কি বিস্ময়কর অধ্যবসায়। মাকড়সাটার পা কেটে ফেলো, একটা খামের ভেতর পুরে দাও আর খামের ওপর লিখে দাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ও ঠিকানা। দৌড়ে নিচে গিয়ে কোনার ডাকবাক্সে চিঠিটা ফেলে এসো।
কি অসাধারণ প্রচেষ্টা। রাস্তার দুপাশের গাছগুলো গুনতে গুনতে হেঁটে যাও, প্রতি পাঁচটি গাছ পেরোনোর পর মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়াও, আর এক পায়ে দাঁড়িয়ে কারোর জন্য অপেক্ষা কর, তারপর জোরে একটা চিৎকার করে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে একপায়ে ভর করে লাটিমের মতো ঘুরে যাও, ঠিক দূরে গাছের ডালে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট পাখিটার মতো।
কি ভয়ংকর সাধনা। একটা কাফেতে গিয়ে সুগার কিউব চেয়ে নাও। আবারও চাও। আরো তিন চার বার চাইতে থাকো। এভাবে চেয়ে নিতে নিতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে চিনির একটা মণ্ড বানাতে থাকো। মণ্ডটা থাকুক টেবিলের ঠিক মাঝখানে। কাউন্টারের ওপাশে সাদা অ্যাপ্রনের পেছনে বিরক্তি জমা হয়ে ফুলতে থাকুক, আর তারপর আস্তে করে মণ্ডটার ঠিক ওপরে মধ্যিখানে একদলা থুতু ফেলো আর দেখতে থাকো কিভাবে হিমনদীর মতো লালার স্রোত চিনির মণ্ড বেয়ে নিচে নেমে আসছে, তার সঙ্গে যেন শুনতে পাচ্ছো ভেঙ্গে পড়া চিনির শিলাচূর্ণের গর্জন।
কি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বাস ধরো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে নেমে পড়ো। সিলমোহর করা রাশভারী খামটা হাতে ধরে চলে যাও ভেতরে, বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ না করে। গম্ভীরভাবে সেক্রেটারির টেবিলকে পেছনে ফেলে আয়নামোড়া বড় অফিসটার ভেতরে ঢুকে পড়ো ঠিক সেই মুহূর্তে যখন নীল রঙের উর্দিপরা দারোয়ানটি মন্ত্রীর হাতে একটা চিঠি তুলে দিচ্ছে। দেখো, মন্ত্রীমশাই কিভাবে একটি প্রাগৈতিহাসিক ছুরি দিয়ে খামটি খুলছেন, আস্তে করে দুই আঙুলের মাঝখানে ধরে বের করে আনছেন মাকড়সার পা, আর তাকিয়ে আছেন কেমন করে। তারপর মাছির ডানার শব্দের মত গতিতে নিমেষে মন্ত্রীর মুখ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, মাকড়সার পা-টা ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারছেন না, যেন সেই পায়ের ফাঁদে পড়ে গেছেন। তখন তুমি পেছন ফিরে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে পড়ো, বারান্দার করিডর দিয়ে যেতে যেতে ঘোষণা করে দাও যে মন্ত্রীমশাই পদত্যাগ করছেন, আর তখন তুমি বুঝতে পেরে যাও যে পরের দিন শত্রুপক্ষ শহরে প্রবেশ করতে চলেছে এবং তারপর হবে নরক গুলজার আর দিনটি হবে একটি লিপ্ ইয়ারের এক বেজোড় মাসের বৃহস্পতিবার।
জেনারেল-এর সৈন্যবাহিনী ভেঙ্গে যায়।
সূর্য ওঠে।
এবারে ভদ্রলোক মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করেন। বুঝতে পারেন যা ঘটেছে, তা আসলে এক বন্ধুসুলভ সাবধানবাণী। সঙ্গে সঙ্গে চশমার দোকানে গিয়ে একটা চামড়ার তৈরি চশমার বাক্স কিনে ফেলেন। তুলোর প্যাডে মোড়া দ্বিগুণ সুরক্ষার সেই চশমার খাপ। মনে ভাবেন, প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধ ভালো... ইত্যাদি ইত্যাদি। এক ঘন্টা পরে হাত থেকে চশমার খাপ পড়ে যায়। এবারে নিচু হয়ে তুলতে গিয়ে তেমন কোনও উদ্বেগ বোধ করেন না। কিন্তু আবিষ্কার করে আশ্চর্য হন যে চশমা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ভদ্রলোকের বুঝতে একটু সময় লেগে যায় যে, ঈশ্বরের অভিপ্রায় নিতান্তই রহস্যময়। এবং বাস্তবে অলৌকিক ঘটনাটি ঠিক এইমাত্রই ঘটে গেল।
অনুবাদকের কথা —১৯১৪ সালে জন্ম হুলিও কোর্তাসার-এর। মস্তিষ্কে মায়াজাল বিস্তার করে অলৌকিক রহস্যের বেড়াজালে পাঠককে নিয়ে নিত্য ডুবসাঁতার খেলতে ভালোবাসতেন হুলিও কোর্তাসার। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, কার্লোস ফুয়েন্তেস এবং মারিও ভার্গাস ল্যোসার মতো কোর্তাসারও ছিলেন ল্যাটিন আমেরিকার বুম-সাহিত্যের এক অনন্য চমক। মানুষের অদ্ভুত মন, মস্তিষ্কে উৎসারিত বিভিন্ন জটিল আর অভিনব খেয়াল, অধিবাস্তবতা – সবকিছুই তাঁর গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয়। সে-কারণেই কোর্তাসারকে তাঁর সমসাময়িক হোর্হে লুইস বোর্হেস, কার্লোস ফুয়েন্তেস, কিংবা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গেই তুলনা করা হয়। বলা হয়, তিনি কাদা ও জলকে মিশিয়েছেন বাস্তবতা এবং কল্পনাকে ধারণ করে। সেইসঙ্গে ফরাসি দর্শন, মায়াবাস্তবতাকে আঁকড়ে ধরে বোর্হেসের মতো তিনিও ছিলেন একজন মানবতাবাদী চিন্তায় মগ্ন মানুষ। আর সে-কারণেই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের দিক থেকে কোর্তাসার ছিলেন আজীবন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধ-শ্রেণির লোক। একই কারণে তিনি জোরগলায় সমর্থন জানিয়েছেন কিউবার বিপ্লবকে, আলেন্দের চিলি অথবা মানবতাবাদীদের পক্ষ হয়ে নিকারাগুয়ার বিপ্লবকে।