সুধীরের মেসেজটা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল মাইকের, “কীপ এন আই অন দ্য নর্থ লন্ডন ডার্বি।” আর্সেনাল বনাম টটেনহ্যাম নর্থ লন্ডনের যুযুধান দুই ক্লাব ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, এফএ কাপ, লীগ কাপ বা ইওরোপীয়ান প্রতিযোগিতায় যখনই মুখোমুখি হয় তখনই ব্রিটিশ পুলিশ চরম সতর্কতা অবলম্বন করে। ঐতিহাসিক ভাবেই এই দুই ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে অহি নকুল সম্পর্ক, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলির (ক্রিকেট অধিনায়ক নন) মোবাইলে এরকম মেসেজ আসার অন্য অর্থ আছে তা বুঝতে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার নেই। নর্থ লন্ডনের, ‘কলকাতা কানেকশন’ রেস্তোরাঁর মালিক সুধীরকে ফোনে ধরল মাইক। একবার নিজের রেস্তোরাঁর একজন ওয়েটারের খুনের মামলায় ফেঁসে গেছিল সুধীর, সন্দেহের তীর ওর ওপরই পড়েছিল, যেদিন রাতে খুনটা হয় সেদিনই দুপুরে কর্তব্যে গাফিলতি নিয়ে ঐ ওয়েটারকে সুধীর ভর্ৎসনা করলে দুজনের মধ্যে তীব্র বচসা হয় আর সুধীর নাকি তখন ওয়েটার মরিসনকে উচিত শাস্তি দেবে বলে শাসিয়েছিল। সারকামস্টেনসিয়াল এভিডেন্সও সুধীরের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল, ঘটনার তদন্তভার এসে পড়েছিল মাইকের ওপর। মাইকের তদন্তেই উঠে আসে সুধীর নির্দোষ, মরিসনকে টাকাপয়সা সংক্রান্ত বিবাদের জেরে খুন করে রেস্তোরাঁরই একজন কাস্টমার। নিয়মিত সেই কাস্টমার সুধীরের সঙ্গে সেদিনের মরিসনের বচসার ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে এমন করে কার্যসিদ্ধি করে, যাতে করে সন্দেহের তীর সুধীরের ওপর গিয়ে পড়ে। নির্ঘাত বিরাট সাজার থেকে রেহাই পেয়ে কৃতজ্ঞ সুধীর সেই থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মাইকের ইনফর্মারের কাজ করে। তার নর্থ লন্ডনের, ‘কলকাতা কানেকশন’ রেস্তোরাঁ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর পেয়েছে মাইক। সুধীরের রেস্তোরাঁর একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে, নর্থ লন্ডনের আর্সেনাল টিউব স্টেশনের কাছাকাছি হওয়ার জন্য এবং দুরন্ত বাঙালি খাবারের জন্য কলকাতার ছেলে সুধীর দত্তের রেস্তোরাঁয় অভিজাত থেকে শ্রমিক শ্রেণি, ফুটবল মাঠ ফেরত জনতা, নিত্য অফিসযাত্রী সবাই ভিড় জমায়। সুধীর দত্তকে খবরের খনি বলা যায়। সুধীর মাইককে বলল, আজকে রাতেই আমার এখানে একবার ঢুঁ মারো। মিসেসকে নিয়ে তো অনেকদিন আসো না। লিলির পছন্দের ভেটকি পাতুরি, লাউ চিংড়ি, আলু পোস্ত, স্মোকড হিলসা সব তৈরি থাকবে, আর সাথে টিকটিকির পছন্দের পোকামাকড়ও জুটে যেতে পারে। প্রস্তাবটা বেশ মনে ধরল গোয়েন্দা প্রবরের, তাই সুধীর যে তাকে টিকটিকি বলল, সেটা বিলকুল হজম করে নিল।
সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় লিলির মেজাজটা বেশ শরিফ দেখেছে মাইক, ভাবল লিলিকে নিয়ে আজ সুধীরের রেস্তোরাঁয় সত্যিই ডিনারে গেলে কেমন হয়! তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। মাইক সবসময়ই সুধীরের রেস্তোরাঁয় কাস্টমার হিসেবে যায়, সুধীর তার ইনফর্মারের কাজ করে এটা গোপন রাখতেই এই সতর্কতা। সঙ্গে একজন মহিলা থাকলে বিশেষত লিলির মতো সুন্দরী থাকলে মাইককে লোকে তত লক্ষ্য করে না। সাহস করে লিলিকে ফোনটা করেই ফেলল মাইক, ভাগ্য আজ তার বিশেষ সুপ্রসন্ন মনে হচ্ছে, শেষ কবে লিলি তার এক কথায় সায় দিয়েছে মাইক মনে করতে পারল না। সুধীরের, ‘কলকাতা কানেকশন’ রেস্তোরাঁয় দুটো সিট রিজার্ভ করে সহকারি রবার্টসনকে বলল আমি নর্থ লন্ডনে, ‘কলকাতা কানেকশন’ রেস্তোরাঁয় লিলিকে নিয়ে ডিনারে যাচ্ছি। রবার্টসন একথার মানে বোঝে, তাকে অ্যালার্ট থাকতে হবে, দরকার পড়তে পারে। লাল স্কার্টে লিলিকে আজ মোহময়ী লাগছে, স্বঘোষিত কবি মাইকের দুটো লাইন মাথায় এসে গেল,
“লাল স্কার্টে লিলি,প্রায় মুখ ফসকে লিলিকে বলে ফেলেছিল, কিন্তু, সেই আপ্ত বাক্যটা ঠিক সময় মনে পড়ল, ‘গোয়েন্দাদের ঝুঁকির ব্যাপারটা সব সময় মাথায় রাখতে হয়।’ লিলি এই চিলির উপমাটা কীভাবে নেবে তা বোঝা যাচ্ছে না। চট করে কথাটা গিলে ফেলে একটা বোকা বোকা হাসি দিল লিলির দিকে তাকিয়ে। লিলি মনে মনে ভাবল, বুড়ো ছুঁচোটা বিয়ের দু-যুগ বাদেও মুগ্ধ চোখে তাকাতে জানে, মাইকের সব কিছুকে সন্দেহ করবার প্রবণতার জন্যই লিলি মাঝে মাঝে ওকে বুড়ো ছুঁচো বলে ডাকে। কিন্তু একজন গোয়েন্দার কাছে সন্দেহ করাটা তার পেশার একটা প্রধান শর্ত। লিলি মুখে বলল, একটা ট্যাক্সি ডাকলে আমরা যাত্রা করতে পারি, তোমার যে গাড়ি নেওয়ার মতলব নেই সেটা ভালোই বুঝেছি, তুমি এমনি এমনি আমাকে ডিনারে নিয়ে যাচ্ছ, না অন্য কোন মতলব আছে? মাইক ভাবল, লিলি যদি গোয়েন্দাগিরি শুরু করে তবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে মাইক ব্রিয়ারলির কদর কমবে। মুখে বোকা বোকা হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে অ্যাপ ক্যাব বুক করে ফেলল। অভিজ্ঞতা থেকেই মাইক জানে এই সময় মুখ খোলা মানেই নিজের বিপদ বৃদ্ধি করা। সত্যিই সে আজ গাড়ি নিতে চায় না, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গাড়ি নিয়ে গিয়ে সে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে চায় না, আর নিজের গাড়ি গ্যারেজ থেকে বার করে ড্রাইভ করবার পরিশ্রম করবার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। একটা ব্যাপারে মাইক নিশ্চিত, সুধীর শুধু শুধু তাকে রেস্তোরাঁয় যেতে বলবে না, সাধারণ খবর দেওয়ার থাকলে ফোনে বলতে পারত। নিশ্চয়ই কিছু দেখাতে চায়, যা ওর রেস্তোরাঁয় না গেলে দেখা সম্ভব নয়।
যেন রেড হট চিলি”
অধীরদা এই অবধি পড়েছেন, সেই সময় নন্দিতাবৌদি মানে অধীরদার স্ত্রী কফি আর পকৌড়া নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। অধীরদা পড়া থামিয়ে বললেন, বুঝলেন অতনুদা, সে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ধুরন্ধর গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলি হোক বা সোদপুরের ছাপোষা অধীর বাগচী অথবা অতনু বিশ্বাস, সব বিবাহিত পুরুষেরই তার স্ত্রীকে সমঝে চলতে হয়। বৌদি বললেন, আহা ঢঙে বাঁচি না, তুমি আবার কবে বৌকে সমঝে চললে? জীবনটাই তো বনেবাদাড়ে কাটিয়ে দিলে, আর এখন থেকে যদি দ্বিতীয় রাউন্ড কফির ধান্দা করতে থাকো তবে বলে রাখছি অপেক্ষা করতে হবে, এখন দুটো সিরিয়াল দেখব, পাক্কা এক ঘন্টা লাগবে। অতনুদা বসুন, চলে যাবেন না, সেকেন্ড রাউন্ড কফি নিশ্চয়ই হবে। আপনি কিন্তু অনেকদিন বাদে এলেন। বাড়িতে সব ভালো তো? আমি বললাম, হ্যাঁ সব ভালো। নানা কাজে কর্মে আসা হয়নি। আসলে, ‘একটি নিঁখুত হত্যার’ ঘটনাটা মন থেকে চট করে মুছতে পারিনি, (পরবাস ৮০ দ্রষ্টব্য : )
অধীরদা হয়তো সত্যিই আমার হাতে মরণ কাঠি ফুটিয়ে দেননি, সবটাই আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু স্বপ্ন অমন পরিষ্কার হয়! সেটাও যেন মন মানতে চাইছিল না। এই কদিন তাই অধীরদার বাড়িতে আড্ডা দিতে আসিনি। আজ রবিবার, সকালে সোদপুর বাজারে অধীরদার সঙ্গে দেখা হতেই পাকড়াও করলেন, বললেন ব্যাপার কী অতনুদা? আপনার দেখা নেই, ওদিকে ডাবলিন থেকে ক্রাইম জার্নাল, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’-এর লেটেস্ট কপিটা এসে পড়ে আছে আর তাতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলির নতুন ইনভেস্টিগেশনের কাহিনি রয়েছে, এসব কী একা একা পড়া যায়! আজকে কোনও কথা শুনছি না, আপনাকে আমার বাড়ি আসতেই হচ্ছে। তাই বাড়িতে বাজারটা নামিয়ে দিয়েই অধীরদার বাড়ি চলে এসেছি, শেষে গোয়েন্দা গল্প শোনার নেশাটাই অধীরদা সম্বন্ধে অস্বস্তিটা কাটিয়ে দিতে সাহায্য করল।
বৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর অধীরদা বললেন, দেখেছেন ঠিক ধরে ফেলেছে যে আমি সেকেন্ড রাউন্ড কফির ক্ষেত্র প্রস্তুত করছি। মেয়েরা গোয়েন্দাগিরিতে এলে সত্যি মাইক ব্রিয়ারলিকেও করে খেতে হত না। কফির কাপে চুমুক দিয়ে অধীরদা বললেন, অতনুদা আপনি তো আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের অন্ধ সমর্থক, তা আপনাদের সঙ্গে টটেনহ্যামের এত ভয়ঙ্কর আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক কেন? আমি বললাম, সে লম্বা ইতিহাস তবে ১৮৮৪তে আর্সেনাল আর ১৮৮২তে টটেনহ্যাম ক্লাবের জন্মলগ্নের সময় বোঝা যায়নি এই দুই ক্লাবের এরকম একটা রক্তক্ষয়ী সম্পর্ক হবে। আর্সেনালের প্রথমে নাম ছিল উলউইচ আর্সেনাল, উলউইচে অবস্থিত শ্রমিকদের ক্লাব, উলউইচ হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব লন্ডনে। পরে উলউইচ লোপ পায় এবং ১৯১৩ সালে আর্সেনাল নর্থ লন্ডনে বিখ্যাত হাইবেরি স্টেডিয়ামে উঠে এলে সমস্যার সূত্রপাত। হাইবেরি স্টেডিয়াম আর টটেনহ্যামের হোয়াইট হার্ট লেন দুটো স্টেডিয়ামই নর্থ লন্ডনে। এখন যদিও দুটো দলই নতুন স্টেডিয়ামে উঠে গেছে। যাইহোক সেইসময় দুটো দলই দ্বিতীয় ডিভিশনে ছিল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর ইংলিশ এফ এ ঠিক করে প্রথম ডিভিশনের কলেবর বৃদ্ধি করবে। আর্সেনাল আর টটেনহ্যাম দুটো ক্লাবের সামনেই প্রথম ডিভিশনে খেলার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আরও কয়েকটি ক্লাবও দৌড়ে ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর্সেনাল টটেনহ্যামকে ভোটে হারিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলবার যোগ্যতা অর্জন করে। ওরা মনে করে আমরা লীগ প্রেসিডেন্ট জন ম্যাকেনাকে ম্যানেজ করেছিলাম, যা সর্বৈব মিথ্যা। সেই থেকে যে ভয়ানক তিক্ততার সৃষ্টি তা ব্রহ্মার জীবদ্দশায় লোপ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আর ওরা ইংলিশ ফুটবলের ইতিহাসে সব সময়ে আমাদের পিছনে থাকবে, শেষ কয়েকবছর বাদে সর্বদা আমাদের পিছনে লীগ শেষ করে এসেছে, এখন আমরা একটু বেকায়দায় আছি, তবু এবারও এফএ কাপ, কমিউনিটি শীল্ড জিতলাম, ওদের ট্রফির ঘরে তো ভাঁড়ে মা ভবানী, লীগেও তো এবার...। আমি যথারীতি টটেনহ্যামের হটস্পারের ওপর গায়ের ঝাল মেটানোর আমার স্বর্গীয় অধিকার প্রয়োগ করি আর কি! অধীরদা হেসে বললেন, অতনুদা আপনি যেভাবে টটেনহ্যামের নাম শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছেন, তাতেই দুই ক্লাবের মধুর সম্পর্কর কথা টের পাচ্ছি। চলুন দেখা যাক, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’-এর পাতায় আপনাদের নর্থ লন্ডন ডার্বি নিয়ে কী কালো মেঘ জমে আছে, আর মাইক ব্রিয়ারলি সেই মেঘের আড়াল থেকে আলোর হদিশ বার করতে পারে কিনা।
‘কলকাতা কানেকশনে’ ঢুকে নির্দিষ্ট আসনে বসার পর অভ্যাসবশত মেনু কার্ডটা খুলতে না খুলতেই মাইকের হোয়াটসঅ্যাপে সুধীরের মেসেজটা ঢুকল, সুধীর লিখেছে, হেডফোনটা অন করো আর খালি শুনে যাও। লিলির সামনে ফোনে আমার সঙ্গে কোনও রহস্যের ব্যাপারে কথা বলবার সাহস তোমার নেই, সেটা জানি। খোঁচাটা হজম করে মাইক হেডফোন চালু করতে না করতেই সুধীরের ফোনটা এল। সুধীর বলে চলল,
ডানদিকের তিন নম্বর টেবিলটা লক্ষ্য করো। হেভেন পার পাউন্ড সংস্থার ডিরেক্টর রজার হার্মিসনের সঙ্গে যে দুজন যুবক বসে আছে তারা মাঝে মাঝে আমার রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে আসে। গতকালও এসেছিল, আমাদের ওয়েটার কলকাতার ছেলে অনুপ টয়লেট থেকে ফেরার সময় ওদের মধ্যে মোটা ছেলেটাকে টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোনে নর্থ লন্ডন ডার্বির দিনে বিরাট ধামাকার কথা বলতে শুনে ফেলে, সেই সময় ও হেভেন পার পাউন্ড আর রজার হার্মিসনের নাম শুনতে পায়। অনুপ টয়লেটের ভেতর থাকায় মোটা ওর অস্তিত্ব টের পায়নি। মোটা ছেলেটার নাম স্টিফেন ফাউলার। ও যখন টয়লেটে ইউরিনাল ইউজ করতে ঢোকে, ততক্ষণে অনুপ একটা কমোড কেবিনে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিয়েছে, ফাউলার ফোনে তখনও বলছে, শনিবার নাকি তার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য দিন হতে চলেছে, নর্থ লন্ডন ডার্বিতে একটা বিরাট বিস্ফোরণ হবে। তুমি জানো অনুপ কেমন ধুরন্ধর ছেলে। এই রেস্তোরাঁয় একমাত্র অনুপই তোমার সঙ্গে আমার যোগসূত্রের ব্যাপারটা জানে। আগেও আমাদের অনেক খবর দিয়েছে, তোমার বিশাল ফ্যান সে তো জানো। নর্থ লন্ডন ডার্বি আর ধামাকা কথাটায় ওর মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিতে আমাকে জানায়, বলে মাইক ব্রিয়ারলিকে একবার খবরটা দাও বস। আজকে হার্মিসন বিকেলে ফোন করে তিনজনের জন্য টেবিল বুক করাতে আমার টনক নড়ল, মনে হল বাকি দুজন আমার এই পরিচিত দুই যুবকই হবে, তোমাকে ডেকে এদের চিনিয়ে দিলাম, কিছু ঘটনা থাকলে তুমি ঠির টের পাবে। রাতে ফোন কোরো, এখন লিলি আর ডিনারে মন দাও, নয়তো তোমার বাড়ির চাকরিটা আবার যাবে। মাইক দেখে নিল লিলি মেনু দেখতে ব্যস্ত, লিলিকে বলল, তুমি অর্ডারটা দাও, আমি টয়লেট থেকে আসছি। এটা কথার কথা, অর্ডার লিলিই তার পছন্দমতো দেবে জানা কথা, বিল মেটানো ছাড়া মাইকের ভূমিকা হল সেই অর্ডার দেওয়া খাবার পছন্দ হোক না হোক সোনা মুখ করে খেয়ে যাওয়া। একবার এখানেই একটা নিমপাতার আইটেম খেতে হয়েছিল। লিলি দিব্যি খেয়ে গেল, মাইকের তো না পারছি গিলতে না পারছি ফেলতে অবস্থা। মাইক টয়লেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চট করে যা ভাবার ভেবে নিল। ফোনে রবার্টসনকে ধরে চাপা গলায় নির্দেশ দিল, ফার্স্ট ফ্লোরে উঠে এস, লিলি দরজার দিকে পিঠ করে বসে আছে, তোমার চাঁদ বদন সে না দেখলেই খুশি হব। আশাকরি তুমি প্লেন ড্রেসে আছ, তিন নম্বর টেবিলের তিনজন অতিথির দিকে নজর রাখতে তোমাকে যদি ডিনারটা এখানেই সারতে হয় তো সারবে। এদের নাড়িনক্ষত্রর খবর আমার চাই, তোমাকে শুধু এইটুকু বলতে পারি শনিবারের নর্থ লন্ডন ডার্বিতে কোনও অঘটন ঘটলেও ঘটতে পারে, আজ বুধবার, মাঝে মাত্র দুটো দিন হাতে। কাজ শুরু করো।
টয়লেট থেকে ফেরার সময় ইচ্ছে করেই তিন নম্বর টেবিলের ধার ঘেঁষে ফিরল মাইক, পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মাইকের চেহারায় এমন কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, যাতে আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তার উচ্চতা মাঝারি, চেহারাও তাই, হাঁটা চলাও কিছু ফিল্মস্টার সুলভ নয়। যতক্ষণ না মাইকের চওড়া চোয়াল আর প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়ার ওপর নজর পড়বে ততক্ষণ তাকে কেউ লক্ষ্য করবে না, পোশাকআশাকেও মাইক বেশ অনুজ্জ্বল, ধূসর রঙের জামা আর ট্রাউজার্সে আজও কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। মাইক তিন নম্বর টেবিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটু বেশি সময় নিলেও টেবিলের তিন অতিথি সেদিকে খেয়াল করল না। মাইকের কানে এল শনিবারের নর্থ লন্ডন ডার্বির কথা, যেটা এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের তিনদিন আগে অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তিনজনকেই আইরিশ অ্যাকসেন্টে কথা বলতে শুনতে বিদ্যুৎসচমকের মতো মাইকের মনে হল, নর্থ লন্ডন ডার্বিতে ধামাকা মানে এর সঙ্গে আইরিশ লিবারেশন আর্মির কোনও যোগাযোগ নেই তো! হার্মিসন নিজে আয়ার্ল্যান্ডের লোক, যদিও আইরিশ লিবারেশন আর্মির সঙ্গে তার যোগাযোগের কোনও তথ্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে নেই। হার্মিসনের ‘হেভেন পার পাউন্ড’ অত্যন্ত নামী ডেভেলপার্স & এন্টারটেইনমেন্ট ব্র্যান্ড।
রাতে সুধীর নতুন করে কিছু জানাতে পারল না, সে অনুপকে তিন নম্বর টেবিলে লাগিয়েছিল, অনুপ নতুন কিছু জানতে পারেনি, তবে ঐ টেবিলে আর্সেনাল, টটেনহ্যাম, প্রিমিয়ার লীগ কথাগুলো ভেসে বেড়াচ্ছিল। তবে সেটা নর্থ লন্ডন ডার্বির তিনদিন আগে নর্থ লন্ডনের রেস্তোরাঁয় খুবই সাধারণ ঘটনা।
ফোনটা কাটতে কাটতে মাইক মনে মনে বলল, হার্মিসনের উইক ডেজে রেস্তোরাঁয় টেবিল বুক করে দুজন টটেনহ্যাম ক্লাবের কর্মচারির সঙ্গে ডিনার সারতে আসা কিন্তু তত সাধারণ নাও হতে পারে। রবার্টসন ততক্ষণে মোটা চেহারার স্টিভেন ফাউলার এবং জিম করা পেটানো চেহারার মার্ক রবিনসন যে টটেনহ্যাম ক্লাবে কাজ করে তা বের করে ফেলেছে। আর দুজনেরই আইরিশ বংশোদ্ভূত হওয়াটা কি কাকতালীয়! ফাউলারের বাবা সিনিয়র ফাউলার, হেভেন পার পাউন্ডের সিকিওরিটি ইনচার্জ, ফাউলার আর রবিনসন সম্পর্কে তুতো ভাই। রবিনসন টটেনহ্যাম ড্রেসিংরুমের সিকিওরিটির দায়িত্বে আছে, ফাউলার ড্রেসিংরুম ইলেকট্রিসিয়ান।
রবার্টসন বলল, বস তিনজনকে তুলে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি? মাইক বলল, দেখো রবার্টসন, তোমার হাতে এমন কোনও তথ্য প্রমাণ নেই যাতে করে তুমি তিনজন ব্রিটিশ নাগরিককে তোমার নিজস্ব কায়দার জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনতে পারো। এরা কোনও অপরাধ করেনি, এদের তিনজনের বিরুদ্ধে সামান্যতম ক্রিমিনাল চার্জ নেই, শুধু আইরিশ বলে আর ফোনে নর্থ লন্ডন ডার্বির দিন ধামাকা বলাতে কিছু প্রমাণ হয় না, সেটা ফুটবল সংক্রান্ত ধামাকা হতে পারে, ফ্যানেরা তো সবসময় ভাবে তার দল অনেক গোলে জিতবে, আর এখানে সে আবার ক্লাবের কর্মচারী। সন্দেহের জায়গা শুধু একটাই, হার্মিসনের মতো একজন ব্যস্ত বিজনেস টাইকুন আগেভাগে টেবিল রিজার্ভ করে বাকি দুজনকে ডিনারে ডাকা। হার্মিসন পরিচিত ক্রীড়াপ্রেমী নয়, তাকে ফুটবল ম্যাচে ন-মাসে ছ-মাসে বড়জোর একবার দেখা যায়। সে এত নর্থ লন্ডন ডার্বি নিয়ে উৎসাহী কেন? ফাউলার আর রবিনসন সামাজিক মর্যাদায় হার্মিসনের সমকক্ষ নয়, বয়সেরও বিস্তর ব্যবধান। স্টিফেন ফাউলারের বাবা হার্মিসনের সংস্থায় কাজ করলেও নিশ্চয়ই সেটা তার সঙ্গে হার্মিসনের ডিনার করার যথেষ্ট কারণ নয়।এদের ঘনিষ্ঠতার কারণটা আমাদের জানতে হবে। যদি ধরে নিই সেদিন সত্যিই কোনও বম্বব্লাস্ট হবে, তবে এদের আরও সাহায্যকারী থাকা স্বাভাবিক। তারা কারা? খুঁজে বার করার চেষ্টা করো, এদের দ্বারা এত বড় ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। সেই স্পেপালাইজেশন এদের নেই। স্টিফেন যখন টয়লেটে ঢোকার মুখে ফোনে কারও সঙ্গে, সম্ভবত হার্মিসনের সঙ্গে কথা বলছিল, তখন হার্মিসন বা হেভেন পার পাউন্ডের নাম করতে দ্বিধা করেনি, পরের দিন একসাথে ডিনারও করেছে। তার মানে, হয় সুধীরের ওয়েটার অনুপের রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়েছে, অথবা ফাউলাররা নিশ্চিন্ত আছে, যাই ঘটুক, তাদের কেউ সন্দেহ করবে না।
পরের দিন অফিসে বসে মাইক হিসাব করল, আজ ১৩ই মে, বৃহস্পতিবার আর পরশু ১৫ই মে, শনিবার প্রিমিয়ার লীগ মরশুমের শেষ সপ্তাহ। আর্সেনাল আর টটেনহ্যাম দুই ক্লাবেরই লীগের শেষ ম্যাচে পরস্পরের মুখোমুখি হচ্ছে টটেনহ্যাম হটসপার ফুটবল স্টেডিয়ামে, অর্থাৎ টটেনহ্যামের হোম ম্যাচ। ডেইলি মেলে লীগ টেবিলটা দেখে মাইকের ভ্রু অসম্ভব কুঁচকে গেল। মস্তিষ্কের কোষগুলো বলে গেল, মাইক তুমি সেদিন তিন নম্বর টেবিলে আরও একটা জিনিস দেখেছিলে।
মাইক, টটেনহ্যাম ক্লাব প্রেসিডেন্টকে ফোনে ধরল,তাকে আশ্বস্ত করে বলল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড টটেনহ্যাম স্টেডিয়ামে তল্লাসি চালাবে। এটা রুটিন এনক্যোয়ারি, একটা খবর এসেছে, যেটা আমরা খতিয়ে দেখতে চাই। ক্লাবের সিকিওরিটি ইনচার্জকে বলবেন তল্লাসির খবর গোপন রাখতে। আসলে মাইক কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না। পনেরো হাজারের ওপর দর্শক মাঠে থাকবেই, প্রত্যেকটা প্রাণ গুরুত্বপূর্ণ। অতিমারির পরে সবে দর্শকদের জন্য স্টেডিয়ামের দরজা খোলা হয়েছে তাই এক চতুর্থাংশ টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। টটেনহ্যাম মাঠে বাষট্টি হাজারের কিছু বেশি লোক ধরে।
অধীরদা পড়ে চলেছেন, রহস্য ক্রমশ দানা বাঁধছে, এই সময় নন্দিতা বৌদি আমাদের দ্বিতীয় প্রস্থ কফি আর পকৌড়া নিয়ে ঢুকে বললেন, নাও একদম গরম গরম ভেজে এনেছি, খেয়ে নিয়ে তারপর গুচ্ছের খুন জখম রাহাজানির গল্পে মেতো, তোমরা এতে কী যে সুখ পাও তা জানি না! আমি গোয়েন্দা গল্প থেকে পকৌড়া আর কফিতে মনোনিবেশ করলাম, কিন্তু অধীরদা দেখলাম চুপচাপ একমনে পড়ে যাচ্ছে, কফি ঠান্ডা হচ্ছে দেখে বললাম, অধীরদা কফিটা খেয়ে নিন। সম্বিত ফিরে পেয়ে অধীরদা বললেন, গল্পটা অন্যরকম ভাবে শেষ করলে হয় না? আমি বললাম, সেটা কীরকম? অধীরদা বললেন, এতক্ষণ আমি গল্পটা পড়ছিলাম, আপনি ছিলেন শ্রোতা, এবার আপনি গল্পটা বলবেন, আমি শুনব। আমি গল্পটা পড়ে ফেলেছি, আপনি পড়েননি, কিন্তু আপনি বুদ্ধিমান, গোয়েন্দা গল্পের পোকা এবং আর্সেনাল ফ্যান হিসেবে প্রিমিয়ার লীগের একজন বিশেষজ্ঞ বললে অত্যুক্তি হয় না। আমি আপনাকে কয়েকটি সূত্র দেব, আপনি গল্পটাকে শেষ করবেন, তারপর আমরা মিলিয়ে দেখব, আপনার বিশ্লেষণী ক্ষমতা কতটা মূল কাহিনির সঙ্গে মিলল। ্কি, চ্যালেঞ্জটা নেবেন নাকি? ‘বুদ্ধিমান’, ‘বিশেষজ্ঞ’ এইসব ভালো ভালো বিশেষণ শুনে বেশে তেতে গেলাম। বললাম, আপনার চ্যালেঞ্জটা নিলাম। শুনি আপনার সূত্র। অধীরদা বললেন, দ্যাটস লাইক আ স্পোর্টসম্যান। তবে শুনুন,
সূত্র ১) মাইক খবর নিয়ে জানতে পারে, হার্মিসন হলিউডের একটি ছবি প্রযোজনা করতে গিয়ে বিশাল অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২) মাইক তার সহকারি রবার্টসনকে কয়েকটি নামী বেটিং সংস্থায় তদন্তে পাঠায়। ৩) ম্যাচের দিন সকালে মাইক, আর্সেনাল ম্যানেজার মাইকেল আর্তেতা ও অধিনায়ক অবামায়েঙ্গের সঙ্গে ফোনে কথা বলে, কয়েকটি সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শদেয়। ৪) শেষ ম্যাচের আগে লীগ টেবিলে দু-দলের পয়েন্ট--কথাটা শেষ করবার আগেই আমি অধীরদাকে থামাই, বলি ওসব আমার মুখস্থ, আর কোনও সূত্র দেওয়ার আছে? অধীরদা বললেন, আপাতত এইটুকু। আপনি নেহাত আটকে গেলে দেখা যাবে। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, খুব একটা আটকাব না মনে হয়। আমি গল্পটা, মাইক ব্রিয়ারলি আর রবার্টসনের যেরকম কথোপকথন হবার কথা, সেভাবেই বলে যাব। সফল হলে তৃতীয় দফার কফিটা আপনি বানাচ্ছেন, বলে শুরু করলাম।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের একটা অফিসিয়াল রিকোয়েস্ট লেটার রবার্টসনকে ধরিয়ে দিয়ে মাইক বলল, লন্ডনের সব থেকে বড় তিনটি বেটিং সংস্থায় গেলেই তোমার কাজ হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রিমিয়ার লীগ বেটিং-এর জন্য এরাই সেরা। নাম, ঠিকানা লিখে দিয়েছি। রবার্টসন মনে মনে ভাবল, আবার শালা পাগলামি শুরু করেছে, হচ্ছে ফুটবল মাঠে বম্ব ব্লাস্ট-এর তদন্ত, মাঠে স্নিফার ডগ পাঠিয়ে এখন আমাকে বলছে বেটিং সংস্থার কাগজপত্র দেখতে! মুখে বলল, বস একটু খুলে বললে আমার কাজ করতে সুবিধা হয়। মাইক বলল, বেশ। প্রিমিয়ার লীগ টেবিলটা দেখো, কিছু বুঝলে? রবার্টসন ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল। মাইক নিজের মনে বিড়বিড় করল, কেউই বোঝে না, আর তাই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে মাইক ব্রিয়ারলির কদর বাড়ে। মুখে বলল, খেলাটা হচ্ছে আর্সেনাল আর টটেনহ্যামের মধ্যে, দু-দলের এটি শেষ ম্যাচ, লীগ টেবিলে এদের অবস্থান লক্ষ্য করো। সাঁইত্রিশ ম্যাচে একাত্তর পয়েন্ট পেয়ে টটেনহ্যাম চতুর্থ স্থানে আছে আর সমসংখ্যক ম্যাচে সত্তর পয়েন্ট পেয়ে আর্সেনাল পঞ্চম স্থানে আছে। মানে আর্সেনাল জিতলে চার নম্বরে শেষ করবে, ড্র হলে বা টটেনহ্যাম জিতলে তারা চার নম্বর স্থান দখল করবে। তুমি নিশ্চয়ই জানো, প্রিমিয়ার লীগের টপ ফোর ফিনিশের গুরুত্ব। প্রথম তিনটে দল সরাসরি চ্যামপিয়ন্স লীগ খেলবার ছাড়পত্র পেয়ে যায় আর চতুর্থ দল পায় প্লেঅফ খেলার যোগ্যতা, এই প্লেঅফ ধারাবাহিক ভাবে ধারে ভারে এগিয়ে থাকা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের দলগুলো জিতে চ্যামপিয়ন্স লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেয়। চ্যামপিয়ন্স লীগে খেলা খালি মর্যাদার জন্য নয় আর্থিক কারণেও মাল্টি মিলিওন ডিল। উয়েফা থেকে এবং টিভি স্বত্ব থেকে প্রচুর উপার্জন, স্পনসরারদের থেকে বোনাস এবং ট্র্যান্সফার মার্কেটে বড় খেলোয়াড়দের আকর্ষণ করবার জন্য টপ ফোর ফিনিশ প্রচণ্ড লোভনীয়। আর এই টপ ফোর ফিনিশ নিয়ে কোটি কোটি টাকার বেটিং হয়, অবশ্যই লিগ্যাল বেটিং, কিন্তু আমার ধারণা এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের যাবতীয় রহস্য। মি: হার্মিসন যদি প্রচুর অর্থ এই ম্যাচের বেটিংএ লগ্নি না করে থাকে তবে আমি খুবই অবাক হব। তোমাকে জানিয়ে রাখি, ইতোমধ্যে খবর পেয়েছি হার্মিসনের হেভেন পার পাউন্ডের অবস্থা খুব ভালো নয়। হলিউডের একটা মেগাবাজেট ছবিতে প্রযোজনা করে ব্যাপক ক্ষতির সামনে পড়েছে, ছবিটা চলেনি। ডেলি মেলে লীগ টেবিলটা দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে যায় সেদিন হার্মিসনদের টেবিলে ফুটবল বেটিং-এর বইও দেখেছি, তখন সেটার গুরুত্ব না বুঝলেও অবচেতন মনে তথ্যটা মজুদ করা ছিল। খেলাটা টটেনহ্যাম মাঠে এবং দুজন টটেনহ্যাম কর্মচারীর সঙ্গে হার্মিসনের দহরম মহরম বেশ চিন্তার খোরাক যোগাচ্ছে, আমি একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছি। ঐ দুই কর্মচারী টটেনহ্যাম ড্রেসিংরুমের সঙ্গে যুক্ত। এখন