• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গল্প
    Share
  • যাপনকথা : শ্রাবণী দাশগুপ্ত


    || এক ||

    লিনাক্ষ ব্যালকনিতে। ব্যালকনিটা টানা লম্বা অনেকখানি, চওড়া একটু কম, বুকসমান রেইলিং। সে হিলহিলে শরীর ঈষৎ ঝুঁকিয়ে রাখে। মুখোমুখি বাড়ি বলতে সবুজ-ঘেরা দেড়তলা ভিলা। তাদের পাঁচতলার ফ্ল্যাট থেকে চোখ ওপরে ছুড়লে আকাশে পৌঁছায় আর সামনে ছুড়লে মাথা উঁচু বড়ো গাছের গায়ে পাখির বাসা খোঁজে। হাতে একটা দলাপাকানো বস্তু—চকোলেট বোম প্রথম ধাপে পাটের সুতলি দিয়ে যেমনটা পাকানো হয়, সেরকম ছেঁড়া-গোটা সব মিলিয়ে আছে। নলিনাক্ষ বহুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে।

    সেই থেকে রুহী ল্যাপটপ খুলে নিজের ঘরে— অন্‌ কল্‌। দরজা ভেজানো। সন্ধ্যের মুখে টী-ব্রেক নিয়ে আধঘন্টার জন্যে উঠে এসেছিল।

    রুহীর হাতে সময় থাকলে নলিনাক্ষকে একা চা বানিয়ে এমনকী একা বসেও চা খেতে হয় না কক্‌খনো। এসময়ে দুজনে ব্যালকনির কোণ ঘেঁষে রাখা পাতলা হালকা বেতের সেট-এ বসে। উভয়েই লাল-চা খায়। রুহী চমৎকার চা বানাতে পারে। চায়ের রঙ স্বাদ ও গন্ধ তিনটেই যথাযথ রাখতে জানে। সাজিয়ে আনে চায়ের সরঞ্জাম। কাপ-প্লেট, টী-পট, শুগার-পট, স্পুন্স একেক দিন একেক ডিজাইনের। তাদের তিন-চাররকমের সেট আছে–-পোর্সেলিনের সাদা সোনালি বর্ডার দেওয়া, দেশী পটারির একটু ধ্যাবড়া ফুলপাতা আঁকা, স্বচ্ছ সাদা কাচের আর জার্মান সিলভারের। সবই যে দামি তা নয়। রুহী চায়ের সাথে প্লেটে সাধারণ থিন এরারুট বিস্কিট হোক বা গোলগোল স্ন্যাক্স বিস্কিট এমন করে সাজিয়ে আনে, নলিনাক্ষ শুধু চেয়ে থাকে। ছুঁতে ইচ্ছে করে না। রুহী বলে,

    —কী হল, বিস্কিট নাও!

    —উঁহুঃ থাক।

    —শুগার?

    —নো।

    দু’আঙুলের বিশেষ মুদ্রায় পার্ফেকশন বুঝিয়ে দেয়। তারপরে সময় নিয়ে বলে,

    —রুহ্‌ তুমি নন্দনতত্ত্ব নিয়ে পড়তে পারতে!

    —মানে? কঠিন বাংলা বুঝি না।

    —আই-টি ছাড়া অন্য কিছু পড়লে ভালো করতে।

    রুহী মধুর করে হাসে। হাসি দেখে নলিনাক্ষর গোঁফ-দাড়ি-ঢাকা মুখে হাসি ছেয়ে যায়। রুহী বাংলা আজকাল অল্পস্বল্প বোঝে—জন্মসূত্রে তামিল ব্রাহ্মণ, মা বাঙালি। বাবার পরিবার অতি রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও এই বিয়ে হয়েছিল। এসব প্রসঙ্গ তারা আলোচনা করে না। জাতি-ধর্ম-ভাষা নিয়ে জানতে চায় না। আলগা মন্তব্য বা তর্ক করে মেজাজ খারাপ করে না। নিপুণতার সঙ্গে এড়িয়ে থাকে।

    রুহীর চোখ বড়ো ও বিন্যস্ত। সে দীর্ঘাঙ্গী, চেহারাটি ভারী দক্ষিণী ধরনের। আশির দশকের মাঝামাঝি জন্ম, নলিনাক্ষর সত্তর দশকের গোড়াতে। বয়সে এত ব্যবধান, কিন্তু আশ্চর্য বোঝাপড়া দুজনের মধ্যে। রুহীর কোনো ব্যাপারে নলিনাক্ষ মন্তব্য করে না। তার অফিসের পোশাক বেসিক জিন্স আর সু্তির একরঙা ফর্মাল শার্ট। ঘরে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত গাঢ় রঙের লম্বা ফ্রক পরে, পায়ে থাকে নরম কাপড়ের পাম্প-শু। বেড়াতে গেলে অধিকদিন উজ্জ্বল বা গাঢ় রঙের সিল্ক শাড়ি পরে। চুলে বেণী বাঁধে, ভারী গয়না থাকে হাতে কানে গলায়।

    নলিনাক্ষর এলোমেলো কাঁচাপাকা চুল। দাড়ির জঙ্গলে ফর্সারঙ ঢাকা। চশমার ময়শ্চার-ধরা কাচের ভেতরে উড়ে-যাওয়া দৃষ্টি। কাপড়জামার দশাও তথৈবচ। রুহী সেসব নিয়ে প্রশ্ন করেনা। এই তাদের শর্ত —অলিখিত, অস্ফুট, অব্যক্ত। দুজনেই কম কথা বলে এবং কোনো অবস্থাতে চেঁচিয়ে কথা বলে না।

    সামনে আকাশে লাল কমলা হলুদ মেলানো অজস্র রঙ খেলা করে চলেছে। একপাশেমোটা কালচে মেঘ চলেছে গজগমনে। এখানে গরম পড়ে অল্প সময়ের জন্য। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে গরম ধুয়ে যায়। নলিনাক্ষ উদাস গলায় ইচ্ছাপ্রকাশ করল,

    —যাবে রুহ্‌?

    —হুঁ চলো।

    —কাল?

    —ওকে, কাল।

    —ছুটি?

    —হ্যাঁ।

    গাড়ি বের করে নলিনাক্ষ। এখন রুহী ড্রাইভার। তারা অদল-বদল করে গাড়ি চালায়। নলিনাক্ষ আড়চোখে দেখে, রুহী শাড়ি পরেনি। সোনার বদলে ভারী কস্ট্যুম জুয়েলারি পরেছে। বেণীর বদলে হাইলাইট করা চুল চুড়ো করে তুলেছে। আলুথালু খুচরো কানের পাশ দিয়ে ঝুলছে, উড়ছে। রুহী কোথায় নিয়ে যাচ্ছে নলিনাক্ষ জানতে চাইল না। সে জানালার বাইরে সরে যাওয়া ঘুম-না-ভাঙা শহর দেখছে। ভোর বলে রাস্তা খালি। বেশ কয়েক কিলোমিটার চলে রুহী গাড়ি দাঁড় করায়। জলের বোতল থেকে আলগোছে গলায় ঢালে, নলিনাক্ষর দিকে আলগা করে বাড়িয়ে দেয়। নলিনাক্ষ ঠোঁট ছড়ায়, চেনা-চেনা রাস্তা। সীটের ওপরে রুহীর বাঁহাতের পাতা। উজ্জ্বল শৈবাল ত্বক, সুগঠিত পুষ্ট আঙুলে কালো নেইলপলিশ। মধ্যমায় মস্ত একটা দস্তার আংটি। নলিনাক্ষ দেখে। নিজের হাত বাড়িয়ে এমনভাবে রাখে যাতে শুধু মধ্যমা রুহীর মধ্যমার ডগাটুকুই ছুঁয়ে থাকে। প্রশ্ন করে,

    —ওয়াইনারি যাচ্ছি?

    —হুঁ।

    —নীউ দ্যাট!

    সে খুশি হয়, প্রকাশ করতে গুছিয়ে বসে। আজ তারও পরনে রুহীর মতো থ্রী-কোয়ার্টার বারমুডা আর গাঢ় টী-শার্ট –- অথচ কে কী পরবে প্ল্যান করা ছিল না। জানতোই না। সামান্য উচ্ছ্বাস গলায় আনে,

    —নেক্সট্‌ উইক এন্ড?

    —নট্‌ নাউ প্লিজ।

    —ও-কে! হোম-স্টে সামহোয়্যার?

    —ঠিক আছে।

    ভেঙে, চেখে একটু করে স্বাদ নেওয়া – নলিনাক্ষ জানালার পাশে সরে বসে। রুহী সোজা সামনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

    পরের দুসপ্তাহ বাদ পড়ে যায়, কাজের ব্যস্ততায় কথা বলার সময় অবধি থাকে না। প্রজেক্ট কমপ্লিশন, ক্লায়েন্ট মীট্‌ অবিচ্ছিন্নভাবে। ষোলোদিন এভাবে কাটলে রুহী হঠাৎ বলে,

    —কাল তুমি থাকবে ড্রাইভিং-এ।

    —যাচ্ছি তবে, না জোকিং?

    —হুঁ। নো জোকিং!

    —আ উইক?

    —থ্রী ডেজ্‌।

    —অনলি?

