• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গল্প
    Share
  • ছুই-মুই چھوئی موئی : ইসমত চুঘতাই
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়


    প্রখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক সাদাত হাসান মাণ্টো একবার বলেছিলেন যে জীবনের সত্যগুলোর সঙ্গে ইসমত চুঘতাইয়ের নিজের যে বিরোধ, সেই বিরোধের নিরিখে তিনি সত্যকে পরখ করে দেখেন। দৃষ্টিভঙ্গির এই সততার কারণেই বোধহয় বিংশ শতাব্দীর এই খ্যাতনামা মহিলা গল্পকার-ঔপন্যাসিকের রচনার বিষয়বস্তু এমনকী রচনাশৈলী আপাত রুক্ষ – এমনই যে কখনও কখনও তা পাঠককে স্তম্ভিত করে দেয়। সমসাময়িক রক্ষণশীল সমাজকে তাঁর লেখনী কেমন নাড়া দিয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়।

    উত্তর প্রদেশে ১৯১৫ সালে জন্ম। পরিবারের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ছিল খোলামেলা – যৌনতা, গর্ভধারণের মত বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা সম্ভব ছিল। উদারমনা, প্রগতিবাদী পিতা চেয়েছিলেন তাঁর কন্যা যেন পুত্রদের মতই সমান সুযোগ পায়, স্বাধীনভাবে বড় হয়ে ওঠে। এইভাবে বেড়ে ওঠার ফলেই ইসমত হয়ে উঠেছিলেন স্পষ্টবাদী, কখনও বা অত্যন্ত জেদি ও সরব এক নারী।

    রাশিদ জাঁহা’র ‘আঙ্গারে’-র পরে ১৯৪২-এ প্রকাশিত ইসমত চুঘতাইয়ের ‘লিহাফ’ উর্দু সাহিত্য জগতে সাড়া ফেলে দেয়। নারীর যৌনতা এবং সমকামী সম্পর্কের এমন উন্মোচন ইতিপূর্বে শুধু উর্দু কেন, অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্যেও বিরল। মধ্যবিত্ত মুসলমান নারীদের জীবন নিয়ে ইসমত নাগাড়ে লিখে গেছেন।

    এবারের অনূদিত গল্পটি রক্ষণশীল সমাজের সেই ভণ্ডামিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যেখানে নারী এবং বধূ সন্তান প্রসব এবং বংশরক্ষার উপকরণ মাত্র। ‘ছুই-মুই’ অর্থাৎ লজ্জাবতী লতার মত অল্প আঘাতেই কাতর হয়ে পড়েন এই গল্পের ভাবিজান। তিনি যাতে পুত্র সন্তান প্রসব করে বংশে আলো দেখাতে পারেন, তার জন্য পরিবারের অন্য নারীদের কড়া নজর আছে তাঁর দিকে। সযত্নলালিত, গৃহবন্দী এই মহিলাটির ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটল? সন্তান প্রসব কি সত্যিই স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন? নারীর গর্ভ কি তাঁর জীবন, ব্যক্তিত্ব বা সত্তার থেকেও বড়?

    এই অনুবাদের জন্য আমি কুতব পাবলিশার্স লিমিটেড, মুম্বই কর্তৃক প্রকাশিত ‘ছুই মুই’ (১৯৫২) শীর্ষক গল্প সংগ্রহে মুদ্রিত গল্পটি ব্যবহার করেছি।

    —অনুবাদক

    হুইলচেয়ার রেল কামরার দরজায় গিয়ে ঠেকতেই ভাইজান কামরায় উঠে পড়লেন। ‘ইলাহি খের! হে গুলাম দস্তগির! বারো ইমামের কৃপা! বিসমিল্লাহ্‌, বিসমিল্লাহ্‌! বেটিজান, সামলে! ধীরে ধীরে পা ফেলো! শালওয়ারের পা’টা তুলে ধরো!’ বি মুঘলানি বার্তাবাহকের মত চেঁচায়। কিছুটা আমি ঠেলে দিই, ভাই সাহেব ওদিক থেকে টানেন। আর ভাবিজান যেন তাগা-তাবিজ আর মাদুলির বিজ্ঞাপন হয়ে কোনও মতে ছোট-ছোট পা ফেলে ভয়ানক ফোলা বেলুনের মত গড়াতে গড়াতে গিয়ে কামরার সিটের ওপর বসে পড়ে।

    ‘পরম করুণাময়ের কৃপা!’ বি মুঘলানি স্বস্তির হাঁফ ছাড়েন। আমাদের মন থেকেও একটা ভার নেমে যায়। একেবারে হাত-পা না নেড়ে বেঁচে থাকার অভ্যেস তো ভাবিজানের জন্মগত নয়। হাতে দাসী – পায়ে দাসী’র জীবনও তাঁর ছিল না। তা সত্ত্বেও, রোগা-পাতলা, সুন্দরী মধ্যবিত্ত মেয়েটি কয়েক বছরের মধ্যেই ফুলে ওঠা ফোঁড়ার মত নরম হয়ে গেল। আসলে, নিজের মায়ের বুক থেকে সরে এসেই সে সটান চলে এল ভাইজানের পালঙ্কের শোভা বর্ধন করতে। সেখানে সুগন্ধি ফুলের মত প্রস্ফুটিত হওয়া ছাড়া তার বিশেষ কোনও দায়দায়িত্ব না থাকায় জীবনের কোনও বোঝা তাকে বইতে হল না। শাদি’র দিন থেকেই বি মুঘলানিকে তার পালন-পোষণের সব দায়দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হল। সকাল-সকাল, মানে যে সময়ে ধনী মানুষদের সকাল হয় আর কী, মুখ ধোওয়ার পরে মশারির মধ্যে বসে বসেই চুল বেঁধে, চুলে চিরুনি গুঁজে, চিরাচরিত প্রথা মেনে ষোলো রকমের গয়না-প্রসাধনে সজ্জিত হয়ে, নানাবিধ সুখাদ্য থেকে বেছে নিয়ে চেটেপুটে খেয়ে তিনি প্রাতরাশ সেরে নিতেন। তারপর আমার ভাবি গালে হাত দিয়ে বসে থাকতেন। তার মুখে একটা হাসি লেগে থাকত।

    কিন্তু সেই হাসি শাদি’র দ্বিতীয় বছর পেরোতে না পেরোতেই যে ফিকে হয়ে এল। সে সময় ভাবি’র সব সময় গা বমি-বমি করত। তার পুতুলের মত সুন্দরী বিবি’কে সারাক্ষণ অসুস্থ দেখতে দেখতে ভাইজানও যেন বিবাহিত জীবনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। শুধু আম্মা বেগম আর বি মুঘলানি তখনও উৎসাহ-উত্তেজনায় ভরপুর। ভাবি’র গর্ভধারণের প্রথম মাস থেকেই তাঁরা এমন সোৎসাহে জামা সেলাই-ফোঁড়াই শুরু করলেন, যেন কালই সন্তান আসছে। তাগা-তাবিজে ভাবি’র গায়ে একটা তিল ধরার জায়গাও আর রইল না। নানারকম টোটকা টুটকি’র বোঝা তাকে ক্লান্ত করে তুলল। এমনিতেই ভাবিজানের দৌড়োনো অথবা লাফঝাঁপের কোনও শখ কোনও দিন ছিল না। আর এখন তো পাশ ফিরতে গেলেও বি মুঘলানি ‘আল্লাহ্‌-বিসমিল্লাহ্‌’-র নাম নিয়ে ঘর মাথায় তোলেন। ভাবিজানকে কাঁচা ঘটির মত সযত্নে রাখা হত। সকাল-সন্ধ্যায় পির আর ফকিরদের আনাগোনা। তাঁরা প্রার্থনা আওড়াতে আর ঝাড়ফুঁক করতে লেগে পড়েন।

    কিন্তু মুঘলানির কড়া পাহারা সত্ত্বেও কাঁচা ঘটি’টি সময়ের আগেই ফেটে চৌচির হয়ে সকলের প্রত্যাশায় জল ঢেলে দিল। ফুল ঝরে গেল, গাছের ডাল খালি রয়ে গেল। কিন্তু আল্লাহ্‌’র কৃপায় মায়ের প্রাণ বাঁচলে আল্লাহ্‌ লাখ সন্তান দেবেন। সংসারের ধন বলে কথা! আল্লাহ্ আবার দিলেন। এবারে পাহারা আগের থেকে চার গুণ কড়া হল। কিন্তু এবারেও হাত খালি! তিনবারের বার তো অবস্থা আরও সঙ্গিন হল। কিন্তু এবারও হাত খালি! নানাবিধ ওষুধ সেবনে ভাবিজান কাহিল হয়ে পড়ল। চেহারা হল রক্তশূন্য। দেখতে যেন ফোলা রাঙা আলুর মত। অগত্যা ভাইজানের সন্ধ্যে শুরু হয় রাত বারোটায়। আম্মা বেগম আর বি মুঘলানি মোটেই খুশি নন। মশারি’র মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে ভাবিজান যেন ভাইজানের দ্বিতীয় শাদি’র সানাইয়ের আওয়াজ শুনতে পান।

    আর আল্লাহ্‌-আল্লাহ্‌ করতে করতে যখন সেই দিন আবার এল, তখন এবার পির-ফকির ছাড়াও দিল্লির ডাক্তারেরাও তাঁদের সব উপকরণ নিয়ে হাজির হলেন। খোদার কৃপায় এবার গর্ভধারণের পরে বেশ কিছুদিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। দ্বিতীয় মাস থেকেই ভাবিজানকে সাবানের বুদ্বুদের মত তুলোর ফুলের ওপর রাখা শুরু হল। তার কাছে গিয়ে কারও হাঁচা অথবা নাক ঝাড়ার অনুমতি নেই। বুদ্বুদ আবার ফেটে না যায়!

    এবারে ডাক্তারবাবুরাও যখন বললেন যে বিপদ কেটে গেছে, তখন আম্মা বেগমও ভাবলেন যে প্রসব আলিগড়েই হওয়া উচিত। অল্পই তো দূর। ভাবিজান কিন্তু দিল্লি ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলেই ভয়ে কাঁপতেন। ডাক্তারেরা যতই ছাড়পত্র দিন, ভাবি’র চোখে যে আঁধার ঘনিয়ে আসে। এবারেও যদি কোল খালি থাকে, তা হলে ভাইজানকে আর কোনও ভাবেই ঘরে সতীন আনা থেকে নিরস্ত করা যাবে না। সে তো উত্তরাধিকারী আনার বাহানায় সব কিছু করতে পারে। কে জানে বেচারা নিজের নাম জিইয়ে রাখার জন্য এত উদ্‌গ্রীব কেন, যখন এই দুনিয়ায় তার তেমন কোনও নামই নেই। দাম্পত্য সহবাসের যে প্রধান দায়িত্ব, তাও যদি ভাবিজান পালন করতে না পারেন, তা হলে তাঁকে সুখের শয্যা ছাড়তে হবে। এই কয়েক বছর যৌবন আর সৌন্দর্যের ওপর নির্ভর করে তিনি দিল্লিতে থেকেছেন। কিন্তু এখন তো তক্তাপোশের পায়াগুলো নড়বড় করছে, আর তার স্বামী সেটাকে উল্টে দিতে চাইছে। কিন্তু তক্তাপোশ থেকে নামতে হলে বেচারি আর যাবে কোথায়? সেলাই-ফোঁড়াই শিখলেও তাতে তার কোনও আগ্রহ ছিল না। লেখাপড়া যা করেছিল, তাও ভুলে বসে আছে। এটা তো সত্যি যে দুনিয়ায় যদি তার ভরণপোষণের জন্য কেউ না থাকে, তা হলে সে একটাই কাজ করতে পারে। অর্থাৎ সে যেভাবে এতদিন শুধু ভাইজানের সেবা করে এসেছে, এখন সেই সেবা দুনিয়ার মানুষ পাবে। এই ভয়ে অন্তত এ’বার সে প্রাণপণে এমন হাতিয়ার প্রয়োগ করতে রাজি ছিল, যাতে তার খাওয়া-পরার ব্যবস্থাটা হয়ে যায়। বাপ যদি সন্তানকে না দেখে, দাদা-দাদি নিশ্চয়ই তার ভরণপোষণ করবেন।

    মাথায় যখন এই ভীষণ দুশ্চিন্তা, তখন আম্মা বেগমের রাজকীয় হুমকি এল, আর আমরা হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করতে করতে আলিগড় রওনা হলাম। একগুচ্ছ টোটকা আর তাগা-তাবিজে ভর করে ভাবিজানেরও সাহস বেড়ে গেল। ‘ইলাহি খের!’ ইঞ্জিনের ঝাঁকুনিতে বি মুঘলানি হঠাৎ দড়াম করে পড়ে গেলেন আর ভাবিজান শুয়ে শুয়েই নিজের পেটের ঘড়াটি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরল।

    ‘হায়...হায়...একী ট্রেন, নাকি নরকে যাওয়ার গাড়ি! হে পির-মুরশিদ, আমাদের বাঁচাও!’ ভাবিজানের ফুলে ওঠা পেট ধরে বি মুঘলানি বিড়বিড় করে দোওয়া করতে আর কালাম পড়তে থাকেন। এইভাবে খুদা-খুদা করতে করতে গাজিয়াবাদ তো পৌঁছোনো গেল।

    তুফান মেলের নামটাও বেশ যুতসই। প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলে, থামার আর নাম নেই। গোটা বগিটাই আমাদের জন্য রিজার্ভ করা ছিল। কোনও ভিড়ের ভয়ই ছিল না। আমি দরজার সামনে লোকের ভিড় দেখতে মশগুল। বি মুঘলানি ইঞ্জিনের সিটি বাজার ভয়ে কানে হাত দিয়ে বসে। দূর থেকে লোকের ভিড় দেখেই তো ভাবিজান প্রায় মূর্ছা যায়। সে কাঠের পাটাতনের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিল। রেলগাড়ি যেই চলতে শুরু করেছে, তখনই কামরা’র দরজা খুলে গেল, আর একটি অনূঢ়া তরুণী ঠেলে ভেতরে ঢুকে এল। কুলি তাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করলেও সে নির্লজ্জ সরীসৃপের মত চলতে থাকা গাড়ির পাদানিতে ঝুলে রইল। তারপর বি মুঘলানি’র ‘হাঁই...হাঁই’ এর পরোয়া না করে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল, আর স্নানঘরের দরজায় পিঠে ঠেস দিয়ে হাঁপাতে লাগল।

    ‘আল্লাহ্‌ আমাদের কসুর মাফ করুন,’ বি মুঘলানি’র অস্পষ্ট বিড়বিড় কানে এল। ‘এই তোর কি ব্যথা উঠেছে?’ হাঁপাতে হাঁপাতে বেদম হয়ে পড়া সেই মেয়েটি কোনও মতে তার শুকনো ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে চায়।

    ‘ইয়া আল্লাহ্‌, এই একরত্তি মেয়েটার সাহস দেখো! তোবা হ্যায় আল্লাহ্‌....তোবা’ এই বলে বি মুঘলানি বারে বারে নিজের গালে থাপ্পড় মারে।

    মেয়েটি কোনও উত্তর দেয় না। শুধু প্রচণ্ড ব্যথার তাড়নায় স্নানঘরের দরজার পাল্লাগুলো দু’হাতে আঁকড়ে ধরে। সে যেন আরও জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা মাটির ওপর যেমন শিশির বিন্দু ফুটে থাকে, তার কপালেও তেমনই বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে।

    ‘এই কি তোর প্রথম বিয়োনো?’ মেয়েটির সাদামাটা, গেঁয়োভাব যেন বি মুঘলানি’কে রুষ্ট করে। কিন্তু এবার ঢেউয়ের মত যন্ত্রণার একের পর এক ধাক্কায় কাহিল সে নারী আর উত্তর দিতে পারে না। তার মুখের সব শিরা-উপশিরা যেন দপ দপ করে। তার বিস্ফারিত চোখ দুটি থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল ঝরে পড়ে। বি মুঘলানি’র ‘হায়...হায়’ শুনতে শুনতেই সে যেন বেদনার আছড়ে পড়া ঢেউগুলোর সঙ্গে যুঝছে। এদিকে আমি ফুঁপিয়ে কাঁদছি, আর ভাবিজানের কান্নার সঙ্গে দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ছে।

    ‘এই ছুকরি মজায় বসে বসে কী দেখছিস? বেটি মুখ ঘুরিয়ে বোসো!’ এই শুনে আমি দ্রুত মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম। তবুও যখনই যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মেয়েটির মুখ থেকে আওয়াজ বেরোয়, তখনই আমার নিজের ঘাড়ের ওপর আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ঘাড় ঘুরে যায়। আর বি মুঘলানি’র গালিগালাজ শুরু হয়। ‘হুঁ, তোবা! যেন একটা বাচ্চাকে জন্মাতে দেখলে আমার কুমারীত্ব নষ্ট হবে!’ ভাবিজান মুখে দোপাট্টা চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। বি মুঘলানি নাক পর্যন্ত বোরখা নামিয়ে সারাক্ষণ থুতু ফেলে ফেলে রেলের ফরাস ভিজিয়ে চলেছে।

    হঠাৎ এমন মনে হল যেন গোটা পৃথিবীটা সংকীর্ণ হয়ে গুঁটিয়ে গেছে। প্রসারিত বিশ্ব নেমে এসে যেন সব কিছুকে ওলটপালট করে দিল। আমার রগগুলো যেন জ্বলন্ত লোহার রডের মত শক্ত হয়ে গেছে আর চোখের জল আপনিই অবিরত গড়িয়ে পড়ছে। খালি মনে হচ্ছিল যে এই মেয়েটা এবারে বোধহয় মরে যাবে। মোচড়-দেওয়া সে ব্যথা বোধহয় শেষমেশ বিশ্ব চরাচরকে থামিয়ে দেবে।

    অকস্মাৎ একতাল লাল মাংসপিণ্ড ভাবিজানের সেলিমশাহী জুতোজোড়ার ওপর ধপ করে পড়তেই বি মুঘলানি’র নাক থেকে বোরখাও খসে পড়ল। বিস্ময় আর আনন্দে আমি কেঁদে উঠলাম। ঝুঁকে পড়ে সেই ছোট্ট প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে রইলাম যে ততক্ষণে রেলের কামরার ভেতরে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিয়ে তুলকালাম কাণ্ড শুরু করেছে।

    বি মুঘলানি ঝুঁটি ধরে আমাকে এক কোণে ঠেলে দিল, আর সেই মেয়েটির ওপর একের পর এক তিরস্কারের ঢেউ যেন আছড়ে পড়তে শুরু করল। আমি সিটের কোণ থেকে অশ্রুসজল চোখে দেখলাম যে মেয়েটি মরেনি। বরং তার ফাটা-শুকনো ঠোঁটদুটিতে, যা সে এতক্ষণ চেপে ধরে ছিল, যেন হাসির আভাস ফুটে উঠল। সদ্যোজাত শিশুটির নাগাড়ে চিৎকারে অস্থির হয়ে মেয়েটি চোখ মেলে চাইল। নিচু হয়ে একরত্তি বাচ্চাকে বুকে তুলে নিল। তারপরে কিছুক্ষণ তার অনভিজ্ঞ হাতদুটি দিয়ে শিশুকে সাফসুতরো করার চেষ্টা চলল। দোপাট্টা থেকে এক ফালি কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে নাড়ি বেঁধে দিল। তার অসহায় চোখদুটি এদিক-ওদিক ঘুরছে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে খিলখিল করে হেসে উঠল: ‘কোই ছুরি-চাক্কু হ্যায়, বিবিজী?’

    বি মুঘলানি’র গালিগালাজ যেন আর থামে না। আমি নখ কাটার কাঁচিটি মেয়েটির দিকে এগিয়ে ধরতে ধরতে অনুভব করলাম যে ভাবিজানের হাত আমার আঁচলটি আঁকড়ে ধরেছে।

    মেয়েটির বয়স বোধহয় আমার মতই, বা হয়ত ছ’মাস-এক বছরের বড় হবে। যাকে সে কয়েক মুহূর্ত আগেই প্রসব করেছে সেই বাচ্চার নাড়িটি সে তার অনভিজ্ঞ হাত দুটি দিয়ে কাটছে। ওকে দেখে আমার সেই ভেড়া-ছাগলগুলোর কথা মনে পড়ল যারা দাই বা মহিলা ডাক্তারের সাহায্য ছাড়াই মাঠে চড়তে চড়তে গাছের তলায় প্রসবগৃহ তৈরি করে নেয় আর সদ্যোজাতকে চেটে চেটে পরিষ্কার করে দেয়।

    বড়রা কুমারী মেয়েদের প্রসবের দৃশ্য দেখতে মানা করেন। বলেন জেবউন্নিসা যখন তাঁর বোনকে বাচ্চা প্রসবকালীন দেখে ফেলেছিলেন, তখন তিনি এমন ভয় পেয়েছিলেন যে সারা জীবন অবিবাহিতই রয়ে গেলেন। হয়ত জেবউন্নিসা’র বোন আমার ভাবিজানের মতই ছিলেন। যদি তিনি এই মেয়েটির প্রসবের ঘটনা স্বচক্ষে দেখতেন, তা হলে হয়ত আমার মতই তাঁরও মনে হত যে লোকে অহেতুক ধোঁকা দেয়, আসলে বাচ্চার জন্ম দেওয়া ততটাই সহজ যতটা ভাবিজানের পক্ষে রেলগাড়িতে ওঠানামা।

    আর আমার তো ঘটনাটা তেমন ভয়ানক লজ্জার বলেও মনে হল না। এর থেকে অনেক বেশি নির্লজ্জ আলোচনা বি মুঘলানি আর আমার আম্মা বিভিন্ন মহিলাদের সম্পর্কে সব সময় করে থাকেন, যা আমার অপক্ব কানে প্রবেশ করে জ্বলন্ত অঙ্গারের মত ফোটে।

    কিছুক্ষণ তো মেয়েটি অগোছালোভাবে তার শিশুকে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করল। তার চোখের জল ততক্ষণে শুকিয়ে এসেছে। বরং সে মাঝে মাঝেই এমনভাবে হেসে উঠছে যেন মনে হয় যে তাকে কেউ কাতুকুতু দিচ্ছে। কিন্তু মুঘলানি’র ধমক খেয়ে সে সামলে নিল। বাচ্চাকে একটা ছেঁড়া কাপড়ে জড়িয়ে আরেকটা সিটের তলায় চালান করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভাবিজান সেই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠলেন।

    এই সময় বি মুঘলানি ভাবিজানের গায়ে হাত বুলিয়ে, সুড়সুড়ি কেটে দিয়ে তাঁকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মেয়েটি বাথরুম থেকে জল এনে কামরা পরিষ্কার করার কাজে লেগে গেল। ভাবিজানের জরির কাজ করা সেলিমশাহী জুতোজোড়া সাফসুতরো করে এক কোণে দাঁড় করিয়ে রাখল। তারপরে ছেঁড়া ন্যাকড়া আর জলের সাহায্যে কামরায় তার সন্তান প্রসব করার সব চিহ্ন মুছে দিল। এই সময় আমরা তিন পবিত্র নারী সিটের ওপর আহাম্মকের মত বসে বসে তার ক্রিয়াকলাপ দেখছিলাম। শেষে মেয়েটি নিজের বাচ্চাকে বুকে নিয়ে বাথরুমের দরজায় এমন ভাবে ঠেস দিয়ে বসল যেন সারাদিনের কাজকর্ম শেষ করে সে আরাম করতে বসেছে। তারপরে ছোলা চিবোতে চিবোতে সে ঝিমোতে শুরু করল।

    ট্রেন হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থামায় তার তন্দ্রা কেটে গেল। গাড়ি থামতে থামতে সে কামরার দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে গেল। টিকিট চেকার তাকে ‘তোর টিকিট কোথায়?’ জিগ্যেস করতে সেই মেয়ে পাগলের মত হাসত হাসতে তার ঝোলাটি এমনভাবে মেলে ধরল যেন তার ঝোলার মধ্যে আছে চুরি করা একগুচ্ছ বুনো ফল। টিকিট চেকার তাজ্জব বনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন আর সে লেড়কি হাসতে হাসতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বারবার পিছনে তাকাতে তাকাতে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    ‘এই খান্‌কিগুলোর ওপর যেন খোদার অভিশাপ নেমে আসে। এই হারামিগুলো যত বেজম্মার জন্ম দিয়ে চলেছে।‘ বি মুঘলানি বিড়বিড় করতে থাকেন। আবার একটা ঝাঁকুনি দিয়ে রেলগাড়ি চলতে শুরু করে।

    ভাবিজানের চাপা কান্না হঠাৎ বুকফাটা চিৎকারে পর্যবসিত হল। ‘হায়...হায়...কী হল বেগম দুলহন?’ ভাবিজানের ভয়ার্ত চাউনি দেখে বি মুঘলানির বুকের ভেতরটা ধক্ করে ওঠে। ভাবিজানের চোখের ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে ততক্ষণে যেন প্রতিফলিত হচ্ছে ভাইজানের দ্বিতীয় শাদি’র তাসার বাদ্যির দৃশ্য।

    নিয়তির নৈপুণ্য দেখুন, মই সেখানেই ভাঙল,

    যেখানে ছাদ আর দু-চার হাতই দূরে।

    দুনিয়ায় সে নবজাতকের দ্বিধান্বিত পায়ের চিহ্ন পড়ল না, জন্মের আগেই সে মুখ ভার করে বিদায় নিল। আমার পলকা, সুশ্রী রানি রেল কামরায় সেই অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক প্রসব দৃশ্য স্বচক্ষে অবলোকন করে এতই ঘাবড়ে গেলেন, যে তাঁর আবার গর্ভপাত হয়ে গেল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার এবং ইসমত চুঘতাই-এর ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments