• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • মিষ্টিমুখ : পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়


    লালি বলল, ‘ওফ্‌, কত জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায় ওদের মা-বাবা ওদের, ইস্কুলে একটা মোটামুটি লম্বা ছুটি পেলেই হলো। ব্যস, আর নিজের মুখেও বলতে হয় না কুসুম আর সৌরভকে, ওদের মা-বাবা নিজে থেকেই শুধাবে, কোথায় তাদের ইচ্ছে করে যেতে।’

    ছোটেলাল বলল, ‘ঠিকই বলছিস দিদি। এই দেখ না, এই বড়দিনের ছুটিতেই ওরা যাচ্ছে মুম্বই। কী যে মজা হবে ওদের। আর ওরা ফেরার পরে আমাদের শুধু ওদের জানলার এই ফাটলের অন্ধকারে বসে ওদের সমুদ্র দেখার গল্প শুনেই দিন কাটাতে হবে।’

    লালি আদ্যিকালের বুড়ির মতো বলল, ‘হয় রে ভাই, এমনিই হয়। দেখতি আমরা পিঁপড়ে না হয়ে মানুষ হলে আমাদেরও কত্তো মজা থাকত।’

    ছোটেলাল বলল, ‘মানুষও হবার দরকার নেই। আমরা যদি লাল পিঁপড়ে না হয়ে কালো পিঁপড়ে হতাম তাতেই মজা কিছু কম থাকত না।’

    লালি বলল, ‘আমার কী মনে হয় জানিস রে ভাই, লাল পিঁপড়ের মা-বাবারা তাদের ছেলে-মেয়েদের ভালো করে ভালোই বাসে না।’

    ছোটেলাল বলল, ‘হুঁ, আমারও তাই মনে হয়।’

    মা দাদুকে একটা চিনির দানা খেতে দিচ্ছিলেন। দাদুর অনেক বয়েস হয়েছে, তা প্রায় চার বছর। কোথাও আর ঘোরাঘুরি করতে পারেন না। সারা দিন এক জায়গায় বসে থাকেন। ডাক্তার আন্টি, মানে পিপীলিকা বোস বলেছেন, এই সময় রোজ ঘুম থেকে উঠেই দাদুকে একটা চিনির নয় মিছিরির ছোটো দানা খেতেই হবে। রাতে আরেকটা।

    লালি আর ছোটেলালের কথা শুনতে পেয়ে মা বললেন, ‘আমরা লাল পিঁপড়েরা আমাদের সন্তানদের ভালোবাসি না, মোটেও তেমনটা নয়।’

    লালিটা খুব মুখরা। সে মা-র কথার জবাবে বলল, ‘তা-লে আমাদের দূরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাও না কেন?’

    ছোটেলাল বলল, ‘আমাদের ইস্কুলও তো কুসুম-সৌরভদের মতো নয়। আমাদের কোনো চাপ নেই। পড়া মুখস্থও নেই। শুধু প্রকৃতিপাঠ। সে আমরা ঠিক শিখে যাবই ধীরে ধীরে। প্রকৃতি মা-ও আমাদের বেঁধে রাখেন না। যখনি ইচ্ছে ছুটি নাও। তবু কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে বাবা-মাদের গড়িমসি।’

    দাদু বললেন, ‘তোমরা মন্দ কিছুই বলছ না। কিন্তু দাদুভাই, দিদি, এত বয়েসেও আমার এই এদের পুরো ঘর আর বাগান দেখাই শেষ হল না। মুম্বই শহর দেখতে হলে হাজার জন্মের কল্পনাও ছোটো পড়ে যাবে যে ভাই। তবু ইচ্ছের ওপর তো জোর নেই। এই বুড়ো বয়েসে আমারও মাঝে মাঝে ভীমরতি হয়। বড়ো বড়ো জায়গা দেখতে ইচ্ছে করে।’

    দাদুর জন্য লালি আর ছোটেলালের দারুণ দুঃখ। ওরা জানে, দাদুর আয়ু শেষ হয়ে আসছে। পাঁচ বছরের বেশি ওদের প্রজাতির কেউই বাঁচে না। দাদু কবে যে চলে যাবেন হুট করে!

    কিন্তু এই দাদুর ইচ্ছেতেই বাবাকে শেষে হার মানতে হলো।

    মা বললেন, ‘কিন্তু বাবা, আমরা সবাই অত দূরে ঘুরতে গেলে আপনার দেখাশোনা, মনে করে চিনি খাওয়ানো এসব কে করবে?’

    দাদু বললেন, ‘পিপীলিকা বোস আমার নাতনির বয়েসি। আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। দাদুন-দাদুন করে গলা শুকোয়। আমি কথা বলেছি। ও-ই থাকবে আমার কাছে।’

    ছোটেলাল বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, সত্যি আমরা ট্রেনে চেপেছি?’

    বাবা বললেন, ‘তাই তো মনে হচ্ছে। কুসুম-সৌরভের বাবা বললেন না সেদিন, রাত আটটা কুড়িতে ট্রেন, সেই ট্রেনেই যাওয়া? আজই ত শুক্কুরবার, সেই দিন, নাকি গো?’

    লালিদের মা বললেন, ‘আমি তো সেরকমই জানি।’

    লালি বলল, ‘কিন্তু ট্রেন যে চলছে না বাবা।’

    বাবা বললেন, ‘চলছে, চলছে। ওরকম মনে হয়। এতো বড়ো রেলগাড়ি, মানুষই বুঝতে পারে না চলার সময় তার আমরা!’

    মা বললেন, ‘তাছাড়া আমরা আছি জুতোর ভেতর, বোঝা যায় কখনো!’ তারপর বাবাকে বললেন, ‘হ্যাঁ গো, আমরা ঠিক কুসুম-সৌরভের বাবার জুতোতেই তো ঢুকেছি? ওদের মা-র আবার এই সরু হিল তোলা জুতো।’

    বাবা বললেন, ‘হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ।’

    মা বললেন, ‘তবু কেন চাপ লাগছে বলো দেখি। ওনারই তো সবচেয়ে বড়ো জুতো বাড়ির মধ্যে। লালি ছোটু তোমাদের কষ্ট হচ্ছে না তো? হলে বোলো।’

    দু-জনই বলল, ‘না মা, আমাদের কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না।’

    বাবা বললেন, ‘মানুষের পায়ের সামনের দিক আর গোড়ালির দিকটাতেই বেশি চাপ। মাঝখানটা একেবারে ফাঁকা। বুদ্ধি করে সেখানেই এসে ঢুকেছি। এ বুদ্ধি অবশ্য আমার নয়। বাবার। তা তোমাদের সামনের দিক আর গোড়ালির দিকে বেশি ঘেঁষার দরকার নেই।’

    ছোটেলাল লালিকে বলল, ‘জানিস দিদি, কুসুম আর সৌরভ বলছিল, মুম্বইয়ে নাকি অনেক গুন্ডা। তাদের ভীষণ চেহারা।’

    লালি বলল, ‘আমাদের ভয় কী! আমরা তো ওদের জুতোর ভেতরেই থাকলাম। আর কুসুমদের বাবাও খুবই বড়ো মানুষ, ওনাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের চিন্তা কিছুই নেই। আমরা শুধু মাঝে মাঝে জুতোর মুখে এসে শহর দেখব। কী মজা হবে না রে ভাই?’

    ছোটেলাল বলল, ‘হ্যাঁ দিদি, ব্যাপক এনজয় হবে।’

    লালি আর ছোটেলাল দু-জনই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল মা-র ডাকে।

    ‘অ্যাই ওঠ্‌ ওঠ্‌। এসে গেছি।’

    দুই ভাই-বোন ঘুম চোখে বলল—

    ‘এসে গেছি?’

    ‘এসে গেছি!’

    মা বললেন, ‘অনেকক্ষণ। জুতোটা খোলা বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল। তোদের বাবা বেরিয়ে জায়গাটা একটু দেখে আসতে গেছেন।’

    ছোটেলাল বলল, ‘মা, বাবা যদি হারিয়ে যায়?’

    ‘হারান কখনো! তোর বাবা বোকা নন। জুতোর কাছাকাছিই থাকবেন।’

    লালি বলল, ও মা, এটা কি একটা ঘর?’

    ‘কী জানি বাপু। মাথার ওপর নীল আকাশও দেখা যাচ্ছে অথচ।’

    ছোটেলাল বলল, ‘এখানে আকাশ কী কাছে! দাদুকে গিয়ে বলব।’

    এই সময় বাবা এসে পড়ে মাকে বললেন, ‘একটু দেখেই বুঝে গেছি। একেবারে খাস মুম্বই। বিরাট জায়গা।’

    লালি নাকি গলায় বলল, ‘আঁমরা কঁখন বেঁরোব, বাঁবা?’

    বাবা বললেন, ‘ওরা যখন ঘুরতে এসেছেন তখন কি আর ঘরে বসে থাকবেন? সন্ধ্যেবেলা নিশ্চয় বেরোবেন সবাইকে নিয়ে। ওদের বেরোনো মানেই তো আমাদের ঘুরতে যাওয়া।’

    মা-কে বললেন, ‘হ্যাঁ গো, ছেলেমেয়ে দুটোর কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা দেখতে হয় যে। তোমারও খিদে পাওয়ার কথা।’

    জুতোর থেকে বেরিয়ে জুতোর কাছেই দাঁড়িয়েছিল সবাই। কয়েক জন হেঁটে আসছে ভারিক্কি চালে। এটা কি তবে রাস্তা? কাছে আসতে দেখা গেল, যা ভয় করেছিল তাই। মুশকো মতো চেহারার এক ডেঁয়ো। কুচকচে কালো রং। মাথাটা এই বড়ো। বিরাট দুটি শুঁড়। মুখের দু-পাশে ধারালো বাঁকা করাতের মতো খাঁজ কাটা। পরিচয় না দিলেও চলে। দেখেই বোঝা যায় সে কে এবং কী। সঙ্গে আবার তিন চ্যালা।

    ছোটেলাল ফিসফিস করে লালিকে বলল, ‘দিদি, ওই দেখ এসে গেছে মুম্বইয়ের গুন্ডা! বলেছিলাম না?’

    বাবা তখন ভয়ে কাঁপছে। মা তো কেঁদেই ফেলেছে।

    ডেঁয়োটা ভীষণ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বাবাকে বলল, ‘এই এখেনে দল পাকাচ্ছ কেন বাপ?’

    বাবা তো-তো করতে লাগলেন।

    ডেঁয়ো বলল, ‘আর কত ঘর চাই তোমাদের অ্যাঁ? একটা অত বড়ো রুম দিয়েছি, তাও কুলোয় না? তা আমার এলাকায় যে এসেছ, আমাকে শুধিয়ে এসেছ? চেনো বাছাধনেরা আমি কে? এই অ্যান্টাসিড, বলে দে তো কুটুমদের, আমি কে।’

    তার অ্যান্টাসিড নামের শাকরেদ অমনি বলল, ‘এনার নাম ফর্মিক অ্যাসিড। যাকে বলবে সে-ই চিনবে।’

    আরেকজন শাকরেদ বলল, ‘আমাদের গুরু চাচ্ছেন, মানে মানে এখান থেকে সবাই কেটে পড়ো। আর কোনোদিন এই ঘরে ভুলেও পা রেখো না, বুইলে?’

    লালি সাহস করে খোদ ফর্মিক অ্যাসিডের দিকে ফিরে বলল, ‘কিন্তু আমরা তো মুম্বই শহর ঘুরতে এসেছি কাকু।’

    ফর্মিক অ্যাসিডের মুখের করাত দুটো দু-পাশে সরে গিয়ে মুখটা হাঁ হয়ে গেল।

    অবাক ভাবের নেশাটা কেটে গেলে সে বলল, ‘মুম্বই শহর! খেপেছ মামণি? এটা তো পাশের রুম। চেনো না বুঝি?’

    অ্যান্টাসিড ফোড়ন কেটে বলল, ‘এদিকে কোনোদিন আসোনি বুঝি?’

    দু-নম্বর চ্যালা বলল, ‘দেখছো না ছাদে নতুন নীল রং। কিছুদিন ব্যবহার করত না। এবার করবে।

    ফর্মিক অ্যাসিড বলল, ‘কিন্তু কুসুমদের বাবাও আমাকে সমঝে চলে। জানে ফর্মিক অ্যাসিড কী বস্তু। যাও, এবার পাশের ঘরের ছেলে-মেয়ে—’

    অ্যান্টাসিড বলল, ‘আর মা-বাপেরা—’

    ফর্মিক অ্যাসিড বলল, ‘পাশের ঘরেই ফেরৎ যাও।’

    লালি বলল, ‘কিন্তু ওরাই তো বলেছিলেন মুম্বই যাবেন ঘুরতে।’

    ফর্মিক বলল, ‘যেদিন বলেছিলেন, তোমরা শোনোনি খুকি, সেদিনই হয়েছে ক্যানসেল।’

    ‘বা রে, ট্রেনে চেপে জুতোর ভেতর আমরা যে মুম্বই এলাম, তার বেলা?’

    ‘ভুল। জুতো আজ দশ-বারো দিন যেখানকার সেখানেই আছে। নট নড়ন-চড়ন।’

    ‘ধ্যেৎ, তা আবার হয়?’

    ফর্মিক অ্যাসিড দুঃখ-দুঃখ মুখে নিজেকে নিজেও যেন বলল, ‘আমাদের কথার কি কোনো দামই নেই?’

    অ্যান্টাসিড বলল, ‘আহা গো, গুরু চোট পেল মনে। চলো তবে তোমাকে সত্যিটা দেখিয়ে দিই।’

    লালিকে নিয়ে অ্যান্টাসিড জানলা দিয়ে নিচে নেমে গেল।

    ফিরে এল একটু পরেই। আর বিশ্বাস না হয়ে উপায় নেই। জানলার ওপারে লালি নিজেদের আস্তানা দেখে এল। কিন্তু এখান থেকে সত্যি কিছুই বোঝা যায় না।

    ফর্মিক অ্যাসিড বলল, ‘গৃহপ্রবেশের দিন এলে, মিষ্টি মুখ করে যাও। ওরে নিয়ে আয়—’

    তিন শাকরেদ দৌড়ে গেল, ছুটে এল। সবার মুখে দরবেশের টুকরো।

    ফর্মিক অ্যাসিড বলল, ‘কুসুমদের বাবা মিঠাই আনিয়েছেন বটে। কিন্তু আমাদের ভাগ আমরা বুঝে নিয়েছি। মুম্বই না গেলেও এ হলো মুম্বই কা লাড্ডু। মদন নাগের দোকানের হলেও আসলে এসেছে খাস মুম্বই থেকেই। আমাদের মুখ খুব সেয়ানা। আমারা চিনে যাই। খেয়ে দেখো।’

    লালিদের মুখ কাঁদো-কাঁদো। যদিও ফর্মিক অ্যাসিড বলেছে, আগের কথা ওরা ফিরিয়ে নিচ্ছে। লালিরা যেন এদিকে মাঝে মাঝে আসে। তাতে ওদের ভাল লাগবে। আরেকটা সান্ত্বনাও আছে। লালি-ছোটেলালরা ভাবছে, মুম্বই না গিয়েও যদি দাদুর জন্যে মুম্বই-লাড্ডুর একটা দানা নিয়ে যায়, তো ক্ষতি কী!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments