রান্না করার মেজাজ নেই এখন। লাঞ্চটা বাইরে খেয়ে চালিয়ে নেবে আজ। কোনক্রমে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়ে।
অফিসে ঢুকতে ঢুকতে ঘরের অশান্তি মাথা থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে সৃজিতা।
প্রচুর কাজ অফিসে। সদ্য প্রোমোশান পেয়ে সাব এডিটর হয়েছে সে। পদক্ষেপ ম্যাগাজিনের ‘আজকের মেয়েরা’ বিভাগটার দায়িত্ব এখন তার। শুভশ্রী রিজাইন করেছে। তার কাজগুলো তাড়াতাড়ি বুঝে নিতে হবে। পরের মাসের সব লেখা রেডি করে দিতে হবে এই সপ্তাহের মধ্যেই।
কদিন ধরেই পরিকল্পনা করছে ম্যাগাজিনে নতুন কী বিষয়বস্তু তুলে ধরা যায়। এতোদিন এই সেকশানটার প্রধান ফোকাস ছিল মেয়েদের ফ্যাশান আর শো বিজনেস। বুদ্ধিবৃত্তি, শৈল্পিক সুষমা বা সাধারণ মেয়েদের জীবন সংগ্রামের কোন গুরুত্ব ছিল না। সেই দিকটাকেও জোরালো ভাবে তুলে ধরতে চায় সৃজিতা।
টিমের সঙ্গে একটা মিটিং ডাকে। সবাইকে তার পরিকল্পনা সংক্ষেপে জানায়। পুরো সেকশানটার পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত রূপ দিতে হবে। এক্কেবারে আধুনিক বুদ্ধিদীপ্ত একটা সংস্করণ চাই। আকর্ষণীয় উপস্থাপনা আর কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়বস্তুর ওপর টিমের সবাইকে এক সপ্তাহের মধ্যে ফ্রেশ ও ইনোভেটিভ আইডিয়া জমা দিতে বলে।
দুপুরে সীমাকে ফোন করে লাঞ্চে ডেকে নেয়। অফিস থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা রাস্তা।
আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। গুমোট দমবন্ধ করা গরম। একটুও হাওয়া নেই। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। দূর থেকে দেখতে পেল রেস্টুরেন্টের কাছে এক ল্যাম্পপোস্টের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে সীমা। মুখ চোখে উপচে পড়েছে ছোঁয়াচে হাসি। দেখেই জড়িয়ে ধরলো ওকে।
— চল্ না কোথাও বেড়িয়ে আসি। তুই, আমি, কৌশিকী আর দেবারতি। তুই কবে নেক্সট ছুটি পাবি বল। সেই মতো প্ল্যান বানাবো।
— ধ্যুত, বেড়াতে যাওয়ার মুড নেই একটুও।
— আবার ঝগড়া করেছিস নীলাদ্রিদার সঙ্গে?
— নাহ। চেন্নাই গেছে। বাড়ি ফিরলেই শুরু হয়ে যাবে। ডিপ্রেশানে পাগল হয়ে যাচ্ছি। অফিসেও প্রচুর কাজ। অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে পড়েছে। তার ওপরে বাড়িতে কাজের মেয়েটা আসছে না।
— সারাক্ষণ দুজনে ঝগড়া করছিস। তাও কেন যে ওই বাড়িতে পড়ে আছিস কে জানে!
— ওই বাড়ি মানে? ওটা আমারও বাড়ি। দলিলে আমার নাম নেই তো কি হয়েছে। কম করেছি নাকি ওই বাড়ির জন্যে? ওই ফ্ল্যাটটা দেখে পছন্দ করে কেনার সিদ্ধান্ত আমিই নিয়েছিলাম। প্রথম এডভান্সের অর্ধেক টাকা আমার ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে দিয়েছিলাম। বাড়ির প্রত্যেকটা ঘরের রঙ আমি ঠিক করেছি। বাড়ির সব জিনিষ আমি নিজে পছন্দ করে কিনেছি। নিজের রোজগারের কম টাকা ঢেলেছি নাকি ওই বাড়ির পিছনে? এখন কে এক জিনিয়া মুনিয়ার হাতে সব ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে?
— তুই অহেতুক জেদ করছিস সৃ। নীলাদ্রিদার ওই জিনিয়া মুনিয়া গার্লফ্রেন্ডরা তো তোর জীবন নরক গুলজার করে তুলেছে। মেনে নে যে তোদের সম্পর্কটা ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। নীলাদ্রিদার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা কর।
— তার তো একটাই কথা। বলবে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। কেন যাব আমি? এ বাড়ি আমার নয়?
— যাবি কারণ তোর সুস্থ জীবনযাপন করা জরুরি। যথেষ্ট হয়েছে। এইবার পাতা উলটে অন্য গল্প লেখ। জাস্ট লেট ইট গো এন্ড মুভ অন। নতুন জীবন শুরু কর।
— জীবন তো শেষই হয়ে গেছে। বাদ দে এসব। এই সমস্যার সমাধান করা তোর কর্ম নয়। তোর সুখের সংসার। তুই বুঝবি না। ‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’ — জোর করে হেসে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে সৃজিতা।
— কী ভ্যাপসা গরম না আজ? কবে যে এক পশলা ঝমঝম করে বৃষ্টি হবে।
— উফ, তুই আর তোর বৃষ্টিপ্রেম। কলকাতায় না জন্মে তোর চেরাপুঞ্জিতে জন্মানো উচিত ছিল।
চেরাপুঞ্জির নাম শুনেই মনে পড়ে গেল নীলাদ্রির সঙ্গে চেরাপুঞ্জি বেড়াতে যাওয়ার কথা। গোটা চেরাপুঞ্জিটাই যেন মেঘের মধ্যে ডুবে ছিল সেদিন। ভেজা হাওয়া আর অবিরাম ঝির ঝির বৃষ্টি। চারিদিকে চোখ জুড়োনো সবুজ পাহাড়। স্তূপীকৃত মেঘের সমুদ্রে দ্বীপের মতো জেগে থাকা কিছু পাহাড়ের চূড়ো। মেঘের গায়ে গা লাগিয়ে, নীলাদ্রির হাতে হাত রেখে, বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ে প্রজাপতি মন নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। গোলাপি স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো।
বেড়াতে যাওয়ার জায়গা ঠিক করার জন্যে একটা মজার খেলা খেলত ওরা । চোখ বন্ধ করে প্রথম যে ছবিটা চোখে ভাসবে সেখানেই বেড়াতে যাওয়া হবে। শেষ যেবার এই খেলা খেলেছিল, নীলাদ্রি চোখ বন্ধ করে নৌকায় জলবিহার করার ছবি দেখেছিল। ঠিক হয়েছিল কেরালা ব্যাকওয়াটার্সে বেড়াতে যাবে। হাউসবোটে কাটাবে একটা রাত। সে আর পূরণ হয়নি কোনদিন। জীবনটাই ওলোটপালোট হয়ে গেল তারপর।
নতুন ভাবে ম্যাগাজিনের ‘আজকের মেয়েরা’ সেকশানটা সাজানো গোছানোর প্ল্যানিং শুরু হয়ে গেছে জোর কদমে। দু’তিন মাস পর থেকে পরিবর্তিত সংস্করণ প্রকাশ করা হবে। ঠিক করেছে বিভাগটার নতুন নাম দেবে ‘অর্ধেক আকাশ’।
প্রথম মাসে কলকারখানা, ফ্যাক্টরির মেয়েদের কথা লেখা হবে, যারা ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। তাদের সংগ্রাম সাফল্য, কাজের সুবিধে অসুবিধে, জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ ক্ষোভ, সর্বোপরি তাদের ভালোলাগা। দ্বিতীয় মাসে থাকবে ছোট ও মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ী মেয়েদের গল্প, যারা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে মাথা উঁচু করে ব্যবসা চালাচ্ছে, আরো অনেক মানুষের রুটি রোজগারের উপায় করে দিচ্ছে। তারপরের মাসে থাকবে ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি, ট্রাক চালক মেয়েদের কথা। এর পর ক্রমশঃ আসবে চিত্রশিল্পী, ডাক্তার, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী, বিজ্ঞানী। মেয়েরা এত অসংখ্য জীবিকায় কাজ করে যে বিষয় বৈচিত্র্যের কোন অভাব হবে না।
মেয়েদের জীবিকা নিয়েও নানা পরামর্শের কথা ভাবা যেতে পারে। কোন্ কোন্ জীবিকায় মেয়েদের কাজের সুযোগ আছে, কী ধরনের কাজ, কী রকম মাইনে, সেই চাকরি পেতে গেলে কী পড়াশোনা করতে হবে ও কী দক্ষতা দরকারি।
এডিটর মিঃ সেন ওর প্ল্যানিং অনুমোদন করেছেন। বললেন,
— সৃজিতা, তোমার যা উদ্দীপনা, যা পরিকল্পনা তাতে মনে হচ্ছে এক বছরের মধ্যেই বলবে মেয়েদের জন্যে একটা আলাদা ম্যাগাজিন চাই।
— একেবারেই না। মেয়েদের জন্যে আলাদা ম্যাগাজিন হলে ছেলেরা সেই ম্যাগাজিনকে ব্রাত্য করে দেবে। আমি চাই এইসব মেয়েদের গল্প মেনস্ট্রিম ম্যাগাজিনেই থাকুক। যাতে সমাজের পুরুষরাও জানতে পারে মেয়েরা আর কোন কাজে পিছিয়ে নেই। মেয়েদের আর দমিয়ে রাখা যাবে না।
— বিভাগটা নতুন চেহারায় যদি মানুষের নজর টানতে পারে তাহলে অতিরিক্ত কিছু পাতা বরাদ্দ করার কথা ভেবে দেখব।
দু’সপ্তাহ পর থেকেই নানান লেখা এসে জমা পড়তে থাকে ভারতবর্ষের নানান প্রান্ত থেকে। লেখা ছাড়াও ভিডিও ক্লিপিং, ইন্টারভিউ, ফটো। টিমকে হস্তান্তর করার আগে সব উলটে পালটে একঝলক দেখে নেয় সৃজিতা।
খেলনা তৈরির কোম্পানি প্রথম ইন্ডাস্ট্রিজে নব্বই শতাংশ কর্মচারী মহিলা। যেসব মেয়েরা ফ্লোরে কাজ করে, তারা সব থেকে কম মাইনের কর্মচারী। অনেকেই বাড়ির একমাত্র আরনিং মেম্বার। একজন বলেছে, ‘খুব খাটনির কাজ এখানে। বাড়ি ফিরেও আমাকে সংসারের সব কাজ করতে হয়। দুই মেয়ে আমার। বড়টা আমার সঙ্গে বাড়ির কাজে হাত লাগায়। আমি বেশি কাজ করতে দিই না। বলেছি মন দিয়ে পড়াশোনা করতে। ওরা যত দূর পড়তে পারে আমি পড়াব। দরকার হলে টাকা ধার করব। একটু ভালো পড়াশোনা থাকলে এত শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হবে না।’
