গগনচুম্বী বাড়িটার মাথার ওপর থেকে কিছুদিন আগেও আগুনের ফুলকি খসে পড়তে দেখা যাচ্ছিল। তবে যে সে আগুন নয়, একেবারে ফুলঝুরির আগুন! সন্ধ্যার খবরটা একদম মিস করত না দীপ্তরূপ। কেননা সারাদিনের অফিসের কাজকর্ম ভার্চুয়াল মিটিং আরও কিছু ঝুটঝামেলা যেসব থাকত, মিটিয়ে সোফায় বসে মায়ের গায়ে ঠেস দিয়ে খবর শুনত সে। এটা একপ্রকার পুরোনো অভ্যাস ছিল ওর। দীপ্তরূপ দেশের জনপ্রিয় মেডিসিন রিপ্রেজেন্টেটিভদের মধ্যে একজন। বিশ্বের নামীদামি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার সাথে ওর নিত্য ওঠাবসা। ভালো কোনও খবর এলেই লাফিয়ে উঠত দীপ্তরূপ। দৌড়ে চলে যেত ছাদে। মুঠোমুঠো ফুলঝুরি পুড়িয়ে চিৎকার করে পাড়া জাগিয়ে নিচে নেমে আসত।
মা সুমিতা দেবী এখন মন খুলে কাশছেন। বাবা ভাস্বরজ্যোতিও সকলপ্রকার ভয়ভীতি সরিয়ে লাঠি ঠুকে বাইরে বেরিয়ে পড়েন। আর ফাঁক পেলেই পাশের ফ্ল্যাটের ছোটছোট বাচ্চাকাচ্চাদের দিকে হাত নেড়ে মজা করে বলেন,“কী রে ক্যারিয়ার, আয় ছুঁয়ে দে। কালই আমার খোকা ভ্যাকসিন এনে দিয়েছে। এই দেখ এই হাতে একটা নিয়েছি এই হাতে আরেকটা। আসছে শুক্কুরবার নাকেও একটা নেব!”
এখন সবার চোখেমুখে অদ্ভুত এক আলো! কেবল কুহেলী হাসে না। কুহেলী দীপ্তরূপের স্ত্রী। হাসলেও অল্প একটুখানি দায়সারা গোছের ঠোঁট চিকিয়ে সরে পড়ে। কিম্বা ঘর অন্ধকার করে দিয়ে ব্যালকনির এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে পালকের চেয়েও হালকা হতে ইচ্ছে হয় দীপ্তরূপের। পারে না। একটি নামহারা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্তরূপ। যেদিন জেনার ইনস্টিটিউট ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগে সারার সাফল্যের কথা দীপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ঠিক সেইদিন গাছটিকে রীতিমত পাড়া জাগিয়ে পুঁতেছিল সে! এবার কুহেলীকে দেখে ওপরে উঠে এল দীপ্তরূপ। ভাবল কুহেলী বুঝি গাছটাকে দেখছে। কিন্তু না। কখন যে সে আকাশের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিয়েছে হয়ত নিজেও জানে না। এবার দীপ্ত আরও কাছাকাছি এসে এক হাতে খোলা পিঠের ওপর থেকে কেশরাশি সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী দেখছ কুহেলী? নতুন কোনও অনুসন্ধান?”
কুহেলী আকাশে আবিষ্ট থেকেই যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, “কই না তো! আমি আবার কী অনুসন্ধান করতে যাব! আমার জন্যে কেবলই আছে সাবেকি সেই তারাখসা!”
দীপ্ত চুপ করে থাকে। এবার কী জানি কী মনে হতেই কুহেলী আবারও বলে ওঠে, “সত্যিকথা বলতে কী এমন আলোয় আমার আদৌ কোনও আসক্তি নেই। যেখানে প্রাণ নেই... প্রাণের উল্লাস নেই, সেখানে আর যাই হোক আলো আসতে পারে না!”
একদল তারার দিকে নির্দেশ করে দীপ্তরূপ জিজ্ঞেস করে, “এখন এদের কাছাকাছি আছ নিশ্চই?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এরপর কুহেলী নিজে থেকেই বলতে শুরু করে, “ও তো আমার নিঃশ্বাসের ধুলো! তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। আমি যেদিন যার দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলি, সেদিন ঠিক সেই তারাটাই খসে পড়ে!”
“এতে লাভ?”
“আমার জন্যে কোথাও কেউ ভালোলাগার মতো আইটেম রেখে যায়নি! তাই আমিও চাইনে আমার দিকে তাকিয়ে কেউ মিটমিট করে হাসুক!”
“কে বলেছে তোমার জন্যে কিছু রচনা করেননি? আমি কি নেহাত খেলনা?” এমনসময় ওই চারাগাছটির পাতায় একটা জোনাকি উড়ে এসে পড়ল। অবাক হওয়ার ভান করা লাগল না। এমনিতেই দুজনেই অবাক হয়ে দেখছিল, কী অদ্ভুত সুন্দর একটা পোকা মিটমিট করে জ্বলতে জ্বলতে গাছটির পা থেকে মাথা অবধি আলোর মই বেয়ে উঠছে, আর নামছে! কুহেলী দৌড়ে নিচে নেমে গেল। দীপ্তরূপ ভয় পেল খুব! সেও ছুটল। জোনাকিটাকে ধরে এনে আবার ব্যালকনিতে এল। এবার ওটাকে কুহেলীর আঙুলের ওপর ছেড়ে দিয়ে দীপ্তরূপ বলল, “এখন এই জোনাকিটাকেই জিজ্ঞেস করো, আজ এই মুহূর্তে...ঠিক এই শুভক্ষণে ও কার জন্যে এই আঙুলের ওপর এসে বসেছিল!”
জোনাকিটাকে দেউটির মতো দুহাতে চাপা দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে চোখ বন্ধ করল কুহেলী। তারপর বলে উঠল, “সুন্দরের জন্যে!”
“কে সে?” উত্তর দেবার আবশ্যিকতা মনে করল না কুহেলী। তার পরিবর্তে পোকাটাকে বুকের কাছে আগলে নিয়ে আবদার করল, “একটা মুখছিদ্র শিশি এনে দেবে?”
“দেব। তার আগে বলো, গাছটির কী নাম দেওয়া যায়?”
“কোন গাছটা? সেদিন যেটা দিয়ে সেলিব্রেট করলে, ওটা?”
“হ্যাঁ। স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর...ঐশ্বর্যের চেয়ে আরও তীক্ষ্ণতর নাম দাও প্লিজ!”
“আত্রেয়ী...অরুন্ধতী যাহোক কিছু একটা হলেই তো হয়।”
কুহেলী বুঝতে পারে এগুলো ঠিক মনঃপূত হচ্ছে না দীপ্তর কাছে। এবার সে মিহিস্বরে বলল, “পুতিন কন্যার নামটাও ভেবে দেখতে পারো!”
দীপ্তরূপ ব্যগ্রস্বরে বলে উঠল, “ওফ নো নো! ওগুলো সবই উল্কি আর উল্কার ধুলো। তুমি এমন একটা নাম নির্বাচন করে দাও, ওই নাম একটিবার কানে গেলেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে মুমূর্ষু রুগীও নতুনকরে বাঁচার স্বপ্ন দেখার সাহস পাবে! আর বাদবাকি মানুষের কাছে এর সমস্ত শাখাপ্রশাখা পৃথিবীর বাক্ বদলের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে!”
কুহেলী মরু চাতকের মতো খিলখিল করে হেসে উঠল,“ডেফিনেটলি সি ইজ সারা গিলবার্ট, অ্যা ওয়ারিয়র অব ইবোলা! ... রাইট?”
শেষের কথাটা ঠিকঠাক জায়গায় স্ট্রাইক করল দেখে দীপ্ত আবেগতাড়িত হয়ে বলে উঠল,“এবার করোনা যুদ্ধেও তিনি জিতবেন!”
“সিওর?”
দীপ্তরূপ আবারও অলৌকিক এক আবেশে চোখ বন্ধ করল, “হানড্রেড পারসেন্ট সিওর!”
সপ্তাহে দুদিন আসেন সুরিন্দর পিল্লাই। বড় অদ্ভুত সুন্দর কথা বলেন তিনি। যেমনি চেহারা তেমনই তাঁর ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজেই বলেন তিনি নাকি পৃথিবীর প্রথম বর্জ্যবাহী জাহাজ। আর তাতে যেসমস্ত বর্জ্য বোঝাই করা হয় তা সবই প্রায় নামীদামি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যর্থ সব কিট! কুহেলী এক অদৃশ্য রোগের শিকার। সে আত্মহত্যা প্রবণ। সুরিন্দর ওকে পাল্টে পাল্টে ওষুধ দেন। কুহেলী কি সবটা খায়? একমাত্র ওই বলতে পারে! মাঝে মাঝে সুরিন্দরেরও ভুল হয়ে যায়। আবার নতুন করে প্রেসক্রাইব করেন। কিন্তু কুহেলীর ভুল হয় না। সে মেডিসিনের জেনেরিক লেবেলগুলো মোটামোটা হরফে লিখে জারের গায়ে সেঁটে রাখে। যেগুলোর মধ্যে সে ইদানিং জোনাকি পুষতে শুরু করেছে। এখন দীপ্তরূপ রোজ একটি করে জোনাকি ধরে দেয়। আর কুহেলী সেগুলো সরু ছিদ্রমুখ ওয়ালা জারের মধ্যে বন্দি করে পরাগের সাথে মধু মাখিয়ে ওদেরকে প্রতিপালন করে। সুরিন্দর এলেই কুহেলী ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দেয়। এরপর জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সুরিন্দরকে নিয়ে যায় ছোট্ট একটা কুঠুরিতে। ওই ঘরে সেলফের ওপর বোয়ামে বন্দি করে রেখেছে যেসব জোনাকিগুলো, তাদের আলোর গতিবিধির দিকে নিরিখ করে চেয়ে থেকে কুহেলী জিজ্ঞাসা করে, “কী, কিছু বুঝলেন ডঃ? আশা আদৌ আছে কিছু?”
সুরিন্দর হাসেন।
কুহেলী অস্থির হয়ে ওঠে,“কই কিছু বললেন না তো?”
“এগুলো এভাবে আটকে রেখেছেন কেন বুঝলাম না।”
“এরা দীপ্তরূপের একেকটা অজুহাত। আমি চাই এরা আদৌ আলোর উৎস কিনা সেটা অন্তত দেখি!”
“আমি তো ভাবছি উল্টো।”
“যেমন?”
“আপনি তো ওদের লাইট সেলগুলো সিজ করে নিয়েছেন মনে হচ্ছে!”
কুহেলী লজ্জা পেল খুব, “কী যা-তা বলছেন!”
“সত্যি বলছি। ওদের ওই ভাল্ব থেকে আপনার চোখদুটো আজ অনেক উজ্জ্বল লাগছে! সত্যি বলছি।”
কুহেলী নিজের তলপেটে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে উঠল, “আমাদের ফ্যামিলিতে একজন নতুন অতিথি এসেছে।”
সুরিন্দর লাফিয়ে উঠলেন, “সত্যি? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না? এদ্দিন লুকিয়ে রেখেছেন কেন? কনগ্রাচুলেশান মিসেস কুহেলী!”
“আপনি যেটা ভাবছেন সে নয়। সি ইজ সারা, সারা গিলবার্ট! এজেড্ডি১২২২ নিয়ে তিনি তো রীতিমত তুফান তুলে দিয়েছেন!”
ডঃ সুরিন্দরের হাত ধরে ব্যালকনির কাছে নিয়ে এল কুহেলী।
“ওই সেই অতিথি। যাকে ঘিরে এখন আমাদের দিনরাত্রি তোলপাড়!”
ডঃ সুরিন্দর বললেন, “এ তো একটি গাছ। যার চওড়া করতলের মতো পাতা আপনাদের ছোট্ট উঠোনটুকুকে অনেকখানি উন্নত করে রেখেছে।”
ঠিক এমনসময় দীপ্তরূপ ঝারি হাতে উঠোনে এল। গাছটির গোড়ায় জল সিঞ্চন করল। পাতায় ফুঁ দিয়ে ধুলোময়লা ঝেড়ে দিল। তারপর ওর পাতাগুলো চোয়ালে চেপে ধরে অনেকখানি আদর করল।
ডঃ সুরিন্দর বললেন, “আজ আসি? নেকস্ট উইক আশাকরি...!”
কথাটা শেষ হবার আগেই কুহেলী বলে উঠল, “ওই হাত দুটো কেটে রেখে এলে খুশি হই!”
সুরিন্দর কথাটা নোট করে নিতে চাইছিলেন। সাথে সাথে কুহেলী ওঁর হাতখানি ধরে বাধা দিয়ে বলল, “আমি কিছুতেই এইসব অড অরগ্যানগুলো অ্যালাউ করতে পারছি না!”
এরপর কুহেলী অস্থির হয়ে দেখাতে লাগল, “এই দেখুন না আমার গলার কাছটায় কী বিচ্ছিরি দাগ! কী করে হল বলুন তো? মাঝে কদিন খুব ঘুমিয়েছি। এখন চোখ বন্ধ করলেই কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুঝতে পারি বুকের ওপর কেউ একজন উঠে বসেছে! কিন্তু কে যে তা চিনতে পারি না! দীপ্তরূপের হাত তো মোমের চেয়েও নরম। তাহলে? আপনি নন তো?”
ডঃ সুরিন্দর জবাব দেন না। বিদায় নেবার আগে জানতে চান, “এনি সাজেশান?”
“ওঁর মাকে একটু বোঝাবেন একটু নরমাল বিহেভ করতে।”
“শ্রীমতী দেবী তো আপনাকে খুবই স্নেহ করেন। তো...?”
“সেটাই তো বললাম। এক্কেবারে ইনটলারেবল!”
“আর কিছু?”
“আর দীপ্তকে বলবেন, যদি সম্ভব হয় নিষিদ্ধপল্লী থেকে যেন মাঝেমধ্যে স্বাদবদল করে আসে!”
“কেন? এনি অবজেকশান?”
“ও কিন্তু মারাত্মক রকম মাস্টারবেশনে আসক্ত! এসব দেখতেও ঘেন্না লাগে!”
“বলছেন কী! আপনার সামনেই?”
কথাটা মুখ থেকে খসিয়েই মাথা নিচু করে বসে থাকে কুহেলী। হয়ত সে লজ্জা পেয়েছে। ডঃ সুরিন্দর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“আপনার জন্যে সত্যি সত্যি কষ্ট হয় মিসেস কুহেলী! বলুন আপনার জন্যে আমি কী করতে পারি?”
এবার কুহেলী খোঁপা খসিয়ে দিয়ে সুরিন্দরের চোখে চোখ রেখে এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে লাগল, “একটি অন্ধকার বাড়ি। ওর মধ্যে একটা কুঠুরি একান্ত আমার মতো, আমার মাথার চুলের চেয়েও ঘন কালো। কালিপড়া কুলুঙ্গি, পাতাল অব্দি প্যাঁচানো সিঁড়ি, সিঁড়ির নিচে স্নানের ঘাট আমার প্রসাধন, আয়নাঢাকা ঝালর সবই কালো। ওয়ালফ্রেমে বন্দি অতীতের সমস্তরকম আমি, আমার সহকারী শাখাপ্রশাখা সবই সেখানে আবছা অবয়ব!... তেমন একখানি বাড়ি আমার চাই। সমস্ত বাড়িটা জুড়ে কেবল একপাটি দাঁত একটা অধাতব তরবারি ছাড়া সেখানে আর সবই অনুজ্জ্বল! এমন একখান বাড়ি যদি এনে দিতে পারেন আর আমার অসুখ থাকবে না! পারবেন...?”
ডঃ সুরিন্দর কাঁচের বোয়াম খুলে একটা জোনাকির আলোর অংশটুকু কেটে কুহেলীর কপালে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “ওঃ বুঝেছি। ইলোরার অভিসারিকা? এবার মানিয়েছে খুব!”
অকস্মাৎ কুহেলী ডঃ সুরিন্দরের গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিল!
অনেকক্ষণ হল সমস্ত ঘর জুড়ে একটা ঘনকালো নিস্তব্ধতা! কারও মুখে কোনও কথা নেই। কেবলমাত্র ঘড়ির কাঁটার খটখট আওয়াজটুকু ছাড়া বাকি বাড়ি একদম বোবা! এমন সময় দীপ্তরূপ এল। দুজনের সাথে চোখাচোখি হতেই দীপ্তরূপ দেখল ডঃ সুরিন্দরের চোখেমুখে এখন অদ্ভুত এক আলো! বোঝবার চেষ্টা করল মিরাক্যেল কিছু একটা হতে চলেছে। এবার সে আলোয় দীপ্তরূপের চোখদুটোও ঝিকমিক করে উঠল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছে ছিল ১৫ই আগস্ট লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার শুভ মুহূর্তের সাথে সাথে আরও একটা সারপ্রাইজ দিয়ে দেশবাসীকে চমকে দেবেন। হল না। সিরামের সাথে সাথে দেশজুড়ে তুমুল হই-হল্লায় থেমে গেল সব। কিন্তু সারা এসে দেখালেন নতুন স্বপ্ন। ওঁকে দমাতে পারলেন না কেউ। এখন একটা মেঘের সাথে আরেকটা মেঘ যেন পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। রাশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, ইন্ডিয়া, চাইনা এরা যেন সেই অলৌকিক মেঘ মেঘেদের ঘরবাড়ি। যাতে শুধু বৃষ্টির ছবি আঁকা আছে কিন্তু আদতে ভিজে গন্ধ নেই। ভাস্বরবাবু ইজিচেয়ারে বসে গল্প বলেন। সুমিতা দেবী দোলনায় বসে বসে দোল খান আর গাছটার দিকে স্থির চোখে চেয়ে থাকেন।
“এই যে রাস্তাটা দেখছ, লাল মোরাম দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। একদিন এই বাড়িতেই বালিশে কান পাতলে দুরমুশ করার দুমদুম শব্দ শোনা যেত! সেই ঠাকুরদার আমলের কথা। এই ফটকের মধ্যে দিয়ে ওঁরা নাকি দেশের গতিবিধির দিকে নজর রাখতেন। কে কখন যুদ্ধের খবর নিয়ে আসছেন। কারা কোন সওদা নিয়ে আসছে। কোন উটের পিঠে পেস্তাবাদাম অথবা কোন ঘোড়ার খুরে বিষাক্ত নাল লাগানো আছে, ওঁরা এখান থেকেই আন্দাজ করে বলে দিতে পারতেন। তারপর তো সবকিছু আস্তে আস্তে আবছা হয়ে এল। তখন এত গায়ে গায়ে বাড়িঘর ছিল না। খিড়কি খুললেই রাজপথ। সামনেই বিরাট বড় ফটক। পাহাড়ের চুড়োটা দেখা যেত শরতের সকালে সোনার টিকলির মতো! একসময় সেটাও হয়ে গেল ধোঁয়ার মেঘ। আমরা তখন ছোট। এই লাল মোরামে মোড়া রাস্তা বেয়ে কত যে ভালো ভালো খবর আসত! আমরা মুখিয়ে থাকতাম। সেই এইটুকু বয়েসে কলের গান এল। জাহাজ বোঝাই করে আস্ত একখান রেল এঞ্জিন এল। ভিক্টোরিয়ার জন্যে মোটর এল। গ্রাম থেকে ক্ষুধার্ত মানুষ এল। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাখো লাখো শরণার্থী এল! সবই দেখতাম ওই ফটকের মধ্যে দিয়ে। তখন এটাই ছিল আমাদের একমাত্র দৈনিক দেশদর্পণ! হঠাৎ একদিন ওই ফটকের ঠিক সামনেই উঁচু একটা মিনার উঠল। দেশের মানুষের মতিগতি কোনদিকে গেল তখন থেকে আর কিছুই বোঝা গেল না।”
কুহেলী কথা বলে না। কেবল শোনে আর হাতে সূচ সুতো চাকতি নিয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করে।
দেখতে দেখতে বাড়ির সামনের রাস্তাটা ফোর-লেন হয়ে গেল। এক নাম্বার দিয়ে সারাক্ষণ অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। একটাতে কেবলমাত্র কার্নিভাল অথবা রাজ্য-রাজনীতির রীতি সংস্কৃতির শোভাযাত্রা। মাঝেরটা শুধুমাত্র মালবাহী। বাকিটাতে কেবল শব আর শোকযাত্রা! ভাস্বরজ্যোতি সারাবেলা এসব বসে বসে দেখেন। দীপ্তরূপ বকাঝকা করে। সে নিজেও আর সন্ধ্যার খবটা দেখছে না। মেডিসিন নিয়ে মোহভঙ্গ হয়েছে দীপ্তরূপের। কেননা হু-র নির্দেশে সমস্ত ভ্যাকসিন সরকার একা হাতে ডিস্ট্রিবিউট করছেন। এখন ডোর টু ডোর সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ বাদ পড়লেন কিনা সে তথ্যও আপলোড করতে হচ্ছে। ওপর দিকে শাসকদলের নেতারাও আলাদা করে কুপন দিয়ে যাচ্ছেন। ওঁদের প্রচার পুস্তিকায়ও কোনোরকম দলীয় সিম্বল নেই। কোনও কোনও নেতার গাড়ির পেছনে ছোট্ট ব্যানার। তাতে লেখা আছে, “কিনতে হয় না কোভাক্স।” কোথাও বা বলা আছে, “চিন্তা নেই চাইলেই চ্যাডক্স!”
ভ্যাকসিন নিয়ে এতদিন যারা আকাশকুসুম কল্পনা করছিলেন সরকার যেন তাঁদের সকল আশায় জল ঢেলে দিয়েছেন!
বেলায় পেপার ওয়ালা আসে। বিশ্রীরকম চেঁচিয়ে পাড়া জাগায়, “বয়স্কদের জন্যে কোনও ভ্যাকসিন নেই। পেপার। আনন্দবাজার। দেশে আরও দুকোটি মরবে। দুর্বলদের কেউ বাঁচাতে পারবে না। পেপার। বর্তমান। জলের দরে ফলের রস। আগে ভ্যাকসিন পরে ভোট! পেপার টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি...!”
কুহেলী এসবে কান দেয় না। সে জানে শাশুড়ি ভীষণরকম দুর্বল! ওঁর জন্যে আলাদা জায়গায় দোলনা বেঁধে দিয়েছে। ভাস্বরবাবুও নতুন করে ভয় পেতে শুরু করেছেন। তিনিও আর রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন না।
কুহেলী একটার পর একটা কার্পেট সেলাই করে, আর লতিকাকে দিয়ে কাচিয়ে রৌদ্রে মেলে দেয়। লতিকা কুহেলীদের কাজের মেয়ে। দীর্ঘ এক বছরের ঘরবন্দি জীবনে অনেকগুলো নকশায় সুতো হাঁটিয়ে ফেলেছে কুহেলী। পথচলতি মানুষেরা অবাক হয়ে দেখে কুহেলীর কাজ। সত্যাগ্রহ থেকে শুরু করে তুর্কি বিজয়, কোনও কোনটাতে আবার নাগা বিদ্রোহ থেকে মীরা বাঈ,--সবই নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছে সে।
লতিকা কাজের ফাঁকে জিরিয়ে নেয়। আর সুযোগ পেলেই কুহেলীকে জিজ্ঞেস করে, “এ কেমন ভ্যাকসিন এল গো বৌদিমণি?”
“কেন রে?”
“এই দেখো না, শাশুড়ির কাশিটা আবার চাগান দিয়েছে দেখছি।”
“উনি টিকা নেননি?”
“উরি বাপরে! পাড়ায় কিছু এলেই উনার আগে টিকিট চাই! পুরোনো ভোটার বলে উনার ডিমান্ড বেশি!”
কুহেলীর মুখ উঁচু করার অবসর থাকে না। লতিকা কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করে। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করে, “এরা কারা গো?”
“অতীতের অসুস্থ মানুষজন!”
“একসাথে এতজন? এঁরা সবাই অসুস্থ? দল বেঁধে কোথায় যাচ্ছে?”
এবার কুহেলী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, “তোদের পাড়ায় ভ্যাকসিন বিলি হচ্ছে বললি যে!...আনতে!”
“এর আগেও করোনা ছিল?”
“করোনা না থাকলেও কারণ কিছু একটা ছিল! এই মন্দিরা হাতে মহিলাটি ছুটে চলেছেন, এ কে চিনিস? ইনি মীরা বাঈ, এককালের ভারত সম্রাজ্ঞী! এঁর পাগলামি কী ছিল শুনবি?-- একটা পাথরকে পাবে বলে!”
কিন্তু এতসব লতিকা জানে না। সে জানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বদল হয়েছে। আরব আমির শাহীর প্রধানমন্ত্রী না কে একজন রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে দুদিন অসুস্থ ছিলেন। সিরিয়াল পাড়ায় আবার সুটিং শুরু হয়েছে। ঘোলাঘাট অব্দি অ্যাভেলএবেল লোকাল পাওয়া যাচ্ছে,...আরও কত কী!
উঠোনের গাছটি একা একাই হাওয়ায় দোল খেতে পারে। জল না দিলেও শিকড়ের সাহায্যে নিজেকে সতেজ করে নিতে পারে। কুহেলী ওর দিকে না তাকালেও পথ চলতি মানুষের সম্ভ্রম আদায় করে নিতে পারে। গাছটিতে এখন অনেকগুলো শাখা। খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। গাছটি কোন প্রজাতির, কেমন ফুল দেবে, আদৌ কি ফুল হবে? এসব কিছুই জানে না কুহেলী। শুধু জানে গাছটির নাম সারা, সারা গিলবার্ট! এখন ওর গোড়ায় না এলেও কুহেলী ওপর থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ মাপজোক করে নিতে পারে।
আজ সকালবেলা লতিকা গেট খুলেই চিৎকার করে পাড়া মাথায় করল, “বৌদিমণি, পেপারে তোমার ছবি বেরিয়েছে! ডঃ স্যারের ছবিও আছে গো!”
এমন আদেখলাপনায় কুণ্ঠায় দলা হয়ে এল কুহেলী! তাড়াতাড়ি কাগজটা নিয়ে দলামুচড়া করে এক কোণে গুঁজে রেখে শ্বশুরকে চা দিল।
ভাস্বরবাবু চায়ে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ছবি বেরিয়েছে মা? তোমার কার্পেটের?”
“কুহেলি শ্বাস চেপে বলল, “হ্যাঁ।”
“কই দেখি।”
“রাতে দিই? আগে আপনার ছেলে আসুক!”
রাতে দীপ্তরূপ এলে কাগজটা বার করল কুহেলী। ততক্ষণে ভাস্বরবাবু ঘুমিয়ে পড়েছেন। মোচড়ানো পাতাটা সমান করে দীপ্তর সামনে ধরে জিজ্ঞাসা করল, “এই ছবিগুলো তুমি ডঃ সুরিন্দরকে দিয়েছিলে?”
“এটা তো বিরাট সাফল্য! তুমি এমনভাবে নিচ্ছ কেন?”
“আমি যেটা জানতে চাইছি, সেটার আগে উত্তর দাও! ছবিগুলো তুমি দিয়েছিলে?”
দীপ্তরূপ চোখদুটো রক্তবর্ণ হয়ে বলে উঠল, “বেশ করেছি! উনি একা নাম কামাবেন এটা হতে পারে না! তোমার অবদানও কম কিছু নেই! এর আগেও বেশ কয়েকটি জার্নালে ওঁর নাম ছাপা হয়েছে। তখন উনি কিন্তু একটিবারের জন্যেও...!”
“পৃথিবীতে আর একজনও আমার মতো রুগী নেই তাই না?”
কোনও কথাই আর শুনতে প্রস্তুত নয় দীপ্তরূপ। সে কুহেলীকে জড়িয়ে ধরল। চিবুকে গ্রীবায় চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিল। আদরে আদরে অস্থির হয়ে কুহেলীও একসময় হাঁপিয়ে উঠল।
আঁচলের তলায় মুখ গুঁজে দিয়ে দীপ্ত বার বার একই কথা বলতে লাগল,“আজ আমি সত্যিই খুশি কুহেলী!”
এবার কুহেলীও সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে বলল, “সত্যি সত্যি আমি সুস্থ হয়ে গেছি! সব ক্রেডিট উনিই বা একা কেন নেবেন? এখন তো আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত, তাই না?”
“কী চাও বলো?”
“একটা আকাঙ্ক্ষিত জীবন!”
আজ আর আকাশের দিকে তাকাতে পারল না দীপ্তরূপ। প্রতিটা নক্ষত্র যেন তুবড়ির মতো ফেটে দিকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে! আর সে আলোয় ওর চোখ ঝলসে যাচ্ছে!
এখন অনেক রাত। ঘরে আলো কম। খাটের একপাশে নববধূর মতো বসে আছে কুহেলী। হোমথিয়েটারে মিহিস্বরে সানাই বাজছে। অনেক অপেক্ষার পর দীপ্তরূপ এল। নতুন পাঞ্জাবি পাজামা পরা। আর অঙ্গ থেকে আরব আতরের উগ্র এসেন্স ভেসে আসছে! এমন দীপ্তকে দেখে কুহেলী ঘাবড়ে গেল, “দূরে দাঁড়িয়ে আছে কেন সে? চোখদুটোই বা এতো ফোলাফোলা লাগছে কেন? তাহলে কি দীপ্ত ড্রিংক্স নিয়ে এল?” মনে মনে ভাবল কুহেলী।
এবার কুহেলী কুহুস্বরে ডাকল, “কী হল? এসো...!”
দীপ্ত এল। ঘোমটা তুলল না। কোনও কথা না বলেই কোলের মধ্যে গোটোমোটো হয়ে শুয়ে পড়ল। কুহেলী কপালে হাত ঠেকিয়ে শিউরে উঠল, “এমা! গায়ে তো অসম্ভব জ্বর!”
দীপ্তরূপকে শুইয়ে দিয়ে গায়ের ওপর একটা পাতলা বেডশিট দিয়ে দৌড়ে বাইরে গেল।
কুহেলী আসছে না দেখে দীপ্তরূপ উতলা হয়ে উঠল। পাশ ফিরতেই অন্ধকারে খচ্ করে একটা খোঁচা অনুভব করল দীপ্ত। আলো জ্বেলে দেখল একটা সূচ। একটা নকশি করা বেডকভারের ওপর শুয়ে আছে সে। সাদা চাদরের ওপরে রেশমের সুতোয় বোনা নকশা দেখে আঁতকে উঠল দীপ্তরূপ, “এসব কী? কুহেলীর কাজ? উঠোনের সেই গাছটা না? হ্যাঁ ওই গাছটাই তো! ওর ডালে গলায় দড়ি বেঁধে একসাথে ঝুলছে এরা কারা?” দীপ্ত আরও ঝুঁকে পড়ল। পাগলের মতো সুতো টানতে লাগল। কিন্তু কুহেলী যেসব গিঁট দিয়ে কাজ করে, সেটা খোলা দীপ্তর সাধ্যের বাইরে। ততক্ষণে ওর গা দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে!
এবার দীপ্তরূপ মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল, “শেষমেশ ডঃ সুরিন্দর আপনিও...!”
আর ভাবতে পারে না দীপ্তরূপ। খাট থেকে নেমে পড়ল। অজ্ঞাতেই অস্ত্র জাতীয় কিছু একটা খুঁজল। পেল না। এবার গেট খুলে সেই গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। একটা শাখারও নাগাল পেল না দীপ্তরূপ! কেননা গাছটা এখন ওর অনেক ঊর্ধে!
আর ঠিক এই সময় ওপর থেকে একটার পর একটা কৌটো খুলে কুহেলী তার পোষা জোনাকিগুলো উড়িয়ে দিল!