পঁচিশ বছর ব্যাপী সাহিত্যিক জীবনে কুড়িটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন ফিনল্যান্ডের মিরইয়াম আইরিন টুয়োমিনেন—তার মধ্যে আছে উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা; এছাড়াও নিয়মিত পত্রপত্রিকায় বুক রিভিউ ও সাহিত্যের আলোচনা করতেন তিনি। ইয়োরোপের প্রধান প্রধান কবি-লেখকদের রচনা অনুবাদ করেছেন ফিনল্যান্ড-সুইডিশ ভাষায়—তার মধ্যে রয়েছে রাইনার মারিয়া রিলকের চিঠিপত্রের সংকলন এবং “অর্ফিউসের প্রতি সনেটগুচ্ছ”। মৃত্যুর সময় রেখে গেছেন দুটি দীর্ঘ, অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, ডায়েরি ও স্মৃতিচারণা, কয়েকশো পেনসিলে আঁকা ড্রইং এবং পঞ্চাশটি অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইনটিং। কিন্তু ফিনল্যান্ডের সুধী পাঠক তাঁকে একবাক্যে চেনেন একটি জীবনীগ্রন্থের জন্যে—১৯৬০ সালে প্রকাশিত “হ্যেল্ডার্লিন: একটি অন্তর্মুখী জীবনী”। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “Whoever has begun to read Holderlin will return to him and will gradually become a willing captive of his poetry.” জীবনীকারের নিজের জীবনের সঙ্গেই পুরোপুরি মিলে গেছে এই বাক্যটি।
কবির জন্ম ১৯১৩ সালে ১৯শে এপ্রিল মধ্য ফিনল্যান্ডের কাইনান শহরে। ১৯৩১ সালে হাইস্কুলের এবং ১৯৩৫ সালে কলেজের পাঠ সমাপ্ত হয়। ১৯৩৮ সালে প্রথম গ্রন্থের প্রকাশ “প্রারম্ভিক দ্বিধা” নামে গল্পগ্রন্থ; গ্রন্থটি চোখে পড়ে তখনকার শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য সমালোচক হেগার ওলসন (১৮৯৩-১৯৭৮)-এর এবং তিনি একটি প্রবন্ধে লেখেন, “She is an artist in soul and spirit and not merely a more or less good writer… It is certain that she touches the nerve of our time very intimately.” গল্পগুলির প্রধান চরিত্র “ইরিনা” লেখিকার দ্বিতীয় সত্তা অথবা ‘অল্টার ইগো’, এক অসুস্থ বালিকা যে বাবাকে হারিয়েছে অল্প বয়েসে, যার কাছে জীবন মানে বাড়ি আর হাসপাতাল, জীবন মানে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই আর জীবন মানে দৈনন্দিন আলো এবং অন্ধকার। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে যে জীবন খুঁড়ে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে। যার দৈনন্দিন জীবন যাপনেও যাতনা অন্তহীন সে কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে আর বেছে নেয় জীবনকে।
পরবর্তী গল্প সংকলন “দেয়ালগুলি”-র প্রকাশ ১৯৩৯ সাল—গল্পগুলির চরিত্রেরা তরুণী, তন্বী, বিদুষী, বুদ্ধিমতী—অনেকে দৃশ্যতঃ সুন্দরীও, কিন্তু তাঁদের যুদ্ধ করে যেতে হয় নিয়মিত—কখনও পরিবেশের সঙ্গে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় নিজের অভ্যন্তরে লালন-পালন করা দৈত্য-দানবদের সঙ্গে। এই সব নারীরা একদিকে যেমন আকাঙ্ক্ষা করেন বৌদ্ধিক স্বাধীনতা এবং নিজের মতো করে জীবনধারণের উপায়, তেমনি অন্যদিকে চান স্বাভাবিক ইন্দ্রিয়কেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা—১৯৩০ দশাব্দের ইয়োরোপে এই দুই প্রান্তকে মিলিয়ে ফেলা ছিল প্রায় অসম্ভব। “আনা স্টাইন” নামে একটি গল্প হেগার এবং অন্য সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সবচেয়ে বেশি—সেখানে স্ভেন কোলমার নামে এক যুবক চেষ্টা করে আনাকে খুন করতে—ডস্টয়েভস্কির “অপরাধ ও শাস্তি” উপন্যাসের রাসকলনিকফের মতনই তাঁর যন্ত্রণা, নির্যাতন ও অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের জন্ম। তাঁর রচিত চরিত্রগুলি একই সঙ্গে ভয়ংকর ও হাস্যকর—মনে পড়িয়ে দেয় আয়ারল্যান্ডের স্যামুয়েল বেকেটের কথা। অন্য একটি গল্পের নাম “কেবলমাত্র কুকুর”—সেখানে কুকুরের জবানিতে তার দৈনন্দিন জীবন, দ্বন্দ্ব এবং প্রভু ও প্রভুপত্নীর মর্মান্তিক বিবাহবিচ্ছেদ। প্রথম দুটি গ্রন্থের সূত্রে তাঁর খ্যাতি বাড়ল এবং গল্পের পাশাপাশি নিয়মিত চিন্তাশীল প্রবন্ধ রচনার সূত্রপাত। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগুন ছড়াল ফিনল্যান্ডে, ফলে দুর্যোগ নেমে এল সাধারণ মানুষের জীবনে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রেম করছিলেন টরস্টেন কর্সস্ট্রম নামে এক যুবকের সঙ্গে—হঠাৎ আবেগপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁকে বিবাহ করলেন। স্বামী পড়াতেন এক দূর, পাণ্ডববর্জিত শহরে একটি শিক্ষক-শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে—সেখানেই কাটল তাঁর যুদ্ধের বছরগুলি, কবিতা ও সাহিত্যের পরিবেশ থেকে দূরে। ঘরগেরস্থালিতে মন দিলেন তিনি—দুটি কন্যার জন্ম হল—১৯৪১ সালে কাইরা এবং ১৯৪৬ সালে টুভা; দ্বিতীয়জন এখনও রয়েছেন সাহিত্যের জগতে—তিনি লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। স্বামী চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে ফ্রন্টে গেলেন যুদ্ধ করতে—যোগাযোগ বজায় থাকল অনুরক্ত চিঠিপত্রে এবং মাঝেমধ্যে সনির্বন্ধ, আবেগবিহ্বল বাড়ি ফেরায়।
নাইকার্লবি নামক সেই ছোটো শহরে মিরইয়াম তাঁর প্রাণ ঢেলে দিলেন সংসারে ও সাহিত্যে। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হল তৃতীয় গল্পগ্রন্থ, “নিশ্চয়তা”— তাঁর চরিত্রগুলির মধ্যে মর্তের মানব ছাড়াও উঠে এল ভূত, প্রেত, ডাইনি এবং অন্যান্য আধিভৌতিক বিষয়। তাঁর কথাসাহিত্য ক্রমশ হয়ে উঠতে লাগল প্রবন্ধঘেঁষা—নানান তত্ত্ব ও তথ্যের আলোচনায় মুখর। নারীপুরুষের প্রেম ও দ্বন্দ্ব এখন তাঁর জীবনে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত তার অতল যৌনতা, অপার ইর্ষা ও অসীম টানাপোড়েন সমেত। আর যুদ্ধ—সেখানে বোমা পড়ে, ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তা দিয়ে কনভয় চলে, নিহত ও আহত হয় মানুষ—আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী। তিনি ভয়ে শিউরে ওঠেন সাধারণ মানুষের মধ্যে নাৎসিদের জন্য সমর্থন ও সহানুভূতি দেখে। তিনি আশ্রয় খোঁজেন যিশুর পাদপদ্মে, ক্যাথলিক ধর্মে। পরবর্তী দুটি গ্রন্থ কথাসাহিত্য ও নন-ফিকশানের সীমান্তে—১৯৪৪ সালে প্রকাশিত “শ্যামবর্ণ ঈশ্বর” এবং ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত “সংকট”। মানুষ কাঁদছে, মানুষের দুঃখে কাঁদছেন যিশু—এই অমারাত্রির শেষ কোথায়?
১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হল তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ “তিক্ত পানীয়”—বিষাদবহুল গ্রন্থটি ছেড়ে যাবার, বিদায় নেবার, বিষণ্ণতার সঙ্গে নিজেকে ছিন্নভিন্ন করার আশংকায় ভরপুর। তিনি বিদায় নেবেন কথাসাহিত্যের জগত থেকে, ছাড়বেন স্বামী ও সংসার, সাম্প্রতিক বাসস্থান—ভবিষ্যৎ অজানা ও অসম্পূর্ণ—কেবল তাঁর নিজের নয়, ফিনল্যান্ডের ও পৃথিবীর। মানবসমাজ পুরোপুরি দেউলিয়া তখন এবং হিটলারের অশুভ প্রভাবে বিষাক্ত পৃথিবী। যুদ্ধের বিভিন্ন, ভয়াবহ দৃশ্য খুব নিকট থেকে দেখেছেন তিনি—তার অভিঘাতে তিনি চিৎকার করে পৃথিবী মুখর করছেন না বা প্রকাশ্যে বুক চাপড়ে শোক প্রকাশ করছেন না। তাঁর নিজস্ব অস্ত্র সাহিত্যকে ব্যবহার করে তিনি অসীম বিশৃঙ্খলার মধ্যে কিছু রীতি বা বিন্যাস আরোপের প্রচেষ্টা করছেন। জার্মান সৈন্যদের উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেন মানবমনের স্বকীয় অপরাধবোধ এবং সেই সঙ্গে তুলনা করেন অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের মানসিকতার।
আরও একটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেই তিনি বিদায় জানাবেন কথাসাহিত্যের জগতকে। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হল “কিছুই হয়ো না”—তাঁর অন্তিম গল্পসংকলন। গল্পগুলি ছোট, সংহত, অনেকটাই নীতিকথার মতন। “অর্থহীনতার পথে” গল্পের প্রধান চরিত্র এক নর্তকী—তিনি চেষ্টা করেন নৃত্যকলায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে—তার জন্যে যেকোনো আত্মত্যাগ বা কৃচ্ছসাধনে রাজি। শেষ পর্যন্ত মঞ্চে পড়ে গিয়ে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন এবং মৃত্যুর আগে তাঁকে দেখা দেন স্বয়ং ঈশ্বর। সংকলনের অন্য গল্পগুলিও রূপকাশ্রয়ী।
এক গ্রীষ্মে মিরইয়াম ত্যাগ করলেন তাঁর তিন প্রধান সম্বলকে—অথবা তারাই একা ফেলে রাখল তাঁকে; প্রথমে স্বামীর ঘর, তারপরে গত প্রায় এক দশকের বাসস্থান নাইকার্লবি শহর, মফস্বল হলেও যাকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি; আর ছাড়লেন গদ্যের জগৎ, যদিও মূলত কথাসাহিত্যের জগৎ—এর পরেও গদ্য লিখবেন তিনি, তবে তা প্রধানত কবি ও কবিতাবিষয়ক। প্রথমে কিছুদিন মা ও বোনদের সঙ্গে বাস করলেন শৈশব স্মৃতি বিজড়িত হেলসিংফর্স শহরে—দুই শিশুকন্যাসহ একাকী মা তিনি। যে প্রাচীন অন্ধকার অ্যাপার্টমেন্টে তিনি শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন এবং ইরিনা ও তাঁর গল্পের অন্য অনেক চরিত্রের বাস যেখানে। সরকার থেকে অল্পখরচে অ্যাপার্টমেন্ট দেওয়া হয় পিতৃহীন দুঃস্থ শিশুদের—সেটি পেতে লাগল বছর দুই; কন্যাদের নিয়ে তিনি উঠে গেলেন কটবি শহরে, অল্পদূরেই, সরকারি বাসস্থানে। সেখানেই বাস করবেন তিনি মৃত্যু পর্যন্ত।
সম্বল হিসেবে রইল তাঁর ধর্মবিশ্বাস—ক্ষমাসুন্দর যিশুর সুসমাচার। তাঁর জীবনের দুই সেকুলার ধ্রুবতারা—দুই জার্মান কবি রিলকে এবং হ্যেল্ডার্লিন। জার্মান ভাষা শিখে তিনি আত্মস্থ করলেন এই দুই মহাকবির কবিতা। স্বেচ্ছায় বন্দী হলেন তিনি কবিতার হাতে এবং কবিতার জন্যে উৎসর্গীকৃত তাঁর বাকি জীবন। তাঁর থেকে বয়েসে কয়েক বছরের বড় আর এক কবিতাপ্রেমী আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-১৯৮২)ও একইরকম আন্তরিকতা ও তীব্রতা সহ বাংলাভাষা শিখেছিলেন মূল গীতাঞ্জলি পাঠ ও অনুধাবনের জন্যে।
কবিতা রচনাতে হাত দিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন আগেই; এখন দুঃখের গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল কবিতার ঘনত্ব। সেই জটিল রাসায়নিক সমীকরণে অনুঘটক হিসেবে দুই মহীরুহ জার্মান কবি, খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন সন্তের প্রভাব এবং মনোবিকলন জনিত অসুস্থতা—সব মিলিয়ে কবিতার উর্বর ভূমি। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হ’ল চল্লিশ পেরোনো নামকরা প্রাক্তন কথাসাহিত্যিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পদতলে ডুবে যায় মাটি”; তার কয়েকমাস পরেই দ্বিতীয় সংকলন “একতারা”। মানসিক অসুস্থতার জন্যে মাঝেমধ্যেই কবিতা রচনা বন্ধ রাখতে হ’ত—সেই সময়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন পেনসিল দিয়ে। গল্প লেখার জন্যে তাঁকে কল্পনা দিয়ে গড়ে তুলতে হ’ত চরিত্র ও পরিবেশ, তারপরেই হতে পারে অন্তর্লীন চিন্তাভাবনাগুলির বহিঃপ্রকাশ। কবিতায় সেসবের প্রয়োজন নেই—নিজের বিশুদ্ধ সত্তাকে প্রকাশ করা সেখানে—স্বাস্থ্য ও অসুস্থতার, স্বাভাবিকতা এবং অপ্রকৃতিস্থতার মলিন সীমারেখায় কবির বসবাস।
নিজস্ব কবিতা রচনার পাশাপাশি চলল নিয়মিত অনুবাদ&mdashঅমানুষিক নিষ্ঠা ও তীব্রতায়। পরপর দুটি নতুন কাব্যগ্রন্থ—“তৃতীয় কবিতাগুচ্ছ” (প্রকাশ ১৯৫৬) এবং “গেইটার পাশে” (প্রকাশ ১৯৫৭) এবং দুটি অনুবাদ—রিলকের চিঠিপত্রের দীর্ঘ, প্রামাণ্য সংকলন (প্রকাশ ১৯৫৭) এবং “অর্ফিউসের প্রতি সনেটগুচ্ছ” (প্রকাশ ১৯৫৭) সুইডিশ ভাষায় প্রথম সম্পূর্ণ অনুবাদ। আর সঙ্গে থাকলেন চিরসখা হ্যেল্ডার্লিন। জীবন মানে তাঁর কাছে এখন “কবিতা, অসুস্থতা ও দারিদ্র্য”। দুবার অল্প সময়ের জন্যে হলেও থাকতে হ’ল মানসিক হাসপাতালে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তাঁর ধারণা হ’ল যে আত্মীয়স্বজনেরা তঞ্চকতা করছেন তাঁর সঙ্গে; তিনি মা, বোন এবং প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন; বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও কমিয়ে ফেলে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণ তাঁর নিজের ভাষায় নারীর “fornication with spirits, demons and non-personified men” এবং তার বিরুদ্ধে পুরুষালি ঈর্ষা। কাল্পনিক বিষয়ের প্রতি তাঁর অকুন্ঠ মনোযোগ, বিশেষ করে কবিতায় এবং তাঁর একাকিত্বপ্রীতি যেকোনো সুস্থ সম্পর্কের পরিপন্থী। সংসার ত্যাগ করলেও কাল্পনিক দানবেরা তাঁর সঙ্গ ছাড়ল না—চলল নিজের সঙ্গে যুদ্ধ—মানসিক স্থিরতা ও অসুস্থতার সীমান্তে বেঁচে রইলেন তিনি; সঙ্গী তাঁর টাইপরাইটার, দুই শিশুকন্যা এবং নতুন পরিবেশ—“A row of recently and badly built tenement houses, filled with large working class families, gypsies, alcoholics, social cases and rootless people from all over postwar Finland.” ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হ’ল পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ “বেরীগুলো গোছায় গোছায় পাকে”— দার্শনিকতা মিশ্রিত, ধর্মবিশ্বাস সিঞ্চিত, ভবিষ্যতের বিপর্যয়ের সম্ভাবনায় ব্যাকুল কবিতাগুচ্ছ।
পরের বছরে প্রকাশ তাঁর ম্যাগনাম ওপাস—হ্যেল্ডার্লিনের জীবনী, তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। অনেক বছর ধরে তিনি হ্যেল্ডার্লিনের জীবন ও সাহিত্যের হাতে স্বেচ্ছাবন্দী—নিজের জীবনে তিনি খুঁজে পান জার্মান কবির জীবনের প্রতিফলন। হ্যেল্ডার্লিন কম বয়েসে পিতৃহীন, জীবনীকারের মতন তিনিও মানুষের সঙ্গ চাইতেন, কিন্তু সামাজিক পরিবেশ পছন্দ করতেন না, দুজনেই কবি হিসেবে খ্যাতনামা কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময় মানসিকভাবে অসুস্থ। দুজনেই বৈষয়িক বিষয়ে অসফল এবং অর্থনৈতিক জগতে অসচ্ছল—হ্যেল্ডার্লিনের একমাত্র জীবিকা ছিল গৃহশিক্ষকতা, ছিলেন অন্যের সহৃদয়তার ওপরে নির্ভরশীল। প্রকৃত প্রস্তাবে পাগল হবার অনেক দিন আগেই মানুষ তাঁকে পাগল বলে ভাবত। মিরইয়াম তাঁর সঙ্গে তীব্র মানসিক সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলেন, দুজনে বোধ করেছিলেন একাত্মতা, হয়ে উঠেছিলেন প্রাণসখা ও আত্মার আত্মীয়। জীবনীকারের একটি গুণ তাঁর ছিল ষোলো আনা—মানুষটিকে অন্তরঙ্গভাবে বোঝার ক্ষমতা, কিন্তু ছিল না সফল জীবনীকারের উপযুক্ত নিরাসক্তি বা নৈর্ব্যক্তিকতা। সেই কারণে গ্রন্থটি এক সর্বগ্রাসী বৌদ্ধিক অন্ধতার দোষে দুষ্ট। কবির প্রতি জীবনীকারের অনুভূতির তীব্রতা এই মহান গ্রন্থের একমাত্র ত্রুটি; তিনি কবির মগ্ন পাঠক, অন্ধভক্ত, গোপন প্রেমিকা, এক প্রায়-যৌন আকাঙ্ক্ষায় মুখর। তাঁর সাড়ে তিন দশকের উন্মাদ, জড়জীবন যাপন ও জীবনীকারের কাছে প্রার্থিত এবং স্বর্গীয়—“The silence that emanates from the latter half of his life has self-mastery and piety.” এর পরে তিনি প্রুস্ত ও কাফকার জীবন ও সাহিত্য নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন—সেখানে বুদ্ধিজীবীর যথার্থ দূরত্ব বজায় রাখতে কোনো অসুবিধে হয়নি। জন্মসূত্রে কবি ছিলেন লুথেরান চার্চের সদস্যা ও উপাসক, কিন্তু তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি সন্তুষ্ট করত না তাঁকে। পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি নাগাদ তিনি রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুরক্ত হন—সেখানে করুণাময় যিশুর প্রতিচ্ছবির পাশাপাশি কুমারী মা মেরী যোগ করতেন স্বর্গীয় নারীত্ব ও মাতৃত্ব। এছাড়া ক্যাথলিক ধর্মের অন্যান্য সন্তদেরও তিনি পছন্দ করতেন উপাসনার জন্যে। এই ধর্মীয় চিন্তাভাবনার অভিঘাত দেখা দিল তাঁর কবিতায়—কবিতা হয়ে উঠলো ধ্যান, পূজা, ঈশ্বরচিন্তার অঙ্গ। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হল তাঁর অন্তিম কাব্যগ্রন্থ “ঈশ্বর আছেন”—কবিতাগুলিতে গূঢ় ভবিষ্যদ্বাণী এবং ঈশ্বরদূতের মর্তে আগমনের আহ্বানবাণী। পরবর্তীকালে আরো দুটি ধর্মীয় কবিতাবলীর পাণ্ডুলিপি নির্মাণ করেছিলেন তিনি “যিশু খ্রিস্টের বীণা” এবং “আভা মারিয়া”। সেগুলি প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন তাঁর প্রকাশক। প্রত্যাখ্যানের ফলে তীব্র আঘাত ও অপমান বোধ করেন তিনি—গুটিয়ে ফেলেন নিজেকে এবং শরণাপন্ন হন নৈঃশব্দ্য, যিশু এবং হ্যেল্ডার্লিনের। ১৯৬৩ সালে তিনি ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা নিয়ে নিভৃতে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৬৭ সালের গ্রীষ্মে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর পরে প্রায় দেড় দশক তিনি সম্পূর্ণ বিস্মৃত—১৯৮৩ সালে তাঁর প্রথম জীবনী রচনা করেন গিটা বার্ক, গ্রন্থটির নাম “মিরইয়াম বিষয়ক গ্রন্থ” এবং তারপর থেকেই পাঠকের আগ্রহ বাড়ে এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদকর্মেরও সূচনা হয়। তাঁর নির্বাচিত রচনার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ডেভিড ম্যাকডাফ (১৯৪০-) এবং সেগুলি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৪ সালে কবিকন্যা টুভা কর্সস্ট্রম (১৯৪৬-) এর দীর্ঘ ভূমিকা সহ। প্রকাশক—ইংল্যান্ডের ব্লাডেক্স বুকস। আমার বঙ্গানুবাদগুলি ডেভিড ম্যাকডাফের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।
২০১৩ সালে খুব ধুমধামের সঙ্গে ফিনল্যান্ডে ও সুইডেনে পালিত হয়েছে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনাসমগ্র এবং সরকারি প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ভাষায় তাঁর অনুবাদ। এ ছাড়া তাঁর চিত্রশিল্পের প্রদর্শনী এবং সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা চলেছে উত্তর ইয়োরোপের নানা দেশে। কবি, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী মিরইয়াম টুয়োমিনেনকে পুনরাবিষ্কারের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ।
(এপ্রিল ২০১০)
নিম্নগামী / মিরইয়াম টুয়োমিনেন, ফিনল্যান্ড (১৯১৩-১৯৫৭)(Down / Mirjam Tuominen)
পাখিরা মাটিতে নামে সরলরেখায়
নীরবতা হে নৈঃশব্দ্য
নামো নামো
সমুদ্রের মতন দুফাঁক পৃথিবীর বুকে
ডুবে যাও সমুদ্রে
ওঠো ওঠো আবার
বন্ধ হয় গহ্বর
ফিঙে পাখি ওড়ে(The Swallows Fly)
ফিঙে পাখি ওড়ে
উঁচু
আরো নীল আকাশের পানে
নীচে
নামে কালো মেঘের স্তর পেরিয়ে
আত্মশিক্ষণ(Make me teach me)
আমাকে বিশুদ্ধ করো
নীরবতা শেখাও
সম্পূর্ণ করো আমায়
নতুন বুলি শেখাও
যে শব্দেরা শব্দ নয়
এ শব্দেরা নৈ:শব্দ্যের সামিল
অবিভাজ্য শুদ্ধ
নিজেকে বাতিল করা নয়
অভিযোগ না
প্রতিরক্ষা নয়
তত্ত্ব নয়
প্রতিতত্ত্বও নয়
কেবল সংশ্লেষ।
জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে
বজায় থাক ভারসাম্য।
দেকার্ত(টীকা- রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০)- ফরাসি দার্শনিক, আধুনিক দর্শনশাস্ত্রের উদ্যোক্তা। (Descartes))
যুক্তিবিচারের অর্থ বের করেছ তুমি
তর্কের
সঙ্গতিপূর্ণ আচরণের
রূপকহীনতার
ধর্মবিরোধীতার।
তুমি ছুটে গেলে চার্চের দিকে
আশ্রয় চাইলে কুমারী মা মেরীর পাদপদ্মে।
যুক্তি তোমার অকাট্য
আর অনুধাবন করেছ
সামঞ্জস্যকে।
স্পিনোজা(টীকা: বারুচ দ্য স্পিনোজো (১৬৩২-১৬৭৭)- ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ওলন্দাজ দার্শনিক। (Spinoza)
সরলতার থেকে বেরিয়ে
বহুত্বের জগতে প্রবেশ
সরলতায় গঠিত
সরলতার স্রোতে
সরলতায় নিরূপণ
বহুত্বের দিকে যাত্রা
সরলতার
আবার নতুন যাত্রা
বহুত্বের দিকে
সহজ সিদ্ধান্ত
উপসংহার
অনেক পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত
সবচেয়ে সরল বস্তুটি
সরলতম সরলতা
ভীষণতম – সরল:
(হে ঈশ্বর!)
পুরোটাই।
ফ্রয়েড(টীকা: সুগমুন্দ ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) মন: সমীক্ষণের জনক। (Freud)
তোমরা যারা দৃঢ় বিশ্বাসে অপারগ
তোমরা কখনও মস্তিষ্কের ভেতরে উঁকি দাওনি
আমি দেখেছি আমার মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে
আমি দেখেছি সুড়ঙ্গের পথে তাকিয়ে
আমি অনুসন্ধানে মেতেছি খনিগর্ভে।
চল্লিশ বছর আমি মোজেস কে খুঁজেছি
মরুভূমির এক খনিতে
মানবজীবনের অর্ধেক অংশ
তারপর সেখানে পৌঁছে
যন্ত্রণার সমাপ্তি
তাগিদও অন্তর্হিত
আমি তখন সুড়ঙ্গপথে
উজ্জ্বল সোনালি আলোর স্রোতে।
অর্ধেক জীবন কেটে যায়
কেবল সেখানে পা ফেলতে।
তখন অধিচেতনার জগতে আমি।
বাকী অর্ধেক কাটবে
শুদ্ধ করতে নিজেকে।
মরুভূমিতে নবীর মতন
ধৈর্য আমার অনন্ত।
পাহাড়চূড়া থেকে তীব্র স্বর নামে:
“আমি এক অচেনা আর
এই ভূমিও আমার না।”
তবে আমি তাকে আপন করে নেবো।
আমার সন্তুষ্টি
সর্বসেরাকে পেয়ে
মানুষের মধ্যে যা অতুলনীয়।
কাদায় ঘোলা জল নয়।
আমার তৃষ্ণা নিবৃত্তি টলটলে ও টাটকা
প্রাগৈতিহাসিক উৎসের জলে।
মৃত্যুর বিশ্লেষণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই সংশ্লেষে যা পরিবর্তনশীল বিষয়টাকে আরও খানিকটা পালটে একঘেয়েমির একঘেয়েমিতে মিশিয়ে অসীমের সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাগুলিকে গড়ে তোলে নতুন এক বিষয়ে যাকে বাধা-বন্ধনের মধ্যে বাঁধতে বাঁধতে আবার নতুন করে বাঁধন পুনরায় আবার আরও পরিষ্কার বাঁধন আরও অমোঘ বাঁধনে বাঁধতে চায় তাকে অটল হৃদয় শেষ পর্যন্ত বন্দীত্বে বাঁধনে তার অন্তিম সংশ্লেষ যখন সে তার পাখা দুটো শূন্যে তোলে আর বিশাল শূন্যতার স্বচ্ছ শীর্ণতায় ডানা মেলে উড়ে যায়। শূন্যতাই বিরাজ করে সর্বদা।
(Death Analysis)।
হাতের তালু(Palm of Hands)
হাতের তালু ছড়িয়ে যায় ত্বকহীন
নরম হাঁটুর আদেশ মানে না
আঁকাবাকা পদযুগল ত্বকের জন্যে
আনচান পায়ের চেটো
দন্তহীন মুখ
অন্তহীন কান্না
দুঃখের নির্ঝর থেকে
সদ্যোজাত শিশু।
আমার লেখা(I write)।
আমার লেখা ধরা দেয় পোষা কুকুরের চোখে
গুঁড়ি মেরে এগোয় বেড়ালের থাবার দিকে
ঝিকমিক করে নিঃসঙ্গ মাছির দুই ডানায়
লাফ দেয় শিশু হরিণের সঙ্গে
উড়ে যায় পাখির ঝাঁকে
ওড়ে
ডুবে যায়
ধরার ভূতলে শিকড় বেয়ে বেয়ে
হাসে সদ্যোজাত শিশুর চোখে
বিস্ময় হয়ে ফোটে নবীনের দৃষ্টিতে
আর কামনা করে মানবী আকাঙ্ক্ষাকে।
ফিনল্যান্ড- সুইডিশ ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ডেভিড ম্যাকডাফ।