কিছু খুব উদ্বেগজনক রিপোর্ট আছে গারমেন্ট ফ্যাক্টরির মহিলা কর্মচারীদের ওপর। অনেকেই নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে। মৌখিক গালিগালাজ, নোংরা কদর্য ইঙ্গিত থেকে যৌন অত্যাচার। উপরমহলে জানালেও কাজ হয় না। উপরন্তু চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে চুপ করে থাকতে বাধ্য হয় তারা। নাম বলতে রাজি হয়নি কেউ।
এক গুচ্ছ হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়ে কাজ করে হরিদ্বারের হিন্দুস্তান কসমেটিক্সের নেল পলিস তৈরির কারখানায়। এখানে প্যাকেজিং, সুপারভাইজিং থেকে ম্যানেজমেন্ট সবটাই মেয়েরা করে। ম্যানেজমেন্ট খুব খুশি। বলেছে মেয়েদের বেশি সংখ্যায় নিয়োগ করার ফলে পুরো ফ্যাক্টরির উৎপাদন বেড়ে গেছে, ত্রুটিবিচ্যুতি কমে গেছে। গত চার বছরে একজনও চাকরি ছাড়ে নি। একজন কর্মচারী বলেছে, – ‘আমি খুব গরীব পরিবারের মেয়ে। অনেক জেদ করে পড়াশোনা করেছিলাম। স্বপ্ন দেখতাম নিজে রোজগার করব। কম বয়সে বাড়ি থেকে বিয়ে দেয়নি বলে প্রতিবেশীরা কত সমালোচনা করেছিল। এখন তারাও মেয়েদের তড়িঘড়ি বিয়ে না দিয়ে পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করছে। আর মেয়েরাও চাকরি করার স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। স্বপ্ন দেখলে তবে তো কিছু বদলাবে!’
হায়দরাবাদের প্রিয়দর্শিনী ফুড প্রোডাক্টস প্ল্যান্টের একজন কর্মচারী বলেছে, ‘রোজ রাত্রে আমার স্বামী মাতাল হয়ে ফিরত আর আমায় মারধোর করত। একদিন সব ছেড়েছুড়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পরিশ্রম করতে পারি। খেটে খাব। এতো কীসের চিন্তা। এত অসম্মান সহ্য করব কীসের জন্যে? আমি খুব ভালো আছি এখন। মেয়ে স্কুলে পড়ে।’ ফটোতে কী মুখ ভর্তি হাসি মেয়েটির।
অন্যমনস্ক হয়ে যায় সৃজিতা। এত অসম্মান, এত অপমান সহ্য করে সে কেন এখনো পড়ে আছে ওই বাড়িতে। যে সামাজিক সম্পর্কের জোরে সে বাড়িটাকে নিজের ভাবে, তাও তো সে গায়ের জোরে ধরে রেখেছে। কতদিন হয়ে গেল দুজনে একই বাড়িতে দুটো আলাদা ঘরে বসবাস করে। কবেই উবে গেছে তাদের মন আর শরীরের সব ভালোবাসাবাসি। রয়ে গেছে এক তিতকুটি স্বাদ আর ঘুসঘুসে জ্বরের মতো এক মন খারাপের অসুখ। কোথাও পালিয়ে গিয়ে একটা রাতও কাটানোর জায়গা নেই তার। মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ নেই নিজের। তাই কি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে সে? নীলাদ্রি অফিসের কাজে বাইরে গেলে ঘরের অশান্তি থেকে সাময়িক মুক্তি পায়। তার গার্লফ্রেন্ডেরও কমতি নেই, প্রেম প্রীতিরও অভাব নেই।
আজ এই সব আপাত সাধারণ হয়েও অসাধারণ মেয়েদের কথা পড়তে পড়তে তার বুকের গভীরে যেন নিঃশব্দে একের পর এক ভূমিকম্প হয়ে চলেছে। সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বার বার। কেবলই মনে হচ্ছে কী করে সে এতদিন নীলাদ্রির এই ব্যবহার, একাধিক মেয়েদের সঙ্গে তার সম্পর্ক সহ্য করে চলেছে দিনের পর দিন। ড্রাগের নেশার মতো সে কেন এই নষ্ট সম্পর্ককে আঁকড়ে পড়ে আছে। কেন সে অশান্তির আগুনে নিজেকে আহুতি দিচ্ছে।
যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে সে আজ। অবিলম্বে এই দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তাকে। এক কামরার একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া চাই। অফিসের কাছেপিঠে কোথাও। যত দ্রুত সম্ভব তাকে নিজস্ব ঠিকানায় উঠে যেতে হবে। এই একঘেয়ে মানসিক টানাপোড়েনের গল্প তার জীবনের গল্প হতে পারে না। এবার সে নতুন গল্প লিখবে।
একটা রেন্টাল এজেন্সির সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রায় দিনই অফিস থেকে দুপুরে বেরিয়ে ফ্ল্যাট দেখতে যাচ্ছে। বিকেলে অফিসে ফিরে আবার কাজে বসছে। ফলে বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে রোজ। রোজই দেখছে নীলাদ্রি বাড়ি ফিরে এসেছে ওর আগেই।
চেন্নাই থেকে ফেরার পর থকেই তার ঝগড়া করার উৎসাহে ভাটা পড়েছে যেন। অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর আর চুপচাপ। যেন একটু দুঃখী, একটু ডিস্টার্বড। প্রেমে আঘাত পেয়েছে কি? একটা স্যাডিস্টিক প্লেজার হয় সৃজিতার। মনটা খুশি খুশি লাগে। একটু গায়ে চিমটি কাটা, রাগ উসকে দেওয়া কথাবার্তা বলতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু যে সম্পর্ক সে সারাজীবনের মতো ছেড়ে দিতে চলেছে তার জন্যে এতো আবেগের অপব্যায় করে কী হবে!
সে নিজের কাছে অঙ্গীকার করে কোন ঝগড়ার প্ররোচনায় পা দেবে না আর কিছুতেই। শান্ত নিরুদ্বিগ্ন হয়ে নীলাদ্রির সঙ্গে বিচ্ছেদপর্বটা সামলাতে হবে। যতদূর সম্ভব বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করবে সে। এতদিনের সম্পর্ক এটুকু সম্মান তো দাবি করে।
দু সপ্তাহর মধ্যে পাঁচ ছ’টা বাড়ি দেখে সে একটা শর্টলিস্ট করে ফেলে। অফিস থেকে একটু দূরে হয়ে যাবে। কিন্তু এই ছোটখাটো অপছন্দ নিয়ে তার বিলাসিতা করার সময় নেই এখন। বাড়িওয়ালাকে জানিয়ে দিয়েছে যে পরের মাসের পয়লা থেকেই সে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নেবে। এখানে থাকার মেয়াদ আর দিন পনেরো। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথাটা জানাতে হবে নীলাদ্রিকে।
একদিন সৃজিতা অফিস থেকে ফিরে দেখে নীলাদ্রি বসে বসে টিভিতে ক্রিকেট দেখছে। তাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে,
— এতো দেরি করে ঘরে ফেরার কী দরকার? অফিসে থাকলেই হয়।
সৃজিতা সুযোগটা হাতছাড়া করে না,
— আমি বাড়ি দেখছি। সামনের মাসের এক তারিখেই চলে যাব।
— যত্তোসব নাটক। এত সহজে আমাকে মুক্তি দেবে তুমি? তোমাকে চিনি না? ঘরের দিকে তোমার মন আছে? চেন্নাই থেকে ফিরেছি পনেরো দিন হয়ে গেল। জামাকাপড়গুলো এখনো ঘরের কোণেই ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। কাচা পর্যন্ত হয়নি।
— ওয়াশিং মেশিন তো আছে। নিজের জামাকাপড় নিজে কেচে নাও। আমার পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব নয়।
— কোন কাজটাই বা তুমি করতে পারো? গত মাসের ইলেক্ট্রিক বিল, টেলিফোন বিল কিছুই দেওয়া হয়নি এখনো। সেই আমাকেই দিতে হবে। বাড়িতে চা, কফি কিচ্ছু নেই। কোনো দিকে তোমার খেয়াল আছে?
— এটা তোমার বাড়ি। এখন থেকে সব কিছু নিজে করা অভ্যেস করো। না পারলে, জিনিয়া মুনিয়া পরী অপ্সরা কার সঙ্গে তুমি থাকতে চাও তাদেরকে নিয়ে এসো বাড়িতে, তাদেরকে দিয়ে কাজ করাও।
নীলাদ্রি ভস্ম করে দেওয়ার মতো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর টিভির রিমোটটাকে সজোরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। রিমোটটা দু-টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল। রিমোটের ব্যাটারি খুলে গড়িয়ে গেল সোফার তলার অন্ধকারে।
এত মনস্থির করা সত্ত্বেও গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে একটু খোঁচা দেওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারে নি সৃজিতা। সোজা কথা সহজ করে বলার আর্টটাই ভুলে গেছে যেন।
চট করে বেরিয়ে পাড়ার মোড় থেকে চা, কফি কিনে আনে। কফি বানিয়ে নীলাদ্রিকে দিয়ে আসে ঘরে। নীলাদ্রি কফিটা নিয়ে ওর দিকে তাকায় এক দৃষ্টে অপলক। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে সৃজিতার। কতদিন পরে তাকালো তার দিকে এরকম গভীর দৃষ্টিতে?
— সত্যিই চলে যাবে ঠিক করেছ?
— হ্যাঁ। আর দিন পনেরো আছি আমি। শেষ কটা দিন তোমার সঙ্গে আর ঝগড়া করতে চাই না। তুমিও কোরো না প্লীজ।
— হঠাৎ এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে। আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?
— হঠাৎ কোথায়? তুমি তো চাইছ কতোদিন ধরে। আমিই জেদ করে পড়েছিলাম এখানে।
— এখন কী ঘটল হঠাৎ?
— দমবন্ধ লাগছে খুব। মনে হচ্ছে জীবনের গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলেছি দুজনেই। মিউচুয়াল ডিভোর্সে আমার আপত্তি নেই।
— ডিভোর্সের খুব তাড়া দেখছি। কাকে বিয়ে করছ। সঞ্জয় না তুষার? এখন তো আর বলতে কোন অসুবিধে নেই।
— তোমার মতো নাকি আমি যে যার তার সঙ্গে সবসময় প্রেম করে বেড়াব?
— আমি প্রেম করলেই যার তার সঙ্গে হয়ে যায়? তুমি খুব ধোওয়া তুলসীপাতা? একেবারে সতী লক্ষ্মী?
— প্লীজ ভালো করে কথা বলো। বিবাহিত জীবনে আমরা ডাহা ফেল করেছি। শেষ কটা দিন অন্তত বন্ধুর মতো ব্যবহার করি।
— তাহলে সত্যি কথাটা বলে ফেলো। প্রেম করো না তো রোজ দেরি করে ফিরছ কেন? আগে তো বলতে তুষারের সঙ্গে সিনেমা যাচ্ছ, সঞ্জয়ের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছ। কাকে বিয়ে করছ শেষপর্যন্ত?
হেসে ফেলে সৃজিতা।
— আমায় সন্দেহ করছ? নাকি ঈর্ষা। তোমার অগুন্তি এফেয়ারসের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বানিয়ে বলেছিলাম ওসব। ভেবেছিলাম কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলব। কিন্তু লাভ হয়নি। তুমি সন্দেহের আগুনে নিজে যত জ্বলেছ, আমাকেও তত জ্বালিয়েছ। জোর করে সম্পর্কটা বজায় রাখার চক্করে দুজনেরই সব দাঁত নখ বেরিয়ে এসেছিল। কী যাচ্ছেতাই ভাষায় ঝগড়া করেছি আমরা! এইবার চলো দাঁড়ি টানি এই ঝগড়াঝাঁটির, এই সম্পর্কের। আমাদের দুজনেরই একটা ভালো জীবন প্রাপ্য।
অনেক রাত পর্যন্ত সৃজিতা চুপ করে নিজের ঘরের বারান্দায় বসে থাকে। ঘুম ধরে না ওর। আস্তে আস্তে ট্র্যাফিকের আওয়াজ কমে আসে। আশে পাশের বাড়ির আলো নিভে যায় একে একে। ওর চারিদিকে মেঘের মতো ঘন হয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। বুকের মধ্যে ঝির ঝির করে বৃষ্টি নামে। ভিজিয়ে দেয়। জীবনের যত দুঃখ, কষ্ট, না পাওয়া, মনখারাপ সব ভরিয়ে তোলে তার অন্তর বাহির। চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলে সব প্রতিরোধ। ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
নীলাদ্রিও ঘুমোতে পারে না বুঝি আজ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলেছে। সিগারেটের গন্ধ নীলাদ্রির বারান্দা থেকে ভেসে ওর বারান্দায় পৌঁছে যাচ্ছে বেশ। শুধু ওরা কেউ পৌঁছতে পারে না পরস্পরের কাছে, অতিক্রম করতে পারে না এই দূরত্ব। তাদের দুজনের গল্প আজ আলাদা হয়ে গেছে।
এরোপ্লেনের জানলা থেকে নীচে তাকিয়ে দেখলে যেমন মাঠ রাস্তা বাড়ি এইসব খুঁটিনাটিগুলো ধীরে ধীরে আবছা হয়ে গিয়ে দেশের অবয়বটা ফুটে ওঠে, দেখা যায় উঁচু পাহাড়, মাইলের পর মাইল বয়ে চলা নদী, বিস্তৃত সবুজ মাঠ বা অসীম নীল সমুদ্র। তেমন করে আজ এতদিন পরে তাদের যৌথ জীবনের কথা ভাবলে তাদের রাগ-অনুরাগের উত্থান-পতনটাও বেশ স্পষ্ট নজরে পড়ে।
তাদের সংক্ষিপ্ত প্রেমপর্বে আর বিবাহিত জীবনের শুরুর দিকটা ছিল নিয়মমাফিক উজ্জ্বল উচ্ছল। ওদের মন ভর্তি টলটলে দীঘির মতো ভালোবাসা ছিল, চোখে ছিল রঙিন স্বপ্ন। ওরা নিয়ম করে একসঙ্গে সিনেমা দেখত, বাইরে খেত, বেড়াতে যেত। তারপর অফিসে নীলাদ্রির পদোন্নতি হল। দেশে বিদেশে যাওয়া শুরু হল। কখনো দু’দিন কখনো দু’সপ্তাহ। সৃজিতা নীলাদ্রির বাড়ি ফেরার দিন গুনত। নীলাদ্রি ওকে মিস করত কিনা জানা নেই। কিন্তু ফেরার সময় মনে করে ওর জন্যে উপহার নিয়ে আসত।
ক্রমশ নীলাদ্রির ট্যুরের সংখ্যা বাড়ল, ট্যুরের মেয়াদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হল। পরস্পরকে ছেড়ে থাকা বেশ অভ্যেস হয়ে গেল। আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড? কী জানি! তখনই সম্ভবত এক বা একাধিক গার্লফ্রেন্ডের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল নীলাদ্রির জীবনে। নানা রকম খবর পেত সৃজিতা। জিগ্যেস করলে নীলাদ্রি অস্বীকার করত। কখনো বলত পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা। কখনো বলত অফিস কলিগ। নীলাদ্রি সবসময় ব্যাস্ত থাকত। সৃজিতার জন্যে তার কোন সময় ছিল না। ভালোবাসাও সম্ভবত ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল তখনই।
যেটুকু দেখাসাক্ষাতের সময় জুটত তা ঝগড়াঝাটি আর মন কষাকষি করে কেটে যেত। অবিশ্বাস, অসন্তোষে ভারী হয়ে থাকত বাড়ির পরিবেশ। সৃজিতার মনে হত ও একা সব আনন্দ থেকে বাদ যায় কেন? সেও বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার, সিনেমা, বেড়াতে যাওয়া শুরু করে। তখন নীলাদ্রি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার গার্লফ্রেন্ডদের উপস্থিতি তখন সে সোচ্চারে জানান দিত। ঝগড়াঝাটি ক্রমশ অশালীন হয়ে যায়। নীলাদ্রি সৃজিতার ওপর ডিভোর্স করার জন্যে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। দিনরাত্রি তাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর প্ল্যান ভাঁজত সে সময়। কিন্তু সৃজিতা জেদ ধরে ছিল ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী।’
তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়ার ঝাঁঝ কমে গিয়েছিল অনেক। কিন্তু তিক্ততা বেড়েই চলেছিল। আজ অবশেষে মুক্তি মিলল দুজনের।
অফিসে প্রতিদিন প্রচুর লেখা এসে জমা হচ্ছে। ব্যবসায়ে মেয়েদের অগ্রগতি দেখলে মন আশায় ভরে উঠছে। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, এত সামাজিক বাধাবিঘ্নের মধ্যে মেয়েদের এই সাফল্য অর্জন করা যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনি কৃতিত্বের। প্রত্যেকের জীবন যেন উপন্যাসের মতো রোমাঞ্চকর। কিছু কিছু ইন্টারভিউ কেটেছেঁটে ছোট করতে ইচ্ছে করছে না। ম্যাগাজিনে কতটুকুই বা জায়গা। মেয়েদের এই সংগ্রামের গল্প এত ছোট করে একটা কলামে ঢোকানো অপমানজনক। অন্তত একটা গোটা পাতা যদি উৎসর্গ করা যেত এক একটা মানুষের লড়াইয়ের জন্যে তবেই সম্মান জানানো হত তাদের লড়াইকে।
রাজস্থানে নিকিতা শর্মা একটা কোম্পানি খুলেছে যারা মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারদের ট্রেনিং দেয়। অনেক কোম্পানি প্রজেক্টের জন্যে লোক নিয়োগ করে আর প্রজেক্ট শেষ হলেই তাদের ছাঁটাই করে দেয়। এদের টার্গেট মূলত সেই সব মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কাররা যারা দুম করে চাকরি খুইয়ে বেকার হয়ে যায়। অল্প পয়সায় এদের নানা রকম ট্রেনিং দিয়ে উপযুক্ত কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। নিকিতা বলেছে – ‘আমি কলেজে ইকোনমিক্স পড়াতাম। কিন্তু পড়িয়ে আনন্দ পেতাম না। তখন এই ব্যাবসাটার প্ল্যান আসে মাথায়। ব্যবসা জগৎটা এতটাই পুরুষশাসিত, যে অফিসের জন্যে বাড়ি ভাড়া, ব্যবসার জন্যে লোন নেওয়া সবেতেই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু চ্যালঞ্জ না থাকলে তো কাজের মজা নেই। নিত্য নতুন সমস্যার সমাধান করতে করতে এগিয়ে চলেছি এখনো। আমি বিশ্বাস করি ইচ্ছে থাকলে, অধ্যবসায় থাকলে উপায় একটা হবেই।’
মাইসোরে একটা হাইস্কুলের কাছে সারদা আন্টির ধোসার দোকান আছে। শ্বশুরবাড়ির রোজদিনকার লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য না করতে পেরে তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। নিজের গয়না বিক্রি করে খুলেছিল ধোসার দোকান। জানিয়েছে, ‘আমার একটা আত্মসম্মান বোধ নেই? এত অভদ্রতা কোন মানুষ সহ্য করতে পারে? অনেক চেষ্টা করেছি বোঝানোর, শোধরানোর। মানুষটাকে বদলাতে পারিনি, তাই নিজেকেই বদলেছি। আধ পেটা খেয়ে থাকতে হলেও মনে শান্তি থাকবে।’
সারদা আন্টির মতো সাধারণ জ্ঞানটুকুও থাকলে তার মনস্থির করতে এতগুলো বছর নষ্ট হত না!
তামিলনাড়ুর কৃষ্ণার জীবনটা তো প্রায় রূপকথার মতো। তার বাবা, মা বিড়ি বাঁধত। খুব গরীব পরিবার। তার ওপর তারা পাঁচ বোন। ছোটবেলা থেকে দেখত বাবা মাকে পেটাচ্ছে, গালাগাল দিচ্ছে। ভাবত এটাই স্বাভাবিক। পড়তে খুব ভালবাসত কৃষ্ণা। নিয়মিত স্কুলের লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই নিয়ে এসে পড়ত। ওটাই ছিল ওর এই বাস্তবের কঠিন জগৎ থেকে কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তির উপায়। বই পড়তে পড়তেই গ্রামের বাইরের বিশাল পৃথিবীটাকে চিনতে শিখেছিল, আত্মমর্যাদা বোধ কাকে বলে বুঝতে শুরু করেছিল। হেলেন কেলারের আত্মজীবনী পড়ে সে প্রথম অনুভব করে যে তার জীবনকে সে, একমাত্র সে-ই বদলাতে পারে, অন্য কেউ নয় । মনে মনে নিজের অবস্থাটাকে বদলানোর জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। নিধি দত্তও খুব অনুপ্রাণিত করেছিল তাকে। মায়ের সঙ্গে চুক্তি করত যে সে দিনে একশোটা বিড়ি বেঁধে দেবে যদি মা তাকে নিধি দত্তর প্রোগ্রাম দেখতে দেয়। এই প্রোগ্রাম দেখতে দেখতেই সে ইংরেজি কথা বুঝতে ও বলতে কিছুটা সড়গড় হয়। সেই তার লড়াইয়ের শুরু। এখন বিদ্যা ফাউনডেশান নামে একটা নন-প্রফিট অরগানাইজেশান চালায়। গ্রাম মফস্বলের গ্রাজুয়েট ছেলেমেয়েদের ট্রেনিং দিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে কিছুটা প্রস্তুত করে দেয়। এফেক্টিভ কমিউনিকেসান শেখায়, আত্মসম্মান বিকাশের জন্যে ট্রেনিং দেয়। বাইরের বিশাল কর্মক্ষেত্রের হালচাল সম্বন্ধে আলোকপ্রাপ্ত করে যাতে তারা নিজেদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। ‘আমি এদের প্রত্যেককে বলি – তোমার জীবনকে, তোমার অবস্থাকে একমাত্র তুমি-ই বদলাতে পারো, অন্য কেউ নয়।’
সৃজিতাও শেষ পর্যন্ত নিজের হাতে তুলে নিয়েছে নিজের জীবন বদলানোর ভার। জীবনে চড়াই উতরাই রোদ ঝড় বৃষ্টি থাকবে। কিন্তু সে-ই ঠিক করবে কোন দিকে হাঁটবে সে, কখন পালটাতে হবে দিক, কখন আঁকবে নতুন ছবি, লিখবে নতুন গল্প।
