ঝলক স্যারকে আমাদের খুব পছন্দ। সব সাবজেক্ট পড়ান। ওনার ক্লাসের জন্য আমরা হাঁ করে থাকি। ফাইভের ঘটনাটা বলি।
সেদিন ফার্স্ট পিরিয়েড এসেছিলেন। ছোটখাট চেহারা। গোল চশমা। ইয়া বড় টাক। মুশকিল হল, মুখ ভালো বোঝা যাচ্ছে না। জাবদা মুখোশ।
সঙ্গের ঝোলায় কী? দু'ধারে বেঞ্চ। মাঝে হাঁটছেন।
চোখের হাসিটা ফেভিকুইকে লটকে আছে।
বললেন, 'আমার নাম জানো?'
আমাদের এবার ডে সেকশন। কাউকেই চিনি না। উনিও সেদিন প্রথম। ক্লাস শুরু হয়েছে। এই একমাস হবে।
--নাম জানব কী করে? হঠাৎ উঠে দাঁড়াল পাগলা। ভালোনাম গুণময়। প্রাইমারি থেকে আমাদের বন্ধু।
ফস করে বলল, 'আপনি মালতি আন্টি।'
আমরা হেসেই অস্থির।
স্যার বললেন, 'এটাও খারাপ না।'
মালতি তো মেয়েদের নাম। উনি কি মেয়ে? মাথায় নির্ঘাত ছিট। আশ্চর্য!
স্যার বললেন, 'ঝলক লাল নামটা পুরোনো হয়ে গেছে। ছাত্ররা আড়ালে আমায় 'ঝোলা' বলে। সবসময় তো কাঁধে ঝোলা থাকে, তাই। এটা বেশ ভালো। চকচকে।'
পাগলা বলল, 'নাম কীভাবে চকচকে হয় স্যার?'
‘ভাবো তো। ঝলক বলার কেউ আছে? এখন ডাক বলতে স্যার। নয় মিস্টার লাল। কিন্তু 'ঝোলা' নামটা? এতবছর তোমাদের মুখে মুখে! মাজাঘষায় চকচকে তো হবেই।’
স্যার যদি নিজেই নিজের দিয়ে দেন। সে ডাকায় মজা আছে?
স্যার প্রশ্ন করলেন, 'তোমরা কে কে ছবি আঁকতে পারো?'
কথাটা শুনেই সবার হাত উপরে।
'বাহ! তাহলে আমার একটা ছবি আঁকো দেখি।'
আমরাও ব্যস্ত হলাম আঁকায়।
পলু বলল, 'স্যার, একটু মুখোশটা খুলবেন?'
এটা ঢের আগের ঘটনা। তখনও করোনা আসেনি। স্যারের মাস্কটা হলুদ। জাল জাল। সামনে লাল।
জোকারের নাকের পিংপং বল।
স্যার মাস্ক খুলতে খুলতে বললেন, 'এই মাস্কের জন্য অনেক অসুবিধা। কী করব বলো। আমার একটা অসুখ আছে। মাস্কটা তাই পরতেই হয়। কষ্ট হলেও পরতে হয়।'
মাস্কটা খুললেন। দেখি ফিনফিনে নাক। কাগজের পতাকার মত। দাড়িগোঁফের জঙ্গলে ঠোঁট। ফুটফুটে বরফকুচি দাঁত। যেন ঝরনা জমেছে। হাসলে নাকটা ওঠানামা করছে। শুঁড়ের মত।
সবাই আঁকায় মত্ত। একে একে ছবি দিচ্ছি। স্যার ছবিগুলো উল্টে রাখছেন। বললেন, 'সব একসঙ্গে দেখব।'
গৌরহরি ভালো ছবি আঁকে। দেখলেই টক করে এঁকে ফেলে। তবে আজ আমরা নির্ভাবনায় এঁকেছি।
স্যার বললেন, 'আর কেউ দেবে?'
আমরা চুপ। কেউ জমা দেবার নেই। হঠাৎ কাণ্ডটা ঘটল।
পাগলার আঁকাটা জয়দেব জমা দিয়ে দিল। গুণময় ছুটে গেল। কাঁচুমাচু মুখ। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
'হয়নি স্যার ছবিটা। জয়দেব জোর করে দিয়েছে।'
'হয়নি মানে?'
পাগলা কাতর হয়ে বলল, 'আঁকাটা হিজিবিজি হয়েছে। ছবিটা ফেরত দিন না স্যার। সত্যি বলছি। জমা দিতে চাইনি। বাজে হয়েছে।'
স্যার নরম স্বরে বললেন, 'তুমি কাঁদছ কেন? তোমাদের আঁকা ছবি। যেমনই হোক। সব ভালো লাগে। রেখে দিই। যা হয়েছে তাই ভালো।'
বেল বাজল। আঁকাগুলো ঝোলায় পুরতে লাগলেন। আমাদের সবচেয়ে অবাক করল গুণময়ের
কান্না।
ওকে দস্যু বলি। আন্টিরা বিরক্তিতে ঠ্যাঙাত। গুণের নামে কমপ্লেইনের বন্যা। গার্জেনরা বড়দির কান ঝালাপালা করেছে। মারপিটের ওস্তাদ। কতজনের মাথা ফাটিয়েছে। নিজের হাত-পাও কম কাটেনি। ভাঙেনি। তবু চোখে জল দেখিনি।
শুধু রাগলে ফর্সা মুখ গনগনে। কান লাল। এমন দুর্ধর্ষ বন্ধু, ছবির জন্য কাঁদছে!
গুণ চুপ করে থাকল। জয়দেব মুচকি হাসছে। ওরা থার্ডবেঞ্চে পাশাপাশি ছিল।
আমরাও যে যার মত। ছবি আঁকছিলাম। জানি না কী ছবি এঁকেছে। আর ফেরতই বা চাইছিল কেন। আমাদের আঁকাও হিজিবিজি হয়েছে। স্যার হাসবেন। তাতে কি আমরা কাঁদছি? আমাদেরও আঁকার মাথামুণ্ডু নেই। তবে খুব মজা হয়েছে।
পলু হাত তুলল, 'একটা কথা বলব স্যার?'
'বলো?'
'ছবিগুলো কবে ফেরত পাব?'
স্যার বললেন, 'শনিবার।'
আজ বুধবার। আরও তিনদিন! আমাদের গভীর ছটফটানির মধ্যে রেখে গেলেন।
আজ শনিবার। আমরা হাউজফুল। এই সেকশনে মোট আটান্ন। বেঞ্চে বসার জায়গা নেই। তাতে কী। আমাদের গাদাগাদিই পছন্দ। ঠেলাঠেলির মজাই আলাদা। এতে গোলমালের সুবিধা। একটু পরে পরেই ঝনাৎ। কারো না কারো জ্যামিতি-বক্স পড়ে ছত্রখান। ওয়াটার-বটলের জল ছিটকে উঠবে।
মাঝে মাঝে টিফিন-বক্সও ফেলে দিই। আর এসব হয় পেছনদিকের বেঞ্চগুলোতে। খেয়াল করে দেখেছি। কিছু কিছু আন্টি জল ফেললে খুব চটে যায়। আমরা সেই ক্লাসে সবাই জল ঢেলে দিই হুড়মুড় করে। পুরো ক্লাস কাদা।
থার্ডপিরিয়ড শেষে বারান্দায় উসখুস করছি।
স্যার আসলে এখান থেকে দেখা যাবে।
ঝংকার বলল, 'স্যার…'
আমরা যেখানে পারলাম বসে ভাবছি ছবিগুলো?
গৌরহরি উত্তেজিত। হাতে হাত ঘষছে। ভালো আঁকে বলে একটু অহংকার আছে। ওই জন্য আর কি। বলল, 'স্যার, ছবিগুলো?'
স্যারের একমুখ হাসি। 'হুম। এনেছি।'
পঞ্চা ফিসফিস করে, 'এঃ স্যার গুল দিচ্ছেন। আমরা সবাই ভালো আ়ঁকি?
আমার ছবিতে স্যারকে পেঁপের মত দেখাচ্ছে। কত চেষ্টা করলাম। থুতনিটা করতে। দূর। হলই না। ওই পেঁপেটাই দিয়েছি।'
কথাটায় হাসি পেল। স্যার যদি সত্যি পেঁপে হতেন! আমার আঁকাও কাগের ঠ্যাং। চিরকুটে কথা চলছে।
স্যার ছবিগুলো রাখছেন। গোল করে পাকানো। মনে হচ্ছে পাইপের ত্রিভুজের (??)।
স্যার আঁকাগুলো দেখাতেই ক্লাসে হাহা হিহি। পেটব্যথা হয়ে গেল।
নীলা: বাক্সের মত স্যারের মুখ। চশমা ধরলে চারটে চোখ। মাথায় একটা চুল।
শায়ের চুপি চুপি বলল, 'ওটা মাথার আংটা।’ শায়েরটা যে কীসব বলে!
অভি: একচোখে চশমায় ঢেউ খেলানো মুখ। মনে হচ্ছে স্যার জলে।
সুফি: তালশাঁস দাড়ি। তিনকোণা পতাকা নাক। কম্পাসে গোল একটাকার কয়েন। দু'চোখ।
এমনই সব ছবি। মাত্র দুটো বাকি।
গৌরহরি চমৎকার ছবি এঁকেছে। হুবহু স্যার।
স্যার বললেন, 'ভালোই হয়েছে।'
গুণময়ের ছবিটাই এখনও দেখিনি। ওর মাথা নিচু।
'স্যার গুণের ছবিটা?'
হেসে বললেন, 'আছে আছে। ওটা তো সেরা ছবি।'
আমরা অবাক। সেরা ছবি!
গুণের ছবিটা যে একেবারে হয়নি তা নয়। মুখের ভাব অনেকটাই এসেছে। তবে গৌরহরির আঁকার মত নয়। আমরা বুঝেছি। কেন সেদিন গুণময় ছবিটা ফেরত চাইছিল।
মুখের আদলটা এঁকেছে ঠিকই। মুখে জাল পরানো। যেমন গরুর মুখে থাকে। ঘাস খাওয়া আটকাতে। মাথায় চারটে শিংয়ের মত। তিনটে পা। একটা লম্বা লেজ মত। অসম্পূর্ণ।
ওটাতেই সারা ক্লাসে উত্তাল হাসি।
তবে আমরা আশ্চর্য হলাম। স্যার হাসছেন না। মুখটা যে রাগী তাও না। আমাদের হাসিটাও মিইয়ে গেল।
অবাক কাণ্ড! গুণময় কেঁদে ফেলল। দু'কান ধরে বলল, 'কক্ষনো হবে না স্যার। ভুল হয়ে গেছে।'
স্যার বললেন, 'তুমি বোকা নাকি। শুধু শুধু কাঁদছ। এ ছবিটা অন্যসব ছবির থেকে বেশি পছন্দ হয়েছে।'
স্যার আবার বললেন, 'গুণময়ের আঁকাটা সত্যিই পছন্দ।'
গুণময় এতক্ষনে মুখ খুলল। 'ছবিটা আপনার ভালো লেগেছে!'
'হ্যাঁ। পরের দিন কিছু কথা বলব।'
ক্লাসে কোন শব্দ নেই। এও কি সম্ভব?
স্যার কেমন শান্ত হয়ে বললেন গুণের ছবিটা পছন্দ হয়েছে। সত্যিই অপছন্দ হলে বলতেন?
বড়দির মারেও গুণ কাঁদেনি। সে তো ওর জেদ। আজ তো কেঁদেছে। যেদিন জয়দেব আঁকাটা ছিনিয়ে জমা দিয়েছিল। সেদিন কেঁদেছিল ভয়ে।
তবে ও মনে মনে তৈরি ছিল মারের জন্য। পিঠ টানটান ছিল। হাত-পা শক্ত। আমরা জানি। ও বলেছে। মার খেলেও ব্যথা লাগে না।
স্যারের কথায় ও কেঁদেছিল। সে তো ভালবাসার কান্না। বাচ্চাদের ভালবাসলেও কান্না পায়। বরং মারলে ভেতরটা ফুটতে থাকে।
গুণময়ের ভেতরটা সবসময় ফুটছে। বাবা-মা রাতদিন পেছনে লেগে আছে। পরীক্ষায় নম্বর কমলেই ঠাসঠাস। কেন? নম্বর কমে কী হয়?
ও যে ভালো খেলে। দু'হাতে লিখতে পারে। চমৎকার গান করে। ভালো গিটার বাজায়। যদিও কাকিমা রাগে ভেঙে দিয়েছে।
ও যে-কোন কথাকে পিয়ানোতে বাজাতে পারে। আমরা শুনেছি। কথাকে এমন করে রিডে বাজায় প্রথমে শুনলে হিজিবিজি লাগে।
পরে ও রেকর্ডের কথাগুলো শুনিয়েছে। বুঝেছি রিডেও সে কথাই হচ্ছে। অথচ আমরা আগে শুনেও বুঝিনি। কী যে অদ্ভুত, কী বলব। শুনে হয়ত অনেকেই হাসবে। নীলা তো হারমোনিয়াম বাজায়। ও তো পারেনি।
বন্ধুদের বিপদে গুণ সবার আগে। যেদিন হাইবেঞ্চ পড়েছিল নীলার পায়ে। ও কী ব্যস্ত। বারবার বলছে জুতো খোল। দেখি। বরফ দিয়ে আনি।
গুণ পিঠে করে দোতলা থেকে একাই নামিয়েছে। নীলার যা ওজন! তবে?
এগুলো কিছু না? এগুলোতে কোন নম্বর নেই। কেন? এসবে নম্বর থাকলে জয়দেবের ফার্স্ট হওয়া ঘুচে যেত। তখন দেখতাম কেরামতি।
স্যার এলেন। আমরা চুপ করেছিলাম। মুচকি হাসি।
'সবাই ভালো আছ?'
আমরাও একসঙ্গে, 'হ্যাঁ স্যার।'
আজকেও বেঞ্চের ফাঁকে হাঁটছেন। নীলা আমাদের মনের কথাটাই বলল, 'স্যার, বলেছিলেন কী বলবেন—'
'হুম বলব। আগে কিছু কথা বলি। ওইগুলো যাতে ভালো করে বুঝতে পারো... বোর্ডে একটা শব্দ লিখছি তোমরা তার মানে জানো?'
বোর্ডে বড়বড় অক্ষরে লিখলেন: 'পেরেডোলিয়া', Pareidolia.'
আমরা চুপ। কেউ শুনিনি।
স্যার বলছেন, 'পেরেডোলিয়ায় দুটো শব্দ আছে। প্যারা: অতিরিক্ত। এইডোলোন: ছবি,আকৃতি, আকার। যেমন ধরো, কখনও আকাশের মেঘ দেখে মনে হচ্ছে হাতি। শুঁড় তুলে আছে। কিম্বা গাছের ডালকে, জন্তুজানোয়ারের মুখ। কোন পাহাড়কে পাশ থেকে দেখলে মানুষের মুখ। কিম্বা চাঁদের আলোয় গাছের ডাল দুলছে। দেখে মনে হচ্ছে পেত্নী। এই যে অন্য কিছুর সঙ্গে বাস্তবে মিল পাওয়া, অন্যরকম মনে হওয়া। বহু প্রাচীনকাল থেকেই আছে।’
‘আগে মানুষ এগুলোতে ভয় পেত। কেউকেউ এসব দেখত। কল্পনা করে আরেকজনকে বলত। অন্যরা ভাবত লোকটার মাথার গোলমাল। ওসব কিছু হয় নাকি?
‘এমনও হত। কেউ আবার কথা বা গানের মধ্যেই লুকানো অন্য গুপ্তকথা সংকেত খুঁজে পেত। সবাই ভাবত লোকটারই কোন অসুখ করেছে।’
‘এগুলোকে দেখার ভুল, চোখের ভুল ভাবত। তবে আজকের বিজ্ঞানের উন্নতিতে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত-- ভাবনাগুলো ভুল নয়। আমাদের মাথায় সংকেত তৈরির পদ্ধতিতেই থাকে। সবার ব্রেনেই এই ভাবনার ছাপ তৈরি ক্ষমতা আছে। কারো কারো সেই ক্ষমতাটা বেশি।’
‘একটা ছড়া শোনাই—' স্যার একটা ছড়া শুরু করলেন। ছোট্ট।
‘লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই
দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই।
ঘাটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন-ছুটছে যখন
মায়ের কাছে বাবার কাছে করছি বকম বকম।
হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে চলন্ত সব গাছে
এক একরকম ভঙ্গি ফোটে এক একরকম নাচে।
“ওমা, দেখো নৃত্যনাট্য”--যেই বলেছি আমি
মা বকে দেয়, 'বড্ড তোমার বেড়েছে ফাজলামি।'
চিড়িয়াখানার নাম জানো তো আমার সেজ মেসোর
আদর করে দেখিয়ে দিলেন পশুরাজের কেশর।
ক’দিন পরে চুন খসানো দেয়াল জুড়ে এ কী
ঠিক অবিকল সেইরকমই মূর্তি যেন দেখি?
ক্লাসের মধ্যে যেই বলেছি সুরঞ্জনার কাছে
'জানিস! আমার ঘরের মধ্যে সিংহ বাঁধা আছে।'
শুনতে পেয়ে দিদিমণি অমনি বলেন 'শোন,
এসব কথা আবার যেন না শুনি কখনো।'
বলি না তাই সে সব কথা সামলে থাকি খুব
কিন্তু সেদিন হয়েছে কি এমনি বেয়াকুব
আকাশ পারে আবারও চোখ গিয়েছে আটকে
শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।’
সঙ্গে সঙ্গে নীলা হাত তুলল। খুব। উত্তেজিত। হ্যাঁ। স্যার। এটা শঙ্খ ঘোষের লেখা। ছড়াটার নাম ‘মিথ্যে কথা'।
'বাহ! তুমি জানো দেখছি।'
'হ্যাঁ স্যার। আমি আবৃত্তি শিখি।'
‘তোমাদের আরও সহজ উদাহরণ দিচ্ছি। এখন প্রায় সবার হাতেই মোবাইল। ইমোজি ব্যবহার করে। মেসেজে। হতে পারে সেটা কান্নার। কী হাসির। কী স্রেফ মুখ।’
স্যার বোর্ডে গোল আঁকলেন। দুটো ছোট দাগ। নিচে একটা বড় দাগ।
বললেন, 'এটার সঙ্গে কি কিছুর মিল পাচ্ছ?'
'হ্যাঁ স্যার। মানুষের মুখ মনে হচ্ছে।'
'ঠিক বলেছ। এটাকে মানুষের মুখ বলে ভাবি। খুঁটিয়ে দেখো তো। চোখের মণি। ঠোঁট। নাক। কান। এসব আছে? কিছুই নেই। তবুও এটাকে তোমরা মানুষের মুখ বলে ভাবছো। ঠিক এভাবেই মাথায় কোন কিছুতে মানুষের মুখের ছবি তৈরি হতেই পারে। কাছাকাছি কতগুলো সংকেত থাকতে পারে। যা জুড়ে মুখের প্যাটার্ন তৈরি করে।
‘এই প্যাটার্নে বাস্তবে মুখের একটা মুখের মিল থাকতেও পারে। নাও পারে। কোন পরিচিত মানুষ সামনে দাঁড়ালে নিমেষেই চিনতে পারি। কারণ মাথার ভেতরে মানুষটা দেখেই প্যাটার্নটা চটপট তৈরি হয়। এই প্যাটার্নগুলো স্মৃতিতে জমা থাকে। সামনের মানুষটার মুখের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। তাই পরিচিত মানুষকে চিনতে পারি।’
‘কিছু অসুখ আছে। সেটা হলে মেমোরির এই প্যাটার্ন তৈরির ক্ষমতাটা নষ্ট হয়। চেনামুখও অচেনা লাগে। তাহলে সবার এই মেঘ। গাছ। পাহাড়। গাছের ডাল দেখে এমন মনে হয় না কেন? কারণ এই ক্ষমতাটা সবার থাকে না। কিছু মানুষের থাকে। ক্ষমতাটাকে কল্পনা বিস্তৃত করতে পারে।
‘এই রকম মেঘ। গাছ। পাহাড়। অথবা সাধারণ রঙ চটে যাওয়া দেওয়াল। জলের ফোঁটা। রঙের ছিটে। এর মধ্যে অনেক সময় মানুষের মুখের আদল। জানোয়ার। পাখি। অনেকের চোখে পড়তে পারে। যা অন্য মানুষের চোখে ভাসে না। বিজ্ঞানীদের প্রমাণে আগে লোকেরা হাসাহাসি করেছে। এদেরকে অসুস্থ বলছে। যদিও এসব কিছুই না। যেমন ওই 'মিথ্যে কথা' ছড়াটায়। বাচ্চাটার কল্পনায় আকাশের মেঘে এক একরকম ছবি। এক একরকম ভঙ্গি। কখনও গাছগুলো হাত পা তুলে নাচছে। কখনও চুন খসানো দেওয়ালে সিংহের কেশর। কখনও মেঘের ফাঁকে রবীন্দ্রনাথের ছবি।
‘বাচ্চার এই দেখাটাকে অনেকেই ভালভাবে নিচ্ছে না।
‘মা বলছে ফাজলামি।
‘সুরঞ্জনাকে চুন খসানো দেওয়ালে সিংহের কেশরের গল্প বললে দিদিমণি ধমক দিচ্ছে। বাচ্চাটা বকুনি শুনছে। বেচারা বেয়াকুব হচ্ছে। কাউকে মনের কথাটা বলতে পারছে না। এই দেখতে পাওয়াটাকে চারপাশের লোকজন ভালোভাবে নিচ্ছে না। বাচ্চাটার সেটাতেও ভয়। নিজের মনেই ভাবনাকে চেপে রাখছে।
‘তবুও এত বকাঝকার পরেও ও মেঘের ফাঁকে রবীন্দ্রনাথকে পুনরায় দেখতে পায়। এই দেখতে পাওয়াটা অন্য সবার কাছে মিথ্যে। বাচ্চাটার কাছে নয়।’
‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। এমন একজন বিখ্যাত মানুষ। অনেকেই আছেন। ওনার নামটা বেশি পরিচিত। মনে করা হয়, তার এক একটি ছবির ভেতরে আরও একাধিক ছবি লুকিয়ে আছে। বিভিন্ন গুপ্তসংকেত রেখেছেন। যা এখনও পরিষ্কার বোঝা যায়নি।’
পলু জিজ্ঞেস করল, 'স্যার এমন কেন হয়?'
'এখন চিকিৎসার যন্ত্রপাতি অনেক উন্নত। মাথার ভেতরের ছবি তুলে খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়েছে। আমাদের খুলির নিচটা আখরোটের মতন। আখরোটটা শক্ত খোলাটার মধ্যে যেমন থাকে। দেখা গেছে অনেকটা ঠিক এমনই। কোঁচকানো। ভাঁজ। ঢেউ খেলানো। এই ঢেউয়ে উঁচুনিচু ভাঁজ আছে। এই ভাঁজের নিচের অংশটা সব মানুষের আলাদা আলাদা। এইযে অন্যরকম কিছু দেখতে পাওয়া। যা ঐ 'মিথ্যে কথা'র বাচ্চাটা পাচ্ছে। আর সেইমত বাইরের জগতের কল্পিত মুখ। নাচ। ছবি। মানুষ। জন্তু। কি অন্য কিছু। সবাই কল্পনা করতে পারছে না। এটা ওই তফাতের জন্য।’
এবার স্যার গুণময়ের ছবিটাকে বোর্ডের একপাশে আঁকলেন। এখন আর আমরা কেউই হাসলাম না। আরেক পাশে নিজের মুখটা। মুখোশ পরা।
এবার বললেন, 'খেয়াল করো। কী করছি।'
মুখোশটাকে খুললেন। আর ছবি থেকে মুখোশের অংশটুকু মুছে দিলেন। আর করলেন কী নিজের মুখোশ খোলা ছবিটায় মাথার উপরে তিনটে উঁচু উঁচু বাঁকানো রেখা দিলেন।
বললেন, 'দেখ মুখোশটা ক্লাসেই খুলেছিলাম। পেছনের ইলাস্টিকের সঙ্গে লেগে কয়েকটা চুল উঠেছিল। আর গুণের আঁকা ছবিটায় এইযে কয়েকটা চুল। রেখায় আঁকলাম। এবার কাঁধের ব্যাগটা আঁকছি। আর সেইসঙ্গে গুণের ছবিতে লেজের মত অংশটাকে।’
ব্যাগটা মুছে শুধু ঝোলানো ফিতের নিচটা রাখলেন। নিচে যে তিনটে পায়ের মত অংশ। ওর ছবিতে ওটা বদলে টেবিলের তিনটে পা করলেন।
বললেন, 'তোমাদের বেঞ্চ থেকে দেখলে টেবিলটাকে এমনই দেখায়।'
আমরাও দেখলাম। সত্যিই তো টেবিলে ওই পায়াই দেখা যাচ্ছে!
এবার বললেন, 'ভালো করে দেখো। মুখোশটা কেমন জাল জাল। তাই না?’ এবার আবার গুণের ছবির মত নিজের ছবির মুখের সামনে জালের মত অংশ আঁকলেন।
'এবার দেখো। গুণের ছবিটার সঙ্গে কি আমার আঁকা ছবিটার কোন তফাৎ আছে?'
'না স্যার।'
'অথচ সেদি তোমাদের হাসি পেয়েছিল। আজ কিন্তু আমি ওর ছবি বুঝিয়ে দেবার পর আর কেউ হাসছ না। গৌরহরির আঁকার হাত চমৎকার। মুখের ছবিটা পোর্ট্রেট হিসেবে এক নম্বর। তবে একটা তফাৎ আছে। গৌরহরি যা দেখেছে তাই হুবহু এঁকেছে।’
‘তোমরা যা দেখোনি। গুণময় তেমনই কিছু দেখেছে। ছবিতেও চমৎকার ফুটিয়েছে। আমি অসুখের জন্য মাস্ক পরি। এটা আমার স্বাভাবিক জীবনযাপনে একটা বাধা। ইচ্ছে না করলেও পরতে হবে। এটাকে বাদ দিয়ে আমার জীবন অসম্ভব। অথচ সত্যি বলতে কি আমার এটা বাদ দেওয়ার উপায় নেই। কষ্ট হলেও নেই। এই অনিচ্ছে নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে। লোকে হাসাহাসি করলেও নিরুপায়। সত্যিই একটা অসহনীয় অবস্থা। এসব দেখে হাসি আসাই স্বাভাবিক। আমাকে যারা চেনে না অবাক হয়ে দেখে। যেন আমি একটা আশ্চর্য কিছু। আজব জন্তু। এসব আমার ভাল লাগে না।’
‘গৌরহরির ছবিতে আমি অবশ্যই আছি। তবে আমার কষ্টটা নেই।
‘গুণময়ের ছবিতে আসল আমি। অসহনীয় জীবনের আমি। এটা গুণময়েরর বিশেষ কৃতিত্ব।’
ক্লাসে হাততালির ঝড়। গৌরহরি তো দিচ্ছেই। এমনকি জয়দব শীলও। শুধু গুণের মুখ ঢাকা। খুব কাঁদছে।