এই আবৃত্তি শুনতে শুনতেই একদিন কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার সঙ্গে পরিচয় হল। আমাদের পাড়ায় আবৃত্তি প্রতিযোগিতা চলছিল। ওখানেই বেশ কয়েকজন শঙ্খ ঘোষের কবিতা “বাবুমশাই” আবৃত্তি করেন। এই সময়টাতে, মনে আছে, গান হিসেবে গাঁয়ের বধূ আর কবিতা হিসেবে বাবুমশাই আমাকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে, আমি মনে মনে অনেকবার গানটির তো বটেই, এমনকি “বাবুমশাই” কবিতাটার সুর-তাল নকল করে প্রয়োজনে নিজে শব্দ গুঁজে দিয়ে বিড়বিড় করেছি একাই। তারপর ফের শঙ্খ ঘোষের কবিতার সঙ্গে দীর্ঘদিন আমার আর কোনও সম্পর্ক ছিল না।
তখন একটু বড় হয়েছি। মনে আছে আমার সেজো কাকা “সুভাষ” আবৃত্তি করতেন, “তারপর যে-তে যে-তে যে-তে/ এক নদীর সঙ্গে দেখা।” আমার মন মজল তাতে। বেশ কিছুদিন এবার “সুভাষ” নিয়ে কাটল। এরপর একদিন আবারও এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় শুনলাম, “আকাশপারে আবার ও চোখ গিয়েছে আটকে/ শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।” কবি, শঙ্খ ঘোষ, কবিতার নাম “মিথ্যে কথা”। এই কবিতাটাও আমার মননে গভীর ছাপ ফেলে গিয়েছিল। মনে আছে, সে সময় বহুবার আমিও আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘে রবীন্দ্রনাথের আদল খুঁজেছি।
ব্যস এইটুকুই। এরপরেও কবিতা নিয়ে আমার কোনও উৎসাহ ছিল না, কবি নিয়ে তো নয়ই। এর মধ্যেই একদিন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর লেখায় পড়লাম, উনি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় এতটাই মুগ্ধ যে, উনি নিজে তাঁর কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত কবি শঙ্খ ঘোষের অনুমতি পাননি বলে “সে কাজটা” আর করে ওঠা হয়নি বুদ্ধদেব গুহর। ততদিনে জেনে গেছি শঙ্খ ঘোষ বিখ্যাত কবি এবং ওঁর কবিতা মানেই ভিড় থেকে আলাদা।
২০০৫ সালের ডিসেম্বরের এক শীত সন্ধ্যায় সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রেক্ষিতে আমি নিজে হঠাৎ কবিতা লেখায় বা কবিতা লেখার চেষ্টায় নাম লিখিয়ে ফেলি। এই পর্যায়ে – সত্যি কথা বলতে কী – সুনীল পড়েছি, শক্তি পড়েছি, সুভাষ পড়েছি, জীবনানন্দ পড়েছি চুটিয়ে – কিন্তু শঙ্খ ঘোষ পড়িনি। কেন পড়িনি? ভয়ে। হ্যাঁ, স্রেফ শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়ে পড়িনি। চারদিকে ওঁর কবিতা নিয়ে বিভিন্ন শ্রদ্ধাপূর্ণ আলোচনায় মনে হত শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়া এবং বোঝার জন্য একটু অন্য ধরনের “কবিতা-শিক্ষিত” হতে হয়। ফলে দূরে থাকতাম।
এরপর একদিন অরকুট এল। জয়দেব বসুকে পেলাম ওখানে শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায়। কবি শঙ্খ ঘোষের উদ্দেশ্যে জয়দেব বসুর সেই অসাধারণ উচ্চারণ “স্বয়ং খোদা” আমি প্রথম অরকুটেই পাই। বুঝতেই পারছেন তখন কবিতা জগতে সামান্য কয়েক দিনের যাত্রী আমি কী আকাট পাঠক ছিলাম। তবে এটাও বুঝতে পারছিলাম যে, কবি শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা পড়ে “ভয়” কাটছে আস্তে আস্তে। এর মধ্যে আমার এক জন্মদিনে আমার মেয়ে উপহার হিসেবে দিল “শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা”। মানে, সলতে পাকানোর পর্বটা চলছিলই – এবার আগুনের মুখোমুখি।
ভয়ে ভয়ে “শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা”র দু-চারটে কবিতা পড়ে এসে থমকে দাঁড়ালাম “যমুনাবতী” কবিতায়। “নিভন্ত এই চুল্লিতে মা/ একটু আগুন দে/ আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি/ বাঁচার আনন্দে।” স্বরবৃত্তে দিব্যি লাগছিল পড়তে। ভয়ও কেটে যাচ্ছিল। কয়েক লাইন পরেই দেখি, “হায় তোকে ভাত দিই কী করে যে ভাত দিই হায়/ হায় তোকে ভাত দেব কী দিয়ে যে ভাত দেব হায়।” ঘেঁটে গেলাম। মনে হল, আরে এই লাইনগুলো তো স্বরবৃত্তে লেখা নয়। মনে হচ্ছে অক্ষরবৃত্ত। দারুণ লাগছিল পড়তে। ভাবলাম, কবিতার কিছু বুঝি না আমি তাই ঘেঁটে গেছি। এগোলাম। এবারে “কান্না কন্যার মায়ের ধমনীতে আকুল ঢেউ তোলে, জ্বলে না/ মায়ের কান্নায় মেয়ের রক্তের উষ্ণ হাহাকার মরে না”। ফের পড়লাম। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মাত্রাবৃত্তে ৭+৭+৭+৩ চলন। উফ্ তখন জাস্ট গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এই কবিতার একদম শেষে এসে পাই “যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে/ যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে নিয়ে।” ফিরে এলাম স্বরবৃত্তে। কবিতাটা এরপর অন্তত আরও দশবার পড়লাম, বা বলা ভালো কবি পড়িয়ে নিলেন। সেদিন আর কোনও কবিতা না পড়ে স্রেফ “যমুনাবতী”কেই বুকপকেটে, মানে হৃদয়ের খুব কাছাকাছি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পরদিন আবারও খুলে বসলাম “শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা”। সেদিন কয়েকটা কবিতা পার হয়ে এসে দাঁড়ালাম “মুনিয়া”তে এসে। ছোট্ট কবিতা। “মুনিয়া সমস্ত দিন বাঁধা ছিল/ খুব বারোটায় উঠে চুপি চুপি খাঁচা খুলে/ ‘উড়ে যা’ ‘উড়ে যা’ বলে প্ররোচনা দিতে / আমার বুকের দিকে তুলে দিল ঠ্যাঙ -/ জ্যোৎস্নায় মনে হল বাঘিনীর থাবা।” কবিতার অর্থ বোঝার জন্য ছাত্রবন্ধুর খোঁজ না করে যেটা আমাকে ভাবালো সেটা হল “বারোটার” আগে “খুব” শব্দের প্রয়োগ। “সাধারণ জনেরা” নিশ্চিন্তে এখানে লিখতে পারতেন “রাত বারোটায়”। এবং তাতে এই লাইনটার ব্যাপ্তি কমে যেত বলেই বিশ্বাস করলাম। এই “খুব” শব্দের প্রয়োগ পরবর্তীকালে এই অধমকে অনেকবার উদ্ধার করেছে কবিতায় ছন্দ ধরে রাখতে।
এবার “রাঙামামিমার গৃহত্যাগ”। মনে হল, আহা, কবিতার নামেই জড়িয়ে আছে আটপৌরে যামিনী টান! চার লাইনের কবিতা। “ঘর, বাড়ি, আঙিনা/ সমস্ত সন্তর্পণে ছেড়ে দিয়ে মামিমা/ ভেজা পায়ে চলে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে--/ ছড়ানো পালক, কেউ জানে না।” কবিতার মধ্যে হঠাৎ করে ঢুকে আসা “মামিমা” জাতীয় একেবারে ঘরোয়া শব্দ আমাকে খুব টানে। ফলে “রাঙামামিমা”ও টেনেছিল খুব করে। ইদানিং প্রায় রোজই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এই “ছড়ানো পালক”এর খবর পড়ে এই কবিতার শেষ লাইনটা আজ যেন একটু বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
শঙ্খ ঘোষের কবিতা আলোচনা করতে গেলে যে বিদ্যা, বুদ্ধি এবং যোগ্যতা লাগে, “হয়ত” নয় – “নিশ্চিতভাবেই” আমি তার ধারে-কাছেও নেই। তাই বিস্তারে না গিয়ে শুধু ব্যক্তিগত ভালোলাগার ব্যাপারটাতেই আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছি। উদাহরণ দিতে গেলে যত টাইপ করতে হবে তাতে আমার হাতের আঙুলগুলো চেঁচিয়ে উঠতে পারে। তাই সামান্য আরও কিছু লিখেই এই লেখা শেষ করতে চাই। দেখা যাক…।
পড়ুন –
“ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল সবাই ‘এইরকমই হবে,
আকাল, মশাই, আকাল।”
গোরুর পিঠে দাঁড়িয়ে যুবা বলে ‘এবার আমিই
এই শহরের রাখাল।” (এই শহরের রাখাল)
“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত –
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।” (বাবরের প্রার্থনা। বিখ্যাত কবিতা। মাত্রাবৃত্তে ৭+৭+৭+৫ চলনে লেখা)
“পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
নৌকোর গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ
জলজ গুল্মের ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর
আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে।” (পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ। আমার খুব প্রিয় কবিতা। পাঠক, অক্ষরবৃত্তে লেখা এই কবিতায় “ৎ”র ব্যবহারটা লক্ষ করুন।)
“একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।” (মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)
“লাইনেই ছিলাম বাবা, লহমার জন্য ছিটকে গিয়ে
খুঁজেই পাই না আর নিজেকে – কী মুশকিলে পড়েছি।” (লাইন)
উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। তবু একটা কবিতার প্রথম দু’ লাইন একটু আমার মতো করে আলোচনা করার চেষ্টা করি। কবিতার নাম “মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়”। এই কবিতার প্রথম দু’ লাইন –
“ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?
চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?”
এই কবিতার দ্বিতীয় লাইনে এসে মনে হতে পারে প্রথম লাইনের প্রশ্নের সঙ্গে তাল রেখে কবি নিজেকেই প্রশ্ন করছেন, তবে কি “চতুরতা”ই মূল কারণ। কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। বরং কবি “চতুরতা” শব্দটির পরে কমা দিয়ে “চতুরতা”কেই প্রশ্ন করেছেন, কী হে “ক্লান্ত লাগে খুব?” আমার ব্যাখ্যা খুব বোকা বোকা মনে হলে কবি শঙ্খ ঘোষের “কাছাকাছি” থাকা কবি, পাঠকদের কাছে অনুরোধ রইল, প্লীজ কবিকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন যে, আমার ব্যাখ্যা সঠিক কিনা।
মনে হতেই পারে, শ্রদ্ধায়, ভয়ে, ভক্তিতে যাঁর কবিতা থেকে একটু দূরে থাকার চেষ্টা করেছি, সেই শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে হঠাৎ এই আলোচনা কেন! আসলে দিন কয়েক আগের একটা ঘটনা আমাকে প্ররোচিত করেছে এই লেখাটা লিখতে। একদা জয় গোস্বামী কবি শঙ্খ ঘোষের “ইঁট” কবিতার আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন তাঁর দোতলার পথে সিঁড়ি থেকে এক ভদ্রলোককে দেখা যেত একতলায়। একদিন সে ভদ্রলোক মারা যান। এবং সেদিনই “ইঁট” পত্রিকার দ্বিতীয় লাইনের একটি অংশ, “ছিল, নেই-মাত্র এই” তাঁর কাছে বাস্তব হয়ে ধরা দেয়। আমি এই মুহূর্তে ৬১+। বাজার যাবার পথে প্রায় রোজই আমার পাড়ার এক বয়স্ক ভদ্রলোককে (বয়েস অন্তত ৮০) দেখতাম দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর বাড়ির গেট আগলে। দেখা হলেই উনি হাসতেন, একদা সান্ধ্য ভ্রমণের সঙ্গী আমার বাবার (এখন ৯০) শরীর-স্বাস্থ্যর খোঁজে নিতেন। মাঝে একদিন শুনলাম, উনি আর নেই। ইদানিং ওঁর বাড়ি, ওঁর বাড়ির গেট পেরোনোর সময় খেয়াল করি, কেউ ছিলেন ওখানে, এখন কেউ নেই ওখানে। আমার মনে পড়ে “লেখো আয়ু, লেখো আয়ু”র সৃষ্টিকর্তা কবি শঙ্খ ঘোষের এই অমোঘ লাইন “ছিল, নেই-মাত্র এই”।
এরপর শ্রদ্ধেয় কবিকে নিয়ে কিছু তো লিখতেই হয়…।