• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | গল্প
    Share
  • গৃহে কর্মে : সাত্যকি সেনশর্মা



    কোম্পানিটা ভালই। দেখতে দেখতে এখানে বছর দুয়েক কেটে গেল। বিগত পাঁচ বছর ধরে এই তথ্যপ্রযুক্তির কাজই করছে স্বর্ণাভ। কর্মক্ষেত্রের রোমাঞ্চটা ক্রমশ কমে আসছে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়া বিকেলের মতন। প্রথম ভোরের আলো দেখার যে উত্তেজনা থাকে, সারাদিন আলো আর রোদ্দুরের প্রাচুর্যে থাকার ফলে বিকেলে সেই উত্তেজনা আর থাকে না। যা জানা হয়ে গিয়েছে, যা বোঝার আর কোনো বাকি নেই তার আকর্ষণ কমে আসবে এমনটাই প্রত্যাশিত। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে একটা নতুন উত্তেজনা এসে পড়েছে স্বর্ণাভর জীবনে, অথবা কর্মজীবনে। কণিকা বাসু। সুন্দরী নয়, কিন্তু স্বর্ণাভ বুঝতে পারছে সে খানিকটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রভাবিত হয়ে পড়ছে এই সীমিত রূপলাবণ্যে। একই প্রজেক্টে কাজ করে ওরা। কর্মক্ষেত্রে কণিকা স্বর্ণাভর মতই অভিজ্ঞ। হয়ত বয়সটাও একই। বেশ বন্ধুবৎসল। একেবারেই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা নেই। স্বর্ণাভর সঙ্গে বেশ ভালই আলাপ-পরিচয় হয়েছে। একসঙ্গে কাজ করেও বেশ সাফল্য আসছে। শুধু স্বর্ণাভ বুঝতে পারছে তার অন্তরে কোথাও একটা অভূতপূর্ব অনুভূতি কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে মাঝেমাঝেই। এই অনুভূতি স্বর্ণাভর কানের কাছে ফিস্‌ফিস্‌ করে তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কণিকার কাছে। কণিকা হাসছে; হাসছে স্বর্ণাভ। হাসিতে হাসিতে গড়িয়ে যাচ্ছে সময়।


    এক বছর ধরে গড়াতে গড়াতে সময় এখন এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে স্বর্ণাভ নিজেকে আর চিনতে পারছে না আগের মতন করে। পাল্টে গিয়েছে সবকিছু। আজকাল স্বর্ণাভ আগের মত বেলা এগারোটার বদলে সকাল আটটায় অফিসে ঢুকছে। কণিকাও ওইরকম সময়ই আসে অফিসে। আরো বেশি সময় কণিকার সঙ্গে কথা বলা যায়। সময়টা খুব অল্প। মাত্র আট-দশ ঘন্টা দেখা হয় কণিকার সঙ্গে। হৃদয়ে পাহাড়প্রমাণ অপ্রকাশিত আবেগ আর অব্যক্ত কথা নিয়ে সন্ধ্যে ছ’টায় বাড়ির পথে রওনা দেয় স্বর্ণাভ। অফিস থেকে বেরোনর সময় তার মুখ দেখেই যে কেউ সহজেই অনুমান করতে পারবে যে তার বাড়ি ফেরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। যে কেউ যা অনুমান করতে পারে তা কণিকার পক্ষে বুঝে নেওয়াটা দুরূহ না হওয়ারই কথা। আজ শুক্রবার। এখন রাত পৌনে আটটা। ফ্লোরে আশেপাশে কেউ নেই। প্রায় সকলেই কাজ শেষ করে বেরিয়ে গিয়েছে।

    “কি? বাড়ি যাবে না?” স্বর্ণাভর দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞাসা করল কণিকা।

    “হ্যাঁ,” স্বর্ণাভ বলল।

    “তাহলে যাও!”

    “হ্যাঁ, এই যাচ্ছি… তুমি কখন বেরোবে?”

    “দেখি… ঠিক নেই এখনও।”

    “ও… কিন্তু আজ তো কাজ তেমন নেই কিছু!”

    “আমার কাজের তুমি কী জানো?”

    “মানে?”

    “কিছু না। ভাবছি শুধু…” কণিকা স্বর্ণাভর দিকে তাকিয়ে চোখ পিট্‌পিট্‌ করল।

    স্বর্ণাভ হঠাৎ একটু লজ্জা পেয়ে গেল। একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল মনে মনে। কণিকা কি সব বোঝে আসলে? সে বলল “কী ভাবছ?”

    “বলো তো?” কণিকা উল্টে জিজ্ঞাসা করল।

    “বা! আমি কী জানি!”

    “ভীতুরাম তুমি আসলে!”, কণিকা হঠাৎ বেশ জোরে হেসে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিল দ্রুত পায়ে। মুহূর্তের মধ্যে স্বর্ণাভর মাথায় একটা আবেগ বিদ্যুতের মত ঝলসে উঠল। ক্ষিপ্রগতিতে কণিকাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল সে। কণিকা যে মুহূর্তে দরজা দিয়ে বেরোতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে স্বর্ণাভ কণিকার বাঁ হাতের কবজি চেপে ধরল। কণিকাও চমকে উঠে অবাক হয়ে তাকাল স্বর্ণাভর দিকে।

    “আমি ভীতুরাম নই কণিকা। তুমি যদি কিছু ভেবে থাক তাহলে ঠিকই ভেবেছ…” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল স্বর্ণাভ।

    এরপর কেটে গেল আরো ক'দিন। বাড়িতে থাকতে স্বর্ণাভর দমবন্ধ লাগে। একটা অসহ্য অস্বস্তি তাকে সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। কণিকাকে চোখের সামনে দেখতে না পাওয়ার অস্বস্তি। যতক্ষণ অফিসে থাকে ততক্ষণ শুধু একটা অদ্ভুত শান্তি, একটা মনোরম আবেশ। কিন্তু দিনের বাকি সময়টা যেন একটা কারাবাস, একটা অনিবার্য অথচ অবুঝ প্রতীক্ষা।


    একমাস আগে বিয়ে হয়েছে স্বর্ণাভ আর কণিকার। একটা আজীবন মনে রাখার মত অভিজ্ঞতা। যেমন সকলেরই হয়। রাজারহাটের ফ্ল্যাটে নতুন সংসার। স্বপ্নের মতন। সবকিছুই বর্ণময় আর সুন্দর। স্বর্ণাভর সবথেকে আনন্দের বিষয় – সেই অসহ্য অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। আর কারাবাস নেই। সেই অবুঝ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে অবশেষে। রোজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠে কণিকার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যায় স্বর্ণাভ। তারপর একসাথে বসে প্রাতরাশ এবং নিজেদের গাড়িতে চেপে অফিসের পথে। একসাথে কাজ সারাদিন ধরে। একসাথে দুপুরের খাওয়া। সন্ধ্যায় বা রাতে একসাথে বাড়ি ফিরে যাওয়া। বাড়িতে একসাথে রাতের খাবার খাওয়া এবং পারস্পরিক ভালবাসার স্পর্শে একসাথে ভেসে যাওয়া ঘুমের দেশে। এ এক মধুময় দাম্পত্য। স্বর্ণাভ আর কণিকার জীবনদুটি জুড়ে গিয়েছে অবিচ্ছেদ্যভাবে। জীবনের প্রাত্যহিক মুহূর্তগুলি একাকার হয়ে গিয়ে যেন গ্রন্থিত হয়েছে এক নিরবচ্ছিন্ন প্রেমমাল্য। এমনই চলুক জীবন, এমনই একসাথে।


    খুব তাড়াতাড়ি কেটে গিয়েছে একটা বছর। আজও জীবন এগিয়ে চলেছে একইভাবে, একই সাথে। আজকাল স্বর্ণাভর মনোজগতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আজকাল আর ঘুম থেকে উঠে কণিকার সেই একই মুখশ্রী দেখে তার আর আগের মতন রোমাঞ্চ হয় না। কোনো নতুনের ছোঁয়া নেই তাতে। তারপর সেই একই মানুষের সঙ্গে একসাথে বসে প্রাতরাশ এবং অফিসে যাওয়া। অফিসের কাজ, দুপুরের খাওয়া, রাতের খাওয়া আর পরিশেষে সেই একই ভালবাসার চেনা স্পর্শে ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া। সমস্তটাই যেন একই ছকে বাঁধা একটা গান, যে গান প্রত্যেকদিন বাজছে স্বর্ণাভর জীবনে। এমন একটা গান যে গানের স্বরলিপির আগাগোড়াটাই স্বর্ণাভর চেনা; কোনো নতুনের স্পর্শ নেই, কোনো রোমাঞ্চ নেই। অবশ্য স্বর্ণাভ এ’কথা বেশ ভালই বোঝে যে এই পুরো ব্যাপারটাই তাদের বহুপ্রতীক্ষিত দাম্পত্যেরই অঙ্গ। কিন্তু মাঝে মাঝে সে একথাও ভাবে – আগে যেমন কণিকাকে চোখের সামনে না দেখতে পেলে তার দমবন্ধ লাগত, আজকাল আর কেন তেমন লাগে না! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রেম কি তা’হলে কমে যাচ্ছে? কৈশোর থেকেই সে শুনে এসেছে প্রেম হল অনেকটা সাদা জামায় লাগা হলুদের দাগের মতন; একবার লাগলে পুরোটা কখনই ওঠে না। তাহলে নিশ্চয়ই তার প্রেমও এত ঠুন্‌কো নয়। মাঝেমাঝে ভাবে – যে অনুভূতিটাকে সে প্রেম ভেবেছিল সেটা সত্যিই প্রেম ছিল তো? আবার এও ভাবে – সকলেরই হয়ত এমনই হয়, এটাই হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু মন মানতে চায় না সহজে। তার এত সুন্দর সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলো শুধুমাত্র সাময়িক ছিল! আর কোনোদিন সেইসব আবেগ ফিরবে না! এইসব ভাবতে ভাবতে আজকাল মাঝেমাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে স্বর্ণাভ। কণিকাকে স্বর্ণাভ তার এইসব ভাবনা বলেনি কখনও। মনে একঘেয়েমি এসে থাকলেও কণিকাকে ছাড়া যে তার জীবন অসম্পূর্ণ এ’কথা সে অবচেতনে অবশ্যই জানে। হয়ত এই অবচেতনের প্রভাবেই আপাত একঘেয়েমি সত্ত্বেও আজও ওদের দাম্পত্য এগিয়ে চলেছে মসৃণভাবে।


    মানুষের মনের রহস্য সাগরের অন্তঃস্থলের রহস্যের চেয়ে কিছু কম নয়। একসাথে, একইভাবে পা্র হয়ে গিয়েছে আরো একটা বছর। সবকিছুই প্রায় একই আছে। ওদের দৈনন্দিন জীবন, কণিকার ঘুমন্ত মুখ, প্রাতরাশ, অফিসের কাজ, ভালবাসার চেনা স্পর্শ – সবকিছুই আজও আছে অবিচল। শুধু পাল্টেছে স্বর্ণাভ। পাল্টেছে তার ভাললাগা, খারাপলাগার টানাপোড়েন। দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ‘চেনা’গুলো আজকাল স্বর্ণাভকে কেমন যেন গায়ের জোরে জাপটে ধরে। দমবন্ধ লাগে স্বর্ণাভর। সকালে ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলার মুহূর্ত থেকে শুরু করে রাতে শুয়ে চোখ বন্ধ করা পর্যন্ত সর্বত্র তার চোখের সামনে উপস্থিত থাকে কণিকা। বাড়িতে থাকতে স্বর্ণাভর দমবন্ধ লাগে। অফিসে থাকতেও দমবন্ধ লাগে। একটা অসহ্য অস্বস্তি তাকে সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। কণিকাকে সর্বক্ষণ চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার অস্বস্তি। গোটা জীবনটাই যেন একটা কারাবাস। হাঁফিয়ে উঠেছে স্বর্ণাভ। বৈচিত্রময়ী এই পৃথিবীতে সমস্তকিছুই পরিবর্তনশীল; একমাত্র ব্যতিক্রম স্বর্ণাভর এই কণিকাময় দৈনন্দিন যাপন। দুটিমাত্র জায়গায় স্বর্ণাভ স্ব-অস্তিত্বে একা – একটি স্নানঘর, অন্যটি ঘুমের দেশ। স্নানঘরের আয়নার দিকে তাকিয়ে একমনে এ’সব কথাই ভাবছে স্বর্ণাভ। আজ রবিবার। তাই কোনো তাড়া নেই। এইরকম ছুটির দিনে স্বর্ণাভ এইভাবে স্নানঘরে অনেক সময়ই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়, কণিকার অনুপস্থিতিটা উপভোগ করে সে। কিন্তু এই স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। স্নানঘর থেকে বেরোলেই আবার কণিকা।

    স্বর্ণাভর মনে হল এই একঘেয়েমির মূল কারণ হতে পারে তার বৈচিত্রহীন জীবনযাত্রা। এখন অগাস্ট। সাময়িক পরিবর্তন আনার জন্য ডিসেম্বরে গোয়ার টিকিট কাটল সে। কেরালায় মধুচন্দ্রিমার পর থেকে আর কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিকে অনেক কিছুই অন্যরকম লাগে, অনেক অন্ধকার দূর হয়ে যায় সহজেই।


    এই সময়টা গোয়াতে খুব ভিড় হয়। আবহাওয়া বেশ মনোরম। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে হোটেলের পথে যেতে যেতে জানলা দিয়ে বাইরে দেখছে কণিকা। স্বর্ণাভ পাশেই বসে আছে। ফুরফুরে বাতাসে বেশ আরাম লাগছে। স্বর্ণাভর মনে হল এই গাড়ি করে হোটেলে যাওয়া আর কলকাতায় নিজেদের গাড়ি করে অফিসে যাওয়ার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য আছে কি? সহযাত্রী তো সেই একই। সেই পাশে বসা, সেই জানলা দিয়ে বাইরে দেখা।

    “কী ভাবছ এত?” কণিকা জিজ্ঞাসা করল স্বর্ণাভর দিকে তাকিয়ে।

    “অ্যাঁ?” স্বর্ণাভর ভাবনাপ্রবাহ বাধা পেল।

    “বলছি এত কী ভাবছ গম্ভীর হয়ে?”

    “ও… না না, কিছু না। বলো।”

    “আমি কিছু বলছিলাম না… দেখলাম তুমি গম্ভীরভাবে কী যেন ভাবছ তাই জিগেস করলাম…”

    “ও।”

    সারাদিনের বেশিরভাগ সময়টাই সৈকতে বসে বসে কেটে গেল। কখনও কখনও স্বর্ণাভ অফিসে বা বাড়িতে বসে সময় কাটানোর সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য করতে পারছিল না আজকের এই দিনটার। পাশে বসে তো সেই একজনই। পারিপার্শ্বিকের উৎসবমুখরতা কণিকার উপস্থিতিকে খুব একটা ম্লান করতে পারল না। রাতে হোটেলের ঘরে শুয়ে সেই একই চেনা ভালবাসার স্পর্শ। অন্ধকার ঘরে শুয়ে খুব একটা বোঝারও উপায় ছিল না যে ঘরের বাইরেটা গোয়া না কলকাতা! সমস্ত অন্ধকার হয়ত অভিন্ন হয়। কলকাতার অন্ধকারের সঙ্গে স্বর্ণাভ গোয়ার অন্ধকারের কোনো তফাৎ খুঁজে পেল না। ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল স্বর্ণাভ। অন্ধকারের গভীর থেকে হঠাৎ প্রতিভাত হয়ে উঠতে লাগল কণিকার সেই পরিচিত হাসিমুখ। একটা, দুটো, তিনটে… আরও অনেক… অজস্র কণিকার মুখ একে একে প্রায় সমস্ত অন্ধকারটাকে ঢেকে দিল। কণিকা হাসছে। নির্মল ওষ্ঠাধর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে কোমল প্রেমজ্যোতি। এই প্রেম শুধুমাত্র স্বর্ণাভরই জন্য। এর থেকে স্বর্ণাভর মুক্তি নেই।

    ভয়ানক অস্বস্তিতে হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল স্বর্ণাভ। পাশ থেকে ভেসে এল কণিকার কণ্ঠস্বর – “কী হল?”

    “ন্ নাহ্… কিছু না।” স্বর্ণাভ আবার শুয়ে পড়ল।


    গোয়া থেকে ফিরে এসেও একইরকমভাবে চলতে লাগল জীবনতরী। গোয়ায় গিয়ে হাওয়াবদল হল ঠিকই, কিন্তু মনবদল হল না। স্বর্ণাভ আজ ছুটি নিয়েছে। কণিকা একাই চলে গিয়েছে অফিসে। স্বর্ণাভ যাচ্ছে না শুনে সে প্রথমে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল – “শরীর খারাপ?” স্বর্ণাভ বলেছিল – “না না এমনি, জাস্ট ফর আ চেঞ্জ।” কণিকা বলেছিল – “এমা! তাহলে আমিও ছুটি নিতে পারতাম! কোথাও ঘুরে আসা যেত একটু।” স্বর্ণাভ মনে মনে ভেবেছিল এটাই তো সে চায়নি। সে একটু একা থাকতে চেয়েছিল। ঠিক যেমন রোজ একা থাকে স্নানঘরে। নিজের ঘরে একা বসে আছে স্বর্ণাভ। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে। কী শান্তি! রোজ কেন এমনটা হয় না? ম্যাগাজিন থেকে মন সরে এল স্বর্ণাভর। রোজ কেন এমনটা হতে পারে না? বিয়ের আগেও তো এমনটাই হত! তখন সমস্ত দিনটা তো স্বর্ণাভ নিজের সঙ্গেই কাটাত, একা। তখন অবশ্য এটাকেই কারাগার মনে হত। মনে হত কতক্ষণে অফিস যাবে, কতক্ষণে আবার দেখা হবে কণিকার সঙ্গে। অথচ আজকাল আর সেইসব অনুভূতির আঁচও পাওয়া যায় না। সবকিছু আবার আগের মত হয়ে গেলে ভাল হত। স্বর্ণাভ আগের মত থাকত নিজের বাড়িতে। কণিকা থাকত তার বাড়িতে। শুধু অফিসে দেখা হত দু'জনের। আট-দশ ঘন্টার জন্য। বাকি সময়টা বাড়িতে কাটাত যে যার মত। বাড়িতে বসে বসে মনে মনে ভাবত কখন আবার পরের দিন অফিসে যাবে। অপেক্ষার সময়টা হয়ত বাড়িটাকে কারাগার মনে হত আগে মতই, কিন্তু তবুও সেই কারাবাসের অবসান ঘটত নিয়মিত, প্রত্যেকদিন। সেই প্রাত্যহিক কয়েকঘন্টার কারাবাস এখনকার এই নিরন্তর, কণিকাময় বন্দিদশার চেয়ে অনেক শান্তির হত। জীবনের পথে চলতে চলতে কণিকার এতটাই কাছাকাছি এসে পড়েছে স্বর্ণাভ যে সেই সহজ নৈকট্যের প্রকোপে কণিকার প্রতি তার স্বাভাবিক আকর্ষণ ক্রমশ ম্লান হয়ে পড়ছে। স্বর্ণাভ প্রায় নিশ্চিত – এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হল বিয়ের আগের অবস্থায় নিজেদেরকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তা’হলেই সে তার সমস্ত লুপ্ত অনুভূতিগুলো আবার ফিরে পাবে। কিন্তু একটা বড় সমস্যা আছে। এই কাজ তো একা করা সম্ভব নয়, কণিকাকে জানাতে হবে সমস্তটা, তারপর সে রাজি থাকলে তবেই করা যাবে। স্বর্ণাভর মনে হল তার এইসব অনুভূতির কথা কণিকাকে জানালে হয় কণিকা ভাববে স্বর্ণাভ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে অথবা ভাববে স্বর্ণাভ আসলে কোনোদিনই তাকে ভালবাসেনি। কিন্তু স্বর্ণাভ জানে এর কোনোটাই সত্য নয়। কণিকাকে স্বর্ণাভ আজও ততটাই ভালবাসে যতটা সে তাকে বিয়ের আগে ভালবাসত। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে কণিকাকে তার সমস্যার কথা জানালেই সে তাকে ভুল বুঝবে। এমন একটা জটিল চিন্তায় ডুবে গেল স্বর্ণাভ যার কোনো তল পেল না সে। ক্রমশ তার চোখ বুজে এল। হাত থেকে ম্যাগাজিন খসে পড়ল।

    হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে এলেন এক কালো কোট পরিহিতা উকিল, হাতে এক বান্ডিল কাগজ। স্বর্ণাভর দিকে এগিয়ে এসে চোখ পিট্‌পিট্‌ করে বললেন –

    “এই যে আপনি… কোন গ্রাউন্ডে বলেছেন আপনি কণিকার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাবেন না?”

    “আমার ইচ্ছা নেই তাই বলেছি… কেন সেটা কি বেআইনি নাকি?” স্বর্ণাভ বলল।

    “অবশ্যই… আপনি আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে সিনেমায় যেতে বাধ্য।”

    “বটে! এ'সব আইন কি আপনার নিজের লেখা মশাই?”

    “দেখুন, আপনার সঙ্গে আমার কোনো পার্সোনাল ক্ল্যাশ নেই, তাই আমাকে আপনি ব্যক্তিগত আক্রমণ না করলেই ভাল করবেন।”

    “বেশ… কিন্তু আমি সিনেমায় যাব না… কিছুতেই যাব না।”

    স্বর্ণাভ এই কথা বলামাত্র উকিল হঠাৎ বেজায় রেগে গিয়ে বললেন – “কী! এত সাহস! দাঁড়ান আপনি যাবেন না আপনার ঘাড় যাবে!” তারপর উকিল সোজা এগিয়ে এসে ক্ষিপ্রগতিতে স্বর্ণাভর চুলের মুঠি ধরে এক ভয়ানক ঝাঁকুনি দিলেন।

    চোখ খুলে স্বর্ণাভ দেখল সেই একই পরিচিত হাসিমুখ নিয়ে তার মাথার চুল ধরে ঝাঁকাচ্ছে কণিকা, বলছে – “পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ! চলো, বেড়াতে চলো।” স্বর্ণাভ কণিকাকে দেখে অবাক হল, বলল “তুমি, এখনই?”

    “হে-হে… কেমন সারপ্রাইস দিলাম বলো? হাফ-ডে নিয়ে চলে এলাম, কাজ তেমন ছিল না তো আজ।” কণিকা বলল।

    “ও,” স্বর্ণাভর মনের ভিতরটা অনেকটা চায়ে ভেজানো বিস্কুটের মত নিজেকে অটুট রাখার চেষ্টা করল।

    “একটু তাড়াতাড়ি করবে? ছ'টার শো, টিকিট কেটে নিয়েছি অনলাইনে…” কণিকা উৎসাহ নিয়ে বলল।

    “টিকিটও কেটে ফেলেছ!”

    “কেন? ভাল করিনি? তোমার অন্য কোনো প্ল্যান ছিল নাকি?”

    “না না… এমনি বললাম।”

    “তাই বলো… তাড়াতাড়ি করো, বুঝলে?”

    স্বর্ণাভ উঠে দাঁড়াল অগত্যা। আবার সেই একই হাসিমুখ, একই হাতের স্পর্শ। কিছুক্ষণের মুক্তির এখানেই ইতি।


    নতুন হিন্দি ছবি। একটু নতুন ধরনের গল্প, এক ঝলক টাটকা বাতাস। সিনেমার পছন্দটা স্বর্ণাভ আর কণিকার বেশ ভালই মেলে। ছবিটা শুরু হওয়ার পর থেকেই বেশ টানটান। স্বর্ণাভ আর কণিকা দু'জনেই বেশ মন দিয়ে দেখছিল। কখন যে অর্ধেকটা সময় কেটে হয়ে গেল ওরা টেরই পায়নি। হঠাৎ ছবি বন্ধ হয়ে পর্দায় ভেসে উঠল বিরতি বার্তা। হলঘরে আলো জ্বলে উঠল। ছবির মধ্যভাগে এই বিরতি কোনোদিনই পছন্দ হয় না স্বর্ণাভর।

    “ধুর্! কেন যে এরা ইন্টারভাল দেয় কে জানে!” বিরক্তি প্রকাশ করল স্বর্ণাভ।

    কণিকা হাসল।

    “হাসির কী হল?”

    “বিয়ের আগে বা পরে যতবার সিনেমা দেখেছি কোনোবার মনে হয় এমন হয়নি যে তুমি এই কথাটা বলোনি।”

    “ও… হ্যাঁ… তুমিও তো প্রত্যেকবারই এ’রকম ফ্যাচ্‌ফ্যাচ্‌ করে হাসো।”

    “হি-হি।”

    “ওই আবার হাসছ…”

    “আচ্ছা হাসব না তো কী করব? তোমার সিনেমার ইন্টারভাল হলে রাগ হয়… কথাটা হাস্যকর নয় কি?”

    “আমার মনে হয় ছবিগুলো কোনো ইন্টারভাল ছাড়াই চালানো উচিত… দেখতে অনেক বেটার লাগবে… ইন্টারভাল দিলে ছন্দটা কেটে যায়।”

    “উফ্… সত্যি! তুমি আর তোমার ছন্দ।”

    “সে যাই বলো… আমি কিছু ভুল কিন্তু বলিনি।”

    “ভুলই বলেছ… এখন তুমি বলছ তো একটানা দেখালে ভাল হত… যদি সত্যিই একটানা দেখাতো, তখন দেখতে তুমিও বোর হয়ে যেতে, তখন মনে হত একটা ইন্টারভাল দিলে ভাল হত।”

    “কক্ষনো না। আমি সবসময়ই একটানা সিনেমা দেখতে পছন্দ করি। বিশেষ করে যদি এ’রকম ভাল সিনেমা হয় তাহলে তো ওই ইন্টারভাল দিয়ে দেখার থেকে একেবারে না দেখা বেটার।”

    “সে আবার কী অদ্ভুত কথা! ইন্টারভালের উপর রাগ করে গোটা সিনেমাটাই দেখবে না?”

    “সিনেমার মাঝে বিজ্ঞাপন দিলে যেমন বাজে লাগে, ইন্টারভাল দিলেও তেমনই বাজে লাগে। যদি দিতেই হয় সিনেমার শুরুতে আর শেষে দিতে পারে! মাঝখানে কেন?”

    “কী করে হবে সেটা? তাহলে তো ইন্টারভাল কথাটারই কোনো মানে থাকবে না!”

    “না থাকুক, কিন্তু সিনেমাটা তো পুরোটা দেখা যাবে, উইদাউট ব্রেক…”

    “উইদাউট ব্রেক হবে ঠিকই কিন্তু তুমি ভুল করছ… একটা ব্রেক কিন্তু সবসময় দরকার, ইন ফ্যাক্ট বেশি লম্বা সিনেমা হলে কিন্তু আগেকার দিনে অনেক সময়ই দুটো ইন্টারভাল দিত বলে শুনেছি।”

    “যত্তসব…”

    “শুধু সিনেমা কেন… যে কোনো ক্ষেত্রে দেখো… ধর স্কুল বা স্কুলের পরীক্ষা… সেখানেও কিন্তু ব্রেক দেওয়া হয়, নইলে সেকেন্ড হাফটা টানা যায় না… বোর হয়ে যাবে তো একজন।”

    স্বর্ণাভ আর কিছু বলল না। হলঘর আবার অন্ধকার হল। ছবির দ্বিতীয়ভাগ শুরু হল।


    আজ হঠাৎ স্বর্ণাভ একটু বেশি সাজগোজ করেছে। সকাল হতেই সে কণিকাকে বলল – “আজ তুমি তোমার টাইমমত অফিসে চলে যাও… আমার একটু দেরি হবে।”

    “কোথায় যাবে?” কণিকা জিজ্ঞসা করল অভ্যাসমত।

    “আমার কলেজের একটা বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে, সিয়াটেলে থাকে, কলকাতায় এসেছে ছুটিতে।”

    “এই সকালে! অফিসের সময়!”

    “ওর আর কী… ও তো ছুটিতেই আছে, আমারই একটু অড্ টাইম হল।”

    “আমার সঙ্গে আলাপও হবে না... কোথায় কাজ করে?”

    “সিয়াটেলের কী একটা কোম্পানিতে আছে… নামটা মনে নেই।”

    “ও কে… যাও দেখা করে এসো… লাঞ্চ কি অফিসে এসে করবে? না বন্ধুর সঙ্গে?”

    “না না… অফিসে ফিরে করব… ওর সঙ্গে শুধু একটু দেখা করেই আমি অফিসে চলে যাব।”

    “ঠিক হ্যায়… চলো… সি ইউ।”

    দিন সাতেক পরে সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বর্ণাভ দেখল সেই চেনা হাসিমুখ নিয়ে ঘুমাচ্ছে কণিকা। আলতো স্পর্শে কণিকার ঘুম ভাঙালো স্বর্ণাভ।

    “ঘুম হল?” জিজ্ঞাসা করল স্বর্ণাভ।

    কণিকা হাসল।

    “তোমাকে একটা কথা বলার আছে…”

    “বাবা… এত আয়োজনের কী আছে? বলে ফেলো।”

    “আমি আর তোমার সঙ্গে…” এই পর্যন্ত বলে কণিকার কপালে তৈরি হওয়া হাল্কা ভ্রূকুটির দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত থামল স্বর্ণাভ। তারপর আবার বলতে শুরু করল –

    “আমি আর তোমার সঙ্গে অফিসে যাব না।”

    “কী?”

    “আর দু’মাস বড়জোর, তারপর থেকে তোমাকে নিজেকেই যেতে হবে।”

    “মানে কী?”

    বালিশের পাশ থেকে নিজের ফোনটা বের করে কণিকার চোখের সামনে ধরল স্বর্ণাভ।

    “বেশ ভাল অফার করেছে ওরা… প্রায় ফর্টি পার্সেন্ট হাইক…” স্বর্ণাভ বলল।

    “তুমি এই চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছ!! কিন্তু কেন?!” কণিকা উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল।

    “চব্বিশ ঘন্টার একটা দিনে আট ঘন্টার ইন্টারভাল।”

    “ইন্টারভাল!!? কিন্তু…”

    কণিকা আর কিছু বলার আগেই সেই চেনা একঘেয়ে ভালবাসার নতুন স্পর্শে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল কারাগারের বন্ধ কপাট।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)