নর্থ-ইস্টের রাজ্যগুলি সম্বন্ধে নানান গল্প শোনা যায়। সেইসব গল্পের মধ্যে থাকত নানা অনিশ্চয়তা ও নানান বিপদের কথা, যার বেশিরভাগই জনশ্রুতি ছিল। সব অনিশ্চয়তাকে সঙ্গে নিয়েই নাগাল্যান্ডের হর্নবিল উৎসবে যাওয়ার পরিকল্পনা করে বেশ দুরুদুরু বুকে ২০১৩ সালের ২৯শে নভেম্বর আমরা পাঁচজন কামরূপ এক্সপ্রেসে উঠে পড়েছিলাম। তারপর ৩০শে নভেম্বর গুয়াহাটি নেমে স্টেশনের গেস্টরুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। গুয়াহাটির স্টেশনমাস্টার অর্কর পরিচিত, ফলে আপ্যায়ন ভালোই হল পরের ট্রেন রাতের বেলা। ঠিক ১১-৩৫-এ আমাদের ট্রেন নাগাল্যান্ড এক্সপ্রেস ছেড়ে দিল, আর ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলল ডিমাপুরের দিকে। বেশ ঝরঝরে একটা ঘুম দিয়ে ভোর ৫-১৫ নাগাদ ডিমাপুর নামলাম। স্টেশনের বাইরে এক কাপ চা খেয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাই। ওখানে দেখি সার সার হলুদ রঙের মারুতি অল্টো ট্যাক্সি। আমাদের দেখে কয়েকজন ড্রাইভার এগিয়ে এল, তার মধ্যে একজনকে ঠিক করে আমরা যাত্রা শুরু করলাম কোহিমার দিকে। ডিমাপুর থেকে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা ৭৪ কিমি পথ, যেতে সময় লাগে ২:৩০ ঘন্টা। আমাদের গাড়ি ছুটে চলে পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। পাশে সরে সরে যায় বাঁশের জঙ্গল, কলাগাছ, নানান গুল্ম আর শাল-সেগুনের সারি। রাস্তার দুপাশে আগাছা ভরে রয়েছে জংলি ফুলে। কুয়াশামাখা সবুজ বনানীর মধ্যে দিয়ে পৌঁছলাম ‘চুমুকেডিমা’। ওখানে আমাদের ইনার পারমিট চেকিং হল নানান প্রশ্নের সম্মুখীনও হলাম। ভালোভাবে সেসব পাট চুকিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল। এতক্ষণ রাস্তাঘাট সব থমথম করছিল তবে যত সূর্যের তেজ বাড়ল ততই যেন স্বাভাবিক হতে লাগল প্রকৃতি এবং মানুষজন। বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর ‘লালমাটি’ নামে একটা জায়গায় গাড়ি থামল। চা-পানের বিরতি। ওখানে একটা দোকানে দেখি গরম সিঙ্গাড়া ভাজছে। গোটা দুয়েক করে সিঙ্গাড়া আর চা খেয়ে আমরা আবার এগিয়ে চলি। পাহাড়ের প্রতিটা বাঁকে বাঁকে মিলিটারি রক্ষীরা বন্দুক উঁচিয়ে অতন্দ্র পাহারায় রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে একটু ভয়ও পেলাম, কেন এত পাহারা!
যেতে যেতে দেখলাম রাস্তার দু-ধারে গ্রামবাসীরা বাঁশ দিয়ে দোকান তৈরি করে তাতে আনারস বিক্রি করছে। অত্যন্ত সস্তা সেই আনারস — আমাদের কলকাতায় পাওয়া আনারসের এক চতুর্থাংশ দাম। এরকম নানা কিছু দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাই কোহিমার দিকে। প্রায় ৯-টার সময় পৌঁছলাম কোহিমার জিপ স্ট্যান্ডে। রাস্তাঘাটে খুব পুলিশ আর মিলিটারি টহল দিচ্ছে, নানান জায়গায় নো-এন্ট্রি বোর্ড লাগানো। দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে ভারতের রাষ্ট্রপতি এসেছেন হর্নবিল উৎসবের শুভ সূচনা করতে, তাই এত কড়াকড়ি। এবার কলকাতা থেকেই আমরা হোটেল বুকিং করে এসেছি। জিপ থেকে নেমে সেই ‘ব্লু-বাইন্ড’ হোটেলে ফোন করে জেনে নিলাম কীভাবে যেতে হবে। হোটেলটি কোহিমার অন্যতম দ্রষ্টব্য ওয়ার মেমোরিয়াল বা ওয়ার সেমেটারির ঠিক উল্টো ফুটে। তাই হোটেল পৌঁছতে কোনো অসুবিধা হল না। অত্যন্ত পরিপাটি, নিখুঁত ব্যবস্থার হোটেল। ইউনিফর্ম পরা পরিচারিকা আমাদের ঘর দেখিয়ে দিল। দরজা খুলে দেখি বিশাল আয়তনের একটা ঘর, তাতে লাগোয়া ব্যালকনি। ঘরের মধ্যে দুটো বড় বড় নরম গদি দেওয়া খাট, দুটো বড় আলমারি, একটা হোয়াটনট আর বেশ বড় ছ-জন বসার ডাইনিং টেবিল। ঘরের আসবাব, বিছানাপত্র নিখুঁত ভাবে সাজানো, মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। সময় নষ্ট না করে আমরা পাঁচজন একে-একে স্নান সেরে নিলাম। দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি লিছুটা লাঘব হল। তারপর প্রাতরাশ টেবিলে চলে আসি। ওদের হোটেলে প্রাতরাশ কমপ্লিমেন্টারি। প্রাতরাশ সেরে চটপট বেরিয়ে পড়লাম হর্নবিল উৎসবে যাবার জন্য। ট্যক্সি করে চলে গেলাম কোহিমা শহর থেকে ১২ কিমি দূরে কিসামা হেরিটেজ ভিলেজ — প্রত্যেক বছর সেখানেই অনুষ্ঠিত হয় হর্নবিল উৎসব।
নাগাল্যান্ডে ১৬টি আদিম জনজাতি আছে। যেমন — আঙ্গামি, আও, চাখেসাং, চাং, কাচারি, খিয়ামনিউগান, কনিয়াক, কুকি, লোথা, ফোম, পচুরি, রেংমা, সাংটাম, সুমি, ঈমচুঙ্গের এবং জেমে-লিয়াংমাই (জেলিয়াং)। বহুদিন ধরেই এদের নিজস্ব উৎসব পালিত হয় বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। কিন্তু ২০০০ সালে নাগাল্যান্ড সরকার ঠিক করে যে একই ছাতার তলায় এই ১৬টি জাতি একত্রিত হবে এবং সেখানে তারা নাচ, গান, খেলা বা ওদের নিজস্ব কোনো প্রতিযোগিতা প্রদর্শন করবে। উদ্যোগটি বেশ প্রশংসনীয়। এবং এই অভিনব উদ্যোগের কারণে পর্যটকরা বা নাগাল্যান্ডবাসী একই ছাতার তলায় ওই ষোলোটি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ দেখতে পাবে। সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে প্রত্যেক বছর পয়লা ডিসেম্বর থেকে ১০ (দশ) তারিখ পর্যন্ত এই উৎসব পালন চলে কিসামা হেরিটেজ ভিলেজে।
২০১৩-এর ডিসেম্বরেও একইভাবে এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হল নাগাল্যান্ডের রাজ্য হিসাবে স্থান পাওয়ার ৫০-বছর পূর্তি — তাই একেবারে সাজো সাজো রবে উৎসবে পালিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এসেছেন স্বর্ণজয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধন করতে। বিভিন্ন জাতির অনুষ্ঠান শুরু হল খোলা আকাশের নিচে, একটা গোল মাঠে। ওই গোল মাঠ ঘিরে রয়েছে প্রচুর চেয়ার — ঠিক যেমন স্টেডিয়ামে থাকে। আমরা টিকিট কেটে প্রধান তোরণদ্বার দিয়ে একেবারে উৎসবের মূল স্রোতে ঢুকে পড়লাম। বিভিন্ন জনজাতির পোশাক দেখবার মতো — তার কত রং আর কত বাহার। ঘোরের মধ্যে চলতে থাকি। প্রথমেই চলে গেলাম স্টেডিয়ামের দিকে। স্টেডিয়ামে পৌঁছে তার বাঁ দিকে উঠে চললাম। পাহাড়ের ঢালে ঢালে তৈরি হয়েছে ষোলোটি জাতির ‘মোরুং’ বা ওদের নিজস্ব কায়দায় তৈরি ঘর। প্রত্যেকটি ঘরের সামনে বেশ খানিকটা জায়গা। কেউ কেউ খাবারের নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে, কেউ আবার কাফেটেরিয়া খুলেছে, কেউ বা পুরোদমে খাবারের হোটেল। বেশিরভাগ দোকানপাট খোলা আকাশের নিচে কিন্তু খুবই বিন্যস্ত। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে একটা আদিমতার ছাপ। আমরা কোনটা ছেড়ে কোনটায় যাব বুঝতে পারি না। এই অংশের নাম দিয়েছে ‘উইন্ডো টু নাগাল্যান্ড’ (window to Nagaland)।
উইন্ডো টু নাগাল্যান্ডের পাশেই বিশাল আকারে তৈরি হয়েছে 'ব্যাম্বু প্যাভিলিয়ন'। পুরো সাজসজ্জাই বাঁশের। সেখানে প্রচুর দোকান, তাতে রকমারি জিনিস বিক্রি হচ্ছে। গয়নাগাঁটি থেকে শুরু করে কত বিচিত্র রকমের জিনিস। গয়নার মধ্যে গলার হারগুলো অবাক হয়ে দেখবার মতো — তাদের যেমন রং তেমনি তাদের রূপ। কোনোটা পাথরের তৈরি, কোনোটা বা হাড়ের তৈরি। মোটা এক গোছা হারই নাগা মহিলারা সাধারণত পরে থাকে, সরু হারের চল প্রায় নেই বললেই চলে। সেগুলোর প্রচুর দাম, কোনোটা দশ হাজারী কোনোটা আবার তার থেকেও বেশি। ঘুরে দেখতে থাকি দোকানপাট। এ যেন লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে। নাগা মহিলারা সেইসব দোকানপাট সামলাচ্ছে। অত্যন্ত হাসিখুশি ও খোলামেলা মনেই তারা পর্যটকদের জিনিসপত্র দেখাচ্ছে। সবাই শিক্ষিত মহিলা। চোস্ত ইংরাজিতে কথা বলছে। বিভিন্ন জাতির এক বা একাধিক স্টল, তাতে নানান জিনিস। ছোট ছোট কিছু জিনিস সংগ্রহে রাখব বলে কিনে ফেললাম। সেদিনের মতো খাপছাড়া ঘোরাঘুরি শেষ করে শেয়ার ট্যাক্সি ধরে আমরা কোহিমা শহরের দিকে ফিরে গেলাম। হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে ৬-৩০ বেজে গেল। শীতকালে সন্ধ্যে নেমেছে অনেক আগেই। আর ৬.৩০টায় তো ঘন রাত। কোহিমা শহরের পুরো চিত্রটাই তখন পাল্টে গেছে। সকালে যে শহরটা প্রাণোচ্ছ্বল ছিল, কর্মব্যস্ত ছিল, সেই শহরটা সন্ধ্যের পর একেবারে আলাদা। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে, মানুষজন যে ক’জন রাস্তায় রয়েছে তাদের চাহনিগুলোই পাল্টে গেছে। ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে।
হর্নবিল উৎসবের আরেকটা আকর্ষণ হল পশ্চিমী গানের উৎসব ও প্রতিযোগিতা। ‘রক’ ফেস্টিভাল। কিন্তু সেই উৎসব ‘কিসামো’তে হয় না। সেই জায়গাটি কোহিমার অন্য প্রান্তে। প্রতিযোগিতা শুরু হয় সন্ধ্যে ছটার পর। সারাদিন পর ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম ফলে ‘রক’ ফেস্টিভালে যাওয়া হল না। হোটেলে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে সুগন্ধি চা খেতে খেতে আড্ডা জমে উঠল। বাইরে বেশ ঠান্ডা। হোটেলের ঘরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতে চমক লেগে গেল। আলোয় ঝলমল করছে পুরো কোহিমা শহর। সে এক অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য — সারা শহরটা সেজে উঠেছে রঙিন আলোয়। চার্চগুলো খুব সুন্দর সেজে উঠেছে বড়দিন উপলক্ষ্যে। আমরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি আলোকজ্জ্বল কোহিমা শহর আর তার আলোর রোশনাই। আমরা ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকি সেই আলোর উৎসবে।
রুমে বেল বাজছে, আমাদের সম্বিৎ ফেরে। রুম সার্ভিস জানিয়ে গেল রাতে খাবারের সময় ৭টা থেকে ৯টা। উৎসবের দিনগুলোতে হোটেলে জনপ্রতি ৫০০/- টাকার ‘বুফে’ ডিনার খেতেই হবে বাধ্যতামূলক ভাবে। আমরা রেডি হয়ে চলে যাই ডাইনিং হলে। নানারকমের পদ সাজানো আছে, যা খুশি এবং যতখুশি খাওয়া যাবে, যেমন হয় আমাদের কোলকাতার কোনো কোনো হোটেলের বুফে মেনুতে। গল্পে গল্পে খাওয়াদাওয়া সাঙ্গ হল। ঘরে ফিরেও সেই গল্পের রেশ চলল বেশ কিছুক্ষণ।
২রা ডিসেম্বরের সকাল হল ভারি সুন্দর। কুয়াশার পাশ কাটিয়ে সূর্য উঠতে লাগল কোহিমা শহরকে জাগাতে। চাদর মুড়ি দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। মেঘমুক্ত আকাশ, পুবের কালো পাহাড়ের রেখার পিছন দিকটা, রাঙা হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে প্রকাশিত হলেন সূর্যদেব। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর ছটা। আর সেই সঙ্গে অন্ধকার ও অনিশ্চয়তার জগৎ নিমেষে মিলিয়ে যেতে লাগল। কলকাকলিতে ভরে উঠল কোহিমা শহর, জাদুকর বরফির সেই ওষুধের গুণে যেমন কথা ফুটেছিল শুন্ডি রাজ্যের মানুষদের, ঠিক তেমনি শুরু হল এক নতুন সকাল, চলমান হল সব কিছু। পাখিরা উড়ে গেল নিজেদের কাজে, পাহাড়ের ঢালের বাড়িগুলো থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করল, আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে লাগল পুরো শহর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নরম রোদ মেখে কোহিমার চলমানতাকে অনুভব করতে থাকলাম।
সকালের চা এল সুদৃশ্য টি-পটে। বেশ মজা করে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চা খেলাম। এদিকে আরাম করার বেশি সময় নেই, সারাদিনের জন্য বেরিয়ে যাব তাই তাড়াতাড়ি স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। তারপর প্রাতরাশ টেবিলে, মন ভরে খাবার খেয়ে ট্যাক্সি ধরে চলে গেলাম কিসামা হেরিটেজ ভিলেজে। ৪০০-টাকা ভাড়া নিল কিসামা পৌঁছতে। হর্নবিল উৎসবের মূল তোরণের সামনেই টিকিট কাউন্টার। প্রবেশমূল্য ১০টাকা দিয়ে গা ভাসিয়ে দিলাম মূল স্রোতে। নানান রঙবেরঙের ঢেউ কেটে কেটে আমরা এগিয়ে চললাম। প্রথমদিন ঘুরে দেখেছি, কোথায় কি রয়েছে তাই দ্বিতীয়দিনের ঘোরাঘুরি অনেক গুছিয়ে করতে পারলাম। স্টেডিয়ামের গা বেয়ে সিঁড়ি উঠেছে। বেশ কিছুটা উঠে ‘কনিয়াক’ জাতির ডেরায় গিয়ে হাজির হলাম। ওখানে ওদের নিজস্ব নাচগান চলছিল, বলা ভালো একটা গীতিনাট্য চলচিল। ‘কনিয়াক’ জাতি আসলে বন্দুকবাজ জাতি, তাই ওদের শিকার করা, শত্রু নিধন এসবের গল্পকাহিনী নাচে গানে প্রকাশ পাচ্ছিল। ওই জাতির তরুণ রাজা ও রানি উপস্থিত ছিল। ছবি তুলতে কোনো দ্বিধা নেই। এদিকে ওদের গীতিনাট্য শেষ হয়েছে। আমরা ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাজার এক অমাত্য আমাকে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো। আতিথেয়তা তো রক্ষা করতেই হয়। সুদেব আর অর্ককে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে বসলাম ওদের ‘মোরুং’-এ। বাঁশের তৈরি বেঞ্চিতে বসতেই বাঁশের তৈরি গ্লাসে চা এল। দুধ ও চিনি ছাড়া ঈষৎ তিত্কুটে কালো চা। মৃদু ঠান্ডা আবহাওয়ায় ওই চায়ে চুমুক দিতেই দারুণ আমেজ এল। ওদের সঙ্গে গল্প জমে উঠল। সামনে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে শুয়োরের মাংস বা হ্যাম — একেবারে আদিম প্রথায় বার-বি-কিউ। সেখান থেকে ছোট ছোট মাংস কেটে তাতে নুন দিয়ে একটা বড় বাঁশের কাঠিতে গেঁথে আমাদের স্বাদ নিতে বলল। মাংসটি খুবই সুস্বাদু ছিল। ওদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটালাম, তারপর সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লাম অন্যত্র যাব বলে।
‘কনিয়াক’-দের ‘মোরুং’ থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম মিউজিয়ামের কাছে। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। কোহিমার ইতিহাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোহিমার মানুষদের লড়াই, ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাপানি আক্রমণকে প্রতিহত করার ঘটনা সুন্দর করে লেখা আছে সেখানে। সঙ্গে ছিল প্রচুর ছবি। অনেকটা সময় লেগে গেল দেখতে। সুভাষচন্দ্র বসুর দুটো ছবি লাগানো থাকলেও একটু যেন উপেক্ষিত লাগল নেতাজীকে। নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কীর্তির কথা কোথাও লেখা নেই দেখে আশ্চর্য এবং দুঃখিত হলাম। ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে কোহিমার ইতিহাসও যেন অন্য সুরে বাঁধা আর তাই জন্য আমাদের অতি প্রিয়, পরম শ্রদ্ধেয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও অনাদরে থেকে গেছেন। মিউজিয়ামের চত্বরে ভাস্কর্য ও আঁকা ছবির একটা প্রদর্শনী চলছিল। ঢুকে পড়ি ভিতরে — দারুণ দারুণ সব কাজ করা আছে, কিছু কিছু ছবিও তুলে রাখলাম। প্রদর্শনীর শেষ দিকে ট্যাটু করা চলছে, দু-একজন বিদেশী ট্যাটু করাবে বলে দাঁড়িয়েও আছে। এসব দেখে প্রদর্শনী থেকে বেরিয়ে থমকে গেলাম — দেখি এক তরুণ শিল্পী পাথরে খোদাই করছিল এক বৃদ্ধ নাগার মুখ। পা সরে না তার কাজ দেখে। ছেনি হাতুড়ির শব্দের বিন্ বড্ড ভালো লাগছে। ধীরে ধীরে নাগা বৃদ্ধ যেন জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে।
এরপর আবার স্টেডিয়ামের দিকে গেলাম। ওখানে এবার কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এক একটা জনগোষ্ঠী এবং তাদের নাচ-গানের দল সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিল। ওদের পোশাকের রঙ ও ধরন ছিল ভিন্ন ভিন্ন তেমনি তাদের নাচের ছন্দ, গানের সুর ছিল আলাদা আলাদা। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বিকেল গড়াল। ওখানে বেশ ঠান্ডা পড়ে আর খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে যায়। ফোন করে ডেকে নিলাম আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। ওর নাম ধোনী বোরো — অসমের ছেলে — খুব শান্ত এবং ক্বচিৎ কথা বলে। বয়স ২০/২১ হবে, কোহিমাতেই থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির ধোনী। হর্নবিল উৎসবের গেটে এক কাপ কফি খেয়ে উঠে পড়লাম ট্যাক্সিতে। সারাদিনের ঘোরা আজ সার্থক হয়েছে। হোটেলে ঢুকলাম তখন ৬-৩০ বাজে। সেদিনের মতো আমাদের উড়ান শেষ হল। হাত-মুখ ধোয়া আর সারাদিনের নানা কথা-ঘটনা নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করা সব একসঙ্গেই চলতে থাকে। তারপর খাবারের সময় এসে যায়। ৮টা নাগাদ চলে গেলাম ডাইনিং হলে। হর্নবিল উৎসবের সময় অর্থাৎ পয়লা ডিসেম্বর থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত হোটেলের মেনুতে কি কি থাকবে তা একটা বাঁধানো বইয়ে ছাপানো আছে, আমাদের রুমেও ওইরকম একটা মেনুর বই ছিল। কৌতূহলবশত চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম। টেবিলে রকমারি খাবার সাজানো, সদা হাস্যময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দেখাশুনা করছে। খাওয়া-দাওয়া ঠিক করে হচ্ছে কিনা তদারকিতে ব্যস্ত। এইসব কর্মরত ছেলেমেয়েরা সবাই কলেজে পড়াশুনা করে কেউ ফার্স্ট ইয়ার কেউবা সেকেন্ড ইয়ার। উৎসব উপলক্ষে ওরা এই দশদিন ভালো ভালো হোটেলে কাজ করে উপার্জন করে। খাওয়া-দাওয়া জমিয়ে হল। তারপর ঘরে ঢুকে জোরদার আড্ডা বসে। পরদিনের পরিকল্পনাও সেরে নিলাম।
তৃতীয়দিন সকাল হল। ঝলমলে রোদ উঠেছে। সেদিনও আমরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম হর্নবিল উৎসবে যাব বলে। শেষবারের মতো হর্নবিল উৎসবের রং, গন্ধ আর টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে সময় কাটানো যাবে। সেদিনই আমরা ফিরে যাব ডিমাপুর। কিন্তু সকালবেলাতেই খবর পাওয়া গেল ডিমাপুরে বারো ঘন্টার বন্ধ ডাকা হয়েছে। আমরা একটু মুশকিলে পড়লাম কারণ সন্ধ্যা ৬টার পর বন্ধ উঠবে। খবরাখবর নিলাম, তারপর আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার ধোনীকে নিয়ে কিসামার দিকে যাত্রা করলাম। গাড়ি সারাদিনই আমাদের সঙ্গে থাকবে। সেদিন উৎসবের তৃতীয় দিন — ভিতরে ঢুকে মনে হল আরো জমকালো হয়ে উঠেছে। সোজা স্টেডিয়ামে পৌঁছলাম। আমরা যাবার পর পরই একটা মজার খেলা শুরু হল। তিন তিনটে তৈলাক্ত বাঁশ রাখা আছে। প্রতিযোগীরা ওঠার চেষ্টা করছে। কে কতটা উঠতে পারবে তারই ওপর পুরস্কার। মজার খেলা দেখে ছোটবেলার তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্কের কথা মনে পড়ে গেল। খুব ঝামেলায় পড়তাম অঙ্কগুলো কষতে। ওই প্রতিযোগিতার পর ব্যাম্বু প্যাভিলিয়নে গিয়ে দোকানপাট আরেকবার ভালো করে ঘুরে দেখে নিলাম। এরপর আবার স্টেডিয়ামের দিকে, এবারে শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পছন্দের সিট দেখে বসে পড়ি, আর ওদিকে মাইকে ঘোষণা হতে লাগল একেক দলের নাম। বিভিন্ন জাতির নাচ-গানের দল ঘোষণার পর তাদের অনুষ্ঠান শুরু করল। কেই পরিবেশন করল গীতিনাট্য, কেউবা গানের তালে নাচ, কেউ কেউ আবার নাটক পরিবেশন করল। ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর পোষাকের রং ও ধরন ছিল যেমন ভিন্ন তেমনি তাদের নাচের ছন্দ বা গানের সুর ছিল আলাদা আলাদা। বিশেষ দ্রষ্টব্য ছিল পুরুষ প্রতিযোগীরা, অধিকাংশের মাথার টুপি হর্নবিলের পালক দিয়ে সজ্জিত। মাঝে একবার বিরতি হল। মাঠের একদিকে একটা স্টেজ করা আছে। বিরতির পরই ঘোষণা হল — শুরু হবে লঙ্কা খাওয়ার প্রতিযোগিতা। ব্যাপারটা কী? আমরাও একটু নড়েচড়ে বসলাম।
নাগাল্যান্ডের ওই বিশেষজাতের লঙ্কা পৃথিবীর অন্যতম ঝাল লঙ্কার মধ্যে একটি। এ যে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হতে চলেছে। প্রতিযোগীরা সব দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। আরেকপাশে ডাক্তার-নার্সদের কয়েকজন। সুবেশা ঘোষক নাম ডাকতে একে একে প্রতিযোগীরা বসে পড়ল টেবিলে টেবিলে। শুরু হল চরম উত্তেজনাময় প্রতিযোগিতা। বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগীরা লঙ্কা খাওয়া শুরু করল। প্রথমজন তো তিনটে লঙ্কা খেতে খেতেই চেয়ার ছেড়ে পালালো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় জনের অবস্থা তথৈবচ। বরং চতুর্থজন বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লঙ্কার পর লঙ্কা খেয়ে চলে। শেষমেশ সময়সীমার মধ্যে চতুর্থজন ৬-খানা লঙ্কা খেয়ে পুরস্কার জিতে নিল।
এবারে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম, বেলা বেড়েছে। আমাদের অন্য একটা পরিকল্পনা ছিল। ঘন্টা দুয়েক কিসামাতে কাটিয়ে তারপর ওখান থেকে চলে যাব খোনোমা গ্রামে। তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম কিসামা থেকেই। কিসামার রঙিন হর্নবিল উৎসবকে শেষ বিদায় জানিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম খোনোমার উদ্দেশ্যে। অত্যন্ত প্রাচীন গ্রাম — খোনোমা, কোহিমা থেকে মাত্র ২০কিমি পশ্চিমে এর অবস্থান। উল্লেখযোগ্য হল এই গ্রামটিকে এশীয় মহাদেশে সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম বলে গণ্য করা হয়। চারদিকে সবুজ পাহাড়ের বেষ্টনী, তারই মাঝে ধাপে ধাপে সেজে রয়েছে ছোট্ট গ্রাম খোনোমা। নাগা ন্যাশনালিস্ট আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ এ. জেড. ফিজো-র জন্ম হয়েছিল এখানেই। ওনাকে “ফাদার অফ দ্য নাগা নেশন” বলেও অভিহিত করা হয়। খোনোমার মানুষজন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অনেক লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল। এছাড়াও খোনোমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল ওখানকার “ট্র্যাগোপান স্যাংচুয়ারী”। খোনোমা গ্রাম থেকেই সব ঘোরা যাবে। এছাড়া কেউ ট্রেকিং পথেও যেতে পারে সবুজে সবুজে মোড়া পশ্চিম যুকৌ উপত্যকায়। সেসব ব্যবস্থাও খোনোমা গ্রামে থেকেই করা যায়।
রাস্তা খারাপ থাকায় অনেকটা ঘুরে যেতে হল। আমাদের গাড়ি থামল ছোট্ট একটা চত্বরে। সরু লম্বাটে এক ফালি গ্রাম। সিঁড়ি করা আছে গ্রামের একটা দিকে, আরেকটা রাস্তা চলে গেছে নিচে। গ্রামের ঘর বাড়ি পেরিয়ে পৌঁছে যাই একেবারে উঁচুতে। সেখান থেকে পুরো গ্রামটি দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথা থেকে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি এসে পড়েছে অনতিদূরে একটা শহীদ বেদীর ওপর — মনে হল ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে। ওপর থেকে নিচে নামার সময় ওখানকার এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হল। ওর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ভীষণ মার্জিত ব্যবহার ছেলেটির। সোসিওলজিতে এম. এ. করেছে সে। ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান সম্বন্ধে খুব স্বচ্ছ ধারণা আছে স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু ও খুব বতাশ যে পাশ করেও কোনো চাকরি পায়নি। ছেলেটি একপ্রকার জোর করেই আমাদের আপ্যায়ন করে ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। চা, বিস্কুট, কলা, চালভাজা — এরকম বিবিধ জিনিস সুন্দর চিনেমাটির প্লেটে নিয়ে হাজির হল ওর দিদি। নাগাদের আপ্যায়ন উপেক্ষা করা উচিত নয়, ওরা ভীষণই দুঃখ পায়। আমরাও ওদের দুঃখ দিইনি, চায়ের আগে বা পরে কলা খাওয়ার বিধিনিষেধ যতই থাক আমরা তাও খেয়ে নিয়েছিলাম। এদিকে তো বিকেল প্রায় শেষ। আমাদেরও ফিরে যাবার পালা, ওদের বিদায় জানিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। গাড়ির কাছে এসে একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম — এক শ্রমজীবী মহিলা ও তার সঙ্গে দুটি শিশু, তাদের হাতে ধুলো লেগে রয়েছে। চত্বরের রকটায় বসে মন দিয়ে ইংরেজি দৈনিক ‘নাগাল্যান্ড মিরর’ পড়ছে। একই সঙ্গে অবাক লাগা ও ভালো লাগা নিয়ে আমরা ফিরে চললাম কোহিমায়। হোটেলের ক্লোকরুমে মালপত্র রাখা ছিল। বের করে গাড়িতে তুলে দিলাম, আধঘণ্টার মধ্যেই রওনা দেব ডিমাপুরের দিকে, ধোনী আমাদের নিয়ে যাবে। ততক্ষণে বন্ধ উঠে গেছে তাই আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে এগিয়ে গেলাম। একটার পর একটা ঘটনা মনের মধ্যে ক্যালিডোস্কোপের মতো পাল্টে পাল্টে যায়। হর্নবিল উৎসবের রঙের স্রোত, ‘কনইয়াক’-দের আপ্যায়ন, খোনোমার মানুষদের লড়াই-এর অতিহাস, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাগাল্যান্ডের ‘মারাম’-এ পতাকা তোলার ঘটনা আর সেই শ্রমজীবী মা-কে, যার শিক্ষামন আলোড়িত করেছিল আমাকে, যা আজও কর্মব্যস্ত শহুরে জীবনে আমায় প্রাণিত করে বারংবার।