দেখতে হবে হার্মিসন কোন দলের পক্ষে টাকা লাগিয়েছে। বেটিং সংস্থা এমনিতে এসব তথ্য দিতে বাধ্য নয়, তবে ওরা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসার রবার্টসনের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করবে বলেই আমার বিশ্বাস, নাও তোমার কাজ শুরু করে দাও। এর মধ্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড টটেনহ্যাম স্টেডিয়ামে একটা রুটিন তল্লাশি চালাবে। এটা নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে ধরে নাও। ফাউলার, রবিনসনের মতো কর্মীরা এটা জানবেই, ওরা এমনিতে নিশ্চিন্ত আছে, আরও নিশ্চিন্ত হবে যে বেটিং-এর ব্যাপারটা কারও মাথাতে নেই। আর অন্য কোনও ফাউল প্লে, অর্থাৎ বিস্ফোরক কিছু স্টেডিয়ামে মজুত করা হলে সেটাও ধরা পড়বে।
এই অবধি বলে আমি উল্লেখ করলাম, অধীরদা এই পঁয়ত্রিশ লক্ষ পাউন্ডটা আমার কাল্পনিক অঙ্ক, ঠিক পরিমাণটা আপনার ম্যাগাজিনে আছে। অধীরদা বললেন, হ্যাঁ বুঝেছি, একটা বিরাট পরিমাণ অর্থ ধরে নেওয়া যাক। আপনি বলতে থাকুন। আমি আবার খেই ধরলাম,
মাইক বলল, এত বিরাট অঙ্কের টাকা লাগানো মানে হার্মিসন নিশ্চিত যে আর্সেনাল এই ম্যাচ জিতছে না, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই নিশ্চয়তা আসছে কোথা থেকে! আচ্ছা রবার্টসন, ফুটবল ম্যাচ জিততে গেলে কী করতে হয়? রবার্টসন বলল, গোল অবশ্যই। আর তুমি জানো রবার্টসন, গোল করে স্ট্রাইকাররা। গোলের জন্য আর্সেনালের সেরা বাজি কে? অবশ্যই মরশুমে বাইশ গোল করা তাদের অধিনায়ক, ‘অবামায়েঙ্গ’। তাদের অপর সিনিয়র স্ট্রাইকার, ‘ল্যাকাজেতে’ চোটের জন্য এমনিতেই এই ম্যাচের বাইরে। তার মানে যদি, ‘অবামায়েঙ্গ’ কোনও কারণে এই ম্যাচ না খেলে তবে আর্সেনাল অনেকটা পিছিয়ে পড়বে, আর হঠাৎ অধিনায়ক এবং মহাতারকা ফুটবলারের এরকম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে না খেলতে পারলে দল মানসিকভাবেও পিছিয়ে পড়বে। এ ধাক্কা সামলানো খুবই কঠিন হবে। আরও একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ফুটবল ম্যানেজার, ‘মাইকেল আর্তেতা’। ম্যানেজারই টিমের খেলার স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে, হাল ধরবার ভার পুরোপুরি তার ওপর। তিনি যদি ম্যাচের সময় উপস্থিত না থাকতে পারেন, তবে পুরো আর্সেনাল দলটা দিশেহারা হয়ে পড়বে।
তৈরি থাকো রবার্টসন, পুরোটাই আন্দাজ, তবে তার একটা ভিত্তি আছে, টটেনহ্যাম ম্যাচ জিতলে হার্মিসন বিরাট লাভবান হবে, সঙ্গে সঙ্গে ফাউলার আর রবিনসন। এরা একটা বিরাট চক্রান্ত করছে বলেই আমার বিশ্বাস। সেইসময় মাইকের মোবাইলে সুধীরের কলটা আসতেই মাইক বলল, আবার হার্মিসনরা টেবিল বুক করেছে তো? বিস্মিত সুধীরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাইক বলল, আজ তোমার ব্যবসা ভালো হবে, হার্মিসন দেখো শ্যাম্পেনট্যাম্পেন অর্ডার করবে, একটা ছোটখাট, প্রি নর্থ লন্ডন ডার্বি সেলিব্রেশন, তবে পোস্ট সেলিব্রেশনটা পোস্টপন্ড হয়ে যাবে বলে কথা দিলাম। ফোনটা কেটে দিয়ে রবার্টসনকে বলল, কাল আর্সেনাল ড্রেসিংরুমে একটা কিছু ঘটতে চলেছে, আর সেটা হবে ফাউলার আর রবিনসনের মাধ্যমে। না, খুনোখুনি কিছু হবে না, তবে আর্সেনালের প্রথম দলের এক বা একাধিক খেলোয়াড়ের খেলার আগে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা, আর্সেনাল অধিনায়ক হবে প্রধান টার্গেট। এটা আমাদের আটকাতে হবে যে করেই হোক। একটানা বলে জল খাওয়ার জন্য যখন থামলাম, তখন অধীরদা আমার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন, ব্র্যাভো অতনুদা, অসাধারণ এগোচ্ছেন। শেষটা আপনি করবেন না, আমি করব? আমি বললাম, ফুটবল আর গোয়েন্দা গল্পের নিবেদিত অনুরাগী হিসেবে, শেষটা আমারই করা উচিত। বলে আবার শুরু করলাম।
টটেনহ্যাম হটসপার ফুটবল স্টেডিয়ামে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তদন্ত করে কিছুই পায়নি। ম্যাচের দিন সকালে মাইক পরপর আর্সেনাল ম্যানেজার এবং অধিনায়ককে ফোনে ধরে কয়েকটা নির্দেশ দিল। তারপর রবার্টসনকে বলল, আমাদের চূড়ান্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে করে কেউ ঘুণাক্ষরে ড্রেসিংরুমের আশেপাশে আমাদের উপস্থিতি টের না পায়। টটেনহ্যাম স্টাফেরা জানে, লন্ডন পুলিশ তাদের স্টেডিয়ামে একটা রুটিন তল্লাশি চালিয়েছিল যাতে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং অল ক্লীয়ার সার্টিফিকেট দিয়েছে। তোমার দলবলের জন্য স্পেশাল পাশের ব্যবস্থা করেছি, ড্রেসিংরুমে এন্ট্রি পেতে তোমাদের কোনও অসুবিধা হবে না, তবে বেশি লোকের দরকার হবে না। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দু তিনজন অফিসার ফাউলারদের কব্জা করবার জন্য যথেষ্ট। আমার নিশ্চিত ধারণা, যতক্ষণ না আর্সেনাল খেলোয়াড়রা ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে ওয়ার্ম আপের জন্য যাচ্ছে, ততক্ষণ ফাউলার, রবিনসনরা তৎপর হবে না। আর্সেনাল দলের সঙ্গে যে সাপোর্টিং স্টাফরা আসবে, তাদের সিংহভাগ সেই সময় খেলোয়াড়দের সঙ্গে মাঠে থাকবে, তবে দুই ক্লাবের ঐতিহাসিক তিক্ততার কারণে, হয়তো আর্সেনালের দু একজন কর্মচারী ড্রেসিংরুমে থেকে যাবে, ওরা টটেনহ্যাম সিকিওরিটি সিস্টেম আর সিসিটিভির ওপর পুরোপুরি ভরসা করবে না। আর্সেনাল ফুটবলাররা ওয়ার্ম আপ সেরে ম্যাচ কিটস পরবার জন্য ড্রেসিংরুমে ফেরার সময়ের ব্যবধানটা কাজে লাগাবে ফাউলার, রবিনসনরা। এই সময়েই ইলেকট্রিসিয়ান ফাউলার তার খেলা দেখাবে, শর্ট সার্কিট জাতীয় কিছু ঘটিয়ে সিসিটিভি অল্প সময়ের জন্য বিকল করে দেবে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে। আর সেই ফাঁকে কাজ হাসিল করবে রবিনসন। টটেনহ্যাম ড্রেসিংরুম ফাউলারদের মুখস্থ। বিদ্যুৎ ফেরার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু হবে তোমার, অবামায়েঙ্গ আর আর্তেতার নির্দিষ্ট আসন থেকে, হেল্থ ড্রিঙ্ক আর জলের বোতল তুলে নেবে। দেখবে হাতের ছাপ যাতে নষ্ট না হয়। এই বোতলগুলো দ্রুত ল্যাবরেটরিতে পাঠাবে পরীক্ষার জন্য, আমরা কোনওরকম ঝুঁকি নেব না, পুরো আর্সেনাল দলের জন্য টিম বাস থেকে আবার পানীয় আসবে। ড্রেসিংরুমে থাকা পানীয় কেউ ছোঁবে না। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ল্যাবরেটরিতে আর্সেনাল অধিনায়ক ও ম্যানেজারের পানীয়তেই শুধু তীব্র জোলাপ জাতীয় ওষুধ পাওয়া যাবে। বিশেষভাবে তৈরি ঐ পানীয় খেলে ওরা কিছুতেই ম্যাচে অংশগ্রহণ করতে পারত না। এই ক্ষেত্রে আর্সেনাল টিম ডক্টরের পক্ষে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে এই দুজনকে ফিট করা সম্ভব হত না। পুরো টিমকে এই ধরনের পানীয় দেবার চেষ্টা করা হবে না, কারণ পুরো দল অসুস্থ হয়ে পড়লে খেলা বাতিল হয়ে যেত, সেক্ষেত্রে হার্মিসনদের মূল উদ্দেশ্য বাতিল হয়ে যেত।
অধীরদা বললেন, অতনুদা পাঁচ মিনিট বসুন, শর্ত অনুযায়ী তৃতীয় রাউন্ড কফিটা আপনি আমার হাতে খাচ্ছেন, আপনি গল্পটা দারুণ ভাবে বলে গেছেন, খালি মাঝখানে মাইকের লিলিকে নিবেদিত দু একটা কবিতা বাদ গেছে, তাতে বিশেষ কিছু এসে যায় না, আমি কবিতা তেমন বুঝি না, তবে মাইকের নিজের কবিতা সম্বন্ধে যতই উচ্চ ধারণা থাকুক না কেন, ওগুলো গল্পে কমিক রিলিফ ছাড়া তেমন সুবিধের নয় বলেই মনে হয়, বাদ গেলে মূল গল্পে তেমন প্রভাব পড়ে না। অধীরদা কফি নিয়ে ঢুকলেন সঙ্গে এক প্যাকেট ফাইভফিফ্টিফাইভ সিগারেট, বললেন এটা আমার তরফ থেকে আপনাকে উপহার। আপনার চুলচেরা বিশ্লেষণে আমি অভিভূত, মনে হচ্ছিল যেন গল্পটা দেখে দেখে পড়ছেন। সেই ফাইভফিফ্টিফাইভের প্যাকেটের সিগারেটে সুখটান দিতে দিতেই আপনাদের গল্পটা বললাম। ও! হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই আর্সেনাল অধিনায়ক ও ম্যানেজারের পানীয়ের বোতলে জোলাপ জাতীয় ওষুধ পাওয়া গেছিল, কি একটা খটোমটো মেডিক্যাল নেম আছে, তার উল্লেখ আর করলাম না। হার্মিসন, ফাউলার, রবিনসনের কয়েক বছর হাজতবাস হয়েছে, মাইক ব্রিয়ারলির সুচতুর পদক্ষেপে নর্থ লন্ডন, আর্সেনাল টটেনহ্যামের একটা বড় ভুল বোঝাবুঝি থেকে রেহাই পেয়েছে, সব থেকে খুশির খবর আর্সেনাল সেই ম্যাচে অধিনায়ক অবামায়েঙ্গের দেওয়া একমাত্র গোলে টটেনহ্যামকে হারিয়ে চতুর্থ স্থানে লীগ শেষ করে চ্যামপিয়ন্স লীগ প্লেঅফে জায়গা করে নিয়েছে। আমার মতো একজন আর্সেনাল ভক্তের কাছে এর থেকে মধুরেণ সমাপয়েৎ কী বা হতে পারে!