মুখ্যমন্ত্রীভবনের বিরাট উঠোনটায় হরি একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। নানা সমস্যায় ঝাঁঝরাপোড়া গাদাগাদা লোক … যেন ভগবানের সভায় অপেক্ষা করছে। সর্বাঙ্গে, সর্বাংশে এরা প্রার্থী, প্রত্যাশায় উদ্বিগ্ন। কষ্ট-ভরপুর আবেদনপত্র হাতে, চওড়া রাস্তার দুধারে দড়ি আর পুলিশকর্মীদের বেষ্টনী ঘেঁষে, অগণন নারীপুরুষ প্রধান বাড়িটার দিকে চেয়ে আছে--- শেষ আশা যে ওটাই।
“ও সেপাইদাদা, মুখ্যমন্ত্রীসাহেব জনতাদরবারে আজ আসবেন তো?”--- নিজের ঘোলাটে চশমা আর ফোকলা মুখ মুছতে মুছতে ঝঙ্গুবুড়ো জানতে চায়।
“আমি কি জানি!”- রোদে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা হাবিলদারটি ঝাঁঝালো গলায় বলে। ... বস্তুত এদেশে নিরীহতম কর্মী পুলিশের এই হাবিলদাররাই; সামান্য কিছু বেতনের বিনিময়ে যে কোনো পরিস্থিতি, তা মহামারী হোক বা মৃত্যু, সামাল দিতে যারা সদাপ্রস্তুত।
সে যাক গে, তিনদিন ধরে হরি এই জনতাদরবারে আসছে; কিন্তু ভাগ্যদেবী হয় তার ওপর রাগ করেছেন কিংবা ভুলে গেছেন, নাহলে এ’কদিনে দরবারের জন্য সাহেবের একটু সময় হল না? ঘন্টার পর ঘন্টা তেতেপুড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে শেষে অসুস্থ দিদিকে নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে ওকে ।
গামছায় মুখ মুছে দিদির দিকে তাকাল হরি, অগুন্তি তালিমারা ছাতার অল্প ছায়ায় আধঘুমন্ত, ব্যথাকাতর।
“দিদি জল খাবে?”
তোবড়ানো নোংরা প্লাস্টিকবোতলের বেশ উষ্ণ জলই ওর মুখে ঢেলে দেয় হরি। “বাবা, এ তোমার কে?” ছেঁড়া ময়লা ধুতির আঁচল দিয়ে নিজের মাথাটা ঢাকতে ঢাকতে সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
“আমার দিদি।”
“অসুস্থ নাকি?”
“খুবই! সেইজন্যই তো সাহায্যের আশায় এখানে এসেছি। এখান থেকে পাঁচশো কিলোমিটার দূরে আমাদের গাঁ।”
“অনেক দূর থেকে এসেছো বাবা! ... আমার বাড়িও কাছে নয়। রেলকামরার দরজার কোনায় দুদিন ধরে একঠায় বসে এলাম। একাই। খেতেও পাইনি দুদিন কিছু!”
“আমার কাছে ছাতু আছে। এসো খেয়ে নাও। সকাল থেকে আমিও না-খাওয়া।”
ছাতু খেতে খেতে বৃদ্ধা নিজের দুঃখকষ্ট ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে লাগল।
“ছেলে-বউ খেতে দেয় না। মেরেধরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। নিরাশ্রয় বিধবার পেনশনটাও পঞ্চায়েত থেকে পাচ্ছি না। ঘুষ চাইছে তারা। গরীব মানুষ, ঘুষ কোথা থেকে দেব? এখন আর পরিশ্রম করতে পারি না। খিদেও সহ্য হয় না। শুধু যতক্ষণ প্রাণটুকু আছে পথে পথে ঘুরে মরছি, আর কি।”
“আমারও খুব হয়রানি যাচ্ছে গো মাসি! দিদিটার ভীষণ অসুখ। সারতে অনেক টাকা লাগবে। সরকারি সাহায্য পাওয়া গেলে ওর প্রাণটা বাঁচে ! সংসারে নিজের বলার মতো দিদি ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই।”
সম্পূর্ণ অপরিচিত দুটি মানুষ পরস্পরকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। সাধারণ জনগণ এমন সহজ-সরলই হয়। দেখানোপনা, লুকোচুরি এসব তো বড়লোকি কায়দাবাজি।
হঠাৎই ভবনের বাইরে ভিড়টা বেশ অস্থির হয়ে উঠল। জনতাদরবারে উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানোর জন্য শয়ে শয়ে মানুষ, এদের সামলাতে ব্যস্ত দক্ষ সুরক্ষাকর্মীর দল।
পথের ধারে অপেক্ষারত লোকগুলোর প্রার্থনাপত্র নিলেন, দু-এক মিনিট দাঁড়িয়ে তাদের কাকুতিমিনতি শুনে, চিঠিটা আধিকারিকদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আবার পরের জনের দিকে এগিয়ে চললেন রাজ্যনেতা।
বেশ লম্বা ছিল লাইনটা। পৌনে এক ঘন্টার ব্যাকুল অপেক্ষার পর দেবদূতকে নিজের সামনে পেল হরি। পলকা দড়িদড়া আর সুরক্ষাকর্মীদের ঘেরাটোপ ভেঙে নিজের অজান্তেই মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে গড়িয়ে পড়ে সে। ইশারায় তাদের না বাধা দিলে পুলিশরা তাকে টেনে-হিঁচড়েই সরিয়ে দিত।
“কেঁদো না ভাই। সমস্যাটা কী, বলো?”
একটু ঝুঁকে তার কাঁধে হাত রাখেন মন্ত্রী। কাঁপা হাতে নিজের আবেদনপত্র এগিয়ে দিয়ে হাত জুড়ে অশ্রুসজল চোখে তাকে দেখতে থাকে হরি।
“আচ্ছা, তোমার দিদি খুবই অসুস্থ, তার চিকিৎসার জন্য সরকারি সাহায্যের দরকার।” – সান্ত্বনা দিতে হরির কাঁধে আঙুল ছোঁয়ান তিনি; সাংবাদিকরা ঝটপট সেই ছবি তুলে নিল।
“তুমি ভেব না। নিশ্চয়ই তোমার দিদির চিকিৎসা হবে, সরকার পুরো খরচ দেবে।”
সি. এম. সাহেব আবেদনপত্রে কী লিখে সচিবকে দিয়ে বললেন, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রার্থীর আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করুন।”
দ্রুত সাহায্যের আশায় প্রতিদিন মুখ্যমন্ত্রীভবনে আধিকারিকদের কাছে মিনতি করতে থাকে হরি, ওর দিদি তখন রাজধানীর এক সরকারি হাসপাতালে জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি। অসুস্থ দিদিকে ভরসা জোগায় সে, বলে, “আমার কী বুদ্ধি দেখ দিদি! মুখ্যমন্ত্রীসাহেবের দপ্তরে আমি এই হাসপাতালের ঠিকানাই দিয়ে এসেছি। সরকারি টাকা সোজা তোমার এই খাটের ওপর এসে পড়বে। ব্যস দু-চার দিনের মধ্যেই ওটা আসছে, তোমার অপারেশনও তখন হয়ে যাবে। তারপর তরতাজা হয়ে আবার আগের মতোই তুমি আমায় খুব ধমকাবে, বলবে আরে হাঁদা, কতদিন আর মুটেগিরি করে দিন চালাবি! নিজস্ব কাজকম্ম কিছু কর যাতে তোর বিয়েটা দিতে পারি। বউ এলে তোর জন্য গাদা গাদা রুটি করা থেকে আমি ছুটি পাই।” এমন নাটুকে ভঙ্গিতে সে এই কথাগুলো বলে যে দিদির অসুখে শুকিয়ে যাওয়া মুখটাতেও আবছা একটু খুশি ফুটে উঠত।
দশটা দিন কেটে গেল। তারপর একদিন দুপুরবেলা সরকারি চিঠিতে হরি জানল, মুখ্যমন্ত্রী তার বোনের চিকিৎসার জন্য স্বেচ্ছানুদান তহবিল থেকে যে পঞ্চাশ হাজার টাকা মঞ্জুর করেছেন, খুব তাড়াতাড়িই সেটা ও পেয়ে যাবে।
ভরসাহারা হরি আর প্রতি মুহূর্তে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া তার দিদি---দুজনের কাছেই এই চিঠি যেন মৃতসঞ্জীবনী। পুরো ওয়ার্ডে সেটা দেখানো হলে, দু টাকার ছোলা-এলাচদানা দিয়ে হাসপাতালেরই রাম-জানকীর মন্দিরে পুজো দিল গরীব ছেলেটা।
আরও পনেরোটা দিন গেল। সরকারি সাহায্যের আশায় রোজই তিন কিলোমিটার হেঁটে হরি মুখ্যমন্ত্রীভবনে যায়, আধিকারিকদের কাছে খুব কাকুতিমিনতি করে।
গাঁয়ের যেখান থেকে সম্ভব, যার থেকে পারে, ধার করে যে টাকাপয়সা এনেছিল এতদিনে তা সব ফুরিয়ে গেছে। এখন ও টাকার চিন্তায় পাগল। নিজের ঝুপড়ি আর টুকিটাকি ঘরোয়া জিনিসপত্রের কথা তন্নতন্ন করে ভেবেও এমন কোনো কিছুর কথা মনে পড়ল না যা বিক্রি করে আরও কিছু টাকার বন্দোবস্ত করা যায়; তাছাড়া পাঁচশো কিলোমিটার দূরের গাঁয়ে যেতেও তো পয়সা লাগবে! পকেটে কানাকড়িও নেই; কালই দিদির জন্য ওষুধ না কিনলে বড় ডাক্তারবাবু আবার রাগারাগি করবেন।
দুর্গন্ধময় গিজগিজে ভিড়ের জেনারেল ওয়ার্ডে, দিদির বিছানার কাছে, অপরিষ্কার মেঝেতে ছেঁড়া ময়লা চাদরে শুয়ে, হরির আর ঘুম আসে না। পুটঁলিটা খুলে দেখল, যদিও জানে, কাল রাতেই আটা শেষ হয়ে গেছে। আজ সারাটা দিন সে অভুক্ত। রোজই তো সামনের গমভাঙানির দোকান থেকে আটা এনে, হাসপাতালের সীমানার মধ্যেই ভাঙা ইঁট আর শুকনো কাঠকুটো মিলিয়ে উনুন বানিয়ে, তাতে মোটা মোটা রুটি করে আর হাসপাতালের ট্যাঙ্কের জল খায়। দিদির খাবারও এখান থেকেই দেয়; কিন্তু হরির আজ পাইপয়সা শেষ। পুঁটলিতে অবশিষ্ট আটাটুকু দিয়ে যে তিনটে রুটি হয়েছে তার সবটাই দিদিকে খাইয়ে এখন রাতে খিদেতে তার নাড়ী জ্বলছে।
হরি উঠে বসে। সামনের হলদে দেওয়ালে টাঙানো পুরোনো ঘড়িতে রাত দুটো। বোতলের পুরো জল আগেই খেয়ে শেষ করেছে। এখন কী করবে? তার বোনের চিকিৎসার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার সরকারি অনুদান খুব তাড়াতাড়িই দেওয়া হবে, লেখা চিঠিটা সে পুঁটলি খুলে বের করল। আগেও সাতবার এটা পড়েছে; এখনও একবার দেখে নিজেকে ভরসা দিতে দিতে শেষে ঘুমিয়ে পড়ে।
বেশ ভোরেই জেগে উঠল হরি। এখন শুধু ঘুমোলেই দিদি একটু আরাম পায়। মরিয়মের মতো পবিত্র, শয্যাশায়ী দিদির দিকে সে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। একাধারে বাপ-মা হয়ে যে তাকে বড় করে তুলেছে, সেই দিদির আজ ওষুধের দরকার। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ে সে, সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামলে মাটি ধুলো ঘামে মাখামাখি হয়ে ফিরে আসে। তাকেই দেখেই নার্স চেঁচিয়ে উঠল, “অ্যাই, তুই আজ সারাটা দিন কোথায় ছিলি? এখানে কি আমাদের ভরসায় পেশেন্টকে ফেলে রেখে গিয়েছিস? এর আছে না খাবার, না ওষুধ। সারাদিন কেঁদেছে বেচারি। ওকে মেরে ফেলতে চাইলে, নিয়ে যা এখান থেকে। অসুস্থ অভুক্ত এক মেয়েছেলের মরার দায়-দোষ আমাদের ওপর চাপাচ্ছিস কেন?”
“কাল থেকে একটা টাকাও নেই সিস্টারদিদি; তাই মজুরি খাটতে বেরিয়েছিলাম। এই দেখুন একশো টাকা আয়ও করেছি। এক্ষুনি দিদির জন্য ওষুধ আর খাবার নিয়ে আসছি।”- স্বস্তিতে জামার ময়লা আস্তিনে মুখের ঘাম মুছে সে এগোতে যায়।
“এই শোন!”- নার্সের গলায় তিক্ততা --- “বড় ডাক্তারবাবু খুব রাগ করছিলেন। আর যদি এভাবে পেশেন্ট ফেলে সারাদিন তুই পালিয়ে বেড়াস তবে ওকেই হাসপাতাল থেকে বের করে দেব।”
“ঠিক আছে সিস্টারদিদি, কাল থেকে আমি আর বাইরে কাজে যাব না।” একথা বললেও পরদিনই আবার হরির হাত পুরো খালি। দিদির বিছানার শেষ ধারে বসে ঝাড়ুদার ওয়ার্ডবয়টিকে উদাসভাবে দেখে ও। আসলে তার খিদে পেয়েছে খুব।
“দাদা, একটু শুনুন”- বেশ ভয়ে ভয়ে ওয়ার্ডবয়ের কাছে যায় হরি।
“কি ব্যাপার রে?”
“দিন দাদা, আমি ঝাঁট দিয়ে দিচ্ছি।”
“অ্যাই, তুই কেন ঝাঁট দিবি? আমার কাজ,আমিই করে নেব। যা ভাগ এখান থেকে!”
“দাদা আমি খুব ভালো করে ঝাঁট দিয়ে দেব, ঝকঝক করবে সব। বদলে আপনি আমায় পাঁচটা টাকা দেবেন। আচ্ছা, চার টাকা দিলেও হবে।”
একমুহূর্তের জন্য তার প্রত্যাশী মুখের দিকে তাকিয়ে ঝাঁটাটা ধরিয়ে দেয় ওয়ার্ডবয়। খুব সুন্দরভাবে পুরো ওয়ার্ডটা পরিষ্কার করে হরি পাঁচটাকা পেল। তা দিয়ে দুকাপ চা কেনে---দিদির আর নিজের জন্য। আজ দুদিন পর সে চা খাচ্ছে। সত্যনারায়ণ পাঁচালি শেষে প্রসাদ নিয়ে মানুষ যে শান্তি পায়, ঠিক সেই তৃপ্তির আমেজ এখন তার মুখে ফুটে উঠছে।
“অ্যাই শোন!”- ওয়ার্ডবয়টি ডাকে।
“হ্যাঁ, দাদা।” হরি ক্ষুধার্ত শিশুর মতো চঞ্চল --- “তোর কাছে কি একদম টাকাপয়সা নেই?”
