• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • বিপাশার পাশে : রাহুল মজুমদার

    ১২ অক্টোবর; ১৯৯৯

    বেলা ১২.৩১- ভারতীয় রেল ঐতিহ্য বজায় রেখে মাত্র চার ঘন্টা লেট করে আমাদের দুজনকে ঘাড় থেকে নামাল নিউ দিল্লী স্টেশনে। রীতিমতো কসরত করে ওয়েটিং রুমে ওয়েট করতে সমস্ত ওয়েট নিয়ে (লটবহর ছাড়াও, নিজেদের ওয়েটও তো মন্দ নয়) হাজির হয়েছি। গিন্নীকে মাল পাহারায় রেখে পেট বোঝাই করার মালের খোঁজে বেরোচ্ছি। পেটে ছুঁচোদের নামসংকীর্তন ‘জোর শোরসে’ চলছে।

    বেলা ১.৩০- এবার ঝিমিয়ে নেওয়ার পালা। মানালি যাওয়ার বাস সেই শেষ বিকেলে।

    সন্ধে ৭.১৭- মানালির বাসে বসে সাতসতেরো ভাবছি। বাস এখনও বিশ্রাম মোডে।

    রাত ১১.০৩- রাত কা খানা, বাথরুম জানা।

    ১৩ অক্টোবর

    ভোর ৪.৩৪- বাস আঁধারের পিছু ছাড়িয়ে আলোর দিকে ছুটছে। এবার পিছনবাগে ছুটে চলা গাছপালা পাহাড় বিয়াস নদীর মনভোলানো রূপ চোখে পড়ছে।

    সকাল ৬.৫১- একটা মন্দিরের গা ঘেঁষে বাস দাঁড়িয়ে। ভক্তেরা মন্দিরের বন্ধ দরজাতেই পেন্নাম ঠুকছে গেছে। আমাদের অবশ্য টান রূপসী বিয়াসের দিকেই। সে তার পান্নাসবুজ মেশানো জল ছিটিয়ে নাচে মেতেছে।

    সকাল ৮.০৮- সারারাত দৌড়োবার পর মানালি বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বাস। আমরাও নেমে বাঁচলুম। মানালিকে ভালোবাসতে আড়াই মিনিটের বেশি লাগল না।

    সকাল ৮.৩৮- সব মুখ উধাও। এই প্রথম কলকাতা থেকে হোটেল বুক করে এসেছি। হোটেলের বাইরেটা দেখেই মনটা দমে গিয়েছিল, ভেতরটা বুক ভেঙে দিল। পায়রার খোপের মতো ছোট আর নোংরা ঘর, আয় আমাদের বরাদ্দ চিলেকোঠার ঘর। স্বর্গের, থুড়ি, নরকের সিঁড়ি ভেঙে পাঁচতলায় নরকবাস করার কথা ভেবেই মন বেঁকে বসল। বোঝার ওপর শাকের আঁটি পড়ল, যখন শুনলাম খাওয়ার জন্য যেতে হবে ওঁদেরই অন্য হোটেলে। স্পষ্টই জানিয়ে দিলাম, বুকিংয়ের টাকা চুলোয় যাক, এখানে আর এক মুহূর্তও নৈব নৈব চ।


    সকাল ৯টা- আমাদের ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা শুনে হোটেল কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল। তাঁরা ঘাড়বেঁকা জমিদারের ভূমিকা ছেড়ে বিনয়াবনত সেবকের পোশাক পরে ফেললেন। সসম্মানে তাঁদের ‘অন্য হোটেলে’ নিয়ে এলেন, যেখানে আমাদের খেতে আসতে হতো। দিব্যি ঝকঝকে আধুনিক হোটেল। দোতলার ঘরখানাও চমৎকার। কার্পেট মোড়া, আধুনিক বাথরুম, পরিষ্কার বিছানা। এমনকী, চা জলখাবারও চলে এলো ঘরে। লোকজনের ব্যবহারও আন্তরিক। জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ধৌলাধার। আমাদের সুখ দেখে সূয্যিমামাও ঈষদুষ্ণ কিরণ বিছিয়ে দিলেন মানালির গায়ে!

    সকাল ৯টা- নিচে নেমে ব্রেকফাস্ট সেরে বাইরের সোনালি রোদের ডাক আর এড়ানো গেল না। গুটি গুটি গেট দিয়ে বেরোতেই অভ্যর্থনা জানাতে হাজির জমিদারের মতো রূপ আর চলন নিয়ে অল্প অল্প ল্যজ নাড়তে নাড়তে তিনি এলেন, খানিক আদর করার সুযোগ দিলেন, তারপর উল্টোদিকের দোকান অবধি গাইড করে নিয়ে গেলেন। আমরা আমাদের এবং তাঁর জন্য চিনিমাখানো চেরির চেহারার করমচার টুকরো বসানো বানরুটি কিনলাম। কয়েক মুহূর্তেই তিনি যে অতি অভিজাত বংশজাত, সেটার প্রমাণ দিলেন বানের ওপরর চিনি এবং ‘চেরি’ চেটে বানটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।

    সকাল ১০.৪৩- যেন কোনোরকম অপমানই হয়নি, এমন ভাব করে দুজনে মানালি বাজারে ঘুরে বেড়ালাম। বিয়াসকে পাঁচিল দিয়ে আড়াল করে শয়ে শয়ে দোকানের জঙ্গল তৈরি হয়েছে আর সেখানে কিলবিল করছে ট্যুরিস্ট — যেন জীবনে গরম জামাকাপড় দেখেনি। আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা ‘আলুপোস্ত’, ‘বেগুনভাজা’, ‘মাছের ঝোল’ লেখা দোকানের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন দুপুরুষ ওইসব বস্তু তাদের জোটেনি।

    দুপুর ১২.৪৭- বিরক্ত হয়ে শেষে একখানা অটো পাকড়িয়ে ঘুরে এলাম বশিষ্ঠ কুণ্ড থেকে। বিয়াসের ওপারে পাহাড়ের কোলে উষ্ণকুণ্ড ঘেঁষে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রম। হিমাচলি শৈলীতে কাঠের কারুকার্য করা অপরূপ আশ্রম। ‘বশিষ্ঠ মুনি দীর্ঘকাল তপস্যা করেও দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে না পেরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজেকে পাশে আবদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জনের উদ্দেশ্যে নদীতে ঝাঁপ দেন, কিন্তু পুণ্যতোয়া নদী তাঁকে পাশমুক্ত করে তীরে ফিরিয়ে দেন। এ জন্যই সে নদীর নামকরণ হয় ‘বিপাশা — স্থানীয় মানুষদের আদরের বিয়াস।’ এই জনশ্রুতি বিশ্বাস করতে মন্দ লাগে না। কিন্তু জনশ্রুতি শুনে পেটের ছুঁচোদের যে পেট ভরেনি, সেটা টের পেতেই ফিরে এলাম হোটেলে।

    বিকেল ৩.৪৯- দুপুরে খেয়ে খানিক গড়িয়ে হিড়িম্বা দেবীকে দর্শনের আকুতি জেগে উঠল। একটা অটো বাগিয়ে বিখ্যাত হিড়িম্বা মন্দিরের দোরগোড়ায় এসে পড়লাম। পাইন-ফারের বুনো ছায়ায় হিমাচলি শৈলীর মন্দিরের কাঠের কারুকার্য, গর্ভগৃহে হিড়িম্বার ‘প্রস্তর বিগ্রহ’, মন্দিরের ভিতরের আলো আঁধারিতে মন ভরে গেল। পাশে দেখলাম, গড়ে উঠেছে ‘অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’। এখানকার স্বর্গীয় শান্তি তছনছ করার আয়োজন চলছে জোরকদমে। ‘মানালি ক্লাব’ ঘুরে বাজারে এসে দেখি ভিড় বেড়ে গেছে দেড়গুণ।

    সন্ধ্যা ৬.৩৭- ভিড় ছেড়ে হোটেলের ঘরের একান্তে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। উপরি পাওনা চা পকোড়া। জানালার ওপারে তখন ধৌলাধার শেষবেলার সিঁদুরখেলা শেষ করে আবছা আঁধার মুড়ি দিয়েছে।

    ১৪ অক্টোবর

    সকাল ৯.৩১- বাসস্ট্যান্ডের বাইরে বাইশজনকে বওয়া রথ তৈরি। তৈরি আমরাও। আজকের রুটিন রোহথাং মানে রোটাং পাস। রোহথাং মানে নাকি আত্মাদের বাসস্থান। একসময় এই গিরিবর্ত্ম পায়ে হেঁটে পার হতে গিয়ে প্রচুর মানুষ প্রকৃতির রোষে প্রাণ হারাতেন। তাঁদেরই আত্মা (রুহ্‌) রা নাকি এখন সেখানে হাহাকার করে বেড়ায়। অবশ্য আমরা অকুতোভয়; একে তো দিনের বেলায় বাসে চড়ে এরকম হুশ করে পৌঁছে যাব তেরোহাজারি পাসে, তায় সেখানে এত ভিড় হয় যে আত্মারা লুকোবার জন্য গুহা খোঁজে।

    সকাল ১০.৪৮- নদী পেরিয়ে এসে বশিষ্ঠ আশ্রমের পথকে ডাইনে ফেলে রেখে, বিয়াসের উজানে বাস এসে থামল রাহালা ফলস্‌-এর সামনে। কয়েকশো ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাহালা দ্বিতীয় ঝাঁপে নিজেকে সঁপে দিয়েছে বিয়াসের বুকে। রাহালা আর গরম কফি যেন সোনায় সোহাগা।

    সকাল ১১.১৯- মাঢ়ীতে এসে শেষ চরাই চড়ার আগে বাস দম নিতে দাঁড়ালো। আমরাও তুষারশৃঙ্গের সাক্ষী রেখে আলুর পরোটা আর কফির দম নিয়ে নিলাম।


    সকাল ১২.০৭- গোঁ গোঁ কোঁ কোঁ করে বাস বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে চড়াই ভাঙছে। আস্তে আস্তে মাথা তুলছে তুষারমণ্ডিত গিরিশ্রেণী। ঠান্ডা হাওয়া তার জোর বাড়াচ্ছে পাল্লা দিয়ে।

    দুপুর ২.০৮- রোটাং পাসের (১৩০৫৮ ফুট) দুরন্ত বেগের হিমেল হাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে একটা পলিথিনের ছাউনির নিচে বসে গরম চা-কফিতে মোকাবিলা চালিয়ে যাচ্ছি। বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বরফে কেউ লাফাচ্ছে, কেউ বরফের বল বানিয়ে ছুঁড়ছে, কেউ কেউ আরও চড়াই ভেঙে চলেছে আর ও বেশি বরফের খোঁজে। সবই তুষারদেবতাদের কড়া নিগরানীতে। রোটাংয়ের ওপারে নামলেই একদিকে কেলং পেরিয়ে লাদাখের পথ অন্যদিকে স্পিতির আহ্বান। সে ডাকে এবারে আর সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিয়তি কেন বাধ্যতে — শেষমেশ লাহুলে পা রাখার সুযোগ মিলেছিল এই ট্যুরেই। সে কথা পরের বার।

    দুরন্ত বেগে বয়ে যাওয়া বাতাসে যেন মৃতদের আত্মার গোঙানি। কে জানে, হয়তো এইজন্যই এর নাম আত্মাদের আস্তানা।

    দুপুর ৪.১৩- রোটাংয়ের ছবি চোখে নিয়ে আবার মানালির বুকে। ঠিক করেছি, আগামী কাল মণিকরণের খোঁজে যাব। বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দুটো সীট বুক করে রাখতে হবে।

    বিকেল ৪.৪১- সীট সংরক্ষণ সুসম্পন্ন।

    সন্ধ্যা ৬.০৬- বৈকালিক উদ্দেশ্যহীন পদচারণান্তে শয্যোপরি চা-পকোড়ার সদগতিতে মনোনিবেশ।

    ১৫ অক্টোবর

    সকাল ৮.৩০- বাস বাবাজী গা-ঝাড়া দিলেন। বিয়াসের অক্লান্ত অফুরন্ত খিলখিলানিকে সাক্ষী রেখে।

    সকাল ১০টা- কুলু পর্যন্ত পরিচিত পথ পেরিয়ে বিয়াসকে টপকে চলে এলাম ভুন্টারে, পার্বতী নদীর আওতায়।

    সকাল ১১.১৮- এক শাল কারখানার ‘ঘাড়ভাঙা’ এম্‌পোরিয়ামে কালাতিপাত করে পার্বতী নদীর উজানে বাসের পর্বতারোহণ শুরু হলো। সূর্যের আলো আড়াল করে পাহাড় তার ঠান্ডা ছায়ায় মুড়ে নিল আমাদের।

    দুপুর ১২.০৮- বাস দাঁড়িয়ে পড়তেই পার্বতী নদীর ওপার থেকে মণিকরণ যাত্রীদের সহাস্য আবাহন জানালো। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাত্রীরা উদ্বাহু হয়ে তার বাহুবন্ধনে ধরা পিতে ছুটল। আমরা কোনোকালেই ব্যস্তবাগীশদের দলে নেই।


    দুপুর ১২.৪১- একটা ঢাবায় দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে সাঁকো পেরিয়ে চললাম পার্বতীর মণিকুণ্ডল উদ্ধারের জন্য মহাদেবের ত্রিমূলের খোঁচায় উৎপন্ন উষ্ণকুণ্ডের উদ্দেশে। সাঁকো পেরোতেই সরু উঁচুনিচু পাথুরে গলিপথ। তার দুধারে পূজার উপকরণ আর হাজার ‘মনোহারি’র দোকান। তাদের পার করতে পারলে বাঁ হাতে পার্বতীর তীর ঘেঁষে বিশাল গুরুদ্বারা, ডাইনে উষ্ণকুণ্ড ঘিরে দেবদেবীরা আস্তানা গেড়েছেন। উষ্ণকুণ্ডে পুণ্যার্থীরা ভুঁড়িতে ভুঁড়ি ঠেকিয়ে পুণ্যাবগাহনে মত্ত। নানান মন্দিরে পুজো দেওয়ার ভিড়ও যথেষ্ট — সব মিলিয়ে পুণ্যার্জনের জমজমাট বাজার। পুণ্যার্থীদের পুণ্যবৃদ্ধির সুযোগ দিয়ে সাঁকো পেরিয়ে পৈটিক খাণ্ডবদাহন নির্বাপণে মনোযোগ দিলাম। ওপার যেমন কোলাহলমুখরিত, এপার তেমনই শান্ত নির্জন — শুধু পুণ্যার্থী আর পর্যটক বয়ে আনা গাড়ি আর বাসগুলো নিশ্চিন্তে জিরিয়ে নিচ্ছে।

    বিকেল ৩.৫৩- ব্যাক টু মানালি।

    সন্ধ্যা ৬টা- বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, এখান থেকে কেলং এমনকী উদয়পুর পর্যন্ত বাস চলে। কিন্তু হাতে বাড়তি দিন বলতে দুই। এত কম দিনের পুঁজি নিয়ে লাহুল বেড়ানো কি সম্ভব! তার চেয়ে পুরোনো রাজধানী নাগগর ঘুরে এলে হয়।

    রাত ৮.৫০- কেলং না নাগগর এই দোটানা নিয়ে মানালির শেষ রাতটাকে কম্বলের তলায় গুঁজে নিলাম। বিপাশা রইল সস্নেহ পাহারায়।



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচ : রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments