• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | গল্প
    Share
  • মায়ালোকের বাসিন্দারা : লুনা রাহনুমা


    দুই দিন ধরে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে নাতাশা। তৃতীয়বারের মতো মা হতে যাচ্ছে। প্রসববেদনার সাথে পূর্বপরিচয় আছে বলে ব্যথার ভয়ে প্রচণ্ড আতঙ্ক তৈরি হয়েছে মনে। তিনমিনিট পরপর কন্ট্রাকশন আসছে আর ব্যথার আতঙ্কে ভয়ে নীল হয়ে যাচ্ছে নাতাশা। প্রতিবারই মনে হচ্ছে আর নিতে পারবে না। এইবার হার্ট এট্যাক করে মারা যাবে।

    - আমাকে ইপিডুরাল দিন। Give me something, I cannot tolerate this pain anymore!

    নার্স জানায় ইপিডুরাল দেয়া সম্ভব না কারণ ডেলিভারির আগে মিডওয়াইফের সাথে যে প্ল্যান করা হয়েছিল তাতে ইপিডুরালের কথা বলা হয়নি। ইপিডুরাল দিতে ডাক্তার লাগে। নাতাশার সবকিছু নরমাল থাকায় ডেলিভারি রুমে এখন কোন ডাক্তার নেই।

    - ছয় সেন্টিমিটার ডাইলুটেড হয়ে গিয়েছে। যেকোনো সময় বাচ্চার মাথা দেখা যাবে। এখন গ্যাস ছাড়া আর কোন পেইন কিলার না দিলেও চলবে। অভিজ্ঞ মিডওয়াইফ আর অক্সিলারি নার্স মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্তে আসল।

    কন্ট্রাকশন এখন ডিউরেশন কমিয়ে এক মিনিটে নেমেছে। নাতাশার মনে হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে হাসপাতালের অনেকগুলো নার্স, স্টুডেন্ট নার্স, কন্সাল্ট্যান্ট, পাশের রুমের ডাক্তারকে জড়ো করে ফেলেছে। নাতাশার স্বামী শিহাব খুব লজ্জা পাচ্ছে। আবার অসহায়ও বোধ করছে। স্ত্রীর সন্তান তারও সন্তান। কিন্তু প্রসব-বেদনা ভাগ করে নেবার কোন উপায় নেই। নাতাশার হইচইয়ের কারণে ডাক্তারের অনুমতিতে নাতাশার ডান উরুতে পেথিড্রিন ইনজেক্ট করা হলো। পেথিড্রিন রক্তে মিশে ব্যথা কমানোর আগেই নাতাশার বাচ্চাটি মায়ের শরীর থেকে পিছলে বেরিয়ে এল।

    কিছুক্ষণের ভেতর নার্স হাসিমুখে বাচ্চাটিকে নাতাশার বুকে তুলে দিল। শিহাব একটি ধারালো কাঁচি দিয়ে আম্বিলিকাল কর্ডটি কেটে শিশুপুত্রকে মায়ের শরীর থেকে আলাদা করে। জন্মের পর বাচ্চার জন্য মায়ের স্কিনের স্পর্শটুকু খুব জরুরি। সন্তান হয়তো মায়ের গায়ের এই গন্ধ আর স্পর্শ এরপর নিজের ভেতরে অনুভব করতে পারে সারাজীবন।

    - ছেলে দেখতে তোমার মতো হয়েছে নাতাশা, কানের কাছে ফিসফিস করে বলে শিহাব।

    - তোমার ছেলে, তোমার মতো হয়েছে। অনেক হ্যান্ডসাম।

    - আমাদের ছেলে।

    ব্র্যান্ড নিউ ছোট্ট মানুষটিকে নিয়ে ওরা পরদিনই হাসপাতাল থেকে বাড়ি চলে আসল। বাড়িতে অধীর হয়ে অপেক্ষা করে আছে বাচ্চাটির দুইবোন। তারা অপেক্ষা করছে একটি নতুন খেলনার জন্য। ওদের মনে আজ খুব আনন্দ।

    - মা, বেবিকে আমি কোলে নিতে পারব? নাতাশার পাঁচ বছরের মেয়েটি মায়ের কাছে এসে মৃদুস্বরে বলে।

    - অবশ্যই পারবে তৃণ। পশমি ব্ল্যাঙ্কেটে ছোট্ট পুতুলটাকে পেঁচিয়ে মেয়ের কোলে বসিয়ে দিল নাতাশা। তোমার ছোট্ট ভাইয়া।

    - কী নাম ওর?

    - ওর নাম পূষণ।

    - পূষণ!

