পাণিনি একটা সুবিপুল ভাষার প্রকৃতিগত বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা কী উপায়ে আবিষ্কার করলেন তা এক বিস্ময়কর অভিযাত্রা। আমার বর্তমান উদ্দেশ্য তাঁর ‘অষ্টাধ্যায়ী’-র নানারকম প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যাওয়া --- এই ভাষাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত কিছু প্রকরণ, পদ্ধতি, অন্য টুকিটাকি --- সব মিলিয়ে একটা পাণিনীয় miscellany গেঁথে ফেলা। সামগ্রিক ভাবেই এ আলোচনা পাঠকের কোনো বিশেষজ্ঞতা দাবি করে না, সংস্কৃতজ্ঞানও দাবি করে না। বর্তমান আলোচনার প্রয়োজনে পাঠকের পক্ষে কিছু প্রত্যয়ের নাম জানাই যথেষ্ট। অনেকেরই ব্যাকরণ পড়ার সূত্রে 'অণ্' ‘অনট্’ ‘ষ্ণিক’ ইত্যাদি অনেক পাণিনীয় অপাণিনীয় প্রত্যয়-নামের সঙ্গে পরিচয় আছে। অর্থাৎ, যে নামে প্রত্যয়ের কার্যকর অংশের (অ, অন, ইক এবং অন্যান্য) বাইরেও কয়েকটি বর্ণ আছে (ণ্, ট্, ষ্ প্রভৃতি)। এইটুকু নিয়েই পথ-চলা শুরু করা যাবে। |
প্রসঙ্গ-সূচি: ২.১ সূত্র ২.১.১ সংজ্ঞা সূত্র, ২.১.২পরিভাষা সূত্র, ২.১.৩ বিধি সূত্র, ২.১.৪ নিয়ম সূত্র ও প্রতিষেধ সূত্র, ২.১.৫ অতিদেশ সূত্র, ২.১.৬ অধিকার সূত্র
২.২ পাণিনির সূত্রভাষা ২.২.১ ‘ষষ্ঠী স্থানেযোগা’--- ষষ্ঠী বিভক্তি, ২.২.২ ‘তস্মিন্নিতি নির্দিষ্টে পূর্বস্য’ --- সপ্তমী বিভক্তি, ২.২.২.১ উপপদে সপ্তমী --- ‘তত্রোপপদং সপ্তমীস্থ’, ২.২.৩ ‘তস্মাদিত্যুত্তরস্য’ --- পঞ্চমী বিভক্তি, ২.২.৪ প্রথমা বিভক্তির বিশিষ্ট প্রয়োগ ---‘প্রথমানির্দিষ্টং সমাস উপসর্জনম্’; এবং সূত্রে সন্ধি, ২.২.৫ প্রত্যাহারের সাধারণ পরিচয় --- ‘আদিরন্ত্যেন সহেতা’, ২.২.৫.১ প্রতীকী প্রত্যাহার, ২.২.৬ বহুবচনের বিভক্তি, ২.২.৭ ‘আদি’-র সন্ধানে, ২.২.৮ বর্ণনির্দেশ --- ‘ত্’ এবং ‘কার’, ২.২.৮.১ স্বরবর্ণ: ‘তপরস্তৎকালস্য’, ২.২.৮.২ সমস্ত বর্ণ: ‘বর্ণাৎ কারঃ’, ২.২.৯ র-নির্দেশ --- ‘রাদিফঃ’, ২.২.১০ সূত্রে ধাতুর উল্লেখ, ২.২.১০.১ ধাতুর নাম: বিনা অনুবন্ধে ও অনুবন্ধ সমেত, ২.২.১০.২ ধাতুনির্দেশ: ‘ইক্-শ্তিপৌ ধাতুনির্দেশে ইতি বক্তব্যম্’, ২.২.১১ বিভাষা: ‘ন বেতি বিভাষা’, ২.২.১২ বহুলম্, ২.২.১৩ নিত্যম্, ২.২.১৪ সূত্রের মাপ, ২.২.১৫ পাণিনির respectively --- ‘যথাসংখ্যমনুদেশঃ সমানাম্’
২.৩ কতিপয় ধারণা ও সংজ্ঞা ২.৩.১ প্রাতিপদিক, ২.৩.১.১ প্রাথমিক সংজ্ঞা --- ‘অর্থবদধাতুরপ্রত্যয়ঃ প্রাতিপদিকম্’, ২.৩.১.২ সংযোজন ---‘কৃত্তদ্ধিতসমাসাশ্চ’, ২.৩.২ পদ --- ‘সুপ্তিঙন্তং পদম্’, ২.৩.৩ সার্বধাতুক --- ‘তিঙ্শিৎ সার্বধাতুকম্’, ২.৩.৪ আর্ধধাতুক --- ‘আর্ধধাতুকং শেষঃ’, ২.৩.৫ অঙ্গ --- ‘যস্মাৎ প্রত্যয়বিধিস্তদাদি প্রত্যয়েঽঙ্গম্’, ২.৩.৬ স্থানী--- ‘স্থানিবদাদেশোঽনল্বিধৌ’ |
পূর্ববর্তী আলোচনার সঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া হল: https://www.parabaas.com/PB80/LEKHA/pDevadatta80.shtml
ওই আলোচনায় দেখা গেছে যে ইৎ-সংজ্ঞক বর্ণ বা অনুবন্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। বলা চলে, ইৎ-সংজ্ঞক বর্ণসমূহের মধ্যে পাণিনি ভাষার অর্ধেকেরও বেশি খবর রেখে গেছেন। প্রতিটি ইৎ-বর্ণ বা অধিকাংশ ইৎ-বর্ণ নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করবার ইচ্ছে রইল। তার আগে অষ্টাধ্যায়ী কীভাবে রচিত ও বিন্যস্ত, তার যুক্তির বনিয়াদ ও ইমারত, তার সঙ্গে কিছু প্রাথমিক পরিচয় আমার মতে বেশি আবশ্যক ও ফলপ্রদ।
২.১ সূত্র
আগের পর্বে বেশ কিছু সূত্র উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে সূত্রের আকৃতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে একটু ধারণা করা গেছে। সূত্র সম্বন্ধে যুগ যুগ ধরে যে উক্তিটি প্রচলিত সেটা এড়িয়ে চলা কঠিন। ---
সূত্রের উদ্দেশ্য ছয় প্রকার, তাই সূত্রও ষড়্বিধ। --- সংজ্ঞা সূত্র, পরিভাষা সূত্র, বিধি সূত্র, নিয়ম সূত্র, অতিদেশ সূত্র, অধিকার সূত্র। এই শ্রেণিবিভাগ পাণিনি-পরবর্তী কালে এতটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিয়ম-সূত্রের পাশাপাশি কেউ কেউ ‘প্রতিষেধ সূত্র’ নামে আরেকরকম সূত্রেরও উল্লেখ করেন; সেই হিসেবে সূত্রের সাতটি জাত। অষ্টাধ্যায়ীর সমস্ত সংকলনেই যে সূত্রের পাশে তার শ্রেণি নির্দেশ করা হয় এমন নয়। যেমন, শ্রীশচন্দ্র বসু সূত্রের শ্রেণি আদৌ উল্লেখ করেন না অথবা ক্বচিৎ-কখনও করেন; কিন্তু তপনশংকর ভট্টাচার্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই করে থাকেন। সূত্রবিশেষের শ্রেণি নিয়েও মতভেদ লক্ষ করা যায়। যথা, সূত্র ১|১|৫৬ ‘স্থানিবদাদেশোঽনল্বিধৌ’ --- কোনো সংকলনে এটি ‘পরিভাষা সূত্র’ বলে চিহ্নিত, কিন্তু শ্রীশচন্দ্র বসুর মতে একে ‘অতিদেশ সূত্র’ বলা যায়। আবার, কোনো সংকলনে যেগুলি ‘প্রতিষেধ সূত্র’, অন্য সংকলনে সেগুলি নিয়ম-সূত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। এইসব বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সূত্রের শ্রেণি উল্লেখ করা থাকলে যে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয় তাতে সন্দেহ নেই।
২.১.১ সংজ্ঞা সূত্র
বাংলায় ‘সংজ্ঞা’ বলতে আমরা ইংরেজি definition বুঝি। সংজ্ঞা-সূত্রের ‘সংজ্ঞা’-র সঙ্গে তার তেমন পার্থক্য নেই। ‘সংজ্ঞা সূত্র’ হল Technical Rules বা Rules of Definition --- এখানে সরলতার খাতিরে aphorism নয়, সাধারণ rule শব্দটাই ব্যবহার করতে হল। ‘সংজ্ঞা সূত্র’ কোনো নতুন ধারণার বা ঘটনার বিবৃতি ও নামকরণ। সংস্কৃতে ‘সংজ্ঞা’ কথাটার অর্থও নাম, এবং ব্যাকরণে proper noun-কেও বলে ‘সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য’। অষ্টাধ্যায়ীর প্রথম সূত্র ‘বৃদ্ধিরাদৈচ্’ জানাচ্ছে ‘বৃদ্ধি’ বস্তুটি কী, তাই সূত্র ১|১|১ একটি ‘সংজ্ঞা সূত্র’। সূত্র ১|১|২ ‘অদেঙ্ গুণঃ’ জানাচ্ছে ‘গুণ’ বস্তুটি কী, এটিও একটি ‘সংজ্ঞা সূত্র’। মাঝখানের কয়েকটি ‘পরিভাষা সূত্র’ ছেড়ে আবার নতুন বস্তু সংজ্ঞায়িত হচ্ছে, ‘সংযোগ’ বা যুক্তব্যঞ্জন; সেটি ‘সংজ্ঞা সূত্র’ --- 'হলোঽনন্তরাঃ সংযোগঃ' (সূত্র ১|১|৭)। তার পরের সূত্র ১|১|৮ ‘মুখবচনোঽনুনাসিকঃ’ ঘোষণা করছে কাকে বলে ‘অনুনাসিক’ বর্ণ। ‘তুল্যাস্যপ্রযত্নং সবর্ণম্’ (সূত্র ১|১|৯) এবং ‘নাজ্ঝলৌ’ (সূত্র ১|১|১০) বলছে কোন্টা ‘সবর্ণ’ ও কোন্টা নয়। তারাও ‘সংজ্ঞা সূত্র’।
বাংলায় ‘পরিভাষা’ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি terminology বা কোনো বিষয়ের বিশিষ্টার্থক শব্দ। পাণিনিতে ‘পরিভাষা সূত্র’ বলতে বোঝায় interpretive rules, অর্থাৎ যে সূত্র কোনো নির্দিষ্ট সূত্রের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই পূর্বোক্ত ‘বৃদ্ধি’ ও ‘গুণ’ সম্বন্ধে সংজ্ঞা-সূত্রের পরে জানতে হবে তাদের প্রয়োগের নিয়ম ও ক্ষেত্র --- সেগুলি হবে ‘পরিভাষা সূত্র’। সূত্র ১|১|৩ ‘ইকো গুণবৃদ্ধী’ বলছে ‘ইক্’ বর্ণের (ই উ ঋ ৯) জায়গায় গুণ ও বৃদ্ধি হয়। এটি ‘পরিভাষা সূত্র’। ‘ন ধাতুলোপ আর্ধধাতুকে’ (সূত্র ১|১|৪), ‘ক্ঙিতি চ’ (সূত্র ১|১|৫), ‘দীধীবেবীটাম্’ (সূত্র ১|১|৬) জানাচ্ছে কোথায় কোথায় গুণ ও বৃদ্ধি হয় না। সুতরাং একই কারণে তারাও ‘পরিভাষা সূত্র’।
২.১.৩ বিধি সূত্র
‘বিধি সূত্র’ অর্থ operation rule; সংখ্যায় এরাই সব থেকে বেশি। একটি নির্দিষ্ট শব্দ বা শব্দাংশ বা বর্ণ, অর্থাৎ একটি input-এর ওপর কী কার্য হবে তা ব্যক্ত করে ‘বিধি সূত্র’। একটি উদাহরণ --- ‘প্রিয়বশে বদঃ খচ্’, সূত্র ৩|২|৩৮। এটি আমাদের খুব পরিচিত দু’টি শব্দ সম্বন্ধে ‘বিধি সূত্র’ --- ‘প্রিয়ংবদ’ ও ‘বশংবদ’। সূত্র বলছে, কর্মবাচক উপপদ ‘প্রিয়’ এবং ‘বশ’ শব্দের পরে বদ্-ধাতুর উত্তর ‘খচ্’ প্রত্যয় হয়। এর থেকেই আমরা জানতে পারি, প্রিয় + √বদ্ + খচ্ = প্রিয়ংবদ, বশ + √বদ্ + খচ্ = বশংবদ। কিন্তু উপপদ ‘প্রিয়’ বা ‘বশ’-এর পর একটা ‘ম্’ কোথা থেকে আসছে জানতে পারি না। সেটা জানতে পারি আরেকটি ‘বিধি সূত্র’ থেকে--- ‘অরুর্দ্বিষদজন্তস্য মুম্ (খিতি)’, সূত্রসংখ্যা ৬|৩|৬৭। সেই সূত্র বলছে, ‘অরুস্’ ‘দ্বিষৎ’ এবং স্বরান্ত (অচ্-অন্ত) শব্দের উত্তর ‘মুম্’ আগম হয়, যদি খিৎ (খ্-ইৎ) প্রত্যয়ান্ত কোনো শব্দ পরে থাকে। অর্থাৎ, খচ্-প্রত্যয়ের ইৎ-বর্ণ খ্ বোঝাচ্ছে পূর্বপদের পর ‘মুম্’ (= ম্) আগম। সুতরাং দু’টি ‘বিধি সূত্র’, ৩|২|৩৮ এবং ৬|৩|৬৭, প্রয়োগ করে আমরা বুঝতে পারি পূর্বোল্লিখিত দু’টি শব্দের ব্যুৎপত্তি --- প্রিয় + √বদ্ + খচ্ = প্রিয় + মুম্ + বদ্ + অ = প্রিয় + ম্ + বদ্ + অ = প্রিয়ংবদ।
আবার, নানাবিধ সূত্রের আন্তঃসম্পর্কের দিক থেকে এটাও লক্ষ করা যেতে পারে যে ‘খচ্’-এর খ্ যে ইৎ-বর্ণ তা বলা হয়েছে ‘লশক্বতদ্ধিতে’ সূত্রে (১|৩|৮)। খচ্-এর অন্ত্য চ্ এবং মুম্-আগমের অন্ত্য ম্ যে ইৎ-সংজ্ঞক তা বলা হয়েছে ‘হলন্ত্যম্’ সূত্রে (১|৩|৩)। এ দু’টিই ‘সংজ্ঞা সূত্র’। এই দুই সূত্র প্রয়োগেই আমরা পাচ্ছি খচ্-এর কার্যকর অংশ ‘অ’, এবং মুম্-এর কার্যকর অংশ ‘ম্’। আর, মুম্-এর ম্-ইৎ নির্দেশ করছে এই আগম কোনো স্বরান্ত পদের পরে বসবে। তা জানা যাচ্ছে সূত্র ১|১|৪৭ ‘মিদোঽচন্ত্যাৎ পরঃ’ থেকে; এটি ‘পরিভাষা সূত্র’। অতএব, ‘প্রিয়বশে বদঃ খচ্’ এই ‘বিধি সূত্র’ (৩|২|৩৮) দ্বারা একটি কার্য বিহিত হয়েছে; সেই বিধির সম্পূর্ণ প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে বিধি-সূত্র ৬|৩|৬৭, সংজ্ঞা-সূত্র ১|৩|৩ ও ১|৩|৮, এবং পরিভাষা-সূত্র ১|১|৪৭। এতগুলো সূত্র দ্বারা ভাষার মাত্র একটি ঘটনাকে বুঝতে হবে তা প্রথম দর্শনে ভীতিপ্রদ হলেও ঠিক এই কাজই আমরা সাবলীল ভাবে করে থাকি জ্যামিতিশাস্ত্রে। একটি ত্রিভুজের তিনটি কোণের যোগফল দুই সমকোণের সমান এই সত্যের প্রমাণ করতে গেলে যেকোনো সরলরেখার ওপর অবস্থিত কোণটি দুই সমকোণ সেই প্রথম উপপাদ্য থেকে শুরু করে সমান্তরাল রেখার নানা ধর্ম পর্যন্ত কতগুলো উপপাদ্য আমাদের আয়ত্ত করতে হয় তা স্মরণ করা চলে। অথচ অতুলনীয় একটি যুক্তি-পরম্পরায় তা আমাদের চিন্তাবৃত্তির অংশ হয়ে ওঠে, সেটি আর জটিল ও দুর্বহ কোনো ভার বলে মনে হয় না।
২.১.৪ নিয়ম সূত্র ও প্রতিষেধ সূত্র
‘নিয়ম’ শব্দ সংস্কৃতে ব্যবহৃত হয় restriction অর্থে। কোনো সূত্রে বিহিত কার্যকে ক্ষেত্রবিশেষে সীমাবদ্ধ ও সুনির্দিষ্ট করার প্রয়োজন হতে পারে, সেই কাজটি করে ‘নিয়ম সূত্র’ (restriction rule)। যেমন, অবিশেষিত অবস্থায় ‘ধাতু’ পরস্মৈপদী ও আত্মনেপদী দু’রকমই বোঝায়, কিন্তু ‘ধাতুপাঠ’-এ কোনো ধাতুর ইৎ-স্বর যদি ‘অনুদাত্ত’ বলে নির্দিষ্ট থাকে অথবা সে ধাতুতে যদি ইৎ-বর্ণ রূপে ‘ঙ্’ থাকে তাহলে সে ধাতু আত্মনেপদী বুঝতে হবে, এবং এর অন্যথা হবে না। এই কথাটি জানাচ্ছে সূত্র ১|৩|১২, ‘অনুদাত্তঙিতো আত্মনেপদম্’; তাই সেটি ‘নিয়ম সূত্র’। এরকম সূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কাশিকাবৃত্তি প্রায়ই বলে ‘নিয়মঃ ক্রিয়তে’ কথাটা।
‘প্রতিষেধ সূত্র’ দ্বারা অন্য কোনো সূত্রে নির্দিষ্ট কার্য নিষেধ করা হয়। এ জাতীয় সূত্রকে negation rule বলে বুঝতে হবে। কিৎ (ক্-ইৎ) কৃৎ-প্রত্যয় গুণ বৃদ্ধি দুই-ই নিষেধ করবে তা বিহিত আছে ‘ক্ঙিতি চ (ইকো গুণবৃদ্ধী ন)’ সূত্রে (১|১|৫); কিন্তু সূত্র ১|২|১৮ বলছে ‘ন ক্ত্বা সেট্ (কিৎ)’। অর্থাৎ, ক্ত্বা-প্রত্যয়ে ইৎ-বর্ণ ক্ আছে, তবু সেট্-ধাতুর (যে ধাতুতে ইট্-আগম হয়) বেলায় ক্ত্বা-প্রত্যয় গুণ বারণ করবে না। যেমন, √ভিদ্ + ক্ত্বা = ভেদিত্বা (ভেদ করিয়া)। কিৎ-এর পূর্বনির্দিষ্ট কার্যকে এই ক্ষেত্রে নাকচ করল ‘ন ক্ত্বা সেট্’ সূত্র। অতএব এটি একটি ‘প্রতিষেধ সূত্র’। এ জাতীয় সূত্রের ব্যাখ্যায় কাশিকাবৃত্তিতে প্রায়শ পাওয়া যায় ‘প্রতিষিধ্যতে’ ক্রিয়াপদটি।
২.১.৫ অতিদেশ সূত্র
‘অতিদেশ সূত্র’-কে extension rule বলা চলে। যে কার্য কোনো বস্তুর জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে তা অন্য কোনো বস্তুর জন্য প্রযোজ্য হয়ে উঠলে সেই ঘটনাটি হয় ‘অতিদেশ’। যেমন, কৃৎ-প্রত্যয় ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হলে ধাতুর স্বরের গুণ হয় এটা নির্দিষ্ট কার্য [সূত্র ৭|৩|৮৪, ‘সার্বধাতুকার্ধধাতুকয়োঃ (অঙ্গস্য গুণঃ)’]; এবং প্রত্যয়ে যদি নির্দেশক ইৎ-বর্ণ ঙ্ থাকে তাহলে গুণ হয় না, সেটিও নির্দিষ্ট কার্য [সূত্র ১|১|৩, ‘ক্ঙিতি চ (ইকো গুণবৃদ্ধী ন)’]। কিন্তু কয়েকটি ধাতুতে দেখা যায় যে অঙিৎ (ঙ্ ইৎ নয়) এমন প্রত্যয় যুক্ত হলেও গুণ হচ্ছে না। তাহলে সেই ঘটনা একটি ‘অতিদেশ’। এমন ঘটে থাকে ‘কুট্’-আদি ধাতুগুলিতে। কুট্-ধাতু থেকেই ‘কুটিল’ শব্দ; ধাতুপাঠ-এ বলা আছে ‘কুট কৌটিল্যে’ (কুটিলতা বোঝাতে কুট্-ধাতু; অন্যান্য অর্থও অবশ্য আছে)। কিন্তু কুট্-ধাতু যখন যুক্ত হল ‘তব্য’ প্রত্যয়ের সঙ্গে তখন পাওয়া গেল ‘কুটিতব্য’। ধাতুর উ-কার গুণিত হয়ে ও-কার হল না। এই অগুণ ঙিৎ-জাতীয় প্রত্যয়ের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং একটি ‘অতিদেশ সূত্র’ দ্বারা এই ঘটনাটি বলে দিতে হবে। সেই ‘অতিদেশ সূত্র’ হল, ‘গাঙ্কুডাদিভ্যোঽঞ্ণিৎ-ঙিৎ’ (সূত্র ১|২|১)। কাশিকাবৃত্তি এই সূত্রের ব্যাখ্যায় প্রথমেই বলছে --- ‘অতিদেশোঽয়ম্’ (এটি অতিদেশ)। এবং অষ্টাধ্যায়ীতে এটাই প্রথম ‘অতিদেশ সূত্র’।
২.১.৬ অধিকার সূত্র
পাণিনির ব্যাকরণ মোটামুটি ৩৯৮০-টি সূত্রের অনবচ্ছিন্ন মালা; এবং সেটি মৌখিক আবৃত্তির মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলত। এর মধ্যে যে বিবিধ বিষয় আলোচিত হয়েছে, কারক প্রত্যয় ধাতু ইত্যাদি, তার সূত্রগুলিকে আবৃত্তির মাধ্যমেই চিহ্নিত করার প্রয়োজন ছিল। সেই উদ্দেশ্যে একেকটি অতিসংক্ষিপ্ত সূত্র আলোচ্য বিষয়টি ঘোষণা করত। সেই সূত্র একটু অন্য সুরে পাঠ করার নির্দেশ ছিল। বোঝা যেত তার পর থেকে অন্য কোনো নির্দিষ্ট সূত্র পর্যন্ত যা পড়া হবে তা ওই বিষয়ভুক্ত। এই বিশেষ সুরের ব্যাপারটি বেশ স্বাভাবিক। আমরাও যখন কোনো লেখা থেকে পাঠ করে শোনাই তখন তার শিরোনামগুলি পাঠ করি কিঞ্চিৎ অন্য সুরে। পাণিনির সেই সূত্রগুলিই ছিল ‘অধিকার সূত্র’, বা বিষয়ের শিরোনাম। ইংরেজিতে এদের heading rules বা governing rules বলা যায়। এদের পাঠ করতে হবে ‘স্বরিত’ স্বরে, সেকথা বলা হয়েছে ‘স্বরিতেনাধিকারঃ’ এই পরিভাষা-সূত্রে (সংখ্যা ১|৩|১১)। অধিকার-সূত্রের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত ‘প্রত্যয়ঃ’, সূত্রসংখ্যা ৩|১|১। কাশিকাবৃত্তি জানাচ্ছে, ‘অধিকারোঽয়ম্’, এইটি অধিকার। এই ‘অধিকার সূত্র’ পাঠ করা হচ্ছে তৃতীয় অধ্যায়ের একেবারে আরম্ভে। এখান থেকেই প্রত্যয়ের আলোচনা শুরু হচ্ছে। এই অধিকারের প্রদেশ বিস্তৃত হয়ে আছে পঞ্চম অধ্যায়ের শেষ সূত্র পর্যন্ত। সেখানে পৌঁছে প্রত্যয় বিষয়টি সমাপ্ত হল। ‘প্রত্যয়ঃ’ সূত্রের ঠিক পরের সূত্রও একটি অধিকার, ‘পরশ্চ’ (সূত্র ৩|১|২)। সে সূত্র জানাচ্ছে যে প্রত্যয় নামের সমস্ত কিছু যুক্ত হবে ধাতু বা প্রাতিপদিকের পরে। একটি অধিকারের ভিতরে এভাবে আরেকটি অধিকারের প্রদেশ থাকতে পারে। তারও সীমা নির্দিষ্ট থাকে।
২.২ পাণিনির সূত্রভাষা
বিভক্তির সঙ্গে বাক্যের পদের অর্থবোধ জড়িত। ‘এই গোধূলির ধূসরিমায় শ্যামল ধরার সীমায় সীমায়’ --- এখানে ‘ধূসরিমায়’ এবং ‘সীমায়’ শব্দের ‘এ’-বিভক্তি বোঝাচ্ছে অধিকরণ কারক। কিন্তু ‘আমায় দাও গো বলে সে কি তুমি’, সেখানে ‘আমায়’ শব্দের ‘এ’-বিভক্তি বোঝাচ্ছে ‘আমাকে’, কর্মকারক। বাংলাভাষা শিখতে হলে একই ‘এ’-বিভক্তি যে নানারকম অর্থ বোঝায় তা শিখতে হয়। এই প্রভেদগুলো ভাষার বাগ্ধারা বা ইডিয়মের বৈশিষ্ট্য। পাণিনি তাঁর সূত্রগুলিতে নানা বিভক্তি তাদের চিরাচরিত অর্থে প্রয়োগ করেছেন, না বিশিষ্ট অর্থে প্রয়োগ করেছেন তা তাঁর সূত্র অধ্যয়ন করতে হলে জানতে হবে। অর্থাৎ, পাণিনি-সূত্রের ইডিয়মটি আগে রপ্ত করতে হবে। তার জন্যও সূত্র আছে। এইরকম প্রথম সূত্রটি হল ষষ্ঠী বিভক্তি সংক্রান্ত। আমি এখন থেকে সূত্রের আলোচনার সঙ্গে প্রায়শ তাদের কাশিকাবৃত্তির ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করব ও তার সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবানুবাদ করব। কোনো সূত্রের সঙ্গে বন্ধনীতে এক বা একাধিক পদ থাকলে বুঝতে হবে তা ‘অনুবৃত্তি’।
২.২.১ ‘ষষ্ঠী স্থানেযোগা’ (সূত্র ১|১|৪৯) --- ষষ্ঠী বিভক্তি
সাদা কথায় এই সূত্র বলছে, এই শাস্ত্রে কোনো শব্দে ষষ্ঠী বিভক্তি সাধারণত ‘(সেই বস্তুর) স্থানে’ (in place of) এইরূপ বোঝাবে। ষষ্ঠী বিভক্তি প্রধানত সম্বন্ধ পদ বোঝায়। ‘তদ্’ শব্দের ষষ্ঠী বিভক্তির একবচন ‘তস্য’ অর্থ ‘তার’। কিন্তু অষ্টাধ্যায়ীতে তা হবে না, যদি-না অন্য কোনো নিয়ম বলা থাকে। আমাদের পরিচিত ‘ইকো গুণবৃদ্ধী’, সূত্র ১|১|৩-এ ‘ইকঃ’ পদটি বিসর্গসন্ধিতে ‘ইকো’ হয়েছে। ‘ইকঃ’ হল ‘ইক্’ শব্দের ষষ্ঠীর একবচন। ‘ইক্’ প্রত্যাহার অর্থ {ই উ ঋ ৯}, মাহেশ্বর-সূত্র। গুণ: {অ এ ও}, অষ্টাধ্যায়ীর সূত্র ১|১|২; বৃদ্ধি: {আ ঐ ঔ}, সূত্র ১|১|১। সুতরাং ‘ইকো গুণবৃদ্ধী’ সূত্রের অর্থ হবে, ‘ইক্-এর স্থানে গুণ এবং বৃদ্ধি।’ অর্থাৎ, {ই উ ঋ ৯}-এর স্থানে {অ এ ও} এবং {আ ঐ ঔ} হয়। আবার, ‘ইগ্যণঃ সম্প্রসারণম্’ সূত্রে (১|১|৪৫) ‘যণঃ’ হল ‘যণ্’ শব্দের ষষ্ঠীর একবচন। যণ্-প্রত্যাহার: {য্ ব্ র্ ল্}। সন্ধিতে ‘ইক্’ হয়েছে ‘ইগ্’। সুতরাং সূত্রার্থ হল, ‘যণ্-এর স্থানে ইক্ হওয়াকে সম্প্রসারণ বলে।’
ষষ্ঠী বিভক্তিতে ‘(অমুকের) স্থানে’ অর্থটি প্রযোজ্য না হলে এই সূত্র চলবে না বলাই বাহুল্য। যেমন, আমাদের আরেকটি পরিচিত সূত্র ‘অণুদিৎ সবর্ণস্য চাপ্রত্যয়ঃ’ (সূত্র ১|১|৬৯) --- এখানে পূর্বসূত্রের অনুবৃত্তি ‘স্বং রূপম্’ সহ সূত্রটি হল, ‘অণুদিৎ (স্বং রূপম্) সবর্ণস্য চ অপ্রত্যয়ঃ’। অর্থাৎ, অপ্রত্যয়ে ‘অণ্’ ও উ-কার-ইৎ কোনো প্রত্যাহারের বর্ণ নিজের রূপ এবং সবর্ণেরও রূপ বোঝাবে। এখানে ‘সবর্ণস্য’ শব্দে ষষ্ঠী বিভক্তি তার চিরাভ্যস্ত অর্থই বহন করবে।
কাশিকাবৃত্তি ‘ষষ্ঠী স্থানেযোগা’ সূত্রের ব্যাখ্যায় বলেছে --- ‘পরিভাষেয়ং যোগনিয়মার্থা। ইহ শাস্ত্রে যা ষষ্ঠী অনিয়তযোগা শ্রূয়তে সা স্থানেযোগৈব ভবতি, নান্যযোগা। স্থানেযোগস্য নিমিত্তভূতে সতি সা প্রতিপত্তব্যা। স্থানশব্দশ্চ প্রসঙ্গবাচী। যথা দর্ভাণাং স্থানে শরৈঃ প্রস্তরিতব্যমিতি দর্ভাণাং প্রসঙ্গ ইতি গম্যতে। এবমিহাপি অস্তেঃ স্থানে প্রসঙ্গে ভূর্ভবতি। ভবিতা, ভবিতুম্, ভবিতব্যম্। ব্রুবঃ প্রসঙ্গে বচির্ভবতি। বক্তা, বক্তুম্, বক্তব্যম্। প্রসঙ্গে সম্বন্ধস্য নিমিত্তভূতে ব্রুবঃ ইতি ষষ্ঠীঃ। বহবো হি ষষ্ঠ্যর্থাঃ স্বস্বাম্যনন্তরসমীপসমূহবিকারাবয়বাদ্যাঃ, তত্র যাবন্তঃ শব্দে সম্ভবন্তি তেষু সর্বেষু প্রাপ্তেষু নিয়মঃ ক্রিয়তে। ষষ্ঠী স্থানেযোগেতি স্থানেযোগোঽস্যা ইতি ব্যধিকরণো বহুব্রীহিঃ। অত এব নিপাতনাচ্চ সপ্তম্যা অলুক্।’
উক্ত ব্যাখ্যার মোটামুটি বক্তব্য এই --- যোগনিয়মের জন্য (যোগ অর্থাৎ relation) এই পরিভাষা। [এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এটি ‘পরিভাষা সূত্র’।] যে ষষ্ঠী অন্য নিয়মে বদ্ধ নয় (অনিয়ত) এই শাস্ত্রে সে স্থানেযোগেই হবে, অন্য যোগে নয়। ‘স্থান’ বলতে ‘প্রসঙ্গ’-ও (occasion) বোঝাবে। [এই occasion অর্থে বাংলায় ‘উপলক্ষ্য’ শব্দটি বেশি প্রচলিত, আমিও ‘উপলক্ষ্য’-ই ব্যবহার করতে চাই।] যথা, ‘দর্ভাণাং স্থানে শরৈঃ প্রস্তরিতব্যম্’ এই বাক্যে ‘স্থানে’ অর্থ ‘প্রসঙ্গে’, উপলক্ষ্যে। যখনই দর্ভ-ঘাস বিছানোর উপলক্ষ্য আসবে, শর দিয়ে বিছিয়ে দাও। এইভাবেই ‘অস্তের্ভূঃ (আর্ধধাতুকে)’ সূত্রে (সংখ্যা ২|৪|৫২) এবং ‘ব্রুবো বচিঃ (আর্ধধাতুকে)’ সূত্রে (সংখ্যা ২|৪|৫৩) যেখানে ‘অস্তেঃ’ এবং ‘ব্রুবঃ’ শব্দ দু’টি ষষ্ঠী বিভক্তিতে আছে সেখানে বুঝতে হবে, ‘অস্’ এবং ‘ব্রু’ ধাতুর সঙ্গে যদি আর্ধধাতুক-প্রত্যয় ব্যবহার করবার উপলক্ষ্য আসে তাহলে যথাক্রমে ‘ভূ’-ধাতু ও ‘বচ্’-ধাতু ব্যবহার করবে। তার উদাহরণ, ভবিতা, ভবিতুম্, ভবিতব্যম্; বক্তা, বক্তুম্, বক্তব্যম্। পরিশেষে বলা হচ্ছে, ষষ্ঠীর বহু অর্থ --- স্বস্বামিত্ব, অনন্তর, সমীপ, সমূহ, বিকার, অবয়ব ইত্যাদি। ‘স্থানেযোগা’ শব্দটি ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস; পূর্বপদ ‘স্থানে’-র সপ্তমী বিভক্তি নিপাতনে ‘অলুক্’ (অলুপ্ত) হল।
‘স্থান’ শব্দ প্রসঙ্গ (উপলক্ষ্য)-ও বোঝায়, এই কথার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম দিক আছে। কাশিকাকার প্রদত্ত তার উদাহরণ থেকেই তা স্পষ্ট হচ্ছে। দর্ভ-ঘাস বিছানো আছে, সেই জায়গায় শর বিছিয়ে দেওয়া হবে, একথার তো মানে নেই। তাই ‘দর্ভাণাং স্থানে’ অর্থ, যেখানে দর্ভ-ঘাস বিছানোর কথা ছিল সেখানে। অর্থাৎ, দর্ভ-ঘাস বিছানোর উপলক্ষ্য দেখা দিলে শর বিছিয়ে দাও।
২.২.২ ‘তস্মিন্নিতি নির্দিষ্টে পূর্বস্য’ (সূত্র ১|১|৬৬) --- সপ্তমী বিভক্তি
এই সূত্রের পদচ্ছেদ করলে পাই, ‘তস্মিন্ ইতি নির্দিষ্টে পূর্বস্য’। ‘তস্মিন্’ অর্থ তার মধ্যে, তাতে। এটি ‘তদ্’ সর্বনামের সপ্তমী বিভক্তির একবচনের রূপ। সপ্তমী বিভক্তি সাধারণত অধিকরণ কারক বোঝায়। ‘তস্মিন্ ইতি’ বা ‘তার মধ্যে এমন’ অর্থ সাধারণ ভাবে কোনো শব্দের সপ্তমী বিভক্তি। সূত্রার্থ হল, সূত্রে সপ্তমী বিভক্তি দ্বারা নির্দিষ্ট কোনো পদ বোঝাবে যে সেই বিধি (operation) সেই সপ্তমী বিভক্তিযুক্ত পদের ঠিক আগের পদে প্রযোজ্য হবে। এটিও ‘পরিভাষা সূত্র’।
কাশিকাবৃত্তি বলছে --- ‘তস্মিন্ ইতি সপ্তম্যর্থনির্দেশে পূর্বস্যৈব কার্যং ভবতি, নোত্তরস্য। ইকো যণচি (সূত্র ৬|১|৭৭) --- দধ্যুদকম্, মধ্বিদম্, পচত্যোদনম্। নির্দিষ্টগ্রহণমানন্তর্যার্থম্। অগ্নিচিদত্রেতি ব্যবহিতস্য মা ভূৎ।’
বৃত্তির অর্থ --- ‘তার মধ্যে’ এমন সপ্তমী বিভক্তির অর্থ নির্দেশ করবে যে পূর্বপদের স্থলে কার্য হবে, উত্তরপদে নয়। তারপর ‘ইকো যণচি’ সূত্রের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে। এখানে পূর্বপদ ‘ইকঃ’ (বিসর্গসন্ধিতে ‘ইকো’), তাতে ষষ্ঠী বিভক্তি। ‘ষষ্ঠী স্থানেযোগা’ সূত্রের বলে এর অর্থ ‘ইক্-এর স্থানে’। ইক্-প্রত্যাহার: {ই উ ঋ ৯}। ‘যণচি’ ভাঙলে আমরা পাই, যণ্ + অচি। যণ্-প্রত্যাহার: {য্ ব্ র্ ল্}। অর্থাৎ, ইক্-এর স্থানে যণ্ হবে। কখন? পরপদ ‘অচি’, এখানে ‘অচ্’ শব্দের সপ্তমীর একবচনে ‘অচি’। ‘অচ্’ প্রত্যাহার বোঝায় সমস্ত স্বরবর্ণ। সুতরাং ‘তস্মিন্নিতি নির্দিষ্টে পূর্বস্য’ সূত্র অনুযায়ী যা কার্য হওয়ার তা পূর্বপদ ইক্-এর স্থানে হবে। অর্থাৎ, কোনো অচ্-এর (স্বরবর্ণ) আগে ইক্ {ই উ ঋ ৯} থাকলে ইক্-এর স্থানে যণ্ {য্ ব্ র্ ল্} হবে। বোঝা যাচ্ছে এটা সন্ধির নিয়ম। ই + স্বরবর্ণ = য্ + স্বরবর্ণ, দধি + উদকম্ = দধ্যুদকম্, পচতি + ওদনম্ = পচত্যোদনম্। উ + স্বরবর্ণ = (অন্তঃস্থ) ব্ + স্বরবর্ণ, মধু + ইদম্ = মধ্বিদম্। ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা হচ্ছে, সূত্রে ‘নির্দিষ্ট’ শব্দ ‘আনন্তর্য’ অর্থে, ‘অব্যবহিত’ অর্থে, নেওয়া হয়েছে। অব্যবহিত (ব্যবধান নেই এমন) না হলে এই কার্য (সন্ধি) ঘটবে না। যেমন, ‘অগ্নিচিৎ’। এখানে অগ্নি-র অন্ত্য ই-কারের সঙ্গে চিৎ-এর ই-কারের সন্ধি হল না কারণ মাঝখানে যে চ্ আছে।
এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, ই উ ইত্যাদির অব্যবহিত পরে যদি ই উ বর্ণই থাকে তাহলে তো য্ ব্ ইত্যাদি হওয়ার হেতু নেই, সেই সেই বর্ণের দীর্ঘস্বর হবে। তাহলে ‘ইকো যণচি’ সূত্র যেকোনো অচ্-এর কথা বলছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব ‘স্থানেঽন্তরতমঃ’ (সূত্র ১|১|৫০) প্রভৃতি সূত্রের ভিতরে।
২.২.২.১ উপপদে সপ্তমী --- ‘তত্রোপপদং সপ্তমীস্থ’ (সূত্র ৩|১|৯২)
এই ‘তত্রোপপদং সপ্তমীস্থ’ সূত্রে জানানো হচ্ছে যে কৃৎ-প্রত্যয় বিষয়ক সূত্রে ‘উপপদ’ মাত্রেই সপ্তমী বিভক্তি দ্বারা নির্দিষ্ট হবে। কাশিকাবৃত্তি বলছে --- ‘যৎ সপ্তমীনির্দিষ্টং তদুপপদসংজ্ঞং ভবতি।’ ওপরে আলোচিত ‘তস্মিন্নিতি নির্দিষ্টে পূর্বস্য’ সূত্রে সপ্তমী বিভক্তির তাৎপর্য সম্বন্ধে যা বলা হল তা থেকে এর কিছু পার্থক্য আছে।
‘কর্মণ্যণ্’ সূত্রটি (৩|২|১) দেখা যাক। ‘কর্ম্যণ্যণ্ (ধাতোঃ কৃৎ)’ অর্থাৎ ‘কর্মণি অণ্’, এখানে ‘কর্মণি’ পদটি ‘কর্মন্’ শব্দের সপ্তমী বিভক্তির একবচন। সূত্রটি বোঝাবে, কর্মবাচক উপপদ থাকলে ধাতুর উত্তর অণ্-কৃৎপ্রত্যয় হয়। কাশিকাবৃত্তির ব্যাখ্যায় --- ‘সর্বত্র কর্মণ্যুপপদে ধাতোরণ্প্রত্যয়ো ভবতি।’ বাংলাভাষায় অধিকরণ কারকে ‘এ’-বিভক্তি দ্বারা আমরা যেমন বলতে পারি ‘কর্মবাচক উপপদে ধাতুর উত্তর অণ্-প্রত্যয় হয়’, সেরকম বাগ্ধারা। উপরন্তু বারবার ‘উপপদ’ শব্দ ব্যবহার করা এড়ানো গেল। (সূত্রের বৃত্তিতে ‘সর্বত্র’ শব্দ বোঝাচ্ছে সর্বপ্রকার কর্ম; কর্ম তিন প্রকার, ‘নিকর্য’ ‘বিকর্য’ ‘প্রাপ্য’।) কর্মবাচক উপপদের উদাহরণ ‘কুম্ভং করোতি ইতি কুম্ভকারঃ’। কুম্ভ (উপপদ) + √কৃ + অণ্ = কুম্ভকার। এখানে ‘কুম্ভ’ শব্দ কর্মবাচক, তাই প্রত্যয়ান্ত পদের অর্থে সেটির রূপ ‘কুম্ভম্’। [অণ্-প্রত্যয়ের অন্ত্য ব্যঞ্জন ণ্ ইৎ-সংজ্ঞক (‘হলন্ত্যম্’ সূত্র) এবং ধাতুর অন্ত্যস্বরের বৃদ্ধি-দ্যোতক।] এখানে উপপদ একটি প্রাতিপদিক (বিশেষ্য)।
উপপদ একটি ধাতুও হতে পারে। ‘শংকর’, ‘শম্ভব’, ‘শংবদ’, এই শব্দগুলিতে উপপদ ‘শম্’-ধাতু; তার পরে যথাক্রমে কৃ ভূ বদ্ ধাতুতে অচ্-প্রত্যয় যুক্ত হচ্ছে। সূত্র ৩|২|১৪ বলছে, ‘শমি ধাতোঃ সংজ্ঞায়াম্ (অচ্)’। সূত্রে ‘শমি’ পদটি শম্-এর সপ্তমী বিভক্তির একবচনের রূপ। তা থেকে বোঝা গেল, শম্-ধাতুটিই উপপদ, এবং কৃ ভূ বদ্ ধাতু ‘অঙ্গ’ (দ্র. উপভাগ ৩.২.৫)। কাশিকাবৃত্তির ভাষায় --- ‘শম্যুপপদে ধাতুমাত্রাৎ সংজ্ঞায়াম্ বিষয়ে অচ্প্রত্যয়ো ভবতি।’ শম্ উপপদ থাকলে সংজ্ঞা অর্থাৎ নাম বিষয়ে যেকোনো ধাতুর উত্তর অচ্-প্রত্যয় হয়। ‘শংকর’ ইত্যাদি যে নাম তাতে আর সন্দেহ কী।
২.২.৩ ‘তস্মাদিত্যুত্তরস্য’ (সূত্র ১|১|৬৭) --- পঞ্চমী বিভক্তি
আগের সূত্র থেকে আমরা জেনেছি, সপ্তমী বিভক্তিযুক্ত পদের পূর্বপদে কার্য ঘটবে। বর্তমান সূত্র বোঝাবে কোন্ বিভক্তির পরের পদে কার্য ঘটবে। পদচ্ছেদ করলে অনুবৃত্তি সহ সূত্রটি হয়, ‘তস্মাৎ ইতি উত্তরস্য (নির্দিষ্টে)’। ‘তদ্’ শব্দের পঞ্চমী বিভক্তির একবচন ‘তস্মাৎ’, তার থেকে। অর্থাৎ, সূত্রে পঞ্চমী বিভক্তিযুক্ত পদের উত্তরপদে সেই সূত্রনির্দিষ্ট কার্য ঘটবে।
কাশিকাবৃত্তি বলছে --- “নির্দিষ্টগ্রহণমনুবর্ততে। তস্মাদ্ ইতি পঞ্চম্যর্থনির্দেশঃ। উত্তরস্যৈব কার্যং ভবতি, ন পূর্বস্য। তিঙ্ঙতিঙঃ (সূত্র ৮|১|২৮) --- ওদনং পচতি। ইহ ন ভবতি। ‘পচত্যোদনমিতি।” [এখানে নিম্নরেখা অনুদাত্ত ও ঊর্ধ্বকমা উদাত্ত স্বরের চিহ্ন।]
বৃত্তির অর্থ --- ‘নির্দিষ্ট’ শব্দ অনুবৃত্তি রূপে গ্রহণ করতে হবে। ‘তস্মাৎ’, তার থেকে, এমন পঞ্চমী বিভক্তির অর্থ নির্দেশ করবে যে পঞ্চমী বিভক্তিযুক্ত পদের উত্তরপদের স্থলে কার্য হবে, পূর্বপদে নয়।
বৃত্তির উদাহরণ --- তিঙ্ঙতিঙঃ (সূত্র ৮|১|২৮)। তার বৃত্তি --- ‘তিঙন্তং পদং অতিঙন্তাৎ পদাৎ পরম্ অনুদাত্তং ভবতি।’ অস্যার্থ --- ‘অতিঙন্ত পদের (non-verb) পরে তিঙন্ত পদ (conjugated verb) অনুদাত্ত (with grave accent) হয়।’ ‘তিঙ্ঙতিঙঃ’ পদের সন্ধি ভাঙলে ‘তিঙ্ অতিঙঃ’। এখানে ‘তিঙ্’ শব্দে প্রথমা বিভক্তি, ‘অতিঙ্’ শব্দ পঞ্চমী বিভক্তিতে ‘অতিঙঃ’। অতএব ‘অতিঙঃ’ বোঝাচ্ছে তিঙ্-এর অনুদাত্ত হওয়ার কার্যটি অতিঙ্-এর পরপদে হবে। পূর্বপদে নয়। তাই ‘ওদনং পচতি’ (সে ভাত রান্না করছে) বাক্যে ‘পচতি’ ক্রিয়াপদের (তিঙন্ত পদ) স্বর উদাত্ত হবে না, অনুদাত্ত হবে, কারণ এই বাক্যে সে অতিঙন্ত পদ ‘ওদনম্’-এর পরে রয়েছে। কিন্তু ‘পচত্যোদনম্ (পচতি ওদনম্)’ বাক্যে ‘পচতি’ উদাত্ত হবে কারণ সে অতিঙন্ত পদ ‘ওদনম্’-এর পরে নেই।
অন্য একটি উদাহরণ --- সূত্র ৮|৪|৬১, ‘উদঃ স্থাস্তম্ভোঃ পূর্বস্য’। এ সেই ‘উদ্ + স্থান’ সন্ধিতে কেন ‘উত্থান’ হবে তার সূত্র। এখানে ‘উদ্’ থেকে পঞ্চমী বিভক্তি অপাদান কারকে ‘উদঃ’। সুতরাং যা কার্য উদ্-এর পরবর্তী পদেই হবে। কীসের স্থানে হবে? সূত্রে ষষ্ঠী বিভক্ত্যন্ত যে পদ, অর্থাৎ ‘স্থাস্তম্ভোঃ’ (স্থা ও স্তম্ভ্ ধাতুর), তার স্থানে। এর বৃত্তি বলছে --- ‘উদ উত্তরয়োঃ স্থা স্তম্ভ ইত্যেতয়োঃ পূর্বসবর্ণাদেশো ভবতি।’ অর্থ --- উদ্-এর পরবর্তী স্থা এবং স্তম্ভ্ ধাতুর স্-এর স্থানে পূর্বের (উদ্-এর) সবর্ণ বসবে (‘আদেশ’, substitution, হবে)।
‘ষষ্ঠী স্থানেযোগা’ সূত্রের বৃত্তি থেকে জানা গিয়েছিল ‘স্থান’-শব্দ ‘প্রসঙ্গবাচী’, occasion বোঝায়। সেইমতো লিখলে ‘উদঃ স্থাস্তম্ভোঃ পূর্বস্য’ সূত্রের বৃত্তির অনুবাদ হবে --- উদ্-এর উত্তর স্থা এবং স্তম্ভ্ ধাতু থাকলে পূর্বের সবর্ণাদেশ হবে।
এখানে তো বলা হয় নি স্থা-এর কোন্ বর্ণে উদ্-এর সবর্ণাদেশ হবে, এবং উদ্-এর কোন্ বর্ণের সবর্ণ বসবে। এটা ‘আদেশ’ সংক্রান্ত একটি general প্রশ্ন, তার সমাধান পাণিনি কীভাবে করে গেছেন তাও আমরা পরে দেখতে পাব।
২.২.৪ প্রথমা বিভক্তির বিশিষ্ট প্রয়োগ ---‘প্রথমানির্দিষ্টং সমাস উপসর্জনম্’ (সূত্র ১|২|৪৩); এবং সূত্রে সন্ধি
প্রথমা বিভক্তি সাধারণত কর্তৃকারক বোঝায় একথা আমরা সকলে জানি। কিন্তু পাণিনি-সূত্রে প্রথমা বিভক্তির দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট বস্তুকে চিহ্নিত করা হচ্ছে এমন প্রকরণ ক্ষেত্রবিশেষে পাওয়া যায়। তার দৃষ্টান্ত --- ‘প্রথমানির্দিষ্টং সমাস উপসর্জনম্’, সূত্র ১|২|৪৩। এখানে বলা হচ্ছে, সমাসবিষয়ক সূত্রে যে পদ প্রথমা বিভক্তিযুক্ত হবে তা সেই সমাসের ‘উপসর্জন’ রূপে জানতে হবে। ‘উপসর্জন’ কাকে বলে তা একটু বিশদ আলোচনা দাবি করে। তা এখনকার মতো বাকি রেখে কেবল কাশিকাবৃত্তি যে উদাহরণ দিয়েছে সেটুকু সংক্ষেপে দেখে নেব। কাশিকা প্রদর্শন করছে সূত্র ২|১|২৪, ‘দ্বিতীয়া শ্রিতাতীতপতিতগতাত্যস্তপ্রাপ্তাপন্নৈঃ’। এখানে ‘দ্বিতীয়া’ শব্দে প্রথমা বিভক্তি, সুতরাং সেটি ‘উপসর্জন’। সূত্রটি দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস সম্পর্কে। বলা হচ্ছে, ‘শ্রিত’ ‘অতীত’ ‘পতিত’ ‘গত’ ‘অত্যস্ত’ ‘প্রাপ্ত’ ‘আপন্ন’ শব্দের সঙ্গে দ্বিতীয়া বিভক্তিযুক্ত কোনো শব্দ সমাসবদ্ধ হলে তা দ্বিতীয়া তৎপুরুষ হবে। যথা, ‘নরকং পতিতঃ = নরকপতিতঃ’। ‘নরকম্’ পদটি দ্বিতীয়ান্ত।
সূত্রে সন্ধি: এই সূত্রে সন্ধির একটি বিশেষ প্রয়োগ আছে। সূত্রটির পদচ্ছেদ করলে পাওয়া যায়, ‘প্রথমানির্দিষ্টং সমাসে উপসর্জনম্।’ ‘সমাসে’ শব্দের অন্ত্য এ-কারের পরেই আছে পরবর্তী ‘উপসর্জনম্’-এর উ। অ-কার ব্যতীত অন্য স্বরবর্ণ পরে থাকলে পূর্বপদের অন্ত্য এ-কারের স্থলে বিকল্পে অ-কার হয়। পক্ষে দুইয়ে মিলে হয় ‘অয়্’। তাই ‘সমাসে উপসর্জনম্’ = ‘সমাস উপসর্জনম্’। এই সন্ধিরই প্রয়োগ দেখা যায় ‘ন ধাতুলোপ আর্ধধাতুকে’ সূত্রে (১|১|৪)। এখানেও পদচ্ছেদ করলে পাওয়া যায়, ‘ন ধাতুলোপে আর্ধধাতুকে।’ (এই রচনার প্রথম পর্বে, পরবাস-৮০, আমি ছিন্নপদ রূপেই এই সূত্র উদ্ধৃত করেছিলাম।)
২.২.৫ প্রত্যাহারের সাধারণ পরিচয় --- ‘আদিরন্ত্যেন সহেতা’
মাহেশ্বর সূত্র প্রসঙ্গে ‘প্রত্যাহার’-এর কথা হয়েছিল, আমরা দেখেছিলাম কীভাবে বর্ণসংক্ষেপ করা হয়। এবং ‘হলন্ত্যম্ (উপদেশে ইৎ)’ সূত্র (১|৩|৩) থেকে জেনেছিলাম যে উপদেশের অন্ত্য ব্যঞ্জন ইৎ-সংজ্ঞক হয়। কিন্তু ‘হলন্ত্যম্’ কেবল প্রত্যাহারের অন্তসীমা নির্দেশ করে, সেটা একটা দিক মাত্র। দু’দিক সম্বন্ধে যে সূত্র আমাদের অবহিত করে তা হল --- ‘আদিরন্ত্যেন সহেতা (স্বং রূপম্)’, সূত্র ১|১|৭১। এর পদচ্ছেদ --- আদিঃ অন্ত্যেন সহ ইতা। এখানে ‘আদিঃ’ প্রথমা বিভক্তির একবচন, ‘অন্ত্যেন’ তৃতীয়া বিভক্তির একবচন, এবং ‘ইৎ’ শব্দের তৃতীয়া বিভক্তির একবচন ‘ইতা’। কাশিকাবৃত্তির ব্যাখ্যা --- ‘আদিরন্ত্যেন ইৎসংজ্ঞকেন সহ গৃহ্যমাণঃ তন্মধ্যপতিতানাং বর্ণানাং গ্রাহকো ভবতি স্বস্য চ রূপস্য।’ সূত্রার্থ --- আদিস্থিত বর্ণ অন্তস্থিত ইৎ-সংজ্ঞক বর্ণের সহিত তার নিজেকে এবং দুইয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত বর্ণদের বোঝায়।
কার আদিস্থিত, এবং কার অন্তস্থিত? এর ক্ল্যাসিক উদাহরণ দিয়েছে কাশিকাবৃত্তি। তাতেই বিষয়টা অসন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। উদাহরণটি এই --- শব্দরূপের বিভক্তিগুলো প্রথমায় ‘সু ঔ জস্’, দ্বিতীয়ায় ‘অম্ ঔট্ শস্’, তৃতীয়ায় ‘টা ভ্যাম্ ভিস্’। যদি বলা হয় ‘সুট্ প্রত্যাহার’ তাহলে আদিতে প্রথমার ‘সু’, কিন্তু অন্তের ‘ট্’ কি দ্বিতীয়ার ঔট্-এর ট্, না তৃতীয়ার টা-বিভক্তির ট্ বোঝাবে? টা = ট্ + আ, এখানে ট্ আদিস্থিত, অন্তস্থিত নয়। ‘আদিরন্ত্যেন সহেতা’ অনুসারে আমরা খুঁজছি অন্ত্য ট্। তাহলে সেটা ঔট্-এর অন্তস্থিত ট্-বর্ণই বোঝাবে। এবং ‘হলন্ত্যম্’ সূত্র অনুযায়ী সেই ট্ ইৎ-সংজ্ঞক। সুতরাং ‘সুট্’ বোঝাবে আদি বিভক্তি ‘সু’ থেকে ‘ঔট্’ পর্যন্ত, মাঝখানে পড়বে ‘ঔ জস্ অম্’ বিভক্তিগুলো। সুট্: {সু ঔ জস্ অম্ ঔট্}।
অতএব ‘আদিরন্ত্যেন সহেতা’ সূত্র প্রত্যাহারের ব্যাপ্তি নির্দেশ করল, এবং ‘হলন্ত্যম্’ সূত্র অন্ত্যবর্ণের জাতি (ব্যঞ্জন) নির্ধারণ করল।
২.২.৫.১ প্রতীকী প্রত্যাহার
আমরা ‘কু’ ‘চু’ ‘টু’ ইত্যাদি প্রত্যাহারের কথা জেনেছিলাম ‘অণুদিৎ সবর্ণস্য চাপ্রত্যয়ঃ’ সূত্র (১|১|৬৯) থেকে। এগুলিতে ইৎ-বর্ণ উ নির্দেশ করে সেই সেই বর্গের সমস্ত বর্ণ। যেমন, কু = {ক খ গ ঘ ঙ}। কিন্তু লক্ষণীয়, এগুলি ঠিক ‘আদিরন্ত্যেন সহেতা’ সূত্রের প্রকরণ অনুসরণ করে না। এখানে ‘কু’ ‘চু’ ‘টু’ প্রত্যাহার প্রতিটিই পাঁচটি বর্ণের প্রতীক। এরকম প্রতীকী বর্ণসংক্ষেপ আরও অনেক আছে। যেমন, ঘু = {দা-ধাতু, ধা-ধাতু}; ঠ = {ঠক্-প্রত্যয়, ঠঞ্-প্রত্যয়, ঠন্-প্রত্যয়} = ইক; ঙী = {ঙীপ্-প্রত্যয়, ঙীষ্-প্রত্যয়}। নমুনা অসংখ্য। এগুলো যেন বীজগণিতের variable-এর মতো; বিভিন্ন মান গ্রহণ করতে পারে।
২.২.৬ বহুবচনের বিভক্তি
ওপরে ২.২.৩-সংখ্যক উপভাগে যা আলোচিত হয়েছে তা প্রধানত পঞ্চমী বিভক্তির একবচন। যদি সূত্রের কোনো পদে পঞ্চমী বিভক্তির বহুবচন থাকে তাহলে কী বোঝাবে? ‘দ্যুদ্ভ্যো লুঙি’ সূত্রে (১|৩|৯১) ‘দ্যুদ্ভ্যঃ’ এবং ‘বৃদ্ভ্যঃ স্যসনোঃ’ সূত্রে (১|৩|৯২) ‘বৃদ্ভ্যঃ’ পদ যথাক্রমে ‘দ্যুৎ’ এবং ‘বৃৎ’ শব্দের পঞ্চমী বিভক্তির বহুবচন। এই জাতীয় বহুবচনান্ত পঞ্চমী আরও অনেক সূত্রে পাওয়া যায়। এখানে ‘দ্যুৎ’ ও ‘বৃৎ’ ধাতুর নাম, অর্থ যথাক্রমে ‘দীপ্ত হওয়া’ ও ‘বর্তমান থাকা’। পঞ্চমী বিভক্তি ‘তস্মাদিত্যুত্তরস্য’ সূত্র অনুসারে যা বোঝায় তা-ই বোঝাবে, অর্থাৎ ‘পরে’; বহুবচন বোঝাবে ‘দ্যুৎ ইত্যাদির পরে’, ‘বৃৎ ইত্যাদির পরে’। বাংলায় যেমন বলা হয়, ‘অশোকবাবুরা আসছেন’, যার মানে অশোকবাবু ও অন্যান্যরা আসছেন। কাশিকাবৃত্তি স্পষ্ট বলছে, ‘বহুবচননির্দেশাদ্ আদ্যর্থো ভবতি।’ বহুবচন দ্বারা ‘আদি’-অর্থ নির্দেশ করা হচ্ছে। ‘আদি’ বোঝায় ‘দ্যুৎ’ দিয়ে বা ‘বৃৎ’ দিয়ে শুরু হচ্ছে এমন ধাতুর তালিকা যা ‘ধাতুপাঠ’-এর অন্তর্গত। এ বিষয়টিতে ‘আদি-র সন্ধানে’ উপভাগে প্রবেশ করব।
‘জ্বলিতিকসন্তেভ্যো ণঃ’ (সূত্র ৩|১|১৪০) আবার বহুবচন দ্বারা অন্যরকম প্রকরণের ছবি। ‘জ্বল্-ইতি-কসন্তেভ্যঃ ণঃ’ বোঝাচ্ছে একটি range --- ‘জ্বল্’ থেকে ‘কস্’ পর্যন্ত সমস্ত ধাতু, সেই কারণেই বহুবচনে ‘ভ্যস্’ বিভক্তি। জ্বল্ থেকে কস্ ধাতু ‘ধাতুপাঠ’-এ ভূ-আদিগণীয় ধাতুর অন্তর্গত প্রায় ৫৬টি ধাতু। (সূত্রে কস্-ধাতুর উল্লেখ করা হয়েছে ‘কসন্তি’ শব্দ দ্বারা; এ জাতীয় উল্লেখ ‘ধাতুনির্দেশ’ উপভাগে আলোচিত হবে।)
কেবল ধাতু নয়, শব্দের ক্ষেত্রে বহুবচন বোঝাবে সেই শব্দের শ্রেণি বা গণ যা ‘গণপাঠ’-এ তালিকাবদ্ধ আছে। এরকম একটি সূত্র, ‘জে প্রোষ্ঠপদানাম্’ (৭|৩|১৮)। এখানে বহুবচন (ষষ্ঠী বিভক্তি) ‘প্রোষ্ঠপদানাম্’ থেকে বুঝতে হবে ‘প্রোষ্ঠপদ’ এবং তার সমার্থক যাবতীয় শব্দ।
২.২.৭ ‘আদি’-র সন্ধানে
দেখা যায় সংস্কৃত ব্যাকরণে অমুকাদি তমুকাদি বলে নানা বস্তু উল্লেখ করার চল খুব বেশি, এবং ব্যাকরণ বই প্রায়শই পরিষ্কার করে বলে না তারা কী। ‘আদি’-র গুরুত্ব প্রায় একটি পারিভাষিক শব্দের মতো। এখানে সেই 'আদি'-র খোঁজে নেমেছি। ‘আদি’ শব্দের স্বতন্ত্র প্রয়োগ নয়, আমাদের লক্ষ্য সমাসের উত্তরপদ ‘আদি’; যেমন, ‘সনাদি’।
অষ্টাধ্যায়ীর প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাদেই এতগুলো সূত্রে সমাসের উত্তরপদরূপ ‘আদি’ পাওয়া যাচ্ছে --- ‘সর্বাদীনি সর্বনামানি’ (সূত্র ১|১|২৭), ‘স্বরাদিনিপাতমব্যয়ম্’ (সূত্র ১|১|৩৭), ‘অচোঽন্ত্যাদি টি’ (সূত্র ১|১|৬৪), ‘ত্যদাদীনি চ’ (সূত্র ১|১|৭৪)। ‘সর্বাদি’, ‘স্বরাদি’, ‘অন্ত্যাদি’, ‘ত্যদাদি’। এদের ব্যাসবাক্য হতে পারে ‘সর্ব আদিতে যার’, ‘স্বর্ আদিতে যার’, ‘অন্ত্য আদিতে যার’, ‘ত্যদ্ আদিতে যার’। ‘আদি’ অর্থাৎ আরম্ভ, উৎস। ‘সর্বাদীনি সর্বনামানি’ অর্থ হল, ‘সর্ব’-শব্দ আদিতে যাদের, বা ‘সর্ব’-শব্দ দিয়ে যাদের আরম্ভ, তারা সর্বনাম। বলা বাহুল্য, এটি একটি ‘সংজ্ঞা সূত্র’। বোঝা যাচ্ছে, ‘সর্ব’ দিয়ে আরম্ভ এমন শব্দের একটা তালিকা আছে। সে তালিকা সূত্রপাঠের মধ্যে নেই; আছে অষ্টাধ্যায়ীর পরিশিষ্ট ‘গণপাঠ’ অংশে। তেমনি ‘স্বরাদিনিপাতমব্যয়ম্’ অর্থ, ‘স্বর্’-শব্দ আদিতে যাদের তারা এবং ‘নিপাত’-সমূহ অব্যয়, (সংজ্ঞা সূত্র)। ‘স্বর্’-শব্দ দিয়ে আরম্ভ অব্যয়ের তালিকাও আছে ‘গণপাঠ’-এর মধ্যে।
‘অচোঽন্ত্যাদি টি’ (সংজ্ঞা সূত্র) দিচ্ছে ‘টি’-এর সংজ্ঞা। কোনো শব্দের অন্ত্য অচ্ (স্বরবর্ণ) থেকে আরম্ভ শব্দাংশকে ‘টি’ বলে। তাই ‘সাধু’ শব্দের টি-অংশ হল ‘উ’। আবার, জন্-ধাতুর টি-অংশ ‘অন্’। ড-প্রত্যয় যোগে টি-লোপ হয়; ‘জন্’ হয় ‘জ’। ‘চুটূ’ সূত্র অনুসারে ড-প্রত্যয়ের ড্ ইৎ-বর্ণ, প্রত্যয়ের আকর অংশ ‘অ’। তাই, পঙ্ক + √জন্ + ড = পঙ্ক + জ্ + অ = পঙ্কজ। শব্দাংশের ‘টি’-নাম দেওয়া হয়েছে বলে সাধারণভাবে বলা সম্ভব হবে ড্-ইৎ প্রত্যয়ে ধাতুর ‘টি’ লুপ্ত হয়।
সূত্র ৩|১|৩২-এ এসে পাণিনি বললেন, 'সনাদ্যন্তা ধাতবঃ'। এর অর্থ সন্-আদি প্রত্যয় যে-সকল শব্দের অন্তে আছে তারা ধাতু। 'ধাতবঃ' হল 'ধাতু' শব্দের প্রথমা বিভক্তির বহুবচন। এর অনেক আগে প্রথম অধ্যায়ে সূত্র ১|৩|১-এ বলা হয়েছিল ধাতুর কথা, 'ভূবাদয়ো ধাতবঃ'। 'ভূ' ইত্যাদি হল ধাতু। এখানে ইঙ্গিতটা হল অষ্টাধ্যায়ীর অন্যতম পরিশিষ্ট ‘ধাতুপাঠ’ বা ধাতুর তালিকার দিকে। সে তালিকা শুরুই হচ্ছে ‘ভূ’ দিয়ে। বলা হচ্ছে, ‘ভূ সত্তায়াম্’, সত্তা (অস্তিত্ব) অর্থে ‘ভূ’। এই ‘ভূ’ দিয়ে আরম্ভ যে-সকল বস্তু ধাতুপাঠের অন্তর্গত তারা ‘ধাতু’। এই ছিল ধাতুর প্রথম সংজ্ঞা। 'সনাদ্যন্তা ধাতবঃ' সূত্রে এসে ধাতুর ব্যাপ্তি বাড়ানো হল, ধাতুর একটা অন্য জাত পাওয়া গেল। কিন্তু এই 'সন্-আদি' মানে কী?
'সন্-আদি' অর্থ what begins with সন্ --- 'সন্' থেকে শুরু করে এই উক্তি ('সনাদ্যন্তা ধাতবঃ') পর্যন্ত ওইরকম যা-কিছু। তাহলে দেখতে হবে 'সন্' প্রত্যয়ের কথা প্রথম কোথায় বলা হয়েছিল। প্রথম বলা হয়েছিল ৩|১|৫ নং সূত্রে, ‘গুপ্তিজ্কিদ্ভ্যঃ সন্’। সুতরাং সূত্র ৩|১|৫ থেকে বর্তমান সূত্র ৩|১|৩২ পর্যন্ত যে যে প্রত্যয় উক্ত হয়েছে তারাই 'সনাদি'। সূত্র ৩|১|৫ থেকে গুনে গুনে যা যা প্রত্যয় পাওয়া যায় তারা এই --- সন্, ক্যচ্, কাম্যচ্, ক্যঙ্, ক্যষ্, ণিঙ্, ণিচ্, যঙ্, আয়, ঈয়ঙ্, যক্। এরাই 'সনাদি', যারা 'প্রকৃতি'-র (ধাতু বা প্রাতিপদিক) সঙ্গে যুক্ত হয় ও নতুন নতুন ধাতু গঠন করে। এবং ব্যাকরণগ্রন্থে এগুলোকেই ণিজন্ত প্রকরণ, সনন্ত/সন্নন্ত প্রকরণ, যঙন্ত প্রকরণ, কণ্ডূ-আদি-ধাতু, নামধাতু ইত্যাদি রূপে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। ‘সনাদ্যন্ত’ (= সনাদি + অন্ত) অর্থ ‘সনাদি প্রত্যয় অন্তে যাদের’। ধাতুপাঠে তালিকাবদ্ধ সমস্ত ধাতুর উত্তর এবং নানা প্রাতিপদিকের উত্তর সনাদি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যা উৎপন্ন হয় তারাও ধাতু --- এই হল ‘সনাদ্যন্তা ধাতবঃ’ সূত্রের তাৎপর্য।
আটপৌরে ভাষায় আমরা ‘ইত্যাদি’ শব্দ প্রায়ই একটা অনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করি। ‘ইত্যাদি’ বলে যা-কিছু আমরা উল্লেখ করি তার সাধারণত কোনো সীমা নেই। যখন বলি ‘আম জাম বটগাছ ইত্যাদি’ তখন যেন পৃথিবীর সমস্ত উদ্ভিদ সেই না-বলা অংশে ঢুকে যেতে পারে। পাণিনি-সূত্রে ‘আদি’ বলতে অনির্দিষ্টতা বোঝায় না; তার সীমা সুনির্দিষ্ট। ওপরে আলোচিত উদাহরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ‘x-আদি’ শব্দ বোঝাবে: (১) ধাতুপাঠ বা গণপাঠে উল্লিখিত কোনো বস্তু x থেকে বাকি সমস্ত বস্তু; (২) কোনো পূর্বসূত্রে উল্লিখিত বস্তু x থেকে বর্তমান সূত্র পর্যন্ত উল্লিখিত সমস্ত বস্তু; (৩) সূত্রের মধ্যেই উল্লিখিত কোনো বস্তু x থেকে অন্য বস্তু পর্যন্ত।
২.২.৮ বর্ণনির্দেশ --- ‘ত্’ এবং ‘কার’
এই ২.২.৮ থেকে ২.২.১০ পর্যন্ত বর্ণনির্দেশ র-নির্দেশ ও ধাতুনির্দেশের যে আলোচনা করব তার প্রত্যেকটি প্রণালীই যে পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ীতে ব্যবহার করেছেন এমন নয়, কিন্তু সংস্কৃতভাষার যে বিপুল ব্যাকরণসাহিত্য, পাণিনিপূর্ব ব্যাকরণ, উত্তর-পাণিনীয় ব্যাকরণ, অসংখ্য ভাষ্য ও বৃত্তি, যার কেন্দ্রস্থলে অধিষ্ঠিত ‘অষ্টাধ্যায়ী’, তার সঙ্গে পরিচয় লাভ করতে হলে এগুলি না জানলে চলে না।
২.২.৮.১ স্বরবর্ণ: ‘তপরস্তৎকালস্য’ (সূত্র ১|১|৭০)
এই প্রসঙ্গটি আগের পর্বে একবার আমরা ছুঁয়ে গেছি মাত্র, গভীরে প্রবেশ করি নি। মাহেশ্বর সূত্রে সমস্ত স্বরবর্ণের হ্রস্বরূপ শুধু আছে, দীর্ঘরূপ নেই। ই আছে, ঈ নেই; উ আছে, ঊ নেই; ইত্যাদি। ই-বর্ণ সেখানে তার phoneme-এর প্রতিনিধি; হ্রস্ব দীর্ঘ দুই বর্ণই বোঝায়। ব্যাকরণের সূত্রের জন্য বর্ণের কোষাগার ওই চোদ্দটি মাহেশ্বর সূত্র। কোনো সূত্রে অ-বর্ণ ই-বর্ণ বা উ-বর্ণের উল্লেখ করা হলে তা বোঝাবে {অ, আ} {ই, ঈ} {উ, ঊ} দুই-ই। কিন্তু যদি কেবল অ কি আ উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়? সেইজন্যই এই সূত্র ‘তপরস্তৎকালস্য (স্বং রূপম্)’। পদচ্ছেদ করলে, ‘ত-পরঃ তৎকালস্য (স্বং রূপম্)’। এর দ্বারা বলা হচ্ছে, কোনো বর্ণের পরে ‘ত্’ যুক্ত হলে সে নিজের রূপ ও তার তুল্যকালের (same prosodial length) সমস্ত রূপ বোঝাবে। একটি বর্ণের তুল্যকালের সমস্ত রূপ মানে তার উদাত্ত অনুদাত্ত ও স্বরিত উচ্চারণ। যদি বলা হয় ‘অৎ’ তাহলে তা বোঝাবে কেবল ‘অ’; ‘আ’ নয়। এ প্রসঙ্গে ‘অদেঙ্ গুণঃ’ সূত্র (১|১|২) স্মর্তব্য। ‘অদেঙ্’ (= অৎ + এঙ্) শব্দের ‘অৎ’ বোঝাচ্ছে কেবল অ; আ নয়। অষ্টাধ্যায়ীর প্রথম সূত্রে, ‘বৃদ্ধিরাদৈচ্’ (= বৃদ্ধিঃ + আৎ + ঐচ্), ‘আৎ’ বোঝাচ্ছে কেবল আ; অ নয়। ‘অণুদিৎ সবর্ণস্য চাপ্রত্যয়ঃ’ সূত্রে (১|১|৬৯) ‘অণুদিৎ’ (= অণ্ + উৎ + ইৎ) শব্দের ‘উৎ’ বোঝাচ্ছে ইৎ-সংজ্ঞক বর্ণ ‘উ’ হবে, ‘ঊ’ নয়।
স্বরবর্ণের পরে ত্-বর্ণ জুড়ে এভাবে বিশেষ একটি স্বরকে নির্দেশ করবার পদ্ধতি তৈরি হল।
২.২.৮.২ সমস্ত বর্ণ: ‘বর্ণাৎ কারঃ’
ওপরে উদ্ধৃত ‘বর্ণাৎ কারঃ’ পাণিনির সূত্র নয়, পাণিনির আগে থেকেই এ সূত্র প্রচলিত। শাকটায়নেই ‘বর্ণাৎ কারঃ’ পাওয়া যাচ্ছে। ‘কার’ আমাদের অপরিচিত শব্দ নয়। বাংলাভাষা পড়তে লিখতে শেখা মাত্রই আমরা ‘আ-কার’ ‘ই-কার’-এর সঙ্গে পরিচিত হই।
আমাদের অনেকেরই একটা ধারণা থাকে যে ‘কার’ মানে একমাত্র আ-কার ই-কার উ-কার প্রভৃতি, অর্থাৎ ব্যঞ্জনের সঙ্গে যে স্বর যুক্ত হয় তার উল্লেখ ‘কার’ শব্দ দ্বারা করা হয়। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণে কোনো বর্ণের কথা আলাদা করে বলতে হলে ‘কার’ দ্বারা স্বর বা ব্যঞ্জন যেকোনো বর্ণকেই নির্দেশ করা হয়। অষ্টাধ্যায়ীর সূত্রে প্রায়শ পাওয়া যায় অব্যয়পদ ‘চ’, also অর্থে। ‘কার’ ব্যবহার করার রীতিটা সংস্কৃতভাষায় এত ব্যাপ্ত যে ‘চ’ যেহেতু একবর্ণ পদ তাই সূত্রের বৃত্তিতে তারও উল্লেখ করা হয় ‘চকার’ বলে। এবং বুঝিয়ে দেওয়া হয় সূত্রের ওই ‘চ’ (also) ঠিক কী নির্দেশ করছে। ধরা যাক, স্ত্রীলিঙ্গে কৃৎ-প্রত্যয় ক্যপ্-এর কথা চলছে একাধিক সূত্রে। সূত্র ৩|৩|৯৮ থেকে এল ক্যপ্-প্রত্যয়ান্ত ‘ব্রজ্যা’ ‘ইজ্যা’ শব্দ। সূত্র ৩|৩|৯৯ থেকে এল ‘শয্যা’ প্রভৃতি নয়টি ক্যপ্-প্রত্যয়ান্ত শব্দ। তারপর সূত্র ৩|৩|১০০-তে বলা হল, কৃ-ধাতুতে স্ত্রীলিঙ্গে শ-প্রত্যয় হয়, আবার ক্যপ্-ও হয়। এই সূত্র বলছে, ‘কৃঞঃ শ চ।’ এই ‘চ’ বলতে যে ক্যপ্-এর কথা বলা হচ্ছে তা বোঝাতে কাশিকাবৃত্তি এইভাবে বলে --- ‘চকারাৎ ক্যপ্ চ’। ‘চকার’ অর্থাৎ চ-বর্ণ বোঝাচ্ছে ক্যপ্-ও হয়।
‘ওঙ্কার’ ‘হুঙ্কার’ ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে ধ্বনিকে (ওম্, হুম্) ‘কার’ দ্বারা নির্দেশ করার সঙ্গে আমরা পরিচিত। সংস্কৃত ব্যাকরণে ধ্বনি অর্থেই বর্ণ (phoneme)। প্রকৃতপক্ষে ‘কার’-এর ইতিহাস অতি প্রাচীন। বৈদিক সাহিত্যে ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’-এই পাওয়া যাচ্ছে ‘অকারো উকারো মকারো ইতি’; এখানে স্বর (অ, উ) এবং ব্যঞ্জন (ম্) দু’রকম ধ্বনির জন্যই ‘কার’। পাণিনি ঠিক কোনো বর্ণ বোঝাতে ‘কার’ শব্দ ব্যবহার করেন নি, কিন্তু তাঁর ‘উচ্চৈস্তরাং বা বষট্কারঃ’ সূত্রে (সংখ্যা ১|২|৩৫) তিনি যজ্ঞকর্মের ‘বষট্’ (বা ‘বৌষট্’) ধ্বনির উল্লেখ করছেন ‘কার’ দ্বারা। বর্ণ যে ‘কার’ শব্দ দ্বারা নির্দিষ্ট হবে তা পাওয়া যাচ্ছে কৃৎ-প্রত্যয় ণ্বুল্ (অক)-সংক্রান্ত একটি বার্ত্তিকে, যা উদ্ধৃত হয়েছে কাশিকাবৃত্তিতে। ণ্বুল্-প্রত্যয়ান্ত রোগার্থক স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ (যথা, ‘বিচর্চিকা’, চুলকুনি, ফোসকা) বিষয়ে ‘রোগাখ্যায়াং ণ্বুল্ বহুলম্’ সূত্রের (সংখ্যা ৩|৩|১০৮) একাধিক বার্ত্তিক। তার একটাতে বলা হচ্ছে, ‘বর্ণাৎ কারঃ’। অর্থাৎ, বর্ণের উত্তর ‘কার’ যুক্ত হয়। এই ‘কার’ শব্দ ‘কৃ’-ধাতুর সঙ্গে ঘঞ্-প্রত্যয় যোগে গঠিত।
২.২.৯ র-নির্দেশ --- ‘রাদিফঃ’
যদিও পাণিনি ব্যবহার করেন নি, কিন্তু ব্যাকরণে র-বর্ণকে ডাকা হয় ‘রেফ’ নামে। বস্তুত, বাংলাভাষা শেখার সূত্রেই ‘রেফ’ শব্দের সঙ্গে আমাদের একপ্রকার পরিচয় আছে। আমরা জানি, স্বরবর্ণ + র্ + ব্যঞ্জনবর্ণ, এমন অবস্থায় র্-কে ডাকা হয় ‘রেফ’ নামে। বলা হয়, অমুক ব্যঞ্জনবর্ণে রেফ। অধিকরণ কারকে বলা হলেও ব্যঞ্জনের পরে র্ (অর্থাৎ, র-ফলা) নয়, রেফ বোঝায় ব্যঞ্জনের অব্যবহিত আগে র্।
সংস্কৃত ব্যাকরণে অন্যান্য বর্ণ নির্দেশ করার জন্য ‘কার’ শব্দের ব্যবস্থা, কিন্তু র্-এর জন্য ‘ইফ’। র + ইফ = রেফ। লক্ষ করতে হবে যে ক-বর্ণকে ‘ককার’ বললে উচ্চারণার্থে ক্-এর সঙ্গে একটি ‘অ’ জুড়ে নেওয়া হয়। সেইভাবেই ‘রেফ’ বললে র্-এর সঙ্গে জুড়ে নেওয়া হয় একটি ‘অ’ বর্ণ, এবং তাই র্ + অ + ইফ = রেফ।
এই নামকরণের উৎস কোথায়? কাত্যায়নের বার্ত্তিকেই পাওয়া যাচ্ছে, ‘রাদিফঃ’। এবং সেটিও পূর্বোক্ত অষ্টাধ্যায়ী-সূত্র ৩|৩|১০৮-এর (‘রোগাখ্যায়াং ণ্বুল্ বহুলম্’) অধীনে। ‘রাদিফঃ’ অর্থাৎ ‘রাৎ ইফঃ’। ‘রাৎ’ র-শব্দের পঞ্চমী বিভক্তির একবচন। অর্থ ‘র-এর পরে’। বার্ত্তিকের বক্তব্য, ‘র-এর পরে ইফ’। পতঞ্জলি বলেছেন, ‘রাদিফঃ ইতি বক্তব্যম্। রেফঃ।’
২.২.১০ সূত্রে ধাতুর উল্লেখ
২.২.১০.১ ধাতুর নাম: বিনা অনুবন্ধে ও অনুবন্ধসমেত
আগে আলোচনা করেছি যে, ধাতু = ইৎ-বর্ণ + আকর অংশ + ইৎ-বর্ণ। এবং ইৎ-বর্ণ = ০, অথবা কোনো বর্ণ। এই ইৎ-বর্ণ অথবা অনুবন্ধ যুক্ত করে ধাতু উল্লিখিত হয় ধাতুপাঠে। এবং বাংলাভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণের আলোচনায় আমরা ধাতুর উল্লেখ করি তার অনুবন্ধহীন আকর অংশ দ্বারা। ‘কৃঞ্’ না বলে আমরা বলি ‘কৃ-ধাতু’।
এভাবে ধাতুনির্দেশ করার রীতি সংস্কৃত ব্যাকরণেও আছে বলা বাহুল্য। অষ্টাধ্যায়ী-র ১|৩|৫৭-সংখ্যক ‘জ্ঞাশ্রুস্মৃদৃশাং সনঃ’ সূত্রে সেই রীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। ধাতুগুলো ‘জ্ঞা’ ‘শ্রু’ ‘স্মৃ’ ‘দৃশ্’ নামেই উল্লেখ করা হচ্ছে, ধাতুপাঠে উল্লিখিত নামে নয়।
ধাতুপাঠের অনুবন্ধসমেত নামে ধাতুর উল্লেখও বিরল নয়। তার একটি দৃষ্টান্ত --- সূত্র ৭|৩|৭৫, ‘ষ্ঠিবুক্লম্বাচমাং শিতি’। ষ্ঠিবু – ক্লমু – আচমাম্। ষ্ঠিবু ও ক্লমু হচ্ছে ‘ষ্ঠিব্’ ও ‘ক্লম্’ ধাতুর অনুবন্ধসমেত রূপ। এই ‘ষ্ঠিব্’ ধাতু থেকেই ‘নিষ্ঠীবন’ (থুতু), ‘ক্লম্’ ধাতু থেকে ‘ক্লান্তি’।
২.২.১০.২ ধাতুনির্দেশ: ‘ইক্-শ্তিপৌ ধাতুনির্দেশে ইতি বক্তব্যম্’
সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্রপাঠে অথবা সূত্রের বৃত্তিতে ধাতুর উল্লেখ করবার অন্য প্রণালীও আছে। সেটা জানা না থাকলে অনেক জায়গায় ধাতুর উল্লেখ যথেষ্ট অপরিচিত লাগে। যথা, ধাতুটি ‘ভূ’ আমরা জানি, ধাতুপাঠ আরম্ভই হচ্ছে ‘ভূ সত্তায়াম্’ দিয়ে, কিন্তু ১|২|৬-সংখ্যক সূত্রে বলা হচ্ছে ‘ইন্ধিভবতিভ্যাং চ’। এখানে দু’টি ধাতুর উল্লেখ করা হচ্ছে, ‘ঞীন্ধী’ এবং ‘ভূ’। এগুলি তাদের ধাতুপাঠের সানুবন্ধ রূপ। ধাতুপাঠে বলা হচ্ছে, ‘ঞীন্ধী দীপ্তৌ’, অর্থাৎ দীপ্তিতে ‘ঞীন্ধী’ (প্রজ্বলিত করা অর্থে ‘ঞীন্ধী’); আর ‘ভূ সত্তায়াম্’ (অস্তিত্ব অর্থে ‘ভূ’)। ‘আদির্ঞিটুডুবঃ (উপদেশে ইৎ)’ সূত্র (১|৩|৫) থেকে আমরা জেনেছি আদিস্থিত ‘ঞি’ ইৎ-সংজ্ঞক, এবং ‘উপদেশে অজনুনাসিক ইৎ’ সূত্রের (১|৩|২) বলে ‘ঞীন্ধী’-র অন্তস্থিত ঈ-কার ইৎ-সংজ্ঞক। তাহলে ‘ঞীন্ধী’ ধাতুর আকর অংশ ‘ইন্ধ্’ (এই ধাতু থেকেই ‘ইন্ধন’ শব্দটি)। কিন্তু এই সূত্রের মধ্যে আমরা না পাচ্ছি ‘ইন্ধ্’, না পাচ্ছি ‘ভূ’। পাওয়া যাচ্ছে, ‘ইন্ধি’ ও ‘ভবতি’। ‘ভবতি’ হচ্ছে ‘ভূ’ ধাতুর লট্ অর্থাৎ বর্তমান কালের প্রথমপুরুষের একবচনের রূপ। ‘ইন্ধি’-র কথায় পরে আসছি। আবার, ‘বয়সি চ’ সূত্রের (সংখ্যা ৩|২|১০) ব্যাখ্যায় কাশিকাবৃত্তি বলছে, ‘বয়সি গম্যমানে হরতেঃ কর্মণ্যুপপদেঽচ্প্রত্যয়ো ভবতি’। এখানে ‘হরতেঃ’ হল ‘হরতি’-র সম্বন্ধপদ, বোঝাচ্ছে ‘হৃ-ধাতুর’। আর, ‘হরতি’ হৃ-ধাতুর বর্তমান কালের প্রথমপুরুষের একবচনের রূপ। পক্ষান্তরে, আমরা ‘গুপেশ্ছন্দসি’ সূত্রের (সংখ্যা ৩|১|৫০) দিকে নজর দিতে পারি। এই সূত্রে বৈদিক সাহিত্যে গুপ্-ধাতু বিষয়ক কোনো কথা বলা হচ্ছে। অনুবন্ধ সহ গুপ্-ধাতু হল ‘গুপূ’; ধাতুপাঠ বলছে, ‘গুপূ রক্ষণে’ (রক্ষা করা অর্থে ‘গুপূ’)। ধাতুর ‘গুপ্’ নামটা যদি ব্যবহার করা হত তাহলে ষষ্ঠী বিভক্তিতে তার রূপ হত ‘গুপঃ’। কিন্তু সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে ‘গুপেঃ’। সেটা কোনো ই-কারান্ত শব্দের ষষ্ঠী বিভক্তির একবচনের রূপ। বোঝা যাচ্ছে, সূত্রের উল্লেখে ধাতুর নাম তাহলে ‘গুপি’। একইভাবে ‘বিদিভিদিছিদেঃ কুরচ্’ সূত্রে (সংখ্যা ৩|২|১৬২) তিনটি ধাতুর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে ‘বিদি’ ‘ভিদি’ ‘ছিদি’ নামে। ধাতুপাঠে এদের নাম ‘বিদ’ (‘বিদ জ্ঞানে’), ‘ভিদির্’ (‘ভিদির্ বিদারণে’), ‘ছিদির্’ (‘ছিদির্ দ্বৈধীকরণে’)। অনুবন্ধ ‘অ’ এবং ‘ইর্’ বাদ দিলে এদের ‘বিদ্’ ‘ভিদ্’ ‘ছিদ্’ নামে আমরা চিনি। কিন্তু সূত্রে উল্লিখিত রূপ, ‘গুপি’-র মতোই, ‘বিদি’ ‘ভিদি’ ‘ছিদি’।
ধাতুর এই উল্লেখ-রূপের প্রকরণ বুঝতে সাহায্য করে পূর্বোক্ত ‘রোগাখ্যায়াং ণ্বুল্ বহুলম্’ সূত্র (সংখ্যা ৩|৩|১০৮) বিষয়ক একটি বার্ত্তিক যা উল্লিখিত হয়েছে কাশিকাবৃত্তিতে। সেই বার্ত্তিক মতে, ‘ইক্-শ্তিপৌ ধাতুনির্দেশে ইতি বক্তব্যম্’। ‘শ্তিপ্’ অর্থ ‘শ্ + তিপ্’। বার্ত্তিক বলছে, ধাতু নির্দেশ করতে ‘ইক্’ এবং ‘শ্ + তিপ্’ যোগ করতে হবে (ধাতুর সঙ্গে)। অনুবন্ধ ‘শ্’-বর্ণ বোঝায় সার্বধাতুক অথবা বিকরণ, যে প্রত্যয় ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয় ও যার পরে আসে ধাতুর কাল/পুরুষ-বাচক ‘তিঙ্’-বিভক্তি। (১) ইক্-এর ক্ ইৎ-সংজ্ঞক এবং অবশ্যই নির্দেশ করছে স্বরের গুণ-বৃদ্ধি হবে না। এই ইক্ যোগ করেই: √ইন্ধ্ + ইক্ = ইন্ধি, √গুপ্ + ইক্ = গুপি, √ভিদ্ + ইক্ = ভিদি। (২) কাশিকাবৃত্তি ‘শ্তিপ্’ প্রত্যয়যুক্ত ধাতু-নামের উদাহরণ দিয়েছে ‘পচতিঃ’, ‘পঠতিঃ’। এ দু’টি ই-কারান্ত ‘পচতি’ ও ‘পঠতি’ শব্দের প্রথমা বিভক্তি একবচনের রূপ। এখানে ‘√পচ্/√পঠ্ + শপ্ (বিকরণ) + তিপ্ (বিভক্তি) = পচতি/পঠতি’। ‘ইন্ধিভবতিভ্যাং চ’ সূত্রে ‘ভবতি’ এবং ‘বয়সি চ’ সূত্রের বৃত্তিতে ‘হরতেঃ’-র মূলেও, √ভূ + শপ্ + তিপ্ = ভবতি, √হৃ + শপ্ + তিপ্ = হরতি। এখানে মনে রাখতে হবে, বিকরণ ‘শপ্’ এবং বিভক্তি ‘তিপ্’, অর্থাৎ, শপ্ + তিপ্, যোগ করেই পাওয়া যায় ভূ-আদি ধাতুর বর্তমানকালে প্রথমপুরুষের একবচনের রূপ। আবার, ‘ম্রিয়তের্লুঙ্লিঙোশ্চ’ (১|২|৬১), ‘শেতেঃ’ (৩|১|১৫) সূত্রে ‘ম্রিয়তে’ ও ‘শেতে’, বা ‘কৃঞঃ প্রতিযত্নে’ সূত্রের (২|৩|৫৩) বৃত্তিতে ‘করোতেঃ’, ‘দিবস্তদর্থস্য’ সূত্রের (২|৩|৫৮) বৃত্তিতে ‘দীব্যতেঃ’, ‘শকি ণমুল্কমুলৌ’ সূত্রের (৩|৪|১২) বৃত্তিতে ‘শক্নোতৌ’ শব্দগুলি থেকে বোঝা যায় কেবল ‘শপ্’ নয়, যেকোনো প্রকার বিকরণ ও ‘তিপ্’ জুড়েই ধাতুর এই উল্লেখ-রূপগুলো গঠিত হয়েছে।
‘ইক্’ এবং ‘শ্তিপ্’ দু’রকম প্রত্যয় জুড়েই ধাতু থেকে পাওয়া যাচ্ছে ই-কারান্ত একটি নামশব্দ, এবং সূত্রের ভাষায় সেই শব্দকে ব্যবহার করা হচ্ছে উপযুক্ত বিভক্তি সমেত। সেই পদই বুঝিয়ে দিচ্ছে কোন্ ধাতুর কথা বলা হচ্ছে।
২.২.১১ বিভাষা: ‘ন বেতি বিভাষা’
ভাষায় নানা বিকল্প প্রয়োগ চলতে থাকে, পক্ষে ও বিকল্পে যা পাওয়া যায় তার দুই-ই প্রায়শ সিদ্ধ। ভূয়োদর্শী ভাষাবিজ্ঞানী দুই দিকই গভীর অভিনিবেশে লক্ষ করেন এবং সূত্রবদ্ধ করেন। তাই ‘বিভাষা’ ‘বা’ এবং ‘অন্যতরস্যাম্’ শব্দগুলির ঘন ঘন দেখা মেলে অষ্টাধ্যায়ীর সূত্রে। এদের ব্যবহার ক্রিয়াবিশেষণের মতো, এর প্রতিটিই বোঝায় ‘বিকল্পে’।
অষ্টাধ্যায়ীর প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাদে সূত্র ২৮ (‘বিভাষা দিক্সমাসে বহুব্রীহৌ’) এবং সূত্র ৩২ (‘বিভাষা জসি’) এই দুই সংজ্ঞা-সূত্রের পরে ‘বিভাষা’-র সংজ্ঞা পাওয়া যাচ্ছে ৪৪-সংখ্যক ‘ন বেতি বিভাষা’ সূত্রে। পদচ্ছেদ করলে পাই, ‘ন বা ইতি বিভাষা’। ‘ন’ (হতে পারে না, প্রতিষেধ), এবং ‘বা’ (বিকল্প)। প্রতিষেধ এবং বিকল্প, না হতে পারে অথবা হতেও পারে, may or may not, এই অবস্থার নাম (সংজ্ঞা) ‘বিভাষা’। এই সূত্র বিষয়ে কাশিকাবৃত্তি বলছে, ‘নেতি প্রতিষেধঃ, বেতি বিকল্পঃ, তয়োঃ প্রতিষেধবিকল্পয়োর্বিভাষেতি সংজ্ঞা ভবতি।’ এই ব্যাখ্যাই ওপরে বাংলায় ব্যক্ত করা হল।
বিভাষা-র অসংখ্য প্রয়োগের মধ্যে কয়েকটা নেওয়া যাক। সূত্র ১|১|৩২, ‘বিভাষা জসি’। পূর্বসূত্রের অনুবৃত্তি নিয়ে, ‘বিভাষা জসি (সর্বাদীনি সর্বনামানি দ্বন্দ্বে সমাসে ন)’। এই প্রসঙ্গের উৎপত্তি ‘সর্বাদীনি সর্বনামানি’ (সর্বাদি শব্দ সর্বনাম) এই সূত্র (১|১|২৭) থেকে। সর্বাদি শব্দ সর্বনাম, কিন্তু ভাষার সর্বত্র কি তা-ই? দেখা যাচ্ছে, একাধিক প্রয়োগে তারা সর্বনাম নয়, এবং তদনুসারে একের পর এক সূত্র রচিত হচ্ছে। সেভাবেই এসেছে, দ্বন্দ্বসমাসে সর্বাদি শব্দ সর্বনাম নয়। ‘দ্বন্দ্বে চ (সর্বাদীনি সর্বনামানি সমাসে ন)’, সূত্র ১|১|২৬। তার পরে বলা হচ্ছে, ‘বিভাষা জসি’ --- ‘জস্’ বিভক্তিতে তারা সর্বনাম যেমন হতে পারে না, আবার হতেও পারে। দুই দিকই, দুটো option খোলা রইল। এই অবস্থাটাই ‘বিভাষা’। এ হল প্রতিষেধ (ন) থেকে বিকল্পে (বা) যাত্রা, may not থেকে may-তে উত্তরণ। কাশিকাবৃত্তি বুঝিয়ে বলছে, ‘দ্বন্দ্বে সমাসে জসি বিভাষা সর্বাদীনি সর্বনামসংজ্ঞানি ন ভবন্তি।’ দ্বন্দ্বসমাসে জস্-বিভক্তিতে সর্বাদি শব্দ ‘বিভাষা’ রূপে (optionally) সর্বনামসংজ্ঞক না হতে পারে। ‘জস্’ বিভক্তি নামশব্দের প্রথমার বহুবচনের বিভক্তি। ‘চুটূ’ সূত্রানুসারে (১|৩|৭) জ্ ইৎ-সংজ্ঞক, ‘ন বিভক্তৌ তুস্মাঃ’ সূত্রানুসারে (১|৩|৪) অন্ত্য স্ ইৎ-সংজ্ঞক নয়। অতএব জস্-এর আকর অংশ ‘অস্’। শব্দরূপে অস্-এর স্ থেকে বিসর্গ হবে। তাই ‘অণ্’ এই প্রত্যাহার-নামের প্রথমার বহুবচন হবে ‘অণঃ’। আর, শব্দটি যদি অ-কারান্ত হয়, যেমন ‘নর’, তাহলে নর + অস্ = নরাঃ। কিন্তু, সর্বনামের ক্ষেত্রে প্রথমার বহুবচনে ‘শী’-বিভক্তি হয়। ‘লশক্বতদ্ধিতে’ সূত্র (১|৩|৮) অনুযায়ী আদ্য শ্ ইৎ-সংজ্ঞক। তাহলে সর্বনাম ‘সর্ব’ হলে, প্রথমার বহুবচনে ‘সর্ব + শী = সর্ব + ঈ = সর্বে’। দ্বন্দ্বসমাসে সর্বাদি শব্দ সর্বনাম হয় না তা ‘দ্বন্দ্বে চ’ সূত্রে (১|১|২৬) বলা হয়েছে। কিন্তু ‘বিভাষা জসি’ সূত্র (১|১|৩২) থেকে বোঝা যাচ্ছে নামশব্দের ‘জস্’ বিভক্তির বদলে সর্বনামের ‘শী’ বিভক্তিও বসতে পারে। তাই ‘কতরকতম’ এই দ্বন্দ্বসমাসটি যদি নেওয়া যায় তাহলে প্রথমা বিভক্তির বহুবচনে তার রূপ নামশব্দের মতো ‘কতরকতমাঃ’ হতে পারে, আবার সর্বনাম শব্দের মতো ‘কতরকতমে’ হতে পারে। প্রথমা বিভক্তিতে তিনটি বচনের রূপ লিখলে পাই: ‘কতরকতমঃ, কতরকতমৌ, কতরকতমাঃ/কতরকতমে’। বহুবচনে দু’টি বিকল্প রূপ পাওয়া গেল।
‘কতরকতম’ শব্দটি আমাদের একটু অপরিচিত। এর প্রয়োগ দেখা যায় প্রথমা বিভক্তির দ্বিবচনে, সূত্র ২|১|৬৩ ‘কতরকতমৌ জাতিপরিপ্রশ্নে’। ‘কতর’ অর্থ ‘দুইয়ের মধ্যে কোন্টি?’; ‘কতম’ অর্থ ‘এগুলির মধ্যে কোন্টি?’ প্রশ্নবাক্যে এগুলি প্রযুক্ত হয়। যথা, ‘কতরকালাপঃ, কতরকঠঃ?’, এ দু’টির মধ্যে কোন্টি কালাপ (ব্যাকরণ), কোন্টি কঠ (উপনিষদ)? ‘কতমকালাপঃ, কতমকঠঃ?’, এগুলির মধ্যে কোন্টি কালাপ, কোন্টি কঠ?
বিভাষার মধ্যে কয়েকটি প্রকারভেদ দেখা যায়। --- একটি বিধি ব্যক্ত হয়েছে কোনো সূত্রে, তথাপি তার একটি বিকল্প ব্যক্ত হল অন্য সূত্রে, এই অবস্থার নাম ‘প্রাপ্ত-বিভাষা’। যথা, সূত্র ৩|১|১১৩ ‘মৃজের্বিভাষা (ক্যপ্)’ একটি প্রাপ্ত-বিভাষার দৃষ্টান্ত। √মৃজ্ একটি ব্যঞ্জনান্ত ধাতু। ‘মৃজি’ (√মৃজ্ + ইক্) এই উল্লেখ-রূপের ষষ্ঠী বিভক্তির একবচন ‘মৃজেঃ’। সাধারণত ‘ঋহলোর্ণ্যৎ’ সূত্র (৩|১|১২৪) অনুযায়ী মৃজ্-এ ণ্যৎ-প্রত্যয় হওয়ার কথা। ণ্ এবং ৎ ইৎ-সংজ্ঞক (‘চুটূ’ এবং ‘হলন্ত্যম্’ সূত্র দ্বারা), ণ্-ইৎ ধাতুর অন্ত্যস্বর ও উপধা অ-কারের বৃদ্ধি বোঝায়; ণ্যৎ-এর আকর অংশ তাহলে ‘য’। তাই পরি + √মৃজ্ + ণ্যৎ = পরিমার্গ্য (ণ্যৎ-প্রত্যয়ে চ্ জ্ স্থলে ক-বর্গের বর্ণ বসে, সূত্র ৭|৩|৫২ ‘চজোঃ কু ঘিণ্ণ্যতোঃ’; মৃজ্-ধাতুতে ঋ-কার উপধা হওয়া সত্ত্বেও তার বৃদ্ধি ‘মৃজের্বৃদ্ধিঃ (অঙ্গস্য)’ সূত্র ৭|২|১১৪ অনুসারে)। কিন্তু ‘মৃজের্বিভাষা (ক্যপ্)’ সূত্রানুসারে এখানে ণ্যৎ-প্রত্যয়ের একটি বিকল্প বলা হল, ‘ক্যপ্’-প্রত্যয়। পরি + √মৃজ্ + ক্যপ্ = পরিমৃজ্য। সুতরাং এটি প্রাপ্ত বিধির বিকল্প, অর্থাৎ ‘প্রাপ্ত-বিভাষা’।
আরও আছে ‘অপ্রাপ্ত-বিভাষা’। কোনো সূত্র থেকে সাধারণ বিধি প্রাপ্ত না হয়েও একটি বিভাষা-বিধি ব্যক্ত হতে পারে, তার নাম ‘অপ্রাপ্ত-বিভাষা’। ‘প্রাপ্তাপ্রাপ্ত-বিভাষা’ এই দুইয়ের মাঝামাঝি।
‘ব্যবস্থিত-বিভাষা’ আর এক প্রকার বিভাষা। √গ্রহ্ + অচ্ = গ্রহ, এটা বিধি। কিন্তু ‘বিভাষা গ্রহঃ (ণঃ)’, সূত্র ৩|১|১৪৩, বলছে গ্রহ্-ধাতুর সঙ্গে ণ-প্রত্যয়ও হয়, এবং √গ্রহ্ + ণ = গ্রাহ শব্দ সাধিত হয়। ‘বিভাষা গ্রহঃ’ সূত্র সম্বন্ধে কাশিকাবৃত্তি বলছে, ‘ব্যবস্থিতবিভাষা চেয়ম্। জলচরে নিত্যম্ গ্রাহঃ।’ অর্থাৎ, এই সূত্র কেবল প্রাপ্ত-বিভাষা নয়, তদুপরি এটি ‘ব্যবস্থিত-বিভাষা’; জলচর জীব অর্থে সর্বদা ‘গ্রাহ’ হবে (জলচর অর্থে গ্রহ্-ধাতুর সঙ্গে সর্বদা ণ-প্রত্যয় হবে)। যেখানে বিভাষার ক্ষেত্র এভাবে সীমাবদ্ধ ও সুনির্ধারিত করে দেওয়া হয় সেটি ‘ব্যবস্থিত-বিভাষা’।
সূত্রের ভাষায়, এবং বৃত্তির ভাষায়ও বটে, ‘বিভাষা’-র দু’টি সমার্থক শব্দ, ‘বা’ এবং ‘অন্যতরস্যাম্’। সূত্র ১|২|১৩ ‘বা গমঃ’, অথবা সূত্র ১|৩|৯০ ‘বা ক্যষঃ’ সেই ‘বা’-এর দু’টি দৃষ্টান্ত। ‘অন্যতরস্যাম্’ শব্দের দু’টি উদাহরণ, সূত্র ২|৩|২২ ‘সংজ্ঞোঽন্যতরস্যাং কর্মণি’ এবং সূত্র ২|৪|৪০ ‘লিট্যন্যতরস্যাম্’।
‘বিভাষা’ ‘বা’ এবং ‘অন্যতরস্যাম্’ যেভাবে ক্রিয়াবিশেষণের মতো ব্যবহার হয় সংস্কৃত ব্যাকরণে, তার উপযুক্ত প্রতিশব্দ বাংলায় খুঁজে পাওয়া ভার। ‘বা’ আছে, এক অর্থে ‘বিভাষা’-ও আছে, কিন্তু ব্যাকরণের এই অর্থ তাতে নেই। ‘অন্যতরস্যাম্’ একেবারেই নেই।
অষ্টাধ্যায়ী-র সূত্রে এই তিনটি শব্দের একেকটি একেক জায়গায় পাওয়া যায়। কোথাও এটা, কোথাও ওটা। সূত্রেরই ভাষায় বলা যায়, তারা ‘বহুলম্’ ব্যবহৃত হয়। এটি আরেকটি ক্রিয়াবিশেষণ-সম শব্দ যার সঙ্গে আমাদের পরিচিত হওয়া প্রয়োজন।
২.২.১২ বহুলম্
‘বহু’ থেকে নিষ্পন্ন ‘বহুলম্’ শব্দ বোঝায় বহুভাবে, নানাভাবে, বিচিত্রভাবে, বিভিন্নত। বাংলায় ‘বহুল’ শব্দ আছে, যেমন ‘নির্বহুল’ ‘তথ্যবহুল’, কিন্তু এই ভাবটা নেই। এককালে বাংলা লেখায় ‘বহুশঃ’ শব্দটা চলত ক্রিয়াবিশেষণ রূপে, তাতে ‘বহুলম্’-এর ভাব কিছুটা ছিল। এখন ‘বহুশঃ’ প্রায় অচল।
পাণিনি-সূত্রে ‘বহুলম্’-এর ব্যবহার প্রচুর। প্রথম পাওয়া যাচ্ছে ‘কর্তৃকরণে কৃতা বহুলম্ (তৎপুরুষঃ তৃতীয়া)’ সূত্রে (২|১|৩২)। তৃতীয়া-বিভক্তিযুক্ত কর্তৃবাচক বা করণবাচক শব্দ কৃদন্ত শব্দের সঙ্গে কখনও সমাস (তৎপুরুষ) গঠন করে, আবার কখনও করেও না। কোথায় করে এবং কোথায় করে না? কাশিকাবৃত্তি উদাহরণ দিয়েছে --- ‘অহিনা হতঃ (অহি বা সাপের দ্বারা হত) অহিহতঃ’, এখানে ‘অহি’ কর্তা, ‘অহিনা’ তৃতীয়া বিভক্তি, ‘হতঃ’ কৃদন্ত শব্দ (√হন্ + ক্ত-কৃৎপ্রত্যয়)। ‘নখৈর্নিভিন্ন’ (নখ দ্বারা নির্ভিন্ন), ‘নখ’ করণ (instrument), ‘নখৈঃ’ তৃতীয়া বিভক্তি, ‘ভিন্ন’ (√ভিদ্ + ক্ত) কৃদন্ত পদ। এখানে সমাস হচ্ছে। কিন্তু ‘দাত্রেণ ধান্য লূনবান্’ (কাস্তে দিয়ে ধান কাটা হল), এখানে ‘দাত্রেণ’ (তৃতীয়া বিভক্তি) এবং ‘লূনবান্’ (কৃৎপ্রত্যয় ‘ক্তবতু’) থাকা সত্ত্বেও সমাস হচ্ছে না। অথচ ‘পাদহারকঃ’ (পাদাভ্যাং হ্রিয়তে), ‘গলেচোপকঃ’ (গলে চোপ্যতে), এসব স্থানে সমাস হওয়ার কথা নয়, কিন্তু সমাস হয়। ইংরেজিতে ‘বহুলম্’ variously বা diversely বোঝায়।
২.২.১৩ নিত্যম্
‘নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে’, এই পঙ্ক্তিতে ‘নিত্য’ শব্দের যে অর্থ, ব্যাকরণের সূত্রে ‘নিত্যম্’ শব্দেরও মোটামুটি সেই অর্থ। অর্থাৎ, সর্বদা। ব্যাকরণের কোনো বিধি যখন সর্বত্র সত্য হয় তখন তা ‘নিত্য’। যদি না হয় তখন তা ‘অনিত্য’। ‘চুটূ (উপদেশে ইৎ আদিঃ প্রত্যয়স্য)’ এই সূত্রে (১|৩|৭) বলা হচ্ছে, প্রত্যয়ের আদিস্থিত ‘চু’ (চ-বর্গের বর্ণ) এবং ‘টু’ (ট-বর্গের বর্ণ) ইৎ-সংজ্ঞক হয়। কিন্তু প্রত্যয়টাই যদি ‘চণপ্’ বা ‘চুঞ্চুপ্’ হয় (বিদ্যাচণ, বিদ্যাচুঞ্চু) তাহলে চ্-বর্ণ প্রত্যয়েরই অংশ, সেখানে আদ্য চ্-ইৎ হওয়ার ‘চুটূ’ সূত্র আর খাটবে না। সুতরাং ‘চুটূ’ সূত্রটি ‘নিত্য’ নয়, এটি ‘অনিত্য-সূত্র’। কিন্তু ‘চুটূ’-র ঠিক আগের সূত্র (১|৩|৬) ‘ষ প্রত্যয়স্য (উপদেশে ইৎ আদিঃ)’ একটি ‘নিত্য-সূত্র’। প্রত্যয়ের আদিস্থিত ষ্ ইৎ-সংজ্ঞক হয় না এমন প্রত্যয় নেই।
‘নিত্যম্’ অব্যয়টি পাণিনি নানা জায়গায় ব্যবহার করেছেন। প্রথম পাওয়া যাচ্ছে ‘তিষ্যপুনর্বস্বোর্নক্ষত্রদ্বন্দ্বে বহুবচনস্য দ্বিবচনং নিত্যম্’ সূত্রে (১|২|৬৩)। ‘তিষ্য’ একটি নক্ষত্র, ‘পুনর্বসু’ একজোড়া নক্ষত্র। তাদের দ্বন্দ্ব-সমাস বহুবচন হওয়া উচিত ছিল, ‘তিষ্যপুনর্বসবঃ’; কিন্তু হচ্ছে দ্বিবচন, ‘তিষ্যপুনর্বসূ’। এবং এর কোনো ব্যতিক্রম নেই, তাই এই সূত্র বিশেষভাবে বলে দিচ্ছে, ‘নিত্যম্’। সূত্রের বয়ানে ষষ্ঠী বিভক্তিতে ‘বহুবচনস্য’ কথাটা লক্ষণীয়। ‘ষষ্ঠী স্থানেযোগা’ সূত্র (১|১|৪৯) অনুসারে এর অর্থ ‘বহুবচনের স্থানে’। ‘তিষ্য এবং পুনর্বসু নক্ষত্রের দ্বন্দ্ব-সমাসে বহুবচনের স্থানে নিত্য দ্বিবচন হয়।’ এবং ষষ্ঠী বিভক্তি যে ‘প্রসঙ্গবাচী’ সেকথা আমরা আলোচনা করেছিলাম। কাশিকাবৃত্তিতে ‘প্রসঙ্গ’ শব্দটিই পাওয়া যাচ্ছে --- ‘তিষ্যপুনর্বস্বোর্নক্ষত্রবিষয়ে দ্বন্দ্বে বহুবচনপ্রসঙ্গে নিত্যং দ্বিবচনং ভবতি।’
যেখানে অনিত্যতার সম্ভাবনা থাকে সেখানে স্পষ্টভাবে ‘নিত্যম্’ বলে দেওয়া হয়। ‘নিত্যং কৌটিল্যে গতৌ (যঙ্)’ সূত্র ৩|১|২৩ ‘যঙ্’-প্রত্যয় সংক্রান্ত। এই প্রত্যয় ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে নতুন ধাতু গঠন করে তা সেই কার্যের ‘ক্রিয়াসমভিহার’, অর্থাৎ অতিশয় (intensity) বা পৌনঃপুন্য (repetition), বোঝায়। যেমন, √জ্বল্ + যঙ্ = √জাজ্বল্য (যে ধাতু থেকে ‘জাজ্বল্যমান’ শব্দ)। কিন্তু গতি-অর্থক কোনো ধাতুর সঙ্গে যঙ্-প্রত্যয় যুক্ত হলে তা সবসময় ‘কৌটিল্য’ (বক্রগতি, গতির কুটিলতা) বোঝায়, কখনোই অতিশয়/পৌনঃপুন্য বোঝায় না। √ক্রম্ + যঙ্ = √চংক্রম্য। ‘নিত্যং কৌটিল্যে গতৌ’ সূত্র সেই কথাই বলছে। কাশিকাবৃত্তির জবানিতে --- ‘গতিবচনাদ্ধাতোঃ কৌটিল্যে গম্যমানে নিত্যং যঙ্প্রত্যয়ো ভবতি। কুটিলং ক্রামতি চংক্রম্যতে। দন্দ্রম্যতে। নিত্যগ্রহণং বিষয়নিয়মার্থম্ --- গতিবচনান্নিত্যং কৌটিল্য এব ভবতি, ন তু ক্রিয়াসমভিহারে। ভৃশং ক্রামতি।’ ‘নিত্য’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বিষয় নিয়মবদ্ধ করার জন্য। গতিবচন (গত্যর্থক) ধাতুর উত্তর যঙ্-প্রত্যয়ে নিত্য (সর্বত) কৌটিল্যই বোঝায়, ক্রিয়াসমভিহার অর্থ হয় না। --- বৃত্তিতে ‘কুটিলং ক্রামতি চংক্রম্যতে’, ‘দন্দ্রম্যতে’, এগুলো বিষয়ের উদাহরণ; ‘ভৃশং ক্রামতি’ প্রত্যুদাহরণ।
২.২.১৪ সূত্রের মাপ
সূত্রের ‘লাঘব’-এর কথা বলেছি, লাঘবের তাগিদ কীভাবে সূত্রভাষাকে নিয়ন্ত্রিত করছে তা দেখা যাচ্ছে। আছে ‘চৌ’-এর মতো ক্ষুদ্র সূত্র (৬|১|২২১, ৬|৩|১৩৮)। কিন্তু কত বড়ো হতে পারে সূত্র? একটি সূত্রের দৃষ্টান্ত দিই। সূত্র ৪|১|৪২ ---‘জানপদকুণ্ডগোণস্থলভাজনাগকালনীলকুশকামুককবরাদ্ বৃত্ত্যমত্রাবপনাকৃত্রিমাশ্রাণাস্থৌল্যবর্ণানাচ্ছাদনায়োবিকারমৈথুনেচ্ছাকেশবেশেষু’। --- সূত্রের সাইজের দু’রকমের মাপকাঠি হতে পারে, অক্ষর-সংখ্যা ও উল্লিখিত বস্তুর সংখ্যা। আকারে বৃহত্তম না হলেও এই সূত্র যেকোনো নিরিখেই ওপরদিকেই থাকবে।
এরকম একটি সূত্রের মুখোমুখি হলে লাঘবের ধারণাটায় হঠাৎ ধাক্কা লাগে বৈকি। কিন্তু এ জাতীয় সূত্র আদতে বহু বস্তুর তালিকা ভিন্ন আর কিছু নয়। সেই বস্তুগুলি ছাড়া একটাও বাড়তি অক্ষর নেই। সব ক’টি বস্তুর নাম একসঙ্গে নিয়ে একেকটি বিরাট দ্বন্দ্ব সমাস। পরপর চ-অব্যয় দিয়ে জুড়লে সূত্র আরও লম্বা হয়ে যেত। বর্তমান সূত্রে অনুবৃত্তি হল ‘স্ত্রিয়াম্ অনুপসর্জনাৎ ঙীষ্’। উল্লিখিত প্রত্যেকটি অ-কারান্ত প্রাতিপদিকেই বিশেষ বিশেষ অর্থে স্ত্রীলিঙ্গে ‘ঙীষ্’ প্রত্যয় হয় সেকথা বলা হচ্ছে। সূত্রোক্ত প্রথম পদটিতে সেই প্রাতিপদিকগুলো, দ্বিতীয় পদে তাদের বিশেষ বিশেষ অর্থগুলো যাতে ‘ঙীষ্’ প্রত্যয় যুক্ত হয়।
প্রথম পদে আমরা পাই --- জানপদ, কুণ্ড, গোণ, স্থল, ভাজ, নাগ, কাল, নীল, কুশ, কামুক, কবর। দ্বিতীয় পদে পাই --- বৃত্তি (জীবিকা), অমত্র (পাত্র), আবপন (শস্য রাখার পাত্র), অকৃত্রিমা (কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত নয় এমন ভূমিখণ্ড), শ্রাণা (পক্ব), স্থৌল্য (স্থূলতা), বর্ণ (রঙ), অনাচ্ছাদন (বস্ত্র নয় এমন), অয়োবিকার, মৈথুনেচ্ছা, কেশবেশ। অর্থাৎ, স্ত্রীলিঙ্গে ঙীষ্-প্রত্যয় যোগে সূত্রোক্ত বিশেষ বিশেষ অর্থে ‘জানপদী’, ‘কুণ্ডী’, ‘গোণী’, ‘স্থলী’, ‘ভাজী’, ‘নাগী’, ‘কালী’, ‘নীলী’, ‘কুশী’, ‘কামুকী’, ‘কবরী’ শব্দগুলি হবে।
এখানে ‘জানপদ … কবর’ এগারোটি বস্তু; ‘বৃত্তি … কেশবেশ’ এগারোটি বস্তু। কাশিকাবৃত্তি বলছে --- ‘জানপদাদিভ্য একাদশভ্যঃ প্রাতিপদিকেভ্য একাদশসু বৃত্ত্যাদিষ্বর্থেষু যথাসংখ্যং ঙীষ্প্রত্যয়ো ভবতি।’ এদিকের একাদশ বস্তুর কোন্টি ওদিকের একাদশ বস্তুর কোন্টির সঙ্গে সম্পর্কিত? এই প্রশ্নের আলোচনা করব পরবর্তী উপভাগে। সেই প্রসঙ্গে এই ‘যথাসংখ্যম্’ শব্দটির সঙ্গেও পরিচিত হব।
২.২.১৫ পাণিনির respectively --- ‘যথাসংখ্যমনুদেশঃ সমানাম্’ (সূত্র ১|৩|১০)
ওপরে ৪|১|৪২-সংখ্যক সূত্রে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে তার চরিত্রটি গাণিতিক বলা চলে। আমরা পাচ্ছি ভিন্ন বস্তুসম্বলিত দু’টি set, A: {a1, a2, a3, ... } এবং B: {b1, b2, b3, ... }। দু’টি set-এই সমসংখ্যক বস্তু আছে, দু’টি set-এরই মাপ সমান --- এটা আবশ্যিক শর্ত। ভিন্ন বস্তু সম্বলিত বললাম এইজন্য যে {a1, a2, a3, ... } এক প্রকার বস্তুর সমাহার, ধরুন সবজি; আর {b1, b2, b3, ... } আরেক প্রকার বস্তুর সমাহার, ধরুন ফুল। এখন কোনো বিজ্ঞানে এমন প্রয়োজন হতেই পারে যে প্রথম প্রকার সমাহার থেকে a1 তুললে দ্বিতীয় প্রকার সমাহার থেকে b1 তুলতে হবে; a2 তুললে b2; a3 তুললে b3 ইত্যাদি। এই ক্রমের কোনো অন্যথা হবে না। তাহলে এই ক্রমে জোড়ায় জোড়ায় বস্তু বোঝাবার জন্য সেই শাস্ত্রে একটা প্রাথমিক বিবৃতি থাকা দরকার, না হলে বেশ একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে।
এরকমভাবে জোড়ায় জোড়ায় পদ বেছে নেবার প্রয়োজন ব্যাকরণ নামক বিজ্ঞানেই হতে পারে। সূত্র ৪|১|৪২-এ পেয়েছিলাম {a1 = জানপদ, a2 = কুণ্ড, a3 = গোণ, ... a11 = কবর} এবং {b1 = বৃত্তি, b2 = অমত্র, b3 = আবপন, ... b11 = কেশবেশ}। আর সেখানে জোড়াগুলো হল (a1, b1), (a2, b2), (a3, b3) ... (a11, b11)। এই জোড়াগুলো আমরা ধরে নিতে পারছি যে সূত্রটির জোরে তা হল, ‘যথাসংখ্যমনুদেশঃ সমানাম্’ (সূত্র ১|৩|১০)। এটি একটি ‘পরিভাষা সূত্র’। এখানে ‘সংখ্যা’ শব্দ দ্বারা ক্রম নির্দেশিত হয়। কাশিকাবৃত্তি বলছে --- ‘সংখ্যাশব্দেনাত্র ক্রমো লক্ষ্যতে। যথাসংখ্যং যথাক্রমমনুদেশো ভবতি।’ যথাসংখ্যম্ অর্থাৎ যথাক্রমে ‘অনুদেশ’ হয়। ‘অনুদিশ্যতে ইত্যনুদেশঃ। পশ্চাদুচ্চার্যতে ইত্যর্থঃ।’ যা অনুদিষ্ট হয় তা ‘অনুদেশ’; পিছনে (পশ্চাৎ) উচ্চারিত হয় এই অর্থে। ‘সমানাম্’ (সমানগুলির) বোঝায় ‘সমসংখ্যানাম্’, সমসংখ্যার। এই অতি সরল বিবৃতি থেকে দু’টি set-এর সমসংখ্যক পদযুগ্ম গঠনের নিয়মটি স্পষ্ট হল। আর পাওয়া গেল ‘যথাসংখ্যম্’ এই অব্যয় বা ক্রিয়াবিশেষণ।
আরেকটি উদাহরণ --- ধরা যাক বলতে হবে, ‘য-বর্ণের স্থানে ই, অন্তঃস্থ ব-এর স্থানে উ, র-এর স্থানে ঋ, ল-এর স্থানে ৯ হওয়াকে সম্প্রসারণ বলে।’ ইংরেজিতে vocalization (স্বরবর্ণ হয়ে যাওয়া) হল ‘সম্প্রসারণ’। √বচ্ (ধাতু) + ক্ত (প্রত্যয়) = উক্ত, অন্তঃস্থ ব-এর স্থানে উ হল, এটা সম্প্রসারণের দৃষ্টান্ত। যে ক্রম মেনে এই দুটো বর্ণগুচ্ছের উল্লেখ করতে হবে তা হল, {য ব র ল} এবং {ই উ ঋ ৯}। প্রত্যাহার হিসেবে প্রথমটি ‘যণ্’, পরেরটি ‘ইক্’। যে ঘটনাটি ঘটছে তা হল, যণ্ এবং ইক্ দুই-ই চারটি বর্ণের set এবং যণ্-এর স্থানে ইক্ বসছে ‘যথাসংখ্যম্’ অর্থাৎ যথাক্রমে। তাই ‘ষষ্ঠী স্থানেযোগা’ সূত্র অনুসারে ‘যণ্’-এর হবে ষষ্ঠী বিভক্তি, রূপ ‘যণঃ’। ‘ইক্’-এর হবে প্রথমা। সুতরাং সূত্রটি হল, ‘ইগ্যণঃ সম্প্রসারণম্’। একটি সংজ্ঞা-সূত্র (১|১|৪৫)।
যে সূত্রে যখনই এরকম ব্যাপার ঘটে সেখানেই ‘যথাসংখ্যম্’ বলা যেতে পারত। কিন্তু সে ধরনের অনাবশ্যক পুনরুক্তি সংস্কৃত ব্যাকরণের ধর্মবিরুদ্ধ। পাণিনি এতটাই কামনা করেন সংক্ষিপ্তি বা ‘লাঘব’ যে একবার পরিভাষা-সূত্র রচনা করে ‘যথাসংখ্যমনুদেশঃ সমানাম্’ বলে দিতে পারলে তাঁর বিরাট ব্যাকরণ জুড়ে তা সতত ক্রিয়াশীল থাকে, বারবার বলতে হয় না।
এই সূত্রে ‘আদেশ’ না বলে ‘অনুদেশ’ বলা হল। সূত্র ‘ইগ্যণঃ সম্প্রসারণম্’-এ (১|১|৪৫) ‘ইক্’ সত্যিই ‘আদেশ’ (substitution)। সূত্র ৪|১|৪২-এ {বৃত্তি, অমত্র, আবপন ... কেশবেশ} কিন্তু যথাক্রমে {জানপদ, কুণ্ড, গোণ ... কবর} পদগুলির অর্থ নির্দেশ করছে; তাদের স্থলে ‘আদেশ’ নয়। এই দু’ধরনের সম্পর্কেরই সামান্য নাম ‘অনুদেশ’।
২.৩ কতিপয় ধারণা ও সংজ্ঞা
২.৩.১ প্রাতিপদিক
‘প্রাতিপদিক’ শব্দটা প্রথম অধ্যায় থেকেই বারবার ব্যবহার করে আসছি, এবার তার যথাযথ সংজ্ঞা দেওয়া প্রয়োজন। একটু আলগাভাবে বলেছিলাম ‘বিভক্তিহীন শব্দ’। পাণিনি কীভাবে বলেছেন দেখা যাক।
২.৩.১.১ প্রাথমিক সংজ্ঞা --- ‘অর্থবদধাতুরপ্রত্যয়ঃ প্রাতিপদিকম্’ (সূত্র ১|২|৪৫)
এটিই প্রাতিপদিকের প্রথম সংজ্ঞা। সূত্রের পদচ্ছেদ করলে, ‘অর্থবৎ অধাতুঃ অপ্রত্যয়ঃ প্রাতিপদিকম্।’ ‘অর্থবৎ’, অর্থের মতো। ‘অর্থ’ শব্দ অভিধেয় বোঝায়। কাশিকাবৃত্তি বলছে, ‘অভিধেয়বচনোঽর্থশব্দঃ।’ যা ধাতু নয় এবং প্রত্যয় নয়, যা অভিধেয় বোঝায় এমন শব্দ হল প্রাতিপদিক। ‘অর্থবচ্ছব্দরূপং প্রাতিপদিকসংজ্ঞং ভবতি ধাতুপ্রত্যয়ৌ বর্জয়িত্বা’ (কাশিকা)। ধাতু ও প্রত্যয় বাদ দিলে অর্থ বোঝায় এমন শব্দরূপ (“a significant form of a word”) প্রাতিপদিক-সংজ্ঞক। যথা, ডিত্থ (কাঠের হাতি), কপিত্থ (কৎবেল), কুণ্ড, পীঠ, এগুলো প্রাতিপদিক।
ধাতুর অর্থ থাকে কিন্তু ধাতু প্রাতিপদিক নয়। প্রত্যয়ের তো অর্থ থাকে না, তা অর্থহীন রূপমূল (morpheme)। তাহলে প্রত্যয়ের কথা আলাদা করে বলা হচ্ছে কেন? আসলে পাণিনি সমস্ত শব্দকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন --- ধাতু, প্রত্যয়, প্রাতিপদিক। তাই প্রাতিপদিক কী তা বলতে গেলে বলা হচ্ছে, যা ধাতু বা প্রত্যয় নয় তা প্রাতিপদিক।
‘অপ্রত্যয়’ বলতে যা প্রত্যয় নয় শুধু এমন নয়, যা প্রত্যয়ান্ত নয় তার কথাও বলা হচ্ছে। এবং এই প্রত্যয় হচ্ছে বিভক্তি। ‘কুণ্ডে’ শব্দটি অধিকরণ কারক এবং সপ্তমীর ‘ই’ (ঙি) বিভক্তিযুক্ত, তাই সেটি প্রাতিপদিক নয়। ‘অধাতু’ বলতেও যা ধাতু নয় তা ছাড়াও যা ধাতুর বিভক্তিযুক্ত (প্রত্যয়ান্ত) রূপ অর্থাৎ ক্রিয়াপদ নয় বোঝায়। যেমন, হন্-ধাতুর অতীতকালের (লঙ্-বিভক্তি) রূপ ‘অহন্’, তা প্রাতিপদিক নয়। ‘কুণ্ডে’ এবং ‘অহন্’ দু’টিই বাক্যে ব্যবহারযোগ্য ‘পদ’। প্রাতিপদিক কেবল মূল শব্দটা, বিভক্তিতে সজ্জিত হয়ে ‘পদ’ হয়ে ওঠার আগের রূপ। এবং সেটা ধাতু বা ক্রিয়াপদ নয়।
২.৩.১.২ সংযোজন ---‘কৃত্তদ্ধিতসমাসাশ্চ’ (সূত্র ১|২|৪৬)
আগের সূত্র থেকে জানা গেল, প্রত্যয় নয় এবং বিভক্তি নামক প্রত্যয়ান্ত নয় এমন শব্দ প্রাতিপদিক। কিন্তু বিভক্তি ভিন্ন অন্য প্রত্যয় আছে। আছে কৃৎ ও তদ্ধিত প্রত্যয়। জন্ (ধাতু) + অ (কৃৎ প্রত্যয়) = জন (বিশেষ্য)। জন (বিশেষ্য) + ঈন (তদ্ধিত প্রত্যয়) = জনীন (বিশেষণ)। ‘জন’ এবং ‘জনীন’ দুইয়ের সঙ্গেই বিভক্তি যুক্ত করে বাক্যের ‘পদ’ গঠিত হতে পারে। সুতরাং প্রত্যয়ান্ত হয়েও ‘জন’ এবং ‘জনীন’ প্রাতিপদিক। আবার ‘রাজ্ঞঃ পুরুষঃ = রাজপুরুষ’। রাজপুরুষ + সু (প্রথমার একবচনের বিভক্তি) = রাজপুরুষঃ (কর্তৃকারকের পদ)। অতএব দু’টি বিভক্ত্যন্ত পদ সমাসবদ্ধ হয়ে গঠন করল একটি প্রাতিপদিক।
প্রথমে ‘অপ্রত্যয়’ শব্দটির যে ব্যাপ্তি ছিল, বর্তমান সূত্রে তা বিশেষিত হয়ে উঠেছে। (১) যা ধাতু নয়, যা বিভক্ত্যন্ত নয়, সেই অর্থবোধক শব্দ প্রাতিপদিক। (২) যা কৃৎ-প্রত্যয়ান্ত বা তদ্ধিত-প্রত্যয়ান্ত বা সমাসবদ্ধ (‘কৃৎ-তদ্ধিত-সমাসাঃ চ’) সেই অর্থবোধক শব্দও প্রাতিপদিক। প্রথম সংজ্ঞা এবং পরে এই সংযোজনে প্রাতিপদিকের পরিচয় পূর্ণ হল।
২.৩.২ পদ --- ‘সুপ্তিঙন্তং পদম্’ (সূত্র ১|৪|১৪)
প্রাতিপদিকের সঙ্গে কারক ও বচনের বিভক্তি যুক্ত হলে তা বাক্যে ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে। তখন তাকে ‘পদ’ বলা হয়। বিভক্তির জোরে সে তখন বাক্যের অন্যান্য পদের সঙ্গে অন্বয় গঠন করতে পারে। প্রতিটি কারকের বিভক্তি তিন প্রকার --- একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন। কর্তৃকারক, কর্মকারক, করণকারক, সম্প্রদানকারক, অপাদানকারক, সম্বন্ধপদ, অধিকরণকারক, এদের বিভক্তিকে যথাক্রমে প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী বিভক্তি বলা হয়। সেই ক্রম অনুসারে তাদের সাধারণ আকৃতি {সু ঔ জস্}, {অম্ ঔট্ শস্}, {টা ভ্যাম্ ভিস্}, {ঙে ভ্যাম্ ভ্যস্}, {ঙিস্ ভ্যাম্ ভ্যস্}, {ঙস্ ওস্ আম্}, {ঙি ওস্ সুপ্}। এই বিভক্তিগুলির প্রথম সু থেকে শেষ সুপ্ পর্যন্ত প্রত্যাহার গঠন করলে শব্দরূপের বিভক্তির সংক্ষিপ্ত নাম হয় ‘সুপ্’। এবং সেই প্রকরণের নাম ‘সুবন্ত’ (সুপ্ + অন্ত) প্রকরণ। বিভক্তিযুক্ত প্রাতিপদিকের নাম ‘সুবন্ত পদ’।
প্রাতিপদিক ব্যতীত অর্থবহ অন্য শব্দ হল ধাতু। ধাতুর সঙ্গে পুরুষবাচক (সে, তুমি, আমি) বিভক্তি যুক্ত হলে ক্রিয়া গঠিত হয়, তখন তাকেও ‘পদ’ বলা হয়, এবং সে বাক্যের অন্যান্য পদের সঙ্গে অন্বিত হয়। পুরুষ তিন প্রকার --- প্রথমপুরুষ, মধ্যমপুরুষ, উত্তমপুরুষ। প্রতিটি পুরুষের তিনটি বিভক্তি --- একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন। ক্রিয়ার কাল ও ভাব দশ প্রকার --- কাল = {লট্ (বর্তমান), লিট্ (পরোক্ষ অতীত), লুট্ (অনদ্যতন ভবিষ্যৎ), লৃট্ (ভবিষ্যৎ), লেট্, লোট্ (অনুজ্ঞা)}, ভাব ={লঙ্ (অনদ্যতন অতীত), লিঙ্ (বিধি ও আশীর্বচন), লুঙ্ (অদ্যতন অতীত), লৃঙ্ (ক্রিয়াতিপত্তি)}। এই বিভক্তিগুলির নাম ‘লকার’; মনে করা হয় ল-বর্ণ নেওয়া হয়েছে ‘কাল’ শব্দ থেকে। ধাতু দুই প্রকার --- পরস্মৈপদী ও আত্মনেপদী। তাদের বিভক্তি ভিন্ন প্রকার। কোনো ধাতুর পরস্মৈপদী ও আত্মনেপদী দুই প্রকার রূপই আছে, তারা উভয়পদী। তাহলে পরস্মৈপদীর নব্বই প্রকার বিভক্তি, আত্মনেপদীরও নব্বই প্রকার। বিভক্তিগুলির আরম্ভ ‘তিপ্’ থেকে, অন্ত ‘মহিঙ্’-এ। প্রত্যাহার গঠন করলে হয় ‘তিঙ্’, সেটাই তাদের সংক্ষিপ্ত নাম। প্রকরণের নাম ‘তিঙন্ত প্রকরণ’; এইরকম বিভক্তিযুক্ত পদের নাম ‘তিঙন্ত পদ’ (conjugated verb)।
সুতরাং প্রাতিপদিকের উত্তর সুপ্-বিভক্তি এবং ধাতুর উত্তর তিঙ্-বিভক্তি যোগ করলে তা বাক্যে ব্যবহারযোগ্য ‘পদ’ হয়ে ওঠে। ‘সুপ্তিঙন্তং পদম্’ সূত্রে সেকথাই বলা হচ্ছে। ‘সুবন্ত’ এবং ‘তিঙন্ত’ যেকোনো শব্দরূপকে ‘পদ’ বলা যায়। কাশিকাবৃত্তি বলছে --- ‘সুবন্তং তিঙন্তং চ শব্দরূপং পদসংজ্ঞং ভবতি।’ ‘সুবন্ত’ ও ‘তিঙন্ত’ শব্দ দু’টি সংস্কৃত ব্যাকরণে পারিভাষিকের মর্যাদা পায়। তারা যথাক্রমে বোঝায় প্রাতিপদিক ও ধাতুর বিভক্তিযুক্ত ‘পদ’-রূপ।
‘সুপ্তিঙন্তং পদম্’ সূত্র থেকে পদের সাধারণ সংজ্ঞা পাওয়া যাচ্ছে। এর তিনটি বিশেষ সংযোজন পরের তিনটি সূত্র --- ‘নঃ ক্যে’ (সূত্র ১|৪|১৫), ‘সিতি চ’ (সূত্র ১|৪|১৬), এবং ‘স্বাদিষ্বসর্বনামস্থানে’ (সূত্র ১|৪|১৭)। এখনকার মতো তাদের আলোচনায় যাচ্ছি না।
২.৩.৩ সার্বধাতুক --- ‘তিঙ্শিৎ সার্বধাতুকম্’ (সূত্র ৩|৪|১১৩)
পাণিনি কৃৎ-প্রত্যয়কে, অর্থাৎ ধাতুর উত্তর যুক্ত হয় এমন প্রত্যয়কে, দু’টি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছেন --- ‘সার্বধাতুক’ ও ‘আর্ধধাতুক’। আর্ধধাতুক-এর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে অষ্টাধ্যায়ীর একেবারে প্রথম দিকেই, ‘ন ধাতুলোপ আর্ধধাতুকে’ সূত্রে (১|১|৪)। ‘আর্ধধাতুক’ নামটি থাকায় সেই সূত্রে অত্যন্ত জরুরি কথা তিনি বলতে পেরেছেন। এই সূত্রের ব্যাখ্যায় কাশিকাবৃত্তি ‘সার্বধাতুকে মা ভূৎ’ বলে জানিয়েও দিয়েছেন ‘সার্বধাতুক’ নামে একটি সংজ্ঞা আছে।
‘সার্বধাতুক’-এর যথার্থ সংজ্ঞা আসছে ৩|৪|১১৩-সংখ্যক সূত্রে --- ‘তিঙ্শিৎসার্বধাতুকম্’। এই সংজ্ঞা অবশ্য সংস্কৃত ব্যাকরণের স্টাইলে, কী কী লক্ষণে চেনা যাবে তা দিয়ে সংজ্ঞা। ‘তিঙ্’ অর্থাৎ ধাতুর উত্তর যে পুরুষবাচক (ও কালবাচক) বিভক্তি বসে ক্রিয়াপদ গঠন করে। যেমন, ‘তিপ্’ ‘তস্’ ‘অন্তি’। ‘শিৎ’ অর্থাৎ যে প্রত্যয়ের শ্ ইৎ-সংজ্ঞক। যেমন, কৃৎ-প্রত্যয় ‘শতৃ’ ‘শানচ্’ ‘খশ্’; যেমন, ভূ-আদি ধাতুর বিকরণ ‘শপ্’। সার্বধাতুকের সঙ্গে ক্রিয়াপদের সম্পর্ক। সার্বধাতুক পরে থাকলে ধাতুর ‘ইক্’ বর্ণের (ই, উ, ঋ, ৯) স্থানে গুণ হয়। √ভূ + শপ্ + তিপ্ = ভো + অ + তি = ভবতি। এভাবে বর্তমান কাল (লট্) প্রথমপুরুষের একবচনের ক্রিয়াপদ ‘ভবতি’ (হয়) গঠিত হল। যেকোনো সার্বধাতুকেই ইৎ-বর্ণ শ্ বোঝাবে ধাতুর বিকরণ। ‘শতৃ’ ‘শানচ্’ present participle গঠন করার প্রত্যয়, যথাক্রমে পরস্মৈপদী ও আত্মনেপদী ধাতুর জন্য। ‘পচ্-ধাতু + শানচ্-প্রত্যয়’, একে আমাদের বুঝতে হবে এভাবে: √পচ্ + বিকরণ অ + মুক্-আগম + আন = পচ + ম্ + আন = পচমান। (অ-কারান্ত ধাতুর উত্তর প্রত্যয় ‘আন’ থাকলে ‘মুক্’ আগম হয়, সূত্র ৭|২|৮২ ‘আনে মুক্’। মুক্-এর অন্ত্য ব্যঞ্জন ক্ ইৎ, উ-কার উচ্চারণার্থ।)
ওপরের উদাহরণে ব্যঞ্জনান্ত ধাতু পচ্-এর সঙ্গে যখন বিকরণ শপ্ (= অ) যুক্ত হল তখন সে অ-কারান্ত হল এবং তারপর সার্বধাতুক শানচ্-এর আগে মুক্-আগম যুক্ত হল। এর মধ্যে ‘সার্বধাতুক’ নামের আদি ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে। বলা হয়, পাণিনিরও আগে বৈয়াকরণেরা মনে করতেন বিকরণ সহ ধাতুর যে রূপ সেটাই তার সার্বিক রূপ। তা থেকেই এই নামটি এসেছিল; আপিশলির ব্যাকরণে তা ছিল স্ত্রীলিঙ্গ, ‘সার্বধাতুকা’ ও ‘আর্ধধাতুকা’।
২.৩.৪ আর্ধধাতুক --- ‘আর্ধধাতুকং শেষঃ’ (সূত্র ৩|৪|১১৪)
উদ্ধৃত সূত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কৃৎ-প্রত্যয়ের মধ্যে যা সার্বধাতুক নয় তা ‘আর্ধধাতুক’। ‘শেষ’ অর্থ অবশিষ্ট। কাশিকাবৃত্তি বলছে --- ‘তিঙঃ শিতশ্চ বর্জয়িত্বা অন্যঃ প্রত্যয়ঃ শেষো ধাতুসংশব্দনেন বিহিত আর্ধধাতুকসংজ্ঞো ভবতি।’ তিঙ্ ও শিৎ বাদ দিয়ে বাকি যে যে প্রত্যয় ধাতুর উত্তর বিহিত হয় তাকে ‘আর্ধধাতুক’ বলে। যা ‘সার্ব’ নয় তা ‘আর্ধ’।
তাহলে আর্ধধাতুকের মধ্যে পড়বে ধাতুর বিকরণ, তিঙ্ বিভক্তি, এবং শতৃ শানচ্ খশ্ প্রভৃতি বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত কৃৎ-প্রত্যয়। যেমন, অচ্, ক্ত, ক্তিন্, ঘঞ্, ণ্যৎ প্রভৃতি অসংখ্য প্রত্যয়। তদ্ধিত প্রত্যয় তো আর্ধধাতুক হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সুতরাং বাংলাভাষায় তৎসম শব্দে আমরা যেসব কৃৎ-প্রত্যয়ের সঙ্গে পরিচিত তাদের বেশির ভাগই আর্ধধাতুক।
সার্বধাতুক ও আর্ধধাতুক দুইয়ের যোগেই ‘ইক্’ বর্ণের স্থলে সাধারণত গুণ হয়। আবার কোথাও হয় না। যেমন, প্রত্যয় ক্/গ্/ঙ্-ইৎ হলে হয় না (সূত্র ১|১|৫, ‘ক্ঙিতি চ’), অথবা ‘ন ধাতুলোপ আর্ধধাতুকে’ সূত্রানুসারে (১|১|৪) হয় না। কার গুণ হয়? তার সাধারণ নাম ‘অঙ্গ’, যে বিষয়ে এরপর আমরা প্রবেশ করব।
২.৩.৫ অঙ্গ --- ‘যস্মাৎ প্রত্যয়বিধিস্তদাদি প্রত্যয়েঽঙ্গম্’ (সূত্র ১|৪|১৩)
প্রত্যয় যুক্ত হয় ধাতুর সঙ্গে বা প্রাতিপদিকের সঙ্গে। এবং অধিকাংশ প্রত্যয় যুক্ত হয় ধাতু বা প্রাতিপদিকের পিছনদিকে (সূত্র ৩|১|২, ‘পরশ্চ’)। কিন্তু শব্দের ঠিক কোন্ অংশের সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে বলা যায়? সেই অংশটির নাম হবে 'অঙ্গ’ (stem, base)। ধরা যাক, ‘কার্য’ ও ‘উপকার’ শব্দ। প্রথমটিতে ‘√কৃ + ণ্যৎ (প্রত্যয়) = কার্য’। এখানে ‘অঙ্গ’ নিঃসন্দেহে ‘কৃ’। দ্বিতীয়টিতে অণ্ প্রত্যয়, কিন্তু সেখানে কি ‘কৃ-ধাতু + অণ্-প্রত্যয় = কার’, না কি ‘উপকৃ + অণ্ = উপকার’? ‘অঙ্গ’ কৃ, না উপকৃ? আবার, ‘রাজন্’ প্রাতিপদিকের প্রথমা বিভক্তির একবচন ‘রাজা’। এখানে বিভক্তি ‘সু’ (মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতে বিভক্তিও একপ্রকার প্রত্যয়)। তাহলে ‘রাজা’ শব্দে অঙ্গ কী?
‘অঙ্গ’ শনাক্ত করা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? দেখা যায়, প্রত্যয় যুক্ত হলে শব্দের কোনো একটা অংশে ধ্বনির কিছু পরিবর্তন চলছে, কোথাও নতুন কোনো ধ্বনি এসে ঢুকছে, কিংবা বর্তমান কোনো ধ্বনির স্থানে অন্য ধ্বনি বসছে। এই ঘটনাগুলিকে বিধিবদ্ধ করবার জন্য সেই অংশটিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন, তা না হলে বিধির প্রয়োগক্ষেত্র সম্বন্ধে অস্পষ্টতা থেকে যাবে। যদি বলা হয়, প্রত্যয়ের ঞ্-বর্ণ ও ণ্-বর্ণ ইৎ-সংজ্ঞক হলে অঙ্গের অন্ত্য স্বরবর্ণের স্থলে বৃদ্ধি হবে তা হলে বুঝে নিতে হবে অঙ্গ কতটুকু, কোথায় তার আরম্ভ ও কোথায় তার অন্ত। প্রকৃতপক্ষে, অঙ্গ শনাক্ত করা বেশ সূক্ষ্ম ব্যাপার বলেই ষষ্ঠ অধ্যায়ের চতুর্থ পাদ শুরু হচ্ছে ‘অঙ্গস্য’ এই অধিকার-সূত্র (সংখ্যা ৬|৪|১) দিয়ে, এবং সপ্তম অধ্যায়ের শেষ পর্যন্ত দেখানো হচ্ছে নানা প্রত্যয় যোগে অঙ্গের অবস্থা।
‘অঙ্গ’-এর প্রাথমিক সংজ্ঞা শিরোনামে উদ্ধৃত সূত্র, ‘যস্মাৎ প্রত্যয়বিধিস্তদাদি প্রত্যয়েঽঅঙ্গম্’। কাশিকাবৃত্তি বলছে --- ‘যস্মাৎ প্রত্যয়ো বিধীয়তে ধাতোর্বা প্রাতিপদিকাদ্বা তদাদি শব্দরূপং প্রত্যয়ে পরতোঽঙ্গসংজ্ঞং ভবতি।’ এর অর্থ --- ‘যার পরে প্রত্যয় বিহিত হয়েছে, ধাতু বা প্রাতিপদিক, তার আরম্ভ থেকে পরের প্রত্যয় পর্যন্ত শব্দের রূপকে অঙ্গ বলা হয়।’ অঙ্গের উদাহরণ? কাশিকাবৃত্তি যে উদাহরণ দিয়েছে তা হল --- ‘কর্তা, হর্তা। করিষ্যতি, হরিষ্যতি, অকরিষ্যৎ। ঔপগবঃ, কাপটবঃ।’ বৃত্তিতে ধাতু ও প্রাতিপদিক এই অনুক্রমেই উদাহরণ সাজানো আছে। ‘অকরিষ্যৎ’ একটি ধাতুরূপ (ক্রিয়াপদ), ‘ঔপগবঃ’ একটি নামপদ। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে ‘অকরিষ্যৎ’-এর আগের পদগুলি সবই ক্রিয়াপদ। এ কথাগুলি বলতে হল এইজন্য যে ‘কর্তা’ ‘হর্তা’ দেখে বিশেষ্যপদ বলেও মনে হতে পারে। ‘কর্তা’ ‘হর্তা’ আসলে লুট্-বিভক্তিতে (অনদ্যতন ভবিষ্যতে) কৃ এবং হৃ ধাতুর রূপ। অর্থ ‘(সে) করবে’, ‘(সে) হরণ করবে’। বিভক্তি ‘তা’। সেই বিভক্তিযোগে যার গুণ হচ্ছে সে ‘অঙ্গ’। সার্বধাতুক কিংবা আর্ধধাতুক প্রত্যয় যোগে অঙ্গের গুণ হয় সেটা তাদের সাধারণ নিয়ম [‘সার্বধাতুকার্ধধাতুকয়োঃ (অঙ্গস্য গুণঃ)’, সূত্র ৭|৩|৮৪]। গুণিত অবস্থা কী? কর্, হর্; ঋ-এর গুণ ‘অর্’। কর্ + তা = কর্তা, হর্ + তা = হর্তা। সুতরাং, আসলে √কৃ + তা = কর্ + তা = কর্তা, √হৃ + তা = হর্ + তা = হর্তা। অঙ্গ হল ‘কৃ’ ‘হৃ’। ‘করিষ্যতি’ ‘হরিষ্যতি’-তে লৃট্-বিভক্তি (ভবিষ্যৎ কাল): √কৃ + স্যতি = করিষ্যতি, √হৃ + স্যতি = হরিষ্যতি। এখানেও অঙ্গ ‘কৃ’ ‘হৃ’। ‘অকরিষ্যৎ’ পদে লৃঙ্-বিভক্তি (ক্রিয়াতিপত্তি অতীত), অর্থ ‘যদি করত’ (তাহলে অন্য একটি কার্য হতে পারত)। এখানে √কৃ + স্যৎ = অকরিষ্যৎ; অঙ্গ ‘কৃ’।
ঔপগবঃ, কাপটবঃ --- উপগু + অণ্ = ঔপগব। অঙ্গ ‘উপগু’ বলেই স্বরাদি ‘অণ্’ প্রত্যয় যোগে তার আদ্যস্বরে বৃদ্ধি (উ স্থলে ঔ) হল, এবং অন্ত্য উ-কারের গুণ হল। তা থেকে দাঁড়াল, উপগু + অণ্ = ঔপগো + অ = ঔপগব। এবং একইভাবে, কপটু + অণ্ = কাপটব। এখানে অঙ্গ ‘কপট’।
এই হল ‘অঙ্গ’-এর প্রাথমিক পরিচয়। কিন্তু সূত্রে ‘তদাদি’ বলা হল কেন? কেন প্রত্যয় পরে থাকলেই অঙ্গের কথা আসে? অর্থাৎ, ‘প্রত্যয়গ্রহণং কিম্?’ --- ‘প্রত্যয়’ শব্দটা নেওয়া হল কেন? ‘বিধিগ্রহণং কিম্?’, ‘বিধি’ শব্দটা নেওয়া হল কেন? ‘পুনঃ প্রত্যয়গ্রহণং কিমর্থম্?’, সূত্রে আবার (দ্বিতীয়বার) ‘প্রত্যয়’ শব্দটা ব্যবহার করা হল কীজন্য? এগুলি গূঢ় প্রশ্ন। বৃত্তিকারেরা যখন সূত্রের আলোচনা করতেন তখন এইসব প্রশ্ন উত্থাপন করে তাঁরা আলোকপাত করতেন। সঙ্গে থাকত দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই প্রসঙ্গ আপাতত ‘সূত্রের যুক্তি’ অধ্যায়ের জন্য তোলা থাক্।
২.৩.৬ স্থানী --- ‘স্থানিবদাদেশোঽনল্বিধৌ’ (সূত্র ১|১|৫৬)
ভাষায় ‘আদেশ’ বা substitution-এর কথা আমরা জানি। বাংলাভাষা থেকে আদেশ-এর একটা নমুনা --- ‘আমি যাই’ ‘আমি যাইতেছি’, এখানে ধাতুটি ‘যা’; কিন্তু ‘আমি গিয়াছি’ ‘ওইখানে গিয়া’, এখানে ধাতুটি যেন ‘গি’। অথচ এরা ‘যা’-ধাতুরই যথাক্রমে পুরাঘটিত বর্তমান ও অসমাপিকার রূপ। এই যে যা-ধাতুর স্থানে ‘গি’ এসে বসল একেই বলে, যা-ধাতুর স্থানে ‘গি’ আদেশ হল। ‘গি’ হল ‘আদেশ’ বা substitute। যার স্থানে সে বসছে, যাকে সে স্থানচ্যুত করে substitute করছে, সেই ‘যা’ হল ‘স্থানী’ (substituend)।
সংস্কৃতভাষায় ‘আদেশ’ ঘন ঘন ঘটছে, অতএব ‘স্থানী’-রও ঘন ঘন দেখা মিলছে। ধাতু ‘গম্’ (যাওয়া), কিন্তু বর্তমানকালে প্রথমপুরুষের একবচনের রূপ ‘গচ্ছতি’। কোথায় গেল ‘গম্’? ‘গম্’ স্থানী-র স্থলে ‘গচ্ছ্’ আদেশ হল। তৃতীয়ার বহুবচনের বিভক্তি ‘ভিস্’, কিন্তু ‘নর’ শব্দের তৃতীয়ার বহুবচন ‘নরৈঃ’। ‘ভিস্’ স্থানীর স্থলে ‘ঐস্’ আদেশ হল। ধাতুটি ‘হন্’ (মারা), তা থেকে ‘বধ্য’ (মারতে হবে)। ‘হন্’ স্থানীর স্থলে ‘বধ্’ আদেশ হল। ‘পুরাণ + ইক = পৌরাণিক’; পু-এর উ-কার স্থলে ঔ-কার অর্থাৎ বৃদ্ধি আদেশ হল। সন্ধিতে সৎ + ইচ্ছা = সদিচ্ছা। সৎ-এর ৎ কোথায় গেল? ৎ স্থানীর স্থলে দ্ আদেশ হল। আবার সৎ + চরিত্র = সচ্চরিত্র; সেখানে ৎ স্থানীর স্থলে চ্ আদেশ হল। এ যেন x – 1 = 0 যখন x = 1; x – 1 = 1 যখন x = 2, গণিতের এমন ঘটনারই বৈয়াকরণ রূপ। গণিতেও x-এর স্থলে (x একটি ‘স্থানী’) একেকটি মান বসানোকে বলে substitution, সংস্কৃত ব্যাকরণে সেটাই ‘আদেশ’। এরকম দৃষ্টান্ত অফুরান।
স্থানীর স্থলে আদেশ, এ ছাড়া স্থানীর সঙ্গে আদেশের কি কোনো গভীরতর সম্পর্ক আছে? স্থানীতে যা যা হতে পারে, আদেশেও কি তার সব হতে পারে? যেমন, গ্রহ্-ধাতু + ক্ত্বা-প্রত্যয় = গৃহীত্বা। ক্ত্বা-এর আগে একটি ইট্-আগম হল। কিন্তু উপসর্গপূর্বক ‘পরিগ্রহ্’ ধাতুতে স্থানী ক্ত্বা-প্রত্যয় স্থলে ল্যপ্-প্রত্যয় আদেশ হয়। সেখানেও কি প্রত্যয়ের আগে ইট্-আগম হবে? তা হয় না --- পরি + গ্রহ্ + ল্যপ্ = পরিগৃহ্য। অথচ ‘গৃহীত্বা’ একটি অব্যয়, ‘পরিগৃহ্য’-ও একটি অব্যয়। অব্যয়ের নিরিখে ল্যপ্-আদেশ স্থানিবৎ, স্থানীর মতো। কিন্তু ইট্-আগমের নিরিখে সে স্থানিবৎ নয়। স্থানী-আদেশ সম্পর্কের এই সূক্ষ্ম দিকগুলো ‘স্থানিবদাদেশোঽনল্বিধৌ’ সূত্রে (১|১|৫৬) বিধৃত হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করব।
পাণিনি-সূত্রের ভাষা এবং পাণিনীয় ব্যাকরণের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার সঙ্গে কিছু পরিচয় হল। আশা করছি এই সিংহদরজা পেরিয়ে আগামী অধ্যায়ে আমরা আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারব।
মূলগ্রন্থ: (১) ‘অষ্টাধ্যায়ী’, পাণিনি; (২) ‘কাশিকাবৃত্তি’, জয়াদিত্য ও বামন প্রণীত
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শ্রী প্রতাপ দে, শ্রী অমিতাভ প্রামাণিক, শ্রী অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য, শ্রী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়
(পরের অংশঃ আগামী সংখ্যায়)