“ওমা! কী হবে দাদা!” বলে শান্তা যখন ছুটে এল তখনও আমি বুঝতে পারিনি যে গণ্ডগোলটা কত ভয়ানক। আসলে শান্তার স্বভাবই সব কিছুকে বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলা। তিলকে তাল তো নয় একেবারে গন্ধমাদন পাহাড় করে ফেলে সে। যেমন, একটু বৃষ্টি হলেই ওর ফোন চলে আসবে যে ওদের পাড়া নাকি বন্যায় ভেসে যাচ্ছে! দিনে দশবার ‘কী হবে গো’ হয় ওর--তাই ওর মুখ দিয়ে আবার সেই কথা শুনে হিসেবের পাতা থেকে চোখ না তুলেই বললাম, “আবার কী হল?”
শান্তা বলল, “চলো আমার সঙ্গে!”
ওই আরেক দোষ ওর, সব কিছুতেই প্রচুর নাটক! একেবারে যাকে বলে ড্রামা কুইন! তাই আমি আরেকবার চেষ্টা করলাম, “কী হয়েছে সেটা বলবে তো নাকি হেঁয়ালি করবে শুধু?”
“মিসেস সরকার এসেছিলেন আজ সকালে!” শান্তা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল।
“সে তো আসতেই পারেন। তাতে আর নতুন কী? উনি তো প্রায়ই আসেন।”
মিসেস সরকার আমাদের দোকানের নিয়মিত খদ্দের। রাশভারী অবস্থাপন্ন মহিলা। এমনিতে কথা কম বলেন, কিন্তু ভুলভাল কিছু হলে কড়া করে বকুনি দিতে ছাড়েন না। কয়েক মাস আগে ভুল করে চকোলেটের বদলে পাইন্যাপেল কেকের অর্ডার হয়ে যেতে আমাদের একেবারে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিয়েছিলেন!
“আজ সকালে উনি অর্ডার দিতে এসেছিলেন।“
“ও, তা কী বললেন?”
“না, মানে আমি তো সকালে ছিলাম না। রন্টুর স্কুল থেকে ডেকেছিল। ওই যে পেরেন্ট টিচার মিটিং না কী যেন হয় না। তা রন্টুর বাবাকে যেতে বলতেই...”
“আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে,” শান্তার পরিবারের পেঁচালো গল্প শোনার ধৈর্য আর আমার ছিল না, “তা দোকানে কে ছিল?”
“বঙ্কু!”
“ও!”
বঙ্কুর বাবা সুবীরবাবু আমাদের এই হট অ্যান্ড ক্রাস্টি বেকারি চেনের মালিক জগমোহন সরকারের বন্ধু। সেই সূত্রেই তিনদিন হল বঙ্কু আমাদের এখানে কাজ করতে এসেছে। এর আগে নাকি বেশ কয়েক জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে শেষে এখানে এসেছে। কেন সেটা অবশ্য আমাদের বলা হয়নি। এমনি তো বঙ্কুকে হাসিখুশি ভাল ছেলে বলেই মনে হয়েছে আমার কিন্তু ক্লাস টেনের গণ্ডি নাকি পেরতে পারেনি সে।
এদিকে আজ সকালে আমাকে জগমোহন বাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হয়েছিল মাইনেকড়ির ব্যাপারে আলোচনা করতে আর এখন বুঝতে পারছি শান্তা ছেলের পেরেন্ট টিচার মিটিংয়ে গিয়েছিল দোকান খুলে বঙ্কুকে বসিয়ে! এইবার আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।
“শান্তা আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। এই স্প্রেডশিটটা আজকে শেষ করে জগমোহনবাবুকে পাঠাতে হবে। উনি হয়তো কাল আসবেন এখানে।“
“সে তো কাল, আজকে যা কেলেঙ্কারি হয়েছে সেটাকে সামলাতে পারলে হয়!”
আমি এবার বেদম চটে গিয়ে চিৎকার করে বললাম, “শান্তা এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে! কী হয়েছে বলবে তো!”
ধমক খেয়ে শান্তা বলল, “সেটাই তো বলছি। সকালে মিসেস সরকার এসেছিলেন। বলে গিয়েছিলেন ওনার একটা বড়ো চকোলেট কেক চাই। তাতে হ্যাপি বার্থডে রুবাই লেখা থাকবে আর পাশে কয়েকটা বেলুন,” এতটা বলে ও থেমে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “আর মিনিট দশেকের মধ্যেই নিতে আসবেন।”
“তাতে সমস্যাটা কী আমি তো বুঝতে পারছি না। করে দাও। ওটা করতে তোমার তো পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না। বড়ো চকোলেট কেক তো ছিল স্টকে।”
শান্তা বলল, “ছিল তো কিন্তু একটাই। জন্মদিনের বাজারে বাকিগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এমনকি দুটো ছোটোও নেই!”
“একটা যখন রয়েছে তাতেই তো কাজ হয়ে যাবে।”
“আরে বাবা যেটা রয়েছে তাতে তো বঙ্কুবাবু নিজের হাতের লেখার নমুনা দেখিয়েছেন!”
“মানে?”
“সেটাই তো তখন থেকে বলছি, দেখবে চলো!”
পিছনের ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে দোকানের অংশে এসে দেখলাম বঙ্কু অপরাধীর মতন মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর একটা বড়ো চকোলেট কেকে আঁকাবাঁকা অক্ষরে এলোমেলো ভাবে ভুলভাল বানানে লেখা জ্বলজ্বল করছে ‘হেপি বার্টডে রুবাই’!
আমি এবার বুঝতে পারলাম বঙ্কু কেন ক্লাস টেনের গণ্ডি পেরতে পারেনি। কেন ওকে আগের কাজগুলো থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আগেকার সময় হলে হয়তো আমিও বুঝতাম না কিন্তু এখন ব্যাপারটাকে নিয়ে প্রচুর কিছু জানাজানি হয়ে গেছে সবার সিনেমা টিভি গল্পের দৌলতে। বঙ্কুর বাবা যেটা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়েছেন সেটা হল বঙ্কুর মনে হয় ওই রোগটা আছে, মানে কোন এক ধরনের লার্নিং ডিসাবিলিটি। বেচারা পড়তে লিখতে পারে না সেই জন্যেই। তাও আজ সে চেষ্টা করেছে মিসেস সরকারের লেখাগুলোকে হুবহু নকল করার। অথচ বেলুনগুলো খারাপ বানায়নি, লেখাগুলোতেই সমস্যা।
“দেখেছ দাদা?” শান্তা বলে চলেছে, “মিসেস সরকার আর আজ আমাদের আস্ত রাখবেন না!”
ওমা বলতে বলতেই মিসেস সরকার এসে ঢুকলেন দোকানে। শান্তা আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।
“আমি সকালে একটা কেকের অর্ডার দিয়ে গিয়েছিলাম। কী লিখতে হবে সেটাও লিখে দিয়ে গিয়েছিলাম। তখন তাড়া ছিল তাই অপেক্ষা করতে পারিনি। এখন কেকটা নিতে এসেছি। ওটা রেডি তো?”
বলতে বলতে সামনে রাখা কেকটা ওনার চোখে পড়ল।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “দেখুন মিসেস সরকার বড় চকোলেট কেক সব বিক্রি হয়ে গেছে নাহলে আমরা অন্য একটা রেডি করে দিতাম। আপনি চাইলে পাইন্যাপেল বা স্ট্রবেরি...”
হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন মিসেস সরকার, “আমার নাতি চকোলেট কেক ছাড়া খায় না, তাই অন্য কিছু চলবে না। তা আপনাদের বানান এতটাই খারাপ তো জানতাম না!”
আমি নরম সুরে বললাম, “সরি মিসেস সরকার, কিন্তু বেচারা বঙ্কুর ডাইস্লেকশিয়া নাকি ডিস্লেকশিয়া আছে – ওটাকে বাংলাতে কী বলে আমি জানি না। ওই ‘তারে জমিন পার’ সিনেমাটাতে দেখিয়েছিল। ওর পক্ষে অতটা লেখা খুবই শক্ত। আমি আর শান্তা দুজনেই দোকানে ছিলাম না তাই ও যতটা পেরেছে চেষ্টা করেছে। আপনি এবারের মতন এই কেকটা নিয়ে যান প্লিজ, আমরা ওটার পয়সা নেব না। যা হয়েছে তার জন্যে আমি দুঃখিত কিন্তু আমার আর কিছু করার নেই। দয়া করে বঙ্কুর ওপর রাগ করবেন না!”
মিসেস সরকার মুখ তুলে দূরে নত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্কুকে এক ঝলক দেখলেন তারপর বললেন, “কেকটা আমি নিয়েই যাচ্ছি, ভয় নেই! আর বঙ্কু তুমি তোমার যথাসাধ্য করেছ, তোমার ওপর কি আমি রাগ করতে পারি কখনও?”
ওনার কথা শুনে বঙ্কু তো বটেই আমরাও থ!
পরে জানতে পেরেছিলাম ওনার ছেলে আর বউমা নাকি সব শুনে বঙ্কুর কথা আর কেকটার ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলেন। সেই ছবি হাজার হাজার লাইক পেয়েছিল কারণ আর কিছু না হোক রুবাই নামটা ঠিক আছে!
বঙ্কু এখনও আমাদের দোকানে কাজ করে। অনেক কাজই ও শিখে নিয়েছে তবে কেকের ওপর লেখাগুলো ওকে আর কখনও লিখতে দেয় না শান্তা। সব খদ্দের তো আর মিসেস সরকারের মতন হয় না!