    —কান্ট হেল্প... স্যরি।

    —এনি-ওয়ে...।

    এখান থেকে তিনচারশো কিলোমিটারের দূরত্বে অনেক হাওয়াবদলের জায়গা – পাহাড়, ঘন সবুজ, ঝরনা তিরতিরে, ধাপে ধাপে কফিচাষ। ওরা সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যের মুখে পৌঁছে যায়। লাগেজ সামান্য, একটা করে পাতলা স্টোল এনেছে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সাজসজ্জার কী-ই বা দরকার পড়ে? মানুষ আসে-যায়, দেখে, বলে আব্রুরক্ষা, পোশাকের বাহার। রাতের খাওয়া হলে অন্ধকারে বাংলোর সামনের দুখানা চেয়ারে বসে। ভালো-লাগা কথা টুপটাপ ঝরতে থাকে, কিন্তু শব্দ হয় না। চেয়ার দুটির মাঝখানে ইঞ্চিদুই ফাঁক, যে যার শিথিল হাত নিজের চাদরে গুটিয়ে রাখে। ঘুমের আমেজ নরম আরাম বুলিয়ে দিতে থাকে। অনেক ভেবে, সাহস সঞ্চয় করে নলিনাক্ষ ডাকে,

    —রুহ্‌!

    —শোবে?

    —না।

    —তবে?

    —ভেবেছি, তবে করিনি — একটা প্রশ্ন।

    —খুব দরকার?

    —একটু আছে।

    —বলো।

    —তোমার ছেলে—?

    —কী—?

    —কোথায়?

    —উইথ মাই পেরেন্টস্‌।

    —আনবে না?

    —এখানে?

    —তোমার কাছে—।

    —ভাবিনি।

    —হুঁ। কত বয়স এখন?

    —সাড়ে চার। ঘরে যাই।

    রুহী উঠে দাঁড়ায়। নলিনাক্ষ কথা এগোতে চায় না। রুহীর পদানুসরণ করে ঘরে আসে। বেশ দামি হোম-স্টে। অনেক উঁচু কাঠের সিলিং থেকে সুদৃশ্য মৃদু আলো রহস্য তৈরি করেছে। জোড়াখাটে দুধসাদা বিছানা দুখানা। তারা একএক করে বাথরুমে ঢুকে পোশাক পরিবর্তন করে আসে। যথেষ্ট দূরত্ব রেখে নিজের নিজের অংশে শোয়। এর মধ্যে কোনো রাগ, ভান, ভণিতা, অভিমান নেই। যেখানে থাকুক অলিখিত শর্তভঙ্গ আজও পর্যন্ত করেনি। পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে যার যেমন ঘুম আসে সেই সময়ানুযায়ী। আজ ঘুম আসেনি। কোনো গোপন উত্তেজনা নিদ্রাহীনতার কাজ করছে। রুহী শ্বাস টেনে বলে,

    —বলি?

    —বলো—!

    —আদিথ্য ইজ্‌ মাই সন্‌। কে ওর বাবা ওকে জানাই নি। হী নীড নট নো। আমি জানাবই না। এই প্রসঙ্গ আর তুলো না।

    —বুঝলাম!

    —সো...।

    —আমি চেষ্টা করতাম—?

    —কীসের চেষ্টা?

    —বাবা হয়ে ওঠার। আ পুওর বয়!

    —নো! নো! নট এ্যাট অল— ও আমার ছেলে, ও আমার। ডোন্ট আস্ক এগেইন!

    —শান্ত হও।

    উত্তেজনা রোধ করতে গিয়ে গলা ধরে আসে রুহীর। উঠে বসে পাশ থেকে ছোট্ট কুশনটা তুলে বুকে চেপে ধরে, শব্দ চাপা দেয়। অন্ধকারে গুমরে কান্না আর ফোঁপানি বন্ধ ঘরে ঘুরপাক খায়। নলিনাক্ষ বিছানায় মৃত সৈনিক, কাঠের মতো পড়ে থাকে। নিজেকে বলে, ভবিষ্যতে কোনোদিন এবিষয়ে জিজ্ঞাসা করবে না।


    রোমিলা আইয়ার ওরফে রুহী নামের এম্‌প্লয়ী ছমাস আগে অন্য কম্পানিতে জয়েন করে গেছে। মেইল এসেছিল। নলিনাক্ষ এ্যাপ্রুভ করে দিয়েছিল। তাদের কম্পানিতে রোমিলা প্রায় সাড়ে তিনবছর ছিল। অল্প বয়স—পরিশ্রম আর বুদ্ধি দুইই যথেষ্ট। অনেক দূর উঠতে পারে মেয়েটি। কোথায় জয়েন করেছে খোঁজ নিলে জানা যেত, নলিনাক্ষ ওসব আন্‌-এথিক্যাল কাজ সমর্থন করে না।

    গত ক’বছরে কয়েকবার মিটিং প্রিসাইড করার সময়ে রোমিলাকে দেখেছে। এছাড়া সামনাসামনি কথা হয়নি। বারদুই একা তার কেবিনে এসেছিল অফিস-প্রোগ্রামের মুখপাত্র হয়ে। দরকারি কথা সেরে ‘থ্যাঙ্ক্যু স্যর’ বলে চলে গেছে। মেয়েটি অতীব ফর্ম্যাল এবং ডেকোরাম মেনে চলায় অভ্যস্ত।

    ব্যক্তিগত জীবনে রোমিলা ডিভোর্সি, ছোটো বাচ্চা আছে – এরকম খবর কানে এসেছিল নলিনাক্ষর। হতে পারে সত্যি, হতে পারে রটনা। নলিনাক্ষর জেনেই বা কী হবে!

    || দুই ||

    ফোন বেজে গেল কতক্ষণ ধরে। ভিকি ধরছে না। টিভির রিমোট মিউট করে চ্যানেল ঘোরাচ্ছে নলিনাক্ষ। টাটা স্কাই-এর কল্যাণে অজস্র চ্যানেল। মন বসছে না। মাস্টার প্ল্যান ভেবে ফেলতে হবে। চাকরি, কম্পানি বদলানো, প্রজেক্ট, ধূর্ততা, উন্নতি, অগাধ সাফল্য, সমস্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। হচ্ছে এখনো। এবারে অন্যরকম ভাবা যায়। কবেকার ফেলে রাখা প্ল্যান— ভিকিরও তখন উৎসাহ ছিল।

    ডিনার শেষ হয়েছে খানিক আগে। মোটা পর্দা-টানা জানালার বাইরে নিরিবিলি অন্ধকার, যদিও তার হিসেবে রাত বেশি নয়। অনুমান করা যায় দুচারজন অনিদ্রা-ভোগা ছাড়া বাকিরা বিছানায় কাদা হয়ে আছে। নলিনাক্ষর আঙুলের ফাঁকে বাজার-চলতি পেপারব্যাক গোঁজা। গদি, বালিশ, আরামের কুশন, উষ্ণ চাদরে আপনাপন। দেওয়ালের হাল্কা পেইল মরচে-লাল ম্যাট ফিনিশ, আবেশ-আনা ঘুমবাতি— আয়োজনে খামতি নেই। দেওয়াল-টিভিতে একটানা তাকিয়ে ক্লান্ত চোখ বুজে আসছে, কিন্তু ঘুমের পূর্বাভাস বলা যাচ্ছে না। মাথা এলিয়ে রেখেছে, সাইড-ডেস্ক থেকে মোবাইল বেজে ওঠে। আচমকা ডাকে চমকে গেল সে— ‘ভিকি কলিং!’

    ভিডিও কল করছে ভিক্রমজিৎ চোপরা। নলিনাক্ষ স্ক্রিনে চোখ রাখে,

    —গুড ইভনিং!

    —হাই নালিন! ইভনিং... হা হা ইলেভেন ফর্টিফাইভে ইভনিং? সাহেবি কেতা তুমি বদলাবে না!

    —দশটা নাগাদ কল্‌ করেছিলাম, ধরলে না?

    —উও থোড়াসা ... যাক বলো।

    —ওয়েট!! দেখি তোমাকে একটু। বেশ মুটিয়েছ! হেভি ওয়েট বিজনেসম্যান! হা হা।

    —কেয়া বাত! আমরা ফর্টি ক্রস করলেই হেভি ওয়েট...।

    —কেমন আছ?

    —ঠিকঠাক। বিজনেস লকষ্‌মী। সে যেমন রাখে আর কী – ধূপ ভী ছাঁও ভী।

    —হুঁ...।

    —কিন্তু তলব কেন? অনেকদিন বাদে তো!

    —বলছি। রিমেম্বারিং আওয়ার প্ল্যান?

    —কী বলো তো?

    —স্টার্ট-আপ্‌... ইউ রেডিলি এগ্রিড!?

    —ও হো হো!! দ্যাট্‌ ট্রাভেলিং ক্লাব? ট্র্যাভেল এজেন্সি? আলবাৎ মনে আছে। কী নাম যেন ভেবেছিলে?

    —দ্য এক্সপ্লোরার্স — সিম্পল নাম।

    ভিক্রমজিৎ মুখব্যাদান করে হাই তোলে। বলে,

    —গ্রেট। আমরা এটা নিয়ে কথা বলব। কল্‌ মী এগেইন প্লিজ্‌।

    —দিস উইক?

    —শিওর।

    গুড নাইট জানিয়ে ফোন কাটে নলিনাক্ষ।

    নলিনাক্ষর লম্বা ঢিলে কুর্তার সাইড পকেটে সেই সুতলির গোলাটা সামান্য হালকা। পরনে জিন্স, পায়ে ফ্লিপ-ফ্লপ। দেখা করতে এসেছে ভিকির সঙ্গে। ভিক্রমজিৎ রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে। উচ্ছ্বসিত হয়ে জাপটে ধরল,

    —আরে ইয়ার, তোমার দেরি করার অভ্যেস গেল না!

    —কাল অনেক রাত পর্যন্ত ল্যাপটপে অফিস করছিলাম।

    —চলো বসা যাক। খাবার, ড্রিঙ্কস? বলো অর্ডার করি।

    —আমার তরফে ট্রিট আজ।

    মুখোমুখি বসে নলিনাক্ষকে আপাদমস্তক দেখতে দেখতে ভিক্রমজিৎ হাসে,

    —তুম্‌তো বিল্কুল ভী বদলা নহীঁ ভা-ই।

    —তাই?

    —তাইতো দেখছি!

    —তুমি বদলেছ ভিকি -!

    —তব্‌? ঘোর সংসারী মানুষ, তোমার ভাষায় হেভি ওয়েট...!

    হো-হো করে হাসছে ভিকি, ফাঁকা ঘরের চেয়ার-টেবিলে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। কেজো দিনের ভরদুপুর। কাস্টমার প্রায় নেই। হাসি থামলে নলিনাক্ষ বলে,

    —জোকস এ্যাপার্ট, বাচ্চারা কতো বড়ো হল?

    —বেটী গ্র্যাজুয়েট, টোয়েন্টি হল - শাদী করে দিলাম।

    —বলো কী!

    —বেটা কলেজে ঢুকেছে। খুব একটা খবর রাখতে পারি না। সে একটু অন্যরকমের।

    —হুঁ।

    —তোমার প্রোগ্রাম রেডি?

    ওয়েটার দিয়ে গেছে সাজিয়ে, নর্থ ইন্ডিয়ান মশলাদার খাবার নিয়েছে নলিনাক্ষ। চড়া গন্ধ উড়ছে। প্লেটে তুলে দিয়ে বলে,

    —বলব, খেয়ে নাও।

    কাছাকাছি সায়েন্স সিটি। গাড়ি আনেনি, ক্যাব নিয়ে চলে যায়। নিরিবিলি খুঁজে বসে। ভিক্রমজিৎকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে, অনাগ্রহী। জোর করে উৎসাহ প্রকাশ করা লক্ষ করে নলিনাক্ষ। বলে,

    —তাড়া আছে?

    —আ-র ব্যবসাদার মানুষ—, কাউকে ভরসা করতে পারি কই? বলো—।

    —আমি টোটাল প্ল্যান চক্‌-আউট করে ড্র্যাফট বানিয়ে রেখেছি। তোমাকে মেইল করে দেব।

    —গুড্‌! ইসীকে লিয়ে তুমসে—।

    —শোন, ফার্স্টলি কম্পানি আমাদের দুজনের। শেয়ারিং ফিফটি-ফিফটি থাকলেই ভালো।

    —সিক্সটি-ফর্টি করতে পারো। আমার ছেলে জয়েন করতে চাইছে।

    —বাঃ, নিয়ে এলে পারতে?

    —পরে হবে। নেক্সট? দেখো, প্ল্যান এন্‌ এ্যারেঞ্জমেন্ট তোমার। আমি বাস্‌ পয়সা ডালবো— প্রফিট দেখব।

    —ভালো। এজেন্সির নাম বদলেছি স্লাইট–- ড্রিমার্স এন্‌ এক্সপ্লোরার্স। আর—,

    —গুড নেম।

    —প্রতি ট্রিপে লিমিটেড ট্র্যাভেলার্স নেওয়া হবে।

    —সেকী! উও কিঁউ?কেন? কস্ট অনেক বেশি পড়বে!

    —দেখ, পয়সা আছে বলেই দৌড়ে চলে গেলাম–-বরফের পাহাড়ে চড়তে গিয়ে সেখানে নেচে-কুঁদে, খেয়ে-গেয়ে এলাম! শপিং করে লাগেজ ডবল করে ফেললাম! তাদের জন্যে আমদের এজেন্সি–- নো ওয়ে। আমরা মার্জিন্যাল প্রফিট রাখব।

    গুরুত্ব না দিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে থাকে ভিক্রমজিৎ, নলিনাক্ষর তালে তাল দিয়ে যায়। বলে,

    —টু সিলেক্টিভ ইয়ার! বুঝবে কী করে?

    —ডিটেইল ইন্টারভিউ। কোয়েশ্চেনেয়ার বানিয়ে ফেলব।

    —আই ব্বাস! গ্রেট! নেক্সট?

    —ইয়েস ডেস্টিনেশন—।

    —হোমল্যান্ড অর ফরেইন?

    —দুটোই হবে। আমাদের টার্গেট মেইনলি আনকমন, অফ্‌বীট্‌ স্পটস্‌, যেতে হলে ডেয়ারিং হতে হবে। ফিজিক্যাল মেন্টাল স্ট্যামিনাও চাই।

    —ব্বাপরে! কঁহা লে জাওগে? বদ্‌রিনাথ? বৈষ্ণোদেভী?

    —একটু অফ্‌ সিজনের দিকে যাওয়ার প্রভিশন্স রাখা যায়। খরচ কমবে।

    —মানে?

    —যেমন শীতকালে টাবো—।

    —উও কহাঁ ইয়ার?

    —হিমাচল প্রদেশ—লাহুল-স্পিতি ভ্যালী।

    —কী দেখার আছে?

    —খুব পুরনো মনাস্ট্রি।

    —বস্‌ এটাই?! ফির্‌?

    —তাওয়াং। অরুণাচল প্রদেশ, বিশেষ যায় না কেউ। দরকারে পার্মিশন—।

    —মাই গাড্‌! তিরুপতি, সিদ্ধিসাঁই, স্বর্‌ন্‌মন্দির প্ল্যানে রাখবে না?

    —একদম না। তুমি কি থাকবে না তাহলে?

    —না না, অব কোর্স আছি। আমার ছেলেটা তোমার মতো— ড্রিমার! শুনে বলছিল, আঙ্কল যদি ফরেন-ট্যুর রাখে মেক্সিকো মাস্ট বী দেয়ার।

    —গ্রেট! আমি ভেবেছি।

    —আরে ইয়ার, বহোৎ বেকার দেশ। ক্রাইমস ভর্তি, ওখানে কেউ বেড়াতে যাবে?

    —মায়া সিভিলাইজেশন মেক্সিকো জুড়ে–- টুলুম, কোবা, প্যালাঙ্কিউ! দেখাবো আমরা।

    —কেয়া বাৎ! জিন্দেগীতে প্রথম শুনছি।

    —ইস্ট ইওরোপ দিয়ে ফরেন-ট্রিপ শুরু করব–- ধরো প্রাগ বা সোফিয়া। তারপরে টার্কি, আর্মেনিয়া—।

    —চক্কর আসছে ভাই। তুমি ইন্ডিয়ারটা বলো আগে।

    হেসে ফেলে নলিনাক্ষ। ভিকি অধৈর্য হয়ে উঠছে। ওর পিঠে আদরের চাপড় দিয়ে বলে,

    —এখনই? সবে শুরু! ইন্ডিয়াতে নর্থ ইস্ট আর হিমাচলের কয়েকটা স্পট দিয়ে শুরু করব।

    —ও-কে। সব ডিজাইন বুঝিয়ে বলো।

    —ডেস্টিনেশন ছক আঁকছি এরকম–- মাউন্টেইন্স, ফরেস্টস্‌, সীজ্‌ এন্‌ ওশান্স, কেইভস এন্‌ ওল্ড সিটিস্‌। অনেক ফাইন টিউনিং করব।

    —যথেষ্ট ব্রাদার। আজ চলো উঠি, প্রিলিমিনারি পার্ট হল। তুমি আমাকে সমস্তটা মেইল করে দিয়ো।

    —শিওর। আগে প্রচুর খোঁজখবর আর পড়াশোনা করতে হবে।

    —আমি ভীষণ এক্সাইটেড ইয়ার। ভালো ট্যুর গাইড খোঁজ করতে হবে। দেখছি, জানাচেনা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বলি।

    —আমার ইচ্ছে ট্যুর গাইডের কাজ নিজে করব, মাইনে আমাকে দিও। রাত্তিরেই পাঠাচ্ছি তোমায় মেইল।

    চারিদিকের নাগরিক আলো জ্বলে উঠে প্রমাণ দিচ্ছে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার শোরুম থেকে কল্‌ এসেছে ভিক্রমজিতের। আর দেরি করা যায় না। অগত্যাহাসিমুখে বিদায়ী হ্যান্ডশেক করে। ক্যাবে বসে ফুরফুরে লাগে নলিনাক্ষর, প্রোগ্রামের ডিটেইল ভাবে। আলতো স্বপ্ন দেখে, আলতামিরার গুহায় দাঁড়িয়ে আছে ট্যুরিস্টদের সঙ্গে নিয়ে।


    ভিক্রমজিতের সঙ্গে কবে যোগাযোগ কেটে গিয়েছিল নলিনাক্ষ মনে করতে পারে না। কমপক্ষে চারপাঁচ বছর হবেই। ভিকি প্রায়ই বলত,

    —বুঝলে ইয়ার, আমি কোর বিজনেস মেটেরিয়াল না! পাপা জবরদস্তি এম-বি-এ করিয়েছে, ফ্যামিলি বিজনেসে ঢুকতে হবে। বরং তোমার প্রোপোজ্যল বেটার, দুজনে মিলে ট্র্যাভেল এজেন্সি খুলে ফেলি!

