• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গল্প
    Share
  • সেদিন-প্রতিদিন : তাহমিদ হোসেন


    তোমার বাসা ধানমন্ডি ভূতের গলি। কেউ কেউ বলে ব্রিটিশ কলোনিযুগের মিস্টার বুট সাহেবের ভূতের স্মৃতিতে এই গলির নাম হয় বুটের গলি--পরে ভূতের। তবে আমাদের রিক্সা যখন ঝিকমিক আলো সারা শরীরে মাখা হাতিরপুল কাঁচাবাজার থেকে তোমার বাসার দিকে এগোচ্ছিলো, তখন আমি রীতিমতো আসমান থেকে গায়েবি বার্তা পাই--এই অন্ধকার গলি আসলেই এক ভূতের গলি।

    একটা সময় যখন পুরানো ঢাকায় মাহুতটুলিতে মাহুত থাকত, হাতিরপুল পার হয়ে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে নবাবের হাতি দুলকিচালে হাঁটত কলাবাগান থেকে কলা খাবার উদ্দেশ্যে, তখন ভূতেরা চাইলে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতে পারত। এখন শহরের আলো বেড়েছে, কৈশোরে থাকা ঢাকা আস্তে আস্তে স্বপ্ন দেখছেঃ একদিন তার বেখাপ্পা আলোকসজ্জা চেঞ্জ হয়ে হবে মধ্যবয়স্ক কলকাতা, কুনমিং-এর মত। কে জানে হয়ত একদিন টোকিওর মতো ভরা যৌবনবতী। ঢাকার এই স্বপ্ন দেখার সময়ে ভূতগুলো সবাই নিজেদের স্বপ্ন হারিয়ে এখন ভূতের গলির দিকে সরু গলিগুলোয় আশ্রয় নেয় আর চব্বিশ ঘন্টা ট্রাফিকের জ্যাম গোনে।

    জ্যামে আটকানোর সময়টা এদিকে আমার জন্য একটু অস্বস্তির। রিক্সার মধ্যে এমনিতে অসংবৃত প্রেম করা তেমন শক্ত না। হঠাৎ চুমু খেয়ে এদিক-ওদিক তাকালে দেখা যায় মধ্যবয়সি কিংবা বুড়ো এক চাচা ঘাড় ঘুরিয়ে স্তম্ভিত হয়ে রিক্সার দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ফারিত চোখে। কিন্তু সে ক্ষণিকের। তাদের দৃষ্টি এসে পৌঁছানোর আগেই রিক্সা উড়ে যায় সাত আসমানের ওপার। ব্যাপারটা মজার, তাদের দৃষ্টি আমাদের চিনতে পারে না, কিন্তু ঘটনাটা ধরে রাখে--যেন মানুষের চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়া প্রাচীন ফটোগ্রাফ।

    তবে এতকিছুর ভাবনা ফেলে আমি তোমার দিকে এক প্রাগৈতিহাসিক দৃষ্টিতে তাকাই। তুমি সেই দৃষ্টির উত্তর দাও চকিত চুমু খেয়ে। জ্যাম খুলে যায়, রিক্সা আগায়, আমরা আমাদের ঠোঁটের মধ্যে অপরের ঠোঁট আঁকড়ে ধরি যেন স্পিডব্রেকারে ধাক্কা খেয়ে রিক্সা থেকে ছিটকে গেলেও কেউ কাউকে যেতে দিব না।

    তোমার জন্য এইসব দুঃসাহসী কাজের হিসাবগুলো কেমন তা আমি জানি। জন্মগতভাবে তোমার জন্য যুক্ত হয়েছে একটা কাঞ্চনজঙ্ঘা ট্রেক। যদি ঢাকা শহরের সমতটে জন্মাও, তুমি পাড়ি দিবে একটা কাঞ্চনজঙ্ঘা, যদি জন্মাও এভারেস্টে তুমি পাড়ি দিবে একটা এভারেস্ট+কাঞ্চনজঙ্ঘা। এতদবসরে তাই তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে। অনেক জোরে একটা ঝটকা দিবে তুমি, উইইইই, রিক্সা উড়ে যাচ্ছে। তুমি তাকিয়ে দেখছ অসম্ভব ফাঁপা একটা ভিড়। আমি দেখছি তোমার দেখাটা।

    এদিকে রিক্সার দুরন্ত গ্রীবা আঁকড়ে থাকা রিক্সাওয়ালা মামা যন্ত্রের মত নেভিগেট করে। কিন্তু তার মন সেই জগন্নাথ হলের সামনে শেষ বিকেলে হেমন্তের হলুদ পাতাদের ঝরে যাওয়ায় আটকে গেছে। দূর থেকে দেখলে সেই পাতা ঝরা মনে হয় স্বর্ণবৃষ্টি। রিক্সাওয়ালা মামা যার নাম হয়ত নিজাম, তার কি লোভ লাগে?

    তবে নিজাম মামা আসলে হয়ত ভাবছে তার জিগারদোস্ত সুমনের কথা। ভাইবোনে ভাগাভাগি হয়ে জমিজিরাত তেমন ছিল না সুমনের। যেটুক জমি ছিল তাতে কৃষিকাজ কমই লাগে। তাই মাসে ২০-২৫ দিন ঢাকা এসে রিক্সা টেনে কিছু কামিয়ে নিত সুমন। আর গ্রামে যাওয়ার আগে বউয়ের জন্য কিছুমিছু নিয়ে যেত। হোক টিএসসির সামনে থেকে কাঁচের চুড়ি।

    ওদিকে নদীভাঙনের মাল নিজাম। নদীতে সব হারিয়ে ঢাকায় এসে নেয় রিক্সা টানার কাজ। বিয়েশাদী করে নাই। এসে ঠাঁই নিল মহাজনের রিক্সার আড়তে। আড়তে থাকা-খাওয়া আর রিক্সা চালানো বাবদ তিনশ দিতে হয়। বাকি যা কামাই সব নিজের। নিজের ভাগটা থেকেই সুমন গাঞ্জা কিনত। নিজাম আর সুমন দুই বন্ধু মিলে রিক্সা টেনে আটটার দিকে এসে থামত ঢাকা মেডিকেলের উল্টাপাশে, বুয়েটের দেয়াল ঘেঁষে। কল্কিতে টান। রিক্সার টান হাওয়া সাথে সাথে।

    শরীর ছেড়ে আসে, মনে হয় গ্রামের হলুদ ধানের খেতে বাতাস লাগছে। ঢেউয়ের মতো একটা স্রোত এসে ধাক্কা দেয় ধানখেতের পাশে থাকা লালি গাইয়ের গায়ে। লালি গাই ডাকে হাম্বা। তার পিছন থেকে কালো গোবর বের হয়ে পড়ে থাকে রাস্তার উপর৷ নিজামের চাচি গোবর কুড়ায় ঘুঁটে বানাতে। নিজাম সেই দুঃসম্পর্কের চাচির বাড়ির সামনে থেকে হেঁটে যেতে যেতে তাকায়--যদি সেই বাড়ির উঠানে পারুল থাকে! যদি সে ঝুঁকে গিয়ে উঠোন ঝাঁট দেয়, তখন বুকের উপর থেকে কাপড় সরে যাবে একটু, অন্ধকারে ঝাপসা বুঝা যাবে নাভির গোলাকার।

    অপরদিকে গরুর গোবর দিয়ে ঘর লেপতে লেপতে সুমনের বউ আবিষ্কার করে তার শখের নেলপালিশ দেয়া নখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। তার ইচ্ছা করে একটা পাকা ঘরের। কিন্তু সুমন এদিকে ধরে হেরোইন। যা কামাই, সব তো শেষ, কিছুদিনে বাকি জমিটাও বেচে দেয়। কামাইয়ের পুরোটা নেশা করে সুমন দুপুরে রাতে খাবারের জন্য ভিক্ষা করত পথচারী দেখে। কিন্তু এত অল্পবয়সী সমর্থ রিক্সাওয়ালাকে কে খাওয়াবে শুধুশুধু? নিজাম মামা জানে সাতদিন আগে এই জগন্নাথ হলের সামনে হঠাৎ মিড়কি উঠে রাস্তায় পড়েছিল সুমন। ছাত্ররা দয়া করে হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তারটাক্তার কিছু দেখাইছে।

    সেই একই জগন্নাথ হলের সামনে আমরা দুইজন নিজাম মামার রিক্সায় বসে লেমন মিন্ট জুস আর মেন্থল সুইচ সিগারেট উপভোগ করি এই সবকিছু অজ্ঞাতে রেখে। রিক্সা একটু কিছুক্ষণ থামিয়ে রেখে ফুচকা খেয়ে নিব কিনা তা নিয়ে আমরা দুইজন দ্বিধান্বিত থাকি এবং আমাদের মধ্যে নীরব যোগাযোগে সুরাহা করতে চাই। এদিকে গত তিন সপ্তাহের টানা মিছিলে তোমার পায়ে ব্যথা হয়েছে আমি জানি। কিন্তু আপাতত শাহবাগের মোড়ে ফুলের দোকানদারদের দুপুরবেলার ভাতঘুম নষ্ট হওয়া বাদে কোনো ফলাফল আসেনি। তোমাকে দেখে ক্লান্ত একটা শিশুর মতো মনে হয়। উঠার শক্তি নেই, তবে ইচ্ছার জোর যেন একটা ব্যাকআপ জেনারেটর।

    শেষমেশ আমরা নামি শাহবাগের মোড়ে। সেখানে আশি ফিট এক বর্গক্ষেত্রের মধ্যে দুইটা সমাবেশ হচ্ছে। সমাবেশের একটায় দুই সারিতে দশটা করে চেয়ার পাতা। তার অর্ধেক খালি। ওদিকে অন্য সমাবেশে একটা ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছয়জন, সামনে মাটিতে বসা আরও ছয়-সাতজন। তবে দুই সমাবেশের চারদিকে সাংবাদিকদের বিশাল সারি ঠেলে আমি কোনোরকমে তোমার হাত ধরে এক ফুচকার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াই।

    ফুচকার দোকানে ফুচকা খেতে খেতে আমি ফেসবুকে ঢুঁ মারি। নিউজফিডে দেখি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটা আর্টিকেল। এয়াই দিয়ে লেখা লেখানো যাচ্ছে, ডিসিসন নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি বিষয়ের। তোমাকে সেটা দেখিয়ে আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, "অদূর ভবিষ্যতে মানুষের আর তেমন কিছু করতে হবে না।"

    তুমি অদ্ভূত একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিয়েছিলে, "বোরড হয়ে মানুষ আগুন লাগায়ে দিবে সবকিছুতে।"

    এরপর আমরা ফুচকার বিল চুকিয়ে রিক্সায় উঠি। তখন আর কিছু নিয়ে কিছু বলা নিতান্ত বাহুল্য লাগে। আমরা নিজেদের নিয়ে কথা বলতে চাই এবং এইজন্য আমাদের প্রাচীনতম শরীরের কাছে দ্বারস্থ হই। তোমাকে চুমু খেতে খেতে হঠাৎ আবিষ্কার করি রিক্সা ভূতের গলির সাদা জামে মসজিদটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তুমি এজ ইউজুয়াল রিক্সা থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দাও, তোমার বাসার একটু দূরে।

    তুমি চলে যাও বাকি পথটুকু, রিক্সার ভাড়া মিটাও। নিজাম মামা নাকি তোমার কাছে আরও দশ টাকা চেয়ে নিয়েছিল। স্বভাবতই তা আমি দেখতে পাই না।

    সেই দশটাকা দিয়ে নিজাম মামা দুটো ডার্বি কিনে এক অন্ধকার কোণে বসে একটা স্টিক বানায়।


    (এই সংখ্যায় তাহমিদ হোসেন-এর আরো একটি গল্পঃ 'একজন আমি, আমার স্বপ্ন, আমি')



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments