ভার্জিনিয়া আগুনের পাশে বসে আছে। তার বাইরের পোশাকগুলো একটা চেয়ারের উপর ছড়ানো। তার ভেজা জুতোজোড়া শুকোবার জন্য চুল্লির গায়ে আলগোছে রাখা।
ভার্জিনিয়া (চিঠিটা নিচে রেখে): আমি এই চিঠিটা একটুও পছন্দ করছি না — একেবারেই না। আমি ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি সে এটা অবহেলার যোগ্য মনে করেছে। অথবা সে এরকমই (পড়ছে): ‘মোজার জন্য ধন্যবাদ। যেহেতু আমার কাছে আগের থেকে আরও পাঁচজোড়া মোজা আছে, তাই তোমার মোজা আমি আমার আপিশের একজন বন্ধুকে উপহার দিয়েছি। আমি নিশ্চিত তুমি একথা শুনে খুব খুশি হবে।’ না; এটা আমার কখনও ভাল লাগতে পারে না। তার অবশ্যই বোঝা উচিত। আমার কাছে এটা একটা ভয়ানক ধাক্কা।
ওহো, এখন আমার মনে হচ্ছে সেই চিঠিতে যদি আমি তাকে শরীরের যত্ন নেবার কথা না বলতাম! চিঠিটা ফেরত পাবার জন্য কিছুই অদেয় নেই আমার এখন। আমি রবিবার সন্ধে বেলা চিঠিটা লিখেছিলাম, যা — খুবই মারাত্মক ছিল। রবিবারের সন্ধেয় কখনই আমার চিঠি লেখা উচিত নয় — কিন্তু সব সময় এটাই আমি করি। আমি বুঝি না কেন রবিবার সন্ধেগুলো সর্বদা আমার জন্য এমন ভয়ংকর হয়। আমি এরকম কাউকে পেতে চাই যাকে আমি চিঠি লিখতে পারব — যাকে ভালবাসতে পারব। হ্যাঁ, সেটাই; তারা আমায় বিষণ্ণ করবে আবার ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে। খুব মজার, না!
আমি আবার গির্জায় যাওয়া আরম্ভ করব; আগুনের সামনে বসে চিন্তা করা খুব ক্ষতিকর। ওখানে স্তব আছে; একজন অতি সন্তর্পণে স্তবের ভিতরে মিশে যায়। সে (গুন গুন) করে এবং তারপর প্রিয়তম ও শ্রেষ্ঠতমের — (কিন্তু তার চোখ চিঠির পরের বাক্যটির উপর নিবদ্ধ) ‘এটা তোমার মহানুভবতা তুমি নিজেই মোজা বুনেছো।’ সত্যি! সত্যিই এটা খুব বেশি বেশি! পুরুষেরা অসম্ভব দাম্ভিক। সে ঠিক ভেবেছে ওগুলো আমি নিজে বুনেছি। কেন, আমি তাকে খুবই কম জানি; তার সঙ্গে বাক্যালাপও আমার সামান্যই। কেনই বা আমি তার জন্য মোজা বুনব? সে অবশ্যই ভাবছে আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। একজন অচেনা লোকের জন্য মোজা বোনা আর প্রেমে পড়া কি এক? তাকে মোজা কিনে দেওয়া সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। না; আমি আর তাকে চিঠি লিখব না — এটা ঠিক। তাছাড়া, প্রয়োজনই বা কী? আমি হয়তো তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারতাম, কিন্তু তার এতে কিচ্ছু এসে যেত না পুরুষদের কিচ্ছু এসে যায় না।
আমি আশ্চর্য হই ভেবে কেন যে একটা সময়ের পর তাদের উপর আমার বিতৃষ্ণা জন্মে। শুরুতে তারা আমাকে অসাধারণ ভাবে, অথবা প্রথম ভাবে, কিন্তু আমি তাদের কোনো ইঙ্গিত দিলে, তাদের বুঝতে দিলে যে তাদেরও আমার ভাল লেগেছে, তৎক্ষণাৎ ভয়ে তারা অদৃশ্য হতে থাকে। মনে হয় আমিই তাদের ভিতর তিক্ততার সঞ্চার করি। তারা কোনোভাবে জেনেছে যে আমার অনেক কিছু দেবার আছে। হয়তো এটা, এটাই — তাদের ভয়ের কারণ। ওহো, আমি জানি আমার সীমাহীন, সীমাহীন ভালবাসা আছে কাউকে দেবার জন্য — আমি কারও দেখাশোনা করব, সম্পূর্ণ তাদের খেয়াল রাখব — সমস্তরকম ভয়াবহতা থেকে দূরে রাখব — এবং তাদের বুঝতে দেব যদি তারা কিছু করতে চায় আমি সবসময় পাশে থাকব তাদের। শুধু আমাকে বুঝতে হবে কেউ আমাকে সত্যিই চায়, কারও আমাকে প্রয়োজন, আমি তখন অন্য মানুষ হয়ে যাব। হ্যাঁ; এটাই আমার জীবনের গোপন কথা — ভালবাসা চাওয়া, ভালবাসা পাওয়া, কেউ আমার উপর সমস্ত কিছুর জন্য সারাজীবন নির্ভর করবে এবং আমি খুব অনমনীয়, অন্য অনেক মহিলার থেকে আমি অনেক ধনবতী। আমি নিশ্চিত বেশির ভাগ স্ত্রীলোকেরই নিজেদের প্রকাশ করার তীব্র বাসনা থাকে না। অন্ধকারে আমি নিজেকে গুটিয়ে ও বন্ধ করে রাখি, কী এসে যায় কারো। আমার মনে হয় সেজন্য আমি গাছপালা, অসুস্থ পশুপাখির জন্য অস্বাভাবিক আকর্ষণ অনুভব করি — এটাই একমাত্র উপায় এই সম্পদের ভার বহনের থেকে বেরোবার। ভালবাসার ভার থেকেও — এবং তারপর, অবশ্যই তারা অসহায় হয়ে পড়ে — সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু আমার মনে হয় কেউ যদি তোমাকে ভালবাসে সেও সত্যি অসহায় হবে। হ্যাঁ, আমি জানি পুরুষেরা বড্ড অসহায় ....
কেন জানি না আজ রাত্রে আমার খুব কান্না পাচ্ছে। ঐ চিঠির জন্য নিশ্চয়ই না; ওটা এমন গুরুত্বপূর্ণ নয় আমার কাছে। আমি বিস্মিত হচ্ছি ভেবে আমার বার্ধক্য পর্যন্ত কিছু বদলে যাবে কি? অথবা একরকমই থাকবে সব — আমি শুধু চাইব, চাইতেই থাকব! আমি এখন তরুণী নই — আমার বলিরেখা পড়া শুরু হয়েছে, আমার ত্বকও আগের মতো নয়। লোকে যাকে সুন্দরী বলে আমি কখনও সেইরকম সুন্দরী ছিলাম না, কিন্তু আমার ত্বক ও চুল সুন্দর, নরম এবং মসৃণ ছিল। আমি নিজেকে এখন কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখি — আমি এখন ন্যুব্জ, পা ঘষে ঘষে চলতে হয় আমায়, রুচিহীন, বেঢপ দেখায় আমাকে। ভাল না; বোধহয় এতটাও খারাপ নই আমি, আমি সর্বদা নিজেকে অতিরঞ্জিত করে থাকি। কিন্তু এখন আমি সব বিষয়ে খুব খুঁতখুঁতে — আমি নিশ্চিত এটা বার্ধক্যের লক্ষ্মণ। বাতাস — আমি এখন কিছুতেই নিজেকে বাতাসে ভাসিয়ে দিতে পারব না; ভেজা পা আমার অসহ্য লাগে। আগে এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না — এদের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করতাম — এরাই আমাকে প্রকৃতিকে অনুভব করতে শেখাত। কিন্তু এখন এসব পার হয়েছি, এখন আমি কাঁদতে চাই আর এমন কিছু পেতে চাই যা আমাকে সব ভুলিয়ে দেবে। আমার ধারণা মহিলারা এজন্যই মদ্যপান করে। খুব মজার, না!
আগুন নিভে গেছে। এই চিঠিটা আমি পুড়িয়ে দেব। আমার তাতে কী? দূর! আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আরও পাঁচজন মহিলা তাঁকে মোজা পাঠাতেই পারে! আমি তাকে যেমন ভেবেছিলাম সে তেমন ছিল না। আমি শুনেছি সে বলছে, ‘এটা তোমার মহানুভবতা তুমি নিজে মোজা বুনেছ।’ তার আকর্ষণীয় কন্ঠস্বর ছিল। আমি জানি তার কন্ঠস্বর আমাকে তার দিকে আকৃষ্ট করেছে — এবং তার হাতদুটোও; সে দুটো বলিষ্ঠ এবং পুরুষালি। ওহো, ভাল, এজন্য আবেগতাড়িত হবে না, পুড়িয়ে দাও! ... না, এখন পারব না — আগুন নিভে গেছে। আমি শুতে যাব। আমি আশ্চর্য সে সত্যিই আমাকে অবজ্ঞা করেছে। আ, আমি খুব ক্লান্ত। আজকাল, প্রায়ই যখন শুতে যাই, আমি জামাকাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখি — এবং শুধু কাঁদি। খুব মজার, তাই না!