    - হুম। পূষণ অর্থ সূর্য। তুমি চাইলে বাড়িতে আমরা ওকে অন্য নামেও ডাকতে পারি?

    - আমি ওকে সূর্যই ডাকব, The Sun.

    বড় মেয়ে দূর্বার বয়স এখন এগারো। কিছুটা পরিপক্ক সে। দূর্বার খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে যেতে। কিন্তু কেমন যেন লজ্জা করছে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। নতুন বাবুটাকেও ধরে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। দরজার সামনে দিয়ে বার কয় হেঁটে হেঁটে চলে গেল।

    নাতাশা ডাকে, দূর্বা, এখানে এসো।

    মায়ের কাছে গিয়ে দূর্বা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে নীল ব্ল্যাঙ্কেটে পেঁচানো ছোট্ট বাবুটির দিকে। কী ঘুম তার! চোখই খোলে না। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে দূর্বা। নাতাশা মেয়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে আদর করে। বড়মেয়েটি মায়ের খুব কাছের মানুষ। মাকে ছাড়া গত তিনটি দিন তামান্না আন্টির বাড়িতে থাকতে খুব মন খারাপ হয়েছে তার। মনের কষ্ট চেপে রাখতে রাখতে আজ মাকে দেখে কেঁদেই ফেলল।

    - মা আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।

    - আর মিস করবে না। আমি তো চলে এসেছি। এখন আমরা সবাই একসাথে থাকব।

    বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চা এসেছে। সবার চেয়ে সে বয়সে ছোট। অথচ মনে হচ্ছে বর্তমানে তিনিই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান এই পরিবারে। সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে পূষণ। যখন ঘুমোচ্ছে, যখন সে দুধ খাচ্ছে, যখন তার ন্যাপি চেঞ্জ করা হচ্ছে, যখন সে ফাটা গলায় ওয়া ওয়া করে কাঁদছে - সবসময়ই অনেক দর্শক ভিড় করে থাকছে তার চারপাশে। নাতাশার শরীর এখনো খুব দুর্বল। লেবার পেইনের ভয়ঙ্কর উল্লাস এখন শরীরে না থাকলেও বাচ্চা জন্ম দেয়ার দুঃসহ কষ্টকর পরিশ্রমের অবসাদ ছেয়ে আছে শরীর আর মন দুটোকেই। সন্তান প্রসবের হিংস্র ব্যথার কামড় ওর মনকে স্থবির করে রেখেছে এখনো। বুকের ভেতর কন্ট্রাকশনের আতঙ্ক পাষাণীর মতো কেড়ে নিয়েছে মুখের স্বাভাবিক হাসিটুকু। পূষণ নামের বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ায় ভরে যায় নাতাশার মাতৃত্ব নামক সত্তাটি। নিজের বাবার কথা মনে পড়ে খুব। নাতাশার বাবা নাতাশাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। আর নাতাশার কাছেও সবসময় মায়ের চেয়েও আব্বাই বেশি প্রিয় ছিল।

    শিহাব আর নাতাশার বিয়ের তিন বছর পর ওদের প্রথম সন্তান দূর্বা জন্মাল। সারাটাদিন দূর্বার সাথে কত কথা বলেছে নাতাশা! নিজের হাতে মেয়েকে সব কিছু চিনিয়েছে, জানিয়েছে। বর্ণমালা শিখিয়েছে বইয়ের আর মনের। আর জীবনের ধারাপাতের ছন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যেমন করে সে নিজে জীবনকে জানে, বোঝে। মায়ের আঙ্গুল ছুঁয়ে কন্যাটি বেড়ে উঠেছে লাবণ্যে, লালিত্যে, গীতিতে, মাধুর্যে, পরম সাহচর্য হয়ে ছায়ার মতো মায়ের পাশেপাশে থেকেছে। দূর্বা তার বাবাকেও ভালোবাসে। কিন্তু মায়ের জন্য ভালোবাসাটি একটু কেমন যেন বেশি। সে বড় হয়ে ঠিক মায়ের মতো একজন মানুষ হতে চায়। নাতাশা নিজের নরম মনের মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে।

    এক মেয়ের পর দ্বিতীয়বার আবার মেয়ে নাতাশার জন্ম হওয়ায় ওর বাবা সেইসময় অনেকদিন মেয়েকে দেখতে পর্যন্ত চাননি। নাতাশার জন্মের পর থেকে ওর মায়ের খুব দুর্ভাবনা ছিল, এই মেয়েটিকে বিয়ে দিতে তাদের হয়তো লক্ষ লক্ষ টাকা যৌতুক দিতে হবে পাত্রপক্ষকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বন্ধু হিসেবে একসাথে ওঠাবসা করতে গিয়ে শিহাবের সাথে প্রেম হয়ে গেল। নাতাশাকে বিয়ে করতে চায় বলে শিহাবের পরিবারের সবাই শিহাবকে খুব ভর্ৎসনা করেছিল। সবকিছু মিলিয়ে দীর্ঘ একটা সময় নাতাশার নিজের কাছে নিজের অস্তিত্ব খুব মূল্যহীন মনে হয়েছে। অথচ তবুও দূর্বা, মাকেই বেশি ভালোবাসে। পৃথিবীতে তার আদর্শ মানুষ - মা।

    চোখে পানি আসে নাতাশার। দোয়া করে, মেয়েটি যেমন চায়, ওর জীবনটি যেন ঠিক ওর মায়ের মতোই আনন্দময় হয় শেষপর্যন্ত। শেষটুকু ভালো হলে শুরুর গ্লানির কথা মনে রাখে না মানুষের মন।

    দূর্বার পর জন্ম হলো তৃণর। সুস্থ দুটি বাচ্চা নিয়ে শিহাব তুষ্ট। ঘরভর্তি বাচ্চাদের খেলনা, কাপড়, চিপসের প্যাকেট, ফেটে যাওয়া বেলুন - সব মিলিয়ে বাড়ির ভেতর একটি পূর্ণতা এনে দিয়েছে।

    - আমার দুই মেয়ে আমাদেরকে বুড়ো বয়সে লালনপালন করবে। আমার চিন্তা নাই। শিহাব বলে।

    - আমি একটা ছেলে চাই। আরেকবার ট্রাই করে দেখব। নাতাশা জানায় নিজের ইচ্ছার কথা।

    - তোমার মাথা খারাপ হয়েছে তাস! কোন মানে হয় না।

    - মানে হয়। তুমি বুঝবে না।

    - আমি বুঝব কেন? সবকিছু তো তুমিই বেশি বোঝ।

    - আমি তোমাকে একটা ছোট্ট তুমি উপহার দিতে চাই।

    - আমি কি চেয়েছি সেটা তোমার কাছে? বলেছি কোনদিন?

    - তবুও আমার ইচ্ছা করে খুব। একটা ছোট্ট শিহাব হামাগুড়ি দিবে, হেঁটে বেড়াবে এই বাড়িতে।

    - যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়?

    - হলো। মেয়ে হলেও অসুবিধা নেই। ওরা হবে তিনবোন। তিনটি রাজকন্যা। আলোয় আলোয় রাঙিয়ে দেবে আমাদের সংসার।

    মান-অভিমানের খেলায় অবশেষে নাতাশার ইচ্ছার জয় হলো। ওদের তৃতীয় সন্তান পূষণ এল ঘর আলো করে। এখন শিহাবেরও মনে হয়, সত্যি, পূষণ ছাড়া ঘরটি ঠিক পূর্ণ ছিল না। কানায়কানায় সুখে ভরে উঠল ওদের ছোট্ট গৃহপ্রাঙ্গণ।

    হেসেখেলে দিনগুলো ওদের এমনই ছন্দে আনন্দে বয়ে চলছিল। বছরখানেক আগে নাতাশার বাবা মারা যাবার পর তার সম্পত্তি ছেলে ও মেয়েদের ভেতর ভাগ করে দেয়া হয়েছে। ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী নাতাশা মোটামোটি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে এখন। অনেক অর্থের মালিক হলেও নিজের জন্য খরচ করার কিছু ঠিক খুঁজে পায় না সে। ঘরের জন্য কিছু আসবাবপত্র, পুরোনো আওডিটা বদলে আরেকটি নতুন গাড়ি, বাচ্চাদের জন্য টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে থেমে গেল সে।

    পার্থিব বস্তুর প্রতি নাতাশার মোহ কোনকালেই খুব একটা ছিল না। অনেক ভেবে দেখেছে নাতাশা, পৃথিবীর অর্থ সম্পদ ভোগ বিলাস প্রাচুর্য সবকিছু পৃথিবীতেই রয়ে যায়। অনেকটা সেই আলিবাবা চল্লিশ চোরের গুপ্ত গুহার মতো। আলিবাবা সেই যে গুহার ভেতর প্রবেশ করে অঢেল ধন-সম্পদ দেখে দিশেহারা হয়ে গেল, কিছু মনিমাণিক্য হাতেপায়ে জড়িয়ে, গায়ের জোব্বার ভেতরে পকেটে পুরেও গুহার ভেতরেই পড়ে থাকতে হলো তাকে। গুহার ভেতর এক ঘর থেকে আরেক ঘরে টেনে নিতে পারে সব, কিন্তু গুহার বাইরে একটি দানাও সরিয়ে নেবার ক্ষমতা নেই তার।

    মানুষের জীবনটাও ঠিক তেমনি। এই জগতের একটি বিন্দুও অন্য কোথাও সরানোর সাধ্য নেই মানুষের। "চিচিং ফাঁক" মন্ত্রে আলিবাবার গুহার দরজা খুলে গেলেও, মানুষের ইহকাল থেকে পরকালে সশরীরে চলে যাবার দরজাটি খোলে না কিছুতেই। মানুষের শরীরটাই তো পড়ে থাকে এইখানে, অসার নিষ্প্রাণ মৃতদেহ নামে।

    পুষণের দ্বিতীয় জন্মদিনের মাসখানেক পর থেকে ধীরে ধীরে নাতাশার অসুখটা প্রকাশ হতে থাকে। প্রথম প্রথম মাথায় খুব যন্ত্রণা হতো। তারপর হঠাৎ হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করে। কয়েকদিন বাড়িতে কাজ করার সময়ে আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। দিশেহারা শিহাব অনেকগুলো ডাক্তারের সাথে কথা বলল। হাসপাতাল, ব্লাড টেস্ট, নানা রকম পরীক্ষা করে রোগটা ধরা পড়ল। নাতাশার ব্রেইনে টিউমার। অনেক অনেক বছর ধরেই মগজে ঘিলুর অত্যন্ত কাছাকাছি থেকে বাড়ছিল টিউমারটি। ঢাকা শহরের সবচেয়ে নামকরা নিউরোসার্জন কনক কান্তি বড়ুয়াকে দেখানো হলো সব রিপোর্ট। তিনিও নিরাশ করলেন। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন অপারেশন করলে বাঁচা আর মরার সম্ভাবনা ৩০/৭০। আর অপারেশন না করলে যেকোনদিন যেকোন সময় মাথার ভেতর টিউমারটি ফেটে নাতাশার মৃত্যু হতে পারে।

    শিহাব হাল ছাড়ে না। সিদ্ধান্ত নিল অপারেশন করবে। চেষ্টা না করে এমনি এমনি নাতাশাকে চলে যেতে দেবে না সে। তাছাড়া মিরাকল তো মানুষের জীবনে ঘটেই।

    - তুমি টেনশন কোরো না নাতাশা। আমি জানি তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।

    - যদি সুস্থ না হই! যদি মরে যাই?

    শিহাবের বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে কান্না। চোখ মুছে বলে, হতেই পারে না। আমি তোমাকে যেতে দেব না।

    - আমার অনেকগুলো অংশ তোমার কাছে রয়ে যাচ্ছে শিহাব। তোমার অনেক দায়িত্ব সামনে।

    - আমাদের পরিচয় হবার পর থেকে আমি কোনদিন তোমাকে ছাড়া থাকিনি। তুমি চলে যেয়ো না। তোমার সাজানো সংসার তোমার মতো করে আমি রাখতে পারব না।

    - চেষ্টা তো করো। আমি কিন্তু শূন্যে ভেসে ভেসে তোমাকে দেখব। তুমি একা হবে না কখনো। এই যে আমি তোমার হাতটি ধরে আছি। আগামীকাল অপারেশনের সময়ও আমি তোমার হাত ধরে থাকব।

    - ডাক্তার আমাকে ভেতরে এলাও করবে না। আমি বাইরে অপেক্ষা করব।

    - অপেক্ষা! ….অপেক্ষা কোরো শিহাব। আমিও অপেক্ষা করে থাকব। আমি যদি মরে যাই, তোমার সাথে যদি এই জন্মে আর দেখা না হয় এভাবে এই সংসারে, এই আনন্দলোকে, যদি আমি ভুলে যাই কোনদিন আমি তোমার নাতাশা ছিলাম, তাহলে তুমি যতদিন বেঁচে আছো তুমি অন্তত মনে রেখো আমি তোমাকে আর আমাদের তিনটি বাচ্চাকে খুব ভালোবাসতাম, তুমি মনে রেখো আমাকে।

    - তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি থামো। এসব কথা শুনতে আমার ভাল্লাগছে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে নাতাশা।

    নিজের হাতের ভেতর শিহাবের হাতটি নিয়ে খুব শক্ত করে ধরে থাকে নাতাশা। ফিসফিস করে বলে, মৃত্যুর পর যদি দেখি, ওপাশে আর কিছুই নেই, কোটি বছর অপেক্ষা করেও তোমাকে দ্বিতীয়বার পাওয়ার মতো কোন জগৎ অপেক্ষা করে নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও, যদি এই জগতই হয় আমাদের একমাত্র বিচরণক্ষেত্র, তবে জেনে রাখো, তোমার সাথে আমার এই জীবনটি খুব সুখে কাটল। আবার যদি আমি নাতাশা না হয়ে অন্য কোন মানুষ হয়ে জন্মাই, আমার যেন আবার তোমার মতোই কারো সাথে সাক্ষাৎ হয়। প্রেম হয়। ভালোবাসা হয়। তোমার জন্য আমার প্রেম মহাকালের মতো সত্য।

    এইভাবে অশ্রুধারায় ভিজে ভিজে রাত্রি গড়িয়ে ভোর আসে। নাতাশা একে একে প্রাণের তিনটি টুকরোকে চুম্বনে আলিঙ্গনে মমতাময়ীর স্নেহের পরশে যতটুকু ঢেকে দেয়া যায় তারচেয়েও বেশি দিয়ে খর পায়ে, সিক্ত নয়নে হাসপাতালের পথে রওনা হলো।

    শিহাবের শেষ ইচ্ছে রাখতে নাতাশা অপারেশনের জন্য রাজি হয়েছে। ওর মন বলছে, এই যাওয়াইশেষ যাওয়া। এখান থেকে একবার চলে গেলে এই পৃথিবীর কেউ আর কারো না। তবুও কী ভীষণ মায়া! তবুও কিছু মানুষকে একান্ত নিজের বলে ভ্রম হয়। যদিও শুরু থেকেই সবাই জানে জীবন নিশ্চিত অনিত্য, বেঁচে থাকার খেলাটাও ক্ষণস্থায়ী, তবুও মানুষগুলো কখনই এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অজানায় যেতে প্রস্তুত থাকে না।

    সকাল দশটা। প্রাইভেট হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে আট ঘন্টার অপারেশনের জন্য ওটিতে নেয়া হয়েছে নাতাশাকে। বন্ড সাইন করেছে শিহাব। ব্রেইনের অপারেশন সাধারণত খুব জটিল হয়। অপারেশনটি শেষ হলে ওটির দরজা খুলে অজ্ঞান নাতাশাকে যখন বের করা হবে, ওর জ্ঞান আর কোনদিন নাও ফিরতে পারে। এসব কথা জেনেও অপারেশনের রিস্ক নেয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই শিহাবের সামনে।

    ওটির বন্ধ দরজার ওপাশে নাতাশার অপারেশন চলছে। দরজার এপাশে করিডোরে শূন্য মানবের মত স্পন্দনহীন শরীরে দাঁড়িয়ে আছে শিহাব।

    বাড়িতে দূর্বা অপেক্ষা করে আছে, মা ফিরবে হাসপাতাল থেকে। মায়ের কাছে ওর আরো কত কিছু শেখার বাকি আছে।

    তৃণ অপেক্ষা করছে কখন মা আর বাবা দুইজন হাসপাতাল থেকে চলে আসবে। ওদের আর বাড়িতে একা থাকতে হবে না।

    পুষণের এখনো কিছুই বোঝার বয়স হয়নি। টিভিতে কার্টুন দেখছে আর বোনদের সাথে খেলা করছে সারাদিন।

    স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও ভালোবাসার টানে নাতাশা এই সংসারে বিস্মৃতির আবর্তে আরো কিছুটা সময় থাকতে পারবে কিনা কে জানে! এইমুহূর্তে দক্ষ নিউরোসার্জন ও তার দল নাতাশার মস্তিষ্কে কাটাকাটি করে চলছে খুব সতর্কতার সাথে। এক্স-রের ছবিতে ব্রেইনের টিউমারটিকে যত সেন্টিমিটার মনে হয়েছিল, মাথার খুলি সরানোর পর দেখা যাচ্ছে সেটির আকৃতি আরো অনেক বড়। হাইপোথ্যালামাসের সূক্ষ্ম তারগুলোকে চেপে কোনঠাসা করে দাপটের সাথে নিজের অবস্থান শক্ত করে বসে আছে টিউমারটি। পাশের ভেইনগুলোকে আঘাত না করে টিউমারের যথাসম্ভব অংশ বের করে আনার চেষ্টা করছে অভিজ্ঞ সার্জন। নাতাশার ফেরা না ফেরার সবটুকু এখন একমাত্র পরম করুণাময়ের হাতেই নির্ভর করছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments