|| ১ ||
ঠাকুরমার ঝুলির ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৭ সালে লেখা সেই দ্যুতিময় ভূমিকায় আক্ষেপ আর আনন্দ দুটিই সমান। আক্ষেপের কারণ দেশের শিশুরা ঔপনিবেশিক শিক্ষার কবলে পড়ে দেশজ সহজ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
‘তাহাদের সায়ংকালীন শয্যাতল এমন নীরব কেন? তাহাদের পড়াঘরের কেরোসিন-দীপ্ত টেবিলের ধারে যে গুঞ্জনধ্বনি শুনা যায় তাহাতে কেবল বিলাতী বানান-বহির বিভীষিকা। মাতৃদুগ্ধ একেবারে ছাড়াইয়া লইয়া কেবলই ছোলার ছাতু খাওয়াইয়া মানুষ করিলে ছেলে কি বাঁচে!
'কেবলি বইয়ের কথা! স্নেহময়ীদের মুখের কথা কোথায় গেল! — দেশলক্ষ্মীর বুকের কথা কোথায়!’
বাংলার রূপকথার মধ্যে কোন্ বৈশিষ্ট্যটি প্রথম লক্ষ্য করেছেন রবীন্দ্রনাথ? ‘বাঙালীর ছেলে যখন রূপকথা শোনে তখন কেবল যে গল্প শুনিয়া সুখী হয় তাহা নহে — সমস্ত বাংলাদেশের চিরন্তন স্নেহের সুরটি তাহার তরুণচিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া, তাহাকে যেন বাংলার রসে রসাইয়া লয়।’
এই একান্ত দেশজ স্নেহের সুর থেকে শিশুরা বঞ্চিত ছিল, কবির আনন্দ এই যে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার ‘ঠাকুরমার মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন ... রূপকথার সেই বিশেষ ভাষা, বিশেষ রীতি, তাহার সেই প্রাচীন সরলতাটুকু তিনি যে এতটা দূর রক্ষা করিতে পারিয়াছেন, ইহাতে তাঁহার সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্বাভাবিক কলানৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।’
কীভাবে ঠাকুরমার মুখের কথাকে তুলে আনলেন দক্ষিণারঞ্জন সেটি আলাদা চর্চার বিষয়। ঠাকুরমার ঝুলির ভাষা ও নির্মাণশৈলী সম্পূর্ণ আলাদা স্বতন্ত্র গবেষণার বিষয়, সেদিকে আমি যাব না। তবে সকলেই মানবেন ঠাকুরমার ঝুলির ভাষাভঙ্গিতে একটি চমৎকার গ্রামীণ মেয়েলি সুর আছে, যার নির্মাণ বড়ো সহজ কথা নয়।
এটিও লক্ষ্য করার মতো যে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ‘মাতৃগ্রন্থাবলী’র অন্তর্গত। উপহার-পৃষ্ঠায় লেখক তাঁর ভাবপ্রেরণাটিকে স্পষ্ট করেছেন, ‘আমার বাঙলা মা’র ধূলি কুড়ানো ফুলের অর্ঘ্য ডালা বাঙলার রূপকথা।’ সুতরাং এই বই যে নিছক গল্পসংকলন নয়, রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ও দক্ষিণারঞ্জনের উপহারপৃষ্ঠার বাক্য ক’টিতে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই। গ্রন্থকারের নিবেদনে লেখক বিস্তারিত ভাবে জানান, ‘বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ বাঙালীকে এক অতি মহাব্রতে দীক্ষিত করিয়াছেন; হারানো সুরের মণিরত্ন মাতৃভাষার ভাণ্ডারে উপহার দিবার যে অতুল প্রেরণা, তাহার মূল ধারণা হইতেই জাগরিত হইয়া উঠিয়াছে দেশজননীর স্নেহধারা — এই বাঙ্গালার রূপকথা।’
অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী প্রেরণায় এটি লুপ্ত রত্নোদ্ধারের আন্তরিক প্রয়াস। উনিশ শতকীয় নবজাগরণের প্রধান কুললক্ষণ স্বজাতি স্বদেশ সম্পর্কে গরিমাবোধ। দক্ষিণারঞ্জন ও উপেন্দ্রকিশোর দুজনেই রূপকথা সংকলনে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সেই গরিমাবোধের অংশীদার। ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা শিকড়ের সন্ধানী। অফুরন্ত ঐশ্বর্যময় গল্পের বর্ণিল মিছিলে জাতির নিজস্ব ভাবনা কল্পনার যে অতুল জগৎ কাল কালান্তরে রচিত হয়েছে তার দরজা নতুন করে খোলবার দুরূহ কাজে এঁরা ব্রতী। সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান সবদিকেই আত্মসমীক্ষা, আত্মপরিচয়, আত্মআবিষ্কারের যুগ সেটা। দীনেশচন্দ্র সেনের সক্রিয় সাহায্যের কথা বলেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। দীনেশচন্দ্রের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ এবং ‘বৃহৎবঙ্গ’ এই আত্মআবিষ্কারেরই পদক্ষেপ। রূপকথা লোককথার ক্ষেত্রে অবশ্য এর গুরু অনেক আগেই রেভারেন্ড লালবিহারী দে-র ‘ফোকটেলস্ অফ বেঙ্গল’ সংকলনে।
সেই জাতীয়তাবাদের উদ্দীপনাময় স্ফুরণের কাল অতীত হয়েছে। কিছু ঠাকুরমার ঝুলির আবেদন এখনো অমলিন। রূপকথার এই সংকলনে পাতায় পাতায় বাঙালিয়ানা মাখা, ছবিতেও তাই। তবু সেই দেশজ সুর ছাড়িয়ে ছাপিয়ে বিশ্বরূপকথার জগতের সঙ্গেও যোগাযোগ তৈরি করছে এই বই। আশ্চর্য ব্যাপার বা হয়তো আশ্চর্য নয় গোটা পৃথিবীতেই রূপকথার বয়ানে অদ্ভুত এক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। মানুষ যে আদিতে এক কৌমচেতনার শরিক তার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপকথা এবং লোককথার সম্ভার। শিশুদের জন্য রচিত কিন্তু শিশুরা তো এইসব গল্পের রচয়িতা নয়। রচয়িতারা বয়স্ক মানবমানবী, তাদের চেতন অবচেতন এবং অচেতন স্তরের পুঞ্জিত কল্পনা, ত্রাস, আক্ষেপ, প্রতিশোধস্পৃহা, লিপ্সা, জিঘাংসা এবং স্বপ্নমায়ার দলিল হিসেবে গল্পগুলিকে গ্রহণ করে অন্য একটি পাঠ তৈরি করা খুবই সম্ভব। এখানে বলে রাখি, ঠাকুরমার ঝুলি নিয়ে চিন্তার নানা স্তর থাকতে পারে। ভাষায়, ইমেজারিতে, বিষয়ে আশ্চর্য সমৃদ্ধ এর টেক্সট — আমি মাত্র কয়েকটি দিকেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
‘ঠাকুরমার ঝুলিতে’ রবীন্দ্রনাথ হয়তো ইচ্ছে করেই শুধু স্নেহের সুরের কথা বলেছেন, কিন্তু গ্রিমভাইদের বইয়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছিল তা এই বইয়ের ক্ষেত্রেও উঠতে পারে। কী অভিযোগ ছিল গ্রিমভাইদের রূপকথা সংকলনের বিষয়ে? ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে জার্মান লোককথা ও মৌখিক স্তরে সঞ্চিত কথাগুলি সংগ্রহ করে তাঁদের ধ্রুপদী সংগ্রহের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন জেকব ও উইলহেল্ম গ্রীম। ছিয়াশিটি গল্প ছিল সেই সংকলনে। নাম ছিল Kinder and Hausmarchen — ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, Children’s and Household Tales. কাব্যসুরভিত রোমান্টিক রূপকথার মতো নয় এইসব গল্প, বেশ ভালোরকম আছে হিংসা, ভয়ের আবহ, প্রতিশোধ নেবার তীব্র উল্লাস। জীবন যেমন তেমনই কি? এই প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে। মার্গারেট হান্ট তাঁর ‘দি কমপ্লিট গ্রিম্স ফেয়ারি টেলসে’র ভূমিকায় জানিয়েছেন, ‘The volume was criticized as it was considered unsuitable for Children.’
দক্ষিণারঞ্জনের গ্রন্থ সম্বন্ধে অবশ্য এই অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু কে অস্বীকার করবে এই রূপকথাগুলিতেও হিংসা, হত্যা, প্রতিশোধস্পৃহা পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। এগুলিকে অনেকেই নেতিবাচক ভাবনা বলতে চাইবেন। বাচ্চাদের মনে ক্রোধ, হিংসা ভয় এই সবের সরাসরি প্রভাব সম্পর্কে মনস্তাত্ত্বিকদের অনেকে আপত্তি করবেন। আবার অনেকে বলবেন বড়ো হয়ে ওঠার পথে আবশ্যিক এই সব অনুভূতির সঙ্গে পরিচয়। শাদা কথায় ভবিষ্যতের জন্য মানবককে প্রস্তুত করার পক্ষে এই সব উপাদান প্রয়োজন।
‘ঠাকুরমার ঝুলি’র প্রথম গল্প ‘কলাবতী রাজকন্যা’ — রাজার সাতরাণী, কারুরই ছেলেপুলে নেই। গোটা পৃথিবীতেই রূপকথার ধারাবাহিক সমস্যা সন্তানহীনতা। সন্ন্যাসী একটি শিকড় দিলেন, ‘এইটি বাটিয়া সাত রাণীতে খাইও, সোনার চাঁদ ছেলে হইবে।’ সাধভক্ষণের মন্ত্রের মতো, ছেলেভুলোনো ছড়ার মতো এখানেও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী পুত্রসন্তান চাই, এটি লক্ষ্য করে আমরা গল্পে ঢুকে পড়ি। পাঁচ রাণী মিলে শিকড়টি বেটে ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলেন। ন রাণী একটু তলানি পেলেন, ছোটোরাণী কিছুই না। তাঁরা জল তুলছিলেন, মাছ কুটছিলেন। অকুস্থলে হাজির ছিলেন না। ছোটোরাণী যখন কেঁদে ভাসাচ্ছেন তখন ন রাণী বললেন, ‘ওমা! ওর জন্য কি তোরা কিছুই রাখিস নাই? কেমন লো তোরা! চল বোন ছোটরাণী শিল-নোড়াতে যদি একাধটুকু লাগিয়া থাকে, তাই তোকে ধুইয়া খাওয়াই। ঈশ্বর করেন তো উহাতেই তোর সোনার চাঁদ ছেলে হইবে।’
বাকি পাঁচ রাণীর মানুষছেলে জন্ম নিল আর অভাগিনী দুজন? শিল ধোয়া জল খেয়ে ছোটোরাণীর হল বানরপুত্র আর ন রাণীর পেঁচাপুত্র — এরাই বুদ্ধু আর ভূতুম। গল্পের শুরু চরম ঈর্ষা আর দলাদলি দিয়ে। গল্পের শেষে বহু রোমাঞ্চকর অভিযানের শেষে বিজয়ী বুদ্ধুভূতুম দুই রাজকন্যাকে বিয়ে করে রাজার দুপাশে বসল, তাদের দুখিনী মায়েরা রাজরাণী হলেন আর,
‘পাঁচ রাণী ঘরে গিয়া খিল দিলেন। পাঁচ রাজপুত্র ঘরে গিয়া কবাট দিলেন। ... পাঁচ রাণী আর খিল খুলিলেন না। পাঁচ রাজপুত্রেরা আর কবাট খুলিলেন না। রাজা পাঁচ রাণীর আর পাঁচ রাজপুত্রের ঘরের উপরে কাঁটা দিয়া মাটি দিয়া বুজাইয়া দিলেন।’
এরপর প্রকৃত রাজপুত্রদের ছদ্মবেশ ঘোচানো, বানরের ছাল আর পেঁচার পাখ পোড়ানো শুধু সময়ের অপেক্ষা। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত পাঁচ রাণী ও পাঁচ রাজপুত্র যৎপরোনাস্তি দুষ্ট প্রকৃতির কোনো সন্দেহ নেই। তারা শুধু ঈর্ষা করেনি, বুদ্ধুভূতুমকে মেরে ফেলতে অনেক চেষ্টা করেছে। তবু বাবা হয়ে রাজামশাই আপন ছেলেদের ওপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেললেন, ব্যাপারটা কেমন যেন লাগে। পিতৃস্নেহ ও ক্রোধের মধ্যে দ্বিতীয়টিই জিতছে এমন দৃষ্টান্ত নেই তা নয়। মোগল, পাঠান বা তুরস্কের অটোমানদের ইতিহাসে পিতা কর্তৃক পুত্রনিধন বা পুত্রের অন্ধত্ব সম্পাদনের ইতিবৃত্ত পড়ে আমরা শিহরিত হই। ঠাকুরমার ঝুলিতে কিন্তু বিনা আপত্তিতে মেনে নিই।
এই রাজাই কিন্তু বানর আর পেঁচা প্রসবের পর দুই রাণীকে চিড়িয়াখানার বাঁদী ও ঘুঁটেকুড়ানী দাসী করেছিলেন। বুদ্ধু আর ভূতুম রাজসভায় এসে রাজার কাঁধে বসেছিল। তাদের গালে চুমো খেয়ে বুকে তুলে নিলেও রাণীরা যখন ভূতুমের গালে ঠোনা আর বুদ্ধুর গালে চড় মারল — ‘রাজা আর কথা কহিতে পারিলেন না; চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।’
গল্পের পিতৃতান্ত্রিক বয়ান খুব স্পষ্ট। রাজার কোনো দোষ নেই, থাকতে পারে না। মোটামুটি বেশিরভাগ মেয়েরা নষ্টের মূল। ‘শীত বসন্ত’ গল্পে যেমন শয়তানের প্রতিমূর্তি হল সুয়োরাণী — সে রাক্ষসী নয় বটে কিন্তু রাক্ষসীর থেকে তার হিংস্রতা এক তিলও কম নয়। সতীন কাঁটা উদ্ধারের জন্য, বহুপত্নীক স্বামীর মন পাবার জন্য ঈর্ষাকাতর মেয়েরা অভিচার প্রক্রিয়ার সাহায্য নেয় প্রাচীনকাল থেকে। এমনকি ঋগ্বেদেও সেই প্রসঙ্গ আছে। মাথার চুলে ক্ষার খৈল দিতে গিয়ে সুয়োরাণী দুয়োরাণীর মাথায় ওষুধের বড়ি টিপে তাকে পাখি করে উড়িয়ে দেয়। সুয়োর তিন ছেলে — ‘সতীনের ছেলে দুইটা যে নাদুসনুদুস — আর তাঁহার তিন ছেলে পাটকাটি। হিংসায় রাণীর মুখে অন্ন রুচেনা, নিশিতে নিদ্রা হয়না।’ অবশেষে একদিন কী দাবি করল সে,
‘শীত বসন্তের রক্ত নহিলে আমি নাইব না। অমনি রাজা জল্লাদকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিলেন, — ‘শীত বসন্তকে কাটিয়া রাণীকে রক্ত আনিয়া দেও।’
এখানেও রাজার কোনো ঔচিত্যবোধের পরিচয় নেই। যে রাজার নিজের ছেলেদের সঙ্গে এমন ব্যবহার তার রাজ্যে প্রজারা কেমন থাকে কে জানে। রূপকথার, পুরাণের পশুপাখি, জল্লাদেরা হৃদয়বান হয়। শিশু ঈডিপাসকে বাঁচিয়েছিল রাখালরা। শকুন্তলার গল্পে পাখিরা সারারাত শিশুটিকে ঢেকে রাখে। রোমিউলাস ও রেমাসকে নিজের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছিল একটি নেকড়ে। আমাদের গল্পে জল্লাদ শীতবসন্তকে ছেড়ে দিয়ে দুটো শিয়ালকুকুর কেটে রক্ত এনে রাণীকে দিল, ‘রাণী সেই রক্ত দিয়া স্নান করিলেন; খিলখিল করিয়া হাসিয়া আপনার তিন ছেলে কোলে পাঁচ পাত সাজাইয়া, খাইতে বসিলেন।’
এই বর্ণনার বীভৎসতার তুলনা হয় না। অবিকল একই রকম প্রায় স্নো-হোয়াইট অ্যান্ড সেভেন ডোয়ার্ফের গল্প। সেখানে সৎমা হিংসুটে রাণী জল্লাদকে বলে,
‘Take the child away into the forest; I will no longer have her in my sight. Kill her and bring me back her heart as a token.’
সেখানেও জল্লাদের করুণায় মেয়েটি বেঁচে যায়। হানসেল আর গ্রেটেলের গল্পে সৎমা বাড়িতে খাদ্যাভাব ছিল বলে সৎ ছেলেমেয়ে দুটিকে বনে নির্বাসন দেবার পরিকল্পনা করে, বাচ্চাগুলির বাবা তা মেনেও নেয়। বিজন বনে অসহায় ছেলেমেয়ে দুটি ডাইনিবুড়ির খপ্পরে পড়ে। নানা অভিযানে বিজয়ী হয়ে তারা বাবার কাছে ফিরে আসে। সৎমা ততদিনে মারা গেছে। বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়ের মিলনে কোনো বাধা হল না। যেন ওই পাষণ্ড বাবা বাচ্চাদুটিকে কখনো বনে বিসর্জন দেয়নি। গল্প সে বিষয়ে নির্বিকার। সৎমা চরিত্রটি সিন্ডারেলা, স্নো-হোয়াইটের গল্পে যেমন, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’তেও তেমনি ভয়ংকরী হয়েই এসেছে। চেকোশ্লোভাকিয়ার রূপকথা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন মিলাডা গঙ্গোপাধ্যায় ‘বারোমাসের বারো রাজা’ নাম দিয়ে। ‘ভাসা ছেলে প্লাভাচেক’ এবং নামগল্পের মোটিফগুলি অনেকক্ষেত্রে ঠাকুরমার ঝুলির সঙ্গে মিলে যায়। সৎমার নিষ্ঠুরতা চেক রূপকথাতে একইরকম। লোকপ্রবাদও আছে,
‘সতীনমায়ের কথাগুলি মধুরসের বাণী, গোড়া কেটে ঢালেন তিনি আগার উপর পানি।’
মানবজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার বহু শিকড় যে রূপকথার উৎসে রয়েছে কোনো সন্দেহ নেই। সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস সৎমা স্নেহময়ী হতেই পারে না। লোকচৈতন্যে সৎমা সম্বন্ধে অবিশ্বাস, দ্বিধা, সংশয়, ঘৃণা দানা বেঁধে থাকে, রূপকথাতেও তার নানা ধরনের প্রকাশ ঘটেছে। এইসব গল্প মনের মধ্যে গেঁথে বড়ো হবার পর যে সমাজে সংসারে সৎমা ও সৎ ছেলেমেয়ের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে, এটাই আশ্চর্য ব্যাপার।
সাতভাই চম্পার গল্পে রাজার সাত রাণীর মধ্যে ছয় রাণীর ছেলেপুলে হয়নি তাই ছোটো রাণী সন্তানসম্ভবা হবার পর হিংসার আগুন জ্বলে উঠেছে সতীনদের মনে। ছয় রাণী মিলে যুক্তি করে একে একে জন্মানো সাতটি ছেলে, একটি মেয়েকে হাঁড়ি, সরা এনে তাতে পুরে ঢাকা দিয়ে পাঁশগাদায় পুঁতে দিয়েছে আর রাজাকে দেখিয়েছে ব্যাঙের ছানা, ইঁদুরের ছানা। রাজারও বিশ্বাস করতে দেরি হয়নি — ‘ছোটরাণীকে রাজপুরীর বাহির করিয়া দিলেন।’ এই গল্প মনে করিয়ে দেয় ভারতে অবাঞ্ছিত সন্তান নিধনের বিচিত্র প্রথাসমূহ। এইগুলির মধ্যে একটি হল ছোটো হাঁড়িতে বাচ্চাকে মুখে নুনতুলো দিয়ে পুরে সরা চাপা দিয়ে জঞ্জালের গাদায় পুঁতে দেওয়া। অবশ্য এদের মধ্যে ৯৯.৯ শতাংশই কন্যাসন্তান। জ্যোতির্ময়ী দেবীর একাধিক গল্পে এই সব ভয়ংকর হত্যালীলার কথা আছে, ‘বেটি কা বাপ’, ‘ফণী মনসার বন’ প্রভৃতি গল্প মনে পড়বে। আমাদের রূপকথাটিতে অবশ্য সাতটি চম্পা ভাই আর একটি পারুল বোন ঘুঁটেকুড়ুনি ছোটোরাণীর কোলে কাঁখে মানবশিশু হয়ে ঝাঁপ দিয়েছে। ছয় রাণীর জন্য বরাদ্দ হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলা। রাজার তো কোনো দোষ নেই, তিনি শুধু বড়ো বেশি সরল।
সৎমার নিষ্ঠুরতা নিয়ে গ্রিমভাইদের সংকলনে একটি সাংঘাতিক গল্প আছে, গল্পটির নাম কোথাও ‘দি আমন্ড ট্রি’ কোথাও ‘দি জুনিপার ট্রি’। সৎমা সেখানে সৎছেলেকে সিন্দুকের ভারি ডালা মাথায় ফেলে খুন করে মাংস রান্না করে বাবাকে খাইয়েছে। সৎমার কোমলচিত্ত বালিকা কন্যা দাদার হাড়গোড় উঠোনের বাদামগাছতলায় রাখে — ঐ গাছ থেকে তখন অপূর্ব সুন্দর এক পাখির জন্ম হয়। কী গায় সেই পাখি?
‘It was my mother who murdered me; It was my father who ate of me; It was my sister Marjory Who all my bones in pieces found; Them in a handkerchief she bound. And laid them under the almond tree Kywitt kywitt kywitt, I cry, Oh what a beautiful bird am I!’
ঐ বাদামগাছের কাছেই ছেলেটির মা পুত্র প্রার্থনা করেছিল, তাই বাদামগাছটি হয়ে উঠছে মায়ের প্রতিরূপ — ভালো মা। আর খারাপ মা অর্থাৎ সৎমার মাথায় জাঁতার পাথর ফেলে তাকে মেরে ফেলে পাখিটি বাবা আর বোনের কাছে স্বরূপে আবার ফিরে আসে সুখের সংসারে। এই ভালো মা, খারাপ মা ভালো মেয়ে, খারাপ মেয়ে দ্বিভাজন আমরা একটু মনে রাখব।
‘রাজ্যের লোকেরা ডাকিনী রাণীকে উল্টাগাধায় উঠাইয়া, মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া রাজ্যের বাহির করিয়া দিল।’ শিউরে ওঠার মতো বর্ণনা। এখানে সমাজে অদ্যাবধি বলবৎ পিতৃতান্ত্রিক ধারণাটির অনুবর্তন দেখছি। সন্তানের জন্মগত খুঁত, রোগবালাই, বিকলাঙ্গতা, কুশ্রীতা — সবই মায়ের গর্ভের দোষ। যেন মা একাই সৃষ্টি করেছে ভ্রূণটিকে।
নারীচরিত্রগুলি সম্পর্কে ধারাবাহিক এই ধরনের ঘৃণা আমাদের একটু ভাবায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে নারীবিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। তবে কিনা রূপকথা যে মুখ্যত শিশুদের জন্য, তারা তো মেয়েদের কোলেকাঁখেই বড়ো হয়। গল্পগুলি দক্ষিণারঞ্জন এবং আরো অনেকের মতে মেয়েদেরই রচিত। এই সমস্যার সমাধান অবশ্য খুব কঠিন নয়। পিতৃতন্ত্রের ছাঁচে মন যখন গড়ে ওঠে পুরুষ ও নারীর ধ্যানধারণায় তফাত খুব বেশি থাকে না। পিতৃতন্ত্র যেভাবে ভাবতে শেখায় সাধারণত ভাবনা সেই পথে চলে। পঞ্চতন্ত্রের নারীঘৃণাও কিছুটা বিস্ময়কর। কারণ বিষ্ণুশর্মা অপরিণতবয়স্ক বালকদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন। বিদেশি সাহিত্যেও ব্যাপারটা একই রকম। Adolf Bastian-এর ‘Elementary Ideas’ নামে বইটি একটু মনে রাখছি। Frank Boas বলেছেন,
‘Bastian was led to speak of the apalling monotony of the fundamental ideas of mankind all over the globe … certain patterns of associated ideas may be recognized in all types of culture.’
প্রচলিত আর্কিটাইপগুলি একেবারে মানবসমাজের মূল আচার বিশ্বাস, পুরাণকল্প, সংস্কারের সঙ্গে জড়ানো। অবশ্যই তারা খণ্ডিত জীবনের শঙ্কা, সংশয়, নিরাপত্তার অভাব এবং অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নউড়ানে লোকচৈতন্যের বুনোট তৈরি করে। এই কল্পজগতে জাদুকরী মায়ায় নানা রূপান্তর সাধন অনায়াসে ঘটে যায়। রূপকথার পৃথিবীতে ইচ্ছাপূরণ ঘটে নানাভাবে, দুষ্টু ধনী গরিব হয়ে যায়, ভালোমনের গরিব লোক ধনী হয়ে যায়। Poetic justice-এর জন্য মানুষের আর্তিগুলি তৃপ্ত হয়।
স্বপ্ন এবং মিথের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। এই সূত্রে জোসেফ ক্যাম্পবেলের একটি ব্যাখ্যা মনে পড়ছে, ‘Dream is the personalized myth, myth the depersonalized dream.’ স্বপ্নে, যে স্বপ্ন দেখছে তার ব্যক্তিগত উদ্বেগ আশঙ্কা বাসনার সংকট মিশে থাকে, মিথে সমস্যা, সংকট ও তার সমাধান সামূহিক চৈতন্যজাত এবং তার আবেদন সর্বজনীন।
দেখা যাচ্ছে, নারী সম্পর্কে একটি দ্বিমুখী ভাবনার স্রোত কাজ করে। রূপকথা বা লোককথার কেন্দ্রে থাকে হিরো বা বীর নায়ক — সে তার পক্ষীরাজে চড়ে, ব্যঙ্গমা বা অন্য বাহনের সাহায্যে, কখনো ময়ূরপঙ্খী নৌকা বেয়ে অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র — নানা বাধা পার হয়ে অচেনা অজানা দেশে যায় রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে। ঘুমন্ত রাজকন্যা সোনার কাঠি, রূপার কাঠির স্পর্শে জেগে ওঠে। এটি খুব প্রিয় ও পরিচিত মোটিফ। বিদেশি রূপকথাতে রাজকন্যা জেগে ওঠে নায়কের চুম্বনে। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’তে ঘুমন্ত পুরী, পাতালকন্যা মণিমালা, সোনার কাটি রূপার কাটি — সব গল্পেই এই ঘুমন্ত সুন্দরী সুকুমারী কন্যার ছবি আছে। ‘ব্রায়ার রোজ’ও আমাদের মনে পড়বে। সে যেন সমস্ত কামনার প্রস্ফুটিত আশ্রয়। সে একাধারে বীর নায়কের মা, প্রিয়া, বধূ, বোন। বীরের অস্তিত্ব জোড়া তীব্র সংরাগের পরম তৃপ্তি। এই নারীর মধ্যে জগতের যা কিছু ভালো, সুন্দর তা একত্র করা হয়েছে — কুঁচবরণ কন্যা, তার মেঘবরণ কেশ। সে যেন ছিল কোনোকালে এই বাস্তব পৃথিবীতে, তাকে আমরা রূঢ় দৈনন্দিনতায় হারিয়ে ফেলেছি। কালাতীত স্থানাতীত হয়ে সে কখনো নির্জন রহস্যময় প্রাসাদে, কখনো সমুদ্রের অন্ধকার অতলে নিদ্রামগ্ন হয়ে আছে। সাপেরা তাকে পাহারা দিচ্ছে। তাকে ফিরে পাবার জন্য নায়ককে রোমাঞ্চকর অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।
কিন্তু এই যাত্রাপথে বা নায়কের বেড়ে ওঠার পথে যারা বাধা দেবে তারাও অনেকে মেয়ে। কেমন মেয়ে তারা? রাক্ষসী, মায়াবিনী, কুহকিনী — তারা নায়ককে ফাঁদে ফেলে গ্রাস করতে চায়। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র নীলকমল আর লালকমল, ডালিমকুমার, সোনার কাটি রূপার কাটি — এই সব গল্পে রাক্ষসীর সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প জমে উঠেছে। রাশিয়াতে আছে অরণ্যের সুন্দরী কুহকিনীদের মিথ — তারা দলবদ্ধ হয়ে ঘোরে, সুদর্শন তরুণদের প্রতি তাদের বিশেষ আকর্ষণ থাকে। কখনো সুন্দরী বধূ হয়ে তারা গ্রামের কোনো পছন্দের যুবককে বিয়ে করে ঘরকন্না করে আবার দরকারমতো অদৃশ্য হয়ে যায়। নাগকন্যাদের নিয়ে নানা ধরনের মিথ আছে আমাদের দেশে ও অন্যত্র। ‘আরণ্যকে’ সত্যচরণ ডামাবানুদের কথা বলেছিল, এক ধরনের নির্জন জিন পরী, মানুষকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে মেরেও ফেলে। নদী সমুদ্রের কাছাকাছি বসতি করা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানবীতে রূপান্তরিত এই ধরনের প্রেতিনীদের নিয়ে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।
দেশের রাজা শিকার করতে এসে গাছতলায় পরমা সুন্দরী কন্যাকে দেখে রাজপুরীতে নিয়ে গিয়ে রাণী করলেন।
একদিকে নারীর সৌন্দর্য, স্নেহ, সতীত্ব যেন স্বর্গীয় বলয় সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সেই নারীর মধ্যেই মায়াবিনী, ধ্বংসকারিণীকে দেখা হচ্ছে। নারী সম্পর্কে আতঙ্ক ও আকর্ষণের এই মিশ্র অনুভূতির চিত্রকল্প চণ্ডীমঙ্গলের ‘কমলে কামিনী’র মধ্যে দেখতে পাই। সমুদ্রে সহস্রদল পদ্মের উপর বসে এক পরমাসুন্দরী কন্যা একটি হাতি গিলছে আবার উগরে দিচ্ছে। ধনপতি আর শ্রীমন্তের মধ্যে এখানে সন্ত্রস্ত পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে।
এর কাছাকাছি যাবে বাংলা ও ভারতের এক বিখ্যাত সাধকের একটি অলৌকিক দর্শন। তিনি একদিন বিকালে এক পরমাসুন্দরী রমণীকে গঙ্গা থেকে উঠে সাধকের নির্দিষ্ট ধ্যানাসনের কাছে আসতে দেখলেন। সাধক বুঝতে পারেন রমণী আসন্নপ্রসবা। এক মুহূর্তের মধ্যে শিশু জন্ম নিল — রমণী তাকে স্তন্যদান করল তারপর নিমেষের মধ্যে আবার বিকট মুখব্যাদান করে সেই শিশুকে চর্বণ করে উদরস্থ করল। ভোজন সমাপ্ত হলে রমণী ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে আবার গঙ্গায় অদৃশ্য হয়ে গেল। সাধকের কাছে প্রকৃতিরূপা রমণীর যেন সর্বব্যাপিণী দ্বৈত ভূমিকা। ক্যাম্পবেল দর্শনটিকে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন,
For she is the world creatrix, ever mother, ever virgin. She encompasses the encompassing, nourishes the nourishing, and she is the life of everything that lives.She is also death of everything that dies. The whole round of existence is accomplished within her sway, from birth, through adolescence, maturity, senescence, to the grave. She is the womb and the tomb the sow that eats her farrow. Thus she unites the ‘good’ and the ‘bad’ exhibiting the two modes of the remembered mother, not as personal only, but as universal.’
নারীই জীবন, আবার সে মৃত্যু, তাকে জয় করার মধ্যে বীরনায়ক জীবনকে অধিগত করে বিজয়নিশান ওড়ায়। কিন্তু এই ভাবনার মধ্যেই সংগুপ্ত আছে নারীকে ভয়ংকরী রূপে কল্পনা করার বীজ। রক্তমাংসের ক্রন্দন, বাসনার উদ্দামতা, জৈবকোষের অদম্য ইচ্ছাশক্তি, আগ্রাসনস্পৃহা — এই সব কিছুর উগ্র প্রকাশের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা থাকে মানুষের। অস্তিত্বের এই সব প্রমত্ত শক্তিকে সে কোমল সুরভিত প্রসাধিত মৃদুতায় ভূষিত করতে চায়। তাই যখন কোনো বিচ্যুতি ঘটে, আরেকজন কাউকে মানুষ চায় — যার ওপর এই স্খলনের দোষ চাপানো যাবে। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী হয়ে ওঠে এই দোষের আধার। নারীই যেন মূর্তিমতী পাপ, সে জৈবতার স্থূল হাতছানি, সে সত্তার পরাজয় স্বরূপা। এইভাবে দেখে নিজে আশ্বস্ত হয় মানুষ। এই কুহকিনীকে পরাস্ত করাই চূড়ান্ত বীরত্ব। মিথগুলি দেশে দেশে এভাবেই সৃজিত হয়েছে। আদিম মানুষ সন্তান জন্মদানের ক্ষমতার জন্য নারীকে জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করত। মাতৃকাশক্তির রহস্যময়ী আদিকল্পগুলি দেশে দেশে ক্রমে গড়ে উঠেছে। এই ফ্যান্টাসি অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত, কারণ শিশুর মায়ের প্রতি যে মনোভাব থাকে, চতুষ্পার্শ্বের প্রত্যক্ষ বস্তুবিশ্ব, বিপুলা পৃথিবীর প্রতি বয়স্ক মানুষের মানসিকতা অনেকটা তার সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু পরে এই মিথকে নানাভাবে ব্যবহার করেছে মানবমন। ঊর্বরাশক্তির প্রতীকরূপে কুমারীকে বলিদানও এই ফ্যান্টাসির অন্যরূপ। পিতৃতান্ত্রিকতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নারী সংযুক্ত হয়েছে কুহকময় প্রলোভনের সঙ্গে। সাধককে পরাস্ত করার জন্য যারা ফাঁদ পাতে। মানবিক স্খলন পতনের জন্য পাতা রয়েছে নারীর অদৃশ্য জাল — যেন ব্ল্যাক-উইডো স্পাইডার সে। প্রেমিককে, এমনকী সন্তানকেও গ্রাস করে তবে তার তৃপ্তি। স্পাইডার শুধু প্রেমিককে খায়, নারী সন্তানকেও ছাড়ে না।
‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ডালিমকুমার গল্পে দুটি ভয়ংকরী নারীশক্তির দেখা পাই। প্রথমজন রাক্ষসী — সে রাণীকে খেয়ে রাণী সেজে আছে। রাজপুত্র ডালিমকুমার দেখেছে ‘খাবার দিবার সময়, মায়ের জিভের একফোঁটা জল টস্ করিয়া পড়িল। গা ছমছম!’ রাক্ষসীরাণীর সাত ছেলে হল — তারা কিন্তু মানুষ। রাক্ষসীর আজ্ঞাবহ সূতাশঙ্খ, আরেক দানব, সে এক রাজ্যে গিয়ে রাজকন্যার পেটে আশ্রয় নিয়েছে। রোজ রাজকন্যার বিয়ে হয়, রোজ পেট থেকে সূতাশঙ্খ বিকট অজগর হয়ে বেরিয়ে রাজকন্যার বরকে খেয়ে ফেলে। রাক্ষসীর ষড়যন্ত্রে অন্ধ ডালিমকুমার সূতাশঙ্খকে তরোয়াল চালিয়ে হত্যা করে।
দ্বিতীয় কুহকিনীর দল হল পাশাবতীরা সাতবোন। কড়ির পাহাড়, হাড়ের পাহাড় পার হয়ে তাদের দেশ। পাশা খেলতে বসে তাদের পণ হল —
‘যে জিতে সে মালা পায়, হারিলে মোদের পেটে যায়!’রাজপুত্ররা পাশা খেলতে এসে হেরে যায় আর পাশাবতীরা তাদের কুচিকুচি করে খেয়ে রূপসী মূর্তি ধরে বসে থাকে। ডালিমকুমার এই পাশাবতীদের কৌশলে পরাস্ত করে মৃত্যুমুখে পাঠায়, ভাইদের উদ্ধার করে। রাক্ষসী তখন রাণীর শরীর ছেড়ে পালায় আর মরেও যায়। আশ্চর্য ব্যাপার রাক্ষসীর সাত ছেলেও একবার মায়ের কথা বলে না। আগের রাণী রাজা ও আটছেলেকে নিয়ে সোনার হাট সাজায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে গল্পগুলিতে রাক্ষসী মা সন্তানকে খেয়ে ফেলে, জীবিত সন্তানরাও দুষ্টপ্রকৃতির মার কথা মুখে আনে না। নীলকমল লালকমলের বিখ্যাত গল্পে — মানুষরাণীর ছেলে কুসুম, রাক্ষসী রাণীর ছেলে অজিত। রাক্ষসীর ছেলে বলে অজিতের লোহার প্রাণ, অর্থাৎ রাক্ষসের বংশগতিতে শৌর্যবীর্যকে গল্প স্বীকার করে নিচ্ছে। অজিতই পরে হবে গল্পের প্রধান নায়ক নীলকমল। এক রাক্ষস এসে কুসুমকে খেয়ে ফেলে। ‘রাণী দেখিল পৃথিবী উল্টিয়াছে — পেটের ছেলে শত্রু হইয়াছে। রাণী মনের আগুনে জ্ঞান দিশা হারাইয়া আপনার ছেলেকে মুড়্মুড়্ করিয়া চিবাইয়া খাইল।’
এই বর্ণনা পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। খোক্কসের আক্রমণে বিধ্বস্ত দেশে দুই রাজপুত্র ত্রাতা হয়ে উপস্থিত হয়। বন্ধ দরজার ওপার থেকে লালকমল সেই অসামান্য সংলাপ উচ্চারণ করে,
‘নীলকমলের আগে লালকমল জাগে আর জাগে তরোয়াল,’
নীলকমলের নাম শুনে খোক্কসেরা পিছোয়, আর জন্মে সে রাক্ষসীরাণীর পেটে হয়েছিল তো, গায়ে রাক্ষসের রক্ত। শেষপর্যন্ত নীলকমলের বীরত্বেই খোক্কসরা সবংশে নিহত হয়। রাক্ষসের দেশে রাক্ষসী দিদিমা নীলকমলকে আদর করে ডেকে নেয়, ‘আঁমার নীলু! আমার নাতুঁ।’
দেখা যাচ্ছে ভূতেদের মতো রাক্ষসরাও চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা বলে। লালকমলের গায়ে মানুষের গন্ধ — তবু আয়ী রাক্ষসী তাকে খায়নি। নীলকমল আর লালকমল দুই রাজপুত্র মিলে জীয়নকাটি মরণকাটি দুই ভীমরুল ভীমরুলীকে মেরে রাক্ষসের বংশ উজাড় করে আর রাক্ষসী রাণীকেও মারে। রাক্ষসী মা যেমন অজিতকে খেয়েছিল তেমনি অজিতের পরের অবতার নীলকমল মাকে হত্যা করায় কোনো আপত্তি করেনি।
মায়াবিনীকে হত্যার এইসব গল্প পার্সিউস ও মেডুসাকে মনে পড়ায়। মেডুসা-রাও পাশাবতীর মতো একাধিক বোন। গরগোন বোনদের মধ্যে মেডুসারই মাথায় চুলের বদলে অজস্র সাপ, চোখের দৃষ্টিতে মানুষকে প্রস্তরীভূত করার ক্ষমতা। পার্সিউস ঝকঝকে ব্রোঞ্জের ঢালে প্রতিচ্ছবি দেখে মেডুসার মাথা কেটে ফেলেছিল চোখের দিকে না তাকিয়ে।
নায়ক রাজপুত্রের যাত্রাপথের বাধাবিঘ্ন গোটা পৃথিবীতেই একই ধরনের। প্রতিটি বাঁকে বিপদ — কখনো কুহক, কখনো হিংস্রতা, কখনো আপনজনের বিচ্ছেদ মৃত্যু। এই পথ তো আসলে জীবনের কল্পরূপ। বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে হোঁচট খেয়ে নানা বিরূপ অভিজ্ঞতায় ধাক্কা খেতে খেতে চলে আমাদের জীবন। পথের সেই সব বিপদ তজ্জনিত শঙ্কা, ত্রাস, উদ্বেগ, রূপকথার মধ্যে দুর্গম গিরি কান্তার মরু হাড়ের পাহাড় কড়ির পাহাড়ের রূপ ধরে। জীবনে আমরা হেরে যাই, পিছিয়ে পড়ি, ক্লান্তিতে নত হই, আশা ছেড়ে দিই। রূপকথায় কিন্তু তার ক্ষতিপূরণ ঘটে, সেখানে বীরের বিজয় অবধারিত।
ফ্রেডারিক পিয়ার্স তাঁর ‘Dreams and Personality’ বইতে একজন অপেরা গায়িকার একটি স্বপ্ন বিবৃত করেছেন। স্বপ্নে সেই গায়িকা দেখছেন তিনি যেন কোথায় যাচ্ছেন। ভালো রাস্তা ছেড়ে কর্দমাক্ত নর্দমা, বস্তি বেছে নিচ্ছেন। পথে এল এক নদী — তার ওপারে বাঁধানো রাস্তা। কীভাবে পার হবেন? দেখলেন কাছেই এক বাড়ি, সেখানে একজন লোকের কাছে নৌকা চাইলেন। লোকটি বলল সাহায্য করবে কিন্তু নৌকা নয় এনে দিল একটি কাঠের ছোটো বাক্স। কোনো সংশয় না রেখে গায়িকা তাতে চড়ে যে পার হবেন নিশ্চিন্ত হলেন। পরে গায়িকা ভেবেছেন স্বপ্নটি নিয়ে,
‘I had gone to the squalid and muddy district because I preferred adventure … I must have known there was something fine ahead. It is like a determination to be born — or rather to be born again — in a sort of spiritual sense. Perhaps some of us have to go through dark and devious ways before we can find the river of peace or the high road to the soul’s destination.’
কিরণমালা এই রাজকুমারীর থেকেও সাহসী। সে আগুনের মতো ওঠে, বাতাসের আগে ছোটে, দৈত্য, দানা, হিংস্র জন্তু, ভূত পেত্নী তাকে বাধা দেয়। ধেয়ে আসে বৃষ্টিধারা, বজ্রপাত, ভূমিকম্প — কিন্তু মায়াপাহাড়ের সব মায়া বৃথা হল। আসলে কিরণমালা তো রাজপুত্র নয়। রাজপুত্ররা যা পারেনি — পুরুষের ছদ্মবেশে রাজকন্যা তা পারল। পুরুষের ছদ্মবেশে অসাধ্যসাধনে কিরণমালা শেক্সপীয়রের কয়েকজন নায়িকার মতো।
‘কিরণমালা কোনদিকে ফিরিয়া চাহিলেন না, পায়ের নীচে কত পাথর ট’লে গেল, কত পাথর গলে গেল — চক্ষের পাতা নামাইয়া তরোয়াল শক্ত করিয়া ধরিয়া সোঁ সোঁ করিয়া কিরণমালা সর্ সর্ একেবারে সোনার ফল হীরার গাছের গোড়ায় গিয়া পৌঁছিল।'ঝরণার শীতল জলের ছিটা দিয়ে কিরণমালা লক্ষ লক্ষ শিলীভূত রাজপুত্রের প্রাণ ফিরিয়ে দিল।
‘দেখিতে-দেখিতে সকল পাথর লক্ষ লক্ষ রাজপুত্র হইয়া গেল। রাজপুত্রেরা জোড়হাত করিয়া কিরণমালাকে প্রণাম করিল, —‘সাত যুগের ধন্য বীর।’
'অরুণ বরুণ চোখের জলে গলিয়া বলিলেন — ‘মায়ের পেটের ধন্য বোন।’
ভাবতে ভালো লাগে এই গল্পটি এক বা একাধিক নারীর রচনা। গল্পের মধ্যে নারীর আত্মপ্রত্যয়ের আশ্চর্য একটি সুর আছে। ঘরগৃহস্থালির ফাঁকে ফাঁকে কল্পনার সোনালি সুতো দিয়ে বাস্তবের জমিনে ফোঁড় তুলে তুলে নকশীকাঁথার মতো গল্পটি তৈরি করা হয়েছে। গ্রীক পুরাণে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক কিউপিডকে খুঁজতে এক অন্তহীন বিপদসংকুল অভিযানে বেরিয়েছিল রাজকন্যা সাইকি। কিউপিডের মা ভেনাস তাকে ক্রমান্বয়ে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলছিলেন। নায়ককে যেমন বিপদের পর বিপদ পার হতে হয় তেমনি একের পর এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সাইকির পরমপ্রাপ্তির সুযোগ ঘটে।
নায়ক বা নায়িকাকে নানাবিধ পরীক্ষায় সাফল্য অর্জনে সাহায্য করে বিশিষ্ট কিছু অলৌকিক চরিত্র। কখনো তারা বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, কখনো পশুপাখি, কখনো কাল্পনিক বিচিত্র প্রাণী ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী বা গ্রিফিনের মতো। তবে সবাই জাদুক্ষমতা সম্পন্ন কিংবা অসাধারণ বুদ্ধিমান, জ্ঞানী। গ্রিমভাইদের গল্পে ছোট্টো মানুষরা সাহায্য করে নায়ককে। আর নিমেষের মধ্যে রূপবদল তো সবদেশের রূপকথাতেই প্রধান বৈশিষ্ট্য। আধুনিক লেখকের হাতে তার বিচিত্র ব্যবহার ঘটেছে নানা দ্যুতিময় তাৎপর্যে। জে. কে. রাওলিং তাঁর হ্যারি পটারের কাহিনীগুলিতে রূপকথার ভাণ্ডারকে অসামান্য ভাবে ব্যবহার করেছেন। দানব, রাক্ষস বা ক্ষতিকারী কোনো মানুষ যেমন রূপ বদল করে, সাহায্যকারীরাও রূপ বদল করে পাল্লা দেয়। সাহায্যকারীদের মধ্যে আছে কাঞ্চনমালার গল্পে রাখাল, পাতালকন্যা মণিমালার গল্পে পেঁচোর ছদ্মবেশে মন্ত্রীপুত্র, আবার সুখুদুখুর গল্পে চাঁদের মা বুড়ি। চাঁদের মা বুড়ি অনেকটা সিন্ডারেলার গল্পের দয়ালু পরীমার মতো। সিন্ডারেলার গল্পের বিচিত্ররূপ শতশত বৎসর ধরে গড়ে উঠেছে। সৎমা আর বোনেদের অত্যাচার, ঘরের ঊনকোটি কাজে কষ্টকর দিনপাতের মধ্যে রাজপুত্রের মতো বরের স্বপ্ন দেখেছে কোটি কোটি মেয়ে। নিজে বাইরে কোনো অর্থকরী পেশায় যুক্ত থেকে ভাগ্য ফেরানোর রাস্তা একেবারেই ছিল না মেয়েদের। বিয়েই পারে একমাত্র ভাগ্যবদলের ম্যাজিক ঘটাতে এটিই কায়মনে মেনেছে তারা। আজও পৃথিবীর অধিকাংশ মেয়ের ভাগ্যলিপি একই রকম আছে। তাই সিন্ডারেলা মোটিফ ফিরে ফিরে দেখা দেয় গল্প উপন্যাসে। জেন অস্টেনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’, দাফনে দু মরিয়েরের ‘রেবেকা’-তে রূপান্তরিত সিন্ডারেলা-উপাদান আছে। শার্লট ব্রন্টির ‘জেন আয়ারে’ এই উপাদান পাওয়া যাবে। বাংলা সাহিত্যেও প্রভাবতী দেবী সরস্বতী এবং প্রতিভা বসুর গল্প উপন্যাসে এই মোটিফ খুঁজে পাওয়া যায়।
সুনন্দা শিকদার তাঁর ‘দয়াময়ীর কথা’ বইতে পূর্ববঙ্গে তাঁদের গ্রাম দীঘাপাইতের সোনা ঢুলির গল্পের কথা বলেছেন। ঐ গ্রামের জমিদারদের ভাগ্নে ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার। সুনন্দার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দীঘাপাইতের সোনা ঢুলির মুখে মুখে বলা গল্পগুলিই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র প্রধান উপাদান। সোনাঢুলি নিজেই সব গল্প বানিয়েছেন এমনটা নয়, তিনিও শুনেছেন কারুর মুখে — শতশত বৎসর ধরে গড়ে ওঠে মৌখিক ধারার গল্পঐতিহ্য। তবে সুনন্দার দেওয়া তথ্য মাথায় রাখলে সব গল্পগুলিই মেয়েদের রচিত — এই রকম একপেশে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো মুশকিল হয়ে যায়। গল্পের মধ্যেও কিন্তু কান পাতলে মেয়েলি ও পুরুষালি, দুই ভিন্ন স্বর শোনা যায়। কিন্তু সেই আলোচনার জন্য দরকার ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র টেক্সটের ভিন্ন আরেক পাঠ। এই প্রবন্ধে তার পরিসর নেই।
কাপড় কাচতে ঘাটে গিয়ে কাঞ্চনের সঙ্গে সুতোওয়ালার দেখা, আসলে সে ছদ্মবেশী রাখাল। সে অনেক সূঁচ চায়। কাঞ্চন তাকে স্বামীর কথা, নিজের দুর্ভাগ্যের কথা খুলে বললেন। মানুষটা রাজবাড়িতে এসে বলল, ‘আজ পিটকুড়ুলির ব্রত, রাজ্যে পিঠা বিলাতে হয়, রাণীমা আপনি আঙিনায় আলপনা দিয়ে পিঁড়ি সাজান, ও দাসীমানুষ যোগাড়-যাগাড় দিক।’ নকল রাণী অবশ্য দাসীকেও পিঠা করতে দিল। এইবার পরীক্ষার ধাপগুলো শুরু হল।
‘রাণী যে পিটা করিলেন — আস্কে পিটা, চাস্কে পিটা আর ঘাস্কে পিটা। দাসী — চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশী, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা।’
এবার আলপনা আঁকার পালা। দাসী এক কোণ ঝাড়ঝুড় দিয়ে এতটুকু চালের গুঁড়ায় খানিকটা জল মিশিয়ে এতটুকু নেকড়া ভিজিয়ে পদ্মলতা, সোনার সাতকলস, কলসের ওপর চূড়া, ধানের ছড়া, ময়ূর, পুতুল মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকলেন। আর দাসী — ‘এক মন চাল বাটিয়া সাত কলস জলে গুলিয়া এ-ই এক গোছা শণের নুড়ি ডুবাইয়া সারা আঙিনা লেপিতে বসিলেন। এখানে এক খাবল দেন, ওখানে এক খাবল দেন।’
সকলেই বুঝল কে রাণী আর দাসী। শুধু এই গল্পটির ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়েই হয়তো আলাদা গবেষণা করা যায়। অকৃতজ্ঞতা, অসততা, অন্যায়ের শাস্তি পেতেই হবে এই বার্তার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পার্থক্যেরও ইঙ্গিত দেয় গল্পটি। অভিজাত আচার ব্যবহার আর অমার্জিত ব্যবহারের তফাত দেখিয়ে দেয়। এই গল্পটিতে মেয়েদের রচনার নির্ভুল ছাপ আছে। হয়তো পৌষমাসে নতুন ধান উঠলে খেজুর গুড়, নারকেল কোরা ইত্যাদি দিয়ে পিঠে গড়তে গড়তে, ঘরে আঙিনায় মরাইতে আলপনা আঁকতে আঁকতে এই গল্পের সৃষ্টি হয়েছিল।
সহবৎ কাকে বলে, সুন্দর ব্যবহারের সংজ্ঞা কী তা নিয়ে দেশবিদেশে রূপকথার অভাব নেই। কীভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলা উচিত তার আদর্শ তুলে ধরে বিভিন্ন গল্প। গ্রিমভাইদের সংকলিত The Golden Goose গল্পে যেমন ধূর্ত বড়োভাইদের পরাজয় ঘটে — জিতে যায় সরল ভালোমানুষ ছোটোভাই। অন্য একটি গল্পে বনের রহস্যময় বুড়ো মানুষকে ইচ্ছে করে ভুল উত্তর দিয়ে ডাহা বোকা বনে যায় বড়োভাইরা। সোজা ভাষায় সৎ উত্তর দিয়ে জিতে যায় ছোটোভাই। সুখু আর দুখুর গল্পটি এই ধরনের। গল্পের অন্দরে থাকা নীতিকথাটি খুব স্পষ্ট। গ্রিমভাইদের সংকলনে ‘The white bride and the black one’ গল্পটি অনেকটা এই ধরনের।
দুখু উড়ন্ত তুলোর পিছন পিছন যেতে যেতে গাইয়ের গোয়াল পরিষ্কার করে, কলাগাছের নীচে আগাছা সাফ করে, শেওড়াগাছের গুঁড়ি ঝাঁট দেয়, ঘোড়াকে ঘাস দেয় — সবই অনুরোধ রক্ষা করার জন্য। চাঁদের মা বুড়ির বাড়িতে ঘর ভরা কতো দামি দামি সামগ্রী, সে কিন্তু অন্যের জিনিসে লোভ করে না। যেমন তেমন কাপড় নেয়, অল্প একটু খায়, ছোটো পেঁটরাটি তুলে নেয়। আর সবথেকে বড়ো কথা, বুড়ির কথা মেনে দুই ডুব দেয়। অগাধ রূপ আর গা ভরা অলঙ্কার লাভ হয় তার। ফেরার পথে উপকৃত বন্ধুরা তাকে প্রচুর উপহার দেয়। ঘরে ফিরে রাতে পেঁটরা খুলতেই বেরিয়ে আসে তার রাজপুত্র বর। সুখ সমৃদ্ধির আর কিছু বাকি থাকে না।
পরপর উপকার করা বা উপকার চাওয়ার ধরনটি উপেন্দ্রকিশোর ‘টুনটুনির বই’তে বারবার এনেছেন। আমাদের গল্পে সুখু তো দুখুর মতো সংযত নয়। তুলোর পিছনে যেতে যেতে সে নিজের স্বার্থপর স্বভাব অনুযায়ী কারুর অনুরোধ রাখে না, কোনো উপকারের দিকে পা বাড়ায় না। চাঁদের মা বুড়িকে কুবাক্য বলে। হাতের কাছে যা যা সামগ্রী পায় সব নিতে চায়। বুড়ির কথা না মেনে তিন ডুব দিয়ে সুখুর কী হাল হয়েছিল আমরা সবাই জানি। জলদেবতা ও কাঠুরের বিখ্যাত গল্প আমাদের মনে পড়ে যাবে। ‘অতি লোভে তাঁতী নষ্ট’, ‘Grasp all loose all’ ইত্যাদি প্রবাদ।
একটি অসামান্য গ্রন্থের সামান্য আলোচনা আজ এই পর্যন্ত।