    পরে কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করেছে নলিনাক্ষ। ভিকির মোবাইলের যে নম্বর সেভড্‌ ছিল সেটা বলছিল, দিস্‌ নাম্বার ডাজ্‌ নট্‌ একজিস্ট্‌। হয় ফোন-সেট বদলেছে, নয়ত মোবাইল। মাঝেমাঝে আমোদপ্রিয় বন্ধুটিকে মনে পড়ত।

    অবসরে নেট ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে ‘ইলেকট্রনিকা, ভি-কে-সি এন্টারপ্রাইজ্‌, ক্যালকাটা’ খুঁজে পেয়েছিল। সঙ্গে ল্যান্ডফোন নম্বর। উৎসাহিত হয়ে ফোন করেছিল। নলিনাক্ষর জিজ্ঞাসার জবাবে ভারী যুবক-কণ্ঠ দায়সারাভাবে বলেছিল, তার বাবা ভিক্রমজিৎ চোপড়া আপাতত বিশেষ কাজে ইন্ডিয়ার বাইরে গেছে। ব্যবসা দেখার দায়িত্ব তার ওপরে।

    —স্যরি স্যর, ম্যাঁয় বহুৎ বিজি আছে।

    বলে ফোন কেটে দিয়েছিল। নিজেকে অপমানিত লেগেছিল নলিনাক্ষর। পরে অবশ্য ব্যাপারটা মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলেছিল। এসমস্ত বছরখানেক আগের ঘটনা।

    || তিন ||

    রাঙামাসির বাড়ির খানিক আগে পকেট থেকে চিরুনি বের করতে গিয়ে সুতলির গোলাটুকু হাতে ঠেকল। আরো ছোটো মনে হচ্ছে। নলিনাক্ষ জেল-মাখানো ব্যাকব্রাশ পরিপাটি করল, তার চুল যথেষ্ট ঘন। সাদা চুলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে হাইলাইটেড মনে হয়। ঘাড়ের কাছে বাঁধা ঝুঁটি। দাড়ি আঁচড়াতে গিয়ে হাসলো, কী বলবে রাঙা? কুর্তা-পায়জামা পরে বেরিয়েছে। দামি নীল কুর্তাটা একটা ব্যুটিকের, ট্রাইব্যাল মোটিফ পেইন্ট করা আছে। সঙ্গে নিয়েছে একহাঁড়ি রাজভোগ, একবাক্স নরমপাকের সন্দেশ। তাঁতের শাড়ি নিয়েছে রাঙার জন্যে, মেসোর জন্যে শার্ট আর প্যান্টের কাপড়। মনের মধ্যে আনন্দিত উত্তেজনার খই ফুটছে।

    বিহারি গোমড়ামুখো ড্রাইভার নিঃশব্দে চালাচ্ছে। আয়নার কাচে ভাঁজ-পড়া ভ্রূ, অভিব্যক্তিহীন মুখের আংশিক ছবি দেখা যাচ্ছে। থেকে থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেয়েছে, হিসি করেছে। অখুশি গলায় জিজ্ঞেস করেছে,

    —আর কেতো দূর স্যর? রাস্তা ঠিক চিনেন তো?

    প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাইরে চোখ রেখেছে নলিনাক্ষ। ষাট-বাষট্টি কিলোমিটার যেতে এত কথার কী আছে! এমনিতে যথেষ্ট বেশি টাকা নিচ্ছে লোকটা।

    শহর ছাড়িয়ে গেলে দুধারে গ্রামবাংলা। জনসংখ্যা অত্যধিক বলে এসব লোকালয় অনেক জায়গায় অসুন্দর আধাশহর। ক্লাবের কাছাকাছি এসে চেনা লাগে জায়গাটা। যাক, খুব বেশি বদলায়নি। মোড় ঘুরে দুখানা দোতলা পেরিয়ে শেষকোণে রাঙাদের একতলা। গলি সরু হয়ে আসায় গাড়ি ঢুকতে পারল না। সুবিধেমতো পার্ক করে দিয়ে ড্রাইভার বেজার মুখে বেরিয়ে আসে, পাশে থুথু ফেলে। নলিনাক্ষ ততক্ষণে বাগানের গেট পেরিয়ে রাঙাদের লাল মেঝেওয়ালা বারান্দায়। কলাপ্সিবল্‌ দরজার সামনে মাসি-মেসো দুজনে, সে তাড়াতাড়ি চটি খুলে নিচু হয়ে প্রণাম করে। রাঙা টেনে তোলে, একমুখ হাসি নিয়ে বলে,

    —সত্যি এলি!

    —হ্যাঁ।

    —দাঁড়া বাপু দেখি তোকে। ও-মা তুই দেখি প্যাংলাই আছিস? মাথায় এটা—? হী হী! একমুখ দাড়ি আবার–- ঈস্‌!

    —বাজে দেখাচ্ছে?

    —কেমন একটা। তোদের ওখানে সবাই বুঝি এমন রাখে? কেমন আছিস?

    —বলব, ঘরে ঢুকতে দাও—।

    ড্রাইভার বারান্দার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গলা ঝাড়ে। হেঁকে বলে,

    —গাড়ি থেকে সামানগুলো লিয়ে আসেন স্যর। হামার দেরী হোয়ে যাচ্ছে।

    পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ নলিনাক্ষর, বাইরে পেয়ারা গাছে লুকিয়ে-থাকা পাখির ডাক কানে আসছে। রাঙাদের বাড়িতে আলাদা বসার ঘর নেই, বড়ো ঘরের খাটে টানটান বিছানায় সে বসে। ফুল-ফুল চাদর, সাদামাটা পর্দা। লম্বা জানালার কপাট, মশার জন্যে জালমোড়া শিক। পুরনো বাড়িতে, পুরনো আসবাবের কোনায় আগের মতো অবিকল জমতে থাকা ঘন সন্ধ্যে। রাঙা হেসে বলে,

    —কী দেখিস রে?

    —সময় এগোয় নি আসলে।

    —যত্ত হেঁয়ালি কথা। যা বাড়িটা ঘুরে দেখ। একই আছে।

    —আগে চা দাও।

    —একটু বস, শুভু আসুক। আমি রান্নাঘরে বিশেষ যাই না।

    —শুভু কে?

    —শুভ্রা রে! আমার ভাসুরঝি। তোর বয়সি ছিল। খেলতিস, মনে নেই?

    —এখানে থাকে?

    —এনে রেখেছি, তা ছ-সাত বছর হবে। শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা হল, ওর দাদা-বৌদিও রাখতে আর চাইল না। ভাসুর কবে চলে গেছেন, বড়-জারও জোর খাটে না।

    জানালার পাশে রাখা কাঠের আরাম চেয়ারটায় মেসো বসেছিলেন। পাশে বইঠাসা র‍্যাক। উঠে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলেন,

    —আমি খানিক হেঁটে আসি নলিন। এসে কথা হবে’খন।

    নলিনাক্ষ সম্মতি জানিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখে। বরাবর ইনি এরকম, শান্ত স্বল্পবাক মানুষ। অফিস থেকে ফিরে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন। রাঙা বলে,

    —এসে—? তুমিও ঘরে ঢুকে পড়বে। তুই জানিস না, সারাদিন বইমুখে! ওঘরটার যা অবস্থা করেছে দেখবি? খাটের নিচ পর্যন্ত বই। যা পেন্সন পায় তার অর্ধেকই ওতে! ওগো, তাড়াতাড়ি ফিরো।

    মেসোর দিকে তাকায় নলিনাক্ষ, চোখে প্রশ্রয়ের হাসি। বলে,

    —দ্যাটস্‌ গ্রেট! পড়ুয়া মানুষ।

    —সবাই এটাই বলে। আমিও ডিস্টিংশন পাওয়া গ্র্যাজুয়েট—।

    —শাড়িটা পছন্দ হয়েছে?

    —বেশি উজ্জ্বল। মানাবে কি আমাকে? বুড়ি হয়ে গেছি না!

    রাঙা হাসে। ভাঙাচোরা বয়স্ক মুখ, কোঁকড়া চুলের সামনে সাদার আধিক্য। কপালের ভাঁজ স্পষ্ট। ঘন সবুজ দক্ষিণী তাঁতের শাড়িটা পাশে রাখা। মন খুঁতখুঁত করে নলিনাক্ষর। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে,

    —রাঙা তোমার বয়স কত হল?

    —কেন রে?

    —বড্ড এজেড্‌ দেখায়। এমন রোগা, সিক্‌লি?

    —হাজারগণ্ডা অসুখ যে — হাই শুগার, প্রেশার। বাদ কোনটা? অত মিষ্টি এনেছিস, কে খাবে?

    বারান্দার দরজার শব্দ হয়। দ্রুতপায়ে ঘরে এসে ঢোকে মহিলা, হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেট। ব্যস্ত গলায় বলে,

    —দেরি হয়ে গেল কাকিমণি। কাছের দোকানটার সব প্যাকেট দেখি পুরনো, ডেট পেরিয়ে গেছে। সেজন্যে—, যাই চাটা বসিয়ে দি’গে।

    —দাঁড়া, পরিচয় করিয়ে দিই। নলিন দ্যাখ এইযে শুভু, শুভ্রা–-। চিনতে পারিস? তোরা আসবি শুনলে ওরা দুভাইবোনে আমার এখানে চলে আসত।

    নলিনাক্ষ সহজ হতে পারছে না। শুভ্রা সরাসরি তাকায় না কিন্তু আন্তরিকভাবে বলে,

    —কী করে চিনবে? কতকাল আগের কথা। কত বদলে গেছি, সবাই-ই।

    হাসির আভাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে নলিনাক্ষ। ছিপছিপে চেহারা শুভ্রার, বয়স ধরা পড়ে না। প্রায় নিরাভরণ, সাধারণ প্রিন্টেড শাড়ি। চুলে বেণী, চোখে সামান্য কাজল। ম্লান ফর্সা রঙ। খুঁটিয়ে দেখলে ধরা যায় মুখের যুদ্ধ ও ক্লান্তির স্পষ্ট চিহ্ণ। প্যাকেটগুলো নিয়ে ভেতরে চলে যায়। বলে,

    —তোমরা ওদিকে এসো, আমি এক্ষুনি এগুলো ভেজে ফেলছি।

    রান্নাঘরের পাশের লম্বাটে দালানে আধুনিক ডিজাইনের ডাইনিং টেবিল-চেয়ার বেমানান লাগছে। নলিনাক্ষ মন্তব্য করে না। সদ্য ভাজা গরম চিকেন নাগেটস্‌, চীজ্‌ বলস্‌, চা এনে রাখে শুভ্রা। নলিনাক্ষ অবাক হয়ে বলে,

    —এসব কী রাঙা? এসব খাব না।

    —কেন রে? খাস না? পুরনো না, শুভু ডেট দেখে নিয়ে এসেছে।

    —এগুলো খেলে আর এখানে আসব কেন?

    চাপা বিরক্তি ছিল স্বরে, মাসি চুপ হয়ে যায়। শুভ্রা দাঁড়িয়ে দেখে। নিরাশ গলায় বলে,

    —তাহলে?

    —চা-টা খাই।

    —শুধু শুধু?

    —মুড়ি নেই? তেল-পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে মাখা?

    চারজনের টেবিল। শুভ্রা যত্ন করে খাবার গুছিয়ে বেড়ে দেয়। বাড়িটা ঘুরে দেখে নলিনাক্ষ। প্রয়োজনীয় সাধারণ বদল হয়েছে, না হলে প্রায় তেমনই আছে। ডিজাইনহীন, ছড়ানো। পুরনো গন্ধ খুঁজে পায় নলিনাক্ষ। বলে,

    —রাঙা উল্টোদিকের খোলা জায়গায় আমরা খেলতাম না?

    —খেলতিস তো। তখন খোলা জমি ছিল। পরে একজনরা কিনে পাঁচিল তুলে ফেলে রেখেছে—সেও কতবচ্ছর। তুই এলি কত যুগ পরে! মানুর বিয়ের সময়ে আসতে পারিস নি।

    —মানুদা কোথায় আছে?

    —ওই যে তোদের বাড়ির কাছেই তো, সেক্টর ফাইভে। ফ্ল্যাট কিনেছে। নিখিলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়, দেখাও হয়েছে বোধহয় দুএকবার। তুইই কত দূরে চলে গেছিস—!

    —তোমরা এখানেই থাকবে?

    —হ্যাঁ বাবা। তোর মেসো নড়বে না, বদ্ধ জায়গায় নাকি দম আটকায়। তাছাড়া বইয়ের পর্বত রাখবে কোথায় ফ্ল্যাটবাড়িতে? জানিস তো শান্ত মানুষের জেদ! মানু রাগারাগি করে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

    —হুঁউ!

    বাইরের বাগান থেকে গাছপালার হাওয়া আসছে, জানালা গলে চাঁদের আলোর উপঢৌকন। কবেকার শব্দ-গন্ধ আজও অপরিবর্তিত। ঝিমঝিমে ভালো-লাগা অনুভব করছে নলিনাক্ষ। মেসো এবারে সহজ হয়েছেন। টুকটাক অংশ নিচ্ছেন কথাবার্তায়। কত গল্প, ভুলে-যাওয়া, হারিয়ে-যাওয়া, ফুরিয়ে না যাওয়া গল্প টেনে এনে রাখছে একজন, আর কেউ তুলি বুলিয়ে দিচ্ছে মুছে যাওয়া রঙগুলোতে। রাঙা বলেন,

    —ও শুভু তুই ঘুম পেলে শুগে’ যা।

    —ঘুম পায়নি কাকিমণি।

    —আচ্ছা। জানিস নলিন, শুভুর মেয়ে লেখাপড়ায় খুব ভালো। নামী কম্পানিতে চাকরি পেয়েছে, ওই তুই যেখানে থাকিস ওখানে।

    —তাই?

    —হ্যাঁ। তোর কম্পানিতে নাকি ইন্টার্ভিউ ডেকেছিল। গেছে কিনা জানি না অবশ্যি।

    —ও! রাঙা, একবার ছাদে যাওয়া যায়?

    —এখন? যা। লাইট তো নেই।

    —চাঁদ আছে!

    —তা— হ্যাঁ কাল পূর্ণিমা।

    সাবধানে কার্নিশে বসেছিল নলিনাক্ষ। চাঁদের আলো রূপোলি ওড়না বিছানো। সে বুক ভরে পরিষ্কার বাতাস টেনে নিচ্ছিল। অদূরে খাটাল, গোবরের গন্ধ বাতাসে মিশছে। গরুর ডাক। একদা অত্যধিক সিগারেট খেত। নিজে থেকে ছেড়ে দিয়েছে। ড্রাইভারকে ছেড়ে দিল, মেসো বলেছেন এখান থেকে ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে। নলিনাক্ষ ভাবছে আগেকার মতো লোক্যাল ট্রেনে ফিরবে, ছোটোবেলায় যেমন যেত-আসত মায়ের সঙ্গে।

    পেছনের লম্বা ছায়া পড়ল সামনে — শুভ্রা। নলিনাক্ষ আশা করেনি। কী বলতে চায়? সে বিব্রত গলায় বলল,

    —নিচে যাই, ঘুম পাচ্ছে।

    —একটা কথা জানার জন্যে এসেছি।

    —এখন? কী?

    —তোমার দাদার কাছ থেকে নিয়ে তোমার অফিসের ঠিকানাটা অনুকে দিয়েছিল কাকামণি। তোমার সঙ্গে দেখা করেছিল?

    —অনু কে?

    —অনু— অন্তরা, আমার মেয়ে।

    চাঁদের আলো পড়ে কাজল-পরা চোখ চকচক করছে শুভ্রার। বড়ো মায়াবী গভীর চোখ, কতযুগ আগে কাছ থেকে শেষবার দেখেছিল।


    অন্তরা নামটা বহুল প্রচলিত — শুধু বাঙালি কেন, ইদানিং অবাঙালিরাও রাখে। এই নামে অনেক ক্যান্ডিডেট আসে, ইন্টার্ভিউ বোর্ডে বসে দেখেছে নলিনাক্ষ। শুভ্রার মেয়ে কোন্‌জন মনে নেই।

    ক’বছর আগে দাদা এবং বৌদি দুজনে ফোনে জানিয়েছিল, শুভ্রার মেয়ে তার অফিসে যাবে ইন্টার্ভিউ দিতে। সে হেল্প করতে পারলে ভালো হয়। কোন্‌ শুভ্রা, কে তার মেয়ে – ব্যস্ততায় বেমালুম ভুলে গিয়েছিল নলিনাক্ষ। ওই নামে কোনো এমপ্লয়ী তাদের ব্র্যাঞ্চে নেই। অন্তরা নামের মেয়েটি আলাদা করে যোগাযোগ করতে পারত, অন্তত ফোনে—। করেনি। হতে পারে অফিসে এসে দেখা করতে চেষ্টা করেছে, রিসেপশনিস্টকে দিয়ে স্লিপ পাঠিয়েছে। নলিনাক্ষ উটকো ঝামেলা বলে ফিরিয়ে দিয়েছে। অথবা অফিশিয়াল ট্যুরে ছিল বলে দেখা হয়নি। অবশ্য কিসের দায়? এমনিতে এতবছর বাইরে থেকে, লতাপাতার সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে গেছে নলিনাক্ষর কাছে। ক’মাস আগে যেন কথাপ্রসঙ্গে তার বউদি বলছিল,

    —দুবছরের বেশি হল অন্তরা ওখানে থেকে চাকরি করছে— অন্য কম্পানিতে যদিও। তোমার সঙ্গে দেখা হয় না? যোগাযোগ করেনি? মাসি জানতে চাইছিল।

    সে আকাশ থেকে পড়েছিল। বলেছিল,

    —ক-বে? অন্তরা আবার কে?

    বউদি সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করেছিল। নলিনাক্ষর মনেও পড়ে নি।

    || চার ||

    ব্যাকপ্যাক পিঠে ট্রেন থেকে নামে নলিনাক্ষ। আকাশ রঙিন করে ভোরের আলো ফুটছে সবে। লোক নামছে পিলপিল করে। সে ধীরেসুস্থে ভিড়ের পাশ কাটিয়ে পা ফেলে। উস্কোখুস্কো চুল হাত দিয়ে ঠিক করে ঝুঁটি আঁট করে বাঁধে। প্ল্যাটফর্মের দোকানপত্র খুলছে। পুরি-সবজি, গরম চা, কফির গন্ধ আসছে। বিসলেরির বোতল ঝুলছে, স্তূপীকৃত হয়ে আছে। নলিনাক্ষ এগিয়ে গিয়ে একটা কেনে। বাইরে গরম চিটচিটে বাতাস। এ-সিতে থাকার কারণে টের পায়নি এতক্ষণ। বাতানুকূল দ্বিতীয় শ্রেণীতে টিকিট ছিল। টয়লেটের কাজ ওখানে সেরে এসেছে। আপাতত লাইনে কোনো ট্রেন নেই। নেই ঘোষণাও। কিছু যাত্রী ছড়িয়ে বসে আছে। বেঞ্চগুলোতে টান হয়ে ঘুমোচ্ছে কেউ। মাটিতে কাপড় বিছিয়ে শুয়েছে ক’জন যুবক। প্ল্যাটফর্ম তত নোংরা নয়, তবে ময়লার ডাস্টবিনের পাশে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক প্যাকেট, চ্যাপ্টানো কাগজের কাপ — ভেতরে ফেলা হয়নি। চোখ সরিয়ে এগোয় নলিনাক্ষ। জিন্স-এর পেছন-পকেটে হাত দেয়। সুতলির গোলাটা একেবারে ছোট্ট হয়ে গেছে, মালুম হচ্ছে না প্রায়।

    ‘পানীয় জল’ লেখা বেসিনের পাশে পেছন ফিরে সশব্দে জিভছোলা দিয়ে গলা সাফ করছে একজন। সে কাছাকাছি গিয়ে ফিরে এল। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গিয়ে অটো বা ট্যাক্সি ধরে হোটেল খুঁজতে হবে, কোথাও বুক করে আসেনি। একপাশে সরে গিয়ে জলের বোতলের আঁট ঢাকনা খুলে ফেলে। আধ-বোতল জলে নিজের চোখ-মুখ-মাথা ধুয়ে বাকিটা ঢকঢক করে গলায় ঢালে। দু’চারজন কুলি ইতস্তত ঘুরছে। দরকার নেই বুঝেও জানতে চায়,

    —চাই বাবু?

    মায়া হয় নলিনাক্ষর, মাথা নাড়ে। ট্রলি আর ব্যাকপ্যাক হওয়াতে আজকাল কাস্টমার কম।

    প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে বাইরে আসতেই অটোদের হাঁকডাক, সে মাথা ঘামায় না। তাড়া নেই, যতক্ষণ খুশি দেরি করতে পারে। পরিচ্ছন্ন আকাশে সদ্যফোটা সকালের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু যে ভাবে তাও নয়। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, হঠাৎ কে ডাকে,

    —নলিন!

    চমকে ওঠে সে, আবেশ কেটে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। কবেকার বিস্মৃত স্নেহার্দ্র স্বর। ডানদিকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন সুরেন্দ্রনাথ। তার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। গলার ভেতর থেকে বলে,

    —বাবা!

    —জানতাম তুমি আসবে।

    —ওঃ জানতে—!

    সে চেপে-থাকা নিঃশ্বাস ফেলে। আর কথা জোগায় না। নিষ্পলক তাকিয়ে দেখে বাবাকে। ফর্সা দীর্ঘকায়, দাদা নিখিলেশের এখনকার চেহারার সঙ্গে ভীষণ মিল। পরনে সাদা কাপড় লুঙ্গির মতো করে পরা, সাদা ফতুয়া, মাথায় সাদা-কালো মেশানো কদমছাঁট। চশমা, হাওয়াই চটি। দুজনে পাশে পাশে হেঁটে আসে অটোর কাছাকাছি। অটোতে বসে সুরেন্দ্র বলেন,

    —কোন্‌ হোটেল?

    —যা হোক। বুক করে আসিনি। আর যদি বলো—,

    —আমার ওখানে সম্ভব নয়। হোটেলেই থাকো।

    নলিনাক্ষ বাবার দিকে তাকায়, মনের ভাব কী করে বুঝলেন! উনি সোজা সামনে তাকিয়ে আছেন। অটোওয়ালাকে বলেন,

    —স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে যেসব হোটেল সেখানে নামাবে। নলিন, আশা করি ট্যারিফ বেশি হলে অসুবিধে নেই। তুমি তবে স্নানাহার সেরে দশটা নাগাদ নেমে এস। আমি পৌঁছে যাব।

    —হুঁ—।

    ওদিকে ভিড় কম। হাঁটতে হাঁটতে বালিতে এসে বসে দুজনে। বেলা বাড়ছে, ঝাঁঝাঁ রোদ বেশ কষ্টকর। সুরেন্দ্রকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না। ওঁর বয়স হিসাব অনুযায়ী তিরাশি-চুরাশি, নলিনাক্ষ ভাবে। চেহারা তা বলে না। সুরেন্দ্র হাতের কালো ছাতাটা খুলে নলিনাক্ষকে দেন,

    —বালিতে পুঁতে বসো, রোদে কষ্ট হবে না। আমার অভ্যেস আছে। অবশ্য বাতাস বইলে এও থাকবে না। বাতাস জোর হলে কত কী উড়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউ বাড়লে কত কী ভেসে যায়। সময়ও সমুদ্র, একবার ভেসে গেলে আর পাওয়া যায় না। যদিও সমুদ্র এবং সময় কেউই কিছু নিজের বলে ধরে রাখে না— এপারে না হলেও ওপারে ফিরিয়ে দেবেই।

    নলিনাক্ষ নীরবে শোনে। অনর্গল অদ্ভুত কথাবার্তার অর্থ খুঁজে পায় না। অনতিদূরে সমুদ্রের গর্জন, দর্শনার্থীদের সরব উচ্ছ্বাস— মিলিত শব্দ ভেসে আসছে। সুরেন্দ্র বলেন,

    —তোমার কথা বলো নলিন। ক’দিনের জন্যে এসেছ?

    —কাল সন্ধ্যেয় ফেরার ট্রেন।

    —বেশ। আজকের দিন একসাথে কাটাব। অবশ্য সন্ধ্যের পরে আমি আর বাইরে থাকি না। কাল যদি বিশেষ কাজ না পড়ে যায়, আসব তোমার সঙ্গে দেখা করতে। বলো, কেমন আছ?

    —চলে যাচ্ছে।

    —কলকাতায় থাকো? না সেই যে চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে বোম্বে গিয়েছিলে, ওখানে?

    —ছিলাম ক’বছর। তারপরএখন – অন্য কোথাও—।

    —বেশ। যাযাবর হওয়া ভালো, শেকড় গাড়ে না। বিদেশ-ভ্রমণ হয়েছে?

    —হ্যাঁ দু’বার শর্ট টাইমের জন্য, অফিস থেকে ডেপ্যুট করেছিল।

    —ভালো। সংসারজীবন? বিবাহ করেছ?

    নলিনাক্ষর মুখে হাসি ভেসে যায়। খুব আস্তে মাথা নাড়ে, নাঃ। সুরেন্দ্রর চেহারায় উদ্বেগ নেই, বরং কৌতুকের আভাস। বলেন,

    —চুল অনেক সাদা হয়েছে দেখছি। পঞ্চাশ ছুঁলো তোমার।

    —উনপঞ্চাশ।

    —হ্যাঁ। দয়িতা আছে? থাকলে তার জন্যে একটি নাম ভেবে রেখেছিলাম।

    —না, কেউ নেই। কী নাম?

    —তবে আর জেনে লাভ নেই।

    —হুঁ।

    কখন বেলা বেড়ে যায়। বেশিটাই নীরবতা। তবু সুরেন্দ্র কথা বলেন, জিজ্ঞেস করেন। নলিনাক্ষ উত্তরটুকু দেয়, অসহজভাব কাটিয়ে উঠতে পারে না। মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যে, প্রশ্ন বড়ো মাছির মতো ডানা মেলে ওড়ে। জিভের ডগায় এলে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়। সুরেন্দ্র জানতে চান,

    —মন্দিরে যেতে চাও? দর্শন করবে?

    —নাঃ ইচ্ছে নেই।

    —ভালো। বেলা হয়েছে, হোটেলে ফিরে গিয়ে খেয়েদেয়ে জিরিয়ে নাও। চারটে নাগাদ আমি আসব, সন্ধ্যে হলে ফিরে যাব।

    —এখানে দুজনে লাঞ্চ করা যেত!

    ইতস্তত করে বলে ফেলে নলিনাক্ষ। সুরেন্দ্র হাসেন,

    —তা হয় না। আমি আসি।

    এ-সি ডিলাক্স রুম, আরামে শুয়েও ঘুম আসে না নলিনাক্ষর। প্রশ্নটা শান্তি দিচ্ছে না। বাবা তাকে নিজের বাসস্থানে নিয়ে যেতে চাইলেন না। একসাথে খাবার প্রস্তাবও রাখলেন না। ঈষৎ অভিমান হলেও, কৌতূহল অনেক বেশি। যে মানুষ স্বেচ্ছায় সংসার ছেড়ে এতবছর ধরে অন্যত্র রয়ে গেলেন, তার ব্যবহারে অভিমান হয় না।

    চারটের পরে নিচে নেমে দেখল, বাবা হোটেলের বাইরে অদূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আচমকা নলিনাক্ষর বুকের মধ্যে দমকা গরম হাওয়া। আকাশের দিকে চোখ গেল, বিচিত্র রঙে মাখামাখি। সূর্যাস্তের প্রস্তুতি। কোত্থেকে একটুকরো বাদলমেঘ আয়োজনটাকে পণ্ড করে দিতে এসেছে। সুরেন্দ্র বলেন,

    —ক্লান্ত ছিলে বুঝতে পারছি। ঘুম ভাঙতে দেরি হল।

    —ঘুমোই নি।

    —কোথাও যেতে চাও?

    —এই ভিড়ে—!

    —তাহলে নিরিবিলি খুঁজে বসি। তোমার মনে হয় বলার কথা জমে আছে।

    বলার খুব চেষ্টা করছে নলিনাক্ষ, পারছে না। সময় চলে যাচ্ছে। দিগন্তে সমস্ত মাধুর্য নিয়ে সন্ধ্যে নামবে। সুরেন্দ্র আর বেশিক্ষণ থাকবেন না। সুরেন্দ্র হাসেন,

    —কী! পারছ না বলতে?

    —কী?

    —এখানে এর আগে এসেছ কখনো? মনে পড়ে?

    —সেই ক্লাস ফোর না ফাইভে পড়তাম — তুমি—মা আর আমরা দুভাই। তারপরে আর না।

    —তাই নাকি?

    —হ্যাঁ।

    —মনে আছে?

    —আমরা তখন ফুলবাগানে থাকি। আগের রাত্রে হোল্ডল-এ জিনিস প্যাক করা – দারুণ অভিজ্ঞতা! আমি লাফাচ্ছিলাম তার ওপরে। দাদা বোধহয় সবে কলেজে ঢুকেছে।

    —হ্যাঁ। ভোলোনি দেখছি।

    —তোমার ব্যাঙ্কের হলিডে হোমে ছিলাম। মা রান্না করত। টানা অনেকদিন ছিলাম।

    —দিনদশেক। তখন ওরকমই বেড়াতে আসত সকলে।

    —চমৎকার সময়— ভোরবেলা সূর্যওঠা দেখার জন্যে তুলে আনতে আমাদের—! সারাদিন বালিতে হুটোপাটি।

    শৈশবে ঢুকে পড়েছে নলিনাক্ষ, অসংখ্য বিশেষত্বহীন মধুর স্মৃতি। অজ্ঞাতে মিলিয়ে যায় অস্বস্তি। সুরেন্দ্রর চোখে আশ্চর্য প্রশান্তি। বলেন,

    —এবারে আমি যাই নলিন।

    —বাবা!

    —বলো?

    —তুমি সন্ন্যাস নিয়েছ?

    শান্তচোখে তাকিয়ে থাকেন সুরেন্দ্র। সময় নেন, নিঃশ্বাস ফেলেন,

    —না নলিন। তাহলে তোমার এত কাছে আসতাম না, আলাপ করতাম না। পূর্বাশ্রম মনে করার অধিকার নেই সন্ন্যাসীদের।

    —তাহলে? কেন এসেছি জানো?

    —জানি। আমাকে খুঁজতে।

    —বরাবর তুমি এখানেই আছ?

    —নাঃ। চরৈবেতি— চরৈবেতি—।

    —কিন্তু সব ছেড়ে — কেন বাবা?

    —সঠিক কোনো কারণে আসি নি। তোমার মায়ের কাছে জানিয়ে এসেছিলাম। তিনি জানেন।

    —বলেনি কাউকে কখনো। আমরা জানতে পারিনি।

    ফিরতি ট্রেনে ওঠার সময়ে সুরেন্দ্র আসেন নি। সকালে এসেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। ওপরের বার্থে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে আরামে শুয়ে নলিনাক্ষর মনে পড়ছিল বাবার মুখ। দু-যুগ হতে চলল বাবা ঘর ছেড়েছেন। খোঁজখবর করতে মা উৎসাহ দেখায় নি। নলিনাক্ষর প্রথম থেকে বাইরে-বাইরে পোস্টিং। দাদা-বৌদি থেকেছে মায়ের কাছে।

    সকালে সে প্রণাম করার পর বাবা বললেন,

    —পিতা-পুত্র বড়ো মায়াময় সম্পর্ক, যদিও তোমার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। যতটুকু পেরেছি রেখে এসেছি তোমার মায়ের জন্য, তোমাদের জন্যে। সেসব বৈষয়িক, সাংসারিক কথাবার্তা আলোচনায় আর প্রবৃত্তি হয় না। অন্তর থেকে আশীর্বাদ করি সুখী থাকো।

    প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ফেলে নলিনাক্ষ। পাশের বার্থের লোকটি ঘুরে তাকায়। কোনোদিন জানা হয়নি, কেন সুরেন্দ্র চলে গিয়েছেন। মা অত্যন্ত অন্তর্মুখী, অসম্ভব মিতভাষী। নলিনাক্ষ মায়ের স্বভাব পেয়েছে।

    বাবার সঙ্গে নলিনাক্ষর দূরত্ব বেড়েছিল কলেজ হস্টেলে চলে যাওয়ার পর থেকে। সুরেন্দ্রনাথের আকস্মিক গৃহত্যাগের সময়ে সে প্রবাসী, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। তার পক্ষে খোঁজখবর করা সম্ভব ছিল না। দিনের মতো দিন পেরিয়ে গেছে। কেন চলে গেলেন, বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়নি। ব্যস্ততা ধুলোর পরত হয়ে ঢেকে দিয়েছে স্মৃতি, বাবার কথা মনেও পড়েনি। নিয়মবিধি মানলে বারো বছর পরে মায়ের বৈধব্য নেওয়ার কথা। অরুণা ওসব মানেন নি। সংক্ষেপে বলেছিলেন,

    —উনি জীবিত আছেন।

    সুরেন্দ্র চলে যাওয়ার পরে বছরে ঠিক একবার ‘অরুণাদেবী’র নামে একটি করে ছাপা চিঠি আসত। নির্দিষ্ট ডোনেশন প্রার্থনা করে যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি চিঠি পাঠাত, অনুমান করা যায় তার অন্যতম কর্ণধার সুরেন্দ্র। কিন্তু সেখানে কারো নাম, হাতে-লেখা দস্তখৎ ইত্যাদি থাকে না। প্রায় বছরখানেক আগে শেষ যে চিঠি এসেছে, সেখানে সেন্ডার্স এ্যাড্রেস-এ পুরীধাম লেখা ছিল। এর আগে, গয়া, বেনারস, কঙ্খল, সিমলা—নানাপ্রান্ত থেকে আসা চিঠি জমাতেন অরুণা। এব্যাপারে কোনোদিন আলোচনা করতেন না। মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে নলিনাক্ষ ফোনে বউদিকে বলেছিল,

    —বাবাকে খবর—দিয়েছ?

    —কোথায় দেব? জানিই না। আন্দাজে পুরীর ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছে তোমার দাদা।


    (নটে গাছটি মুড়লো।)

    দেড়মাস কাটিয়ে আগামীকাল নলিনাক্ষর ফিরে যাওয়া। অনেক সাবধানতা মেনে সীমিত সংখ্যায় ডোমেস্টিক ফ্লাইট চালু হয়েছে। টান হয়ে শুয়ে অলস চোখে সে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। এ-সি বন্ধ করে দিলেও ঠান্ডাভাব ঘরময়। বাইরে থেকে আসা হালকা উষ্ণতা ক্রমশঃ দখল নিচ্ছে। রিস্টওয়াচে ন’টা কুড়ি। রোদের রঙ কটকটে, গত দুদিন বৃষ্টি হয়নি। জুলাই মাস শেষ হতে চলল। বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু তেমনভাবে বর্ষা আসেনি। দরজা ভেজানো দেখে বউদি হয়তো চা নিয়ে ফিরে গেছে। পাশের বাড়ির বারান্দার অংশ নজরে আসছে, কাপড় মেলছে কাজের মেয়ে। বউদি এখনো ঠিকে কাজের লোককে আসতে দিচ্ছে না। চারুদি’কে বাড়িতে রেখে দিয়েছি বলে সামলে নিতে পারছে। শুয়ে শুয়ে আবোলতাবোল ভাবে। বাবার দলিল অনুযায়ী বাড়ির দোতলা নলিনাক্ষর। এঘরে অরুণা এতবছর কাটিয়েছেন, নলিনাক্ষ এলে পাশে ছোটোঘরে থাকত। কতবার আর আসা হতো? বড়জোর বছরে তিন-চারবার, দিন সাতেকের জন্য। এতদিন একটানা থাকতে হবে কল্পনাতে ছিল না।

    সল্টলেকের এই জমি কোনকালে কিনেছিলেন বাবা। চারপাশ অন্যরকম তখন। মূল কলকাতা থেকে দূরে হওয়ার কারণে অসুবিধেও অনেক। তারপর ধীরেসুস্থে বাড়ি করেছেন। তাদের বাউন্ডারি ঘিরে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে গাছ আছে অল্পবিস্তর। টুইটুই করে পাখি ডাকছে একটানা। গাছপালার মিশ্র সতেজ গন্ধ আসছে। অসাড়, অনুত্তেজিত, চিন্তাহীন মন শান্ত। চোখ বুজে আসে আবার। কতক্ষণ শুয়েছিল টের পায়নি। দরজায় ব্যস্ত টকটক শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসে বিছানায়। জড়ানো গলায় ডাকে,

    —কে? এসো—।

    —আমি। ঘুম ভাঙেনি এখনো?

    বড়ো শাঁখের আওয়াজের মতো নিটোল সুরেলা স্বর, ব্যক্তিত্ব। দরজা ঠেলে দাঁড়ায় সুচরিতা, তার বউদি। নলিনাক্ষ চোখ ডলে উঠে বসে,

    —আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

    —তাই? আমি আটটা নাগাদ একবার চায়ের জন্য নক্‌ করে গেছি। ওঠো নি। সাড়ে এগারোটা বাজে, ভাবলাম ডাকি এবারে। ব্রেকফাস্ট পাঠাই?

    —হালকা কিছু দিও।

    সুচরিতা দরজা টেনে বেরিয়ে যায়। নলিনাক্ষ এ্যাটাচ-বাথে ঢোকে। ঘুমের মধ্যে ঘেমে উঠেছে শরীর। বর্ষা না নামা পর্যন্ত গরম বাড়বে।

    দুপুরে খাওয়ার পরে ঘরে ল্যাপটপ খুলে বসেছিল নলিনাক্ষ। মেইল-এ জরুরি মেটেরিয়াল এসেছে। পড়তে মন বসছে না। এখন কাজের চাপ কম। সারা দুনিয়া নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছে ভাইরাসের উপদ্রবে। লক-ডাউনেও ঠেকানো যায়নি সংক্রমণের বৃদ্ধি। মার মৃত্যুর সময়ে লকডাউন চলছিল। আনলক হওয়ার প্রথম সপ্তাহে সে কোনোরকমে ব্যবস্থা করে কলকাতায় চলে এসেছে। অরুণা বছরদুই প্রায় বিছানায় ছিলেন। অত্যধিক শুগার, শ্বাসকষ্ট এবং আরো নানা উপসর্গ। প্রকাশ করতেন না যদিও, সুরেন্দ্রর চলে যাওয়া মানতে পারেন নি। চাপা স্বভাবের মানুষেরা সাধারণত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। মা আছেন— এটুকু যথেষ্ট ছিল, আলাদা করে সঙ্গ বা সময় দেওয়া হয়নি। সুচরিতার সঙ্গে অন্তর্লীন সংঘাত বাইরে থেকে না বোঝা গেলেও নলিনাক্ষর চোখে ধরা পড়েছে। কারো পক্ষ নিতে পারেনি। দুএকবার অরুণাকে অনুচ্চ স্বগতোক্তি করতে শুনেছে,

    —বাড়িটা আমার। আমার মৃত্যুর পরে তোমাদের।

    মায়ের অনুপস্থিতি তেমন অনুভূত না হলেও একটু যেন ফাঁকা। বেখেয়ালে পড়ে-থাকা বাতিল, ধুলোভরা ছোটো জিনিসও জায়গা থেকে সরিয়ে নিলে দাগ থেকে যায়। অবসাদ কাটাতে উঠে পড়ে নলিনাক্ষ, ল্যাপটপ ভাঁজ করে। দরজা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে। বৃষ্টি আসার সাজসরঞ্জাম নিয়ে আকাশ তৈরি হচ্ছে। শব্দহীন বিদ্যুৎ চিরে গেল দুএকটা। ভারী পায়ের শব্দ, সুচরিতা। বলল,

    —ভাবলাম বৃষ্টি আসছে, তোমার কাপড়গুলো তুলে দিয়ে যাই। টবগুলোতে কালই জল দিয়ে গেছি— আজ আবার বৃষ্টির ছাঁট!

    —বোসো বউদি। দাদা কী করছে?

    —শুয়েছে। সন্ধ্যেবেলা আসবে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।

    —আচ্ছা।

    সুচরিতা চেয়ার টেনে সরিয়ে অনেক দূরে বসে। হেসে বলে,

    —সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং।

    —সত্যিই—দেড়মাস কীভাবে কেটে গেল!

    —তুমি নিজেই এভাবে রইলে, আমাদের যেন দোষ দিও না। চোদ্দদিনের কোয়ারেন্টাইন থাকার কথা ছিল, এতদিন নয়।

    —দোষ কেন দেব? তোমরা বিপদে না পড়ো, এই ভেবেছি।

    —দিতেই পারো। তোমার মা যে চলে গেলেন, হয়তো সে ব্যাপারেও— কী জানি!

    ভীষণ অবাক হয়ে গেছে নলিনাক্ষ। স্বর ফোটে না সহজে। কষ্ট করে বলে,

    —কী বলছ বউদি, বুঝতে পারছি না?

    —নলিন, দায়িত্ব যে নেয় সেই জানে দায়িত্বের ভার কত!

    —অবভিয়াসলি।

    —কুড়ি বছর বয়স থেকে ঘাড় পেতে সংসারের ভার বয়ে চলেছি, আর পারব না বোধহয়।

    —আমার কথা ভাবছ? আমার ভার নিতে হবে না—।

    —তুমি বিয়ে করছ না কেন?

    —র‍্যাডিকালি বদলে গেছ তুমি বউদি।

    —তাই, না? পঞ্চাশ বছর হল আমারও। তোমার চেয়ে এক বছরের বড়ো।

    —জানি।

    —মনে আছে, তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকেছ আর আমি কলেজ ছেড়ে এলাম তোমাদের বাড়িতে? ঘোমটা পরে? অনার্স পাওয়া হল না। আমার রিমা নামটা অবধি পালটে দিলেন তোমার বাবা। আমার মত জানতে চাইলেন না একবারও।

    স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে নলিনাক্ষ। স্যাঁতলা-ধরা পুরনো কথা টেনে বসেছে বউদি— মনোমালিন্যের, অবনিবনার কথা। সে ভারী আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে। এত ক্ষোভ জমা হয়ে আছে? চেহারাও অনেক বদলেছে। ডাঁটার মতো ছিপছিপে মেয়েটি ত্রিশবছরে ভারভরন্ত ফর্সা ধবধবে রাশভারী কর্ত্রী। সম্প্রতি দীক্ষাও নিয়েছে। জোরে বৃষ্টি নামল। বাতাসে জলের গুঁড়ো। নলিনাক্ষ বলে,

    —ভেতরে যাই, একটু কাজ আছে।

    —তোমার সময় নষ্ট করলাম নলিন। ভেতরে জমেছিল, পরিষ্কার করলাম। কিছু মনে কোরো না।

    —কষ্ট জমা রেখো না বউদি।

    —নাঃ, কষ্ট কীসের? ভাবলেই কষ্ট। তুমি দেড়মাস একটা ঘরে বন্দীজীবন কী কষ্টে কাটালে—! প্ল্যান করলে কিছু?

    নলিনাক্ষ নির্মল হাসে,

    —প্ল্যান কীসের? নাঃ। তবে—,

    —তবে কী?

    —ইচ্ছেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম, সাজালাম।

    —কী? মানে বুঝছি না?

    —মানে একটু কঠিন। নিজেও বুঝিনি সবটা। আসলে যত অকাজের অবাস্তব ভাবনা, যদি এমন ঘটে ইন্‌ ফিউচার—!

    —স্বপ্ন দেখলে?

    —স্বপ্ন না ঠিক— কল্পনা বলতে পার। আচ্ছা রাঙামাসিরা কেমন আছে?

    —ভালো আছেন। কান্নাকাটি করছিলেন তোমার মা-র খবর জেনে।এই পরিস্থিতিতে আসা তো সম্ভব নয়। আগে বছরে একবার হলেও আসতেন।

    —ঠিকই। আমিও যে শেষ কত বছর আগে ওদের দেখেছি, মনে পড়ে না।

    —সে-ই। যাক, কী স্বপ্ন দেখলে শুনি।

    —নাঃ শোনানোর মতো নয় গো কোনোটা। অসম্ভব, ইনকমপ্লিট কতগুলো ইচ্ছে, চাওয়া— যখন পৃথিবী নতুন করে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক হবে, ওদেরকে দেখতে ইচ্ছে করবে। যা হওয়ার নয়!

    —কাদের গো?

    —বললাম যে, জমে-থাকা কল্পনা। না বোঝানো যায়, না দেখানো যায়—!

    সুচরিতা উঠে গেলে অন্যমনস্কভাবে প্যান্টের পকেটে হাত দেয় নলিনাক্ষ, খুব ছোট্ট একটা সুতো উঠে আসে। দু-আঙুলে ডলে গুলি পাকিয়ে গ্রিলের বাইরে ছুঁড়ে দেয় সেটাকে। ঘুড়ির সুতোর মতো দীর্ঘ হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)