আচ্ছা বৌ-ক্যাংলা হয়েছে লতিকার ছেলেটা। বৌয়ের দু’-দণ্ড চোখের আড়াল হবার জো নেই, অমনি ‘শোন পাপড়ি, শোন পাপড়ি...’ করে অস্থির হয়ে পড়বে। মানছি তোরা ক্লাস-মেট ছিলিস, তাই বলে বিয়ের পরেও তুই-তোকারি! সব কিছুরই একটা শোভন-অশোভন বলে ব্যাপার আছে তো না কি? আজকালকার ছেলেমেয়েরা পুরনো সব আদবকায়দা নিয়মকানুন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চায়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তবু নাকে-মুখে ব্রেকফাস্ট গুঁজে দু’জনে সকাল-সকাল অফিস বেরিয়ে যেত। লতিকা সারাদিনের জন্য নিশ্চিন্ত হতেন। কাজের মেয়েটা বিকেলে এসে বাসন মেজে, ঘর ঝাড়ু-মোছা করে দিয়ে যেত। রাঁধুনি মেয়েটা আসত সন্ধের পর। লতিকা টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখতে-দেখতে টুকটাক তদারকি করতেন।
দু’জনের অফিস শহরের দু-মুড়োয়, ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আট-নয়। পাপড়ি আধা-পৌনে ঘন্টা আগে ফিরত, আবির খানিকক্ষণ পরে। ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে চেঁচাত, পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে মা, তাড়াতাড়ি খেতে দাও। লতিকা দু’জনের খাবার বেড়ে দিতেন। নিজেরটাও গুছিয়ে নিতেন। পাপড়ির হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে এসে বসার তর দিত না, আবির রাক্ষসের মতো গোগ্রাসে গিলতে শুরু করত। সময়টা অন্যরকম ছিল। লতিকা তখন নিয়মিত মর্নিং-ওয়াকে বেরোতেন। সকালে উঠতে হবে বলে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়তেন। ছেলে-বৌ নিজেদের ঘরে ঢুকত। সেসময় এই সব উদ্ঘট অনাসৃষ্টি কাণ্ড দেখতে হত না। লকডাউন শুরু হবার পর থেকেই সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল।
প্রথমেই বন্ধ হল সকালবেলার হাঁটা আর পার্কের লাফটার ক্লাব। পাড়া-কাঁপানো হা-হা হি-হি, হাততালি থেমে গেল। মহল্লাটা কেমন নিঃঝুম-নিশ্চুপ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। আবির আর পাপড়ির অফিস শুরু হয়ে গেল, ঘর থেকে। সে এক আজব ঝামেলা, সারাদিন দু’জনে ল্যাপটপ কোলে করে বসে আছে, পারলে স্ক্রিনের মধ্যে ঢুকে যায়। একজন সোফার ওপর আড়কাত হয়ে, অন্যজন ডাইনিং টেবিলে। কখনও দু’জনেই খাটের ওপর কুমড়ো গড়ান গড়াচ্ছে। পাপড়ি বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে তো আবির তার কোলে মাথা রেখে... বুকের ওপর ডালা-খোলা ল্যাপটপ। আবার কখনও আবির উপুড় হয়ে শুয়ে আছে তো আবিরের পিঠে পাপড়ির ঠ্যাং, লজ্জা-সরমের বালাই নেই। কাজের মেয়েগুলো আসা বন্ধ করে দিয়েছে। ভাবটা এমন, মায়ের সামনে আবার কীসের লজ্জা?
