এক ছিল ছোট্ট বাগান। সেখানে ছিল নানান গাছের মেলা। কিন্তু তার মধ্যে একটি গোলাপ গাছ যেন গোটা বাগানটাকে আলো করে রাখত। গাছটি নেহাতই মাঝারি আকারের। সবসময় অজস্র ফুলে যে ভরে থাকত তাও নয়। কিন্তু একটি দুটি করে ফুল নীল আকাশের দিকে সেই গাছটি মেলে ধরত নিয়মিত। আর সেই ফুলের যেমন চেহারা তেমন গন্ধ। চারিদিক যেন ঝলমল করে উঠত, আশপাশ যেন গন্ধে বিভোর হয়ে যেত সেই ফুল ফুটলে। তাই গোলাপ গাছটি ছিল ওই ছোট্ট বাগানের এক রত্ন।
ওই গোলাপ গাছের গোড়ায় বাস করত একটি বড়োসড়ো শামুক। গাছের গোড়ার মাটিতে গর্তের মধ্যে ছিল তার বাসা। সারাদিন সে তার অন্ধকার গর্তেই থাকত। মাঝে মাঝে সে তার থলথলে মাথা আর ঘাড়টা উঁচিয়ে গর্তের বাইরে আসত। মাথার সামনে শিঙের মতো শুঁড় দুটো নেড়ে নেড়ে বাইরের জগৎটাকে যেন পরখ করে নিত অতি সন্তর্পণে। সেই সুন্দর বাগানের মধ্যে ওই শামুকটি ছিল যেন এক বিসদৃশ অস্তিত্ব।
কিন্তু এই দুই বিপরীতের মধ্যে দেখা হত মাঝেমধ্যেই। আর কথাও হত কখনোসখনো। গোলাপ গাছটি ছিল স্বভাবতই প্রগল্ভ। সে-ই কথা বলতে শুরু করত প্রতিবার। এইভাবে — "দেখেছেন আজ আকাশটা কী অদ্ভুত সুন্দর — বৃষ্টির পর ওই দূরের মেঘগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এক একটা সোনার ভেলা — আর বাতাসে যেন কেমন একটা আশ্চর্য ভিজে গন্ধ — তাই আমি আমার সমস্ত চেষ্টা দিয়ে আমার সমস্ত ফুলগুলোকে ফুটিয়ে তুললাম — আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন তার গন্ধে।"
শামুক যেন অতি কষ্টে তার শুঁড়সমেত মাথাটা তুলে গম্ভীরভাবে বলত — "নাহ্। তেমন কিছুই বুঝছি না। এই রকম আকাশ বাতাস তো রোজই থাকে। তাছাড়া যদি নতুন কিছুও হয়, এই মেঘগুলো তো ভেসে চলে যাবে যে যার মতো খানিক বাদেই। আর ওই ফুলের গন্ধও মিলিয়ে যাবে একটু পরে। তোমার কত গর্বের পাপড়িগুলোও ঝরে যাবে কদিন বাদেই। তাই এই নিয়ে এত আহ্লাদের কী আছে তা আমার বোধগম্য হয় না।।"
শামুকের এই গুরুগম্ভীর কথায় গোলাপ গাছ থতমত খেয়ে চুপ করে যেত। তারপর ভাবত — "ওনার কথাটা কিন্তু সত্যি। আমার ফুলের মেয়াদ তো কদিন মাত্র। কিন্তু আমি যে নিজেকে সামলে রাখতে পারি না কিছুতেই। এমন আকাশ-বাতাস আমায় এভাবে ঘিরে ধরলে আমার ফুলের পাপড়িগুলো ওই আলো-বাতাসে মেলে দিতে না পারলে যে আমার খুব কষ্ট হয়।"
এইভাবে কেটে যেত সহজ সময়। কখনো এক ভোরের নরম আলোয় অগুনতি কুঁড়ি ফুটিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে গোলাপ গাছটি সগর্বে বাতাসে হেলে বলতে থাকত — "আমি সুন্দর! কত সুন্দর! সবাই আমার কাছে এসো। আমায় দ্যাখো।" তখন কত পথচলতি মানুষ যে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তো সেই থরে থরে ভরে থাকা গোলাপফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে তার ইয়ত্তা নেই।
এইভাবেই সেখানে একদিন এসে দাঁড়িয়েছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। তাঁর চেহারায় যেন ঝরে পড়ছে স্বর্গের আলো। মুখে তাঁর যেন ঈশ্বরের দীপ্তি। তিনি এসে অতি যত্নে স্পর্শ করলেন ওই ফুটন্ত গোলাপের পাপড়িগুলি। আর তখনই রচনা করলেন এক আশ্চর্য কবিতার পঙ্ক্তি। তাঁর চেতনার রঙে। শব্দের জাদুতে। গোলাপ গাছটি তার এই সৌভাগ্যে থরথর করে কেঁপে উঠে নিজেকে বলল — "সার্থক হোলো। এতদিনে সার্থক হোলো আমার সমস্ত চেষ্টা।”
একদিন ভোররাতে হঠাৎ শুরু হোলো প্রবল ঝড়বৃষ্টি। সেই ঝড়বৃষ্টির দাপটে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ওই ছোট্ট বাগানটা। আর ওই গোলাপ গাছটা জলঝড়ের অমন তাণ্ডব সহ্য না করতে পেরে হেলে পড়ল একদিকে। চারিদিকে রক্তের ফোঁটার মতো ছড়িয়ে পড়ল তার অকালে খসে যাওয়া পাপড়িগুলো। এই দুর্যোগ থামার পর যখন দিনের শেষবেলায় আবছা আলো এসে পড়ল ওই বাগানে, তখন কাদামাখা শরীর নিয়ে ভিজে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল ওই শামুকটা। বাইরের ঘোলাটে আলোর দিকে তার থলথলে মুখটা তুলে শুঁড় নেড়ে আশপাশ ভালো করে বুঝে নিয়ে বলল — "ভাগ্যিস এই গর্তে বাস করি। তাই বাইরের কোনো ঝড়ঝাপটার ধাক্কা আমায় নিতে হয় না। এই রকম ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকতে হয় না।"
এরপর আবার আকাশ ভরে কমলা আলোয় নতুন দিনের সূর্য উঠলো — দিনের প্রথম আলোয় বাতাসে থিরথির করে কেঁপে উঠতে লাগল বাগানের গাছের নতুন পাতাগুলো — কোত্থেক একঝাঁক ফড়িং এসে উড়তে লাগল গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে — গোলাপগাছটি কিন্তু আর একটিও কুঁড়ি মেলে ধরতে পারল না তখন ওই আকাশের নীচে। আর এরপর কিছুদিন বাদেই ওই গোলাপগাছটা শুকিয়ে পড়ে রইল বাগানের কোণটিতে। শামুকটা একদিন গর্তের বাইরে এসে ওই মরা গাছটাকে দেখে বলল — "এই তো পরিণতি! এতকাল ধরে নিজেকে নিংড়ে এত ফুল ফুটিয়ে কী পেল শেষপর্যন্ত?" এই কথাগুলো বলে সে আবার মাথা গুটিয়ে ঢুকে পড়ল তার মাটির নীচের গর্তটাতে।
এরপর একদিন হঠাৎ ওই বাগানে এসে হাজির হোলো সেই বরেণ্য মানুষটি। বার্ধক্যের ভার এসে পড়েছে তাঁর শরীরে। কিন্তু তাঁর দুচোখে সেই একই রকম বিশাল দৃষ্টি। তিনি এসে বসলেন — ওই শামুকের গর্তের পাশেই। আর ঠিক তখনই ওই গর্ত থেকে বেরিয়ে এল বৃদ্ধ শামুকটা। তার থলথলে মাথাটা তুলে শুঁড় দুটো উঁচিয়ে তাকাল সেই প্রবীণ মানুষটির দিকে। তিনি তখন প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন — "আমায় চিনতে পারছেন? আমি কবি। এখানে আগে এসেছিলাম। নিজের চেতনার রঙে কিছু শব্দ লিখে রাখার চেষ্টা করি মাত্র।"
শামুকটি তাঁর দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে করে বলল — "ও! আপনি কবি! তাহলে তো আপনি ভুল জায়গায় ভুল সময়ে এসেছেন।"
কবি অবাক হয়ে শামুকটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। শামুকটি বলল — "আপনার লেখার বিষয় তো এখানে এখন আর নেই।" কবি বললেন — "তার মানে?" শামুকটি গম্ভীরভাবে উত্তর দিল — "মানে এখন তো বাগানে ওই গোলাপ গাছটা আর নেই। গোলাপফুলও আর নেই। তাই লিখবেন কী নিয়ে?"
কবি একদৃষ্টে ওই শামুকটির দিকে তাকিয়ে বললেন — "তোমায় নিয়ে।"
শামুকটি কয়েক মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে রইল ওই কবির দিকে। তারপর বলল — "আমায়? আমায় নিয়ে লিখবেন? কী যে বলেন! আমার না আছে রূপ। না আছে গুণ। তাছাড়া আমি তো আপনাদের ওই আলোবাতাসের ঢেউয়ের মধ্যে আসতে পারি না কিছুতেই। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাতে আমার কষ্ট হয়। কেউ ছুঁয়ে দিলেও আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাই। গড়িয়ে পড়ে যাই নুড়িপাথরের মতো।"
কথাগুলো বলতে বলতে থরথর করে কেঁপে উঠছিল ওই শামুকটি। প্রবীণ কবি স্থির হয়ে দেখছিলেন। আর শুনছিলেন। শামুকটি আবার বলতে শুরু করল — "মাথা নীচু করে বাইরে আসি — বাইরে সামান্য কিছু হলেই নিজেকে গুটিয়ে নিই নিজের খোলসের মধ্যে — অন্ধকার গর্তে নিজের কুণ্ডলী পাকানো শরীরটাকে নিয়ে কোনোক্রমে টিঁকে থাকি — আর আমায় নিয়ে কবিতা? উপহাস করলেন, তাই না?" — কথাগুলো বলে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই শামুকটি নিজের খোলসে ভরা শরীরটাকে টানতে টানতে ঢুকে পড়ল মাটির নীচে তার নিজস্ব গর্তের মধ্যে। কবি নিশ্চুপে তাকিয়ে রইলেন সেইদিকে।
এরপর আরো কিছুদিন বাদে এক হেমন্তের বিকেলের শেষবেলায়, সেই কবি আবার এসেছিলেন ওই বাগানে। আর এসে বসেছিলেন ওই মরা গোলাপ গাছের গোড়াটির সামনে। তাঁর মনে পড়ছিল কিছুদিন আগের কথাগুলো। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ওই থুরথুরে শামুকটার চেহারাটা। তখনই তাঁর মনে হোলো যে এখনো একটি পঙ্ক্তিও লেখা হয়নি তাঁর ওই শামুকটিকে নিয়ে। অথচ শামুকটিকে তিনি নিজে মুখে বলেছিলেন যে তিনি লিখবেন ওকে নিয়ে। তাহলে হোলো না কেন এই কদিনে? ভাবতে গিয়ে তাঁর মনে হোলো এই থলথলে মাথার কুৎসিত প্রাণীটিকে তিনি তাঁর কবিতায় স্থান দেওয়ার মতো কোনো ক্ষেত্র পাননি এখনও। একটা বিদঘুটে খোলস ঘাড়ে করে অতি সন্তর্পণে নড়তে নড়তে কোনোক্রমে চলতে থাকা প্রাণীটিকে দেখে কোনো ছন্দ আসেনি তাঁর মনে। এই মাটিপৃথিবীর সামান্য কঠিন স্পর্শে যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নুড়ি পাথরের মতো গড়িয়ে পড়ে সহজেই — তাকে শব্দের জাদুতে মুড়ে দেওয়ার মতো কোনো চেষ্টাই হয়নি তাঁর।
গোলাপ গাছের গোড়াটির দিকে তাকিয়ে এই কথাগুলো নিভৃতস্রোতের মতো ভেসে আসছিল তাঁর মনে। কী মনে করে ওই গাছের গোড়ার মাটিতে হাত রাখলেন তিনি। আনমনে ওই মাটিতে আঙুল রাখতেই ওই মাটির কোমল স্তরের মধ্যে একটা শক্ত কিছু হাতে ঠেকল তাঁর। মনে হোলো একটা নুড়ি পাথরের মতো কিছু। মাটির প্রলেপে ঢাকা। সেই মাটির আস্তরণটা খসে গেল তাঁর আঙুলের ছোঁয়ায়। আর তখনই তিনি দেখতে পেলেন ওই ভিতরের বস্তুটিকে। অর্থাৎ সেই শামুকটিকে। আরো সঠিক ভাবে বলতে গেলে সেই শামুকটির খোলসটিকে। কারণ খোলসের ভিতরের সজীব দেহটি এখন আর নেই। পড়ে আছে তার শরীরের নির্জীব আচ্ছাদনটি।
তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেই শামুকের খোলসটির দিকে। আর ওই খোলসটিও যেন নিঃশব্দে পরম কৌতুকে তাকিয়ে রইল ওই কবির দিকে। তারপর সেই সুস্থির আচ্ছাদনটি যেন গাঢ় নীরবতায় কবির দিকে তাকিয়ে এক আশ্চর্য অলীকভাষায় বলতে লাগল —
"কী দেখছেন? কী দেখছেন কবি? একটা কদাকার শামুকের খোলস — তাই না? মনে হচ্ছে তো এই বিশ্রী জিনিসটাকে কবিতায় ঠাঁই দেবে ভেবেছিলেন কী বিরাট মূর্খতায়?"
কবি নির্ণিমেষে তাকিয়ে রইলেন ওই খোলসটির দিকে। আর সে মহা নিঃশব্দে বলে যেতে লাগল — "আমি সেই আস্তরণ — যার নীচে গুটিয়ে থাকে একটা ক্ষীণজীবী প্রাণ — যে বাইরের আলোবাতাসেই সর্বদা সন্ত্রস্ত — প্রকৃতির সামান্য উচ্ছ্বাসেই যে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে সহজেই — সর্বদা মাথা নীচু করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চলাই যার জীবন — আমি তার সেই গুটিয়ে থাকা অস্তিত্বের একমাত্র সহায় ও সম্বল — এই দুর্বল কুৎসিত প্রাণীটির আমৃত্যু অস্তিত্ব আমার এই বিচিত্র আকৃতির ভিতরেই -- তাই আপনার মতো কোনো কবির আমায় দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো কোনো কারণই নেই।"
কবি তাঁর প্রগাঢ় চেতনায় যেন শুনতে পেলেন এই সমস্ত কথাগুলিই — তারপর মনে মনে বলে উঠলেন—"আমি কিন্তু সত্যিই লিখতে চেয়েছিলাম এই শামুকটিকে নিয়ে একটি কবিতা — অথচ অনেক চেষ্টা করেও তার উপযুক্ত ভাব আর ভাষা কিছুতেই নাগালে আসছিল না তাই—"
কথাগুলো মনে মনে বলতে বলতে কবি আবার গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন ওই খোলসটির দিকে। ধুলোমাটিমাখা একটা হলদেটে পাথরের নুড়ি্র মতো চেহারা। যার গায়ে অদ্ভুত কিছু রেখা আর রঙের সর্পিল আভাস।
"খুবই কিম্ভুত কিমাকার কীসব চিহ্ন বলে মনে হচ্ছে, তাই না? নাকি কিছু বাহারি নকশা?" — কথাগুলো যেন ভেসে এল ওই শামুকটার দিক থেকে।
"শুনুন — মন দিয়ে শুনুন কবি — আমার গায়ে লেগে থাকা ওগুলো কোনো নকশা নয় — রেখা আর রঙের বাহার নয় — ওটি আমার ভিতরে বাস করা সেই সদাসন্ত্রস্ত উঞ্ছজীবীর কিছু অবান্তর ইতিহাস — আমার নিজস্ববর্ণমালায় এই সামান্যকথা নিজের গায়েই খোদাই করে রেখে স্থির হয়ে আছি — মাটির ভিতর মাটির সাথে একাকার হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়—"
খোলসটির কথাগুলো মিলিয়ে গেল সদ্য সন্ধার আসন্ন অন্ধকারে। কবি দেখলেন শামুকের গায়ের ওই বিচিত্র আঁকিবুকিগুলি যেন কোনো গূঢ় বর্ণমালার স্রোতের মতো ভেসে যাচ্ছে এক অতল ছায়াপথে। কবি অনুভব করলেন পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা উৎকীর্ণ হয়ে আছে ওই খোলসটির গায়ে — অজস্র তরঙ্গরেখায় কিংবা এক সন্ধ্যাভাষায় লবণাক্তলিপিতে।