“না দাদা, তাই তো কাল কাজে বেরিয়েছিলাম; কিন্তু নার্সদিদি বলেছে আমি সারাদিন আর বাইরে থাকলে দিদিকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেবে।”
“ওই ছিনালটা তো ওরকমই; ডাক্তারবাবুর পোষা মাগী! গরীব লোকের খিদে-কষ্ট এসব ও বোঝে না; তবে আমি তোকে সাহায্য করতে পারি। তোর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হতে পারে।”
“বড় উপকার করলেন আপনি।”
“উপকার-টুপকার কিছু না। তবে ডাক্তারদের চোখ এড়িয়ে তোকেও পুরো এক হপ্তা হাসপাতালের কাজ করতে হবে। আর এই ডাক্তাররাও ... নিজেরা তো সরকারি ওষুধ চুরি করে বিক্রি করে, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে, ওষুধের বেচুবাবুদের থেকে কমিশন খায়। উলটে নিয়মের ছুতোনাতায় আমাদের মতো গরীব কর্মচারীদের গালিগালাজ করে।”
“দাদা, খাবার ব্যাপারে কিছু বলছিলেন।”
“হ্যাঁ, হাসপাতালের বাইরে রাস্তার ডান মোড় থেকে সোজা গিয়ে বাঁদিকে ঘুরলেই একটা দাতব্য সোসাইটি আছে, দুপুর আর রাতে গরীবরা ওখানে বিনা পয়সায় খেতে পায়। সেখান থেকে তুই খাবার নিয়ে আসিস। কিছুটা নিজে খেয়ে বাকি দিদিকে দিস।”
“সারা জীবন আপনার মঙ্গল কামনা করব দাদা। বিপদের সময় দেবতা হয়ে আপনি এই গরীবকে বাঁচালেন।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে ; তুই কিন্তু হাসপাতালের কাজের ব্যাপারটা ভুলে যাস না।”
অভাবী, গরীব, ভিখারিদের সঙ্গে এখন হরিও সকাল-সন্ধ্যে দাতব্যসংস্থার বাইরে দেড়-দু ঘন্টা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, খাবারও পায়। নোনতা জলের মতো ডাল, চামড়ার মতো রুটি আর কাঁকর মেশানো মোটা চালের ভাত, তাও আবার শুধু একজনেরই পেট ভরার মতো। অর্ধেক খাবার সে ওখানেই খেয়ে ফেলে, বাকিটা নিয়ে আসে দিদির জন্য।
যেমন তেমন করে পেটেরটুকু তো জুটে যেত কিন্তু দিদির ওষুধ? মেয়েটার গায়ে শেষ যে দু-একটা রূপোর গয়না ছিল সেগুলোও বেচতে হয়েছে; যাক, কয়েকদিনের ওষুধের ব্যবস্থা তো হল!
দুবেলা খাবারের জন্য হরি লাইন দেয়। প্রতিদিন দুপুরে মুখ্যমন্ত্রীভবনের কর্তাদের কাছে তাড়াতাড়ি টাকা পাওয়ার জন্য কাতরতা জানায় আর অসহ্য ব্যথায় দিদি যখন কোঁকাতে থাকে, পুঁটলি খুলে মন্ত্রীর পাঠানো চিঠি বের করে জোরে জোরে তাকে পড়ে শোনায়। ভাই-বোন দুজনেরই ভরসা ছিল যে চিঠি এসেছে মানে সরকারি সাহায্যও দ্রুত এসে পড়বে।
বারোদিন আরও কাটল। বিক্রি করার মতো কিচ্ছুটি আর নেই। দুদিন ধরে ওষুধের অভাবে হরির দিদি কাতরাচ্ছে। হয় ওষুধ আনো, নয়তো রোগীকে এখান থেকে নিয়ে যাও --- একথা ডাক্তারবাবু অনেকবারই বলেছেন।
শূন্য হতাশ মনে হাসপাতালের বাইরে বসে হরি চৌরাস্তার কাঁইকিচির দেখছিল। সেদিন রমজান। রাস্তার একধারে তাঁবু পেতে রোজা-ইফতারের খাওয়াদাওয়া চলছে। অনেকদিন ওর ভরপেট খাওয়া জোটেনি। ভালো খাবারের স্বাদ যে কেমন সেটা ভুলতেই বসেছে। ... সারাক্ষণ মাথার মধ্যে তাই শুধুই খিদে।
সাহস করে তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নোংরা ভিখারিদের দলে মিশে যায় হরি। মজুর থেকে ভিক্ষুক হয়ে যাওয়ার বেদনা সে খাবারের সুতীব্র লোভনীয় সুগন্ধে চেপে রাখতে চাইছিল ... ভুলে যেতে চাইছিল!
একটু ভাজাভুজি আর তিনটে কলা পেল দাতব্যে; অনেকদিন পর মুখরোচক কিছু হাতে এল হরির। রাস্তার ধারে উবু হয়ে বসে ও খেতে শুরু করে। অনুতাপে দুঃখে মনটা তার ভারাক্রান্ত। কাঁদছে সে। পকেটে থাকা মুখ্যমন্ত্রীর চিঠিটা আবার পড়ে নিয়ে অবশিষ্ট একমুঠো ভাজা আর কলাদুটো গামছায় বেঁধে হাসপাতালে ফিরে এল।
দিদিকে গভীরভাবে ঘুমোতে দেখে হরির বেশ ভালো লাগে। গত দুদিন ধরে ওষুধের অভাবে দিদিটা সবসময় কাতরাচ্ছে। বোধহয় এখন একটু আরাম পেয়েছে। গামছাটা ওর শিয়রে রাখল হরি। ঘুম ভাঙলে বলবে যে দিদির জন্য ভাজা আর কলা কিনে এনেছে।
দিদির পায়ের কাছে বসে পকেট থেকে মুখ্যমন্ত্রীর চিঠিটা বের করে হরি আবার পড়তে থাকে। ভিখারি হয়ে যাওয়া মজুরটার আজ খুব মনখারাপ; কতদিন ধরে এখানে পড়ে আছে! কবে সরকারি সাহায্য আসবে? দিদির অপারেশন কবে হবে? কবে তারা নিজের গাঁয়ে ফিরতে পারবে?
অনেকক্ষণ উদাস হয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে হরি। হঠাৎ তার মনে পড়ল দিদি বেশ লম্বা সময় ধরে ঘুমাচ্ছে, কিন্তু ওর তো খিদেও পেয়েছে।
“দিদি ওঠো, একটু কিছু খেয়ে নাও তারপর আবার ঘুমিও। দেখ, কি এনেছি আমি!...দিদি!!”
তিন-চার বার সে দিদির হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, তাকে ডাকল তারপর বেশ ভালো করে দেখতে লাগল; মন্দিরের প্রতিমার মতো শান্তি ছড়িয়ে আছে দিদির মুখটাতে। তিলে তিলে ক্ষইতে থাকা শরীরের প্রচণ্ড কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে যেন স্বাধীন অপ্সরা হয়ে গেছে সে।
চরম ক্ষতির আশঙ্কায় প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে হরি ঝাঁকাতে শুরু করে দিদিকে।
তখনই বড় ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দু-তিনজন আধিকারিক সেখানে এলেন।
“তোমারই নাম হরিপ্রসাদ? বোনের চিকিৎসার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে তুমি আবেদন করেছিলে?”
... কিন্তু এ তো হরি নয়, যেন একচাঁই পাথর।
ডাক্তার এগিয়ে এসে রোগীর নাড়ি দেখলেন।
“শী ইজ নো মোর”--আধিকারিকদের বললেন ডাক্তারবাবু।
“কী??”- সাধারণ লোকের মতো এক মুহূর্তের জন্য তারা চমকে গেলেন, পরক্ষণেই অবশ্য সামলে নিয়ে সরকারি কর্মচারী হয়ে জানালেন,
“ওঃ! তাহলে এর চিকিৎসার জন্য সরকারি সাহায্যের চেকটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”