একদিকে মেজ কন্যার নতুন চাকরি, এছাড়া আছে টিউশনি। সেজকন্যা মৈত্রেয়ী অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করে চাকরির খোঁজে লাগল। কাগজে দেখল নার্সিং ট্রেনিং-এর বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, সে সেই ট্রেনিং নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। বড়ো কন্যার অনুমতিক্রমে সে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে নীলরতন হাসপাতালে যাবার জন্য তৈরি হল। সঙ্গে করে নিয়ে গেল জামাতা বৈদ্যনাথ। ট্রেনিং-এ ভর্তি হল। ১৯৮২ সালে সে চলে গেল নিজ কর্মস্থলে, ঘর খালি হতে লাগল। সেদিনের শূন্যতায় আমি যে কতটা আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম তা লিখে প্রকাশ করতে পারব না।
দেবযানী তখন কলেজে পড়ছে, ছেলেও স্কুল ফাইনালের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে যার কাজে বাইরে। যে হাসিমস্করায় ঘর ভরিয়ে রাখত সেই মৈত্রেয়ী আজ বাড়ি নেই। ছেলেবেলা থেকেই নানা অসুখে ভুগত সে, আমার নেওটা ছিল খুব। প্রখর বুদ্ধি ছিল। কথায় কথায় রঙ্গ করা ছিল তার স্বভাব। সংসারে অনটনে বা কোনও কারণে মন বিষন্ন থাকলে ওর মস্করা, আর রঙ্গ করার বহর দেখে না হেসে থাকতে পারতাম না।
ছেলেবেলা থেকেই ছিল মজা করার স্বভাব। দুষ্টুমি করলে মারব বলে তাড়া করলে ঘরের এই দরজা দিয়ে ঢুকে আরেক দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান করে দিত। কোনক্রমে সামনে পড়ে গেলেই দুচোখ ট্যারা করে, হনুমানের মত গাল দুটো ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত, তখন মারব, না হাসব ভেবে পেতাম না। কোনো কারণে কান্নার উদ্রেক হলেও কাঁদত না, গলা ছেড়ে কান্নাকে ও মনে করত পরাজয়। না কেঁদে ও তক্কে তক্কে থাকত, প্রতিশোধ নেবার ফন্দি করত। একবার উঠোনের একপাশে ওর ঠাকুমা ধানিলঙ্কার চারা লাগিয়েছিলেন। একদিন দুপুরে ওরা দুইবোনে উঠোনে রান্নাবাটি খেলছিল, সব লঙ্কাপাতা ছিঁড়ে এনে মাছ বানিয়েছিল। ঠাকুমা ঘুম থেকে উঠে ন্যাড়া, পাতাহীন গাছ দেখে রেগে আগুন। ঠাকুমা পেয়ারা চারার ডাল ভেঙ্গে নিয়ে মৈত্রেয়ীর পিঠে ঘা কতক লাগিয়ে দিলেন। সেদিনের মত খেলা ভঙ্গ হল। দুদিন পর, দুপুরে বাড়িসুদ্ধ সবাই ঘুমে, ওদের ঠাকুমাও ঘরের মাঝখানে পাটি পেতে ঘুমাচ্ছেন। সেই সুযোগে কুঁড়ি কুঁড়ি লংকাগুলি সব তুলে একটা নারকেল মালায় করে ঠাকুমার মাথার কাছে রেখে দিয়ে উধাও। ঠাকুমা তো ঘুম থেকে উঠে তা দেখে রেগে আগুন, আমাকে এসে নালিশ করলেন, কোথায় সে। চুপি চুপি বাড়ি ঢুকল সন্ধের অন্ধকার হয়ে গেলে, ওর প্রিয় বাবা তখন বাড়ি ফিরে এসেছে।
ওর আরেকটা স্বভাব ছিল খানিক বাদে বাদে পায়ের পাতাগুলোয় খানিক জল ঢালা। বারান্দার এক কোনায় ওর ঠাকুমার ব্যবহারের জন্য রাখা থাকত এক বালতি জল আর একটা সিলভারের মগ। মৈত্রেয়ী ফাঁক পেলেই ওই বালতি থেকে জল নিয়ে পায়ে ঢালত। একদিন ঠাকুমার কাছে ধরা পড়ে গেল হাতেনাতে। ধমক দিয়ে হাত থেকে মগটা কেড়ে নিয়ে তা দিয়ে মাথায় একটা ঠোক্কর দিলেন। তখন কিছু বলল না সে মেয়ে। চুপচাপ কাটল ক’দিন। সেদিন দুপুরে প্রতিদিনের মতোই ঝুড়িমাথায় হেঁকে যাচ্ছিল বিস্কুটের ফেরিওয়ালা, সে সিলভারের ভাঙাচোরা জিনিসের বদলে বিস্কুট দিত। তাই ওকে সবাই ডাকত ‘বদলিবিস্কুট’ বলে। তা সেদিন দুপুরে মৈত্রেয়ী সেই সিলভারের মগটা বদল দিয়ে অনেক বিস্কুট নিল। নিয়ে চলে গেল স্কুল মাঠের কাছে বাঁশবাগানের ছায়ায়। ওদের ঠাকুমা ঘুম থেকে উঠে তো আর মগ পান না। কোথায় গেল, বললেন ‘এ নির্ঘাৎ খুকুর কাজ’। আমার তো গালে হাত। কোথায় খুঁজব তাকে। আমি রাস্তায় বেরোই না সচরাচর। সারা বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলল। ফিরল বাবার হাত ধরে। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে জিজ্ঞেস করলাম মগ কে নিয়েছে রে? সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করল। বলল, ‘হ্যাঁ আমিই মগ নিয়েছি, বদল করে বিস্কুট কিনে বাঁশতলায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েও নিয়েছি। সেদিন আমার মাথায় মেরেছিল কেন মগ দিয়ে, শোধবোধ হয়ে গেল।’
একে একে কন্যারা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের বিবাহের সম্বন্ধ আসে। তারা বিদায় হয়। তবে নাড়ির টানটিকে তারা কেউ অস্বীকার করেনি। মা ও ভাইবোনদের জন্য তাহাদের উৎকন্ঠা, যত্ন কিছুরই অভাব ছিল না। তাহাদের সকলের যত্নে ও ভালোবাসায় জীবন কতক সচ্ছন্দে প্রবাহিত হচ্ছিল আমার। বাড়িতে চতুর্থ কন্যা ও পুত্রকে নিয়ে দিন কাটছিল দ্রুত। তারা কলেজে যায়, লেখাপড়া করে; পুত্রটির নাটকের শখ। প্রায়শ তার রিহার্সালের শব্দে ঘর মুখরিত থাকে। ভাইবোনের কাজিয়া, ভালোবাসায় সুখে দিন কাটে।
এই সময় একদিন আমার ছেলে কলেজ থেকে এসে হাসিমুখে বলল, “মা রাঙামাসির কাছে কাশী যাবে?”
কাশীতে আমার এক দিদির বাস। বাল্যবিধবা দিদিটি সেইখানেই নিজের চেষ্টায় বিদ্যার্জন করে একটি স্কুলের শিক্ষিকা হয়েছিল। এছাড়া সেখানে আমার বড়ো দাদার পরিবারও বহুকালের বাসিন্দা।
জানা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের টাকা এসেছে তার। অতএব সেই টাকায় আমাকে কাশী নিয়ে যাবার ইচ্ছা। মনটা আনন্দে ভরে গেল। এই তো কিছুকাল আগে ছোটো শিশুটিকে কোলে হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরেছিলাম। আজ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আজ সে আমায় দেশভ্রমণে নিয়ে যেতে চায়। খুশিমনেই সায় দিলাম।
তবে তার এহেন দেশভ্রমণের যে অন্য কারণ ছিল তা জানা গেল ট্রেনে ওঠবার পর। হাওড়া স্টেশন থেকে বৈদ্যুতিক শকট রওয়ানা হবার পর সে বলল, “জানো মা, আগামিকাল আমার একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল।”
আমি চমকিত হয়ে বললাম, “কী চাকরি? তুই ইন্টারভিউ না দিয়ে…”
সে মাথা নীচু করেই বলল, “রেডিও স্টেশনে ইন্টারভিউতে ডেকেছে। আমি যাব না। আমি পড়া শেষ না করে কক্ষনো চাকরি করব না মা। তুমি যদি জোর করো তাই তোমায় নিয়ে রাঙামাসির ওখানে চলে যাচ্ছি আজ।”
আমি তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এ কোন প্রজন্ম এল! একটি বহুমূল্য সরকারি চাকরি, যা হয়তো আমার অভাবের সংসারের মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারত, তাকে এত অবহেলায় সে ত্যাগ করল পড়াশোনার জন্য। ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কা কাটবার পর হঠাৎ এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে উঠল। মনে মনে ভাবলাম, এই ভালো। হয়তো পরম করুণাময় ঈশ্বরের এমনই ইচ্ছা।
সেইবার কাশীধামে ভগিনী ও ভাইপোদের সংসারে সাতটি দিন বড়ো আনন্দে কাটিয়েছিলাম। প্রত্যহ বাবা বিশ্বনাথের পূজা, দিদির প্রাক্তন ছাত্রের বাবার নৌকায় গঙ্গাভ্রমণ এমন কত না আনন্দের উপকরণ ছিল সেই পুণ্যভূমিতে। কিন্তু তবু এই সবকিছুর আড়ালে যৌবনপ্রাপ্ত পুত্রের দিকে চোখ রেখে একটা অজানা আশঙ্কায় মন ছটফট করত। এইবার তারও ডানা মেলবার সময় এসেছে। এই ঘটনাটি যেন তারই ইঙ্গিত।
এবং সে-ইঙ্গিত বাস্তবায়িত হতে বেশি সময় নিল না। উচ্চতর শিক্ষা চলতে চলতেই রেলকোম্পানিতে একটি চাকরি নিয়েছিল সে। বাড়ি থেকেই চাকরি ও পড়াশোনা দুই চালাচ্ছিল অত কষ্টে। কিন্তু তারপর একদিন দুপুরে সেই চিঠিটি এসে পৌঁছাল। ছেলে আমার রাতে বাড়ি এসে চিঠি খুলে পড়ে বলল, “এইবার আমায় যেতে হবে।”
চলে গেল সে। আমার বুক খালি করে বৃহত্তর জীবনের সন্ধানে বৃহত্তর দুনিয়ায় ডানা মেলে ভেসে গেল। আমার ফাঁকা বাড়িতে ছোটোকন্যাকে নিয়ে একা বসে রইলাম আমি। বিবাহিতা কন্যাদের যাতায়াত আছে। বাড়িতে দেবরের বিধবা ও তার সন্তান সে-ও আছে। কনিষ্ঠ দেবর, তার স্ত্রীপুত্র নিয়ে বাড়ির আরেক অংশে গার্হস্থজীবনে মগ্ন। কিন্তু তবু আমার বুকের শূন্যতা তাতে ভরে কই? ইতিমধ্যে কালের নিয়মে আমার ছোটোকন্যারও বিবাহ হয়ে গেল।
একলা ঘরটিতে কর্মহীনতার অভিশাপ মাথায় নিয়ে কিছুকাল কেটে গেল এরপর। পুত্রেরও বিবাহ হয়েছে। পুত্রবধূ তার সহকর্মী। শিক্ষিতা, সুন্দরী, মার্জিতরুচি। বিবাহের পরেই তারা চাকুরির প্রশিক্ষণের জন্য দেশের দুই স্থানে চলে গিয়েছে। নিয়মিত চিঠিতে, কখনো কখনো প্রতিবেশীর বাড়ির টেলিফোনে যোগাযোগ থাকে।
এখন আর আমার ঐহিক অভাব কোনো নেই। পাঁচপাঁচটি রোজগেরে সন্তান যে মায়ের তার সে অভাব থাকে না। কিন্তু একাকিত্বের যাতনা বড়ো তীব্র।
অবশেষে সেই যাতনা থেকে মুক্তির সন্দেশ নিয়ে এল আর একটি ঘটনা। চাকরির প্রশিক্ষণান্তে পুত্র ও পুত্রবধূ সুদূর শিলং নগরীতে পোস্টিং পেয়ে সেখানে নুতন সংসার জীবন শুরু করবার পর একদিন ডাক এল। আমার এতদিনের সাজানো ঘর ফেলে রওনা হলাম তার সংসারের পথে।
একবার সুজলা সুফলা পূর্ববঙ্গ থেকে মূলোৎপাটিত হয়ে এই বাংলার মাটিতে এই নৈহাটিতে আমায় রোপণ করেছিল আমার বিবাহ। তখন বয়স কম। তরুণ বৃক্ষশিশু সহজেই সেই নতুন মাটিকে আপন করে নিয়েছিল। তার দীর্ঘ অর্ধশতক বাদে এই প্রাচীন বৃক্ষকে ফের একবার ছিন্নমূল হয়ে এক পাহাড়ি দেশে নতুন করে শিকড় বিছাবার চেষ্টায় রত হতে হল।
এইখানে, শিলং পাহাড়ে একটি টিনের চাল দেয়া সুপরিসর বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে এখন আমার বাস। পুত্র ও পুত্রবধূ দুইজনেই কর্মোপলক্ষে সারাদিন বাড়ির বাইরে। সদ্যোজাত ফুলের মত নাতনীটি এখন আমার সঙ্গী। কোনো অলস মধ্যাহ্নে তাহার নিষ্পাপ হাসিটির দিকে চোখ রেখে মনে মনে ভাবি, “মেয়ে জাত। শেকড় তুলে কোথা থেকে কোথায় ভেসে যাবি দিদি কে জানে।”
অবসর সময়ে ডায়েরির কাগজে কিছু আঁকিবুঁকি করি। সাধারণ এক নারীর ততোধিক সাধারণ জীবনকথা। কে-ই বা আর তার মূল্য দেয়!
(শেষ)