অবশ্য দু’জনের চোখ আটকে আছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। গলায় ব্লু-টুথ স্পিকার দুলিয়ে মিটিং করছে। বাড়িতে আছে, ঘুরছে ফিরছে, কিন্তু লতিকার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই কারো। তাঁরও যে সংগী দরকার, মন খুলে দুটো কথা বলা দরকার, সে নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। আগে তবু রাত্তিরে খাবার টেবিলে দু’-চারটে সুখ-দুঃখের গল্প হত। এখন সময় অসময় নেই, আমেরিকার সংগে কনফারেন্স কল, সুখ-দুঃখ হাসি-ঠাট্টা শিকেয় উঠেছে।
পাপড়ি কফি বানাতে উঠে এসেছিল, জিজ্ঞেস করল, “মা, আপনার জন্যও বানাব এক কাপ?” লতিকার দুধ চিনি ছাড়া কফি তেঁতো লাগে, কী করে যে মানুষ খায়? ঘাড় নেড়ে না বললেন। ছেলে বেডরুম থেকে চেঁচাল, “পাপড়ি, কোথায় গেলি রে? দেরি করছিস কেন? কফির সঙ্গে আমন্ড আনিস গোটা কতক।”
বৌকে যেন সর্বদাই চোখে হারাচ্ছে। এমন মেনিমুখো ছেলে লতিকার দু’-চক্ষের বিষ। লতিকা ঠোঁট বেঁকালেন। পাপড়ি কি আড়চোখে দেখল? দেখলে দেখুক। কথায় বলে – বাপকা বেটা সিপাই কা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া... আর এই ছেলেটাকে দেখো। সব সময় বৌ-বৌ করে হেদিয়ে মরছে। আবিরের বাবা প্রবীরবাবু জানতে পারলে নির্ঘাত ভাবতেন, মরে বেঁচেছেন। কী বাপের কী ছেলে! বাপের স্বভাব ছিল একদম উলটো। নীরস, কাঠখোট্টা, পারতপক্ষে নেকু-নেকু রোম্যান্টিকতার ধার ধারতেন না। জীবনের মন্ত্র ছিল – ধরো তক্তা মারো পেরেক। সাতাশ বছর পার করে, দাম্পত্যের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন। একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল লতিকার, জীবনে দুটো ভাব-ভালবাসার কথা শোনা হল না। মানুষটা চলে গেছে বছর পাঁচেক। প্রথম দিকে খালি-খালি লাগত। এখন অনেক সয়ে গেছে।
লতিকার হাতের মুঠোয় ধরা ফোনটায় টুং করে একটা মেসেজ এল। পাপড়ি কাপে কফি ঢালতে-ঢালতে চোখ তুলে তাকাল। লতিকা সরে গেলেন। নিজের ঘরে গিয়ে ধীরে-সুস্থে দেখলেই হবে। বাচ্চা মেয়েটার সামনে ফোন না খোলাই ভাল।
ক’দিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল। আনলকডাউন চালু হয়েছে দিন দশেক। পাপড়ি রোজ ঘুম ভেঙে উঠে দেখছিল লতিকা সকাল-সকাল চান সেরে চা বানাচ্ছেন। ঠোঁটে দু’-এক কলি গুনগুন গান, হায় রে পোড়া বাঁশি...। জিজ্ঞেস করলে বলছিলেন, “যা গরম পড়েছে। চান না করে পারা যাচ্ছে না।”
গরম পড়েছে নিঃসন্দেহে। তাই বলে ভোরবেলা উঠে চান! দুপুর গড়িয়ে গেলেও যে মানুষকে ঠেলে-ঠেলে চান করতে পাঠানো যায় না, সে কিনা...! শীতকালে নিয়ম করে দু’দিনে একবার চান করেন লতিকা। ছেলেও উত্তরাধিকার সূত্রে মায়ের গুণ পেয়েছে। পাপড়ি নাক সিটকোয়। অবশ্য চানের ব্যাপারটা এমনিতেই বেশ ঘেঁটে আছে। নতুন নরম্যাল হয়েছে, ঘরের বাইরে পা রাখলেই ফিরে এসে চান। ওই জন্যই আরও আবির বাইরে বেরোতে চায় না। জলকে সে কুকুরের মতো ভয় পায়। তাছাড়া গ্রোসারি, শাক-সব্জি, ফল-মূল মায় পোশাকআশাকও অনলাইন মার্কেটিং-এর কৃপায় ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। ফালতু পরিশ্রম করে কী লাভ? আবির ঘরে বসে দেদার খাচ্ছে, আর ভুঁড়ি বাড়াচ্ছে। লতিকাই রাঁধেন, পাপড়ি সময় সুযোগ করে, অফিসের কাজের ফাঁকে শাশুড়ির কাছ থেকে দু’-একটা রান্না শিখে নিচ্ছে। ইদানীং লতিকা বেশ খুশ-মেজাজে আছেন। এমনকি আবিরের “শোন পাপড়ি...” শুনেও ঠোঁট বেঁকাচ্ছেন না।
পাপড়ির মনটা খুঁতখুঁত করছিল। লতিকার আচরণ যেন ঠিক স্বাভাবিক শাশুড়ি-সুলভ নয়। আজ একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলল। ভোরের দিকে একটা স্বপ্ন দেখছিল, আবিরের সঙ্গে একটা নদীর ধারে বেড়াতে গেছে, বৃষ্টির মধ্যে দু’জনে হাতে হাত রেখে হাঁটছে... হঠাৎ কীসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল সদর দরজা বন্ধ হবার শব্দ। এসময় কে এল? উঠে গিয়ে দেখল দরজা যেমন কে তেমন বন্ধ। লতিকার শোবার ঘরে উঁকি দিল... বিছানা খালি, লতিকা নেই। বাথরুম চেক করল... যাননি, তবে কি বাইরে হাঁটতে বেরোলেন? যদিও আনলকডাউনে বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল হয়েছে, মর্নিং-ওয়াক এখনও বেআইনি। পইপই করে মানা করা হয়েছে তাঁকে বাইরে যেতে। বয়স্ক মানুষ, কোথা থেকে কী হয়ে যায়।
পাপড়ি হাতে চাবি নিয়ে, মুখে মাস্ক লাগিয়ে রাতের পোষাকেই দরজা খুলে বেরোল। অবিলম্বে ব্যাপারটার একটা তদন্ত করা দরকার। লতিকার ফোনটা মধ্যযুগের, কথা বলা আর এসএমএস পড়া ছাড়া বিশেষ কিছু করা যায় না। কিন্তু সেটা নিয়েই ক’দিন যেন লতিকা একটু বেশি সতর্ক হয়ে পড়েছিলেন। সব সময় হাতে ফোন নিয়ে ঘুরতেন। মেসেজ এলে নিজের ঘরে গিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে টুক করে একবার দেখে নিতেন। নিজের মনে মুচকি মুচকি হাসতেন।
অবশ্য পাপড়ির যাকে বলে শ্যেন দৃষ্টি, কিছুই নজর এড়ায়নি। পাপড়ি নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াল, হুঁ-হুঁ বাবা, পাপড়ি সান্যালের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। পাপড়িদের ফ্ল্যাটটা সেভেন্থ ফ্লোরে। পাপড়ি বেরিয়ে তড়িঘড়ি লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল ডিসপ্লে প্যানেলে ফ্লোরের সংখ্যা বদলাচ্ছে। কিন্তু কিমাশ্চর্য! নিচে নামার বদলে লিফটটা ওপরে যাচ্ছে। সতের নম্বরে এসে সংখ্যাটা থিতু হল। আবাসনের টপ-ফ্লোর। তার ওপরে আবাসনের ছাদ। লতিকা-দেবী চললেন কোথায়? ছাদে হাঁটবেন নাকি? একা একা? ব্যাপারটা সরজমিনে দেখা দরকার। পাপড়ি মিনিট তিনেক অপেক্ষা করে লিফটের স্যুইচে হাত দিল।
টপ ফ্লোরে লিফট থেকে নেমে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। পাপড়ি পা টিপে টিপে সিঁড়ি ভেঙে উঠছিল। শাশুড়ি-মার খিল খিল হাসির শব্দ পেল। একটা পুরুষ কন্ঠ বলল, “ও লতু, আসার সময় কেউ দেখেনি তো?”
ওরে বাবা, একেবারে লতু! পাপড়ি ছাদের দরজা দিয়ে টুক্কুস মুখ বাড়িয়ে দেখল শাশুড়ি-মার সামনে দাঁড়িয়ে ফোরটিন্থ ফ্লোরের দীপ্ত-জেঠু। ছাদে আর কেউ নেই। লতিকা বললেন, “ধ্যুর, ছেলে-বৌ এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।”
দীপ্ত-জেঠু তুড়ি বাজিয়ে বললেন, “আমারও...”
সকালের নরম হলুদ রোদ্দুরের মধ্যে লতিকাকে দেখে কেমন অভিসারিকা টাইপ লাগল পাপড়ির। গালে, কানের লতিতে যেন অল্প অল্প লালের আভা। দীপ্ত-জেঠুর হাতে ওটা কী? বাঁশি? শাশুড়ি-মাকে রাগ ভৈরবী বাজিয়ে শোনাবেন? অসময়ের রোমান্স-পীড়িত দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াকে দেখে পাপড়ির বড্ড মায়া হল। যেমন ভাবে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠেছিল, ঠিক তেমন ভাবেই আবার পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে নিচে নেমে এল।
তিন জনের কাছেই বাড়ির একটা করে চাবি থাকে। খুট করে একটা শব্দ হতেই পাপড়ি বুঝল শাশুড়ি-মা ফিরলেন। পাপড়ি কফির কাপে চামচ নাড়াতে মন দিল। লতিকা পাপড়িকে দেখে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিলেন। মাস্ক খুলে অজুহাত দেবার ঢঙে বললেন, “ওমা তুমি উঠে পড়েছ? পুজোর ফুল তুলতে গিয়েছিলাম।”
শাশুড়ির ঘরে একটা ঠাকুরের সিংহাসন আছে বটে। লতিকা চান-টান করে সেখানে দু’-মিনিট চোখ বুজে বসেনও। পাপড়ি গম্ভীর গলায় বলল, “কোথায়?”
লতিকা বললেন, “কোথায় আবার? ছাদে... সাততলার ঘোষালরা আমেরিকায় ছেলের কাছে যাবার সময় ওদের টবগুলো ছাদে রেখে গিয়েছিল না, ওয়াচম্যান জল দেয়, সেই গাছগুলোয় ফুল ধরেছে।”
বাহানা তৈরি, পাপড়ি বলল, “অ, তা কী ফুল পেলেন?”
লতিকা একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাগ তুলে দেখালেন, “জবা, টগর, জুঁই...”
পাপড়ি বলল, “তা রোজই কি যাচ্ছেন ফুল তুলতে?”
লতিকা কথাটা গায়ে মাখলেন না। টুক করে বাথরুমে ঢুকে পড়লেন।
চান সেরে, শাড়ি-জামা বদলে কিচেনে ঢুকে চা চাপালেন। পাপড়ি লক্ষ করছিল শাশুড়িকে। সদ্য-সদ্য প্রেমে পড়ে বয়স যেন খানিকটা কমে গেছে। চলার মধ্যে একটা হরিণ-হরিণ ছন্দ এসেছে। পাপড়ি বলল, “মা, ফুল তুলে আনলেন, পুজো করলেন না?”
লতিকা জিভ কাটলেন, “দেখেছ, কথায় কথায় ভুলেই গেছি...”
লতিকা গ্যাস অফ করে পুজো করতে দৌড়োলেন। পাপড়ি ব্রেকফাস্টের তোড়জোড় শুরু করল। আবির উঠেই খেতে চাইবে। এক ঘন্টার মধ্যে দু’জনকেই লগ-ইন করতে হবে। দুধ জ্বাল দিতে দিতেই লতিকা পুজো সেরে ফিরে এলেন, বললেন, “তুমি বসো গিয়ে, আমি বানিয়ে দিচ্ছি, চিঁড়ের পোলাও... রোজ এক পাঁউরুটি ডিম ভাল লাগে না।”
পাপড়ি সরে এল। ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে চিঁড়ের পোলাও দেখে আবির খুশি হয়ে গেল। লতিকা ছেলে-বৌয়ের প্লেটে চিঁড়ের পোলাও তুলে দিচ্ছিলেন বেশি করে। পাপড়ি শাশুড়ির যত্ন দেখে ভাবল, আহা, প্রেমের কী মহিমা! মরা নদীতেও বান ডাকে।
লতিকা উদ্বিগ্ন হচ্ছিলেন ভেতরে-ভেতরে, পাপড়ি দীপ্তদার কথা কোনওভাবে জেনে যায়নি তো! দীপ্তদার শেষ মেসেজটা ডিলিট করেছিলেন, নাকি ফোনে রয়ে গেছে? ইস, আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। চান করতে গিয়েছিলেন যখন, পাপড়ি তাঁর ফোন ঘাঁটা-ঘাঁটি করেনি তো? পাপড়ি অবশ্য তেমন মেয়ে নয়, তবু...। জানাজানি হলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। চিঁড়ের পোলাও খেতে খেতে পাপড়ি জিজ্ঞেস করল, “মা, আপনাদের লাফটার ক্লাবের কী খবর? কথা হয় না কারো সংগে?”
দেখেছ কাণ্ড! লতিকা আঁতকে উঠলেন। দীপ্তদা লাফটার ক্লাবের সেক্রেটারি। শয়তান মেয়েটা নিশ্চয়ই কিছু আঁচ করেছে। মুখে বললেন, “কোথায় আর? তোদের ওই দীপ্ত-জেঠুর সঙ্গেই যা মাঝেমধ্যে... ফোনে...”
ব্রেকফাস্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত লতিকা ভয়ে কাঁটা হয়ে রইলেন। পাপড়ি আবার বেফাঁস কিছু জিজ্ঞেস না করে বসে। পাপড়ি অবশ্য আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, তবে মুখখানা তিজেল হাঁড়ির মত ভারি করে রাখল। ব্রেকফাস্টের পরে ছেলে-বৌ বেডরুমে ঢুকল। এবার তাদের ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম চালু হবে। লতিকা হাঁফ ছাড়লেন। প্লেট তুলে সিংকে নামিয়ে নিজের ঘরে গেলেন। অবশ্য অস্বস্তিটা গেল না। পাপড়ি কি সত্যিই কিছু জানতে পেরেছে নাকি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছে? কে জানে?
লতিকা ড্রইং রুমে ফিরলেন। পাপড়ি নিশ্চয় এতক্ষণে আবিরের কান ভাঙাচ্ছে। টেবিলের ওপর রাখা জলের বোতলের ছিপি খুলে জল খেলেন এক ঢোঁক। পেটটা আইঢাই করছে। ছেলে-বৌয়ের দরজায় কান পাতা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কিন্তু সময় বিশেষে, জরুরি দরকার পড়লে কোন শাশুড়ি না করে? তাতে তেমন গুরুতর অপরাধ নেই। আড়ি পাততে গিয়ে দেখলেন, হা ঈশ্বর! ছেলে-বৌয়ের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ওফ, এদের কি কিছুতেই রাখ-ঢাক নেই? খোলা দরজায় কি কান পাতা যায়? কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে কান খাড়া করে ফিসফিস শোনা তো যায়। আবির অবশ্য ফিসফিস করে নয়, হেঁড়ে গলায় হেঁকে-হেঁকে বলছে, “কেসটা কী বল তো? আজ সকাল-সকাল চিঁড়ের পোলাও, উইথ কাজু কিসমিস?”
পাপড়ি বলল, “আস্তে কথা বল, মা শুনতে পাবে।”
আবির বলল, “আরে ছাড়, মা আজকাল ‘শোন পাপড়ি’ শুনেও কিছু বলছে না। তাও যদি জানত কথাটা ‘শোন পাপড়ি’ নয়, তোকে “সোনপাপড়ি’ বলে ডাকি।”
পাপড়ি মুখ লাল করে বলল, “তুই ভারি বদ হয়েছিস।”
আবির খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসল, “কী করব? মুখে নিতেই তুই এমন গলে যাস। আহ্, কী মিষ্টি, কী মিষ্টি!”
পাপড়ির আদুরে গলার ‘ধ্যাত...’ শুনে লতিকা পালাবার পথ খুঁজছিলেন। এক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। পাপড়ি বলছে, “এই শোন না, মা কবে থেকে একটা আদ্দিকালের ফোন নিয়ে ঘোরে। আমার ইচ্ছা হয়েছে মাকে একটা স্মার্ট ফোন গিফট করব। অনলাইনে সার্ভে করে বল দেখি কোন ফোন কেনা যায়।”
আবির ভুরু কোঁচকাল, “মা স্মার্ট ফোন নিয়ে কী করবে?”
পাপড়ি বকুনি দিল, “তোকে সে ভাবনা ভাবতে হবে না। যা বলছি কর।”
আবির বলল, “হুঁ… দেখছি।”
পাপড়ি বলল, “দেখছি নয়, এখনই দেখ।”
আবির বলল, “উফ্, উঠল বাই তো কটক যাই, বললাম তো দেখছি।”
খুনসুটি-পরায়ণ ছেলে-বৌকে ছেড়ে লতিকা নিজের ঘরে ফিরে আসছিলেন। হাতের ফোনে টুং করে মেসেজ এল… দীপ্তদা। লতিকার মনে হল, যতই রোগজ্বালা, লকডাউন থাকুক না কেন, হেসেখেলে বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবী নামের গ্রহটা কিন্তু খুব একটা মন্দ জায়গা নয়। বিশেষ করে যদি হাত বাড়ালেই ভালবাসবার মত মানুষ পাওয়া যায়। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন কি? নাকি সব ধাক্কারই কোনও না কোনও কার্য-কারণ থাকে? লতিকা ডাইনিং টেবিলের কোণায় ধাক্কা খেলেন। হাত আলগা হয়ে ফোনটা ছিটকে গেল। ফোন-মেমরিতে জমা করে রাখা পুরনো ধ্যানধারণাগুলো ছই-ছত্রাকার হয়ে মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। শব্দ পেয়ে ছেলে-বৌ এসে দাঁড়িয়েছিল। পাপড়ি জিজ্ঞেস করল, “লাগেনি তো, মা?”
না, না... লতিকা ব্যস্ত হয়ে ফোনের ভাঙা টুকরোগুলো তুলতে-তুলতে ভাবলেন, যাক গে, নতুন ফোন তো আসছেই। সিমটা কাজ করলেই হল, নতুন ফোনে লাগিয়ে নেবেন। শুধু দীপ্তদার শেষ মেসেজটা দেখা হল না, সেটাই দুঃখ।