উর্দু সাহিত্যের প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক-গল্পকার রাজিন্দর সিং বেদী (১৯১৫ - ১৯৮৪) ‘এক চাদর মৈলি সি’ উপন্যাসের (যা পরবর্তীকালে সিনেমার মাধ্যমে সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা পায়) জন্য ১৯৬৫-তে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। রাজিন্দর সিং বেদী উর্দু সাহিত্যে তরক্কি-পসন্দ মুসন্নিফিন অর্থাৎ প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। এই গল্পকার পরে সিনেমায় নির্দেশক এবং স্ক্রিপ্ট লেখক হিসেবেও কাজ করেছেন। হৃষীকেশ মুখার্জি নির্দেশিত অভিমান, অনুপমা অথবা বিমল রায়ের মধুমতীর মত বহু বিখ্যাত হিন্দি সিনেমার স্ক্রিপ্ট তিনি লিখেছেন।স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের যে স্বপ্ন দেশবাসীর মনে আঁকা ছিল, দেশভাগের ক্ষত এবং অন্যান্য নানাবিধ সমস্যায় সে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব হল না। দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও আর্থিক দৈন্য এবং বহুবিধ সামাজিক কুসংস্কার, পক্ষপাত এবং বৈষম্য থেকে মুক্তির পথটি ছিল কণ্টকাকীর্ণ। এই বিষয়টি সমসাময়িক, বাস্তববাদী, নব্যধারার উর্দু গল্পকারদের নজর এড়ায়নি। দেশভাগের পরিণতি ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের পক্ষে কত মর্মান্তিক হতে পারে, সাদাত হাসান মাণ্টো’র ‘টোবা টেক সিং’ অথবা রাজিন্দর সিং বেদী’র ‘লাজবন্তী’-র মত গল্পে তার প্রতিফলন দেখা যায়। স্বাধীনতার সূর্য উঠলেও, অন্ধকার দূর হল না। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পথের শেষে পৌঁছলেও অন্তরের জ্বালা জুড়লো না।
১৯৪৭-এর ৬ ডিসেম্বর ভারত এবং পাকিস্তান সরকারের মধ্যে অপহৃতা নারীদের পুনরুদ্ধারের বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দু’দেশের অপহৃতা মহিলাদের শনাক্ত করে তাঁদের নিজ পরিবারে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য পদক্ষেপ গৃহীত হয়। চুক্তি হলেও সেই অভাগা নারীদের ঘরে ফেরা ঠিক কেমন হয়েছিল?
১৯৫১ সালে রচিত ‘লাজবন্তী’ গল্পে উর্দু সাহিত্যের প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক-গল্পকার রাজিন্দর সিং বেদী (১৯১৫ - ১৯৮৪) বলছেন তেমনই এক বিবাহিতা নারীর ঘরে ফেরার কাহিনী। এই অনুবাদের জন্য দিল্লীর মকতবা জামিয়া লিমিটেড থেকে প্রকাশিত বেদী-র ‘আপনে দুখ মুঝে দে দো’ (১৯৯৭) শীর্ষক গল্পসংগ্রহে মুদ্রিত গল্পটি ব্যবহার করেছি।
—অনুবাদক
[একটি পাঞ্জাবি গীত]
দেশ ভাগাভাগি হল, আর অসংখ্য আহত মানুষ নিজেদের মুখ থেকে রক্ত পুঁছে উঠে দাঁড়াল। তারপরে সকলের নজর পড়ল তাদের দিকে, যাদের মুখে রক্তের চিহ্ন না থাকলেও হৃদয়ে ছিল গভীর ক্ষত।
গলিতে-গলিতে, মহল্লায়-মহল্লায় ‘পুনর্বাসন’ কমিটি তৈরি হয়ে গেল। শুরুতে অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে ‘ব্যবসায় পুনর্বাসন’, ‘জমিতে পুনর্বাসন’, ‘গৃহে পুনর্বাসন’-এর কর্মসূচি শুরু হল। কিন্তু এমন একটি কর্মসূচি ছিল, যেদিকে কারও নজর পড়ল না। সে প্রোগ্রামটি ছিল অপহরণ করা মহিলাদের নিয়ে, যার স্লোগান ছিল ‘হৃদয়ে পুনর্বাসন’। কিন্তু নারায়ণ বাওয়া-র মন্দির আর তার আশপাশে বসবাসকারী প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীল মানুষেরা সেই কর্মসূচির বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
ওই কর্মসূচিটি শুরু করার জন্য মন্দিরের পাশের পাড়া ‘মুল্লা শুকুর’-এ একটা কমিটি তৈরি হল, আর এগারো ভোটের ব্যবধানে জিতে সুন্দর লাল বাবু সে কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হলেন। উকিল সাহেব, সদর চৌকির বুড়ো মুহুরি আর মহল্লার অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মনে করতেন যে সুন্দর লালের চেয়ে বেশি আন্তরিক উৎসাহ নিয়ে আর কেউ সে কাজ করতে পারবে না কারণ সুন্দর লালের নিজের স্ত্রী অপহৃত হয়েছিলেন। যাঁর নাম লাজো – লাজবন্তী।
তাই প্রভাত ফেরির সময় যখন সুন্দর লাল বাবুর বন্ধু রসালু আর নেকি রাম গেয়ে উঠত, ‘হাথ লাইয়াঁ কুমহ্লাঁ নি লাজবন্তী দে বোটে’, সেই সময় সুন্দর লালের মুখ একদম বন্ধ হয়ে যেত। তিনি নিঃশব্দে চলতে চলতে লাজবন্তীর কথা ভাবতেন। কে জানে সে এখন কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে, আমাদের নিয়ে সে এখন কী ভাবে। সে কি আর কখনও ফিরে আসবে? পাথর পাতা মসৃণ রাস্তায় চলতে চলতে তিনি যেন টলতে থাকেন।
তারপরে তো এমন পরিস্থিতি এল যে সুন্দর লাল লাজবন্তীর কথা ভাবাই ছেড়ে দিলেন। তাঁর দুঃখ এখন যেন সমগ্র জগতের দুঃখ। নিজের দুঃখ ভুলতে উনি জনসেবায় নিজেকে সঁপে দিলেন। তা সত্ত্বেও, যখনই তিনি সঙ্গীদের সঙ্গে গলা মেলাতেন, তখন এই চিন্তা তাঁর হতই যে মানুষের মন কত দুর্বল। সামান্য কথাতেই তাঁর আঘাত লাগে। মন যেন লাজবন্তীর পাতার মত। সেদিকে হাত বাড়িয়েছ কী সে নুয়ে পড়বে। কিন্তু তিনি নিজের লাজবন্তীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার কোনও সীমা রাখেননি। তিনি তাকে উঠতে-বসতে, রান্নাবান্না বা পরিবেশনের সময় এবং এমনই কত মামুলি কারণে ধরে পিটতেন।
বেচারা লাজো ছিল তুঁতগাছের ডালের মত শীর্ণ একটি দেহাতি মেয়ে। দীর্ঘ সময় রোদে থেকে থেকে তার গায়ের রঙ তামাটে। শরীরে ছিল এক অদ্ভুত অস্থিরতা। তার ছটফটে ভাব এমন যেন বড় পাতার ওপর ভেঙে যাওয়া শিশির বিন্দুর মত একবার এদিক, পর মুহূর্তেই অন্যদিকে ঘুরতে থাকে। তার শীর্ণতা অসুস্থতাজনিত ছিল না, বরং তা ছিল সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। ভারী চেহারার সুন্দর লাল প্রথম দর্শনে তাকে দেখে ঘাবড়ে গেলেও যখন তিনি দেখলেন যে লাজো সব রকমের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে, সব প্রহার তার সয়ে যায়, তখন তিনি বউয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের তীব্রতা বাড়িয়ে দিলেন। তিনি সেই সীমার কথা মনে রাখতে ভুলে গেলেন, যেখানে পৌঁছলে যে কারও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে সীমারেখাকে অস্পষ্ট করার পেছনে লাজবন্তীর নিজেরও তো ভূমিকা ছিল। সে এই কারণে যে প্রবল নির্যাতনের পরেও সুন্দর লাল যদি একবার তার দিকে তাকিয়ে হেসেছেন, তাহলেই লাজবন্তী খিলখিল করে হেসে উঠত, আর লাফ দিয়ে তাঁর কাছে চলে আসত। স্বামীর গলা জড়িয়ে সে বলে উঠত, ‘তুমি যদি আবার আমাকে মারো, তা হলে কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা বলব না।’ পরিষ্কার বোঝা যেত যে সে মার খাওয়ার কথা একদম ভুলে গেছে। গ্রামের অন্য মেয়েদের মত সেও জানত যে পুরুষদের আচরণ এমনই হয়। যদি কোনও মেয়ে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত, তা হলে মেয়েরা নিজেরাই নাকে আঙুল চাপা দিয়ে বলে উঠত, ‘সে আবার কেমন পুরুষ যে নিজের আওরতকে কব্জায় রাখতে পারে না?’ আর এই নিপীড়নের কাহিনী নিয়ে মেয়েরা গান বেঁধেছিল। লাজো স্বয়ং গাইত – ‘আমি শহরের ছেলেদের বিয়ে করব না। ওরা বুট পরে। আর আমার কোমরটা যে বড়ই পাতলা।’
কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই সে শহরের একটি ছেলের প্রেমে পড়ে গেল যার নাম সুন্দর লাল। তিনি এক বরযাত্রী দলের সঙ্গে লাজবন্তীদের গ্রামে গিয়েছিলেন। তিনি বরের কানে কানে শুধু এটুকুই বলেছিলেন, ‘ইয়ার, তোর শালীটা তো বেশ মুচমুচে দেখছি। বিবিও বেশ সুস্বাদুই হবে!’ সুন্দর লালের এই কথা লাজবন্তীর কানে গিয়েছিল। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল যে সুন্দর লাল কত বড়সড় আর ভারি বুট পরে, আর তার নিজের কোমরটি কত পাতলা।
প্রভাতফেরির সময় এই সব কথাই সুন্দর লালের মনে পড়ত। যদি একবার, শুধু একবার আবার লাজোকে পাই, তা হলে আমি তাকে আমার হৃদয়ে স্থান দেব। আর মানুষকে বলব যে এই বেচারি মেয়েরা যে বিপথে চলে যায়, তার জন্য তাদের কোনও দোষ নেই। তারা যে বদমাইশ লোকেদের লালসার শিকার হয়, তা নিজেদের কোনও ভুলের জন্য নয়। যে সমাজ এই নিষ্পাপ আর নির্দোষ নারীদের স্বীকৃতি দেয় না, তাদের আপন করে নেয় না, সেটি পচাগলা সমাজ, তার বিলোপ হওয়াই উচিত। তার মনে হচ্ছিল এই মহিলাদের পরিবারে পুনর্বাসন হওয়া উচিত এবং বাড়ির মা-বোন-মেয়েদের যে সম্মান প্রাপ্য তা তাদের দেওয়া উচিত। সে আরও বলত যে এমনকী ইশারা-ইঙ্গিতেও সেই নারীদের এমন ঘটনার কথা মনে করানো উচিত নয়, যা তাদের সঙ্গে ঘটেছে। তাদের লাঞ্ছিত হৃদয় স্বভাবতই দুর্বল, লজ্জাবতী লতার মত। একটু হাত দিয়েছ কী কুঁকড়ে যাবে।
সুতরাং ‘দিল মেঁ বসাও’ কর্মসূচির বাস্তব রূপায়ণের জন্য মুল্লা শুকুর মহল্লার কমিটি প্রভাতফেরির উদ্যোগ নিয়েছিল। ভোর চারটে-পাঁচটা তাদের পক্ষে উপযোগী সময় ছিল – জনকোলাহল, গাড়ির আওয়াজ এসব তেমন থাকত না। সারা রাত চৌকিদারি করা কুকুরগুলোও তন্দুরের মধ্যে মাথা গুঁজে বিশ্রাম নিত। নিজেদের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোর কানে যখন প্রভাতফেরির আওয়াজ পৌঁছোত, তখন তারা শুধু বিড়বিড় করে উঠত, ‘ও! আবার সেই দলটা।’ কখনও ধৈর্য ধরে, কখনও-বা বিরক্তি নিয়ে তারা বাবু সুন্দর লালের প্রচার শুনত। যেসব মহিলাদের সীমান্ত পেরিয়ে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি, তারা যেন ফুলকপির ফুলের মত নিজেদের বিছিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। তাদের স্বামীরা, যারা খড়ের আঁটির মত তাদের পাশে শুয়ে থাকত, তারা প্রভাতফেরির আওয়াজ শুনে বিড়বিড় করতে করতে বিরক্তি দেখাত। কখনও কোথাও কোনও বাচ্চা কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ খুলেই ‘দিল মেঁ বসাও’ কমিটির প্রচারকে আরেকটি ঘুমপাড়ানি গান মনে করে আবার চোখ বুজে ফেলত।
কিন্তু ভোরে যে শব্দ কানে শোনা যায়, তা বৃথা হয় না। সারা দিন সে কথাগুলো যেন মনের মধ্যে চক্কর কাটে। কখনও কখনও মানুষ হয়ত সে সব কথার মানে না বুঝলেও মুখে গুনগুন করে চলত। হয়ত সেই শব্দগুলোর সঙ্গে ধাতস্থ হয়ে যাওয়ার কারণে যখন মৃদুলা সারাভাই ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে বলপূর্বক অপহৃত মহিলাদের বিনিময়ের বন্দোবস্ত করলেন, তখন মুল্লা শুকুর মহল্লার কেউ কেউ সেই মহিলাদের পুনর্বাসনে রাজি হলেন। সেই মহিলাদের আত্মীয়রা শহরের বাইরে চৌকি কালান-এ তাঁদের আনতে গেলেন। কিছুক্ষণ সেই অপহৃত মহিলারা আর তাঁদের স্বজনেরা নিঃশব্দে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপরে তাঁরা নিজেদের বরবাদ হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোকে আবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তোলার জন্য রওনা দিলেন। রসালু, নেকি রাম আর সুন্দর লাল বাবুও কখনও ‘মহিন্দর সিং জিন্দাবাদ’, কখনও বা ‘সোহন লাল জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে তাদের উৎসাহিত করে চললেন যতক্ষণ পর্যন্ত না চিৎকার করতে করতে তাঁদের গলা শুকিয়ে গেল।
কিন্তু সেই অপহৃতা নারীদের মধ্যে এমন কেউ কেউ ছিলেন যাঁদের স্বামী, বাপ-মা অথবা ভাই-বোন তাঁদের চিনতে অস্বীকার করলেন। ‘ওরা মরে গেল না কেন?’ নিজেদের মান বাঁচাতে ওরা বিষ খেল না? কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ল না? ওরা ভীতু, ওরা জীবনের সঙ্গে লেপটে আছে। কত শত সহস্র নারী নিজেদের সম্মান লুট হয়ে যাওয়ার আগেই নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কি জানেন না যে জীবিত থাকলে কী সাহসের প্রয়োজন হয়? মৃতরা কি বুঝবে যে এই কঠিন পৃথিবীতে যেখানে স্বামী স্ত্রীকে চিনতে অস্বীকার করে, সেখানে বেঁচে থাকা কতটা দুষ্কর? তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনের গভীরে নিজেদের নামটাই হয়ত স্মরণ করত – ‘সুহাগবন্তী’ – বিবাহিত জীবনে যে সুখী হবে। হয়ত আপন ভাইকে বহু মানুষের ভিড়ের মধ্যে দেখে শেষমেশ এটুকু বলত, ‘বিহারি, তুইও আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি তোকে কত কোলে করে খাইয়েছি রে!’ আর সেই শুনে বিহারি আড়ালে সরে যেতে চাইত। তারপর মা-বাবার দিকে চাইত। মা-বাবা নিজেদের বুকে হাত রেখে নারায়ণ বাওয়ার দিকে দেখতেন। নারায়ণ বাবা অসহায় দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চাইতেন, সেই স্বর্গ যা সম্পূর্ণ অবাস্তব, শুধুই আমাদের দৃষ্টির সামনে এক মরীচিকা, যা সেই সীমাটি নির্দেশ করে যার পরে আমাদের দৃষ্টি পৌঁছোয় না।
কিন্তু মিস্ সারাভাই ফৌজিদের ট্রাকে করে যে মহিলাদের নিয়ে এলেন, তার মধ্যে লাজো ছিল না। সুন্দর লাল আশা-প্রত্যাশায় শেষ মেয়েটি ট্রাক থেকে না নামা পর্যন্ত দেখলেন। তারপরে অত্যন্ত নিঃশব্দে, গভীর প্রত্যয়ে কমিটির কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। এখন তিনি শুধু সকালে প্রভাতফেরির সময়ই যে বেরোন তা নয়, সন্ধ্যায়ও মিছিল বের করেন। কখনও-সখনও এক-আধটা ছোটোখাটো সভারও আয়োজন করেন যেখানে কমিটির বর্ষীয়ান সভাপতি উকিলবাবু কালিকা প্রসাদ সোনি গলা খাঁকারি দিতে দিতে একটা বক্তৃতা দিয়ে দিতেন। তার পাশে রসালু একটা পিকদান নিয়ে সব সময় তার দায়িত্ব পালন করে যেত। লাউডস্পিকার থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরোত। কখনও-বা চৌকির করণিক নেকি রাম কিছু বলার জন্য উঠত। কিন্তু তিনি যাই বলুন, শাস্ত্র-পুরাণের যতই উল্লেখ করুন না কেন, তার সবই তিনি যে লক্ষ্য নিয়ে বলেছেন তার বিপরীতে যেত। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সুন্দর লাল বাবুকে উঠতে হত। কিন্তু তিনি দুটি বাক্যের বেশি আর কিছুই বলে উঠতে পারতেন না। তাঁর গলার স্বর আটকে যেত, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ত। দুঃখ তাকে এমনই আচ্ছন্ন করত যে তিনি বক্তৃতা করতে না পেরে শেষমেশ বসে পড়তেন। কিন্তু মানুষের সে জমায়েত এক অদ্ভুত নিঃশব্দতায় ছেয়ে যেত। সুন্দর লাল বাবুর বাক্পটু হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা সেই দুটি বাক্য যেন উকিল কালিকা প্রসাদ সোনি-র পরামর্শদাতার ভঙ্গিতে বলা কথাগুলোর থেকে ওজনে ভারী বলে মনে হত। লোকে সে কথা শুনে সেখানেই কাঁদতে শুরু করত। মনের আবেগ প্রশমিত করার সুযোগ পেয়ে সভা শেষে নির্ভার হৃদয়ে ঘরে ফিরতে পারত।
একদিন কমিটির লোকেরা সন্ধ্যেবেলা প্রচার করতে বেরিয়ে রক্ষণশীলদের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত একটি পাড়ায় পৌঁছোল। মন্দিরের বাইরে একটি পিপুল গাছের নিচে সিমেন্ট-বাঁধানো বসার জায়গা। সেখানে বসে ভক্তরা রামায়ণ পাঠ শুনছিলেন। নারায়ণ বাবা রামায়ণের সেই অংশ পড়ে শোনাচ্ছিলেন যেখানে এক ধোপা তার ধোপানিকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলছে, ‘আমি রাজা রামচন্দ্র নই, যে সীতা এত বছর রাবণের সঙ্গে থাকার পরেও তাকে গ্রহণ করব। আর রামচন্দ্রজী তো পুণ্যবতী সীতাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমন সময়ে যখন সীতা গর্ভবতী। রাম রাজত্বের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কীই-বা পাওয়া যেতে পারে?’ নারায়ণ বাবা বললেন, ‘এই হল রাম রাজ! যেখানে একটি ধোপার বলা কথাও এতটা গুরুত্ব পায়।’
কমিটির মিছিল মন্দিরের পাশে এসে থেমেছিল। মানুষ রামায়ণের কথা আর শ্লোক শোনার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছিল। শেষ বাক্যটি শোনার পর সুন্দর লাল বলে উঠলেন:
‘আমি রাম রাজত্ব চাই না বাবা।’
‘চুপ করুন!’
‘তুমি কে?’
‘চুপ!’ ভিড়ের মধ্যে থেকে আওয়াজ আসতেই সুন্দর লাল আবার বললেন, ‘আমার কথা বলায় কেউ বাধা দিতে পারবে না।’ কিন্তু আবারও জনতার মধ্যে থেকে শোনা গেল, ‘চুপ!’
‘আমরা তোমাকে বলতে দেব না।’
আবার একটা কোণ থেকে কেউ বলে উঠল, ‘মেরে দেব।’
নারায়ণ বাবা মিষ্টি স্বরে বললেন, ‘সুন্দর লাল, তুমি শাস্ত্রের মান-মর্যাদা বোঝ না।’
সুন্দর লালের উত্তর, ‘আমি একটা কথা তো বুঝি বাবা। রাম রাজত্বে ধোপার কথা শোনা হলেও সুন্দর লালের কথা কেউ শোনে না।’
যারা একটু আগেই সুন্দর লালকে মারার জন্য দাঁড়িয়ে উঠেছিল, তারা আবার বসার জায়গায় থাকা পিপুলের ফুলগুলো ঝেড়েঝুড়ে বসে পড়ে বলল, ‘শোনো, শোনো, শোনো!’
রসালু আর নেকি রাম সুন্দর লালকে কনুই দিয়ে মৃদু ঠেলা দিলে তিনি বলে উঠলেন, ‘শ্রীরাম আমাদের নেতা ছিলেন। কিন্তু এ কেমন কথা বাবাজি? উনি ধোপার কথাকে সত্যি মনে করলেন, কিন্তু এত বড় মহারাণীর কথা সত্যি বলে বিশ্বাস করলেন না?’
‘হ্যাঁ বাবা,’ সুন্দর লালের উত্তর। ‘এ সংসারে এমন অনেক বিষয় আছে যা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু আমি সাচ্চা রাম রাজ বলতে তাই বুঝি যেখানে মানুষ নিজের ওপরও জুলুম খাটাবে না। নিজের সঙ্গে অন্যায় আচরণ তত বড়ই পাপ যতটা অন্য কারও প্রতি অন্যায় করা। এমনকী আজও ভগবান রাম সীতাকে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছেন। এই কারণে যে তিনি রাবণের কাছে ছিলেন। এতে সীতার কী দোষ? তিনি কি আমাদের অনেক মা-বোনেদের মতই ছলনা আর কপটতার শিকার হননি? প্রশ্নটা কি সীতার সততা অথবা অসততার, নাকি রাবণের শয়তানির? রাবণের ছিল দশটা মানুষের মাথা, কিন্তু আরেকটা আরও বড় মাথা ছিল যেটা গাধার।’
‘আজ নির্দোষ সীতাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সীতা লাজবন্তী,’ এই বলে সুন্দর লাল বাবু কেঁদে ফেললেন। রসালু আর নেকি রাম সেই সব লাল ঝাণ্ডাগুলো ওপরে তুলে ধরল যেগুলোতে আজই স্কুলের ছেলেমেয়েরা খুব পরিষ্কার করে স্লোগান লিখে সেঁটে দিয়েছিল। আর তারা ‘সুন্দর লাল বাবু জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চলল। মিছিলে কেউ বলে উঠল, ‘মহাসতী সীতা জিন্দাবাদ’, অন্য দিক থেকে আওয়াজ এল, ‘শ্রী রামচন্দ্রের জয়’।
তারপরে একসঙ্গে অনেককে বলতে শোনা গেল, ‘চুপ, চুপ!’ নারায়ণ বাবার কয়েক মাস ধরে করে চলা বক্তৃতা বৃথা গেল। আরও অনেক মানুষ মিছিলে যোগ দিল। মিছিলের সর্বাগ্রে উকিল কালিকা প্রসাদ আর চৌকি কালান এর মুহুরি হুকম্ সিং। তাদের নড়বড়ে ছড়িগুলো মাটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গুরুগম্ভীর আওয়াজ তুলছে। সেই মিছিলের কোথাও সুন্দর লালও তাদের সঙ্গে চলেছেন। তাঁর চোখ থেকে তখনও গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। আজ তাঁর মনে বড় একটা ধাক্কা লেগেছে। মিছিলে লোকেরা অতি উৎসাহভরে একে অপরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইছেন –
‘হাথ্ লাইয়াঁ কুমহ্লা নি লাজবন্তী দে বোটে’ –
এখন সে গানের আওয়াজ মানুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে। তখন ভোরও হয়নি। মুল্লা শুকুর মহল্লার ৪১৪ নম্বর বাড়ির বিধবা মহিলা নিজের বিছানায় উদ্বেগে আড়মোড়া ভাঙছেন। সুন্দর লালের গ্রামের লোক লাল চাঁদ, যাকে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে সুন্দর লাল আর কালিকা প্রসাদ একটা রেশন ডিপো-র লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছিলেন, দৌড়তে দৌড়তে এলেন। মোটা চাদরের আড়াল থেকে হাত বের করে বললেন, ‘অভিনন্দন, সুন্দর লাল!’
সুন্দর লাল ছিলিমে মিঠে গুড় ঠেসতে ঠেসতে শুধোলেন, ‘কীসের জন্য এই অভিনন্দন, লাল চাঁদ?’
‘ম্যাঁয় নে লাজো ভাবি কো দেখা হ্যায়।’
সুন্দর লালের হাত থেকে ছিলিম পড়ে গেল। মিঠে তামাক ফরাসে ছড়িয়ে পড়ল। ‘কোথায় দেখেছ?’
উনি লাল চাঁদের কাঁধ পাকড়ে প্রশ্ন করলেন, আর দ্রুত উত্তর না পেয়ে কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে থাকলেন।
‘ওয়াগাহ্-র সীমান্তে।’
সুন্দর লাল তাঁর হাত লাল চাঁদের কাঁধ থেকে সরিয়ে নিয়ে শুধু বললেন, ‘আর কেউ হবে।’
লাল চাঁদ তাঁকে আশ্বস্ত করে বলে উঠলেন, ‘না ভাই, সে লাজো-ই ছিল, লাজো...’
‘তুমি কি ওকে চেনো?’
সুন্দর লাল ফরাসে ছড়িয়ে পড়া মিঠে তামাক তুলে নিয়ে হাতের তালুতে ডলতে ডলতে জিগ্যেস করলেন। তিনি রসালুর হুঁকো থেকে ছিলিমটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, বলো কী চিহ্ন দেখে তাকে চিনলে?’
‘চিবুকে একটা উল্কি আছে। আরেকটা আছে গালে...’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ সুন্দর লাল নিজেই বর্ণনা সম্পূর্ণ করলেন, ‘আর তৃতীয় উল্কিটি আছে তার কপালে।’
যেন সুন্দর লাল চাইছেন না যে লাজোকে চেনার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকে। লাজবন্তীর শরীরের সব উল্কির চিহ্ন যেন তিনি স্মরণ করলেন যা সে ছোটবেলায় নিজের শরীরে আঁকিয়ে নিয়েছিল। সে উল্কির হালকা সবুজ ফুটকিগুলো যেন লজ্জাবতী লতার চারাগাছে দেখা যায়, আর সেদিকে ইশারা করলেই লতা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ঠিক সেই রকম ওই উল্কি চিহ্নগুলোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেই লাজবন্তী লজ্জায় লাল হয়ে যেত। নীরব হয়ে যেত। নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে যেত। যেন তার যা কিছু গোপন, তা কারও কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। তার কোনও অজানা সম্পদ লুট হয়ে যাওয়ায় সে যেন অভাবী হয়ে পড়ল। সুন্দর লালের সারা শরীর যেন এক অজানা ভয়, এক অজানা ভালোবাসার পবিত্র আগুনে পুড়ছে। তিনি আবার লাল চাঁদের কাঁধ জাপটে ধরে জিগ্যেস করলেন, ‘লাজো ওয়াগাহ্তে কীভাবে পৌঁছোল?’
লাল চাঁদ বললেন, ‘হিন্দ্ আর পাকিস্তানের মধ্যে মহিলাদের আদান-প্রদান চলছে না।’
‘তারপরে কী হল?’ সুন্দর লাল হাঁটু ভাঁজ করে উবু হয়ে বসতে বসতে শুধোল, ‘কী হল তারপর?’
রসালুও নিজের চারপাইয়ের ওপর উঠে বসল। তামাকপ্রেমীদের সেই অনন্য কাশির দমক তুলতে তুলতে বলল, ‘সাচ্মুচ্ আ গয়ি হ্যায় লাজবন্তী ভাবি?’
লাল চাঁদ আরও বলে চলে, ‘ওয়াগাহ্-তে পাকিস্তান ষোল জন মহিলাকে পাঠিয়ে তাদের বিনিময়ে ষোল জনকে নিয়ে গেছে। কিন্তু একটা ঝগড়া শুরু হল। আমাদের ভলাণ্টিয়ারেরা অভিযোগ করেছিল যে তোমরা যে মহিলাদের পাঠিয়েছ, তাদের মধ্যে অধিক সংখ্যক মাঝবয়েসি, বুড়ি অথবা অযোগ্য মহিলা আছে। এই বিতর্কের কারণে ভিড় জমে যায়। সেই সময় ওপারের ভলাণ্টিয়াররা লাজো ভাবির দিকে দেখিয়ে বলে, ‘তোমরা ওকে বুড়ি বলছ? দেখো, দেখো! তোমরা যতজন আওরতকে দিয়েছ, তাঁদের মধ্যে একজনও ওঁর সমান আছে? আর সেখানে তখন লাজো ভাবি সকলের সামনে নিজের উল্কি চিহ্নগুলো ঢাকার চেষ্টা করছে।’
‘তারপরে ঝগড়া আরও তীব্র হয়ে উঠল। দু’তরফে নিজের নিজের “মাল” ফিরিয়ে নেওয়ার ভয় দেখানো শুরু হল। আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘লাজো – লাজো ভাবি!’ কিন্তু আমাদের ফৌজের সিপাহিরা আমাকে মারতে মারতে সেখান থেকে হটিয়ে দিল।’
এই বলে লাল চাঁদ তার কনুই দেখাল যেখানে লাঠির বাড়ি পড়েছিল। রসালু আর নেকি রাম নিঃশব্দে বসে, সুন্দর লালের দৃষ্টি যেন দূরে কোথাও নিবদ্ধ। হয়ত তিনি ভাবছিলেন যে লাজো এসেও এল না। সুন্দর লালের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে তিনি বিকানীরের মরুভূমিতে কিছু খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, আর এখন কোনও গাছের ছায়ায় জিভ বের করে হাঁপাচ্ছেন। ‘জল দাও’ – এই সামান্য বাক্যটি বলার শক্তিও যেন তাঁর নেই। তাঁর যেন মনে হচ্ছে যে দেশভাগের আগের হিংসাত্মক পরিবেশ যেন দেশভাগের পরেও বহাল আছে। শুধু তার রূপ বদলে গেছে। এখন যেন মানুষের মধ্যে আগের অনুতাপও নেই। যে কাউকে জিগ্যেস করুন। সানভরওয়ালা-তে লহ্না সিং নামে একজন ছিল। আর তার ভাবি বানতু-ও ছিল। ঝটপট উত্তর আসবে, ‘মরে গেছে’। আর এই বলেই সেই উত্তরদাতা এগিয়ে যাবে, মৃত্যুর অর্থ সম্পর্কে তিনি যেন সম্পূর্ণ অসচেতন। এর চাইতেও খারাপ আছে। সেই সব শীতল হৃদয়ের ব্যবসায়ী যারা মানুষকে পণ্য বলে মনে করে, মানুষের মাংসের আর চামড়ার ব্যবসা করে, সেই পণ্যের আদানপ্রদান করে। গবাদি পশুর ব্যবসায়ীরা যেমন গরু-মোষের চোয়াল ঠেলে সরিয়ে তাদের দাঁত দেখে বয়েস আন্দাজ করার চেষ্টা করে।
এখন তারা যুবতীদের রূপ, তাদের পরিশীলিত রুচি, তাদের গূঢ় গোপনীয়তা, তাদের সৌন্দর্য-চিহ্ন, তাদের উল্কিগুলোকে জনগণের সামনে প্রদর্শনের জন্য রাখছে। এই নিপীড়নমূলক আচরণ ব্যবসায়ীদের হাড়ে-রক্তে প্রবেশ করেছে। আগে মাণ্ডিগুলোতে জিনিসপত্র বিক্রি হত। দরদামের পর রফা হলে ব্যবসায়ীরা রুমালে হাত ঢেকে চুক্তি করত। রুমালের নিচে আঙুলের ইশারায় সওদা সম্পন্ন হত। সে রুমালের ‘আড়ালও’ আজ সরে গেছে। সামনা-সামনি ব্যবসা হয়ে চলেছে, মানুষ ব্যবসার আদব-কায়দাও ভুলে গেছে। এই সব ‘লেনদেন’, এই কারবার যেন আগেকার দিনের গল্পের মত মনে হয় যাতে নারীদের নিয়ে খোলামেলা বেচাকেনার কাহিনী বর্ণনা করা হত। উজবেকিস্তানের ক্রেতার সামনে অগণিত নগ্ন মহিলাদের সার বেঁধে দাঁড় করানো হত। সে ক্রেতা মহিলাদের শরীর আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে দেখত। ক্রেতার আঙুল যেখানে স্পর্শ করত, সেখানে গোলাপি টোল আর তার চারদিকে ফ্যাকাশে গোলাকার দাগ ফুটে উঠত। তারপরে গোলাপি আর ফ্যাকাশে রঙ একে অপরের স্থান দখল করতে ছুটে যেত। উজবেক ক্রেতা এগিয়ে যেত, আর যে মহিলা অযোগ্য বিবেচিত হলেন, তিনি অপমান আর লজ্জায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেন, তাঁর এক হাত নিম্নাঙ্গের পোশাকের আলগা হয়ে যাওয়া দড়ি ধরে রেখেছে, আরেক হাত জনগণের নজর থেকে তার মুখটি ঢাকতে যেন ব্যস্ত। তারপরে সে লজ্জার অনুভূতিটাও যেন আর রইত না। আলেকজান্দ্রিয়ার বাজারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছেন নগ্ন এক নারী....
সুন্দর লাল সীমান্তের শহরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, যখন তাঁর কাছে লাজো-র আগমনের সংবাদ এল। একেবারে এমন একটি খবর পাওয়ায় সুন্দর লাল একটু ঘাবড়েই গেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দরজার দিকে এক পা বাড়ালেও পিছিয়ে এলেন। মন চাইছিল সব ছেড়ে দিয়ে কমিটির যত ব্যানার আর পতাকা আছে সেগুলো ছড়িয়ে বসে কাঁদতে, কিন্তু সেখানে আবেগের এমন প্রদর্শন সম্ভব ছিল না। তিনি পুরুষ মানুষের মত ভেতরের এই টানাপোড়েনের বিরুদ্ধে যুঝলেন। এক পা এক পা করে চৌকি কালানের দিকে এগিয়ে চললেন। কারণ সেখান থেকেই অপহৃতা মহিলাদের ডেলিভারি দেওয়া হত।
লাজো সামনে দাঁড়িয়ে আবেগে-দুঃখে কাঁপছে। সেই সুন্দর লালকে চিনত। সে ছাড়া আর কেউ তাঁকে জানত না। সুন্দর লাল আগে থেকেই তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। আর এখন যখন সে অন্য এক পুরুষের সঙ্গে দিন কাটিয়ে এসেছে, তখন সে না জানি কী করবে! সুন্দর লাল লাজো-র দিকে চাইলেন। সে খাঁটি মুসলমান মহিলাদের মত শরীরের ওপর দিকে দোপাট্টা জড়িয়ে তার এক প্রান্ত বাঁ কাঁধের ওপর ফেলে রেখেছিল। অভ্যাসবশে – শুধুই অভ্যাসের কারণে। উদ্দেশ্য ছিল অন্য মহিলাদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশে যাওয়া যাতে শিকারির ফাঁদ থেকে পালানো সহজ হয়। সে সুন্দর লালের চিন্তায় এমন গভীরভাবে মগ্ন ছিল যে পোশাক বদলানো অথবা দোপাট্টা ঠিকভাবে পরার দিকে তার নজর ছিল না। হিন্দু আর মুসলমানদের প্রাথমিক সাংস্কৃতিক পার্থক্য: ডান আঁচল আর বাঁ আঁচল – এই দুইয়ের মধ্যে তফাত করার সামর্থ্য তখন তার ছিল না। সে সুন্দর লালের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল – আশা আর হতাশার মধ্যে দুলতে দুলতে।
সুন্দর লালকে যেন কেউ ধাক্কা দিল। সে দেখল যে লাজবন্তীর গায়ের রঙ যেন আগের তুলনায় উজ্জ্বল হয়েছে, তার স্বাস্থ্যও যেন ভালো হয়েছে। না, সে যেন বেশ মোটাই হয়েছে। লাজো সম্পর্কে সুন্দর লাল যা কিছু ভেবে রেখেছিল, তার সবই ভুল ছিল। সে ভেবেছিল দুঃখে পীড়িত হয়ে লাজবন্তী আরও শীর্ণকায় হয়ে গেছে, তার মুখ থেকে হয়ত আওয়াজই বেরোবে না। লাজবন্তী পাকিস্তানে বেশ আনন্দেই ছিল একথা ভেবে সুন্দর লাল গভীর দুঃখ পেল। কিন্তু সে চুপ করেই রইল কারণ সে চুপ করে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিল। লাজো যদি সেখানে এতই সুখে ছিল, তা হলে সে ফিরেই বা এল কেন? সুন্দর লাল ভাবে যে হয়ত হিন্দুস্তানের সরকারের চাপে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় তিনি বুঝতে পারছিলেন না। তা হল এই যে লাজবন্তীর তামাটে মুখে যে ফ্যাকাশে ভাব তা শুধু কষ্ট সহ্য করার কারণে। আর সেই যন্ত্রণার ফলেই তার সুঠাম শরীর এলিয়ে পড়েছে এবং তাকে দেখে ‘মোটা’ আর ‘স্বাস্থ্যবতী’ বলে মনে হচ্ছে। এই রকম স্বাস্থ্যবতীরাই দু-কদম পথ চলেই হাঁপিয়ে পড়ে।
অপহৃতা স্ত্রীর প্রথম দর্শনে সুন্দর লাল হতবাক হয়ে গেলেও তিনি তাঁর চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পুরুষোচিত শৌর্যে লড়াই করে চলছিলেন। আরও অনেকে সেখানে উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘মুসলমানদের উচ্ছিষ্ট এই মেয়েদের আমরা ফিরিয়ে নেব না।’
আর সে আওয়াজ রসালু, নেকি রাম আর চৌকি কালান-এর বুড়ো মুহুরির স্লোগানের আওয়াজে চাপা পড়ে গেল। এই সব আওয়াজ থেকে আলাদা ছিল কালিকা প্রসাদের ভাঙা গলার চিৎকারের আওয়াজ। তিনি কাশতে কাশতেই কথা বলে চলতেন। তিনিও এই নতুন বাস্তব, এই নতুন শুদ্ধিকরণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। মনে হচ্ছিল যে তিনি আজ থেকে কোনও নতুন বেদ, নতুন পুরাণ আর শাস্ত্র পড়তে শুরু করেছেন, আর নিজের জ্ঞানভাণ্ডারের এই নতুন সংযোজনে অন্যদেরও শামিল করতে চাইছেন। এই সব মানুষ আর আওয়াজকে সঙ্গে করেই লাজো আর সুন্দর লাল তাঁদের ডেরার দিকে রওনা হল। মনে হল যেন হাজার বছর আগে রামচন্দ্র আর সীতা নীতিগত কারণে এক সুদীর্ঘ বনবাসের শেষে বুঝি-বা অযোধ্যায় ফিরছেন। একদিকে তো মানুষ খুশিতে সারি সারি দীপ জ্বালিয়ে রাখছে। অন্যদিকে তাঁদের এই দীর্ঘ সময় যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য অনুতাপও করছে।
লাজবন্তীর প্রত্যাবর্তনের পরেই সুন্দর লাল বাবু পূর্বের ন্যায় প্রত্যয়ের সঙ্গে ‘হৃদয়ে পুনর্বাসন’ কর্মসূচি চালু রাখলেন। তিনি সে দায়িত্ব পালনে কথা আর কাজের মধ্যে কোনও ফারাক রাখেননি। যাঁরা কর্মসূচির সঙ্গে তাঁর যুক্ত থাকা নিছক ভাবাবেগের বশে আদর্শের পেছনে দৌড়নো বলে মনে করতেন, তাঁদেরও প্রত্যয় বাড়তে থাকল। কেউ কেউ খুশি হলেও অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এটা আফশোসের কারণ হয়েছিল। মুল্লা শুকুর মহল্লার ৪১৪ নম্বর বাড়ির বিধবা মহিলা ছাড়া পাড়ার অনেক মহিলাই সুন্দর লাল বাবুর বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে অস্বচ্ছন্দ বোধ করতেন।
কিন্তু সুন্দর লাল কারও উদ্বেগ অথবা নিরুদ্বেগের পরোয়া করতেন না। তাঁর দিল-কি-রানি এসে গেছে, তাঁর হৃদয়ের গভীর গর্তটি ভরে গেছে। সুন্দর লাল লাজো-র সোনার মূর্তি আপন হৃদয়ে স্থাপন করেছিলেন, আর নিজে দরজার কাছে পাহারায় বসে তাকে সুরক্ষিত রাখতেন। লাজো, যে প্রথম দিকে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত, সুন্দর লালের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে নরম ব্যবহার পেয়ে আস্তে আস্তে নিজেকে মেলে ধরছিল।
সুন্দর লাল লাজবন্তীকে আর লাজো বলে ডাকতেন না। তাঁকে ‘দেবী’ বলতেন। আর লাজো এক অজানা খুশিতে পাগল হয়ে যেত। সে ভীষণ চাইত সুন্দর লালকে তার অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে, কথা বলতে বলতে কাঁদতে – যে কান্নায় তার সব পাপ ধুয়ে মুছে যাবে। কিন্তু সুন্দর লাল সে সব প্রসঙ্গ উঠুক তা চাইতেন না। আর প্রস্ফুটিত হতে হতেও লাজো যেন সিঁটিয়ে থাকত। সুন্দর লাল শুয়ে পড়লে লাজো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। কখনও-সখনও ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে ধরাও পড়ে যেত। সুন্দর লাল কারণ জিগ্যেস করলে লাজো ‘না, না, ও কিছু না,’ ছাড়া আর কিছু বলতে পারত না। সারা দিনের পরে ক্লান্ত সুন্দর লাল লাজবন্তীর ‘কালো দিনগুলো’ সম্পর্কে শুধু এইটুকুই জানতে চাইত: ‘সে কে ছিল?’
লাজবন্তী চোখ নামিয়ে বলত, ‘জুম্মা’। তারপরেই সুন্দর লালের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে সে কিছু বলতে চাইত। কিন্তু সুন্দর লাল এক অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে লাজবন্তীকে দেখতেন আর তার চুল নিয়ে খেলতে শুরু করতেন। লাজবন্তী আবার চোখ নামিয়ে নিলে সুন্দর লাল জিগ্যেস করতেন, ‘সে ভালো ব্যবহার করত?’
‘হ্যাঁ।‘
‘মারত না তো?’
লাজবন্তী সুন্দর লালের বুকে মাথা রেখে বলত, ‘না। সে না মারলেও অমি তাকে আরও ভয় পেতাম। তুমি আমাকে মারলেও আমি তোমাকে ভয় পাই না। এখন তো আর মারবে না?’
সুন্দর লালের চোখ জলে ভরে উঠত। তিনি আফশোস আর লজ্জায় বলে উঠতেন, ‘না দেবী! এখন আর নয়। মারব না....’
‘দেবী!’ লাজবন্তী ভাবে। তার চোখেও জল।
তারপরে লাজবন্তী সম্পূর্ণ কাহিনী বর্ণনা করতে চাইলেও সুন্দর লাল বলে উঠত, ‘সে সব পুরোনো কথা যেতে দাও। এতে তোমার কী দোষ? কসুর আমাদের সমাজের যে তোর মত দেবীদের মর্যাদায় স্থান দেয় না। তাতে তোমার ক্ষতি হয় না, ক্ষতি সমাজের।’
লাজবন্তীর গোপন কথা তার মনেই থেকে যায়। তার সব কথা বলা হয়ে ওঠে না। রেখে ঢেকে রাখে। সে নিজের শরীরের দিকে চেয়ে দেখে। দেশভাগের পর যে শরীরটি এক ‘দেবী’র শরীর হয়ে উঠেছে। লাজবন্তীর সে দেহ আর নেই। সে খুশি ছিল, খুবই খুশি। খুশির মৌতাতে বুঁদ হলেও তাতে প্রচ্ছন্ন ছিল সন্দেহ আর ভয়। সে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ উঠে বসত। যেমন ভীষণ খুশির মুহূর্তে কোনও পায়ের শব্দ পেলে সঙ্গে সঙ্গে কারও মন সেদিকে ধাবিত হয়।
এইভাবে যখন অনেক দিন কেটে গেল, তখন সেই খুশিকে সম্পূর্ণ মুছে দিল সন্দেহ। এজন্য নয় যে সুন্দর লাল বাবু আবার সেই আগের মত খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করলেন। বরং এই কারণে যে তিনি লাজো-র সঙ্গে অতিরিক্ত ভালো ব্যবহার করছেন। এমন আচরণ যে লাজোর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল! সুন্দর লালের কাছে সে সেই পুরোনো লাজো হয়ে উঠতে চাইছিল যে গাজর নিয়ে ঝগড়া করত, আবার পর মুহূর্তেই মুলোতে যার মান ভাঙত। কিন্তু এখন সে খুনসুটি আর ঝগড়া কোথায়? সুন্দর লাল তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে কাঁচের জিনিসের মত ভঙ্গুর। সে যেন ছুঁলেই ভেঙে যাবে। লাজো আয়নায় তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতে দেখতে ভাবত, আর শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে পোঁছোত যে সে আর সব কিছু হয়ে উঠতে পারলেও লাজো আর কখনও হবে না। তার পুনর্বাসন হলেও সে নষ্ট হয়ে গেছে। সুন্দর লালের সে চোখ নেই যে তার অশ্রু দেখতে পাবে, সে কান নেই যে তার দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনবে।
প্রভাত ফেরি এখনও বেরোয়। মহল্লা মুল্লা শুকুরে সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে রসালু আর নেকি রামকে সঙ্গে নিয়ে বাবু সুন্দর লাল আগের মতই এখনও গেয়ে ওঠেন –
‘হাথ লাইয়াঁ কুমহ্লাঁ নি, লাজবন্তী দে বোটে.....’