হঠাৎ নানা রিপোর্ট, লেখাপত্রর মধ্যে একটা ফটোতে চোখ আটকে গেল। টিনা না? টিনাই তো। একসঙ্গে কলেজে পড়ত ওরা। তারপর বিয়ে করে বিদেশে চলে গিয়েছিল। সেই থেকে যোগাযোগ নেই।
সমস্ত রিপোর্টটা পড়ে ভালো করে। টিনা ব্যাঙ্গালোরে একটা সংস্থা চালায় যার নাম ‘সম্মান’। একটা নন-প্রফিট অরগানাইজেশান। পরিবার পরিত্যক্ত বা পরিবারহীন বয়স্ক মানুষদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার ভার নেয় এরা। অনাথ বা রাস্তার ছেলেমেয়েদের থাকার ও পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়। অসহায় মেয়েদের জন্যেও একটা পুনর্বাসন সেন্টারও চালায়। রীতিমতো একটা কর্মযজ্ঞ বলা যেতে পারে।
সৃজিতা মুগ্ধ হয়ে যায়। সেই নরমসরম মেয়েটা, যে জোর গলায় কথা বলতে পারত না, সে এরকম একটা বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। কোথায় পেল এত মানসিক শক্তি? ইন্টারনেটে সার্চ করে ওদের অফিসের ফোন নাম্বার বার করে ফোন করে।
— সৃজিতা, কেমন আছিস? তুই আমার ফোন নাম্বার কী ভাবে পেলি?
— সে অনেক গল্প। ‘সম্মান’-এর খবর পড়ে কী যে ভালো লাগছে তোকে বোঝাতে পারব না। এত বিশাল একটা কর্মকাণ্ড কী করে চালাস তুই?
— আমি একা নই। অনেকে আছেন আমাদের গ্রুপে। আমার শ্বশুরমশাই এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে এটা শুরু করেছিলেন প্রায় কুড়ি বছর আগে। এখন উনি অবসর গ্রহণ করেছেন। তাই আমি জুড়ে গেছি। একবার এসে ঘুরে যা এখানে। নিজের চোখে দেখে যা সব কিছু।
— খুব ইচ্ছে করছে গিয়ে দেখে আসতে।
— চলে আয় যেকোনো দিন। একটু আগে থেকে আমায় জানিয়ে দিবি। তোর থাকার ব্যবস্থা করে রাখব। আমাদের কাজ ভালো লাগলে আর তোর আগ্রহ থাকলে এখানে জয়েন করেও যেতে পারিস।
— এই ধরনের কাজ তো আমি কিছুই করিনি আগে।
— আমাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর দিকটা দেখার জন্যে আমরা একটা ফুল টাইম লোক খুঁজছি। সোশাল মিডিয়াতে আমাদের উপস্থিতি ও প্রচার বাড়াতে হবে। এসব তুই খুব ভালোই পারবি। মাইনে বেশি দিতে পারব না অবশ্য। কিন্তু কাজ করে তোর মনে প্রশান্তি আসবে। গ্যারান্টিড।
— এক্সাইটিং অফার। দাঁড়া, জলদি তোর কাছে যাওয়ার একটা প্ল্যান করি তাহলে।
নতুন ফ্ল্যাটের চাবি পেয়ে গেছে সৃজিতা। ওটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেডি করে ফেলেছে মোটামুটি। কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবলেই বুকের ভেতরে শুধু ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ করে এই বাড়ির সব কিছু কেমন সাজানো খেলাঘরের মতো মিথ্যে হয়ে গেল।
নীলাদ্রির সঙ্গে যখন সংসার শুরু করেছিল তখন কত স্বপ্ন ছিল ওদের। একসঙ্গে বেড়াতে যাবে, মাইলের পর মাইল ট্রেকিং করবে পাহাড়ে, টেন্টে থাকবে। দেখবে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়ো প্রথম রোদের স্পর্শে কেমন অপরূপ সোনালী হয়ে ওঠে। এক কনকনে ঠান্ডা সকালে পাহাড়ের এক ছোট্ট দোকানে বসে ইয়াকের দুধে তৈরি চা খাবে। অথবা কুয়াশায় ঢাকা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটবে দুজনে। আর একদিন সকাল থেকে কালো মেঘে অন্ধকার করে থাকবে আকাশ। সারাদিন ঝমঝম করে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হবে। বেড়ানোর প্ল্যান সব ভেস্তে যাবে। জাঙ্গল লজের বারান্দায় বসে চুপটি করে বৃষ্টি দেখবে সে, শুনবে সহস্র গাছের পাতায় বৃষ্টির টাপুর টুপুর।
আজ সেই সব দিনগুলোর কথা ভাবলে কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। তখন কল্পনাও করেনি তাদের সম্পর্ক এত শীঘ্র এমন তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। জীবনের যে-কোন গল্পই শেষ হয়ে যাওয়ার পর বোধহয় গল্পের শুরুটা এরকমই সম্পূর্ণ অলীক আর অবাস্তব মনে হয়।
ব্যাগ গুছোতে হবে। একটা স্যুটকেস নামায় আলমারির মাথা থেকে। খুলে দেখে কবেকার টুকিটাকি জিনিষ পড়ে আছে এখনো। গ্লাভস, স্কার্ফ, পশমিনা শাল। মানালী বেড়াতে গিয়ে নীলাদ্রি শালটা কিনে দিয়েছিল ওকে। তারপর আর কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। কত স্মৃতি উড়ে এসে জুড়ে বসছে।
কখন নীলাদ্রি ঘরে এসে ঢুকেছে ও খেয়াল করেনি।
— সৃ, তুমি তো চলেই যাবে। একটা অনুরোধ করব?
— আমাদের সম্পর্কটার আয়ু শেষ। বড্ড মনখারাপ লাগছে আজ। কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এখন যা অনুরোধ করবে নির্দ্বিধায় করে ফেলো।
— মনে আছে সেই খেলাটা যেটা প্রত্যেকবার বেড়াতে যাওয়ার গন্তব্য ঠিক করার জন্যে খেলতাম আমরা?
— হ্যাঁ। চোখ বন্ধ করে যে ছবি প্রথম দেখব সেখানেই বেড়াতে যাওয়া হবে।
— লাস্ট বার আমাদের প্ল্যান ছিল, কেরালা ব্যাক ওয়াটার্সে বেড়াতে যাব। বোটের মধ্যে একটা রাত্রি কাটাব। সেটা আর পূরণ হয়নি। চলো আমাদের সম্পর্কটাকে সমাপ্ত করার আগে ওখানে ঘুরে আসি একবার।
— সম্পর্ক ভাঙাটাও উদযাপন করতে চাও?
— না। একটা সেকেন্ড চান্স পেতাম তাহলে। যদি তোমার মন পরিবর্তন করে তোমায় জিতে নিতে পারি আবার। চোখ বন্ধ করলে যদি আমার মুখ ভেসে ওঠে তোমার মনে। কেবলই মনে হচ্ছে যেন একটা বাক্যের মাঝখানে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল আমাদের গল্প।
সৃজিতা অবাক হয়ে তাকায়। নীলাদ্রির এত ভালোবাসা ভরা এমন ব্যথাতুর গলা শোনেনি কোনদিন। সে বলে চলে,
— ভেঙে ফেলা খুব সহজ সৃ। ধরে রাখা কঠিন। নিজেই ভেঙেছি, নিজেকে শুধরে নিয়ে যদি তোমাকে ধরে রাখতে পারি।
— শুধরে নেওয়ার জন্যে কী কী করবে শুনি।
— প্রথমে বাড়িটা আমাদের জয়েন্ট নামে করে নেব যাতে তুমি বলতে পারো তোমার বাড়ি এটা।
— আমার অফিসিয়ালি না হলেও আমি তো জোর গলায় আমার বাড়িই বলতাম। আবার আমরা অফিসিয়ালি বিবাহিত হয়েও কতকাল আলাদা ঘরে থেকেছি বলো। আসলে মনটাই সব।
— জানো, নিত্য নতুন মেয়েদের নিয়ে আমার মোহাচ্ছন্নতা কেটে গেছে অনেকদিন। কারো সঙ্গে সম্পর্ক কখনো বেশিদিন টেঁকেনি। চোখ বন্ধ করলে শুধু তোমার কথাই মনে হত। এত ঝগড়া লড়াই সত্ত্বেও তুমিই ছিলে আমার নোঙর। প্লীজ বাড়ি ছেড়ে যেও না। আমাকে আর একবার নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দাও।
— আর হয় না। বাড়ি মানে তো চার দেওয়াল নয়। বাড়ি মানে একটা প্রিয় সম্পর্কের সঙ্গে বসবাস। একসঙ্গে থাকার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছি আমি। কেন থাকব এখানে - এই প্রশ্নের একটাও গ্রহণযোগ্য উত্তর খুঁজে পাই না মনের ভেতরে। তোমাকে বলা হয়নি, আমি ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি পরের মাসে। আমার একটা বন্ধু একটা এনজিও চালায় ওখানে। ও চাকরির অফার করেছে। ওখানে গিয়ে যদি ভালো লাগে, ভেবেছি মুভ করে যাব।
— ভবিষ্যৎ নিয়ে কত প্ল্যান করে ফেলেছ। শুধু আমি কোথাও নেই সেই ছবিতে।
— এত ইমোশানাল হয়ে যেও না। অফিসিয়াল সম্পর্ক তো এক্ষুনি চুকেবুকে যাচ্ছে না আমাদের। শুধু দু জায়গায় থাকব দুজনে। আলাদা থাকলে অন্তর্দর্শন করার সুযোগ পাব। যোগাযোগ তো থাকবেই।
— তোমার নতুন ঠিকানায় দেখা করতে যেতে পারব আমি?
— নিশ্চয়।
— আর যদি তোমাকে আমার প্রেমে পড়াতে পারি আর একবার?
— তাহলে কেরালা ব্যাকওয়াটার্সে যাব সেকেন্ড হানিমুনে, রাত কাটাব হাউসবোটে।
— চুক্তি রইল তাহলে।