন্স বলল একি, ছবিতে ব্যাকব্রাশ চুল ছিল, আপনি ডান দিকে সিঁথি করে চেহারা পুরো বদলে দিয়েছেন! তবেই বলুন, মিসেস থর্পের কথা মতো ছবি আঁকা হয়েছে অথচ উনি ধরতে পারলেন না। যে ইভ টিজার তাকে দিনের পর দিন বিরক্ত করেছে, তার স্বামীকে খুনের হুমকি দিয়েছে তার চেহারা উনি এখনই ভুলে গেছেন তা হয় কী’ করে?
জোন্স বলল, দাঁড়ান মশাই, দয়া করে পুলিশ স্টেশনে চলুন, সব খুলে বলুন। মাইক বলল, খুলেই বলছি, মৃতদেহের পিঠে কোনও কাটা দাগ নেই, আমি মোবাইল থেকে মিসেস থর্পকে একটা পুরনো ছবি দেখিয়েছি। রবার্টসন কঁকিয়ে উঠল, বস এসব কী হচ্ছে বলুন তো? মিসেস থর্প তবে কেন মিথ্যা বললেন? মি: থর্পকে খুন করল কে?
মাইক ব্রিয়ারলি বলল, মি: থর্প তো খুন হননি।
আমি বললাম, সেকি অধীরদা আমরা তো এতক্ষণ মি: থর্পের হত্যা রহস্য আর দ্য ইনোসেন্ট চুরির তদন্তের কথা পড়ছিলাম। অধীরদা বললেন, আমরা সেরকমই ভাবছিলাম। এখন দেখা যাক, মাইক ব্রিয়ারলি তার বক্তব্যর সপক্ষে কী যুক্তি দেয়।
প্রেস্টন সিটি পুলিশ স্টেশনে অফিসার ইনচার্জ ড্যামিয়েন মার্টিনের ঘরে মাইক ব্রিয়ারলিকে ঘিরে বসেছেন রবার্টসন, মার্টিন, তদন্তকারী অফিসার মি: জোন্স, ভিডিয়ো কনফারেন্সে স্বয়ং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধান টনি অ্যাডামস। অ্যাডামস প্রশ্ন করলেন, ব্রিয়ারলি তুমি কী দেখে বুঝলে থর্প খুন হয়নি?
মাইক বলল, কিউরেটর সাহেবের ঘরে জর্জ ফ্রেডেরিক ওয়াটসের পেন্টিং এর প্রিন্ট দেখে এবং সেই পেন্টারের বিখ্যাত ছবি চুরি যাওয়ায়।
হ্যারিস মিউজিয়াম & আর্ট গ্যালারির কিউরেটরের পেন্টিং সম্বন্ধে ধারণা থাকবারই কথা আর সেটাই চিন্তার খোরাক যোগাল। দ্বিতীয় হল, সিসিটিভির দায়িত্বে থাকা মি: ক্রলির সেদিন ছুটিতে থাকা, এটা বাইরের লোকের জানবার কথা নয়। মিসেস থর্পের ইভ টিজার তো লন্ডনের লোক, সোমবার হুমকি দিয়ে সে বুধবার এসে খুন করল, মিউজিয়ামের ভেতরের কোনও লোক তাকে সিসিটিভি বিকল করে দিয়ে সাহায্য করেছে এটা একটু কষ্ট কল্পনা। জোন্সের নেওয়া জবানবন্দী থেকে জেনেছি, কর্মচারীরা সবাই স্থানীয় বাসিন্দা। তবুও তাদের কেউ সম্ভাব্য আততায়ীর পরিচিত হতে পারে, কিন্তু পরবর্তী তথ্যপ্রমাণে সেই সম্ভাবনা নস্যাৎ হবে।
রজার উইলিয়ামসের ওপর সন্দেহর যথেষ্ট কারণ ছিল, অপরাধে ব্যবহৃত সমস্ত জিনিসই তার কাছে সহজলভ্য এবং থর্পের ঘরে ঢোকা বন্ধু হিসেবে তারপক্ষে সহজ। মনে রাখতে হবে বিকেল পাঁচটার পর কিউরেটর কারও সঙ্গে দেখা করেন না, একমাত্র যদি তিনি নিজে কাউকে না ডাকেন। উইলিয়ামস আটটা নাগাদ দোকান থেকে বেরোন, আর সিসিটিভি আটটা থেকে খারাপ ছিল, তার মানে উইলিয়ামসের কোনও সহকারী মিউজিয়ামের কর্মচারীদের মধ্যে থাকতে হবে, উইলিয়ামস স্থানীয় লোক, তার সে যোগাযোগ থাকা সম্ভব। যদিও মিসেস স্মিথ জানিয়েছিলেন মি: থর্প ছাড়া তার কোনও বন্ধু ছিল না, তর্কের খাতিরে ধরে নিতে পারি, তিনি ভুল জানতেন। পুলিশ মর্গে লাশ দেখার পর আমার অন্য একটা সন্দেহ হলো। আমি উইলিয়ামসের প্রাক্তন স্ত্রীকে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। অ্যাডামস অধৈর্য হয়ে বললেন, হেঁয়ালি ছাড়ো মাইক, বুঝিয়ে বলো।
মাইক বলল, হ্যাঁ সে কথাতেই আসছি বস। মানুষের গোপন স্থানে বা তার আশেপাশে যদি কোনও দাগ থাকে, তা জানতে পারে একমাত্র তার মা এবং স্ত্রী। লাশের পুরুষাঙ্গের ডানদিকের উরুর ভেতর দিকে রয়েছে একটি লাল জরুল, মিসেস থর্প খালি বুকের আঁচিলের কথা বললেন আর এটা বাদ দিলেন কেমন করে? বুকে আঁচিলের কথা পরিচিত লোকেরা অনেকেই জানতে পারে। মি: জোন্স ভালোভাবে লাশ পরীক্ষা করলে জরুলের কথা আপনিও জানতে পারতেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে, জরুল বা আঁচিলের কথা নয়। জোন্স বললেন এত বীভৎস লাশ যে মূল ইনজিউরি দেখতে গিয়ে ওটা চোখ এড়িয়ে গেছে। মাইক বলে চলল, আমি যখন প্রাক্তন মিসেস উইলিয়ামসকে ফোন করলাম, উনি একবারে জরুলটার কথা বলে দিলেন। আমাকে কিছু মিথ্যে বলতে হয়েছিল, সেসব কথা থাক। বুঝলাম উইলিয়ামস খুন করেনি, খুন হয়েছে। গত উইকএন্ডে থর্প আর উইলিয়ামস ব্ল্যাকপুলে সীবিচে গেছিল, সেখানে উইলিয়ামসের বুকে আঁচিল দেখে থর্প তার বউয়ের সঙ্গে আঁচিল দেখে শনাক্তকরণের ছক আঁটে। কোনও ইভ টিজার কোনওদিন মিসেস থর্পের পিছু নেননি, পুলিশকে বিপথে চালিত করতে এই গল্পের আমদানি। মিসেস থর্পের বর্ণনা শুনে পুলিশের শিল্পী ছবি আঁকলেন কিন্তু সেই বানানো বর্ণনা উনি মনে রাখতে পারেননি, তখন যা মাথায় এসেছে বলে গেছেন, আমি ছবিতে পরিবর্তন করলেও উনি ধরতে পারেননি। লাশের পিঠে কোনও দাগ ছিল না, আমি একটা পুরনো ছবি দেখাতে, উনি একটা নতুন গল্প ফেঁদে বসলেন। মার্টিন এবার প্রশ্ন করলেন, কিন্তু উইলিয়ামসের কব্জি কেটে নেওয়ার কারণ কী? মাইক বলল, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মিউজিয়ামে থর্পের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংরক্ষিত, সেই
আঙুলের ছাপ থেকে যাতে বোঝা না যায় ওটা থর্পের মৃতদেহ নয়। নিজের মৃত্যু প্রতিষ্ঠিত করে উনি অন্য জায়গায় অন্য নামে উদিত হতেন।
রবার্টসন, তুমি একটা ভুল বলেছ, খুনী হাত ধুতে টয়লেটে যায়নি। কিউরেটরের ঘরের বাইরে রক্তের ছাপ থাকলে মি: জোন্সও সেটা উল্লেখ করতেন। থর্প তার ঘর সংলগ্ন ছোট্ট কফি কর্ণারের বেসিনেই নিজেকে পরিষ্কার করে নেয়। হাতে এমনিতেও রক্ত লাগেনি, পুরো কাজটা সে সেরেছে গ্লাভ্স পরে, ছিটকে কিছু রক্ত চোখ মুখ জামাতে লেগেছিল ধরে নেওয়া যায়।
তার সঙ্গে থাকা ব্যাগে রাখা ছিল একটি অতিরিক্ত নেভি ব্লু কালারের হুডি। খুনের পর সেটি থর্প পরিয়ে দেয় উইলিয়ামসকে। রাত আটটা অবধি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাবে, ওটা পরীক্ষা করলে পুরো সময় থর্পকে নেভিব্লু হুডিতে দেখা যাবে, ভেতরের জামা দেখানোর ঝুঁকি থর্প নেবে না, কারণ তা উইলিয়ামসের জামার সঙ্গে না মেলার সম্ভাবনা, একমাত্র খুনের আগে সে নিজের হুডি খুলেছিল, যাতে তা রক্তারক্তি না হয়। তখন সিসিটিভি বিকল। সমস্ত কাজ সে ঘরের দরজা বন্ধ করে সারে, আন্দাজ করা যায়। তারপর বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে টয়লেটে যায়, ধরে নেওয়া যায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেই যেতে হয়েছিল, সেখানে থর্পের দুর্ভাগ্যবশত বাটলার থর্পকে দেখে ফেলে। রাত ৯.৩০ নাগাদ, খুনটা হয় ৯-৯.৩০ এর মধ্যে, বেশি আগে খুন করার ঝুঁকি থর্প নেবে না। বাটলারের ডাকে থর্প সাড়া দেয়নি, কারণ সম্ভবত সেই মুহূর্তে বাটলারের আই কনট্যাক্ট সে এড়াতে চেয়েছিল, এটা অপরাধীর একটা মনস্তত্ত্ব অথবা একটা চান্স নিয়েছিল, যদি বাটলার তার মুখ না দেখতে পায় তবে মৃতদেহ আবিষ্কারের পরে বাটলারের মনে একটা ধন্দ তৈরি হবে, বাস্তবে সেটাই হয়েছিল।
সে কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল বলে বাটলারের সম্ভাষণ শুনতে পায়নি সেটাও হতে পারে, তার কারণ সবথেকে বড়ো ঝুঁকির কাজটা অর্থাৎ পেন্টিংটা সরিয়ে ফেলার কাজ তখনও বাকি। আমি সব সম্ভাবনার কথাই তুলে ধরলাম, তবে নিজের মুখ দেখতে না দিলে বাটলার পরে ধন্দে পড়বে এটাই সবথেকে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা মনে হচ্ছে।
মি: জোন্স যদি ভালো করে লক্ষ্য করতেন তবে বুঝতে পারতেন লাশের পরনে হুডির পিঠে রক্তের ছোপ তুলনায় ফিকে, পরে যেটুকু চুঁইয়ে পড়েছে সেটুকু।
অথচ শার্টের পিঠ রক্তে মাখামাখি। মাথার পেছনে আঘাত পেলে তাই হওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, হুডির পিঠের ভেতর দিকে ব্রাশ চালানোর মতো রক্তের দাগ, এটা ঘটেছে হুডি মাথা গলিয়ে পরিয়ে দেওয়ার জন্য, নয়তো হুডির ভেতরে ওরকম রক্তের দাগ লাগে না।
উইলিয়ামস তার বন্ধুর অফিসে নিজের পরনের জ্যাকেট বা হুডি যাই পরে আসুক, সেটা খুলে রেখেই আরাম করে বসেছিল, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। সেই জ্যাকেটও থর্প সঙ্গে নিয়ে গেছে। উইলিয়ামস বসেছিল থর্পের উল্টো দিকের চেয়ারে, তাকে মিউজিয়াম ছুটির পর থর্প রাতে বাইরে খেতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ডেকে এনেছিল, উইলিয়ামস তাই মিসেস স্মিথকে জানিয়েছিল রাতে খাবে না।
কোনও ছুতো করে থর্প ঘরের বাইরে যায়, নি:শব্দে ঘরে ফিরে এসে সঙ্গে থাকা হাতুড়ি দিয়ে প্রচণ্ড আঘাতে উইলিয়ামসের মাথা ভেঙে দেয়। দরজা বন্ধ করে, তারপর ধারাল অস্ত্র দিয়ে মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে কব্জি দুটো কেটে নেয়। অভিজ্ঞতা থেকে থর্প জানত, বুধবার আটটার পর মিউজিয়ামের কেউ তার কাছে আসে না, বড়ো জোর ফোন বা ইন্টারকমে কথাবার্তা হয়। তাই ৮-১০ সময়টাকে সে পাখির চোখ করে।
জোন্স বলেছেন পুলিশ কুকুর মিউজিয়ামের মেন গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে, তার কারণ হলো প্রথমত মিউজিয়ামে নানা ধরনের প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়, তাতে কুকুরের নি:সন্দেহে অসুবিধে হওয়ার কথা এবং মিসেস থর্প যে গাড়িতে প্রচুর ন্যাপথলিন জাতীয় ওষুধ রেখেছিলেন আমি তাতে নি:সন্দেহ। থর্পের মাস্টার প্ল্যানে পুলিশ কুকুরও হিসেবে ছিল। হ্যাঁ, মিসেস থর্প এই অপারেশনে পুরোপুরি স্বামীকে সহযোগিতা করেছেন, তিনিই সেই রাতে মিউজিয়ামের অদূরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন।
মিউজিয়ামের মেন গেটের ভেতরে নানা মূর্তি, গ্যালারির আড়ালে অসংখ্য জায়গা, টয়লেট থেকে ফেরার পর, নিজের ঘর খুলে থর্প জামাকাপড় ভরা ব্যাগ নেয়, ওতেই খুনের যাবতীয় অস্ত্র ছিল, দ্য ইনোসেন্টকে স্থানচ্যুত করে এবং ঘাপটি মেরে থাকে, সে জানত মি: গফ খুনের খবর পেয়ে ভেতরে ঢুকবেই, যদি তা না হত, তবে গফের জন্য বড়ো বিপদ অপেক্ষা করছিল, থর্প তার ওপর হামলা করতেও পিছপা হত না।
মি: থর্প শুধু অতি ধুরন্ধর অপরাধী নয়, তার সঙ্গে খুব ভালো অ্যাথলিটও বটে। হ্যারিস মিউজিয়ামের বাইরের অনেকগুলো সিঁড়ি এবং প্রাচীন শৈলী অনুসারে চওড়া ধাপের, সেগুলো অতি দ্রুত পেরিয়ে গিয়ে অন্তত ৫০-৬০ গজ রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠতে হয়েছে, হাতে অতি সামান্য সময়, কাঁধে ব্যাগ এবং হাতে রীতিমতো বড় একটা পেন্টিং নিয়ে। থর্পের খেলোয়াড়ী অতীত থাকলে আশ্চর্য হব না। প্রেস্টন সিটির সাদা পোষাকের পুলিশেরা এতক্ষণে মি: থর্পের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।
রবার্টসন প্রশ্ন করল, বস কী’করে ভাবছেন থর্প এখনও ঘরে বসে আছে? মাইক বলল, এইজন্য ভাবছি, কারণ সেটাই তারপক্ষে সব থেকে নিরাপদ জায়গা। যে লোকটা খুন হয়ে গেছে, তার বউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আসবে, খোঁজখবর নেবে, কিন্তু তার বাড়ি তল্লাশি করবে না। থর্পের এখন আত্মগোপনের সময়, কয়েক লক্ষ ডলার মূল্যের বিখ্যাত পেন্টিং নিয়ে রাস্তায় ঘোরার সময় নয়। নিজের গাড়ি ব্যবহার করলে সে অবধারিত বিপদে পড়ত। পরিস্থিতি থিতিয়ে গেলে সে অন্যত্র অন্য পরিচয়ে উদয় হবার ছক কষত।
অ্যাডামস প্রশ্ন করল, আচ্ছা পেন্টিংটি চুরির জন্য বাছা খালি পেন্টারের কাজের প্রতি দুর্বলতার জন্য? মাইক বলল, ফ্রেডরিকের পেন্টিং বাছার কারণ তার কাজের প্রতি দুর্বলতা, পেন্টিংটি মহা মূল্যবান কিন্তু আরও অন্যান্য মহামূল্যবান পেন্টিং এই মিউজিয়াম & আর্ট গ্যালারিতে আছে, তবে হতে পারে এটি হাতের নাগালে ছিল। আর পেন্টিং চুরির জন্য বাছার কারণ হলো, অন্যান্য মহামূল্যবান সামগ্রী আকারে হয় ভীমাকৃতি, সরানো সম্ভব নয়, নয়তো আনব্রেকেবেল জারের মধ্যে সুরক্ষিত, যার সুরক্ষিত ডিজিটাল কোড ব্রেক করা একজনের পক্ষে অসম্ভব।প্রেস্টন সিটি পুলিশ স্টেশন নাকের ডগায় থাকার দরুণ এই মিউজিয়াম অপরাধীরা এড়িয়ে চলে, এখানে আগে কখনও চুরি হয়নি, হলে মি: জোন্স সেটা উল্লেখ করতেন। এইসব কারণে সিকিউরিটি গার্ডদের মধ্যে একটু ঢিলেঢালা ভাব ছিল, অনেকদিন ধরেই সুচতুর থর্প এসব খেয়াল করেছে, আর যখন দেখল উইলিয়ামসের মুখের চেহারা বদলে দিলে তাকে নিজের জায়গায় বসানো যাবে, তখন নিজের খুন হয়ে যাওয়ার সাজানো নাটকের ফাঁদ পাতল। উইলিয়ামস আর থর্পের ঘনিষ্ঠতা প্রথমে হয়তো রেসের প্রতি অনুরাগের ফলেই হয়েছিল, পরে থর্পের উর্বর মস্তিষ্কে এই মারাত্মক পরিকল্পনার জন্ম নেয়।
টনি অ্যাডামস পদমর্যাদার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, হুম তাহলে দেখো তোমাকে এই তদন্তে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক। মাইক ব্রিয়ারলি মনে মনে কী বলল, সেটা মুখ দেখে বোঝা গেল না, মুখে বলল, তাহলে উঠি বস, রাত প্রায় নটা বাজে, সকাল দশটায় আপনার ফোন আসা থেকে খুন জখম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। মার্টিন সাহেব সারাদিনের আতিথেয়তার জন্য প্রেস্টন পুলিশকে ধন্যবাদ। মি: জোন্স সার্চ ওয়ারেন্ট হাতে পেলেই থর্পের বাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। দ্য ইনোসেন্ট, থর্প দম্পতি, খুনের অস্ত্র সব আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, জোড়া কব্জির জন্য থর্পদের বাগানে একটু খোঁড়াখুঁড়ি করতে হতে পারে।
চলো হে রবার্টসন, ট্রেনে ফিরতে ফিরতে তোমাকে কয়েকটা নতুন লেখা কবিতা শোনাই। রবার্টসন বলল, চলো বস, ট্রেন যাত্রায় কবিতা খুব ভালো জমে। মনে মনে বলল, শালা বুড়ো ছুঁচো, পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।
অধীরদা বললেন, অতনুদা থর্প একটাই মারাত্মক ভুল করেছিল, সবাইকে বুদ্ধির খেলায় মাত করে দেবে ভেবেছিল, কিন্তু মাইক ব্রিয়ারলিকে হিসেবের মধ্যে ধরেনি। দ্য ইনভেস্টিগেটর লিখছে, মাইক ব্রিয়ারলির অনুমান অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছিল, প্রেস্টন সিটি পুলিশ থর্পের বাড়ির বেসমেন্ট থেকে থর্পকে গ্রেফতার করে, থর্প দম্পতি এখন গারদের পেছনে।
উদ্ধার হয়েছে খুনে ব্যবহৃত সমস্ত অস্ত্র। দ্য ইনোসেন্ট আবার নিজের জায়গায় ফেরৎ গেছে, ঢেলে সাজানো হয়েছে হ্যারিস মিউজিয়ামের সুরক্ষা ব্যবস্থা। প্রেস্টন সিটির পক্ষ থেকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে মাইক ব্রিয়ারলিকে। সেখানে ধন্যবাদ জানিয়ে মাইক স্বরচিত যেসব কবিতা পড়লেন তা হলো,
‘মনের মধ্যে মন,আমি বললাম, ইয়ে মানে অধীরদা মাইকের কবিতা এখন থাক বরং।
একচিলতে হাসি,
রাখাল বাজায় বাঁশি’
আমরাও একটা মারাত্মক ভুল করছি, গিন্নীরা কিন্তু বহুক্ষণ হলো বেরিয়েছেন, পুরী বেড়াতে এসে ওনাদের সময় না দিয়ে মাইক ব্রিয়ারলিকে নিয়ে পড়ে থাকলে, গোয়েন্দা প্রবর যেভাবে লিলির হাতে হেনস্থা হন, আমাদের অবস্থা তার থেকে কিছু ভালো হবে না। এমনকি মাইকের কবিতার থেকেও ব্যাপারটা খারাপ হতে পারে।
অধীরদা বললেন, আরে চলুন চলুন, এগিয়ে দেখি নিজেদের পিঠ এ যাত্রায় বাঁচাতে পারি কি না।