‘উঁহুউঁহু, বড়গুলো আলাদা কর, হুঁ, একদম বেছে বেছে রাখ। কটা হল?’
মাছওয়ালা গুনতে গুনতে, ‘এই...সবসুদ্দু হল ন-টা।’ মাছগুলোর সাইজ দেখে মনে মনে বেশ খুশিই অর্ধেন্দুশেখর।
‘ন’টা? আচ্ছা ঠিক আছে, ওতেই হবে। নে এবার ওজন করে বল কত দিতে হবে।’
‘আটশ গেরাম হয়েছে বাবু। ছ’শো টাকা কেজি দরে দাম হল গিয়ে চারশো আশি।’
‘দিনে ডাকাতি শুরু করলি দেখি!’
‘কি যে বলেন বাবু, কই মাছের যা দাম, পড়তায় পোষায় না। ওই জন্যিই তো...’
‘থাক থাক, বুঝেছি। আর গপ্পো ফাঁদতে হবে না। শোন, আমি পুরোপুরি চারশই দেব।’
‘না বাবু, কম নিতে পারবনা।’
‘তা বলে তুই যা দাম বলবি সেটাই দিতে হবে আমাকে, অ্যাঁ!’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, রাগ করেন কেন। আর পঞ্চাশটা টাকা দেন। এর কমে পারবনা। আপনি অনেকদিনের খদ্দের, সক্কালবেলায় বউনির সময় ...’
‘হুঁ, বুঝিস তো সব, শুধু দাম কমাবার বেলায় ....যাক গে, নে ধর। ওগুলো ঠিক করে কাটিয়ে রাখ। আমার এখনও অনেক কিছু নেওয়ার আছে, আমি ঘুরে আসছি।’
‘কী ব্যাপার দাদা, কোন বিশেষ অতিথি মনে হচ্ছে?’পেছন থেকে অর্ধেন্দুর পিঠে হাত রাখল সরোজ পোদ্দার।
‘না রে ভাই, অন্য কেউ না, বাবুনের ওবেলা আসার কথা, তাই...’
‘ও, ছেলে আসছে, তাই বলো! তা কদিনের জন্য? বউমা আর নাতিও আসছে তো?’
‘হুঁ, কথা তো আছে এক সপ্তার জন্য আসার। দেখি কি হয়! পুজোর সময় আসবে বলে তো আসতেই পারল না, ছুটিই পেল না। আচ্ছা, এখন চলি বুঝলে, দেরি হলে তোমার বৌদি আবার...’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি এগোও। বিকেলে পার্কে আসছ নাকি?’
‘ইচ্ছে তো আছে।’ বলেই ভিড় ঠেলে তড়িঘড়ি এগোলেন অর্ধেন্দুশেখর।
অর্ধেন্দুশেখর গাঙ্গুলি, রাজ্য সরকারের সমবায় দফতরে আধিকারিক ছিলেন। অবসর নিয়েছেন তা প্রায় বছর পাঁচেক হল। একটিই ছেলে – বাপ্পাদিত্য। সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বেঙ্গালুরুতে একটা নামকরা কম্পানিতে আছে। ফ্ল্যাটও কিনে নিয়েছে ওখানে। বাড়িভাড়া এত বেশি যে তার থেকে মাসে মাসে ই.এম.আই. গোনা সহজ। উপরন্তু, একটা নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁইও হয়ে যায়। বাপ্পার স্ত্রী শ্রেয়সীও একটা এম.এন.টসি.-তে এইচ্ আর। নাতি দিব্যর এখনও দুই হয়নি, দিনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটে প্লে-স্কুল আর ডে-কেয়ারে। শ্রেয়সীর মা নেই। আর মহাশ্বেতা, মানে বাপ্পাদিত্যর মায়ের পক্ষে বেঙ্গালুরুতে দীর্ঘ সময় ধরে থাকা সম্ভব নয়। অর্ধেন্দুশেখরের হার্টে স্টেন্ট বসেছে বছর তিনেক আগে। সেই মানুষকে কাজের লোকের ওপর ছেড়ে যাওয়া যায় না। আবার কলকাতায় নিজেদের বাড়ি বন্ধ করে দুজনে মিলে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে দীর্ঘদিন থাকাও সম্ভব হয় না। ষাটোর্ধ দম্পতিদের অধিকাংশেরই আজকাল এইরকম টানাপোড়েনে নাজেহাল হতে হয়, যাদের ছেলেমেয়েরা ভিন রাজ্যে সেটেল্ড চাকরির সূত্রে।
‘মনে করে সব এনেছ তো, যা যা বলেছিলাম?’
‘হ্যাঁ গো, একদম লিস্ট মিলিয়ে এনেছি, দেখে নাও।’ ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বললেন অর্ধেন্দুশেখর।
মহাশ্বেতা এক কাপ চা এনে রাখলেন টেবিলে, সঙ্গে দুটো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট।
‘সেকি! এই অসময়ে আমায় চা দিলে যে বড়!’
‘এত বাজার করেছ, ক্লান্ত হয়ে গেছ না, তাই...ই’ হাসলেন মহাশ্বেতা।
‘আহ্।’ চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটল অর্ধেন্দুশেখরের ঠোঁটে।
‘বুঝলে শ্বেতা, কইগুলোর যা সাইজ না, খুব পছন্দ হবে তোমার। তেল কই রাঁধতে পারবে জম্পেশ করে। মাছটাছ তো আর সেরমভাবে পায় না ছেলেটা। কতদিন পর আসছে বলো তো?’
‘তা প্রায় বছর দুই তো হলই।’
‘হুঁ, প্রতিবারই আসবে আসবে করেও আসা হয় না। দাদুভাই হওয়ার পর আমরা গিয়ে মাস দুয়েক কাটিয়ে এসেছিলাম। তা সেও তো বড় হয়ে গেল এরমধ্যে। শুধু ছবিতেই দেখি, মাঝে মধ্যে ভিডিও কল, ব্যাস! ওতে কি আর সাধ মেটে?’
‘হ্যাঁ গো, খুব ইচ্ছে করে দাদুভাইকে কাছে পেতে। সেই ছোট্টটি ছিল, আমার কোলে পিঠে। কত কিছু বলতে শিখে গেছে সে এখন!’
‘হুঁ, দেখবে না, এবারে এলে দাদাকে বাংলা ছড়া শিখিয়ে দেব কয়েকটা!’
‘তোমার কাছে কত থাকবে, তোমাকে চেনে নাকি?’
‘তোমায় চেনে বুঝি?’
‘বা রে, আমার কোলে ছিল না জন্মের পর, ঠিক গন্ধে গন্ধে চিনে যাবে, দেখে নিও,’ বলতে বলতেই ‘এই রে, দুধটায় পোড়া লেগে গেল বোধহয়! একটা জিনিষে একটু নজর না দিলেই ....লক্ষ্মীর মা, ও লক্ষ্মীর মা ....’ রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলেন মহাশ্বেতা।
পড়ন্ত বিকেল। ঠিক গোধূলি বলা যায় না। তবু দিনান্তের এক খণ্ড আকাশে ছড়িয়-ছিটিয়ে নানান রঙ। পার্কের বেঞ্চে বসে আকাশ দেখছিলেন অর্ধেন্দুশেখর। ইচ্ছেমত ভেসে ভেসে যায় মেঘের দল। সূর্যোদয় সূর্যাস্তের রঙে রাঙিয়ে নেয় নিজেদের পাল। আর এই চলাচলের ফাঁকে আঁকা হয় কত ছবি আকাশের গায়ে। দেখতে বেশ লাগে অর্ধেন্দুশেখরের। আচ্ছা, ছেলেবেলায় বর্ধমানের বাড়ির ছাদের আলসে থেকে দেখা মেঘের দলও কি আছে এদের মধ্যে! তন্ময়তা ভাঙল সরোজের ডাকে।
‘কি হল অর্ধেন্দুদা, কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছ না?’
সম্বিত ফিরে পেয়ে অর্ধেন্দু বলেন – ‘ওহো, একেবারে খেয়াল করিনি, কখন এলে?’
‘এই তো। তা তুমি তো আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, বাবুনরা কখন আসছে?’
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে অর্ধেন্দু বললেন, ‘নাঃ, আমার কোন তাড়া নেই।’
‘কেন? ওদের ফ্লাইট বুঝি অনেক রাত্তিরের?’
‘না সরোজ, ওরা আসছে না।’
‘সে কি!’ সরোজের গলার স্বর উচ্চকিত। ‘কেন?’
‘বাবুনের অফিসে কনফারেন্স আছে, তিন দিন ধরে চলবে। তাছাড়া, শ্রেয়সীর শরীরটাও ঠিক ...।’
‘তা ওরা কি আগে জানত না? তোমাকে ফোন করেছিল?’
‘না, কনফারেন্সটা হঠাৎই ঠিক হয়েছে, ফরেন ডেলিগেটসরা আসছে, সব তো ওকেই সামলাতে হবে। বাবুন মেসেজ করেছে আমাকে।’
‘ইস...তুমি কত আশা করে এত বাজার করলে...’
‘যাকগে, সেসব ভেবে আর কি লাভ! কাজ পড়ে গেলে তো আর ...’
‘হুঁ, তবে এইসব কর্পোরেটের হালচাল আমার ঠিক বোধগম্য হয় না দাদা। প্রয়োজনে কেউ পাওনা ছুটিও নিতে পারবে না, এ কিরকম কথা।’
‘আসলে এই সব জায়গায় পারফরমেন্সের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে তো! তা তুমি দাঁড়িয়ে কেন, বসো!’
‘না, বসলে হবে না, এখনই যেতে হবে।’
‘সে কি, এই তো এলে !’
‘মিসেস-কে একবার ডাঃ ব্যানারজিকে দেখাতে হবে। কদিন ধরে শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। আজকে তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি।’
‘ও, তাহলে তো তোমার আর দেরি করা ঠিক হবে না।’
‘হুঁ, চলি দাদা।’
‘এসো।’
সরোজ চলে গেছে অনেকক্ষণ। আজ পার্ক বেশ ফাঁকা। অনেকেই অনুপস্থিত। দূরে মাঠে একদল ছেলে খেলাধুলো করছে। এক প্রৌঢ় দম্পতি মোরাম বিছানো রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। ঝালমুড়িওয়ালা একটা হাঁক দিয়ে গেল। এই খণ্ডচিত্রটা মনের ইজেলে লগ্ন হয়ে গেছে। অর্ধেন্দুর মনে হচ্ছে চারপাশে গাছগাছালি, পাখিদের ঘরে ফেরার কলকাকলি, এইসব--সমস্ত কিছু নিয়ে জীবনটা যদি এখানেই থমকে যেত! এত অনৃতের জাল বুনতে আর ভাল লাগে না এই বয়সে। বাবুন মেসেজ করেছে কিছুক্ষণ আগে ঠিকই, তবে তাতে এত বিস্তারিত কিছু ছিল না। শুধু দুটো লাইন – ‘আসতে পারছি না। জরুরি কাজ পড়ে গেছে।’ ব্যাস! বাড়ি ফিরে কী বলবেন মহাশ্বেতাকে? বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট। চারিয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীরে। আচ্ছা, সব কিছু ভুলে – বাবুনের অনুভুতিহীনতা, মহাশ্বেতার কান্না, সব, সব ভুলে যদি এখানেই, এই মুহূর্তে, ছোটবেলার সেই খেলাটার মত কেউ পেছন থেকে অর্ধেন্দুকে বলে উঠত – ‘স্ট্যাচু!’ আর অর্ধেন্দু এখানেই ফ্রিজ করে যেতেন!