বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ লেখাটির শুরুতেই বলেছিলেন—‘যশের জন্য লিখিবেন না। টাকার জন্য লিখিবেন না।’ তাহলে কেন লিখব? যদি মনে মনে এমন বুঝতে পারি লিখে ‘দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন’ করা সম্ভব, তবেই লেখা উচিত। তাঁর মতে ‘সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য’। যা হিতকর নয়, ‘তাহা একেবারে পরিহার্য্য’। বঙ্কিমের উদ্দেশ্যমূলক সাহিত্যসৃষ্টির বিষয়টিকে কলাকৈবল্যবাদীরা নস্যাৎ করতেই পারেন, তবে আমাদের মনে হয় লেখক-পাঠক নির্বিশেষে এটি অবশ্যপাঠ্য। যে বারোটি বিষয়ের প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, আজও তা সমান প্রাসঙ্গিক। ‘কেন লিখি?’—সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর সাহিত্যিকের আত্মআবিষ্কারের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে থাকে দেশকাল।
কোচবিহারের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে কীভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে মূল্যবান ভাবনাসূত্র উপহার দিয়েছেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। ‘প্রাচীন কোচবিহারের ভাষা এবং সংস্কৃতি’ প্রবন্ধের একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে চলে যাই—“... প্রাচীন বাংলাভাষা কীরকম ছিল, তা জানতে আমাদের কোচবিহারের ভাষাকেই জানতে হবে, এবং হয়তো এরকম অনুমান করা অযুক্তির হবে না যে, সারা বাংলাদেশে হিন্দু সংস্কৃতি কী অবস্থায় ছিল তার অনুসন্ধান এই একটি রাজসভাতেই করতে হবে। এই প্রসঙ্গে আমাদের বোধ হয় মনে রাখা উচিত, এখন আমরা যাকে বাংলা ভাষা বলি ও সংস্কৃতি বলে জানি, তা যতটা প্রাচীনের অনুবর্তন, তার চাইতে বেশি বিদেশাগত—এক কথায় তাকে কলকাত্তাই বলা চলে, তা ভালো কি মন্দ সে কথা স্বতন্ত্র।” (‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৭, পৃ: ৮৮) ইতিহাস যে আসলে ইতিহাস লেখার ইতিহাস সে কথাটি বারে বারে মনে করা দরকার। আর তাহলেই সাংস্কৃতিক রাজনীতির আগ্রাসী রূপটি স্পষ্টভাবে ধরা দেবে আমাদের কাছে। অমিয়ভূষণের কথায় ফিরে যেতে হয় আবার—“আমরা তেমন ইতিহাস লিখিনি, অথবা লিখতে শিখিনি বলেই ভাষা ও সাহিত্য-ইতিহাসে লজিককে স্থান দিতে পারি না। নতুবা রাঢ়ের কৃষ্ণকীর্তন, ময়মনসিংহগীতিকাকে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে স্থান দিয়ে, কামতার শঙ্করদেব, অনন্ত কন্দলী, পীতাম্বর সিদ্ধান্তবাগীশ প্রমুখকে বাইরে রাখা কঠিন হত।” (‘প্রাচীন কোচবিহার: ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা’, ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’, পূর্বোক্ত, পৃ: ১০৭)
১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে অহোমরাজ স্বর্গনারায়ণকে লেখা মহারাজা নরনারায়ণের চিঠিটি বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত হলেও, কোচবিহার রাজসভার সাহিত্য উপেক্ষিত হয়ে রইল। এই নীরবতার কারণ নিয়ে ‘প্রাসঙ্গিক-কথন’ পাওয়া যাবে স্বপনকুমার রায়ের লেখা ‘কোচবিহার রাজদরবারের সাহিত্যচর্চা’ (বুকস্ ওয়ে, ২০১১) বইতে। কোচশাসনাধীন কামতার সাহিত্য সাধনাকে দুটি পর্বে বিভক্ত করেছেন ডঃ শচীন্দ্র নাথ রায়। একটি পর্ব ষোড়শ শতক থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ নিয়ে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকের চার দশক পর্যন্ত আরেকটি পর্ব। সংস্কৃত মহাকাব্য, পুরাণের অনুবাদ, আঞ্চলিক ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিভিন্ন আখ্যানকাব্য এবং দেশে-বিদেশে নানা পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের সাহিত্য সাধনার ধারা গতিশীল ছিল। দ্বিতীয় পর্বে মূলত প্রাধান্য পেয়েছে মৌলিক লেখালেখি। ডঃ রায় যথার্থভাবেই বলেছেন—“সবচেয়ে বড়োকথা ক্লাসিক্স ও পুরাণ চর্চায় বাংলার আর কোনো রাজবংশ এত দীর্ঘকাল ধরে এমন আগ্রহ দেখায়নি বা আনুকূল্য দান করেনি।” (‘সাহিত্য সাধনায় রাজন্য শাসিত কোচবিহার’, এন.এল.পাবলিশার্স, শিলিগুড়ি, ১৯৯৯, পৃ: ৫৬) রাজনগরের লেখালেখির গৌরবময় ইতিহাস বিষয়ক দু-একটি তথ্য উদ্ধার করতেই হয়। যেমন—বাংলায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছিল মুন্সী জয়নাথ ঘোষের ‘রাজোপাখ্যান’ (১৮৪৫) রচনার মধ্য দিয়ে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে মহারানি বৃন্দেশ্বরী দেবীর লিখিত ও ১৮৫৯-য় প্রকাশিত ‘বেহারোদন্ত’ বইটি প্রথম মহিলা কবি দ্বারা লিখিত ইতিহাস শুধু নয়, কোচবিহারের প্রথম মুদ্রিত ইতিহাসও বটে। সুনীতি দেবীর ‘The Autobiography of an Indian Princess’ (John Murray, Albemarle Street, W. London, 1921) প্রথম কোনো ভারতীয় নারীর লেখা ইংরেজি আত্মজীবনী। যা প্রথম, তাকে ইতিহাস সবসময়ই মনে রাখে। কিন্তু বাঙালি যে আত্মবিস্মৃত জাতি। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে ‘কুচবিহার রাজকীয় গ্রন্থাগারের বাঙলা পুঁথি’ প্রবন্ধে শশিভূষণ দাশগুপ্তের মন্তব্য—“ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বাঙলার সভ্যতা, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি অনেকখানি কেন্দ্রীভূত হইয়া উঠিয়াছে মহানগরী কলিকাতাকে অবলম্বন করিয়া, সাহিত্য-সাধনাও তাই অনেকখানি কেন্দ্রীভূত। কিন্তু দুই তিন শতক পূর্বের সাহিত্য-সাধনা এরূপ কেন্দ্রীভূত ছিল না, বাঙলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে অবলম্বন করিয়া বিভিন্ন স্থানে এই সাহিত্য-সাধনা ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করিয়াছে। বিভিন্ন কেন্দ্রের এই সাহিত্য-সাধনার পরিচয় ভাল করিয়া না জানিলে বাঙলা-সাহিত্যের সমগ্ররূপটির পরিচয়ও আমরা জানিতে পারিব না।” (‘কুচবিহার দর্পণ’, নবম বর্ষ ১১শ সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৫৩, পৃ: ১৭৭)
কেন্দ্র যদি প্রান্ত হয়ে যায় রাতারাতি, জীবনে তার প্রভাব পড়ে। সাহিত্য তার বাইরে নয়। সবাই অমিয়ভূষণ নন যিনি ‘নিজের কথা’-য় বলবেন—“কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাচ্ছি না। কলকাতাকে বলতে চাইছি বেরিয়ে এসো ইংরেজি আনা থেকে—দ্যাখো এই মাতৃভূমি, ভালোবাসো একে, মরবে না। কাদায় ডুবে যাচ্ছে, ধোঁয়ার দমবন্ধ, আর কতদিন অ্যাংলো-স্যাকসনি মুখোশে থাকবে!” (‘প্রবন্ধসংগ্রহ’, পূর্বোক্ত, পৃ: ২৬২) আবার, ‘ভাঙা স্বপ্নের কথক’ অরুণেশ ঘোষ মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে উড়িয়ে দিয়ে, এই শহরের গ্রামীণ প্রকৃতি ও রক্তমাংসের মানুষের সংগ্রামকে আত্মস্থ করেই হয়ে উঠেছিলেন যথার্থ আন্তর্জাতিক মননের অধিকারী। জীবনে ও লেখায় এমন বেপরোয়া মনোভাব সত্যি বিরল।
উত্তরবঙ্গ কি কলকাতার নব্য-উপনিবেশ—এমন প্রশ্ন ওঠে মাঝেমাঝেই। ‘সুদূর কলকাতা থেকে আগত’ শব্দবন্ধে বুকের মধ্যে কেমন একটা হয় আমাদের। হাজার মুগ্ধ মুখের ভিড়ে চমৎকার আতিথেয়তার প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করে সেলেব কবি-গায়ক অন্তর্হিত হন, রাত পোহালে চিনতেও পারেন না মঞ্চের সঞ্চালককে। কলকাতা মানে নির্দিষ্ট ভূগোল নয়, একটি ক্ষমতাকেন্দ্র, সর্বোপরি একধরনের মানসিকতা—সেটা না বললেও চলে। ক্লান্ত ক্লান্ত লাগে স্বীকৃতির জন্য অফুরান তৈলমর্দন দেখতে দেখতে। প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা করে আর যাইহোক কবি হওয়া যায় না, কে বোঝাবে কাকে? ‘বাস্তবকে বুঝতে হোলেও দূর থেকে তাকে দেখতে হয়’—কোচবিহার সাহিত্যসভায় একটি ভাষণে বলেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের শহর থেকে প্রায় সাতশো কিমি দূরে বসে পথের কবির সেই ‘সহজাত নিঃসঙ্গতা’র খোঁজ করি। গভীর নির্জন পথে সঙ্গী হয় এণাক্ষী মজুমদারের লেখা ‘বনেচর: অমিয়ভূষণ মজুমদারের জীবনকথা’। লেখকের কনিষ্ঠা কন্যা তাঁর লেখায় জানাচ্ছেন ১৯৫৮-১৯৬৬ সময়সীমায় ‘সাহিত্যসভা’-র সম্পাদক হিসেবে অমিয়ভূষণের ভূমিকার কথা। ‘সাংস্কৃতিক সংঘ’-এর পরিচালনায় বিভিন্ন সারস্বত অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সেসময় কোচবিহারের মানুষ টিকিট কেটে সাহিত্যের আলোচনা শুনত। ‘সাহিত্যসভা’-র সম্মেলনের পর কলকাতায় ফিরে ১২.১.৫৯ তারিখে অমিয়ভূষণকে এক চিঠিতে মনোজ বসু লিখছেন—“তাজ্জব কাণ্ড দেখে এলাম কোচবিহারে। টিকিট কেটে লোকে বক্তৃতা শোনে! নাচগানের ভেজাল নেই—নির্জলা নিষ্করুণ বক্তৃতা। রাস্তার পোস্টারে সিনেমা-আর্টিস্ট নয়, সাহিত্যিকের নাম। এতৎ সত্ত্বেও লোকে ভিড় করে আসে এবং হিমরাত্রে বসে বসে বক্তৃতা শোনে। এই সমস্ত লিখেছিলাম অধ্যাপক কবিরকে। জবাব এসেছে। তিনিও চমৎকৃত। আপনারা আবার তাঁকে যাবার জন্য লিখেছেন। খুব যাবার ইচ্ছা হয়েছে তাঁর।” (‘বনেচর’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৭, পৃ: ২৪৮) এরপর এণাক্ষী মজুমদার জানাচ্ছেন—“সম্ভবত পরের বছর হুমায়ুন কবীরের নিজেরই এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি কুচবিহারে এসেছিলেন। ...এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় যে, কুচবিহারের এই অভিনব সংস্কৃতিপ্রেম, সাহিত্যপ্রীতি, ষাটের দশকের মাঝামাঝি উধাও হয়ে যাচ্ছিল। কারণ খুঁজে দেখা হয়নি, অনুমান করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিই বাঙালির একমাত্র সংস্কৃতি হয়ে ওঠার ফলেই হয়তো সেরকম।” (পূর্বোক্ত, পৃ: ২৪৯)
স্বাধীনতা-উত্তর কোচবিহারের ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃতভাবে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। আমরা যারা আটের দশকের শেষে জন্মেছি, তারা ভেবে অবাক হই কীভাবে রাজবাড়ি থেকে অন্তর্হিত হল এত এত জিনিস! প্রশাসনের ভূমিকা সেসময় কেমন ছিল? প্রশ্ন অনেক। উত্তর খুঁজতে গিয়ে বহু মানুষের হিরন্ময় নীরবতা আমাদের অবাক করেছে। সেইসব অকথিত ইতিহাসের গভীরে হয়তো লুকিয়ে আছে রহস্য উপন্যাসের বীজ।
করোনাকালে প্রয়াত হলেন ডঃ আশিস কুমার নাহা। ‘উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পি-এইচ-ডি উপাধির জন্য রচিত গবেষণা নিবন্ধর শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীনোত্তর কোচবিহার: সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরম্পরা’ (২০০২)। তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ডঃ দিগ্বিজয় দে সরকার। এই অপ্রকাশিত গবেষণাপত্রটি বই আকারে প্রকাশিত হওয়া দরকার। পশ্চিমবঙ্গ কোচবিহার জেলা সংখ্যা-য় (২০০৬) আশিস নাহা লিখেছিলেন দীর্ঘ প্রবন্ধ—‘স্বাধীনতা-উত্তর কোচবিহারের সাহিত্য’। এই শতকে দু-দশক পেরিয়ে জেলার লেখালেখির রূপরেখাকে বুঝতে চাওয়ার সূত্রেই আমরা ফিরে ফিরে দেখতে চাইছি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়কে। তুলনামূলক আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যাচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আমরা জানি লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া সাহিত্যের স্বরূপ সন্ধান অসম্পূর্ণ। গোপেশ দত্তের লেখা ‘শতবর্ষের আলোকে কোচবিহারের পত্রপত্রিকা’ (‘মধুপর্ণী’, বিশেষ কোচবিহার জেলা সংখ্যা, অজিতেশ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ১৯৯০, পৃ: ২৭৭-২৯১) প্রবন্ধটি থেকে রাজনগরের লিটল ম্যাগাজিনের কালানুক্রমিক তথ্য পাওয়া সম্ভব। এবং এর পরিপূরক হিসেবে আরেকটি লেখার কথা বলতেই হয়, সেটি হল—অভিজিৎ দাশের লেখা ‘অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে কোচবিহার জেলার লিটল ম্যাগাজিন’ (‘কোচবিহার: ইতিহাস ও সাহিত্য’, দেবায়ন চৌধুরী ও মধুরিমা চৌধুরী (সম্পা.), ছোঁয়া, ২০১৯, পৃ: ২৫১-২৭৩)। ১৯৭০ সালে অরুণেশ ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘জিরাফ’। রণজিৎ দেবের ‘ত্রিবৃত্ত’ এইসময়েই প্রকাশিত হয়। স্বপনকুমার রায় ত্রৈমাসিক ‘অন্যস্বর’ শুরু করেন ১৯৭৯ সালে। আশির দশকে সমীর চট্টোপাধ্যায় শুরু করেন ‘তমসুক’ পত্রিকা। অনুভব সরকারের ‘টার্মিনাস’, অমর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘চিত্রকল্প’, সুনীল সাহার ‘গল্প ইদানীং’, বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ের ‘সাহিত্য ভগীরথ’, ভগীরথ দাসের ‘চারুবাক’, সন্তোষ সিংহের ‘ময়ূখ’, বিশ্বনাথ দাসের ‘শব্দশিল্প’, স্বপনকুমার রায়ের সম্পাদনায় ‘সাগর দিঘি’ প্রভৃতি পত্রিকার প্রকাশ ঘটে এই দশকেই। বাংলা সাহিত্যের প্রথম জেরক্স ম্যাগাজিন হল ‘জেরোম্যাগ’ (১৯৯০)। একাধিক সমৃদ্ধিশালী লিটল ম্যাগাজিন বর্তমানে সুলভ নয়। বলতে বাধা নেই আজ হাতে গোনা কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন কেবল নিজের উপস্থিতি জানান দিতে পারছে। সঞ্জয় সাহা সম্পাদিত ‘তিতির’ উনিশ বছর ধরে ব্যতিক্রমী সংখ্যা উপহার দিয়েছে পাঠককে। ‘ডায়েরি’ সংখ্যার জন্য লাভ করেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত লিটল ম্যাগাজিন স্মারক সম্মান (২০১৭)। নিত্য মালাকার সংখ্যা (জানুয়ারি ২০০০), চা-বাগানের সাহিত্য সংস্কৃতি (জানুয়ারি ২০১৮), লুপ্তপ্রায় (অক্টোবর ২০১০) প্রভৃতি তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ‘তিতির’-এর কথাসাহিত্য সংখ্যায় (জানুয়ারি ২০১৫) পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল সুরজিৎ বসুর ‘অবতামসী’ উপন্যাসটি। ‘সম্পাদকীয়’ তেপাই—“যারা ক্রিকেটপ্রেমী তারা যেমন মনে করেন টেস্ট ক্রিকেট না খেললে ভালো ক্রিকেটার হওয়া যায় না তেমন আমাদেরও মনে হয় গদ্যচর্চারও শেষ ও সার্থকতম পদ্ধতি উপন্যাসচর্চা। তাই ‘তিতির’-এর গদ্য সংখ্যাগুলিতে এখন থেকে উপন্যাস রাখার সিদ্ধান্ত নিই। কেন-না উপন্যাসের ব্যাপ্তি, পরিসর, কাঠামো এবং সামাজিক চিহ্নায়ন সময় ও সমকালকে ধরে রাখতে খুব প্রয়োজনীয় যা লিটল ম্যাগাজিনের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্যও বটে।” (পৃ: ৬)
অমর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘চিত্রকল্প’ পত্রিকা ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছে। তারজন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্যের পাশাপাশি অক্টোবর ২০১৮ সংখ্যায় ক্রোড়পত্র ছিল মৈথিলী সাহিত্য। অক্টোবর ২০১৪ (বর্ষ ৩২ সংখ্যা ৪২)–য় সম্পাদক জানিয়েছিলেন—“চিত্রকল্প ভারতীয় সাহিত্যের কাগজ থেকে অসীমাকাশে উড়ছে। এবারও তাই চীনা সাহিত্য, মার্কেস থেকে কোচবিহারের রাজনৈতিক সাহিত্যিকদের পরিচয় করানো হল। আমাদের নির্মাণে কোনো সংকীর্ণতা আঞ্চলিকতা রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রশ্রয় পায়না, এবারও পায়নি।” (পৃ: ৩) প্রসঙ্গত এই সংখ্যার ক্রোড়পত্রের বিষয় ছিল গুজরাতি সাহিত্য।
দেবাশিস দত্তের সম্পাদনায় ‘বোদলেয়ার’-এর কথা উল্লেখ করতেই হয়। অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা (এপ্রিল ২০১২)-র ‘সম্পাদকীয় নয়, অ-কথা কু-কথা’ রচনাটি উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। ‘কবিতা ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বৃষ্টি, রূপকথা ও প্রতিবাদ জাগ্রত হউক’—এ আশা আমাদের সবার। ‘উত্তরবঙ্গের কৃষিজীবন’ প্রণেতা নৃপেন্দ্র লস্কর সম্পাদিত কৃষিবিষয়ক পত্রিকা ‘উজান’ ব্যতিক্রমী। বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সাহিত্য ভগীরথ’ পত্রিকার বিশেষ বাংলাদেশ গল্প সংখ্যা (১৪১৫), তরুণ দাশ সম্পাদিত ‘তিস্তা তোর্ষা সমাচার’-এর হরিশচন্দ্র পাল সংখ্যা (২০০৮-০৯), ‘আধুনিক কবিতা পরিচয়’ (অমল দেব সম্পাদিত)-এর শারদীয় সংখ্যা ১৪১৫ (ক্রোড়পত্র কোচবিহার পরিক্রমা) প্রভৃতির উল্লেখ থেকে বোঝা যাচ্ছে গত কুড়ি বছরে কোচবিহারের লিটল ম্যাগাজিন তার মতো করে বিভিন্ন বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করেছে। কোচবিহার তথা উত্তরবঙ্গ চর্চার ক্ষেত্রে ‘উত্তর প্রসঙ্গ’ নিঃসন্দেহে অদ্বিতীয় পত্রিকা। সম্পাদক দেবব্রত চাকী একের পর এক বিশেষ সংখ্যা উপহার দিচ্ছেন পাঠককে। ‘উত্তরবঙ্গের নদীকথা’ প্রকাশিত হয়েছে দুটি খণ্ডে। ‘দেশীয় রাজ্য কোচবিহারের অন্তর্ভুক্তি ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের ৬০ বছরের পটভূমিতে’ বিশেষ কোচবিহার জেলা সংখ্যা-১ (২০১১) প্রকাশিত হয়েছিল। সুনীল সাহা দীর্ঘদিন ধরে ‘সাহিত্যপত্র নবলিপি’-র সম্পাদনার কাজে রত আছেন। একঝাঁক তরুণেরা নতুন নতুন পত্রিকা প্রকাশ করছেন। প্রিন্ট ও ওয়েব দুটি মাধ্যমেই। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা গতানুগতিক এবং গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। শৌভিক রায় সম্পাদিত ‘মুজনাই’ অবশ্যই স্বতন্ত্রচিহ্নিত। ২০১৭ সালে ‘মুজনাই’ আয়োজন করেছিল লোকসংস্কৃতি বিষয়ক কর্মশালা ‘চিত্রলেখা’-র। হরিদাস পাল সম্পাদিত ‘রসিকবিল’ পত্রিকায় লেখক সমাবেশ লক্ষণীয়। শূন্য ও তার পরবর্তী সময়পর্ব নিয়ে ‘শাঙ্খিক’ (সুকান্ত দাস সম্পাদিত)-এর কর্মপ্রয়াস অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন সারা দেশেই আজ অতীতের উন্মাদনা হারিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা অনিবার্য ছিল। বিশ্বাস করি—বিশ্বায়ন, বাজার-অর্থনীতি আর অসুখের মধ্যে বিশল্যকরণী হয়ে উঠতে পারে লিটল ম্যাগাজিনই। তবে তার জন্য অনেক পথ হাঁটতে হবে। সব ম্যাগাজিনই ‘বারুদশালা’ হয়ে উঠতে পারে না।
পত্রিকার কথা এলে পুরস্কার কিংবা সাহিত্য উৎসবের কথা আসবেই। ত্রিবৃত্ত পুরস্কারের উজ্জ্বল ইতিহাস ও প্রাপকদের সম্বন্ধে আমরা অবগত আছি। এণাক্ষী মজুমদার তাঁর বইতে লিখেছেন—“বহুকাল আগে (১৯৭৩) অমিয়ভূষণকে প্রথম সাহিত্য-পুরস্কারটি দিয়েছিল কুচবিহারের ‘ত্রিবৃত্ত সংস্থা’।... রণজিৎ দেব নামে একজন তরুণ কবির সে এক দুঃসাহস। আরো বড় দুঃসাহসের কাজ অবশ্য তিনি করেছিলেন বছর কয়েক আগে। যে লেখকের বই কেউ পড়ে না, পড়ে না বলে কেউ ছাপে না, যে লেখক লেখেন নিজের খুশিতে, ছাপা হয় অনিয়মিত ভাবে স্বল্পখ্যাত পত্রিকায়, তাঁকে নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যা। সে হল আধুনিক সাহিত্য (চতুর্থ বর্ষ: প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ১৯৭০)।” (‘বনেচর’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৭, পৃ: ২৭) এই সারস্বত উদ্যোগে সমীর চট্টোপাধ্যায়ের কথাও এসেছে। আমরা এবার উদ্ধৃত করছি সমীর চট্টোপাধ্যায়ের ‘এই জীবন: কবিতা, এই অন্বেষণ’ লেখার অংশবিশেষ—“১৯৯৩ এর ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর তমসুক-এর ১০ বছর পূর্তিতে দু’দিন ব্যাপী পূর্বভারত কবি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। এ অঞ্চলে এ রকম সম্মেলন এই প্রথম। পূর্বভারতের অসমিয়া, ওড়িয়া, বাংলা, হিন্দী ও নেপালী ভাষার বিশিষ্ট ও তরুণ কবিরা এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল চিত্রশিল্পী প্রকাশ কর্মকারের ও তরুণ শিল্পীদের আর্ট ওয়ার্কশপ। এই অনুষ্ঠানকে বানচাল করতে কেউ কেউ তৎপর হয়েছিল। সম্মেলনে প্রধান অতিথি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে এক মিথ্যে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তাঁর আসা বন্ধ করেন ওরা। তবুও আলোক সরকার, সুব্রত রুদ্র, নীলমনি ফুকন, মনোরমা বিশওয়াল মহাপাত্র, অশ্রুকুমার সিকদার, প্রসন্ন পাটসানি, অনেক বিশিষ্ট ও তরুণ কবিদের উপস্থিতিতে সম্মেলন সফল হয়েছে। চিত্রশিল্পী প্রকাশ কর্মকার বিরাট ক্যানভাসে সবার সামনে ছবি আঁকলেন। ছবির নাম দিলেন ‘ভর’। সম্মেলন উপলক্ষে তমসুক-এর বিশেষ সংখ্যায় নির্বাচিত কবিদের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এই মর্যাদাপূর্ণ সংখ্যাটি বিদগ্ধজনের কাছে স্বভাবতই আদৃত হয়েছিল। এরকম পাঁচটি ভাষার কবিদের কবিতার অনুবাদ কোন লিটল্ ম্যাগাজিন করেছেন কিনা, আমার জানা নেই।” (‘আত্মস্মৃতিতে উত্তরবঙ্গ’, অজিতেশ ভট্টাচার্য (সম্পা.), সমীক্ষা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০২, পৃ: ২২৮) তোর্ষা সাহিত্য সংস্থা ২০১৫ সাল থেকে বার্ষিক লিটল ম্যাগাজিন মেলার আয়োজন করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলা এবং বাংলাদেশ থেকে বিগত বছরে প্রতিনিধিরা এসেছেন। এই উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন বই ও পত্রপত্রিকা। সম্মাননা জানানো হচ্ছে কবি, সাহিত্যিক ও পত্রিকাকে। বেসরকারি উদ্যোগে এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে আমাদের প্রেরণা যোগায়।
কোচবিহারের কবিতাচর্চা নিয়ে আলোচনায় আসা যেতে পারে। কবি-অধ্যাপক উত্তম দত্ত কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ধরে রাজনগরের বাসিন্দা। তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অংশ। তরুণ কবিদের আশ্রয়স্থল। তাই তাঁর কথা দিয়েই কবিতার কথকতা শুরু হোক। ‘বর্ণমালার দিব্যি’, ‘মৃত্যু-পরবর্তী প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের কবি ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-য় (প্ল্যাটফর্ম প্রকাশন, জানুয়ারি ২০২০) আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘উপমাই কবিত্ব’। তাঁর কবিতায় মিথপুরাণের ভাঙাগড়া দাবি করে মেধাবি মনোযোগ। ‘১৯৬৮’ কবিতার প্রথম স্তবকটি উদ্ধৃত করি— “তখন ভাতের ফ্যানকে আমরা অমৃত বলে ডাকতাম।/ মাঝে মাঝে স্বর্গ থেকে নেমে ইন্দ্রকাকু/ আমার মাকে একবাটি অমৃত দিয়ে যেত।/ দুপুরবেলা আমরা পাঁচ ভাই/ সেটা ভাগ করে খেতাম।/ মা আমাদের ইন্দ্রকাকু আর অহল্যা ম্যাডামের/ গল্প শোনাতেন।” (পৃ: ৩৭) তাঁর কবিতায় আখ্যানধর্ম আছে, কিন্তু কোনো কবিতাই আখ্যানসর্বস্ব নয়। প্রতিটি কবিতাই এক অর্থে কবির আত্মজীবনী। অদ্ভুত কৌশলে উত্তম দত্ত স্বপ্ন ও বাস্তবকে এমনভাবে মিশিয়ে দেন, বোঝা যায় না কে লিখছেন—কবি না পাঠক? স্মরণযোগ্যতা যদি কবিতার অন্যতম শর্ত হয়, তবে শোনা যাক এই পঙ্ক্তিদুটি—“মানুষের ভাষা তোমার আঙুল ছেড়ে চলে গেছে,/ আমাদের মৃত ডাকঘরে কতদিন তোমার চিঠি আসে না।” কিংবা ‘একটি কুড়িয়ে পাওয়া পাণ্ডুলিপি’-র শেষ লাইন—‘ফুল ফুটুক, না ফুটুক, বসন্ত আসিবে না। কেবল তুমি আসিলেই এদেশে বসন্ত আসিবে।’ কবিতা-বিষয়ক গদ্যের বই ‘কবিতার মনন ও মানচিত্র’ (তবুও প্রয়াস, ২০২০) থেকে কবির নন্দনভাবনার পরিচয় পাওয়া সম্ভব।
সুবীর সরকারের কবিতা যেন টুকরো টুকরো ছবির সংলাপ। পোস্টমডার্ন কবিতার বৈশিষ্ট্য তাঁর কবিতায় ধরা পড়লেও তিনি কোনো তত্ত্বের নিগড়ে বাধা পড়েননি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ—‘জ্যোৎস্নাগিটার’, ‘হরফলিপি’, ‘চর্যাপদের হরিণ’, ‘জাহাজডুবি’, ‘নির্বাচিত কবিতা’ প্রভৃতি। সঞ্জয় সাহা সম্পাদিত ‘তিতির’ পত্রিকায় (ডিসেম্বর ২০১৬) প্রকাশিত কবির ‘গ্যালারি’ কবিতাটি উদ্ধৃত করছি—“ঘুমের খুব কাছে তোমার ঘামে ভেজা/ মুখ/ সাঁকো থেকে লাফিয়ে পড়া ঘোড়াটি/ ইতিহাসপুরাণ রচনা করে ফেললে বিকেলমাঠে/ হাডুডু/ গ্যালারিতে বসে থাকছি আর বরফ/ পড়ছে।” (পৃ: ৬৭) মনে পড়ে উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জীবন নিয়ে লেখা কবি সুবীর সরকারের গদ্যগ্রন্থ ‘মাতব্বর বৃত্তান্ত’-এর (গাংচিল, ২০১৮) অংশবিশেষ—“বাঁশের সাঁকো থেকে দীর্ঘতম সুড়ঙ্গপথ—সমস্তটাই আমার কবিতা জীবন/ লোকায়ত ভুবন, যার ভিতর থেকে আমার আর কোনওদিনই বেরিয়ে আসা হবে না। অথচ ব্যাধ যুবকেরা সব একদিন ভুলে যাবে প্রলাপকথন। আর মাটির উঠোন থেকে অনিবার্য কিছু গান গোটা জীবন আমার সঙ্গে থেকে যাবে। আর জীবনের বৃত্তে ঘনঘন আছড়ে পড়বে উড়ন্ত ঘোড়া, হস্তচিহ্ন এবং উৎসব গাথা।” (পৃ: ১৭-১৮)
“কয়েকশ বছরের রাজনগর দীর্ঘ কবিতার মতো/ আমি পড়ি আনন্দ, বিষাদ ও প্রেম,/ পড়তে পড়তে মন ভারী হয়, ভালো থাকি না।”—অজিত অধিকারী লিখেছেন ‘রাজপাঠ’ কবিতায়। ‘চিলা রায়ের ভাঙা দুর্গ’ (নৈষ্ঠিক আকাদেমি, ২০১৭) কাব্যগ্রন্থে বিনির্মিত হয়েছে কোচবিহারের ইতিহাস। ‘রাজবাড়ির আশ্চর্য পাখিগুলি’ ই-বুক আকারে প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর; মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের প্রয়াণ দিবসে। ‘চরণামৃত’ কবিতায় কবি লিখছেন—“নৃপেন্দ্রনারায়ণ তোর্সার তীরে এসেছেন/ কবিতা খুঁজতেই তিনি এসেছেন/ চমৎকার জলে মুছে যাচ্ছে দুঃখলিপি”। ‘মাঠে মাঠে ক্লাসরুম’ (সিগনেট প্রেস, ২০১৮) কাব্যগ্রন্থেও আমরা পাই শান্ত এক কবিকে। যিনি কবিতায় ধারণ করেন রূপশালী ধান, রামপ্রসাদ, ভাওয়াইয়া কিংবা ভারতের ম্যাপকে। ‘লোকাল মানুষ’ কবিতার শেষে ধরা পড়ে অভিমানী স্বর—“সুতরাং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি আমি/ আমি লোকাল মানুষ।” (পৃ: ৪২) লোকায়ত চেতনার উদ্ভাসে রাজনগর নতুনভাবে ধরা দেয় তাঁর কবিতায়। রূপক সান্যালের ‘নির্মাণপর্ব’ (নীলাক্ষর, ২০১৩) অনুভবী মনের ফসল। কবিতার বই উৎসর্গ করা হয়েছে “কবিতা না লিখে যাঁরা থাকতে পারেন না/ কবিতা না পড়লে যাঁরা নিজেকে উপবাসী বোধ করেন/ তাঁদের সকলের প্রতি...”।
এবার আমরা তরুণ কবিদের সম্বন্ধে কথা বলব। পীযূষ সরকার (জন্ম--১৯৮৭)-এর কাব্যগ্রন্থ—‘সুতরাং শিস্ দিলাম’ (২০১০), ‘ভাঙা মানুষের রিংটোন’ (২০১৬)। রাজবংশী ভাষা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘আমাছামা চান’ (২০১৬)। ‘আমন ধান ও নিসর্গ সারিন্দা’ (২০০০) পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। শেকড় ছুঁয়ে মরমি স্বর প্রশ্ন তোলে—‘ভাষার স্বীকৃতি হয়, খিদের স্বীকৃতি নয় কেন’? সমকালকে আত্মস্থ করেই চিরন্তন কিছু পঙ্ক্তি উপহার দেন কবি—“সম্পর্কের বেশি কাছে যেতে নেই, সম্পর্কের বেশি দূরে যেতে নেই…/ প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব কবর।” প্রসঙ্গত তাঁকে নিয়ে কবি উত্তম দত্তের মূল্যায়ন মনে পড়ে—“বাংলার উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত মফসসলের এক তরুণ নিরন্তর আত্মখননের সংবেদনা নিয়ে লিখে চলেছে আশ্চর্য সব অন্তর্মুখী কবিতা”। বিপ্লব সরকার (জন্ম--১৯৯২) কবি ও অনুবাদক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ—‘ওঁ চিহ্নের সন্ধি’ (২০১৭), ‘চাপা পড়ে আস্ত শহর’ (২০১৮)। তাঁর ‘মা’ কবিতাটি উদ্ধৃত করছি—“ঋতু আসুক, না আসুক/ শিউলি গন্ধ আমার নিঃশ্বাসে/ ফুলের দুধে আমি শক্তি পাই/ উচ্চারণ করি ‘মা’/ বুক জুড়ে চলতে থাকে আলোড়ন/ মহীভবক ও গিরিজনি/ আমি বলতে পারি না—এসো ফুল/ আজ অন্তত তোমার পা ছুঁয়ে...”। কবি সন্তোষ সিংহের ‘স্বপ্নের কবিতা: সূর্যাস্তের ভাষা’র ইংরেজি অনুবাদ ‘Poems of Dreams : Language of Sunset’ (Evincepub Publishing, 2020) সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। দেশে-বিদেশে প্রশংসিত বিপ্লবের এই অনুবাদ কোচবিহারের লেখালেখির ক্ষেত্রে অশেষ গুরুত্বের। সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী পাঠকের কাছে পৌঁছুনোর জন্য সার্থক অনুবাদই যে একমাত্র ভরসা। ব্রহ্মজিৎ সরকার (জন্ম--১৯৮৬)-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জড়িয়ে আছি কাঁটাতার’ (২০১৭) নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
মানিক সাহার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ—‘ছায়ারোদের ব্রেইল’ (২০১৩), ‘জলজ্যোৎস্নার মেয়ে’ (২০১৭), ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ (২০১৯)। ‘সংসার’ কবিতায় লিখছেন—“আমাদের ব্যভিচারের গা’য় মৃদু হেমন্ত লেগে আছে/ হলুদ রঙের দাগ কিছুতেই ওঠানো যাচ্ছে না।” মূলত রোম্যান্টিক ঘরানার কবি লেখেন অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তি—‘গানকে যে বন্দী করতে জানে তার কাছে দুঃখ হেরে যায়’। মানিক সাহা তাঁর ‘কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলার শূন্য দশকের কবিরা’ (‘কবিতা করিডোর’, ৩১ আগস্ট ২০০০) গদ্যে ২০০৪ সালে প্রকাশিত অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ’২০ মিনিটের জন্য সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়’-কে শূন্য দশকের প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এসেছে উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মৃত্যুর পর যে ঘোড়ায় চড়ে তুমি দেশ পেরোবে’ (২০১৬) কাব্যগ্রন্থের প্রসঙ্গ। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ কবিতায় উদয়ার্ণব লিখছেন—“তোমার স্বপ্ন ঘিরে সারি সারি সাজানো চিতা।/ তবুও তুমি ভরসা রাখ তোমার দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর।” উদয় সাহা বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গ্রন্থ—‘পেজমার্ক’। ‘অধিক্ষেপ’ কবিতার শেষাংশ এরকম—“ওহে সাধুখাঁ, এটাই তো সময়/ আরো শক্ত করে হাতটা ধরবার/ আমাদের দুঃখগুলো জানালার সিট পাবেই।” ‘গানের সাঁকো’ কবিতাটির কয়েক পঙ্ক্তি উদ্ধার করা যেতে পারে—“বৃষ্টি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যায়/ বৃষ্টি-বাতাসের হাতে থাকে হরিণের আহ্বান.../ এইটুকুই তো ঘটনা/ তুমি বলবে, আমি বলব/ আর সহস্র বিস্ফোরণের ধোঁয়া মাখবে দূরভাষ।”
নীলাদ্রি দেব (জন্ম--১৯৯৫) কবিতার সংসারে পরিচিত মুখ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ—‘ধুলো ঝাড়ছি LIVE’, ‘জেব্রাক্রসিং ও দ্বিতীয় জন্মের কবিতা, ‘এবং নাব্যতা’। আবীর গাঙ্গুলি সম্পাদিত ‘মেলবন্ধন সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত ‘শ্বাস’ কবিতাটি উদ্ধৃত করছি—“কিছু একটা থেকে গেল/ শ্বাস থেকে বারবার শ্বাস উঠে আসছে/ না বলা কথা কবিতাতেও ধরতে নেই/ একটা ক্যানভাসের পাশে/ তুমি আবার এসে দাঁড়াবে কখনও।” সপ্তর্ষি বণিক (জন্ম--১৯৯৯)-এর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে—‘আস্ত শহর ঘুম দেয় এক মিথ্যে সুখে’ (২০১৯), ‘শহর অভিমান ভুলে’ (২০২০)।
রঞ্জন রায়ের কবিতার বই ‘তোর্ষা: দ্বিতীয় জন্ম’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। তিনি সম্পাদনা করেছেন কবি ভগীরথ দাসের ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০১৯), নিখিলেশ রায়ের ‘কবিতা সংগ্রহ’ (সোপান, ২০২০) এবং সমীর চট্টোপাধ্যায়ের ‘কবিতা সমগ্র’ (২০২০)। সবগুলি বইয়ের প্রকাশক—সোপান। তাঁর সারস্বত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে কবিদের যেমন নতুনভাবে চিনতে পারব আমরা, তেমনই গবেষণার জন্য তৈরি হয়ে রইল অপূর্ব রসদ। রঞ্জন রায়ের গল্প ও গদ্যগুলি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
কোচবিহারে নারীদের লেখার ধারাটি অতীতে বেশ শক্তিশালী ছিল। বৃন্দেশ্বরী দেবী, সুনীতি দেবী, সাবিত্রী দেবী, নিরুপমা দেবীর সাহিত্যকীর্তি যতটা আলোচনা দাবি করে, তার ভগ্নাংশও হয়নি। মহিলা সম্পাদিত সাহিত্যপত্র হিসেবে নিরুপমা দেবীর ‘পরিচারিকা নব পর্যায়’ (১৩২৩-১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) ইতিহাসে বিশেষ স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাশ, কালিদাস রায়, শৈলবালা ঘোষজায়া প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকায়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে কবি, রাজনৈতিক কর্মী অপরাজিতা গোপ্পীকে আমরা পেয়েছি ‘সীমান্ত’ (১৯৫৮) পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। শাশ্বতী দেব সাপ্তাহিক ‘ত্রিবৃত্ত’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। গৌরী সাহার সম্পাদনায় ‘কৈশোর’ (১৯৮৭), চৈতালি ধরিত্রীকন্যা সম্পাদিত ‘সারথী’ পত্রিকার কথা উল্লেখ্য। মাধবী দাস বর্তমানে সম্পাদনা করছেন ‘গোল্লাছুট’ পত্রিকাটি। ‘কবিতা পাক্ষিক’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি কবিতার বই—‘অযোগবাহ বর্ণ’ (২০১৭) ও ‘আদি ধর্মকথা’ (২০১৮)। পকেটবুক—-‘ঋতুজন্ম’ (শব্দসাঁকো, ২০১৯)। ‘টার্মিনাস’ থেকে ‘সন্ধ্যার সিলিকন’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ আসন্ন। ‘চিন্তাপাখি’ কবিতায় কবি লিখছেন—“আমি শুধু দেখছি/ ছোটো ছোটো ইচ্ছে বৃষ্টি হয়ে/ ছিটকে পড়ছে আলো অন্ধকারে/ আমাদের প্রিয়পথ একা একা ভিজছে নির্বিচারে।” আবার লেখেন—‘পথ-হারানো নাবিক আমি/ চোখের সামনে জলজ পর্দা’। প্রতিদিনের সংসার থেকেই তিনি খুঁজে নেন কবিতার রসদ। অক্ষরবৃত্তে মূর্ত হয় কবিতার গেরস্থালি।
পাপড়ি গুহ নিয়োগী গুরুত্বপূর্ণ কবি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ—‘বাঘছাল গন্ধের মেয়ে’ (ধানসিঁড়ি, ২০১৬), ‘শূন্য আঁকি, মৃত্যু আঁকি’ (গাংচিল, ২০১৮), ‘নাভিজল’ (ধানসিঁড়ি, ২০১৮), ‘ফিরতে চাই ডাকনামে’ (আলোপৃথিবী, ২০১৯), ‘নেক্রপলিস’ (বৈভাষিক, ২০২০)। ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ কবিতাটি সমকালের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়—“শহর রাতদিন চিৎ হয়ে ঘুমায়/ রাস্তা কারখানা ধর্মস্থান শপিং মল সিনেমা হল/ ঘুমায় আমাদের মানচিত্র/ শুধু জেগে থাকে গরিবের পেট/ আমি মধ্যবিত্ত চিবুক শক্ত করে/ পাণ্ডুলিপি গোছাই।” সম্পর্কের গল্প তাঁর কবিতায় নতুন মাত্রা পায়। যেমন মাত্র তিন পঙ্ক্তির ‘ব্রেকআপ’ কবিতাটি—“তুমি, আমি/ আমরা হচ্ছি না/ সম্পর্কে জল দাও”। রীনা সাহা নিয়মিত কবিতা ও গল্প লিখছেন। মঞ্জু ঠাকুর চৌধুরী, শিউলি চক্রবর্তীর গল্প সুপাঠ্য। জন্মসূত্রে দিনহাটার, বর্তমানে দক্ষিণবঙ্গের বাসিন্দা ওয়াহিদা খন্দকারের দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে—‘নীরব দশমিকের ভিড়’ ও ‘বিবর্ণ স্লেটের সমীকরণ’। তরুণ কবি পূর্বালী চক্রবর্তী, বাসবদত্তা চক্রবর্তী, রেনেসাঁ সাহা, সংকলিতা সান্যাল, গল্পকার নন্দিতা বর্মনের লেখার দিকে আমাদের অবশ্যই নজর রাখতে হবে।
রাজনগরের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসের নাম অবশ্য উল্লেখ্য। আশৈশব বড়ো হয়ে ওঠা এখানেই। পরবর্তীকালে চাকরিসূত্রে দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন জলপাইগুড়িতে। তাঁকে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত করে দেখা হয়—এখানেও আমরা সেই রীতি অনুসরণ করেছি। তবে একটা কথা বিশেষভাবে বলার, লেখকের ‘কুয়াশার গন্ধ’, ‘নদী ছুঁয়ে ছুঁয়ে ইতিহাস’, ‘ভোরের প্ল্যাটফর্ম’ প্রভৃতি আত্মজৈবনিক আখ্যানে বিশেষভাবে রয়েছে কোচবিহার। ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘মহারাণী কথা’। উপন্যাসটি নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছে কেশবকন্যা সুনীতি দেবীর বর্ণময় জীবনকে। সুচন্দ্রা ভট্টাচার্য লোকসংস্কৃতি গবেষক ও আখ্যানকার। তাঁর ‘রাজবংশী ব্রতকথা’ (গাংচিল, ২০১২) নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। রাজবংশী সমাজের ষষ্ঠীর ব্রত নিয়ে ‘ষাইটোরী মাও’ (আনন্দ) পাঠকমহলে সমাদৃত। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘ব্রতকাহিনি’। লোকায়ত চেতনা ও আধুনিক জীবনবোধের মিশ্রণে তাঁর গল্পগুলি অনন্য হয়ে ওঠে। আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে তন্দ্রা চক্রবর্তী দাসের প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে। ড. পম্পা দাসের গবেষণাগ্রন্থ ‘মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ও তৎকালীন কোচবিহার সমাজ ও সাহিত্য’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে রেণু প্রকাশনী থেকে ২০১৫ সালে।
‘অপরাজিতা অর্পণ’ পত্রিকার সম্পাদক, কবি লক্ষ্মী নন্দী অকালে চলে গেলেন। আমরা একজন দক্ষ সংগঠককে হারালাম। সে অভাব ভবিষ্যতে আরো গভীরভাবে অনুভূত হবে। এইসময়ে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, লেখালেখির ক্ষেত্রে রাজনগরের নারীদের আরো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন।
শৌভিক রায়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফালাকাটায়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কোচবিহারের বাসিন্দা। কবিতা, গদ্য, গল্পে তাঁর অবাধ বিচরণ। কবিতার বই—‘ইচ্ছামতির স্বপ্নাদেশ’ (২০১৪), ‘বৃত্তপথ’ (২০১৫), ‘ডুয়ার্সের নোটবুক’ (২০১৭)। ভ্রমণ কাহিনী ‘GO আ’ (২০১৬)। ‘সুরমা কলিং’ (২০১৭) ও ‘মেঘ মেঘ বাদল বাদল’ (২০১৮) গল্পের বই। ‘শব্দ ছবির ডুয়ার্স’ (২০১৭) বইটি পড়ে বোঝা যায় তিনি ছবি তোলেন এবং ছবি লেখেন। ‘মুজনাইয়ের বালক’ (চিত্রাঙ্গী, ২০১৬) বইটি থেকে চমৎকার স্মৃতিমাখা গদ্যের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি—“ফালাকাটার ‘কল্যাণী’ আমাদের ভীষণ আদরের ছিল। আদরের বললাম তার কারণ আমরা কল্যাণীর উপর রাগ করতাম, প্রতিজ্ঞা করতাম কোনওদিন কল্যাণীর দিকে তাকাব না, পেছনে কল্যাণীর নিন্দে করতাম, কল্যাণী কেন এরকম করে সেটা নিয়ে তর্ক করতাম কিন্তু অমোঘ টানে কল্যাণীতেই যেতাম। কল্যাণী আর কেউ নয়। ফালাকাটা-কোচবিহারের মধ্যে চলা একটি বাস।” (পৃ: ৫৯) ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখক ডুয়ার্স বিষয়ক গদ্য লিখছেন। ইতিহাস, স্মৃতি মিলিয়ে পাঠককে নিয়ে যান অক্ষর ভ্রমণে।
ভ্রমণের কথাতেই মনে পড়ে সঞ্জয় সাহার ‘সফরনামা রাজভূমি রাজস্থান’ (২০১৪), ‘আমার বাংলাদেশ ভ্রমণ সাজিয়া থেকে সৌদামিনী’ (২০১০), ‘কোচবিহার থেকে কাশী ভ্রমণ ও মানসভ্রমণ’ (২০১২) বইগুলির কথা। সম্পাদক সঞ্জয় সাহার সঙ্গে সঙ্গে কবি-লেখক সঞ্জয় সাহার সঙ্গেও বেশি করে পরিচিত হওয়া দরকার আমাদের।
এবার আমরা চলে যাব কথাসাহিত্যের আলোচনায়। শ্যামল সরকারের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ—‘ভাঙা বুকের কথকতা’ (বইওয়ালা, ২০১০)। আশিস ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘দশদিগন্ত’ পত্রিকায় বেশ কিছু ভালো গল্প ও গল্পকারের সন্ধান পেয়েছিলাম আমরা। যাঁরা মূলত প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও প্রচারবিমুখ। আশিস ভট্টাচার্যের গল্প ‘দহন’, ‘বুবি’, ‘তেজি ভুটিয়া’, ‘কফিনের অন্ধকার’, ‘মিনিস্টার’ এবং ‘কোনও এক অরণ্যের অনুভব’ উপন্যাসটি পড়লে লেখকের স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হবে। শঙ্খজিৎ দাস, প্রশান্তকুমার রায় গল্পকার হিসেবে উল্লেখযোগ্য। সুজয় বিশ্বাসের ‘মায়াবী শহরে বৃষ্টি’ (প্রকাশক—জয়ন্তনাথ সরকার, ২০১৯) আখ্যানের একটি অংশ উদ্ধৃত করছি—
“আলো আলো নিজে এসে হয়তো ধরা দেয় না; কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজতে হয়। আলো ছড়িয়ে থাকে চারপাশে, মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনযাপনে, প্রতিনিয়ত; —শুধু তাকে দেখার মতো চোখ আর অনুভব করার মতো মন চাই।...” (পৃ: ১৬)
দেবজ্যোতি রায়ের ‘নরকের থেকে একটু করো অনির্বচনীয় মেঘ’ (কোয়ার্ক পাবলিশার্স, ২০১৯) উপন্যাসটি ফর্মের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাহিনি বর্ণনার যেন কোনো দায় নেই লেখকের। শুধুমাত্র নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জীবনদর্শন বিবৃত করা মাত্র। আত্মজৈবনিক এই উপন্যাস থেকে আমরা জানতে পারি, কথক সক্রিয়ভাবে নকশালবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। নকশাল প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে সইতে হয় চরম অত্যাচার। জেল থেকে বেরিয়ে এসেও স্বপ্ন দেখার সাহস মুছে যায়নি কথকের। ডুয়ার্সের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় কাজ করতে গিয়ে তিনি খুঁজে পান বিপ্লবের অক্লান্ত কিছু কর্মীকে। পার্টির পুনর্গঠনের সঙ্কল্প ধাক্কা খেল অভ্যন্তরীণ গোলযোগেই। স্বপ্নদর্শীদের বহু ঐকান্তিক পরিশ্রমে তৈরি কর্মসূচীকে একবার ছুঁয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি নেতারা। নকশাল আন্দোলনের সূত্রেই লেখক খুব ভেতর থেকে জেনেছেন গ্রামের জীবনকে। মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাষাবোধ দিয়ে যে কথাগুলোকে বলা যায় না। বোঝানো যায় না। এই উপন্যাসে স্ল্যাং হয়ে উঠেছে আমাদের অস্তিত্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার অন্যতম চাবিকাঠি।
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ (বৈভাষিক, ২০১৭) উপন্যাসের সূচনায় একটি প্রশ্ন তুলেছেন—“কী এই বেঁচে থাকা? কাকে বলে বাস্তব?” তারপর সমগ্র উপন্যাস জুড়েই চলে বাস্তবতার বিনির্মাণ। উপন্যাসের শুরুতে দেখি কোচবিহার স্টেশনে ঢুকছে ব্যাঙ্গালোর সিটি এক্সপ্রেস। বঙ্কিমচন্দ্রের ঘুম যখন ভাঙল, ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। রাত আড়াইটেয় তিনি নামলেন আলিপুরদুয়ারে। এখানে আবার মান্টো থাকেন। বৃষ্টির রাত। অন্ধকার স্টেশন। ডিজিটাল বোর্ডের ঝাপসা আলো। জলরঙের জ্যামিতি। জলের শব্দ আর বৃষ্টি কুয়াশার মধ্যেই বঙ্কিম কর্নেল বলে একজনকে ডাকলেন। বাঁ কাঁধে বাজপাখি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। বঙ্কিমকে চিনতে পেরে আলিঙ্গন করলেন। তাঁর নাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। উত্তরবঙ্গের একপ্রান্তিক স্টেশনে আখ্যানকার এভাবেই মিলিয়ে দেন পৃথিবীর দুইপ্রান্তের শিল্পীকে। কথায় কথায় জানা যায় বঙ্কিম কোচবিহারে যাচ্ছেন মধুসূদনের চিঠি ফেরত আনতে। মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণের কাছে ১৮৬০ সালে চাকরির জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন মধুকবি। ইতিহাসের তথ্য আর কল্পনা মিলে তৈরি হচ্ছে এক অন্য বাস্তবতা। নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিককালের অন্যতম সেরা উপন্যাস ‘বঙ্কিমচন্দ্র’।
তরুণ লেখক সমিত ভৌমিকের তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে—‘বিক্ষত মানুষ’, ‘বরফের নীচে অন্ধকার’ ও ‘ভোরের আলো’। প্রলয় নাগ শক্তিশালী গল্পকার। একুশ শতক থেকে রয়েছে তাঁর দুটি গল্পগ্রন্থ—‘কাকতাড়ুয়ার গল্প’ (২০১৮), ‘এক পাগলের বটজন্ম কথা’ (২০২০)। শেষোক্ত বইতে রামু আর লালনের ‘সাঁকো’ তৈরির গল্প স্বপ্নময় হয়ে ওঠে—“লালন সাঁকো পেরিয়ে এ গ্রামে আসে আবার, রামুও ওই গ্রামে যায়। সন্ধে হলে জোনাকিরা আবার আলো হাতে বের হয়। কাঠকুঠালি গাছের খোড়লে বসে একা একা আবার মামা বাড়ির আলো দেখে।” (‘সাঁকো’, পৃ: ৩০) লতিফ হোসেন (জন্ম--১৯৯০) বিভিন্ন পত্রিকায় ও সংকলনে গুরুত্বপূর্ণ গল্প লিখেছেন। অভিযান পাবলিশার্স থেকে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গল্পের বই—‘ইবলিশনামা’ (২০২০)।
রাজ আমলে প্রকাশিত বইগুলির পুনঃপ্রকাশের চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন গবেষক। রণজিৎ দেব, নৃপেন্দ্রনাথ পাল, বিশ্বনাথ দাস প্রমুখের নাম করতেই হয় এই প্রসঙ্গে। বর্তমান সময়ে আরো কেউ কেউ এই কাজে এগিয়ে এসেছেন। জয় দাস ও রুম্পা দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে কোচবিহারবাসীর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘আমিনা’ (সোপান, ২০১৮)। সম্ভবত রঙ্গিল নারায়ণের দ্বারা লিখিত এই ঐতিহাসিক আখ্যানটি মুদ্রিত হয়েছিল ১৮৮২ সনে। চিরঞ্জীব শর্ম্মা (ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের ছদ্মনাম) লিখিত ‘নববৃন্দাবন’ নাটকটি ‘কোচবিহার রাজকীয় যন্ত্রালয়ে রাজকীয় সাহায্যে মুদ্রিত’ হয়েছিল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। সেই বিখ্যাত নাটকটিকেও এবছর পাঠকের দরবারে পুনরায় হাজির করেছেন জয় দাস ও রুম্পা দাস। প্রকাশক পাড়ি। ক্ষেত্রমোহন ব্রহ্মের লেখা ‘নূতন সচিত্র-বর্ণপরিচয়’ বইটিও সঞ্চারী ব্রহ্ম ও জয় দাসের সৌজন্যে প্রকাশের অপেক্ষায়। সবিনয়ে জানাতে চাই বয়েজ ক্লাবের দুর্গাপুজার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশ পায় একটি বিশেষ সংকলন—‘দুর্গামঙ্গল’ (দে’জ পাবলিশিং, ২০১৭)। বইটির সম্পাদনার ভার ন্যস্ত হয়েছিল এই কলমচির ওপর। কোচবিহারের শক্তি আরাধনা নিয়ে মূল্যবান কয়েকটি প্রবন্ধ রয়েছে সেখানে। আমরা সকলেই জানি বিখ্যাত ‘কোচবিহার দর্পণ’ পত্রিকার কথা (১৩৪৫-১৩৫৪ বঙ্গাব্দ)। সেই বিখ্যাত পত্রিকার থেকে নির্বাচিত উনিশটি প্রবন্ধ ও সংবাদ নিয়ে সম্পাদনা করেছি ‘কোচবিহার দর্পণ: নির্বাচিত প্রবন্ধ ১’ (পাড়ি, ১৪২৫ ব.)। নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের ‘কোচবিহারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণটি (১৯২৭) পাড়ি প্রকাশনী থেকে পুনঃপ্রকাশ করেছি ২০১৯ সালে। ‘কোচবিহারের রাণী নিরুপমা দেবীর নির্বাচিত রচনা’ (২০১৯) শীর্ষক সংকলন প্রকাশ পেয়েছে এখন ডুয়ার্স থেকে। ‘পরিচারিকা নব পর্য্যায়’ পত্রিকার সম্পাদক, সুকবি, নিরুপমা দেবীর আত্মকথা, নির্বাচিত কবিতা-গল্প-গদ্য-প্রবন্ধ-অনুবাদ পাওয়া যাবে এই বইতে। ‘কোচবিহার: ইতিহাস ও সাহিত্য’ (ছোঁয়া, ২০১৯) বইটি মধুরিমা চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে সম্পাদিত। উনিশ জন প্রাবন্ধিকের লেখায় রাজনগরের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বহুমাত্রিক পরিচয় ফুটে উঠেছে।
মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের শিকারকাহিনি ‘Thirty-Seven Years of Big Game Shooting in Cooch Behar, the Duars, and Assam: A Rough Diary by the Maharaja of Coochbehar’ (১৯০৮)-এর চমৎকার অনুবাদ করেছেন অনিরুদ্ধ পালিত। ‘কোচবিহার ডুয়ার্স ও আসামে শিকারের সাঁইত্রিশ বছর একটি খসড়া দিনলিপি’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়েছে পার্চমেন্ট থেকে ২০২০ সালে।
রাজর্ষি বিশ্বাস সুগবেষক। প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থ—‘কোচবিহার নামা’। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। ‘বেরুবাড়ি তিনবিঘা ছিটমহল: ইতিহাস জনজীবন সংস্কৃতি’ (গাংচিল, ২০১৮) বইয়ের ‘এই ট্রিলজি’ শীর্ষক প্রারম্ভিক অংশে স্পষ্টভাবে বলেছেন তাঁর পরিকল্পনার কথা—“‘বেরুবাড়ি-তিনবিঘা-ছিটমহল’ বিষয়টি উত্তরের সীমান্ত-সমস্যার ‘ট্রিলজি’-ই নয়, তা ছিল বাস্তবে দেশভাগেরই ফেনোমেনন। আর তিনটি অধ্যায়ই একে অপরের সঙ্গে গভীর সম্পর্কিত। আর এই ‘ট্রিলজি’র কোনও একটির পৃথক আলোচনা ও চর্চা করলে দেশভাগ-উত্তরকালের সীমান্ত-সমস্যার প্রকৃত চিত্রটি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।” (পৃ: ৯) আলোচ্য সংকলনে ‘সাবেক ছিটমহলের প্রাচীনতম টেরাকোটা মন্দির’ নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন শঙ্খনাদ আচার্য। দিব্যেন্দু ভৌমিক লিখেছেন ‘কেমন আছেন সাবেক ছিটমহলের নারীরা’। মহম্মদ লতিফ হোসেন ‘ছিটমহল কেন্দ্রিক সাহিত্য: স্বতন্ত্র প্রকরণের খোঁজে’ লেখায় এসেছে অমর মিত্রের ছিটমহল নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ ও সেলিনা হোসেনের ‘ভূমি ও কুসুম’-এর প্রসঙ্গ। ছিটমহলের সাহিত্য পড়তে গিয়ে আত্মপরিচয়ের যে সংকটকে তিনি প্রত্যক্ষ করতে চান, তার সূত্রে দেশভাগের কথা এসে পড়ে অনিবার্যভাবে। কাকে ছিটমহলের সাহিত্য বলা হবে তা নিয়ে বিস্তৃত তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন বরেন্দু মণ্ডল, তাঁর সম্পাদিত ‘ছিটমহলের গল্প’ সংকলনের (সোপান, ২০১৮) ‘ছিটমহল গল্পপাঠের প্রস্তাবনা’ অংশে—“দেশভাগের ফলশ্রুতি হিসেবে ছিটমহলের গল্পকেও কেউ কেউ পার্টিশনের গল্প হিসেবে দেখতে চান, তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না—যদিও সময়, অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যের নিরিখে পার্টিশনের গল্প হিসেবে না পড়ে, এগুলিকে পোস্ট-পার্টিশনের গল্প হিসেবে দেখা যেতেই পারে। ছিটমহলের মানুষজন তো স্বভূমে পরবাসী। সবাই না গেলেও ছিট বিনিময়ের পরে অনেকেই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যদিও উদ্বাস্তুদের মতন তাঁদের দিশাহীন পথের যাত্রী হতে হয়নি। ফলে সামগ্রিকভাবে এই গল্পগুলিকে সরাসরি রিফিউজি-স্টাডিজ-এর বৃত্তে ফেলা সমীচীন হবে না। তাই আমরা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনও একটি বিকল্পের কথা না ভেবে ‘এনক্লেভ’ বা ছিটমহল নিয়ে লেখা সাহিত্যকে সরাসরি ‘এনক্লেভ লিটারেচার’ বা ‘ছিটমহলের সাহিত্য’ বলতে চাই।” (পৃ: ৯)
রাজর্ষি বিশ্বাস সম্পাদনা করেছেন ‘ছিটমহলের নতুন গল্প’ (গাংচিল, ২০১৮)। শৌভিক রায়, বিমল বসাক, জয়ন্ত গুহঠাকুরতা, শিউলি চক্রবর্তী, দীপায়ন ভট্টাচার্য, কিশোরনাথ চক্রবর্তী, আহসানুল করিম, রঞ্জন রায়, মাধবী দাস, অমর চক্রবর্তী, আশিস দে সরকার, রীনা সাহা, রাজীব রায়, সুনীল সাহা, পরেন চন্দ্র রায় বর্মন, অমলকৃষ্ণ রায়, লক্ষ্মী নন্দী, রাজর্ষি বিশ্বাস, মহম্মদ লতিফ হোসেন, পাপড়ি গুহ নিয়োগী, দীপায়ন পাঠক, শাঁওলি দে, উদয় সাহা প্রমুখ লেখকের গল্পে সমৃদ্ধ হয়েছে এই সংকলন। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ভারত-বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময়ের আগে-পরে বিদ্যায়তনিক পরিসরে ছিটমহল বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। যদিও ‘প্রশাসনিক অর্থে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কোনও ছিটমহলের অস্তিত্ব আর নেই।’ শুধু কোচবিহার নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিয়েছে নতুন একটি মানবিক ভুবন। কোচবিহারের লেখকেরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাকে লিপিবদ্ধ করছেন। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, লেখকদের কি নির্দিষ্ট স্থানিক গণ্ডিতে আটকে রাখা যায়? উত্তর অবশ্যই না। কিন্তু একটি অস্তিত্বের অঞ্চল কীভাবে ক্রিয়াশীল থাকে শিল্পীর চেতনায়, তাকে লক্ষ্য করাও জরুরি। সাহিত্যের আলোচনায় যে প্রবণতার কথা আমরা শুরুতেই বলেছিলাম, তার সূত্র ধরেই ছিটমহল ও সাম্প্রতিক কোচবিহারের লেখালেখিকে ধরতে চাইছি আমরা। এবং যে কথাটি না বললেই নয়, ছিটমহলচর্চার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন দেবব্রত চাকী। ‘ব্রাত্যজনের বৃত্তান্ত: প্রসঙ্গ ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল’ (সোপান, ২০১১) এই বিষয়ে আকর গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে সিনিয়ার ফেলোশিপ নিয়ে লিখেছেন গবেষণা-সন্দর্ভ ‘অথ ছিটমহল কথা’। তাঁর সম্পাদিত ‘উত্তর প্রসঙ্গ’ পত্রিকায় ছিটমহল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।
‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকা ও প্রকাশনা উত্তরবঙ্গ চর্চার ক্ষেত্রে আশার আলো সঞ্চার করেছে। প্রদোষ রঞ্জন সাহা সম্পাদিত ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘কোচবিহার’ সংকলনটি প্রবল জনপ্রিয় হয়েছে। তন্দ্রা চক্রবর্তী দাসের ‘প্রাণের ঠাকুর মদনমোহন’ (২০১৮) বইটি লেখায়-ছবিতে মনোগ্রাহী। অসামান্য ‘মুখবন্ধ’ লিখেছেন স্বপন কুমার রায়। গ্রন্থকারের কথা মনে দাগ কাটে—“ঐতিহ্যবাহী এই মদনমোহন বাড়ি যেন একটি খনি। রাজ পরম্পরা মেনে এখানে আজও চলে আসছে কত রীতিনীতি। এই বিস্মৃতির যুগে এখনও যেভাবে এখানে বিভিন্ন প্রথাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে তা সত্যিই অবাক করে। তবে ভক্তিতেই হোক, বা ভালোবাসাতেই হোক, কোচবিহারবাসীর জীবনে যাপনে, এক কথায় রক্তে মিশে গিয়েছে তাদের প্রাণের ঠাকুর মদনমোহন।” (পৃ: ২১) এখন ডুয়ার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে অভিজিৎ দাশের লেখা ‘তিস্তা: উৎস থেকে মোহনা’ (২০১৯) বইটি। মোট পনেরোটি অধ্যায়ে প্রাবন্ধিক তিস্তাকে কেন্দ্র করে রচনা করেছেন পুরাণ, ইতিহাস, কিংবদন্তির অপূর্ব আলেখ্য। সাহিত্যে তিস্তা উপস্থাপন থেকে তিস্তা অববাহিকার অধিবাসীদের যাপনকথা, তিস্তা জলবন্টন, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প এমনকি এই অঞ্চলে পর্যটনের সম্ভাবনাও আলোচিত হয়েছে। হরিপদ রায়ের লেখা ‘গণ আন্দোলনে কোচবিহার’ (২০১৯) বইয়ে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ, অসহযোগ আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন; স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়পর্বে খাদ্য আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, তিনবিঘা চুক্তিবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রতিক ছিটমহল আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণ আন্দোলনের ইতিহাস উঠে এসেছে। বইটির সম্পাদনা করেছেন—অভিজিৎ দাশ। ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে কোচবিহার নিয়ে মূল্যবান লেখালেখি প্রকাশিত হচ্ছে, তার আলোচনা অবশ্য পৃথক প্রবন্ধের দাবি রাখে।
‘রাজবংশী সমাজদর্পণ’ (ভাষাবন্ধন, ২০১২), ‘মৈষালের বাথাননামা’ (দি সী বুক এজেন্সী, ২০১২) প্রভৃতি বইয়ের লেখক জ্যোতির্ময় রায়ের কথা আমরা সকলেই জানি। রাজবংশী ভাষা ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে তাঁর অসামান্য পরিশ্রমী গবেষণা। আমরা বরং তাঁর ‘উত্তরের অসুখ’ (পাঠক, ২০১৪) কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতার অংশবিশেষ পড়ি—“আমাদের সান্ধ্যবাসরে চায়ের সুবাস/ রাত্রিকথায় ভাষ্য আলাপ ইতিহাসের মুখ/ সুখময় অবকাশে উঁকি দেয় উত্তরের অসুখ/ পথ ও প্রান্তিকতায় মুখ চেয়ে থাকে অবয়বে/ অন্ত্যাক্ষরীতে শুধু গান ভেসে যায়”। এখানে লেখাটির ইতি টানলেই ভালো হতো কিন্তু কয়েকটি কথা না বললেই নয়।
রাজ-আমলে মুদ্রিত বইগুলির পুনঃপ্রকাশ বিষয়ে সরকারি সহযোগিতা কাম্য। একটি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গড়ে তোলা জরুরি। সেইসঙ্গে কোচবিহারের লেখককের বই সংরক্ষণ ও বিপণনের সুব্যবস্থা করতে হবে। কলকাতার স্বীকৃতি, পুরস্কার, প্রচারের আলো থেকে দূরে যে সমস্ত ব্যক্তিরা সততার সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করছেন, তাঁদের সম্বন্ধে আলোচনা করবার দায় ও দায়িত্ব আমাদের সকলের। সংকীর্ণ গোষ্ঠীপরিচয়ে আটকে না থেকে সমবেতভাবে কোনো সাহিত্যিক প্রকল্প নেওয়া যায় কিনা, বিদ্বৎজনেরা নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন। পরিশেষে বলতে হয়, অমিয়ভূষণ মজুমদার কিংবা অরুণেশ ঘোষের সার্থক উত্তরাধিকারী হয়তো এইসময় থেকেই উঠে আসবে, কিন্তু তাঁকে গ্রহণ করবার জন্য যে প্রস্তুতি প্রয়োজন; তা যেন আমাদের থাকে।
পুনশ্চ—এই লেখায় সকলের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। তার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। শেষপর্যন্ত কোনো লেখাই নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বিবিধ অসম্পূর্ণতা, অসঙ্গতিই বোধহয় লেখাটির অভিজ্ঞান। সেক্ষেত্রে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলবার ভার আপনাদের হাতে—হে পাঠক, সুধী...।