সে বেশ কিছু বছর আগের কথা। তখন নতুন বাড়ি হয়েছে আমার। ভেসে ভেসে আটলান্টিক পেরিয়ে ডেরা বেঁধেছি ইস্ট কোস্টে। নিউ জার্সির এই অঞ্চলে অনেক বাসিন্দারই ধমনীতে বইছে ডাচ রক্ত। আশ্চর্য নয়, নিউইয়র্কের খুব কাছে এ জায়গাটা। আর কে না জানে, নিউইয়র্ক আদতে ছিল নিউ আমস্টারডাম। সেই চারশো বছর আগের ডাচ সেটলাররা হাডসন নদী বেয়ে এসেছিল নতুন দেশে, নাম দিয়েছিল নিউ নেদারল্যান্ড। উত্তর থেকে দক্ষিণে নেমে যেখানে হাডসন মিশে গেল আটলান্টিকে, সেখানে গড়ে উঠল শহর - নিউ আমস্টারডাম। তারপর তো ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ, হাতবদল। ইয়র্ক শহরের ডিউকের নামে নিউ আমস্টারডাম পেল নতুন নাম - নিউইয়র্ক।
এ সব ইতিহাস যে আমার একেবারে অজানা ছিল তা নয়। তবে পাশের বাড়ির ব্রুস (Bruce) যখন প্রথম সৌজন্যসাক্ষাতে এসে ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গল্প বলছিল, ভারী ভালো লাগছিল শুনতে। ব্রুস ভন স্টাইন। নাম শুনলেই বোঝা যায় ওর পূর্বপুরুষরা এসেছিল নেদারল্যান্ড থেকে। পড়শীদের মধ্যে ব্রুসের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম প্রথম স্বাগতম-উপহার। আকাশ ভরা তারা - Starry Night। নীল ক্যানভাসে মেঘের ঘূর্ণিপাক, তাতে জ্বলছে চড়া হলুদের কনট্রাস্ট, মোটা তুলির আঁচড়ে নেমেছে গাঢ় নীল রাত। গির্জার চূড়া মাথা তুলে দেখছে কেমন করে পাহাড় মিশে যাচ্ছে আকাশে, বইছে সময়।
ব্রুসই আমায় পরিচয় করালো ভ্যান গঘের (ইংরেজি উচ্চারণটাই লিখছি, ব্রুস বলেছে আসলে ডাচ ভাষায় এ নামের উচ্চারণ 'ফান গো') সঙ্গে। শোনালো এ ছবির গল্প। ভ্যান গঘ তখন অ্যাসাইলামে, কিন্তু ছবি আঁকার অনুমতি আছে। ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার চিন্তা আসে ঘুরে ঘুরে। ছবির রং হয় গাঢ় থেকে গাঢ়তর নীল। এভাবেই আঁকা হলো Starry Night - যা এখন পৃথিবীর সর্বাধিক পরিচিত ছবিগুলোর মধ্যে একটি।
ছবিটা টাঙ্গিয়ে রেখেছিলাম আমার শোবার ঘরে। সেই আমার ছবি-প্রেম শুরু। ভ্যান গঘের হাত ধরে। বই কিনলাম, পড়তে শুরু করলাম তাঁর জীবনের, তাঁর আঁকা ছবির গল্প।
তাই আমস্টারডামে গিয়ে আমার পাখির চোখ ভ্যান গঘ মিউজিয়ামে। না দেখলে যে জীবনই বৃথা !
এবং আবারও বুঝলাম - আমস্টারডামে এসে আর কিচ্ছু না দেখে যদি আমি শুধু ভ্যান গঘ মিউজিয়াম দেখে ফিরে যেতাম, তাহলেই আমার আমস্টারডাম আসা সার্থক হয়ে যেত। এখানে এই ডাচ শিল্পী এবং তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের আঁকা ছবির এক অতুলনীয় কালেকশন। ঝাড়া পাঁচ ঘন্টা আমরা একটুও না বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছবির ক্যানভাসের দিকে চেয়ে থেকেছি। পুরো গ্যালারিটি এমনভাবে বিন্যস্ত যে ভ্যান গঘের সংক্ষিপ্ত শিল্পীজীবনের প্রতিটি উত্তরণের ধাপ দর্শকের কাছে ধরা পড়ে।
ভ্যান গঘ নিজেও জানতেন না যে তিনি ছবি আঁকবেন। প্রথম জীবনে আর্ট ডিলিং করেছেন, পড়িয়েছেন, আর অন্যের ছবি নকল করে ছবি এঁকেছেন। সাতাশ বছর বয়সে ঠিক করেন তিনি পুরোসময়ের ছবি-আঁকিয়ে হবেন। কে জানত সেই সিদ্ধান্ত পরে সারা পৃথিবীর ছবি আঁকার ইতিহাসকে পাল্টে দেবে! বাবা আর মা তাঁদের বড় ছেলে রোজগার-হীন চিত্রকরের জীবন বেছে নেওয়ায় খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু ভাই থিও আর্থিক সাহায্য করেছেন বরাবর। এই একটি মানুষ ভ্যান গঘকে সবসময় বুঝেছেন, নিঃশর্তভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
আমস্টারডামের ভ্যান গঘ মিউজিয়াম প্রধানত চারটি তলায় সাজানো। একটি তলায় তাঁর নিজের আঁকা নিজের পোর্ট্রেট, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রূপে - ফেস টু ফেস উইথ ভ্যান গঘ। নিজের পোর্ট্রেট আঁকতে হয়েছিল খানিকটা পেটের দায়ে - মডেল ভাড়া করার পয়সা ছিল না যে! পরে সারা বিশ্ব তাঁকে চিনল তাঁর নিজের আঁকা পোর্ট্রেট দিয়ে। সবচেয়ে প্রিয় পোর্ট্রেটটির মাথায় গ্রাম্য টুপি - যা সাধারণত চাষিরা পরে থাকে। মোটা মোটা ব্রাশ স্ট্রোক, কমলা আর নীলের মিশেলে অনন্যসাধারণ পোর্ট্রেট। ভ্যান গঘ অনাড়ম্বর, সরল, গ্রাম্য জীবন পছন্দ করতেন। নিজেকে তিনি তেমন জীবনেই দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হয় নি।
এই ফ্লোরেই রাখা আছে ভ্যান গঘের ছবি আঁকার একটি প্যালেট, সামনে রাখা আছে রঙের টিউবগুলি। প্যালেটের ওপর মোটা তুলির টানে চাপ চাপ রং। মনে হচ্ছে যেন শিল্পী প্যালেটের ওপরেই রঙ মিশিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন। সে প্যালেটের সামনে থেকে আমি বহুক্ষণ নড়তে পারি নি, এমনই তার সম্মোহন।
পরের গ্যালারিতে সেই সহজ সরল জীবনেরই প্রতিবিম্ব, যা শিল্পীকে চিরকাল আকর্ষণ করে গেছে। পট্যাটো-ইটার্স জগদ্বিখ্যাত। টিমটিমে আলো-অন্ধকারে এক গ্রাম্য চাষি পরিবারের সাধারণ খাওয়া - আলু, বেকন, কফি। অনাড়ম্বর কিন্তু সহজ পারিবারিক বন্ধন। এ ছবি আঁকার ইতিহাসটিও চমকপ্রদ। কতগুলো যে স্কেচ তৈরি করেছিলেন, শেষে আঁকলেন ক্যানভাসে একখানি ড্রাফট ছবি, তারপর শিল্পী মূল ছবিতে হাত দিয়েছিলেন। এত কষ্ট করে আঁকা ছবি কিন্তু ভাই থিও তাঁর আর্ট গ্যালারিতে রাখতে চাননি। তাঁর মনে হয়েছিল প্যারিসের ইম্প্রেশনিস্ট ছবির রসিকদের কাছে এই সাধারণ গ্রাম্য জীবনের ছবি বিকোবে না। ভাগ্যের কী পরিহাস - পটেটো-ইটার্স আজ মাস্টারপিস।
আরেকটি গ্যালারিতে তাঁর প্যারিস বসবাসের প্রভাব। চোখে দেখে ছবি আঁকার থেকে উত্তরণ ইম্প্রেসিয়ানিজম-এর জগতে। এ সময় এঁকেছেন তাঁর সেই বিখ্যাত হলদে বাড়ি, যে বাড়িতে তাঁর স্বপ্ন ছিল উঠতি আর্টিস্টদের কমিউন হবে, তরুণ শিল্পীরা এসে থাকা-খাওয়ার জায়গা পাবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পল গগ্যাঁ ছাড়া আর কেউ আসেন নি। তবে হলুদ-রঙা বাড়িটি, তাঁর নিজের বেডরুম, যাতে হালকা রঙের সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ উজ্জ্বলতার মিশেল - অমর হয়ে আছে তাঁর ছবিতে। প্যারিসের এই ছোট্ট বাড়িটিতেই দুনিয়ার অন্যতম সেরা চিত্রকর তাঁর সৃষ্টির চূড়ায় উঠেছিলেন। এই বাড়িতেই তাঁর জীবন ট্র্যাজিক, নাটকীয় মোড় নিয়েছিল।
এই সময়েই আঁকা হচ্ছিল প্যারিসের কাফে মালকিন আগস্তিনা সেগাতোরির পোর্ট্রেট। পোর্ট্রেটে চারিদিক ধূসর, যেন বা স্বপ্নরাজ্য, বাস্তব নয়, কিন্তু পিছনের চেয়ারগুলির বসার জায়গাটি হলুদ, দর্শকের দৃষ্টি টেনে নেবার জন্যে। সে মানবীর চোখ সুদূরে, হাতে সিগারেট, পাশে পানীয়। মাথায় একটি উজ্জ্বল লাল লম্বা টুপি, যা এ ছবির আরেকটি হাইলাইট। এ সময় ভ্যান গঘ ছবি আঁকছেন কাফের বিল মেটাবার জন্যে। পয়সা ছিল না, তাই ছবি দিয়ে খাবার কেনা। তাঁর আঁকা ছবিগুলি শোভা পেত আগস্তিনার কাফের দেওয়ালে।
চতুর্থ গ্যালারির ছবির ইতিহাস বড় করুণ। ভ্যান গঘের সাঁইত্রিশ বছরের জীবনের শেষ দু-বছরের ছবি। ততদিনে পল গগ্যাঁর সঙ্গে লাগাতার খিটিমিটি, শেষে একদিন রেজার নিয়ে ঝগড়া, পল গগ্যাঁ বেরিয়ে গেলেন হলদে বাড়ি থেকে। ভ্যান গঘ তাঁর বাঁ কানের এক অংশ কেটে ফেলে হাজির হলেন এক দেহপসারিণীর বাড়ি। পুলিশ এল, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলো। ভাই থিও দৌড়ে এলেন। সেদিন ক্রিসমাস। ভ্যান গঘ রক্তপাতে দুর্বল। সেরে উঠে বাড়ি ফিরলেন বটে কিন্তু মস্তিষ্কের, চিন্তার স্থিরতা নেই। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। প্রতিবেশীরা পিটিশন করল তাঁকে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বার করে দেওয়ার জন্যে। ভ্যান গঘ নিজেই চলে গেলেন মানসিক হাসপাতালে। তাঁর ডাক্তার বলেছিলেন - যাই হোক না কেন, তুমি ছবি আঁকা থামিও না। ভ্যান গঘ নিজেও বিশ্বাস করতেন ছবি আঁকলে তিনি সেরে উঠবেন। এ সময় তিনি দিনে একটা করে ছবি এঁকেছেন, আমৃত্যু। বেশির ভাগ ছবি-ই হাসপাতালের জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্য, হাসপাতালের বাগান। অমর হয়ে আছে অরচার্ডের ছবিগুলি, আমন্ড ব্লসম, আইরিস - যা তিনি এঁকেছিলেন এপ্রিল মাসে বসন্তের আগমনে। এ ছবিগুলিতে গাছের ডাল স্পষ্ট ব্রাশ স্ট্রোকে আঁকা, ফুল আর পাতায় ছোট ছোট তুলির টান। উজ্জ্বল নীল, সবুজ, হলুদ রঙে স্বপ্নময় হয়ে আছে। ফসলের ক্ষেতে কাজ করা চাষির ছবিতে গনগনে সূর্য, হলুদ রঙে জ্বালিয়ে দিচ্ছে ছবির ক্যানভাস।
মাত্রই সাঁইত্রিশ বছরের আয়ু তাঁর। তার মধ্যেই এঁকেছেন ন’শো ছবি, এগারোশো কাগজের ওপর স্কেচ। কারোর কাছে প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই তিনি সবার থেকে আলাদা এক বিরল চিত্রকর। জীবনকালে লোকে ভাবত উন্মাদ। তাঁর আঁকা সাধারণ মানুষ, গ্রাম্য জীবন, চাষির ছবি কদর পায় নি প্যারিসের নাক উঁচু অভিজাতদের কাছে। ভ্যান গঘ নিজের বুকে গুলি করে নিজেকে শেষ করে দেন। তার ছ'মাসের মধ্যে ভাই থিও-ও মারা যান। থিওর স্ত্রী জো বা জোহানা দায়িত্ব নেন আর্ট গ্যালারির। জো ছিলেন ভ্যান গঘের ছবির সমঝদার, গুণমুগ্ধ। তিনি খুঁজে খুঁজে ভ্যান গঘের ছবি জোগাড় করে আর্ট গ্যালারিতে বিক্রি করা শুরু করেন। নানা এক্সিবিশনে ভ্যান গঘের ছবি পাঠাতে শুরু করেন। বছর কয়েকের মধ্যেই সেসব ছবি পৃথিবীবিখ্যাত হয়। আরো একটা বড় কাজ জো করেন - ভাইকে লেখা ভ্যান গঘের অমূল্য চিঠিগুলো প্রকাশ করেন । জো-র দুঃখ ছিল যে পুরো এক বাক্স ছবি ভ্যান গঘের মা ফেলে দিয়েছিলেন, সে আর উদ্ধার করা যায় নি। ভ্যান গঘের মা কিন্তু বেঁচে ছিলেন, দেখে গেছেন ছেলের জগৎজোড়া খ্যাতি, যার চিত্রকর হওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁরা মেনে নেন নি। ভ্যান গঘ-কে পৃথিবী আজ চিনেছে জো-র জন্যে। পরে জো আর থিও-র ছেলে - ভিনসেন্ট নাম তাঁরও - প্রতিষ্ঠা করেন ভ্যান গঘ ফাউন্ডেশন।
অসামান্য প্রতিভাধর এই শিল্পীর পুরো জীবনটাই উল্টোপাল্টা, খাপছাড়া। মানবমস্তিষ্ক এখনো বোধহয় চূড়ান্ত ট্যালেন্টকে ধারণ করার উপযুক্ত হয় নি। কে জানে আরও কত ইভোলিউশন পেরোলে তবে জিনিয়াসকে চিনতে পারা যাবে - কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায় ? প্রশ্নগুলো সহজ তবে উত্তর নেই জানা।