স্কুলটা দেখতে অনেকটা ইংরেজি ইউ অক্ষরের মত, দুপাশে দুটো তিনতলা বিল্ডিং খেলার মাঠ ঘিরে, মাঝখানে একটা দোতলা বিল্ডিং। বিল্ডিং তিনটিকে জুড়ে রেখেছে দুটো সিঁড়ি। আকাশে মেঘ, একটু পর পর প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। মাঠের মাঝখানে ঘাসে ঘাসে পানি জমে আছে। ডানদিকের বিল্ডিংয়ের দোতলার বারান্দায় কান ধরে এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি। খেলার মাঠের এদিকে একটা চাম্বুল গাছ উঠে বারান্দাটাকে হালকা আড়াল করেছে। আমার আকাশি রঙের স্কুল ড্রেসের নিচের দিকে কাদা লেগে আছে, হাঁটু সামান্য ছিলে গেছে। রেলিঙের ফাঁকা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তরের পিছন থেকে একটা বেড়াল বেরিয়ে এল। কিছুক্ষণ ধীরে এগিয়ে হঠাৎ দৌড় দিয়ে চলে গেল দারোয়ানের ঘরের পিছন দিকে। এখান থেকে অতদূরে দেখা যায়না। ক্লাসের ভেতর থেকে কবিতা পড়ার আওয়াজ আসছে অনেকক্ষণ ধরে। টিফিনের ছুটি শেষ হয়ে গেছে আগেই। গেটের নিচ দিয়ে হাত বের করে দুটাকার শসার আচার নিয়ে পুকুরপাড়ে বসে খেয়েছি, চেটে ফেলে দিয়েছি খবরের কাগজের টুকরো। ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছ বেয়ে চালতা গাছে ঝুলে থাকা বোলতার বাসায় ছুড়ে দিয়েছি ঢিল। ওই তো, দপ্তরি কাকা হাতুড়ি নিয়ে ঘন্টার দিকে যাচ্ছে, শাস্তি শেষ হবে এখনি। ঢং ঢং ঘন্টার শব্দ এসে কানে আছড়ে পড়ল, আমি লতি ছেড়ে কানে আঙুল দিলাম। পেছনে বাংলার স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলেন। ইশারা করলেন ওনার পেছনে হাঁটতে,আমি পিছন পিছন চললাম। হেডস্যারের রুম মাঠ পার হয়ে ওপাশের বিল্ডিংয়ের নিচ তলায়। বাংলা স্যার আমাকে পছন্দ করেন না। কখনো বলেননি, কিন্তু আমি বুঝতে পারি। হেডস্যার বকুনি দিলেন, টিসি দিয়ে দেবেন বললেন। পরদিন বাবাকে নিয়ে আসতে বললেন। আমি ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে ফিরে চললাম ক্লাসের দিকে। শেষ ক্লাসটা কখনই হয়না, তবুও সবাই বসে থাকে। কাটাকুটি খেলে, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে। আমি খেলিনা, জানালা দিয়ে বাইরে দেখি। স্কুলের পিছন দিকে একটা পরিত্যক্ত বাথরুম। সবাই বলে কোন মেয়ে নাকি আত্মহত্যা করেছে সেখানে। আমি জানি, আসলে তা নয়। হয়ত ফ্লাশ কাজ করছেনা বা পানির লাইন নষ্ট অথবা হয়ত কমোড ভেঙে গিয়েছে। ছুটি হয়ে গেলে হেঁটে হেঁটে বাসায় যাই। আজ বৃষ্টির জন্য রাস্তায় পানি জমেছে। পায়ের কেডস ভিজিয়ে ভিজিয়ে হাঁটছি। বৃষ্টি পড়ছে, থামছে, আবার পড়ছে। আকাশ মেঘে কালো, বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। মাঝেমধ্যে পাশ থেকে হুশ করে গাড়ি চলে যাচ্ছে, ছিটকে উঠছে পানি। পানির উপরে ভাসছে জুস আর চিপসের প্যাকেট। বাবা-মায়েরা রিক্সায় করে নিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাদের। আমার বাবা নেই, মা আছে। বাবা মাকে ফেলে চলে গেছে, আরেকটা বিয়ে করেছে শোনা যায়, যদিও কেউ দেখেনি, উড়োখবর বলা চলে। মা চেয়েচিন্তে সংসার চালায়, মামাদের কাছে, চাচাদের কাছে। হাঁটছি আমি, পা ভিজিয়ে। হঠাৎ আমার পাশ ঘেঁষে একটা রিক্সা থামল। লাফ দিয়ে নেমে ভাড়া মিটিয়ে একটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়াল। চিনতে পারলাম, আমার সাথে কলেজে পড়ত। হড়বড় করে অনেকক্ষণ কথা বলে ছেলেটি জানতে চাইল আমি তার সাথে কোথাও গিয়ে এককাপ কফি খেতে চাই কিনা? আমি না করে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এমনিতেই মা ডিভোর্সি বলে আমার বিয়ে হবার সম্ভাবনা কম। তারপরে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ালে আরও বিয়ে হবেনা। শেষ বিকেলের রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে। শুকনো ধুলায় পা সাদা হয়ে গেছে প্রায়। একটা ছাতা কিনতে পারলে ভালো হত। বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। গেট খুলে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি। দুহাতে বাজার। কনুই দিয়ে কলিংবেলটা বাজালাম। একবার বাজানোর পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার একবার বাজালাম। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আরও একবার বাজানোর পর আমার স্ত্রী দরজা খুলে দিল। খুব অশ্লীল একটা গালি তাকে আমি মনে মনে দিলাম। ছোট ছেলেটা মায়ের আঁচল ধরে পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল, তাই মুখে শুধু বললাম, এতক্ষণ লাগে! জুতো খুলে বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে রেখে গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। হাত পা ধুয়ে বেরিয়ে ট্রাউজার আর একটা ফুলহাতা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে কানটুপি আর মাফলার নিয়ে বেরিয়ে গেলাম দরজায় তালা দিয়ে। গলির মুখে চায়ের দোকানে তাস খেলা হয়, সেখানে আমি সন্ধ্যেটা কাটাই। ঘরে বসে সন্ধ্যেটা কাটতেই চায়না। যারা আসে তারা সবাই প্রায় মধ্যবয়েসি। কত ধরনের আলাপ হয়, ঝগড়া লেগে যায় মাঝেমধ্যে। এরা কেউই রাজনীতি করেনা, আমিও করিনা, তবু রাজনীতির আলাপই বেশি হয়। এলাচগুঁড়া দিয়ে খুব ভালো একটা দুধ-চা হয় এখানে। ঘরে চায়ের তেষ্টা পেলে গরম পানিতে টিব্যাগ দিয়ে খুব বেশি হলে র'চা বানিয়ে খাই। ভালো দুধ-চা খেতে হলে এখানে আসতেই হয়। ঘরে বউ নিয়ে আসুন, বলে দোকানের সবাই। আমি দাম মিটিয়ে হেসে উঠে দাঁড়াই। অন্ধকার কালো গলি দিয়ে ফিরে চলি। ফেরার পথে লক্ষ করি যেখানে আসার নয় সেখানেই ফিরে এসেছি। আমার প্রাক্তন প্রেমিকার বাড়ির সামনে দাঁড়াই। বারান্দার ক্যাকটাস গাছগুলো দেখা যাচ্ছে, অদ্ভুত এক সুর তুলে যেন দুলে উঠছে সেগুলো। রান্নাঘরে বাতি জ্বলল, কেউ যেন সরে গেল জানালা থেকে। বাতি নিভে গেল। আমিও ফিরে চললাম, হাঁটতে হাঁটতে চলেও এলাম। তালা খুলে বাসায় ঢুকলাম, এত দেরি হল যে, মা জিজ্ঞেস করে। সামনে ছাত্রীর পরীক্ষা, তাই একটু বেশি করে পড়ালাম, বললাম আমি। সামনের দিন থেকে যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি, বলে মা। দিনকাল ভালো নয়, রাস্তায় ওৎ পেতে থাকে লোভী পুরুষের দল। কিছু একটা হয়ে গেলে বিয়ে হবেনা। একটা যেকোন ভদ্রগোছের চাকরি পেলেই ছেড়ে দেব টিউশনি, বলতে বলতে বাথরুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে কেটে নিই বরবটি আর আলু। হাঁড়িতে বসিয়ে দিই চাল, একটা ডিমও দিয়ে দিই তাতে। খেতে বসে গরম ভাতে ছড়িয়ে দিলাম একটু ঘি। একা জীবনে এইটুকুও রেঁধে খেতে ইচ্ছে করেনা। খাওয়া শেষে মাকে ফোন করে খোঁজ নিলাম। ভালোই আছে গ্রামের বাড়িতে, পাঙাস মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছে। বাবার কাশিটা একটু বেড়েছে। ওষুধ নিয়ে দেখতে যাব ভাবতে ভাবতে দাঁত মেজে হাঁড়ি পাতিলগুলো ধুয়ে ফেলি। জানালার দিকে চোখ যায়, কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়? তাকিয়ে আছে এদিকে? হয়ত, হয়ত না। আলো নিভিয়ে শুতে চলে যাই। কাল আবার সকাল সকাল অফিস আছে। শোবার ঘরের টিউবলাইট নিভিয়ে ডিমলাইটটা জ্বেলে দেই। বিছানায় শুয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরি আমার ঘুমন্ত স্বামীকে। তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করি। দূরে কোথাও ড্রাম বাজছে, আমার বারান্দার টবের ক্যাকটাস গাছগুলো সেই তালে মৃদু মৃদু গান ধরেছে।