• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গল্প
    Share
  • একজন আমি, আমার স্বপ্ন, আমি : তাহমিদ হোসেন


    ।।১।।

    মার শৈশব-কৈশোর আর তার পরবর্তী সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য গতিতে। ছোটবেলায় পা ছিলো ছোট, কিন্তু বেগ ছিলো বেশি, এখন পা লম্বা হতে হাঁটার বেগ গেছে কমে। এখন আমি পারলে সবসময়ই বসে থাকি। আর প্রতিরাতে কিছু মুভিতে দেখানো আকাশের ফাস্ট-ফরোয়ার্ড ভিডিওর মত চাঁদ অস্ত যেতে আর সূর্য উঠতে দেখি। চাঁদ আর সূর্যকে মনে হয় ছোট্ট ছোট্ট রঙিন বিলিয়ার্ড বল। কেউ বুঝি টোকা দেয়, আর বল আকাশের বোর্ডে একদিক থেকে এসে অন্যদিকে চলে যায়। বলের গতিপথ শুধু সময়ের সাথে সাথে পালটায়, কিন্তু বল পালটায় না, বোর্ডও পালটায় না। ঘটনাটাও আদতে একই থাকে।

    আমাদের পুরানো ঢাকায় ছোট্ট গলিটাও এমন। এই বাসার সামনের কাঠের দোকানে কাজ করে রফিক মিয়া আর তার চার ছেলে। চার ছেলেদের নাম কামাল, জামাল, সালাম আর মনির। প্রায় দিনই বাসার নীচে তাদের কারও কারও সাথে আমার দেখা হয়। সালাম কিংবা মনির কিংবা কামাল কিংবা জামাল আমাকে দেখে হাসি দেয়, কখনো বলে, “স্লামালেকুম ভাইজান, ভালা আছেন নি?”

    আর সেই স্বভাবতই সেইদিন সকালে অফিসের জন্য বের হওয়ার সময় আমাকে জামাল বললো,

    “স্লামালিকুম ভাইজান, ভালা আছেন নি?”

    আমিও স্বভাবত হেসে উত্তর দেই, “ওয়ালাইকুম সালাম, জামাল। ভালোই আছি, দিনকাল ভালো চলে তো?”

    জামালের কপালে ভ্রুকুটির ভাঁজ পড়ে।

    “ভাইজান আমি তো রফিক। জামাইল্যা তো আমার মাইজ্যা পোলা।”

    আমি একটু অবাক হই। তখন লজ্জায় আমার নাক আর গাল মনে হয় গরম সিঙ্গাড়া। আমি একটু হাসি দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি, “আমি তো একটু দৌড়ের উপর আছি, তাই আউলে গেছি। সরি রফিক ভাই।”

    রফিক, জামাল, কামাল, সালাম কিংবা মনির, আমার হঠাৎ মনে হয় আমি তাদের কাউকে আলাদাভাবে চিনি না। যে এখন দোকানের মধ্যে বসে কাঠ কাটা দেখিয়ে দিচ্ছে সে কে? মনির? সে কি জামাল হলে এর থেকে অন্য কিছু হত?

    অফিস যাবার সময় রিক্সায় আমি সবসময় এদিক-ওদিক তাকাই, বাসার গলির সামনে ওইদিন একটা অপরিচিত রেইনট্রি গাছ আমার দিকে তাকায়। আমি অবাক হয়ে মনে মনে প্রশ্ন করি কবে এই গাছটা এখানে কবে আসলো? গাছটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় সেও হয়ত ভাবছে আমি ওখানে কেন। আমার গলা শুকিয়ে আসে।

    কোনো অপরিচিত জায়গায় এলে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার বাবার অফিস। অনেকদিন আগে ছোটবেলায় একবার আমি আব্বুর অফিসে গিয়েছিলাম। সেই অফিসের কাউকে দেখতে হলে আমার সবসময় ঘাড় উঁচু করে থাকতে হত। অফিসের সামনের দিকের টেবিলে বসা কেরানি আমার দিকে তাকাতো তার বড় বড় গোল গোল চোখ মেলে। তার গোঁফে ঢাকা হাসি দেখে আমি একটু কাঁচুমাচু করি। চারদিকে দেখি একের পর এক বিশাল বিশাল টেবিল যার উপর রাখা তাড়াতাড়া কাগজ। জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া একটা শিশুর মত এডভেঞ্চারের নেশায় আমি হঠাৎ ছুট দেই। আর তখনি আমার পিছনে রক্তচোষা বাদুড়ের মত উড়তে থাকে একগাদা কাগজ। গাছের গুঁড়িতে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যাই আর সবগুলো বাদুড় আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে… জ্ঞান ফিরলে দেখি আমার বাবা কিংবা অফিসের কোনো অফিসার কিংবা দারোয়ান, ঐ অফিসের কোনো একজনের চোখ থেকে আগুনের মত তীব্র ভর্ৎসনা্র লাভা এসে আমাকে পুড়িয়ে যায়। সে কে ছিলো আমি জানি না এখনো, শুধু চোখটা জানি।

    সেই চোখের উত্তপ্ত লাভা আমার মুখের সবটুকু লালা, জলকে শুকিয়ে দেয় মুহূর্তে। আমি ভাবি পাশের দোকানটায় ঢুকে একটা পানির বোতল নিবো। দোকানটা অফিসের বেশ কাছেই। তাই রিক্সাভাড়া দিয়ে ছেড়ে দিতে আমি পকেট থেকে বের করি একটা পাঁচশত টাকার নোট।

    “মামা ভাংতি নাই, একটু ভাইংগাইয়া দ্যান।” রিক্সাওয়ালা মামা তার ফোকলা পান খেয়ে লাল হয়ে যাওয়া দাঁতে একটু হেসে বলে।

    দোকানে ঢুকতেই দোকানদার ছেলেটা বলে, “ভাই, বসেন, চা খান।”

    “আমার একটু ভাংতি লাগত।“

    “বসেন, দিতাছি।”

    কি ভেবে যেন আমি বসে যাই এক কাপ চায়ের জন্য। আর সাথে সাথে আমার সামনে আসে গরম গরম চা।

    “ঘন করে দুধ দিয়া দিছি ভাই। আপনে যেমন খান।” ছেলেটা বলে।

    এদিকে চা খেতে বসে আমি আবিষ্কার করি কিছুটা লম্বা চুলের একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে ঠিক নামে চিনি না, তবে ছেলেটার সাথে চায়ের টং-এ প্রায়ই দেখা হয়। সম্ভবত ভার্সিটির হলে থাকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ভাই, কেমন আছেন?”

    “এইতো ভালো, তোমরা?”

    “আছি ভাই, ভালোই। একটা ম্যাজিক দেখবেন?”

    এই বলে ছেলেটা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে পকেট থেকে প্লাস্টিকের একটা বল বের করে আমার হাতে দিল।

    “একদম নরমাল না?”

    আমি মাথা নাড়ি। ছেলেটা দোকান থেকে একটা পানির বোতল নেয়। মুখ খুলে বোতলের মধ্যে সে একটা বল ছেড়ে দেয় আর অদ্ভুতভাবে বলটা পানির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পাক দিতে দিতে উপরে উঠে আর নিচে নামে। বেশ আকর্ষণীয় ম্যাজিক। চা শেষ হয়ে গেছে। ওঠার সময় ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

    “ভাইয়া তোমার নামটা ঠিক মনে নাই।”

    “আসিফ।” সে নাম বলে আরও কিছু বলার জন্য কেমন উশখুশ করে কিন্তু বলে না। যেই আমি দোকানদারকে টাকা দিয়ে বের হতে যাবো সে বলে ওঠে,

    “ভাই, এই জাদুটার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নাই।”

    দোকান থেকে বের হবার সময় আমি একটা হাফ লিটারের পানির বোতল চাই দোকানদারের কাছে। সে আমাকে একটা অদ্ভুত প্রায় চারকোনা একটা বোতল দেয়। আমার মনে পড়ে যায় ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটির প্রডাক্ট ডিজাইন ক্লাসে স্যারের লেকচার,

    “আমাদের ব্যবহৃত বোতলের শেইপ যদি চারকোনা হত, তাহলে আমরা সবচেয়ে বেশি বোতল সবচেয়ে কম জায়গায় রেখে পরিবহন করতে পারতাম। কিন্তু মানুষের হাতে ধরার জন্য একটু গোলাকার বোতল সুবিধাজনক। তার সাথে যুক্ত হয় এস্থেটিক্সঃ ডিজাইনে শৈল্পিক ছোঁয়া…”

    শৈল্পিক...শিল্প...শিল্পের কথা থেকে আমার মনে পড়ে শিল্পকলা ইন্সটিউটের কথা। মনে মনে হাসি পায় ভার্সিটির দিনগুলোয় শিল্পকলার এক্সিবিশনগুলো নিয়ে হাইপের কথা ভেবে। আমরা অনেকেই ছিলাম যাদের পেন্টিং, ফটোগ্রাফিতে ঝোঁক ছিলো। কিন্তু ঝোঁকের চেয়েও অনেকের জন্য বড় ব্যাপার ছিল সবার মধ্যে নিজের উন্নত বুর্জোয়া রুচিবোধ দেখানো। প্রফাইলে এক্সিবিশনে তোলা ছবি না থাকলে চা-সিগারেটের আড্ডায় ইজ্জত থাকবে না! আর এসব ভাবতে ভাবতেই আমার মনে পড়ে হুট করে একদিন, বিপাশা অথবা সিন্ধু, আমার তখনকার প্রেমিকা যার নাম আমি নিশ্চিত না, হাত ধরে ঘাসের মাঠে শুয়ে থাকার সময় বললো সন্ধ্যায় তার সাথে শিল্পকলায় যেতে। শিল্পকলায় তখন একটা আর্ট এক্সিবিশন চলে। সন্ধ্যায় এক্সিবিশনে গেলাম। সেখানে একটা আর্ট গ্যালারি ঘুরতে ঘুরতে আমি করিডোরে তাকিয়ে দেখতে পাই তিনজন কুলি বিশাল একটা গ্রীক ক্লাসিক ভাস্কর্য টেনে আনছে লিফট থেকে। এমন সময় তাদের একজনের পা হঠাৎ টাইলসে পিছলে গেল, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তারা তিনজনই পড়ে গেল তখন ভাস্কর্যের নীচে! পরে শুনেছিলাম একজন কুলির নাকি পুরো অণ্ডকোষ থেঁতলে গেছে সেই ভাস্কর্যের ভারে।

    অফিসে পৌঁছাই। আমার ডেস্কের সামনে একতাড়া কাগজ। কাগজে আঁকিবুকির মত সংখ্যা লেখা। পপুলেশন কাউন্সিলের রিপোর্ট। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে আমার অধঃস্তন কোনো এক কেরানি বসে বসে এগুলো লিখেছে সারারাত। লোডশেডিং-এর মধ্যে তার নববিবাহিতা তরুণী স্ত্রী তার জন্য মোমবাতি নিয়ে আসে। সেই মোমের আলোতে মেয়েটিকে অপার্থিব লাগে… সে যাই হোক, সংখ্যা নিয়েই আমার কাজকারবার সেই ছোটবেলা থেকে। সংখ্যা একটা সময় ছিলো আমার সবচেয়ে প্রিয়। সংখ্যা মিথ্যা বলে না, সংখ্যায় আবেগ কম, মুখে যা অন্তরে তা। কিন্তু আজ অফিসের ফাইল খুলতে আমার হঠাৎ কেমন অস্বস্তি লাগে।

    তখন আমার মনে পড়ে এর আগে একবারই আমার জীবনে এমন ধরনের অস্বস্তিবোধ হয়েছিলো। অনেকদিন আগে আমি তখনো গ্রাজুয়েট করি নি, আমাদের বাসায় একটা কালো বিড়াল আসত। আমি তখন রাত জাগতাম, বিড়ালটা রাতে এলে তাকে খেতে দিতাম। গ্রাজুয়েট করার পরপরই চাকরিতে ঢুকি। দিনের বেলায় অফিস করতে হবে দেখে রাতে আগেভাগে শুয়ে পড়তাম। বিড়ালটার সাথে দেখা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর একদিন রাতে হুট করে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি উঠে দেখি ঘড়িতে তিনটা বাজে। কি মনে করে যেন একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বারান্দায় এসে হঠাৎ দেখি অন্ধকারে দুটো সবুজ চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিড়ালটাকে চিনতে পারি দেখে চমকে উঠিনি। কিন্তু সেই পরিচিত বিড়ালটার উপস্থিতিতেও আমার হঠাৎ খুব অস্বস্তি লাগতে লাগলো। বিড়ালটা যতক্ষণ ছিলো ততক্ষণে আমার জামা ভিজে গেল ঘামে, পা কাঁপতে থাকলো। আমাদের সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয়নি।

    এদিকে আমার সামনে পড়ে থাকে কাগজপত্র। এদিন অফিস করতে আর ইচ্ছা হয় না। আমি লাঞ্চের সময় অফিস থেকে কাউকে না বলে হুট করে বের হয়ে যাই। কোনো একটা ফ্যামিলি ইমার্জেন্সির অজুহাত দিয়ে দেয়া যাবে কাল। এর চেয়ে আমি হাঁটবো নাখালপাড়ার রাস্তায়। এইখানে একটা বাসায় আমাদের একটা এপার্টমেন্ট ছিলো। মাহিয়া আর আমাদের দুজনের এক রুমের ঘর। সেই ঘরের কোনায় একটা র্যাক ছিলো। র্যাকটা আমরা বিছানার পাশে রেখেছিলাম যাতে চাইলেই হাতের নাগালে র্যাক থেকে জিনিস নিতে পারি। ছোট এপার্টমেন্ট, সাজানোর জায়গা ছিলো না। সত্যি বলতে সাজানোর মত কিছু ছিলোও না আমাদের। তখন আমি মাঝেমধ্যে হুট করে নিয়ে আসতাম একটা ক্যাকটাস, মাহিয়া একটা ছোট ফুলদানি। ইচ্ছামতো সাজানো।

    “এই দেয়ালে একটা পোস্টার লাগাবো। মার্ক্সের।” আমি বলি।

    “একটু ডানদিকে লাগাও। আরেকটা পোস্টার লাগাবো।” মাহিয়া বলতো।

    “কিসের?”

    “এডসনের কবিতার লাইন।”

    আমাদের দেয়ালে পোস্টার ঝুলতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে জড়িয়ে থাকা আমাদের মনে হত যে দুজনের চামড়া একসাথে জোড়া লেগে গেছে, তখন আমরা পোস্টারের শব্দগুলো দেখতাম। অনেক আগে মৃত মানুষেরা সেই শব্দগুলো দিয়ে আমাদের সাথে আলাপ করতো।

    এখন আমার থাকা হয় মোটামুটি ভালো তিন বেডরুমের বিশাল এপার্টমেন্ট-এ। পুরানো ঢাকার আর দশটা বাসার মতই তিনদিকে আটকা ঘিঞ্জি যদিও। তবে বাসার সব লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনে দেখা ইন্টেরিয়র ডিজাইনের আদলে সাজানো, দামি আসবাব, আড়ং-এর শোপিস। সম্ভবত আমার স্ত্রীর পছন্দে সাজানো। হ্যাঁ, এটাই ওয়াইজ গেস। যাইহোক নাখালপাড়ায় আমার পুরানো বাসার সামনে এসে দেখি সেই বাসা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, ডেভেলপাররা নতুন করে বানাবে। আমি অবাক হই না। জানি, প্রায় কয়েক মাস আগে থেকেই এই বাসা ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। আমি কনস্ট্রাকশন সাইট থেকে উদ্দ্যেশ্যহীন হাঁটতে থাকি। সন্ধ্যা হয়ে যায়।

    সন্ধ্যাবেলায় ঘুরে ফিরে সময় পার হয়ে যায়। রাতে বাসার গেটে এসে সেদিন দেখি আবার আরেক বিপত্তি। এগারোটায় বাসার গেট বন্ধ। আমার বাসার গেট আমাকে বাইরে রেখে এগারোটায় বন্ধ হবে কেন! ভাবলাম ভুল করে অন্য বাসায় এসে পড়েছি। কিন্তু সারারাত অনেক খুঁজেও আমি আমার বাসা পেলাম না। এখানে উল্লেখ্য যে এগারোটার মধ্যে গলির চারটা বাসা, বারোটার মধ্যে একুশটা আর একটার মধ্যে ত্রিশটা বন্ধ হয়ে যায়। যে দুটো বাসা রাত দুইটায় আমি খোলা পেয়েছিলাম তার মধ্যে একটা আমার বাসা ভেবে ঢুকতে যেতেই গেট থেকেই প্রচণ্ড তারস্বরে চেঁচিয়ে একটা কুকুর তাড়া দিলো। আর পরেরটার বেলায় কুকুরের ভয়ে আমি আর ঢুকতে যাই নি। আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছি।

    সকালে বাসার নীচে কাঠের দোকান খুলতে দেখে আমি বাসা চিনতে পারি। রাতে প্রথমে যে বাসাটায় এসেছিলাম, সেটাই আপাতত আমার বাসা। আমাকে দেখে কামাল এসে কথা বলে,

    “স্লামালিকুম ভাইজান, এত সকালে কই থেকে আইতাছেন?”

    “ওয়ালাইকুম কামাল, এইতো একটু এক বন্ধুর বাড়ি ছিলাম।”

    কামাল আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ দোকানের ভিতর থেকে কেউ ডাকে, “মনির! অই মনিইইর!” কামাল কিংবা যে আসলে মনির সে দোকানের ভিতর ঢুকে যায়। আমার মুখ লজ্জায় লাল হতে থাকে। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে আমার ঘরের দিকে এগোই।


    ।।২।।

    আরবি মিম হরফের মত দেখতে একটা গাছ অনেকদিন আগে থেকে (সম্ভবত কোনো এক ঝড়ে) চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পড়বি তো পড় ঠিক একদম সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের মধ্যে একটা গোল বসার ছাওনির সামনে, লোকে সেই ছাওনির নাম দিছে রহিম। রহিমের পাশে আর এক একটা ছোট্ট গোল, মানুষে বলে ছোট রহিম। ছোটদের সম্ভবত নিজের নাম থাকতে নাই, এই কারণেই সোহেলের মনে পড়ে না বাচ্চাকালে যখন সে প্রথম এইখানে আসলো তখন তার নাম আসলেই সোহেল ছিলো কিনা। তার উপর সে এটাও নিশ্চিত না ব্যপক এই পুলিশী ধরপাকড়ের মধ্যে সে কতদিন সোহেল থাকতে পারবে। এবারে তার পছন্দের নাম মাসুদ। বড় হবার এই জ্বালা, ছোটবেলায় যখন কারবার ছিলো ছোট, তখন নাম থাক বা না থাক অন্তত বদলাতে হত না।

    তবে বেশিক্ষণ এতকিছু নিয়ে ভাবার চাইতে সোহেল বরং তাকিয়ে থাকবে পড়ে থাকা ওই গাছটার দিকে। গাছের উপর উদ্যানের স্থায়ী বাসিন্দারা, যাদের বেশিরভাগ চা/ঝালমুড়ি/চানাচুরওয়ালা, গাঁজার ব্যবসায়ী কিংবা পতিতা, তাদের একমাত্র অল্টারনেটিভ কাপড়চোপড় শুকাতে দিয়েছে। এইসময় গাছটাকে মনে হয় অনেক রংবেরঙের জামা পরে আছে। সোহেল মৃত গাছের শখ দেখে হাসে। কিন্তু সে জানে না তার হাসি অনেকটা তার বাবার মত।

    সোহেলের বাবা মাহতাব মিয়া মারা যাওয়ার সময় তার মুখে হাসি ছিলো না। এই নিয়ে আক্ষেপ করার কোনো মানুষ নাই। সোহেলের মা নাহার, যার বাপের খুব শখের দেয়া এই নাম গ্রামের মানুষজন পাল্টায়ে ডাকতো নহোর, সে হয়তো বা মাহতাব মিয়ার হাসি শেষবারের মত দেখতে না পেরে কিছুটা আক্ষেপ করতো, কিন্তু সে আরও আগেই মরেছে। দুই বচ্ছরের বাচ্চা সোহেলকে স্তন থেকে সরায়েই নাহার চলে আসছিলো ঢাকা, এক ঘরে কাজ করতে। তিন মাসের মাথায় নাহার আর নাই। মাহতাব মিয়ার ঢাকা গিয়ে লাশ আনার টাকাটা বাঁচিয়ে কীভাবে যেন একটা এম্বুলেন্সে করে নাহার নিজেই বাড়ি চলে আসলো। তার এক মাস পর মাহতাব মিয়া বড়বাজারের খারাপ পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে।

    মাহতাব মিয়ার মৃত্যুর পর এইসব পাপকর্মের ফিরিস্তি ভেবে জানাজায় যাওয়া নিয়ে কিছুটা সন্দেহে ছিলেন গ্রামের মোটামুটি নতুন পয়সাওয়ালা লোক ছাদুল আলী। তার তখন মনে পড়ে মাহতাব মিয়া তার বাড়ি এসেছিলো কিছুদিন আগে।

    “ছাদুল ভাই, আমারে হাজার দুই কজ্জ দেও না! একখান ছুডো বেবসা নিই।”

    হাজার দুই কর্জ দেয়ার মত অবস্থা ছাদুল আলীর ছিলো। কিন্তু এই যে গ্রামের গরীব চাষাভুষা, এরা ছোটখাট ব্যবসা দিয়ে কয়দিন পর টাকাপয়সা বানিয়ে ফেলবে ব্যাপারটা একটু কেমন যেন। এই গ্রামে এনজিও নাই। বড়বাজারের দিকে একটা অফিস আছে। কিন্তু সেই এনজিওর বড় স্যারকে খুশি করে এরপরে কর্জ জুটে। ছাদুল আলীর খুশি করতে দিতে হয়েছিলো তার বউ। বেশি না এই দশ রাতের মত। ছাদুল আলীর যখন পাকা ঘর উঠলো, এই বউ তখন গেল মারা। ছাদুল আলীর বেশ স্বস্তি লাগছিলো তখন। এখন ঘরে আছে নতুন বউ, কোনো পাপ নাই। হজ্জ্ব করে আসতে হবে আগামী বছর।

    কিন্তু মনের এই শান্তিপূর্ণ অবস্থায় নিজেকে বিনা চিকিৎসায় মরা মাহতাবের মৃত্যুর সম্ভাব্য এক কারণ ভেবে একটু অস্বস্তি লাগে ছাদুল আলীর। তারপর সে মনে মনে আওড়ায় মাহাতাব মিয়াকে সে যা বলেছিলো,

    “দ্যাখো তোমারে তো পারলে আমি কজ্জ দেই। কিন্তুক তুমি তো মিয়া, যা হুনি আজকাল, বড়বাজারের মাগীগুলার লগে পীরিত, দিনেরাইতে মদ গাঞ্জা খাইয়া পইড়া থাকো। টাকা যা নিবা ফেরত ত দিবার পারবা না, তাও দিতাম নাহয়। কিন্তুক এই টেকা দিয়া যে পাপ অইবো…”

    “ছাদুল ভাই আল্লা কসম এই টেকার পুরাডা ব্যবসায় দিমু। একটা টেকারও পাপ করুম না।”

    “কিন্তুক যা কামাইবা, তা দিয়া তো পাপই করবা। যাইগা মাহতাব মিয়া, আসরের ওক্ত হইয়া গেছে। কই কি, অহন একটু নামাজ কালাম লও।”

    ছাদুল আলী চেতনা ফিরে পান। কি সব বাজে কামকাজ কইরা বেড়াইতো এই মাহাতাব মিয়া। কোন রোগ বাঁধাইয়া আল্লাহর গজব আনছে আল্লাই জানে। এরে নিয়া দুঃখ পাওনের কিছু নাই। তবে জানাজাটা পড়া উচিত।

    তবে আমাদের গল্পে উদ্যানের মাদকব্যবসায়ী সোহেল কিন্তু এইসব ইতিহাস জানে না, সে ইতিহাসে বাঁচে না। অনেকদিন আগে চাচীর মার থেকে বাঁচতে যে মেলট্রেনে উঠে গেছিলো, তখন প্লাটফর্মে তার ইতিহাস থেকে গেছিলো। সোহেল হাতে ধরে তুলে নাই তাকে আর।

    সোহেলের চিন্তা বরং এখন তার সামনে আসা ছেলেটাকে নিয়ে। উস্কোখুস্কো লম্বা চুলের চিকনচাকন লম্বা ছেলেটার পিছে কদমছাঁট চুলের আরও একটা ছেলে, হাইটে সামনের ছেলেটার চেয়ে একটু ছোট, তবে সে আরও শুকনা। আর তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে, মেয়ে হিসাবে ভালোই হাইটের, সুন্দর গড়নের, চেহারা আকর্ষণীয়। সোহেল খুব সতর্কভাবে মেয়েটার দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে পকেট থেকে একটা ছোট্ট পুরিয়া বের করে দেয়।

    “কি মামা! এত্ত কম এইটায়!”

    “দুই জয়েন্ট হইবে তো।”

    “আরেকটু বাড়ায়ে দাও।”

    একটু বাড়তি গাঁজা নিয়ে তারা তিনজন হাঁটে প্যারিস রোড দিয়ে। হঠাৎ রেডিও পয়েন্টে বসে তারা টুক একটা জয়েন্ট বানিয়ে টানে।

    “পদ্ম, ব্যাগ থেকে বোতলটা বের করো একটু।” লম্বা চুলের ছেলেটা বলে।

    মেয়েটা ব্যাগ থেকে বোতল বের করে আনে। তারা একসাথে বোতল থেকে কিছুটা দোচুয়ানি মেরে দেয়।

    রেডিও পয়েন্ট তখন অনেক ধোঁয়াধোঁয়া। প্যারিস রোডের পাশে এই গোল জায়গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যে শব্দ করা হয় তা প্রতিধ্বনিত হয় চারদিক থেকে যেন। গম্ভীর শব্দ, গমগমে শব্দ। রেডিও বাজছে।

    “বাংলাদেশ বেতার… আজ শুক্রবার সারাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে।”

    “হ্যালো লিসেনার্স, আমাদের সাথে স্টুডিওতে জয়েন করছে পিংক ফ্লয়েড। গিলমোর আর রজার ওয়াটার্স দুইজন মুখোমুখি বসে আছেন আমাদের সামনে…”

    রেডিও পয়েন্টের পিছে জমে থাকা আবর্জনাগুলা সময়ের মত পড়ে থাকে। মনে হয় বাতাস ছাড়ছে। বাতাসে উড়ে যাবে পড়ে থাকা সবগুলা দরিদ্র ঝালমুড়ির ঠোঙা। কিন্তু একটু ভারী বলে সুবিধাভোগী প্লাস্টিকের বোতল উড়বে না। এদিকে তীব্র শীত লাগছে এখন এই বাতাসে।

    জয়েন্টে টান মেরে জয়েন্ট পাস না করেই চুয়ানির বোতল থেকে এক মুখ মারলো লম্বাচুল ছেলেটা।

    “অই আসিফ, জয়েন্ট পাস করো।” পদ্ম নামের মেয়েটা বকে উঠে। বামের জংলায় একটা গাছের গায়ে তাদের শব্দ বাড়ি খায়। পদ্মর মনে হয় শব্দের ধাক্কায় গাছটা মাখনের মত বেঁকে গেছে।

    “বাঁইচা থাকা লোনতা লাগে।” অন্য ছেলেটি বলে। কিন্তু তার শব্দ ফুসফুসের লাগাম ছাড়ায়ে মুক্ত বাতাসের মুখ দেখে না। তার মনে হয় তার কথা কড়াইলের বস্তিবাসী। তাও বেঁচে থাকতে হবে, কারণ বেঁচে থাকা জরুরি।

    “আমি একটা জাদু দেখাই প্লাস্টিক বলের, মনে আছে?” আসিফ এ কথা বলে হালকা টলে উঠে।

    “তা আর থাকবে না! সারাদিন তো এইগুলাই করিস।…” পদ্মর কথা উপরে উড়তে থাকা চিলে নিয়ে যায়।

    “আমার ঐ জাদুটার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নাই।”

    “ফাজলামি রাখ তোর।” পদ্মর মুখে একটা হালকা নেশাসক্ত হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে।

    “এইজন্য এইটাই এখন বিজ্ঞান।” হে হে করে হেসে উঠে বলে আসিফ।

    “বরাক রহমান তুরাগকে ভাগাইছিলো শিহাব হারামজাদায়।” অন্য ছেলেটা বলে ওঠে।

    “কস কি রামিম!”

    “আরে বরাক রহমান তুরাগ, অই যে বাদামী কুত্তাটা, অরে শিহাব ভাগাইয়া দিছিলো। “

    “ক্যান ক্যান?”

    “বরাকটা আবার কে?” কৌতূহলে পদ্মর ভ্রু পুকুরে ঢেউ খেলার মত নড়েচড়ে উঠে। ঢেউ এসে ধাক্কা দেয় চারদিকে, তারা এখন সিন্দবাদের নাবিক।

    “একটা কুত্তা আসতো এইদিকে। সবার খুব ন্যাওটা ছিলো। তো একদিন শিহাবরা বইসা কার্ড খেলতেছে, তখন বরাক নামের কুত্তায় আইসা খেলার মধ্যে দিয়ে ঘুরাফিরা করতেছিলো। শিহাব তখন দিছে এক ধমক। এরপর থিক্যা আর কুত্তাডা কহনো ক্যাম্পাসে আসে নাই।”

    “ক্যান, শালা তুই নিজে একটা এপ, প্রাইমেটের বাচ্চা, কুত্তারে ধমকাবি কেন?” পদ্ম চিল্লায়।

    “হ, মানুষ আসলেও একটা বান্দর, বান্দরই থাইকা গেছে ইন্সটিংক্ট এ।”

    নীরবতা একটা সবুজ পর্দা, কিছুটা ঝাপসা আলো, সাদা মেঘ আর সবুজের। ঝিঁঝিপোকা অবচেতনভাবে নিজ কাজ করে।

    "ঝিঁঝিপোকায়ও মানুষ, মানুষেও মানুষ।"

    "এই যে শালার শিম্পাঞ্জিগুলা, গাবচোদ.." আসিফ খেঁকিয়ে ওঠে। দুইটা শুকনা পাতা ঝরে পড়ে সেই শব্দের উত্তরে। খালি একটা কুকুর এসে জ্বলজ্বলে চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন সে বরাক রহমান তুরাগের সন্তান। অন্যসময়ের মত কুকুর আদর করতে উদ্দ্যত হয় না পদ্ম। অনেকগুলো গোলগোল আলোর বল হাতে নিয়ে রাস্তার দুধারের গাছ তাকায়ে থাকে।

    "রামিম তুই না মাঝখানে প্রাইমেট থেকে বিবর্তন নিয়ে একটা ব্লগে লেখছিলি?”

    “হ, এরপর মানুষ সেইটা আবার প্রমাণ কইরা দিছে।”

    “কিহ?”

    “এপস টুগেদার স্ট্রং।” হাসতে হাসতে বলে রামিম। রামিমের হাসি থেকে বের হওয়া দাঁত প্লাস্টারের মত সাদা। সেই সাদা দাঁত দেখে হেসে দেয় আসিফ আর পদ্ম। তারা হাসে, সেই হাসিতে আর্তচিৎকার করে কয়েকটা টিকটিকি দৌড়ে পালায় কুমিরের কাছে নালিশ করবে বলে।

    “শালারা দল বাইন্দা আইসা কমেন্টে গালাগালি করতেছে। তা কি যে কইতেছে ভাই!”

    “কিন্তু দল বাইন্দা কইতেছে। এপ্স টুগেদার স্ট্রং।”

    তারা উঠে প্যারিস রোড ধরে উদ্যানের গেটের দিকে আগায়। তাদের মনে হয় উদ্যান হইলো একটা সাফারি। চারদিকে মানুষ আর এপদের সহাবস্থান। সাফারিতে লোক মরে না, মারে না। এখানে কাশ্মীরের মত বৃষ্টি পড়ে, সবুজ ঘাস হাঁটে মানুষের পাশে।

    উদ্যানের গেট থেকে বেরিয়ে টিএসসির সামনে আসতে গেলে মনে হয় সাফারি পেরিয়ে একটা অচিনপুরে চলে এসেছে। এখানে অনেককিছু এসে মিলেমিশে গলে গেছে। মানুষ, জামাপরা শিম্পাঞ্জি, ঘেয়ো কুত্তা, রাক্ষসগাড়ি সব গলে একটা চীজকেক। আসিফ বিড়বিড় করে চীজকেক চীজকেক। পদ্ম তার হাত চেপে ধরে তীব্র বৈদ্যুতিক তারের মত।

    ওদিকে ভুলভুলাইয়ার গোলকধাঁধায় পথ খোঁজে রামিম। পথের মাথা টিএসসির পাশে বাংলা একাডেমির দিকে এসে শেষ৷ সেখানে জটলা শিম্পাঞ্জির।

    প্রথম শিম্পাঞ্জিটা দূর থেকে হুট করে একটা পাথর ছুঁড়ে মারে। তা ধারালো ছুরির মত বুকের মধ্যে ঢুকে যায়। বুক চাপড়ে ছুটে এসে শিম্পাঞ্জি মুষ্টিহাত দিয়ে তাকে আঘাত করে। তার হাত পাঁজর চিরে গভীরে ঢুকে যায়। আরও গভীর। গভীরতর।

    আসিফ দেখতে পায় গোধূলির মত লাল রক্ত আর তার বন্ধুর বুকে গাঁথা ধারালো ছোরা। সে লাফিয়ে ধরতে যায় আক্রমণাত্মক শিম্পাঞ্জি কিংবা ওরাং ওটাং-কে। অন্যদিকে পদ্ম আঁকড়ে ধরে রামিমের দেহ, তারা একসাথে নীচে পড়তে থাকে। মহাকর্ষীয় পতন। ভরশূন্য। ওদিকে গাছের ডালে চড়ে উধাও হয়ে যায় ওরাং ওটাং। আসিফ হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে।

    ওদিকে রামিমের মনে হয় একটা দুঃস্বপ্নের মত সে অনেক উপর থেকে পড়ছে। তার চোখের সামনে সব অন্ধকার। হঠাৎ সিনেমার পর্দার মত তাতে এক বিন্দু আলো। সেই আলোতে সে দেখতে পায় একটা বানর-জাতীয়। ধীরে ধীরে সে বদলে যায়, হোমো ইরেক্টাস। হোমো স্যাপিয়েন্স। এখন নতুন মানুষ গুহায় থাকে। এখন মানুষ আগুন জ্বালায়, চাকা বানায়। এখন মানুষ এথেন্সের সংসদে ঝগড়া করে। যুদ্ধ করে। যুদ্ধ করতে গেলে মুখের কপাটি দাঁত বেরিয়ে আসে যেন হিংস্র বানর।

    এখন রেনেসাঁ হচ্ছে। নিউটন লিখছে, ডেকার্টে লিখছে, টিনটোরেটো আঁকছে একজন নগ্ন নারী। মেয়েটা দেখতে পদ্মের মত। রামিম পদ্মর শরীরের মধ্যে এবার গোপনে মিশে যায়। চুরি করে ছোঁয়ার মত। কিন্তু নির্দোষ, অনুমোদিত আর অসহায়।

    ওদিকে আসে কল, কম্পিউটার। আর ক্রমাগত জলের বাষ্প হবার মত মানুষ বদলে যায় বানরে, বানর সহজে মানুষ হয় না। এমন সময় সে সামনে দেখে সোহেল মিয়াকে। রামিম তাকে বলে, "এপস টুগেদার স্ট্রং।"

    "গাঞ্জাটা ভাল্লাগছে ভাইজান? আরেকটু নিয়া যাবেন?”

    রামিম একটা পোঁটলা নেয়। কিন্তু তার বড্ড ঘুম আসছে। উপর থেকে এই পড়তে থাকা শেষ হলেই সে ঘুমিয়ে যাবে। গাঞ্জাটা না হয় উঠেই খাবে।

    সোহেল মিয়া কিন্তু কোনো শিম্পাঞ্জি না। রামিম স্বস্তির শেষ নিঃশ্বাস ফেলে।


    ।।৩।।

    সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সন্ধ্যার পর অনেক শীত। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পদ্ম নামের মেয়েটা শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার।

    “আসিফ, রামিম ওরা আসবে না?” আমি পদ্মকে প্রশ্ন করি। পদ্ম শীতে শক্ত-জমাট হয়ে কাঁধ একটু উপরে তোলে আর মাথা নাড়ে না-বোধকভাবে।

    “চলো আগুন ধরাই।” আমি প্রস্তাব দেই। “আগুন দেখতে আমার কেমন জানি অদ্ভুত লাগে।”

    “আমারও। মনে হয় অনেক পুরানো একটা পরিচয়ের মত।”

    “আগুন যখন প্রথম মানুষ ধরায় তখন থেকেই আগুন একটা আশ্রয়ের মত। আগুন দেখলে তাই একটা টান আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে থেকে গেছে জৈবিকভাবে। আমরা নিজেরা সেই ইতিহাস বই।”

    “অথবা প্রত্যেক শিশু যখন প্রথম আগুন দেখে তখনই তার মধ্যে সেই অনুভূতি জন্ম নেয়, উত্তাপ আর আলোর অনুভূতি থেকে।”

    লাকড়ি কুড়াতে কুড়াতে এমন সময় ডোবায় মাছ ধরার মত হঠাৎ কিছু একটা আমার হাতে আটকায়। অনুভূতিতে বুঝতে পারি এটা একটা ক্যানভাস। লাকড়ির স্তূপ থেকে তুলে আনি আমি। পদ্ম ফোনে ফ্ল্যাশ জ্বেলে কৃত্রিম আলো দেয়।

    একটা বেশ সুন্দর ছবি। হালকা ইম্প্রেশনিস্ট বলা যায়। খুব বিষণ্ণ একটা দৃশ্য, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে শহরের একটা ছোট্ট কানাগলিতে। সেখানে ছাতা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে তার ছাতার নিচে বোরখাপরা একটা মেয়ে। সেই মেয়ের চোখ অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ।

    সেই তীক্ষ্ণতা আমাকে ধাক্কা দেয়। পদ্মকেও কি দেয়? আমার যে অক্সিজেন তা তো পদ্মকেও বাঁচিয়ে রাখে। তাহলে আমার মত সেও কি হাঁটা শুরু করে তীক্ষ্ণতার ধাক্কায়? আমি হাঁটার সময় সাবধানে ক্যানভাসটা আঁকড়ে রাখি।

    "কে ছবি এঁকে উদ্যানে এভাবে ফেলে রেখে গেল?" পদ্ম ভাবে। আমি শুনতে পাই। এমন সময় হঠাৎ আমার মাথা ব্যথায় টনটন করে ওঠে। আমি পকেট থেকে মাথাব্যথার ঔষধ মলম বের করি।

    "আমারও হালকা মাথা ধরেছে। এদিকে দিবেন একটু, প্লিজ।"

    আমরা মাথায় মলম মাখতে মাখতে হাঁটতে থাকি অন্ধকারে গাছপালার মধ্যে দিয়ে। হঠাৎ সামনে এক চা-সিগারেটওয়ালা মামার ছায়া পড়ে গ্রাফিতির মত। তাকে দেখে আমি একটু দাঁড়াই।

    "মামা, সোহেল ভাইরে দেখছেন?”

    "হ্যারে তো সন্ধ্যার একটু আগে পুলিশে ধরছে শুনলাম।" এই বলে চা-সিগারেটমামা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। কিংবা অন্ধকারে সে গাছ হয়ে চারপাশেই থেকে যায়। আমি বুঝতে পারি না।

    "ধুর।" পদ্মের কন্ঠে বিরক্তি।

    "এখানে তাহলে আজকে আর গাঁজা পাওয়া যাবে না। আমার এক বন্ধুর বাসা আছে বাংলামোটর, ও বলছিল ওর কাছে আছে।"

    "চলেন, যাই। কি আর করার।"

    আমরা উদ্যান ছেড়ে নেমে আসি ব্যস্ত হেডলাইটের সমুদ্রে। প্রত্যেকটা হেডলাইট যেন মানুষখেকো জন্তু, পেটের মধ্যে আস্ত একেকটা মানুষ পুরে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে যেদিকে খুশি। কিন্তু ভিতরের মানুষের কোনো স্বাধীনতা নাই। পদ্ম বলে,

    "আমার এই মলমের ঘ্রাণ বেশ সুন্দর লাগে।”

    আমি মাথা নেড়ে সায় দেই। নিঃশব্দে যন্ত্রের মত হেঁটে আমরা বাংলামোটরের বেশ কাছাকাছি এসে পড়েছি ততক্ষণে।

    শিহাবের বাসায় ঢোকামাত্র তার চোখ যায় আমার হাতে থাকা পেন্টিং-এর দিকে। স্বাভাবিক কৌতূহলে সে জানতে চায়, "আরে, এই ছবিটা কিসের? দেখি দেখি!" ছবিটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে শিহাব। আমরা চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। শিহাব ছবিটা কিছুক্ষণ দেখে; এরপর একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে জানতে চায়, "এটা কোত্থেকে পাইলি তোরা?”

    "উদ্যানে লাকড়ির স্তূপে ফালাইয়া গেছিলো কেউ। তুই চিনিস এইটা?”

    "এইটা নাসিমের পেন্টিং।"

    "নাসিম কে?” পদ্ম প্রশ্ন করে।

    শিহাব ঘরের ফ্লোরে বিছানো তোষকের উপর এসে বসে। আমি আর পদ্মও তাকে অনুসরণ করি। শিহাব সিগারেটের প্যাকেট বের করে। আমরা তিনজনই একটা করে সিগারেট নিয়ে ধরাই। শিহাব বলতে থাকলো,

    "নাসিম ছেলেটা হইলো আমার গাঞ্জার ডিলার। উদ্যানের ওইদিকেই বেচতো। যদিও খুব কম লোক নিতো ওর কাছ থেকে। তো নাসিমের সাথে আমার এড ছিলো ফেসবুকে।"

    শিহাবের ঘর একদম ফাঁকা ফাঁকা আসলে। শব্দ রীতিমতো ইকো করে। শব্দ জিনিসটা যদি আস্তে আস্তে দূর্বল হয়ে না যেত তাহলে বিষয়টা কেমন হত ভাবি। আজ থেকে কয়েক সহস্র বছর আগের মানুষের কথার মধ্যে এসে মিশে যেত এখনকার মানুষের কথা।

    "...তো আমি ফেসবুকে অনেক পেন্টিং-এর ছবি দিতাম। সেগুলা দেইখা নাসিম আইসা আমাকে এইটা-ওইটা জিগাইতো। শেষমেশ একদিন সে আমারে কইলো যে সে আঁকতে পছন্দ করে। অনেক অবাক হইছিলাম। এরপর আবার একদিন হুট কইরা আইসা সে আমাকে তার আঁকা কয়ডা পেন্টিং দেখাইলো। তেমন একটা ভালো না। আমি সত্যি সত্যিই কিছু ক্রিটিক করছিলাম। এরপর অনেকদিন সে নিজের ছবি দেখায় নাই, কিন্তু নিয়মিত নানা পেইন্টারের ছবিটবি দেখায়ে আলাপ করত।"

    "তারপর?”

    "তারপর একদিন ও আইসা আমাকে এই পেন্টিংটার ছবি দেখায়। আমি দেখে হতবাক হয়ে যাই। এত্ত সুন্দর কাজ!"

    "কী হয়েছে এই ছেলের? ওর পেন্টিং ফেলে দিলো কেন?” পদ্ম জিজ্ঞাসা করে। আমি নিঃশব্দে গাঁজা বানাতে থাকি এই আলাপের ফাঁকে ফাঁকে।

    "জানি না আপু। ব্যাপারটা আমিও ঠিক বুঝলামই না। আচ্ছা আমার কাছে এক বোতল হুইস্কি আর এক বোতল ভদকা আছে। তোরা চাইলে খাইতে পারস।" শিহাব আমার দিকে ঘুরে বলে।

    "ভদকা।" আমি উত্তর দেই।

    "হুইস্কি।" পদ্ম বলে। আমার দিকে একটু অদ্ভুত চোখে তাকায়।

    "আমি দুইটাই আনতেছি।" শিহাব সরে যেতে আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকাই। আমার নিজেকে শূন্য মনে হয়। স্টেরিও স্পিকারে একটা সাইকেডেলিক বি্ট-এর সুর বাজছে। পদ্ম আমার দিকে হঠাৎ দুয়েকপা এগোয় একটু টলে টলে, যেন মধ্যবিত্তের পদক্ষেপ। এমন সময় হঠাৎ আমরা দুজন বাহুলগ্ন হয়ে চুমু খেতে শুরু করি। শিহাবের আগমনে আমরা থামি। সামনে সাজানো ছোট ছোট মদের গ্লাসে মদ ঢালি। নিঃশব্দে আমরা মদ খেতে থাকি। এদিকে শিহাবের স্বভাব হলো দুই পেগেই ঘুম, সে বিছানায় শ্রমক্লান্ত দিনমজুরের মত গভীর ঘুমে লুটিয়ে যায়। তখন পদ্ম আমাকে জিজ্ঞাসা করে "রুমে যাবেন?”

    হঠাৎ আমি পদ্মকে উত্তর না দিয়ে ছিটকে সরে আসি। কিছু না বলে সোজা বের হয়ে যাই ঘরের বাইরে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই ঠান্ডা হু হু বাতাস আমাকে বরফের মত জমিয়ে দেয়। এরপর তুষারপাত, আমিপাত….

    আমার বাসার সামনের কাঠের দোকান রাত্রে বন্ধ করছে দোকানের ওরা। আমি তাদের নাম আন্দাজ করার ঝুঁকি এড়াতে গেটের পাশের অন্ধকারে পা টিপে টিপে বাসায় ঢুকি। হঠাৎ মনে হয় পিছন থেকে তাদের কেউ ডেকে ওঠে, "ভাইজান!"

    আমি সিঁড়ি বেয়ে ভয়ে দৌড়াতে থাকি।


    (এই সংখ্যায় তাহমিদ হোসেন-এর আরো একটি গল্পঃ 'সেদিন-প্রতিদিন')



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments