মাঠে মাঠে ফলে আছে হেমন্তের আধপাকা ধান। মাঠের মাঝে ইতিউতি মুখ উঁচিয়ে আছে একটি-দুটি বাড়ি। ফাঁকে ফাঁকে হোগলার বন। কিছু জলা, বড় গাছ—আর হ্যাঁ, এদিকে প্রচুর বাঁশপাতি পাখি আছে। তারা দিব্যি ফড়িং ধরে-ধরে খাচ্ছে আর উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বা তারে বা অন্য কোথাও গিয়ে বসছে। এই দুপুরে কোথাও এখানে কোনো লোকজন নেই। কেবল জেগে আছে বাঁশপাতির দল ও একটি পাড়া। এই পাড়াতেই জ্যোতি থাকে। এখানে আছে একটি ভাঙা টিউওয়েল।
এই টিউওয়েলের কথা জ্যোতি খুব বলে। তাদের পাড়ায় ঢুকতে হলে এই টিউওয়েলকে সাক্ষী রেখেই ঢুকতে হয়।
তা সেই টিউওয়েলের সঙ্গে দেখা হল। জং ধরে একদম লজ্ঝড়ে হয়ে গেছে। এটি গ্রাম্য এলাকা হলেও এখানেও শহুরে জলবাতাস ঢুকে গেছে। ফলে আজকালকার দিনে টিউওয়েলেদের দিন গিয়েছে। সে এখন একা। তাকে সারিয়ে তুলে ব্যবহারযোগ্য করার কথা কেউ ভাবে না। ঘরে ঘরে এখন টুলু পাম্প। ছাদের মাথায়প্লাসটিকের জলট্যাঙ্ক। যাদের তা নেই, আছে চৌবাচ্চা। পঞ্চায়েতের জল এলে বালতি বালতি করে ধরে চৌবাচ্চায় জমিয়ে রাখে।
ওদের পাড়ায় ঢোকার আগে একটি অদ্ভুত বাড়ি আছে। রাস্তার ধারেই, খাপছাড়া ধরনের। রঙহীন, প্লাস্টারহীন একটি টালির চালের দু’কামরা বাড়ি। বাড়ির সামনে একটি বড় কুলগাছ। তার গায়ে একটি পুরানো সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখা। তার পিছনের পুকুরে শালুক ফুটে আছে। বেশ চমৎকার লাগল সামগ্রিক দৃশ্যটা।
পাড়া জানলেও তার বাড়ি কোনটা—সেটা আমার জানা নেই। কেবল ও আমাকে বলেছিল, যেখানে হেমন্তের আধপাকা ধান ফলে আছে, সেখানের হোগলার বনে উড়ে বেড়ানো ফড়িংদের ধরে ধরে খায় বাঁশপাতি পাখিরা, তার উল্টোদিকে যে বিহারিপাড়া, আমার ঘর সেখানেই।
জমি কি তোমাদের?
না।
আধাপাকা ধান?
সেখানে আমাদের কোনো অধিকার নেই।
আর বাঁশপাতি?
সে তো পাখিরা নিজেদের নিজেদের।
তোমার তাহলে কী আছে?
আমি নিজেই।
আমি বেকুব হয়ে যাই। বুঝে যাই মাস্কের আড়ালে জ্যোতি হাসছে। কিন্তু হাসির কোন শব্দ আসে না। তার সঙ্গে আমার আলাপ অটোতে। ট্রেন বন্ধ সেই মার্চ থেকে, বাসও বন্ধ ছিল। এখন যদিও চলছে, কিন্তু তাতে সোসাল ডিস্ট্যান্সের বালাই নেই। কম বাস নামালে যে বাদুড়ঝোলা হবে পাবলিক—একথা বাচ্চা-বুড়ো সকলেই জানে। আবার অনেকে জানে না। তাই যা হবার হচ্ছেও তাই। গাদাগাদি করে বাসও চলছে, লোকে ঝুলছে। সোসাল ডিস্টান্সএর কোনো উপায় নেই। অনেকে কম দূরত্বের অফিসে যেতে টোটো বুক করেছে মাসকাবারি হিসেবে।
বলি, বিহার থেকে তবে কী নিয়ে এলে আমার জন্যে?
সে বলে, নিজেকে।
আমি চুপ থাকি। বুকটা কেমন যেন আনন্দে ভরে যায়। এই মুখ ঢাকা অবস্থাতেও যে একবারও কেউ কারও মুখ না-দেখে প্রেমে পড়া যায়, আমিই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একবার তার কাছে আবদার করেছিলাম, মাস্ক খোলার জন্য, সে ঘাড় নেড়েছে। বলেছে, আগে সব কিছু মিটে যাক।
এখুনি সব মিটবে বলে তোমার মনে হয়?
আমার হিসেবে তিন বছর সময় লাগবে সবকিছু স্বাভাবিক হতে।
আমি ভুরু কোঁচকাই। বলি, এতদিন কেন?
দেখো, একটা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হতে দু-বছর লাগে। কাগজেই পড়েছি।সেই হিসেবে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কাছে সেই ভ্যাকসিন আসতে আসতে লেগে যাবে আরও এক বছর—ঠিক বললাম?
মাথা নাড়লাম। যুক্তি আছে কথার। বলি, ততদিনে কী হবে?
তখনি আসবে আসল নিউ নর্ম্যাল। এই দেখো না, ট্রেন চালানো নিয়ে টালবাহানা, কিন্তু চালাচ্ছে কি? চালাচ্ছে না। যা ট্রেন চলছে সেটা স্টাফদের জন্য। হেলথের লোকদের অবদি উঠতে দিচ্ছে না। আমাদের কথা ছাড়ো, আমরা সাধারণ চাকরি করি। এই অবস্থায় বাস ছেড়ে বেশি ভাড়ার অটো ছাড়া আমদের আর ভরসা কী?
হ্যাঁ, আমরা অটোতেই যাতায়াত করি। কোভিডকালীন আপতকালীন নতুন রুট। বাসে যে-রাস্তা যেতে ভাড়া লাগত দশটাকা, অটোতে লাগে ত্রিশ টাকা। যাতায়াতের পথেই আমাদের আলাপ। সে বলে, আমার কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে।
বাজে কথা!
সত্যি হয়েছে।
কার সঙ্গে?
একটি ছেলের সঙ্গে।
মেয়েদের বিয়ে তো ছেলেদের সঙ্গেই হয়।
ভুল!
কেন?
মেয়েদের বিয়ে মেয়েদের সঙ্গেও হয়।
হুম! তোমারও নিশ্চয় তেমন হয়েছে।
তানয়। তবে আমার বরের আর একটি বউ আছে। সেটা হল ছেলে বউ।
মানে?
সে আগেই একজন ছেলেকে গোপনে বিয়ে করেছে। পড়ে বাড়ির চাপে করেছে আমাকে। আমাকে ও ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু তাকে ছাড়েনি। এই হল তার প্রেম।
তোমার কথা কিছুই বুঝি না।
বেশি বোঝার চেষ্টাও কোরো না।
কারণ?
মাথা ঘেঁটে যাবে।
এখুনি যাচ্ছে।
যাবেই তো।
এতটা পথ একসঙ্গে যাই, একবারও মাস্ক নামাও না কেন?
আমাকে দেখতে ভালো নয়।
বাজে কথা।
সত্যি ভালো নয়। মোবাইলে ছবি তোলা আছে, দেখাতে পারি।
সে অন্য মেয়ের ছবি।
বিশ্বাস করা না-করা তোমার ব্যাপার।
তার পর আর মেয়েটিকে দেখি না। সে তার নাম বলেছিল বটে, ঠিকানাও বলেছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে সব পেলাম তাকে পেলাম না। সকলেই বলল, জ্যোতি নামে এখানে কেউ থাকে না। হ্যাঁ, এটা একটা বিহারি পাড়া, এখানের সকলেই বিহারি।তারা বাস করে এই ছোট ছোট ঘরে। কাজ করে লেবারের। পয়সার অভাবে পাঁচ ইঞ্চির দেয়াল তুলে সকলেই প্রায় ঘরের মাথায় টালি চাপিয়েছে। সামনে যার যার ফাঁকা জায়গা ছিল, নানা গাছপালা লাগিয়েছে। ফল ফুল ও নারকেল গাছ। একফালি জমিতে সুপারি গাছ। এইটুকু পাড়া আমাদের। সকলেই সকলকে চেনে, জানে। কিন্তু এর মধ্যে জ্যোতি নামে কেউ নেই। দরকারে তুমি সকলের মুখ দেখতে পারো। কারণ আমরা আর মাস্ক পরি না।
কেন?
মাস্ক পরে কী হবে? সব নিউ-নর্মাল।
এতে পজিটিভ রেট বেড়ে যাবে!
সে আর ক’জন! এই তো লোকাল ট্রেন চালু হয়ে গেল, বাস চলছে—সবাই যাতায়াত করছে—মরছে আর ক’জন! ও আর কিছু হবে না।
করোনাকে তোমরা ভয় পাও না?
আগে পেতাম। তখন ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকতাম। তার পর একটু একটু করে বেরোনো শুরু হল। কাজে-কম্মে যাতায়াত করতে হল। নইলে খাব কী? সেই পথে যেতে যেতে আমরা মাস্ক পরতাম। সেখানে নানাজনে নানাকথা বলে। কেউ বলে, মদ খেলে করোনা হয় না। তাই সে দমভরে মদ খেয়ে শুয়ে থেকেছে একমাস। কেউ বলে সারাদিন পাতিলেবুর জল খেয়েছে ভিটামিন সি বাড়ানোর জন্য। কেউ বলে মাঝে মাঝে মাস্ক খুলে কিছু করোনাভাইরাস দেহের ভেতরে ঢুকিয়ে নিতে হবে, তাতে সহ্য ক্ষমতা বাড়বে।সেই থেকে আমাদের ভয় চলে গেল। এখন আমরা মাস্ক পরি না। লেবু খাই না। তবে হ্যাঁ। মদ খাই। পেট ভরে নয়, মাঝে-মাঝে খাই। ভাতই খেতে পাই না, মদ খাব কী? তবে আমাদের পাড়ায় বিকেলে সকলে আগের মত বসে বসে গল্প করে। আমরাও আড্ডা দিই—জীবন মানে এই আর কী!
কিন্তু ভয়-ই বা পাও নাকেন? এখনও নতুন করে আবার লকডাউন ডাকছে অনেক দেশ। ফ্রান্স, জার্মানি—সামনে শীত।
ডাকুক না। সে ওদের ব্যাপার। আমাদের এখানে করোনা আর কিছু করতে পারবে না। ওই নামেই দাপাবে। ওর সব জারিজুরি শেষ।
একটা গাছের নীচে, ছায়া-রোদে বসে মাছ ধরার জাল বুনছিল খোঁচা-খোঁচা দাড়ির একটি বুড়ো। সে হাত না-থামিয়েই মুখ তুলে বলল, এদ্দিন তো দেখলুম—সাতমাস হয়ে গেল সেই মার্চ থেকে—আর যাই হোক আমাদের পাড়ায় করোনা আসেনি। সকলেই বহাল তবিয়তে আছে। ও হল বড়লোকদের রোগ, গরীবদের ছোঁয় না।
এটা তো আত্মহত্যার সামিল!
সে তুমি মাস্ক পরে থাকো না-কেন, কেউ তোমাকে খুলতে বলছে না।
পাড়ার মধ্যে ইঁটফেলা রাস্তা। সেখানে উবু হয়ে বসে একটি লোক ছিপ ফেলছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে জলের হালকা স্রোত বয়ে যাচ্ছে।তার বঁড়শির ছিপ কাদা-পানায় আটকে গেছিল। সেটিকে ছাড়াবার জন্য চটি খুলে সে জলকাদায় নামল। এখান থেকে রোজই এই দুপুরের সময় সে নানারকম মাছ পায়। সবই জিওল মাছ। আবার মাঝে মাঝে কচ্ছপ ও কুঁচে মেলে। হেব্বি ব্যাপার!
টোপ গেঁথে আবার ছোট্ট ছিপটিসেই কাদাগোলা জলে ফেলে বলল, ওসব রোগটোগ যে একদম ছিল না, তা নয়। ছিল। কিন্তু এখন নেই।
নেই মানে?
আসলে পাবলিক বুঝে গেছে ওসব হল আমেরিকার চাল! যতটা বলা হয়, আসলে ততটা নয়। দেখো না, ট্রাম্পও কেমন মুখ খুলে ঘুরছে। করোনা থাকলে পারত?
আগের লোকটি বলল, তা মেয়েটির সঙ্গে দেখা হচ্ছে না ক’দিন?
হ্যাঁ, সে যাচ্ছে না বটে আর। মনে হয় ট্রেনে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে বলেছিল, ট্রেনে ট্রাভেল করবে না। কারণ ট্রেন চলছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই ভিড়ে ভিড়াক্কার হবে সে ট্রেন। ওতে চাপলে পজিটিভ হবার সম্ভাবনা বেশি।
তবু আমাদের মনে হয়, সে ট্রেনেই যাচ্ছে।
এত ভিড়ের ট্রেন! যায় কীভাবে?
ওই ট্রেনে যেতে তাকে হবেই।
এমন কেন?
হেমন্ত এসে গেছে যে! মাঠে মাঠে আধপাকা ধান—এইসময় সে ট্রেনে না-গিয়ে পারে কেউ?হেমন্তে, ধান পাকার সময় এমনি সব হয়। তবে অটোতে গেলে তোমার সঙ্গে দেখা হত।
না হত না।
কেন? অটো তো চলছে। তুমি তো যাচ্ছ অটোয়।
না। আমি আর যাচ্ছি না। বাইক কিনেছি, ওই যে—রাস্তার ধারে দাঁড় করানো— আমি এখন বাইকে অফিস যাই।
আচ্ছা! ওই লাল বাইক তোমার? তা বেশ। হ্যাঁ, এই বাহনটি বেশ কাজের। আমাদের পাড়ার অনেকেই ধারদেনা করে কিনেছে। এতে বেশ লাভ হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকছে। তবে তারা এখন কেবল হেলমেট পরে, মাস্কের পাট উঠে গেছে—সব নিউ নর্মাল।
কোনো মেয়ে কিনেছে কি?
মেয়েরা? না! তারা কিনে কী করবে?
কাজে-টাজে যায় না কেউ?
যায়। ছেলেরা যায়।
আর মেয়েরা? তারা তবে কী করে?
কী আবার—পাখি দেখে।
পাখি? কী পাখি?
ওই যে—বাঁশপাতি, যা তুমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলে।
আচ্ছা!
হ্যাঁ, সংসারের কাজ বাদ দিয়ে তারা যে-যার মত করে বাঁশপাতি পাখিদের ফড়িং খাবার দৃশ্য দেখে যায়। এই কার্তিকের শেষা করে যখন ধান কাটা হবে, হেমন্তের ফড়িং আরও বাড়বে। তারা সব ধানমাঠের ফড়িং।তখন তাদের মজা দেখে কে! তারাও পাখিদের সঙ্গে পাখি হয়ে উড়তে থাকে।
আর জ্যোতি?
হতে পারে, সেটা কোনো এক বাঁশপাতি পাখির নাম।
মনে পড়ল, কোথাও পড়েছিলাম, এক গোপন সৌন্দর্যের নাম বাঁশপাতি। জ্যোতিও হয়তো তাই।