কখন যে নিজের অ্যাটিক-এর ঘরখানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে একভাবে হাঁটতে শুরু করেছে, ঠাওর করতে পারছিল না বিল। শুধু টের পাচ্ছিল, অলস, মন্থর গতিতে ডেট্ফর্ডের অলিগলি দিয়ে হেঁটে চলেছে সে। তার অ্যালবুরি স্ট্রীট-এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়ে, ল্যামারটন্ স্ট্রীট পেরিয়ে, এখন ডেট্ফর্ড গ্রীন-এর কাছাকাছি চলে এসেছে। রাস্তাটা ধরে সোজা গিয়ে বাঁ-হাতি ঘুরলেই পড়ে ওয়ার্ফ্ স্ট্রীট, গলিটা গিয়ে থেমেছে টেম্স নদীর দক্ষিণ কূলে। কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, তেমন ঠান্ডা পড়েনি এখনও। তবু আজ যেন চারিদিক একটু বেশিই শুন্শান্।
রাত এখন ক’টা? কে জানে, ভেবে কী হবে! ইদানীং মাস-বার-তারিখের মোটা হিসেবগুলোই তুচ্ছ মনে হয়, তো রাতের প্রহর! বিল অনুভব করে, তার মনের মধ্যে আর কোনো অস্থিরতা নেই, রাগ, দুঃখের লেশমাত্র নেই। শুধু একরাশ বিষন্নতা এসে এই অক্টোবরের কুয়াশার মতোই আলতোভাবে মুড়ে নিচ্ছে তাকে। অথচ তার তো হতাশ হওয়ার কথা এখন, ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা। আজ সন্ধ্যেবেলা রবার্টের ফোন আসবার পর আশার শেষ ক্ষীণ প্রদীপটাও নিভে গেল।
“ভাই, আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু বুঝতেই তো পারো, আমিও একটা কোম্পানীতে চাকরি করি। লোকে ভাবে লিটারারি এজেন্টরা চাইলে সব পারে, কিন্তু আমাদেরও যে কতরকমভাবে হাত-পা বাঁধা থাকে সে তো তোমার অজানা নয়। আমার এত বছরের কেরিয়ারে এই প্রথমবার একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট কোনো পাব্লিশারকে ধরাতে পারলাম না। এজেন্সিতে এটা একটা দুর্নামের ব্যাপার।”
“কিন্তু ... কিন্তু তুমি তো ম্যানুস্ক্রিপ্টটা নিজে পড়েছিলে রবার্ট, আর তখন তো ... ”
“তখন কেন, এখনও বলছি,” রবার্ট্ বিষন্ন হাসে, “আমার মতে লেখাটা সত্যিই ভাল। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মতের দাম কতটুকু? অনেকদিন হয়ে গেল এই লাইনে কাজ করছি, কত ক্লায়েন্টকে কত ভাল ভাল ডীল্ পাইয়ে দিয়েছি। কিন্তু শিল্পীদের ভবিতব্য যে আখেরে বাজারই নিয়ন্ত্রণ করে, তা ভুলি আমার সাধ্য কী! তুমি তো জানো, প্রায় এক বছর ধরে তোমার স্ক্রিপ্টের জন্য লড়ে গিয়েছি আমি। কিন্তু শেষ অবধি কোনো ফল হল না।”
বিল কোনোদিন বিখ্যাত হতে চায়নি। পয়সাকড়ির প্রতিও তেমন কোনো মোহ ছিল না তার। শুধু যতদূর অবধি স্মৃতির রাস্তায় যাওয়া যায়, দেখেছে, সেখানে দিগন্তবিস্তৃত কেবল শব্দ আর শব্দ। সেই শব্দ গেঁথে গেঁথে একটা একটা করে গল্প তৈরি হতেই থাকে, তবু শব্দ ফুরায় না! তার দশটা-পাঁচটার লাইব্রেরি রিসেপশনিস্ট-এর চাকরিটা অসহ্য মনে হতে থাকে এক সময়। এত এত গল্প জমে উঠে মাথায় কড়া নাড়ছে সমানে — তার চাকরি করবার সময় কোথায়?
কেমন একটা ভূতগ্রস্তের মতো হয়ে উঠেছিল বিল। তার বহু বছরের বান্ধবী কখন তাকে ছেড়ে গেল, কখন যে ছায়াঘেরা ফিন্স্বারি পার্কের ছিম্ছাম্ বাসা ছেড়ে ডেট্ফর্ডের এই আঠেরশো শতাব্দীর এক নোনাধরা বাড়ির অ্যাটিকে এসে উঠল, খেয়ালই নেই তার। বিল তখন লেখার আনন্দে, লেখার যন্ত্রণায় বুঁদ হয়ে আছে। বারবার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বিভিন্ন প্রকাশকের দপ্তরে সেসব পাঠাতে থাকে বিল। বেশিরভাগই খারিজ হয়ে যায়, আবার দু-একটা হয়তো ছাপাও হয়। নতুন করে মনোবল পায় বিল, দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করতে থাকে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আর কফিশপের অস্থায়ী কাজগুলোর একঘেয়েমী, এক-কামরার সংসারের একাকীত্ব ও দারিদ্র, কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
তবে কি ক্রিস্টিনার সঙ্গে দেখা হওয়াটাই সর্বনাশের মূল ছিল?
“Cut is the branch that might have grown full straight … ” বিড়বিড় করে বলে উঠল বিল।
“বলো কী হে! শেষটা ভূতের মুখে রামনাম!”
লাইব্রেরির চাকরিটা ছেড়ে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের পার্ট-টাইম কাজে যদি না ঢুকত বিল, তাহলে হয়তো ক্রিস্টিনার সঙ্গে কোনোদিন দেখা হত না। ক্রিস্টিনার সঙ্গে যদি দেখা না হত, তাহলে জীবনটা হঠাৎ করে এমন বিষিয়ে যেত না। কিন্তু সেই বিষে কি অমৃতও ছিল না? নাই যদি থাকবে, তাহলে কোন মন্ত্রে নিজের শ্রেষ্ঠ লেখাটা সে এই দু-বছরে লিখে ফেলতে পারল?
“আপনার নামটা তো ভারী মজার!”
জিনিসপত্র শপিং ব্যাগে ভরতে ভরতে বিল দেখল, সুন্দরী খদ্দের তার জামায় লাগানো নেমট্যাগটার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আজকাল আর অপ্রস্তুত হয় না সে।
“ওটা আমার আসল নাম। যদিও লোকে আমাকে বিল বলেই ডাকে।”
“আচ্ছা!” মেয়েটি কৌতুকমিশ্রিত সহানুভূতির স্বরে বলে, “এই নাম নিয়ে খুব সমস্যায় পড়তে হয় আপনাকে, বলুন?”
“সমস্যা মানে! স্কুলজীবন থেকে আজ অবধি হাস্যাস্পদ হয়ে আসছি।”
“আপনিও লেখেন নাকি?”
বিল হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “সত্যিই লিখি। কী আর বলব বলুন।”
জোরে হেসে উঠতে গিয়েও থমকে গেল মেয়েটা। কী যেন একটা মনে পড়ে গিয়েছে তার।
“দাঁড়ান, দাঁড়ান! আপনার লেখা তো আমি পড়েছি মনে হচ্ছে? অমুক ম্যাগাজিন-এ গত মাসে আপনি একটা ঐতিহাসিক গল্প লিখেছিলেন না? সেই ম্যাগাজিনে আমারও একটা লেখা বেরিয়েছিল। আমি তখন ভেবেছিলাম কেউ ছদ্মনামে লিখেছে বুঝি!”
বিল শুনতে পেল, মহিলার পিছনের খদ্দেরটি অধৈর্য হয়ে তাগাদা দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাজারের প্যাকেটটা মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আমিই সে।”
চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাল বিল। একটু ঠাওর করতে চোখে পড়ল, অদূরে সেন্ট নিকোলাস চার্চের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক।
লোকটার আশপাশে কোনো কম্বল, স্লিপিং-ব্যাগ, কী কার্ডবোর্ডের বাক্স-টাক্স কিছুই চোখে পড়ল না তার। অতএব ধরে নেওয়া যায়, কোনো ‘হোমলেস’ ভিখিরি নয়। তাছাড়া, ভিক্ষে করবার পক্ষে এটা আদপেই অনুকূল জায়গা নয়। তাহলে রাতবিরেতে এই নিঝুম রাস্তায় কী কারণে দাঁড়িয়ে আছে সে?
কুয়াশার কারণে সবকিছুই অস্পষ্ট। লোকটাকে ভাল করে দেখবার জন্য রাস্তা পেরিয়ে চার্চ-গেটের দিকে এগিয়ে গেল বিল।
বহু প্রাচীন এই সেন্ট নিকোলাস চার্চ। বর্তমান স্থাপত্যটি সপ্তদশ শতাব্দীর হলেও, বাইরের দেওয়ালে সবুজ রঙের প্লেটে লেখা আছে, দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই এই জায়গাতে একটি প্যারিশ চার্চ দাঁড়িয়ে আছে। গেটের দুই পাশের দুই পিলারের উপর মানুষের নশ্বরতার চিহ্নস্বরূপ দুটো পাথরের করোটি ও হাড় বসানো। রাতের বেলা ওইদিকে তাকালে গা-ছমছম করে ওঠে।
লোকটা তারই মতো বছর তিরিশের এক যুবক। স্ট্রীটলাইটের আবছা হলদে আলোয় তার সিংহের কেশরের মতো একমাথা চুলগুলোকে আগুনবর্ণ মনে হচ্ছিল। বেড়ালের মতো সবুজ চোখজোড়া অস্বাভাবিকরকম উজ্জ্বল। এই অক্টোবর মাসেও গায়ে শুধুমাত্র একটা সাদা ফিনফিনে ঢোলা-হাতা বুক-খোলা শার্ট আর পরনে চাপা পাৎলুন। যেন এক্ষুনি থিয়েটারের স্টেজ থেকে নেমে এসেছে।
“আপনি কি আমাকে কিছু বলছিলেন?”
প্রশ্ন শুনে লোকটা হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কী! মহা অপ্রস্তুত হয়ে বিল ভাবে, নির্ঘাৎ কিছু টেনেছে লোকটা। নিজের সুরক্ষার কথা ভেবে একটু দুশ্চিন্তাই হল তার। ট্রিপ্ল নাইন-এ ফোন করবে নাকি? পরক্ষণেই খেয়াল হল, ঘর ছেড়ে বেরোবার সময় ফোনটা অবধি ফেলে এসেছে!
লোকটার হাসির দমক কমেছে ইতিমধ্যে। শ্লেষপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “বাঃ! নাটক করার অভ্যেসটা তোমার যায়নি দেখছি! সেটা অবশ্য তুমি ভালই পারতে। শুধুমাত্র লেখার বেলাতেই ... হাঃ হাঃ! তোমার এলেম আছে বটে!”
লোকটা যে অপ্রকৃতিস্থ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার কথা বলার ধরনের মধ্যে তো কোনো অস্বাভাবিকতার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না! তাতে করে অস্বস্তিটা যেন আরও বাড়ছিল।
“দেখুন,” বিল শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, “আপনি কে আমি জানি না, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছি যে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি কোনোদিন নাটক করিওনি, লিখিওনি।”
যুবক খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর আচমকাই কাছে এসে তার কলার চেপে ধরে বলে উঠল, “কেন বাজে বকছ, উইল্? এতদিন পর দেখা যখন হয়েই গেল, তখন আর মস্করা করে লাভ কী?”
কলার ধরামাত্র বিল ছটফটিয়ে উঠে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল। লোকটার অবশ্য কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একইরকম আক্রোশভরা স্বরে বলে যেতে লাগল সে, “প্রত্যেকদিন এখানে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। মনে করেছিলাম, একবার না একবার তুমি আসবেই। ইতিমধ্যে কতদিন কেটে গেছে! লোকের মুখে শুনতে পেতাম তোমার নাম ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিকে। মনে হত, এই কটাদিন আগেই যাকে আমার কথা দিয়ে মুগ্ধ করে ফেলতাম আমি, আমার কবিতা পড়ে পড়ে যার আশ মিটত না, বারবার যে আমার কাছে নিজের শব্দের দৈন্য নিয়ে হা-হুতাশ করত, সেই কিনা আজ তার শব্দের জাদুতে সারা ইংল্যান্ডকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলছে! স্বয়ং রানী অবধি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ!”
“কিন্তু একটা কথা তো কেউ জানে না উইল্,” যেমন হঠাৎ করে কলার চেপে ধরেছিল, তেমনি আকস্মিকভাবে বিলকে ছেড়ে দেয় লোকটা, “কেউ জানে না, যে তোমার সব গল্পগুলো আমারই দেওয়া! য়ুনিভার্সিটির লাইব্রেরি ঘেঁটে যা যা পেয়েছিলাম, রানীর হয়ে গুপ্তচরের কাজ করতে যখন দূর দেশে পাড়ি দিতাম, সেখান থেকে যে সব গল্প সংগ্রহ করে এনেছিলাম — সবই তো তোমাকে অকপটে বলতাম। না হলে একটা অর্ধশিক্ষিত গ্রামারস্কুলের ছোকরার সাধ্যই কী ছিল, ওই অসাধারণ লাইনগুলো লেখার ... যা এখনও লোকের মুখে মুখে ফিরতে শুনি!”
বিলের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে বোধহয় একটু করুণা হল লোকটার। ক্লান্ত হেসে বলল, “সেই জগৎ-বিখ্যাত স্রষ্টার মুখে কিনা লোকচক্ষুর আড়ালে এককোণে পড়ে থাকা এই নাট্যকারের লাইন শুনতে পেলাম! আশ্চর্য বটে!”
চমকে উঠল বিল। এতক্ষণ এই লোকটার হেঁয়ালির মতো কথাগুলো কেন যেন চেনা চেনা লাগছিল তার। শেষ কথাটায় হঠাৎ করে একটা দরজা খুলে গেল যেন।
“কী বললেন আপনি? কার লেখা লাইন!”
দুটো বছর ঝড়ের মতো কেটে গিয়েছিল ক্রিস্টিনার সঙ্গে। যখনই কোনো নতুন ভাবনা মাথায় আসত, তার সঙ্গে আলোচনা না করলে সেগুলো পূর্ণতাই পেত না যেন।
“কিট্, তুমি আমার মিউজ,” বিল তার একরাশ লাল চুলের ভিতর হাত ডুবিয়ে বলত।
“আই হোপ সো,” উত্তরে হাসত কিট্, “কিন্তু তোমার কী হবে, বিল? সারা জীবন এই ঘরে বন্ধ হয়ে থাকলে তো চলবে না!”
“আরেকটু সবুর করো। রবার্ট আমার এতদিনের বন্ধু, ও যখন নিজে থেকে আমার ম্যানুস্ক্রিপ্টে এত আগ্রহ দেখিয়েছে, তখন ঠিকই একটা ব্যবস্থা করবে।”
কিন্তু সবুর করার অভ্যেস ক্রিস্টিনার ছিল না। একদিন তার ঘরে এসে অদ্ভুত এক পেশাদারী ভঙ্গিতে জানাল, সে আর এই অর্ধমৃত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তার মনে হয়, বিল যেন ঠিক করে বাঁচতেই শেখেনি। ক্রিস্টিনা শুধুমাত্র তার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারবে না সারা জীবন।
এই কথার কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি বিল। সত্যিই তো, তার সঙ্গে এতদিন স্বার্থপরের মতোই ব্যবহার করেছে সে। তাই যখন কিছুদিন পর ক্রিস্টিনার লেখা উপন্যাস বেরোনোর খবর এল, তখনও রাগ বা ঈর্ষা হল না তার। বরং আশা হল, যে তার গল্পটার একটা ব্যবস্থা হলে হয়তো কিট্ আবার ফিরে আসবে তার কাছে। সে তো চেয়েছিল, বিল জগতের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করুক! যদি একবার তার অ্যালবুরি স্ট্রীটের গুহা থেকে বেরোতে পারে, তখন কি আর ক্রিস্টিনা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে?
তাই দাঁতে দাঁত চেপে রবার্টের ফোনের জন্য অপেক্ষা করে ছিল সে। এই প্রথমবার তার মনের ভিতর শব্দের কলরব থেমে গিয়েছিল। একটা অখণ্ড নিস্তব্ধতা তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল চারপাশ থেকে।
সেই নিস্তব্ধতা চুরমার করে আজ সন্ধ্যেবেলা যখন ফোনটা ঝনঝনিয়ে উঠল, তখন মুহূর্তের জন্য ধড়ে প্রাণ ফিরে এসেছিল তার। অধীর আগ্রহে ফোন তুলে রুদ্ধশ্বাসে বলেছিল, “হ্যালো, রবার্ট!”
“মনে আছে সেই সন্ধ্যেটার কথা?” আনমনে বলে চলেছিল আগন্তুক, “হে-মার্কেটের এক ট্যাভার্নে দেখা হয়েছিল আমাদের। আমি তখন সবেমাত্র হাতাহাতির অপরাধে নিউগেট জেল থেকে বেরিয়েছি; আমার খাতির দেখে কে! তুমিও বসেছিলে দূরের একটা টেবিলে, সঙ্গে ছিল টমাস কিড। ওই তো আলাপ করিয়ে দিল! আমার নাম শুনতেই তোমার চোখদুটো জ্বলে উঠেছিল।
“তোমার সঙ্গে দেখা হবে, এই আশায় কবে থেকে দিন গুনছি আমি!
“শুনে মজা লাগল, ভেবেছিলাম আমার সম্পর্কে য়ুনিভার্সিটির লোকেরা লন্ডনে যে নানারকম গুজব ছড়িয়েছে, তার সত্যতা জানতেই বুঝি তুমি উৎসুক। কিন্তু তোমার পরের কথাটা আমাকে একটু অবাক করল বৈকি!
“তোমার কবিতার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পাও? আমি যতই লিখি, যেমনভাবেই লিখি, কই, এমন তো হয় না!
“আমি তোমার কানের কাছে মুখ এনে বললাম, ‘আমার নতুন নাটকটা দেখোনি বুঝি? ডক্টর ফাউস্টাস্ আসলে কে? আমিই তো! শয়তানের সঙ্গে আমার আত্মার সওদা করেছি, যাতে অমন লিখতে পারি!’
“শুনে চমকে উঠেছিলে, তারপর আমার অট্টহাস্য দেখে তুমিও লাজুক হাসতে লাগলে।
“তারপর একসঙ্গে কত মধুর সময় কাটিয়েছি আমরা! এখনও মনে পড়ে, তোমার কমেডি লেখার হাত ছিল চমৎকার। তুমি অবশ্য আক্ষেপ করে বলতে, ‘হাস্যকৌতুক লিখে কি সম্মান পাওয়া যায়, কিট্? লেখার আসল বিষয় হল ট্র্যাজেডি।’
“আমি তখন তোমাকে শোনাতাম আমার মনের নানা গল্প; উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজা, বুদ্ধিদীপ্ত রাজপুত্রের গল্প, তাদের চারিত্রিক দুর্বলতা, মারাত্মক ভুল, এবং মৃত্যুর কথা। তুমি আশ্চর্য হয়ে শুনতে।
“কিন্তু সব সুখেরই ইতি আসে। কে যেন খবর আনল, গুপ্তচরের বেশে আমি নাকি আসলে রাজদ্রোহী। যে এতদিন নিজের প্রাণ বিপন্ন করে দরবারের হয়ে খিদমত খাটল, তার বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ এল। রানীর চোখেও আমি ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলাম।
“অগত্যা যা হবার, তাই হল। প্রাণের ভয়ে টম কিডও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল। তোমাকে ওরা খুঁজে পায়নি; তুমি নাটকের দল নিয়ে তখন গ্রামে গ্রামে ঘুরছিলে। আমার বিরুদ্ধে লোক-দেখানো একটা ইন্ক্যুইজিশান হল বটে, কিন্তু আমি টের পেয়েছিলাম, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে।”
অবশেষে থামল সেই আগন্তুক। নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিল। হয়তো লোকটা সত্যিই পাগল। কিন্তু এই গল্পটাও যে তার বড়ই চেনা!
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আগন্তুক বলল, “তুমি আমার উইল্ নও, তাই না?”
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বিল।
“তিনি মারা গেছেন আজ থেকে চারশো বছর আগে। শেষ জীবনটা স্ট্র্যাট্ফর্ড্-আপন-অ্যাভন-এ কেটেছিল তাঁর। চারিদিকে একটু খেয়াল করে দেখুন, আমরা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আছি।”
যেন ঘোর ভেঙে উঠে চারপাশটা ভাল করে তাকিয়ে দেখল আগন্তুক। বিল বুঝতে পারল, তার মনে নতুন কোনো বোধের উদয় হয়েছে। খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে আগন্তুক অস্ফুটে বলল, “চারশো বছর পরেও আমার কবিতার লাইন আবৃত্তি করলে তুমি! তোমাকে ধন্যবাদ। এবার আমি ফিরব।”
বিল দেখল, চার্চের উত্তর কোণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আগন্তুক। ওইখানেই তো শুয়ে আছেন তিনি। রেনেসাঁ যুগের এক অন্যতম নাট্যকার। তিনি পূর্ণবয়স অবধি বেঁচে থাকলে তাঁর সমসাময়িক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এইভাবে অমরত্ব লাভ করতেন কিনা বলা যায় না। হয়তো এঁর ছায়াতেই ঢাকা পড়ে যেতেন চিরদিনের মতো। কিন্তু মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে ডেট্ফর্ডের এক পানশালায় রহস্যজনকভাবে মারা যান তিনি। তার মাত্র কিছুদিন পরেই তাঁরই বয়সি আরেক যুবকের লেখা নাটক লন্ডনের মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করে।
চার্চের উত্তরদিকের দেওয়ালে মার্বেলের ফলকে লেখা আছে, এইখানেই কোনো এক নামহীন কবরে শুয়ে আছে ক্রিস্টোফার মার্লো, যে ১৫৯৩ খৃষ্টাব্দের ৩০শে মে-তে ডেট্ফর্ডে অকালমৃত্যু বরণ করে।
সকালবেলা খবরের কাগজটা খুলেই চমকে উঠল রবার্ট ফ্র্যাঙ্কলিন্। ভিতরের পাতায় কোণের দিকে একচিলতে একটা খবর, কিন্তু হেডলাইনটাই নজরকাড়া: ‘উইলিয়াম শেক্সপিয়ার মৃত’।
খবরটি জানাচ্ছে, গতকাল সন্ধ্যেবেলা অ্যালবুরি স্ট্রীটের এক বাড়ির ভাড়াটে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে। মৃতের নাম উইলিয়াম শেক্সপিয়ার — যদিও আত্মীয়-বন্ধুমহলে সে বিল নামেই পরিচিত। রাত দশটা নাগাদ মৃতদেহটা আবিষ্কার করে ওই বাড়িরই নীচের তলার ভাড়াটে। মৃত্যুর আগে সে ফোনের সমস্ত কল রেকর্ড মুছে দিয়েছিল; আশেপাশে কোনো সুইসাইড নোট মেলেনি। প্রতিবেশীরা জানিয়েছে, নিতান্তই সহজ নির্বিবাদী লোক ছিল সে। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড তদন্তের ভার নিয়েছে।
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল রবার্ট। জীবনে প্রথমবার নিজেকে খুব ব্যর্থ মনে হল তার।
চমৎকার লেগেছিল বিলের গল্পটা। তার কলমে রেনেসাঁ যুগের থিয়েটার জগৎ কী এক জাদুতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। শেক্সপিয়ার এবং ক্রিস্টোফার মার্লোর এক কাল্পনিক সাক্ষাৎ নিয়ে জমজমাট এক ঐতিহাসিক থ্রিলার। কে জানে, কোনো প্রকাশকই কেন গল্পের কদরটা বুঝতে পারল না!
অস্ফুটে বলে উঠল রবার্ট, “কাট ইজ দ্য ব্রাঞ্চ দ্যাট মাইট হ্যাভ গ্রোন ফুল স্ট্রেট।”